[বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় স্রষ্টাদের মধ্যে শুধু পুরুষ নয়, নারীও রয়েছেন। তাঁদের তাৎপর্যপূর্ণ অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের সাহিত্য ভুবন। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-সব ধরনের রচনাতেই নারীরা সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের সেইসব স্মরণীয় নারী এবং তাঁদের কীর্তির কথাই এই ধারাবাহিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছে।]
বাংলার সংস্কৃতি বিকাশে স্মরণীয় নারী
অতি প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে দৃশ্যমান, সক্রিয়, সাবলীল, শিক্ষিত, সচল এবং বিশেষত শাস্ত্রীয় সংগীতে ও নৃত্যে পটিয়সী অধিকাংশ নারীই ছিলেন বাইজি, বারাঙ্গনা অথবা মন্দিরের দেবদাসী কি সেবাদাসী। অর্থাৎ তাঁরা অধিকাংশই অন্তঃপুুরের নারী ছিলেন না। বাগানবাড়ি, পতিতালয়, বাইজিবাড়ি, মন্দির কিংবা বাজারে কি বন্দরে ছিল তাঁদের কর্মতৎপরতা। বঙ্গ সংস্কৃতির কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শাস্ত্রীয় সংগীত, নৃত্য এবং অভিনয়ে) এই বাইজি-স্বৈরিণীরা বঙ্গে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। নাম করা সব ধনী রাজা, নবাব, সওদাগর, জমিদাররা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। নিজেদের জৌলুস ও আধিপত্য প্রদর্শনে জমিদার-নবাবরা তাঁদের বাগানবাড়িতে সংগীত-নৃত্যে বিশেষ পারদর্শী খ্যাতনামা বাইজিদের এনে রাখতেন। কিংবা তাঁদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন নিজেদের বেলোয়ারি ঝাড়ে সজ্জিত জলসাঘরের উজ্জ্বল আলোর রাত্রিকালীন উৎসবে। সেখানে অন্যান্য সৌখিন ও উচ্চবিত্তের লোকদের উপস্থিতিতে সারা রাত ধরে চলত গান-বাজনা ও খানাপিনা। গেয়ে, নেচে বাইজিরাও পেতেন প্রচুর অর্থ।
শিল্পকলায় বিবিধ গুণের মধ্যে, অভিনয়ে, নৃত্যে, বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শিতায়, চিত্র অঙ্কন এবং চিত্রশিল্প তারিফ করার ক্ষমতায়, গানের কথা তৈরি এবং সুর দেওয়ার দক্ষতায়, সুচারুরূপে গৃহসজ্জায়, নান্দনিক প্রসাধন-চর্চায় ও কেশ-বিন্যাসে, মনোহর রান্নার দক্ষতা, সূক্ষ্ম ধাঁধা তৈরি এবং ধাঁধা সমাধানের ক্ষমতায়, লেখাপড়ার সক্ষমতায়, মুখে মুখে তাৎক্ষণিকভাবে দু’লাইনের পদ্য বানিয়ে জবাব দেওয়ার, কবিতা ও গল্প তৈরি করা এবং লিখতে পারার দক্ষতায়, বিভিন্ন রত্ন চেনার ক্ষমতায়, তাস, পাশা ও জুয়া খেলার পারদর্শিতায়, জড়তাহীনভাবে সাবলীল কথাবার্তা বলা ও নিজের মত প্রকাশের ক্ষমতায়, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জ্ঞান, যোগ্যতা ও নৈপুণ্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই একজন গণিকা চৌষট্টি কলার বিশারদ হয়ে তাঁর পেশায় যোগ দিতে পারতেন। অন্তত প্রাচীন ভারতে এই স্তরে পৌঁছানো রীতিমতো দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ একটি সাধনা ছিল। আর এভাবেই রাষ্ট্রের বাঈজি-বারবণিতারা তাঁদের পেশাটিকে একটি শিল্পে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এইসব গুণাবলি এবং শিল্পকলার সঙ্গে এই নারীদের আবার ব্যবসা ধরে রাখার স্বার্থে কিছু বিশেষ পদ্ধতি রপ্ত করতে হতো। যেমন, দাঁড়াবার বিশেষ মোহন