নক্ষত্র-নূপুর (দ্বিতীয় খণ্ড)

নক্ষত্র-নূপুর  (দ্বিতীয় খণ্ড)

[১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন নতুন রূপ পেতে থেকে। বাংলা এবং ভারতবর্ষের এই বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ল জার্মানি এবং রাশিয়া। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপ্লব-প্রয়াসের প্রায় সমান্তরালে চলতে থাকল বাংলা এবং ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী বিপ্লবের প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে রুশ বিপ্লবী এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বাঙালি বিপ্লবীদের প্রেম এবং বিপ্লবের কাহিনি ও এই দুই ভূখণ্ডের বিপ্লবীদের আন্তঃসম্পর্ক। লেখাটির প্রথম খণ্ডের কাহিনি শেষ হয়েছে ১৯১৪-১৫ সালে এবং এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে ‘অন্যদিন’-এ। এই খণ্ডের গল্প আরম্ভ হয়েছে ১৯১৪ সালের রাশিয়ায় আর শেষ হয়েছে ১৯২১-২২ সালে গিয়ে।]

 

দু মাস হলো ইনেসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে আছে অস্ট্রিয়ার সমুদ্রবর্তী শহর লোভরানে। ইনেসা জন্মগতভাবে ফরাসি আর বিয়ের সূত্রে রাশিয়ান। যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় দুটোই এখন অস্ট্রিয়ার শত্রু দেশ। অস্ট্রিয়ায় থাকাটা ওর জন্য এখন মোটেও নিরাপদ না। ইনেসা সময় নষ্ট করল না, খুব দ্রুত ট্রেনে ইতালিতে চলে এল। কারণ ইতালি এখন পর্যন্ত একটা নিরাপদ দেশ। জেনোয়া থেকে ইনেসা ছেলেমেয়েদের জাহাজে রাশিয়ার আর্কেঞ্জেলে পাঠিয়ে দিল। ওর আগের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ওখানে আছে। ওরা ইনেসার ছেলেমেয়েদের নিরাপদে রাখতে পারবে। জেনোয়া থেকে ইনেসা ফিরে এল লোভরানে। লোভরানে ওর বাড়িটা এখন খাঁ খাঁ করছে। ডাইনিং টেবিলে বাচ্চাদের হইচই নেই, বেডরুমগুলো বিরান, কেবল বাচ্চাদের আধোয়া জামাকাপড়গুলো একটা ঝুড়িতে রাখা। শূন্য ঘরের দিকে তাকিয়ে ইনেসা নিজেকে সামলাতে পারল না। দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

ক’দিন বাদেই কার্ডিফ বন্দর থেকে ইনেসার মেয়ে ইনা চিঠি লিখে জানাল, প্রথমদিকে সি সিকনেস হলেও এখন সবাই ভালো আছে। ইনেসা চিঠি পড়ে খুশি হলো, কিন্তু আবার চিন্তায় পড়ে গেল। আর্কেঞ্জেলের আর্কটিক সার্কেল যে ভীষণ ঠান্ডা, ওদের জামাকাপড় শীত থেকে যথেষ্ট সুরক্ষা দিবে তো ? নাকি দিবে না ?

লোভরানে বেশি দিন একা পড়ে থাকা ইনেসার পক্ষে সম্ভব নয়। দলকে গোছানোর অনেক কাজ আছে। কিছুদিন বাদে ও সুইজারল্যান্ডে এসে জেনেভা লেকের কাছে কয়েকদিন থাকল। বরফে ঢেকে যাওয়া আল্পসের চুড়োগুলো দেখে ওর মন ভরে গেল। ইনেসা এরপর  বার্ন-এ চলে এল। বার্ন-এ এসেই ইনেসা খবর পেল লেনিনকে অস্ট্রিয়ায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটকে রাখা হয়েছে। জিনোভিয়েভও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পায় নি। এ খবর পাওয়ার পর থেকেই ইনেসা যেভাবে পারে টাকা উঠিয়ে নাদিয়ার কাছে পাঠাল। এ কারণেই নাদিয়া বলে ভিক্টর অ্যাডলারের কলকাঠি না নাড়ালে আর ইনেসা অতগুলো টাকা না পাঠালে লেনিনকে অস্ট্রিয়ার জেলেই দিন কাটাতে হতো।

