হাসিম আলী গ্রীন কার্ড পেয়ে গেল।
গত ছয়টা মাস, প্রতিদিন চিঠির বাক্স খুলে প্রতিবারেই হতাশ হয়েছে। কত কত চিঠি, ব্যাংকের স্টেটমেন্ট, বৈদ্যুতিক বিল, বাড়ি-গাড়ি কেনার জন্য শর্তহীন ঋণের প্রলোভন সবই আসে নিয়মমাফিক। কিন্তু গ্রীন কার্ড তো আসে না। ইমিগ্রেশন উকিল ছয় মাস আগেই বলেছে, ‘যে-কোনো সময় পেয়ে যেতে পারো।’
আজকের আনন্দের সময়টায় পুরোনো হতাশাকে টেনে এনে কাজ নেই। শুধু আনন্দ করো, কত যে আনন্দ হাসিম আলীর, গ্রীন কার্ড পেয়ে! হাসিম আলী গ্রীন কার্ড পেয়ে গেছে!
এক
হাসিম আলী একা থাকে, পূর্ব হিউস্টনের নর্থ ফরেস্ট অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে এক রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে। গ্রীন কার্ড পাওয়ার পর সে কী কী করবে, তা একদম খোদাই করে লিখে রেখেছে তার নোটবইতে। গত কয় বছরে তার জীবনে অনেক ওলটপালট হয়েছে। নোটবইতে অনেক কাঁটাছেঁড়া হয়েছে গত বছরগুলোতে, এখন যেটা লেখা তা একদম ফাইনাল।
কিন্তু গ্রীন কার্ডটা হাতে পাওয়ার পর সে কীভাবে উদ্যাপন করবে, তা কখনো ভেবে দেখে নি। কীভাবে এত বড় আনন্দটা উপভোগ করবে, তা তো নোটবইতে লেখা নেই! তাই বলে উদ্যাপন থেমে নেই। এর মধ্যেই তার মনে এখনকার আনন্দের ডুগডুগির সাথে সানাই বাজাচ্ছে ভবিষ্যতের আনন্দের শিহরণগুলো। সবই লেখা আছে ছোট্ট নোটবইটায়।
এখন কী করবে ? বন্ধুদের ডাকবে কোনো রেস্টুরেন্টে ? না, সেটা আগামীকাল করা যাবে। আজকের উপভোগ শুধু নিজেকে নিয়ে। এক মগ কফি বানিয়ে নিজের ঘরের টেবিলটার সামনে বসল হাসিম আলী। নোটবইটা খুলে দেখল, খোদাই করা লেখাগুলো, কী যে আনন্দ—ভবিষ্যতে এইসব সবই হবে, হাসিম আলীর জীবনে।
চোখ পড়ল, টেবিলে বসে থাকা খালি ফটো ফ্রেমটার দিকে। একসময় এখানে একটা ছবি ছিল। বুশরার ছবি। কত স্বপ্ন ছিল বুশরার, আমেরিকায় আসবে, মুক্তি মিলবে জুলিয়া ভাবির জেলখানা থেকে। কত স্বপ্ন ছিল হাসিমের, গ্রীন কার্ডটা হলে বুশরাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। কিন্তু গ্রীন কার্ড তো আসে না। তিন বছর আগে অ্যাপ্লাই করেছে, শুধু কাগজ চাচ্ছে—নিজের কাগজ, যে কোম্পানিতে সে কাজ করে তাদের কাগজ। হাসিম কাগজ দিচ্ছে, তবুও গ্রীন কার্ড তো আসে না। ইমিগ্রেশন উকিল বলেছে অ্যাপ্লাই করার পর দেশের বাইরে না যেতে, অনেক রিস্ক আছে। হাসিম দম ধরে বসে আছে।
দুই
বুশরার চেয়েও জুলিয়া ভাবির তাগাদা বেশি।
হাসিম তখন গ্রীন কার্ডের জন্য একের পর এক কাগজ জমা দিচ্ছে। এরই মধ্যে জুলিয়া ভাবি একদিন ফোন করলেন, কথা বলে হাসিমকে দুই মাস সময় দিলেন—দেশে এসে বুশরাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে হবে।
বুশরা একদিন ফোনে জানাল, জুলিয়া ভাবি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, হাসিম আমেরিকাতে গ্রীন কার্ডের জন্য বিয়েশাদি করে ফেলেছে, এখন বুশরার জীবনটা আরও অসহ্য করছেন। হাসিম বুশরাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি বিশ্বাস করলে ?’