ভঙ্গি, দৃষ্টিপাতের কটাক্ষ আয়ত্বে আনা, কথার আবেশে বশ করার দক্ষতা অর্জন, কামকলা পারদর্শী হয়ে ওঠা ইত্যাদি। আসলে বহুমুখী শিল্পচর্চার সঙ্গে সঙ্গে কামের ষোলো আচারও তাঁদের শিখতে হতো। অর্থাৎ কোন নারী যখন অনন্য বা অসাধারণ কোনো গুণে ভাস্মর হয়ে উঠতেন, পিতামাতা থেকে সমাজপতিরা মনে করতেন সাধারণ ঘরসংসার করা বা একজনের মনোরঞ্জনে জীবন কাটানো সেই নারীর জন্যে চূড়ান্ত এক অপচয়। তার বিশেষ গুণাবলি আরও অনেকের মধ্যে সমাদৃত হবে, সমাজে অনেক বেশি মানুষের মনোরঞ্জন করতে তারা সক্ষম হবে, এটাই ছিল প্রত্যাশা। অথবা কোনো এক দেবতা ও তার পূজারির কাছে সমর্পিত হওয়ার ভাগ্য নিয়েই এই বিশেষ কলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছেন বলে সেইসব নারীদের পিতামাতা নিজেরা সঙ্গে করে কন্যাকে নিয়ে এসে দেবালয়ে এনে রেখে যেতেন, যেখানে নেচে, গেয়ে এবং অতিথিদের সেবা করেই জীবন কাটত তাদের।
প্রাচীন ভারতের গণিকারা পরিচিত হতেন বিভিন্ন নামে এবং তাঁদের মধ্যে শ্রেণিভাগ ছিল। সাধারণত ৬ ভাগে বিভক্ত ছিলেন তারা : ১) রাজবেশ্যা ( রাজার অনুগৃহিতা গণিকারা), ২) নাগরীবেশ্যা (নগরবাসিনী গণিকা), ৩) গুপ্তবেশ্যা (সদ্বংশীয় নারী যে গোপনে অভিসার করে), ৪) দেববেশ্যা (মন্দিরের দেবদাসী), ৫) ব্রহ্ম বেশ্যা বা তীর্থতা (যারা তীর্থস্থানে থাকেন) ও ৬ ) সাধারণ গণিকা।
তখনকার দিনেও, আজকের মতোই, পতিতাবৃত্তির প্রধান ও মৌলিক কারণ ছিল অর্থনৈতিক। এটি নারীর জীবিকা নির্বাহের একটি উপায় বলে সমাজ মেনে নিত। ফলে পতিতাবৃত্তি নিন্দনীয় বা ঘৃণ্য কোনো পেশা বলে বিবেচিত হতো না তখন। জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উপায় এবং বিনোদনমূলক পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হতো সমাজে।
বিক্রমাদিত্য-কৌটিল্যের (চাণক্য বলেও পরিচিত) কালে গণিকারা রীতিমতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। গণিকা, গণিকালয় ও সেখানকার ক্রিয়াকর্মের জন্যে বিভিন্ন নিয়মাবলি পরিচ্ছন্নভাবে লিপিবদ্ধ ছিল সেবাদানকারী ও গ্রহিতা উভয়ের জন্যেই। কৌটিল্যের শাস্ত্র অনুযায়ী ‘গণিকার রূপ নষ্ট হয়ে গেলে তাকে ধাত্রীর পদে নিযুক্ত করতে হবে। গণিকা ও দাসী যখন ভোগের অযোগ্য হবে তখন তারা কাজ করবে রান্নাঘরে।’ তার মানে কৌটিল্য গণিকাদের পেশা থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাঁদের পুনর্বাসনের দায়িত্বও রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা তখনকার দিনে রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে নারীকে গণিকায় পরিণত করতে পারত। আম্রপালিকে তো অপরিসীম সুন্দর হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় আদেশের বলে বারবণিতা হতে হয়েছিল। যুক্তিটা ছিল এই রকম— আম্রপালি এত বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয় যে সে কেবল একজন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারেন না, হওয়া উচিত নয়। সেটি হবে দারুণ অপচয়। শুধু তাই নয়, তাঁর মতো দেহবল্লভীর অধিকারী এক মেয়ে রাষ্ট্রের কোনো এক বিশেষ পুরুষের স্ত্রী হলে অন্য পুরুষদের মধ্যে তাঁর জন্যে রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে যাবে। ফলে আম্রপালিকে রাষ্ট্র নিযুক্ত করে নগরবধূ হিসেবে। এখানে আম্রপালির নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-মতামতের কোনো মূল্য নেই। রাষ্ট্রের আদেশে বারবণিতা হয়ে আম্রপালি বহু ক্ষমতাধর পুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলনে মিলিত হয়েছেন—এমনকি দেশের শত্রু ভিনদেশের রাজাও আম্রপালির প্রেমে উন্মত্ত হয়ে তাঁর ঘরে আসতে ও থাকতে শুরু করেন।