ইনেসা বার্ন-এ আছে বলে লেনিন আর নাদিয়াও সেখানে চলে এসেছে। ওদের বাড়ি থেকে ইনেসার অ্যাপার্টমেন্ট মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ। নতুন করে ইনেসা, লেনিন আর নাদিয়ার ত্রয়ী জীবন আরম্ভ হয়েছে। প্রায়ই ওরা তিনজন সেই আগের মতো বনের পথ ধরে হাঁটে। পথের দুপাশে সবুজ-হলুদ লতাপাতার দিকে ইনেসা মুগ্ধ চোখে তাকায়, আসলে লেনিনের সঙ্গে হাঁটার সময় ওর সবকিছুই ভালো লাগে। কখনো কখনো পাহাড়ের ধারে রোদের নিচে ওরা চাদর বিছিয়ে বসে। সমাজ, রাজনীতি আর বিপ্লব নিয়ে মাথায় নতুন কোনো ভাবনা এলে লেনিন তা যত্ন করে নোটবুকে তুলে রাখে, নাদিয়া ইতালিয়ান ভাষা শেখার চেষ্টা করে, ইনেসা স্কার্ট সেলাই করে। ইনেসাকে নাদিয়া মাঝেমাঝে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে। সেন্ট পিটার্সবার্গে জেল আর নির্বাসনের পর থেকেই ইনেসা সামান্য অস্থির প্রকৃতির হয়ে গেছে, হয়তো এ আর ঠিক হওয়ার নয়। বন থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওরা সবাই জিনোভিয়েভের বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে যায়। সময়গুলো যেন স্বপ্নের মতো। যুদ্ধ সব সময় মানুষের মনে জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে দেয়। জাতীয়তাবাদের বিপ্রতীপ চশমায়  অনেক সত্য মিথ্যে হয়ে যায় আর অনেক মিথ্যে সত্য হয়ে যায়।

রাশিয়া শীঘ্রই যুদ্ধে যোগ দেবে। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক শিবির যুদ্ধ নিয়ে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে। এক ভাগ ভাবছে আগে দেশকে রক্ষা করতে হবে, তারপর অন্য কথা। কিন্তু লেনিনের দল ভাবছে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তর করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবার এটাই সেরা সুযোগ। সেজন্য সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া যদি যুদ্ধে হারে তো হারুক। এই থমথমে সময়ে ইনেসার মাথায় একটা নতুন চিন্তা এসেছে। সে প্রেম এবং পরিবার নিয়ে একটা পাম্ফলেট লিখবে।  ইনেসা বহুদিন ধরে নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। ইনেসার ধারণা বিয়ে হলো মানুষের মন এবং শরীরের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ।  মেয়ে ইনাও বড় হচ্ছে। বিয়ে এবং প্রেম সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। তাই ইনেসা ভাবছে ওর বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো গুছিয়ে লিখবে, যেন মেয়েটাও পড়তে পারে।

জানুয়ারি মাস আসতেই ইনেসা পাহাড়ের দিকে চলে গেল। ইনেসা ওখানে একটা কাঠের ঘর ভাড়া করেছে। অপরূপ পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে ও নিজের ভাবনাগুলো গুছিয়ে লিখবে। ইনেসার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল না। বেশ ক’দিনের ভেতরেই প্রেম এবং পরিবার নিয়ে ও ছোটখাটো একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলল।

পাম্ফলেটের একটা অংশ ইনেসা লেনিনকে পাঠিয়ে বলল, তোমার রিভিউ দাও। লেনিন গভীর মনোযোগে ইনেসার লেখা পড়ে জানাল—