‘অবশ্যই না, তবে তুমি দেশে আসবে না, যে যাই-ই বলুক না কেন! কোনো কিছুতেই দেশে আসবে না।’
একদিন বুশরার ভাইয়ের ফোন এল।
‘হাসিম, তুমি যে বুশরার সাথে এত বড় বিট্রে করবে, আমি চিন্তাই করতে পারি নি। আমার বোনটার জন্য আমি যা পারি নি, ভাবছিলাম ওর জন্য তুমি তা করবে, ওকে জুলিয়ার থেকে মুক্ত করবে। তুমিও ওকে বিট্রে করলে ?’ এই বলে রফিক ভাই গুমড়িয়ে কেঁদে ফেললেন।
হাসিম শুধু বলল, ‘ভাইয়া!’
লাইনটা কেটে গেল। কয়দিন পর বন্ধু খালেদ ফোনে জানাল, বুশরার বিয়ে হয়ে গেছে। হাসিম যেন জানত এমনই হবে, বুশরা তো কোনোদিন বিদ্রোহ করতে শিখে নি। ছোটকাল থেকেই মুখ বুজে সয়ে গেছে তাকে নিয়ে অন্যদের উপেক্ষা—কখনো জুলিয়া ভাবির নিপীড়ন, আবার কখনো হাসিমের গ্রীন কার্ডের অনড় প্রয়োজন।
খালি ফটো ফ্রেমটার দিকে আবার চোখ পড়ল হাসিমের। বুশরার ছবিটা সে নামিয়ে ফেলেছে, কিন্তু ফ্রেমটা সরিয়ে রাখা হয় নি। রেখে দিয়েছে, হয়তো ইচ্ছা করেই। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ফ্রেমে এখনো বুশরা আছে, হয়তো লুকিয়ে আছে কোনো এক কোণে। কিংবা আছে মনের তালা মারা কোনো আঙিনায়! নোটবইতে যাই লেখা থাকুক না কেন, তালাটা খুলে বুশরা মাঝে মাঝে বের হয়ে আসে। বুশরা বলে, ‘হাসিম, তোমার গ্রীন কার্ডটা এসেছে ?’
হাসিম কি কোনোদিন বুশরাকে ভুলতে পারবে ?
হাসিম তৎক্ষণাৎ নিজেকে বুশরার চিন্তা থেকে গুটিয়ে নেয়—না, ইমোশনাল হলে চলবে না। নোটবইয়ের প্ল্যান মেনে চলতে হবে।
বুশরা তো কোনোদিন এই ঘরে আসবে না, এই ফ্রেমে ছবি উঠবে কোনো এক ডাক্তারের, নোটবইতে লেখা আছে—হয়তো মেডিসিনের নতুবা ইএনটির কিংবা সার্জারির—কে সে ? কিছু যায় আসে না, এই ফ্রেমে বুশরার ছবি তো আর কোনোদিন উঠবে না। আমেরিকার জীবনের পরের স্তরটা হাসিম পাড়ি দিবে একজন ডাক্তার মেয়েকে বিয়ে করে, সবই লেখা আছে নোটবইটাতে।
বাংলাদেশে যাওয়ার বুকিংটা এখনই দিয়ে দিতে হবে। মামাতো বোন দিলারা আপাকে ফোন করতে হবে। ফোন করবে দুই-চারজন বন্ধুকেও। খালেদের সাথে বুশরার যোগাযোগ আছে। খালেদই বুশরার বিয়ের খবর তাকে জানিয়েছিল। বুশরা কি তার সাথে দেখা করবে ? বেদনায় বুকটা কুঁকড়ে উঠল, খালি ফটো ফ্রেমটা আরও ঝাপসা লাগছে!