অতীতে ভারতের রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যে ‘বাঈ’ শব্দ বলতে বোঝানো হতো ধ্রুপদী নৃত্য ও গীতে পারদর্শী সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীদের! খুব ছোটবেলাতেই এই মেয়েরা ওস্তাদদের কাছে তালিম নিয়ে নৃত্য ও গীত শিখতে শুরু করতেন। শিক্ষা শেষে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলে লোকে তাদের সম্বোধন কালে ‘বাই’ শব্দটির সঙ্গে সম্মানসূচক ‘জি’ শব্দটি জুড়ে দিত। তখন থেকে ‘বাইজি’ শব্দটি বর্তমানে লব্ধ বড় কোনো ডিগ্রির মতো তাদের নামের শেষে শোভা পেত। বাইজিরা সম্রাট, সুলতান, বাদশা, রাজা, নবাব, জমিদার ও সম্ভ্রান্ত-সম্পদশালী সমাজ-নেতাদের বাগানবাড়ি, জলসাঘর কিংবা রঙমহলে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীত পরিবেশন করে অনেক পরিমাণে অর্থ ও খ্যাতি লাভ করতেন। অর্থ আয়ের জন্য তারা বাইরে গিয়ে ‘মুজরো’ আসরে গান গাইতেন ও নাচতেন। আবার তাঁদের নিজেদের ঘরেও ‘মাহফিল’ বসাতেন।
উত্তর ভারত বিশেষ করে লখ্নৌ, বানারস, পাটনা থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় এবং কিছু পরিমাণে ঢাকায় আগমন ঘটতে থাকে বাইজিদের। শোনা যায়, অযোধ্যা থেকে বিতাড়িত হয়ে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তখন কলকাতায় এসে নির্বাসিত জীবন যাপন করছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই সেখানে সংগীতসভা গড়ে ওঠে। আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক বাইজির আগমন ঘটে। বেশির ভাগ বাইজিই রাগসংগীতে ও শাস্ত্রীয় নৃত্যে উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পী তখন। কথিত আছে প্রথমে বাইজির কণ্ঠে গান শোনার ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও, একবার স্বামী বিবেকানন্দ এক বাইজির গান শুনে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন।
ঢাকায় বাইজিদের নাচ-গান শুরু হয় মোগল আমলে। সপ্তদশ শতাব্দীতে সূচনা হলেও উনিশ শতকে ঢাকার নবাবদের আমলে বাইজিদের নাচ-গান এবং মেহফিলের জোয়ার আসে। তারা আহসান মঞ্জিলের রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন। ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব বাইজি খ্যাতি লাভ করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন লখ্নৌর প্রখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠন খানের নাতি সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান। সুপনজান উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকায় ছিলেন।
সেকালে ঢাকার গানের আসরে ছিল বহু সমঝদার শ্রোতার আগমন। শোনা যায়, ঢাকায় গান করতে আসার আগে ইন্দুবালা কলকাতায় কালীঘাটে যেয়ে মন্দিরে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘মা ঢাকা যাচ্ছি, ঢাকা তালের দেশ, মান রাখিস মা’। তাল যেন কাটা না যায় এটাই ছিল ইন্দুবালার প্রার্থনা।