ইনেসা,

মুক্ত প্রেমের ধারণাটা তুমি বাদ দাও। তুমি বলছ ক্ষণিকের আবেগের চুম্বন স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসাহীন চুম্বনের চেয়ে কাব্যিক এবং পবিত্র। ক্ষণিকের আবেগে যে চুম্বন সেটাও তো আসলে শেষমেশ প্রেমহীন হতে পারে! না, না, তোমার তুলনা ঠিক হয় নি। বরং যদি আরও পরিষ্কার করে লিখতে চাও, তুমি লিখতে পারো ক্ষণিকের সম্পর্ক অনেক সময় পবিত্র হয়, আবার অনেক সময় তা জঘন্যও হতে পারে।

লেনিনের চিঠি পেয়ে ইনেসার মন খারাপ হলো। লেনিন ওদের দুজনের পুরোনো প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অতিমাত্রায় সতর্ক। আর এই সতর্কতা লেনিনের সব মন্তব্যে প্রভাব ফেলছে। লেনিন আর আগের মতো মন খুলে কিছু লিখতে পারছে না। ওদের প্রেমের চেয়ে রাশিয়ার বিপ্লব লেনিনের কাছে এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

লেনিনের কথা ভুলে ইনেসা ওর মেয়েকে লিখল—

ইনা, তোমাকে বলেছিলাম প্রেম নিয়ে একদিন আলাপ করব। পশুপাখি কিন্তু প্রেম করে না। কেন জানো ? কারণ, প্রেম হলো সমাজ এবং সংস্কৃতির তৈরি একটা পরিশীলিত অনুভূতি। এ কারণে এটাও সত্য যে পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষেরই এই অনুভূতির সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। ওরা প্রেমকে জান্তব কামনা আর শরীরের ক্ষুধার সাথে গুলিয়ে ফেলে। প্রেমের মতো উচ্চতর অনুভূতির চূড়া স্পর্শ করার যোগ্যতাই ওদের নেই। নিজের আবেগকে কখনো পরাধীন করে রেখো না। 

ইনা, তোমার যদি কখনো কাউকে সত্যি ভালো লেগে যায়, আমাকে চাইলে জানাতে পারো, কিন্তু আমার অনুমোদনের অপেক্ষা করবে না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে।

 

নাদিয়ার গ্রেভস ডিজিজ আছে। আক্রমণটা হঠাৎ হয়। যখন হয় তখন ওর হৃদকম্পন বেড়ে যায়, তাকাতে অসুবিধা হয়, শরীর কাঁপে। এবারও তাই হয়েছিল। নাদিয়া আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বেরুবার কোনো অবস্থা নেই।

লেনিন আর ইনেসা নাদিয়াকে ছাড়াই পাহাড়ে হাঁটতে যায়। আল্পসের ঢেউ খেলানো উত্তল-অবতলে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মানসিক টানাপোড়েন ভুলে ওরা দুজন যেন সেই পুরোনো দিনের মতোই কাছাকাছি চলে আসছে। তবে দূরত্বের দেয়াল যেন পুরো ভেঙে না যায় সেই ব্যাপারে লেনিন খুবই সতর্ক। ইনেসার সাথে আলাপগুলো সে রাজনীতির আখ্যানের মাঝেই সীমিত রাখার চেষ্টা করে। লেনিনের সীমাবদ্ধতা ইনেসা বোঝে। কিন্তু ওর অভিমান তাতে কমে না।

সামনের কয়েক মাসের ভেতর ইউরোপে অনেকগুলো সোশালিস্ট কনফারেন্স হবে। লেনিন সবগুলোতেই ইনেসাকে ওর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাতে চাইছে। ইনেসা একদিন বলল, ইলিচ, তুমি নিজে কেন যাচ্ছ না ? এসব খ্যাপাটে পুরুষদের সাথে তোমাদের হয়ে বারবার আমি একা লড়াই করব নাকি ?