তিন
ঢাকা পৌঁছেই হাসিম একদিন মিরপুর ডিওএইচএস-এ মামার বাড়ি থাকল। মামাতো বোন দিলারা আপার সাথে কথা হলো—
‘তোর জন্য তিনটা মেয়ে ঠিক করে রেখেছি, তিনটাই ডাক্তার, পারলে কালকেই তোর হাত ধরে উড়াল দিয়ে আমেরিকা চলে যাবে, এতই ডেডিকেটেড! সবাই ভালো ঘরের মেয়ে।’
দিলারা একটা ফাইল বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘এই ফোল্ডারে ওদের সব বিবরণ দেওয়া আছে। তুই দেখাসাক্ষাৎ করে বিশ দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবি, বাকি আট দিন চলবে বিয়ের আয়োজন। তোর তো ভালো টাকাকড়ি আছে, তাই বলে ঘটা করে কিছু করা যাবে না, মেয়েপক্ষও পারবে না। ঢাকার হলগুলো কমপক্ষে ছয়মাস আগে বুকিং হয়ে যায়, কোনো বাসা বাড়িতে সব অনুষ্ঠান করতে হবে।’
‘ওকে দিলারা’দি, তুমি যাই বলো সেভাবে হবে। মামা তো বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। তুমিই এখন গার্জিয়ান মামা।’
‘ফাজিল ছেলে কোথাকার!’
মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাসিম বিকেলে গুলশানে গেল, খালেদের বাসায়। দুই বন্ধুর গল্পগুজব হলো। খালেদ বলল, তার আসার খবর ও বুশরাকে জানিয়েছে ফোনে। বুশরা কিছু বলে নি। ফোন রেখে দেওয়ার আগে খালেদ শুধু একটা দীর্ঘস্বাস শুনেছে।
খালেদ আরও বলল, বুশরার স্বামী হাসান পারভেজ খুব ভালো গান করেন, কম্পোজার হিসেবে ইদানীং বেশ নাম করেছেন এই অল্প বয়সে। আর ওরা উত্তরাতে থাকে।
পরের দিন সকালে হাসিম চান্দিনায় নিজেদের বাড়িতে রওনা দিল। ওখানে মা তার বড় বোনকে নিয়ে থাকেন। বড় বোন চান্দিনা মহিলা স্কুলের শিক্ষক। কত বছর মাকে দেখে নি হাসিম। মা এখন টেলিফোনেও কথাবার্তা ভালো করে বুঝেন না।
চান্দিনাতে বোনের সামনেই হাসিম দিলারার দেওয়া ফোল্ডারটা খুলল। ওয়াও! হাশিম যা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশি মনে হলো ফোল্ডারটাতে। প্রথম জন নোশিন শারমিলি—ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পাশ করে সার্জারিতে ট্রেনিং নিচ্ছে পিজিতে। দ্বিতীয়জন মিটফোর্ড মেডিক্যালের, এখন এফসিপিএসে ভর্তি হয়েছে। আরেকজন সবে মেডিক্যালের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে মিটফোর্ড থেকে। একসময় হাসিমের খুব সন্দেহ ছিল—ডাক্তার মেয়ে পাওয়া যাবে কিনা তার নন-মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে। দিলারা আপা বলেন, অনেক মেয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমেরিকা যেতে, ওখানে নাকি ডাক্তারদের অনেক টাকা বেতন!
বড় বোনের পছন্দ প্রথম জনকে, ঢাকা মেডিক্যালের আবার সার্জারিতে ইন্টার্নি করছে। একটা ছবিও আছে বায়োডাটার সাথে, ছবিটাও বড় বোনের খুব পছন্দ। পরিবারের পরিচিতি ও যোগাযোগের ঠিকানা বায়োডাটাতে নেই, সেটা দিলারা'পা রেখে দিয়েছেন।
মায়ের শুধু একটাই প্রশ্ন, কবে হাসু বিয়ে করবে ? তার ধারণা, হাসু বিয়ে করে বৌকে তার কাছে চান্দিনাতে রেখে যাবে। হাসুর বউ কোথায় থাকবে আর কোথায় ঘুমাবে তার একটা জায়গাও তিনি ঠিক করে রেখেছেন।
তিন
দুই দিন মায়ের সাথে কাটিয়ে, হাসিম ভাড়া করা গাড়িতে ঢাকায় রওনা হলো। অনেক কাজ সামনে, পথে আসা-যাওয়ায় অনেক সময় কেটে যায়। ফিরে আসার আগে বড় বোনকে বলে রাখল, সব ঠিক হলে, মাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে।
যাওয়ায় পথেই হাসিম একটা ভালো রেস্টুরেন্ট দেখে গাড়ি থামাল, ভাবল একটু চা খেয়ে নেবে। চায়ের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছে, এমন সময় একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল।
‘হাসিম , আমি বুশরা। তোমার মনে আছে নিশ্চয় খালেদ আমাকে ফোনে বলেছে তোমার দেশে আসার কথা। ভাবলাম একটু হ্যালো বলব।’
‘বা-- ব্বু--শ-রা’!