কণ্ঠসংগীতের ওস্তাদ হুসেনমিয়া ঢাকার অনেক বাইজিকে তালিম দিয়েছিলেন। পূর্ববাংলার বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে ঢাকার বাইজিদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। বহিরাগত অনেক বাইজি ঢাকায় দীর্ঘদিন থেকে গেছেন। কেউ কেউ স্থায়ীভাবে, কেউ কেউ আবার ঘুরে ফিরে ঢাকায় আসতেন। এসব অস্থায়ী বাইজির পাশাপাশি স্থানীয় মেয়েরাও বাইজির পেশা বেছে নিত। সংগীতের পুরোনো কেন্দ্র হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় ছিলেন কয়েকজন অতি গুণী বাইজি।
বাইরে থেকে ঢাকায় আসা বিখ্যাত বাইজিদের মধ্যে গওহরজান, জদ্দন বাঈ ও মুশতারী বাঈ-এর ঢাকায় মেহফিলে অংশগ্রহণ করা ও শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্যনীয়। গানের সুমধুর কণ্ঠ, বিশেষ গায়কি ভঙ্গি এবং গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ের একেবারে প্রথম দিকের শিল্পী হিসেবে প্রচুর রেকর্ড করে গওহরজান বাংলা সংগীত ভুবনে এক কিংবদন্তি। তাঁকে গ্রামোফোন রেকর্ডের সম্রাজ্ঞীও বলা হয়ে থাকে।
মোস্তারী বাঈ তাঁর অপূর্ব মধুর কণ্ঠস্বর ও সুরের জাদুতে বশ করতেন শ্রোতাদের। ১৮৭০ সালে ঢাকার নবাব আব্দুল গনির আমন্ত্রণে শাহবাগের বাগানবাড়িতে এসে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সেকালের বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক আবদুল গাফফার নাসকানকে। কলকাতায় তাঁর গান শুনে আত্মহারা হয়েছিলেন রাঁইচাদ বড়াল, কৃষ্ণচন্দ্র, কবি নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা। কলকাতার একটি আসরে মোস্তারী বাঈ পূরবী রাগে খেয়াল গেয়ে সুরের ঝংকার ও মদিরাতে শ্রোতাদের এমন আচ্ছন্ন করেছিলেন যে ওই আসরে পরবর্তী শিল্পী বিখ্যাত ফৈয়াজ খাঁ, এনায়েত খাঁ ও হাফেয খাঁ মঞ্চে উঠতেই অস্বীকৃতি জানালেন।
লালচাঁদ বড়ালের গুরু বিশ্বনাথ রাওয়ের ছাত্রী ছিলেন গণিকা-কন্যা মানদা। ল্যান্স ডাউন রোডে নাটোর হাউসে বিখ্যাত ফৈয়াজ খাঁর সঙ্গে একসঙ্গে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন ১৯২৭ সালে, যা এর আগে কল্পনাই করা যেত না। জনসম্মুখে পুরুষ-নারীর একত্রে শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনা, যতদূর জানা যায় সেটাই প্রথম। মানদার ৫০টির মতো বেকর্ড আছে তার মধ্যে ৩টি রবীন্দ্রসংগীত। উপমহাদেশে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারী শিল্পীদের চলা এই সময় থেকেই মূলত শুরু।
বিখ্যাত বাইজি গওহরজান ছিলেন বেনারসের চুলবুলিয়া বা বড় মালকাজানের কন্যা। মালকাজানের মা রুকমনী ছিলেন ভারতীয়, পিতা ইংলিশ। অসামান্য রূপসী মালকাজানের আগের নাম ছিল লেডি এডেলাইন। আর্মেনিয়ান ইহুদি। স্বামী রবার্ট ইউয়ার্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর এডেলাইন বাইজি বৃত্তি গ্রহণ করেন। তখনই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম রাখেন মালকাজান এবং কন্যা এঞ্জেলিনার নাম রাখেন গওহরজান। মালকাজানের সৎবোন ছিলেন জদ্দন বাঈ। জদ্দনও তাঁর মায়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন আর জীবিকার কারণে বাঈ হিসেবে তৈরি হন। জদ্দন বাঈ বেশ কয়েক বার বিয়ে করেন। তিনি ঢাকার বিভিন্ন মেহফিল মাতিয়ে রাখতেন। ঢাকার নবাবেরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন জদ্দন বাই।