ইনেসা, এখন আমার মঞ্চে ওঠার সময় না। ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন টুকরো হয়ে যাচ্ছে। মেনশেভিক দল, রোজা লুক্সেম্বার্গ, কাউটস্কি—সবাই যে যার ধান্দায় আছে। এখন যদি আমি সামনে যাই, আমাকে টেনে নেবে নামাবে ওদের কাদা ছোড়াছুড়িতে। আমি এখন কোনো ফালতুু বিবাদে জড়াব না। ভবিষ্যতের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।

তুমি তো জানো ওরা আমাকে পুরোপুরি গ্রহণ করবে না। শেষবার কী যে একটা নাজেহাল অবস্থা হলো!

লেনিন তীক্ষè দৃষ্টিতে ইনেসাকে লক্ষ করে বলল, শোনো ইনেসা, ওদের তুমি আমার চেয়ে ভালো মোকাবেলা করতে পারবে। তুমি শুধু আমার প্রতিনিধি না, তুমি ইনেসা আরমান্ড। তুমি ওদের ধারে কাটবে, ভারে না।

ইনেসা লেনিনের হয়ে সবগুলো কনফারেন্সেই গেল, কারণ লেনিনের যে-কোনো প্রশংসায় ইনেসার মন এখনো দ্রবীভূত হয় যায়। ও লেনিনের অনুরোধ ফেলতে পারে না। তবে  ইনেসার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিনদিন বাড়ছে। কখনো কখনো লেনিনের সাথে ওর বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘাত লেগে যাচ্ছে। বার্নে একটা বলশেভিক কনফারেন্সে লেনিন, ইনেসা, দুজনেই ছিল। লেনিন ওর বক্তৃতার সময় বলল, যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে আমাদের উচিত ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইউরোপ গঠন করা। তবে হ্যাঁ, সেটা হতে হবে সমাজতান্ত্রিক আবহে।

ইনেসা লেনিনের সঙ্গে একমত হলো না। বলল, ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইউরোপ শুনতে ভালোই শোনায়, কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব না।

লেনিন সামান্য বিরক্ত হয়ে ইনেসার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, কেন সম্ভব না ?

কারণ ইউরোপের একেক দেশের একেক রকম ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। এইসব স্বার্থ ভুলে কীভাবে এতগুলো দেশ একত্র হবে ? আর এখন তো উল্টো সবার সাথে সবার যুদ্ধ চলছে।

লেনিন আঙুল নাড়িয়ে বলল, ইনেসা, তুমি অ্যানার্কিস্টদের মতো কথা বলছ।

ইনেসা একরোখার মতো উত্তর দিল, আর তুমি সুবিধাবাদীর মতো কথা বলছ।

সুবিধাবাদী শব্দটা লেনিন অন্যদের ব্যাপারে অহরহ ব্যবহার করে। তাই ইনেসার মুখে সুবিধাবাদী শব্দটা শুনে লেনিন বুঝল ইনেসা ওর জমে থাকা ক্ষোভ আর অভিমান থেকেই এমন করছে। এ কারণে লেনিন আর কথা বাড়াল না। কিছুদিন বাদেই ইনেসার সাথে ঝগড়া ভুলে লেনিন ওকে একটা চিঠিতে লিখল, নতুন  রেজল্যুশনের খসড়া বানিয়েছি। দেখে দাও।

ইনেসা সেই খসড়া পড়ে দেখল ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইউরোপের কোনো কথাই লেনিন ওখানে লেখে নি। মানে ইনেসার যুক্তিকে সে আমলে নিয়েছে। ইনেসার রাগ কিছুটা পড়ল।

 

১৯১৫ সাল দেখতে দেখতে মাঝামাঝি চলে এসেছে। যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। জুন মাসে লেনিন আর নাদিয়া গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে সরেনবার্গ গেল। সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন ক্যান্টনের এই শান্ত, নির্জন পাহাড়ি গ্রামে ওরা আরেকটা কারণেও এসেছে। এখানে একটা স্যানিটোরিয়ামে নাদিয়া ওর অসুখ সারানোর জন্য কিছুদিন থাকবে। লেনিন ওখানে গিয়ে ইনেসাকে চিঠিতে লিখেছে—