‘আমার স্বামী হাসান পারভেজ তোমার সাথে একটু কথা বলতে চায়।’
‘ভাই, আমি হাসান। ভাবলাম আমেরিকান সাহেবের সাথে একটু কথা বলব।’
‘হাসান ভাই। আপনি যে আমার সাথে কথা বলছেন, খুব ভালো লাগছে। আমি শুনেছি আপনি কত কৃতী লোক. সংগীতজ্ঞ!’
'ভাই, জানি না কার কাছে কী শুনেছেন, ওগুলো পাবলিসিটি। আপনি তো জানেন বুশরা কম কথা বলে, আপনজনদের সাথে আরও কম। ওই আমাকে বলতে বলেছে, আপনি এই রোববার, পরশু চলে আসুন আমাদের বাসায়। আমি ঠিকানা পাঠিয়ে দেব, আমরা দুপুরে একসাথে খাব, আর গল্প করব। আমেরিকার গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।’
হাসিম কখনো ভাবতেই পারে নি যে বুশরার স্বামীর সাথে তাকে কোনোদিন কথা বলতে হবে, সাক্ষাৎ তো দূরের কথা! সে শুধু বলল, ‘হাসান ভাই, আমি অবশ্যই আসব, আপনি যখন বলেছেন। আপনি ঠিকানাটা পাঠিয়ে দেবেন হোয়াটসঅ্যাপে।’
হাসিমের কেমন যেন অস্বস্তি লাগল। বুশরার সাথে দেখা হবে, আর বুশরার স্বামী তাকে নিজ থেকে ডেকেছেন! কেমন এলোমেলো লাগল। চা-টা খেয়ে হাসিমের একটু ভালো লাগল, আবার ঢাকার পথে রওয়ানা দিল।
ঢাকায় এসে হাশিমের সবকিছু ওলটপালট ঠেকছে। দিলারা’পা তাড়া দিলেন, ‘ফাইলগুলো দেখেছিস ? কোন ডাক্তারনির সাথে কোথায় কখন দেখা করতে চাস প্রথমে ?’
হাসিম কিছু একটা ভাবল, মনের আগের সেই উৎসাহ যেন খুঁজে পেল না।
দিলারাকে বলল, ‘আপা, এই দুইটা দিন পুরানো বন্ধুদের সাথে কাটাতে চাই। তারপর তোমাকে জানাব।’
দিলারা আপা কী বুঝলেন কে জানে! শুধু বললেন , ‘দেখ হাসিম, দেখিস আবার পুরোনো বন্ধুদের ঘোরে পড়িস না যেন। তাহলে তোর সব স্ক্যাজুয়েল ভণ্ডুল হয়ে যাবে!’
পাঁচ
হাসিমের এখন শুধু চিন্তা, রবিবার বুশরার সাথে দেখা হবে, ওর স্বামীর সাথে কথা হবে। আচ্ছা বুশরা কি হাসানকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে ? আর হাসান গানের মানুষ, তিনি কি একটা পারিবারিকভাবে ঠিক করা বিয়েতে মত দিয়েছেলেন ? একবার মনে হলো এইসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কোনো অর্থ হয় নি, কী হবে এইসব জেনে ?