গওহরজান ছিলেন ভীষণ শৌখিন আর ফ্যাশন সচেতন। নিজেকে সব সময়ই সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতেন। গওহরজানের কাছ থেকেই এদেশের অন্য শিল্পীরা ফ্যাশন সচেতনতার শিক্ষা গ্রহণ করেন। গান গাওয়া ছাড়াও গওহরজান নিজে নিজে কিছু গানও রচনা করেছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের গুরু ওস্তাদ জমিরউদ্দিন গওহরজানের শিষ্য ছিলেন।
এছাড়া পাটনা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন আবেদী বাই। ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন তিনি, যেমন করেছিলেন আরও অনেক গুণী বাইজি। আবেদির তিন কন্যা— আন্নু, গান্নু ও নওয়াবীন। এই তিন বোন নওয়াব আবদুল গনির দরবারে নিয়মিত নাচতেন, গাইতেন এবং মাসোহারা নিতেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুনাম করেছিলেন নওয়াবীন। তিনি ১৯৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং ছিলেন ঢাকায়। মুনতাসীর মামুনের কথানুসারে, এই তিনবোনই ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ ভাড়া করে ১৮৮০ সালের নভেম্বরে টিকিটের বিনিময়ে ‘ইন্দ্রসভা’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। ঢাকায় নারীদের নিয়ে এটিই ছিল প্রথম নাট্যাভিনয়।
এলাহাবাদ থেকে ঢাকায় এসেছিলেন জানকি বাই। তিনি এক-একটি মুজরোতে তখনকার দিনের দেড় হাজার টাকা করে নিতেন। তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সম্মানি পেতেন। জানকি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী এবং এক নবাবের অতি প্রিয় রক্ষিতা। কেউ যেন জানকিকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্যে জানকিকে একটু কুৎসিত করার জন্যে নবাব ৫৬ বার ছুড়ি দিয়ে আঘাত করেছিলেন। এজন্যে জানকি ৫৬ ছুড়ি বলেও পরিচিত।
আমিরজান বাইজি ছিলেন উনিশ শতকের ঢাকার বিখ্যাত গায়িকা ও নর্তকী। জিন্দাবাহারের রাজলক্ষ্মীও ছিলেন ঢাকার আরেক বিখ্যাত বাইজি। জিন্দাবাহারে তাঁর পাঁচ-ছয়টি বাড়ি ছিল। সংগীতশিল্পীর চাইতেও দান-ধ্যানের জন্য তিনি ছিলেন বেশি পরিচিত ও সম্মানিত। ১৮৮৬ সালে ভূমিকম্পের পর জিন্দাবাহারের কালীবাড়ি ভেঙে গেলে তা মেরামত করে দেন তিনি। রমনার কালীবাড়ির শ্রী বর্ধনেও তিনি প্রচুর চাঁদা দিয়েছিলেন।
মুনতাসীর মামুন আমিরজান ও রাজলক্ষ্মীর দান-দাক্ষিণ্যের মানসিকতার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ১৮৭৪ সালে নওয়াব আবদুল গনি ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থাপনার জন্য এক বৈঠকের আয়োজন করেন। সেই বৈঠকে রাজা-মহারাজা জমিদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই দুজন বাইজিও উপস্থিত ছিলেন। নবাব পানি সরবরাহ প্রকল্পে সবাইকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে আহ্বান জানালে সাড়া দিয়েছিলেন মাত্র দুজন। আমিরজান ও রাজলক্ষ্মী বাইজি তাঁরা প্রত্যেকে ৫০০ টাকা করে দান করতে রাজি হয়েছিলেন। নবাব অবশ্য কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য না নিয়ে পরে নিজেই এক লাখ টাকা দান করেছিলেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.