প্রিয় ইনেসা,

তোমার দাঁতের চিকিৎসা কতদিন চলবে ? তুমি ঠিক কখন বের হতে পারবে ? শুপফহাইম থেকে ফুলিতে ডাকগাড়ি যায় সকাল ৯টা আর বিকেল ৪টায়। সরেনবার্গে সরাসরি যায় সকাল ৯টায়। রাশিয়ার খবর খুব একটা খারাপ না।

তুমি নিজেই এসে পড়ে নাও।

ইতি,

ভি. উলিয়ানভ

লেনিনের চিঠিতে সাড়া দিয়ে ইনেসাও ওদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যোগ দিয়েছে। তবে লেনিন কোথাও সত্যিকার অর্থে ছুটি কাটায় না। সে কেবল ছুটিকে উপলক্ষ করে কাজের পরিবেশটা মাঝেসাঝে পাল্টায়। সরেনবার্গে বার্নের রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে লেনিন কিছুটা দূরে, অথচ রাজনীতি থেকে ও একেবারে বিচ্ছিন্ন না। চাইলেই সরেনার্গে বসে বার্ন কিংবা জুরিখ লাইব্রেরি থেকে ডাকে বই আনানো যায়। এতে লেনিন মহা আনন্দিত। ইনেসাও এখানে এসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই লিখছে। তা ছাড়া ওদের প্রতিদিনের রুটিনে আরও শৃঙ্খলা এসেছে। ওরা সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যায়। দুপুর বারোটায় লাঞ্চের আগেই যে যার কাজ অনেক গুছিয়ে ফেলে। লাঞ্চ শেষে সবাই পাহাড়ে হাঁটতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে বিকেল ফুরিয়ে আসে। সন্ধ্যায় সূর্য নামার সময় আকাশে নানা রঙের বর্ণছটা তৈরি হয়। সবুজ উপত্যকার উপরে জমতে থাকা কুয়াশা তখন কেমন একটা গোলাপি বিভা ধারণ করে। এ দৃশ্য লেনিনের খুব প্রিয়। কিন্তু সেই গোলাপি আভার দিকে তাকিয়ে ইনেসার মন খারাপ হয়ে যায়। রাশিয়ায় ওর ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়ে। কেমন আছে ওরা এখন ? ওর জীবন কি কখনো অবিমিশ্র সুখের হবে না ? সব সময়ই একটা না একটা কাঁটা কোথাও না কোথাও বিঁধে থাকবে ? পরক্ষণেই ইনেসা ভাবল অবিমিশ্র সুখের জীবন কি সে চেয়েছে কখনো ? কেউ কি তাকে বলেছিল সংসার ভাঙতে, বিপ্লবী হতে কিংবা লেনিনের সাথে প্রেমে জড়াতে ? ইনেসা জানে ওর ঝড়ো জীবনের জন্য ও কোথাও কারও কাছে কোনো অভিযোগই সে করতে পারে না।

তবে নিজেকে নিয়ে ভাববার অবকাশ ইনেসার জীবনে খুবই কম। যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে গড়িয়েছে। দশ থেকে বারো লক্ষ মানুষ এর মাঝেই মারা গেছে। লেনিন বারবার বলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ একটি সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত। শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থই নেই এতে। কিন্তু মানুষের বনভূমিতে নেতারা সুচতুরভাবে যে প্রতিহিংসার দাবানল লাগিয়ে দিয়েছে, সব ভস্ম না করে তা নিভবে বলে মনে হচ্ছে না।

সেপ্টেম্বরে লেনিন ইনেসাকে নিয়ে জিমারওয়াল্ডে এল। ওবারল্যান্ড পাহাড়ের উপর এই জিমারওয়াল্ড গ্রাম। এই গ্রামটা বার্ন থেকে বেশি দূরে নয়। সোশালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল একটা গোপন কনফারেন্সের আয়োজন করেছে এখানে। ইউরোপ থেকে আটত্রিশজন ডেলিগেট কনফারেন্সে যোগ দিয়েছে। কিন্তু পুরো বার্ন শহরে নানা দেশের স্পাই গিজগিজ করছে। তাই বাইরে প্রচার করা হয়েছে, এই কনফারেন্স হলো পাখি-বিশেষজ্ঞদের মহাসমাবেশ।