যে প্রশ্নটা হাসিম কোনোরকমে এড়াতে পারল না, তা হলো—বুশরা কীভাবে একজন গায়ককে স্বামী হিসেবে বেছে নিল ? বুশরাকে সে যতটুকু জানে গান-বাজনার থেকে অনেক দূরে থাকার মেয়ে সে। সারা জীবন ভাই-ভাবির সংসারে থেকে শুধু প্রতিকূল পরিস্থিতি তাকে সামলাতে হয়েছে। সুর ও ছন্দ তার জীবনে কখনো ছিল না।
যাহোক এগুলো নিয়ে এখন ভাবার অধিকার হাসিমের নেই। আর এখন বুশরা নিশ্চয় অনেক ভালো আছে, এর বেশি ভাবনা তার মাথায় আসাটা বুশরা ও হাসানের প্রতি অন্যায় করা হবে।
এখন আশু যে চিন্তাটা তাকে করতে হবে, রবিবার ওদের বাসায় কী উপহার নিয়ে যাবে ? একগোছা ফুল ? না—বুশরার জন্য মনের ফুলগুলো মনেই থাকুক, কে চায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে! দু বাক্স মিষ্টি নিলে কেমন হয় ? না সেটাও তেমন রুচিশীল মনে হলো না। অনেক ভেবে, সে ঠিক করল, হাসানের জন্য সে একটা গিটার নিয়ে যাবে। সেদিন ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে তার খুব ভালো লেগেছে। নিশ্চয় খুব ভালো মনের মানুষ! আবার ভাবল, সে তো গিটারের কিছুই চিনে না। কী গিটার কিনবে ? তাতে কী, একটা ভালো গিটার হলেই হলো। মিরপুর রোডে একাউস্টিয়াতে নিশ্চয় ভালো গিটার পাওয়া যাবে।
গিটারের দোকানে গিয়ে তাকে অনেক প্রশ্ন শুনতে হলো। ওগুলোর উত্তর না দিয়ে, সে শুধু জানাল, কী কী গিটার ওদের আছে যা একজন প্রফেশনাল গায়ক পছন্দ করতে পারেন ? দোকানদারটা বেশ সাহায্য করল, তাকে বেশ কয়টা গিটার দেখাল। যাহোক সে বেশি সময় নষ্ট না করে, রুচিসম্মত দামে একটা গিটার কিনে ফেলল।
ছয়
গিটারটা কাঁধে নিয়ে হাসিম উত্তরাতে গেল, হাসান-বুশরার বাসাটা খুঁজে বের করল এবং বাসার কলিং বেল টিপে ধরল।
দরজা খুলে দিলেন হাসান, পাশে দাঁড়ানো বুশরা। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ, অস্বস্তিটা আরও বাড়বার আগেই হাসান উচ্ছ্বল হেসে হাসিমের হাত দুটি ধরলেন এবং বললেন, ‘খুব ইচ্ছা ছিল আপনার সাথে দেখা করার, আপনি যে কষ্ট করে এসেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।’
বুশরা শুধু বলল, ‘অনেকদিন পর দেখা হলো।’
হাসিমের মনে হলো, বুশরা কি বলতে পারত—‘এতদিন কোথায় ছিলে.. ?’
হাসিম গিটারটা হাসানের হাতে দিল। হাসান ধন্যবাদ দিল, তারপর গিটারটা খুলে দেখে বলল, ‘আমাকে এত লোকে এত গিফ্ট দেয়, কোনোদিন কেউ একটা বাদ্যযন্ত্র দেয় নি। আপনিও কি গান করেন ?’
‘জি না।’
হাসান সম্ভবত বুশরার চেয়েও বয়েসে একটু বেশিই হবে, তবে বেমানান নয়। তার চলমান হাসি এবং গায়কী সরলতায় কি জানি একটা উচ্ছ্বল ব্যক্তিত্ব তার চেহারায় ফুটে উঠেছে। হাসান হাসিমকে পাশে বসালেন।
প্রথমে হাসিমের কাছে মনে হলো যে হাসান বুশরা ও তার পূর্ব সম্পর্ক সম্বন্ধে কিছু জানেন না।
হাসিমের ধারণা যে ভুল তা বুঝতে খুব সময় লাগল না।
হাসান বললেন, ‘দেখুন হাসিম, আমি মনের মধ্যে কথা লুকিয়ে রাখা পছন্দ করি না। বুশরা আপনার সম্বন্ধে সব বলেছে আমাকে, আমিও বিয়ের আগে আমার যে জঞ্জালপূর্ণ জীবন ছিল তাও জানান দিয়েছি বুশরাকে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো লুকোচুরি নেই। আমি জানি আপনার মনেও অনেক প্রশ্ন। বুশরা কি জুলিয়া ভাবির কথা বিশ্বাস করেছিল, যখন তাকে বলা হয়েছিল আপনি গ্রীন কার্ডের জন্য আমেরিকাতে বিয়ে করে ফেলেছেন ? বুশরা আমাকে কীভাবে বিয়ে করেছে, সে কথাটাও আপনাকে বলা উচিত।’
‘হাসান ভাই থাকুক না এইসব কথা। জেনেও বা কি হবে ? তা ছাড়া আপনি বলেছিলেন, আপনি আমেরিকার গল্প শুনতে চান, তাই আমি এসেছি।’
‘হ্যাঁ অবশ্যই আমেরিকার গল্প শুনব। তার আগে নিজেদের গল্পগুলো খোলাসা করে নিতে হবে।’
হাসিম ভাবে লোকটা কি জাদু জানেন, হাসান কীভাবে বুঝলেন তার মনে এই প্রশ্নগুলো অনেকদিন ধরে হাবুডাবু খাচ্ছে ?
হাসান কথা বলতেই থাকলেন—‘আসলে আমি তখন ছিলাম পাড়ার একটা সেমি বাউণ্ডেলে ছেলে, কাজের মধ্যে শুধু জানতাম—রাস্তায় পাড়ার সুন্দরী মেয়েদের দেখলে ঘরে এসে গান বাঁধতে। আর কিছু কিছু আয় ছিল একজন সংগীত পরিচালকের সাথে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে। বুশরাকে আমি চিনতাম না। পাড়ার অন্য মেয়েদের মতো সেও ছিল আমার গান বাঁধার অনুপ্রেরণা। একদিন বুশরার ভাবি পাড়ার আরেক ভাবির মারফত আমাকে প্রস্তাব পাঠালেন বুশরাকে বিয়ে করার জন্য। ভাবি আপনার সম্বদ্ধে যেসব কথা বলেছে, বুশরা তা কখনো বিশ্বাস করে নি। কিন্তু আপনিতো ওকে চেনেন, বিদ্রোহ করতে ও জানত না। ছোটকাল থেকে ভাবির কারাগারে থেকে সে হয়ে পড়েছিল পোষা বন্দি।’
হাসিম বলল, ‘আমি জানতাম বুশরা এইসব বিশ্বাস করে নি। ওর সীমাবদ্ধতাও আমি জানতাম। কিন্তু বাকি কথাগুলো আমি জানতাম না। আমার অপারগতার জন্য আমি বুশরার কাছে ক্ষমা চাই।’
হাসিমের চোখ বুশরার দিকে গেল। বুশরা তাদের দুজনের কথাবার্থা শুনছে বলে মনে হলো না। জানালার পাশের চেয়ারটাতে বসে সে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন খুঁজছে—দিনের আলোতে মানুষ যেভাবে রাতের তারাদের খোঁজে। হাসান সাহেব আরও বললেন, ‘ননদ আমেরিকাতে গিয়ে ভালো লাইফ পাবে, এ নিয়ে বুশরার ভাবির কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি যত তাড়াতাড়ি পারেন ননদকে বিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বিদায় দেওয়ার ফন্দি করলেন, হোকনা পাত্র নালায়েক এক গায়ক। বুশরার ভাই খুবই সরল মানুষ, বোনকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। তিনিও বিশ্বাস করেছিলেন হাসিম বোনকে বিট্রে করেছে। বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে আমি লুফে নিলাম। ভাবলাম আর নয় বাউন্ডেলে জীবন, এবার ঘর বাধবো। কী ভাগ্য! মিলে গেছে নাম না জানা একজন—যাকে আমি প্রতিদিনই দেখি। এইভাবে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।’
‘হাসান ভাই, জুলিয়া ভাবি বুশরাকে ঠকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঠকাতে পারেন নি। আপনি শুধু বুশরাকেই মুক্ত করেন নি, আমাকেও আমার মনের অসংখ্য জটিলতা থেকে মুক্ত করলেন আজ।’
‘সে আমি জানি না, বিয়ের পর একজন গায়কের সাথে মানিয়ে নিতে বুশরার খুব কষ্ট হয়েছিল। এই জীবন কোনোদিন সে ভাবে নি। তবে বুশরাকে পেয়ে আমার গানগুলো আরও ভালো হয়ে গেল।’
এই বলে হাসান হাঁক দিলেন, ‘বুশি এবার চা চাই।’
সাত
হাসান টেবিলের ওপর রাখা গিটারটা নিয়ে স্ট্রিংগুলোকে একটু টানাটানি করে টিউন আপ করলেন। কয়টা টুং টাং শব্দ করলেন।
বুশরা চা অনল। এক কাপ চা কাপে ঢেলে হাসিমকে দিল, দুধ-চিনির কথা জিজ্ঞেস করতে হলো না। অন্য এক কাপ হাসানকে। চায়ের পর হাসান আবার খোশ মেজাজে গল্প জুড়ে দিলেন। বললেন, ‘আপনাদের দুজনকে নিয়ে আমি একসময় একটা গান বাঁধব।’ এই বলে তিনি গিটারটা কাঁধে বেঁধে নিলেন এবং তক্ষুনি গান শুরু করে দিলেন।
‘গ্রীন কার্ড তো আসে না
বুশরা কেন বোঝে না
বুশরা কেন বোঝে না
গ্রীন কার্ড তো আসে না।’
গানের দুই লাইন তুলে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘না হলো না, নকল হয়ে গেল—তাহলে আজম খানের আসল গানটাই গেয়ে ফেলি।’
আবার গান শুরু করে দিলেন।
‘পাপড়ি কেন বোঝে না ?