বার্ন থেকে সবাইকে ঘোড়ার গাড়ি করে নিয়ে আসা হয়েছে জিমারওয়াল্ড গ্রামে। রাশিয়া মাত্র আটজন ডেলিগেট নিতে অনুমতি পেয়েছে, এর মাঝে বলশেভিক থেকে মাত্র দুজন। এতে লেনিন সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। এখানে লেনিনকে থাকতেই হবে, জিনভিয়েভকেও লাগবে। তার মানে ইনেসাকে এবার বাদ দিতে হবে। লেনিন ইনেসাকে জিনভিয়েভের বিকল্প হিসেবে রাখল।

সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখ কনফারেন্সে এই গ্রুপের ম্যানিফেস্টো পড়ে শোনানো হলো। ম্যানিফেস্টোতে যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়েছে, শ্রমিক শ্রেণিকে জাতীয় যুদ্ধের বদলে আন্তর্জাতিক শ্রেণিসংগ্রামের পথে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। লেনিনসহ সবাই ম্যানিফেস্টোর ঘোষণায় একমত। জিমারওয়াল্ডের এই অতি বামপন্থী গ্রুপটার নাম দেওয়া হয়েছে জিমারওয়াল্ড লেফ্ট্। লেনিন এবার ইউরোপের বামপন্থীদের নেতা হিসেবে নিজেকে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। অল্প সংখ্যক অনুগামী নিয়েই লেনিন কনফারেন্সের মূল সুরটা ঠিক করে দিয়েছে। লেনিনের জীবনে একজন নতুন বন্ধুরও আগমন ঘটেছে। এই লোকের নাম কার্ল রাদেক। রাদেক অস্ট্রিয়ান। যুদ্ধে যোগ দেওয়া এড়াতে ও সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে এসেছে। রাদেকের প্রাণশক্তি বিপুল। ওর চোখে এক ধরনের বিদ্রোহী দীপ্তি, মুখে হাসি, কথায় বিদ্রƒপ। সে আবার পারভাসেরও বন্ধু। কনফারেন্স শেষে রাদেক লেনিনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ইলিচ, বড় দল জেতে না, বড় আইডিয়াই জেতে। এ কারণে আমি তোমার সাথে কাজ করতে চাই।

জিমারওয়াল্ড কনফারেন্স থেকে ফিরে এসে লেনিনের উৎসাহ বেড়ে গেছে। বলশেভিক গ্রুপ এবার পুরো ইউরোপে ওদের নেটয়ার্ক বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করছে। কিন্তু ফ্রান্সে খুব একটা সুবিধা করা যাচ্ছে না। লেনিন যে যুদ্ধের সময় শান্তি শান্তি করছে, সেটা ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা একদম পছন্দ করছে না। ওরা যুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদের পক্ষে। লেনিন ভাবছে, এই বুরবকগুলোকে বুঝিয়েসুঝিয়ে লাইনে আনতে হবে। লেনিনের প্রেমিকা ইনেসা আরমান্ড ছাড়া এই কাজ আর কে ভালো পারবে ? লেনিন একদিন ইনেসাকে বাড়িতে ডেকে বলল, ইনেসা তোমাকে ফ্রান্স যেতে হবে।

ইনেসা অবাক হয়ে বলল, ফ্রান্স ? আমাকে ? কেন ?