তাই ঘুম আসে না
সারা রাত জেগে জেগে
কত কথাই আমি ভাবি
পাপড়ি কেন বোঝে না ?
তাই ঘুম আসে না।’
আজম খানের পুরো গানটাই হাসান গাইলেন। অদ্ভুত সুরেলা গলা, কেন যে গানের জগতে তার নাম খ্যাতি বাড়ছে, হাসিমের বুঝতে কষ্ট হলো না। তার আরও ভালো লাগল তার উপহার দেওয়া গিটারেই হাসান গানটা করেছেন। হাসান বলল, ‘আপনার দেওয়া গিটারটা খুব ভালো সুর তোলে, এটা আমি শুধু বাড়িতেই ব্যবহার করব।’
হাসান কেন এটা শুধু বাড়িতেই ব্যবহার করবে বুঝতে হাসিমের কষ্ট হলো না। হাসান বললেন, এই গানটা করার আগে এই গানটার গল্পটা বলা উচিত ছিল। একটু থেমে শুরু করলেন গল্পটা—
‘আমাদের গুরু, পপ গায়ক আজম খান, থাকতেন কমলাপুর কবি জসীমউদ্দীন রোডে। তার কাছের বাড়িতেই থাকত পাপড়িরা, একটা অ্যাপার্টমেন্টে। দুজনে একসময় প্রেমে পড়ে যান। পাপড়ির মা টের পেয়ে মেয়ের ওপর করা নজর রাখেন। এক সময় আজম খান ও পাপড়ি ঠিক করলেন, তারা দুজন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবেন। তার আগেই পাপড়ির মা বাসা বদলিয়ে এক রাতে পাপড়িকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন। পাপড়ির আর খোঁজ পাওয়া গেল না।’
হাসান একটু থামলেন, হাসিম ও বুশরা তন্ময় হয়ে শুনছে আজম খানের প্রেম কাহিনি।
‘কয় বছর পর আজম খান একবার চট্টগ্রামে গেলেন এক কনসার্টে গান গাইতে। গানের অনুষ্ঠান শেষে দেখলেন, একজন ভদ্রলোক এসেছেন তার সাথে কথা বলতে। তিনি পরিচয় দিলেন—পাপড়ির স্বামী, পাপড়ি তাকে পাঠিয়েছে আজম খানকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।’
হাসান থামলেন। বুশরা একটু পর কিছুটা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজম খান কি গিয়েছিলেন ?’