লেনিন টেবিলের ওপর রাখা মানচিত্রের ফরাসি সীমান্তে আঙুল রেখে বলল, ফরাসি সমাজতন্ত্রীরা পাগল হয়ে গেছে। ওরা জাতীয়তাবাদের পক্ষে সাফাই গাইছে। ওরা এখন মনে করে, দেশপ্রেমের চেয়ে বড় কিছু দুনিয়ায় নেই। আমাদের ডিফিটিজমের বার্তা পৌঁছাতে হবে।

মানে আমি গিয়ে যুদ্ধের বিপক্ষে, ওদের সরকারের পরাজয়ের পক্ষে কথা বলব ?

হ্যাঁ।

ইনেসা কিছুক্ষণ চুপ থাকে। লেনিনের কণ্ঠে দৃঢ়তার আড়ালে চাপা অস্থিরতা সে টের পেয়েছে। ইনেসা আস্তে করে বলল, কাজটা খুবই বিপজ্জনক হবে।

লেনিনের মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে, সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজগুলো তোলা থাকে সবচেয়ে সাহসী মানুষের জন্য। ইনেসা, তুমি জানো, এই কাজ তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। তুমি জানো কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে মানুষের মন গলাতে হয়।

তারপর এক মুহূর্ত থেমে লেনিন ওর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, তোমার ছদ্মনাম হবে সোফি পপফ।

ইনেসার সেই আগের প্রাণশক্তি কিংবা উৎসাহ এখন আর নেই। লেনিনের ব্যাপারে ওর মনে একটা অভিমানমাখা অনীহা জন্মাচ্ছে। তারপরও লেনিনের অনুরোধ ইনেসা কখনোই ফেলতে পারে না। এ কারণেই লেনিন এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে ওর কাছে বারবার এটা-সেটা আবদার করতে পারে। এবারও ইনেসা রাজি হলো।

 

ইনেসাকে নকল পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নকল পাসপোর্ট দিয়ে এই ভয়াবহ যুদ্ধের ভেতর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইনেসা ফ্রান্সের আনম্যাসি সীমান্তে এল। ওর সঙ্গে আছে রাশিয়ান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী নিকোলাই আর ফরাসি শ্রমিকনেতা লুই। নিকোলাই ফরাসি ও জার্মান ভাষায় পারদর্শী, আগেও অনেকবার সীমান্ত পারাপার করেছে। ইনেসার সব নকল কাগজপত্র নিকোলাই বানিয়ে দিয়েছে। আর লুইয়ের কাজ হলো, প্যারিসে ইনেসার জন্য সেইফ হাউজের ব্যবস্থা করা।

সীমান্ত চৌকিতে ফরাসি কাস্টমস অফিসার ও সৈন্যরা সন্দেহজনক যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। ইনেসার সঙ্গে একটি ছোট স্যুটকেস । ওর ভেতর কিছু ব্যক্তিগত কাপড়, বই, এবং কাগজপত্র। সীমান্ত অফিসার ওর ব্যাগ তল্লাশি করে রাশিয়ান আর ফরাসি ভাষায় লেখা লিফলেটের খসড়া আর সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য পেল। অফিসার ওকে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী ?

ইনেসা শান্তভাবে জবাব দিল, আমি লেখক, গবেষণার কাজে ব্যক্তিগত নোটস রাখি।

কিন্তু অফিসারের সন্দেহ কমল না। লিফলেটে ‘সমাজতন্ত্র’, ‘যুদ্ধবিরোধী’ শব্দগুলো অফিসারের ভালো লাগে নি। ওরা ইনেসাকে একটি ছোট কক্ষে নিয়ে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। ইনেসা বলল, দেখুন, আমি জাস্ট একজন শিক্ষিকা, প্যারিসে আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি।

 অবস্থা বেগতিক দেখে লুই এগিয়ে এসে অফিসারকে বলল, দেখুন, আমি নিজে ফরাসি, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি উনি যা বলছেন তা সত্য।

লুই সঙ্গে করে কিছু উপহার নিয়ে এসেছে। ওই উপহার আর কিছু টাকা দেওয়ার পর ওরা ইনেসাকে সীমান্ত পার হতে দিল, কিন্তু সব লিফলেট রেখে দিল।

 

[চলবে]

Leave a Reply

Your identity will not be published.