এতক্ষণ পর বুশরা একটা কথা বলল। হাসান ও হাসিম যখন কথা বলছিল, বুশরা ছিল কেমন নির্বাক ! সে যেন একটা নাটক দেখছিল—যেখানে তার নাম আছে, কাহিনিতে আছে তাকে নিয়ে অনেক কথা, কিন্তু তার কোনো সংলাপ নেই।
হাসান বুশরার প্রশ্নের উত্তর দিলেন—‘বুশি, সেটা তো গল্পটার জন্য জরুরি কিছু নয়। সেটা না হয় পরে বলব।’
ঘরের পরিবেশটা কেন জানি বেশ ভারী হয়ে গেল। কোথায় যেন বুশরা-হাসান-হাসিম কাহিনি আজম খান ও পাপড়ির কাহিনির সাথে একীভূত হয়ে গেল। হ্যাসিম ভাবল, কী যে সম্মোহিত ক্ষমতা হাসানের! সে যেভাবে তাদের তিন জনের জীবনের জটিল গিঁটগুলোকে টেনেহিঁচড়ে খুলে সামনে তুলে ধরেছেন, কোনো বড় লেখকও বোধ হয় এমন পারতেন না। গল্পের পর হাসান সাহেবও উদাস হয়ে গেলেন। কথা আর জমল না। দুপুরের ঘড়ি বিকেলের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। বুশরা রান্নাঘরে চলে গেল খাবার বাড়তে।
হাসিম বলল, ‘হাসান ভাই, আপনি আজ আমাকে মনের হাজারো কষ্ট থেকে মুক্তি দিলেন।’
হাসান বললেন, ‘জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে যায়, মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমরা আমাদের জীবনে কিছুটা স্বচ্ছতা এনে অনেক কষ্ট ও দুঃখ থেকে রেহাই পেতে পারি।...চলুন দেখি, বুশরা খাবারের কী করল। অনেক বেলা হয়ে গেছে, বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে। আজ বোধহয় আপনার আমেরিকার গল্প শোনার সময় হবে না।’
আট
হাসানের বাড়ি থেকে বের হয়ে হাসিম হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগিয়ে গেল। ডান দিকে একটা খোলা পার্ক। হাসিম পার্কের একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। এখনো একটু বেলা আছে। ওখান থেকেই বুশরাদের বিল্ডিংয়ের একটা কোনা দেখা যাচ্ছে। হাসিমের মনে কত অনুভূতির আনাগোনা, আবার প্রশ্নও আছে কিছু। পাপড়ির স্বামীর সাথে আজম খান পাপড়িদের বাড়িতে গেলেন কিনা তা হাসান বললেন না কেন ? এই হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ এত গম্ভীর হয়ে গেলেন কেন ? আজম খানের অপরিণত ভালোবাসার জন্য কি কোনো দুঃখবোধ আছে হাসানের মনে ? কিংবা বুশরা-হাসিমের জন্য ? শিল্পীরা খুব দিলখোলা, দরাজ ও খুব আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন!
হাসিমের মনের একটা বিরাট বোঝা আজ মন থেকে নেমে গেল। হাসিম-বুশরার সব কাহিনিগুলো আজ খুব স্বচ্ছভাবে হাসান তুলে ধরেছিলেন। তাদের সম্পর্ক ভাঙার পিছনে হাসানের যে কোনো অবদান নেই তাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। কী যে অদ্ভুত ভালো মানুষ! হাসিম নিশ্চিত, হাসান কোনোদিন বুশরাকে কষ্ট পেতে দিবেন না।
নিজেকে নিয়েও হাসিম ভাবল। জীবনের যে স্বচ্ছতা তার স্বাদ কি সে কোনোদিন পাবে ? তার বিয়ে করার একমাত্র মানদণ্ড, একটা পছন্দমতো ডাক্তার চাই, যে আমেরিকাতে গিয়ে অনেক টাকা কামাতে পারবে। তার জীবনের একটা বিরাট অধ্যায় চাপা পড়ে যাবে সাফল্যের খোঁজ করতে গিয়ে। সে কি কোনোদিন উচ্চস্বরে ভাঙা গলায় গাইতে পারবে, ‘গ্রীন কার্ড তো আসে না, বুশরা কেন বোঝে না।’ তার নোটবইতে এখন যে প্ল্যান, তার বড় একটা অংশ হলো, ভুলে যাও বুশরাকে। আজম খান কি পেরেছিলেন পাপড়িকে ভুলতে ? জীবনের যে স্বচ্ছতার কথা হাসান বলল, তা কি সে কোনোদিন পাবে ? হাসান যেন তাকে এক নতুন জীবন-দর্শন শিখাল আজ। হাসিমের কেন জানি ইচ্ছে হলো, সে চিৎকার করে বেসুরো গলায় গাইবে—‘গ্রীন কার্ড তো আসে না, বুশরা কেন বোঝে না... গ্রীন কার্ড তো আসে না, বুশরা কেন বোঝে না ?’
আজম খান যেমন গাইতেন ‘পাপড়ি কেন বোঝে না...?’
নোটবইয়ের খোদাই করা লেখাগুলো হাসিম কি পরিবর্তন করবে ? ডাক্তার নয়, নোশিন নয়, সে কি এমন কাউকে বেছে নিবে, যার সামনে সে সজোরে গাইতে পারবে, ‘গ্রীন কার্ড তো আসে না, বুশরা কেন বোঝে না ?’
হাসিমের মনে হলো, নিজের মনের স্বচ্ছতাই জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ।
Leave a Reply
Your identity will not be published.