রফিকুন নবী: জীবন ও প্রকৃতির রূপকার

রফিকুন নবী: জীবন ও প্রকৃতির রূপকার

রফিকুন নবী। চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট। ছবি আঁকেন স্বনামে, কার্টুন আঁকেন রনবী ছদ্মনামে। বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’ তাঁর সৃষ্টি। কার্টুনের মাধ্যমে তিনি চারপাশের নানা বিষয়, অসঙ্গতি, শ্রেণি বৈষম্য, জাতীয় নানা ইস্যু তুলে ধরেন সচেতন পাঠক ও শিল্পরসিকদের কাছে। অন্যদিকে ছবিতে মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ, চারপাশের সবকিছু মূর্ত হয়ে ওঠে।

রফিকুন নবীর ক্যানভাস বিষয়ভিত্তিক। অর্থাৎ বিষয় তাঁর ছবির একটি অংশ। এবং ছবিতে সরাসরি হোক কিংবা ইঙ্গিতে হোক খানিকটা বক্তব্য থাকে, হয়তো কার্টুন আঁকার অভ্যাসের কারণে। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণেও রফিকুন নবী একটি পরিচিত ও বিশিষ্ট নাম। এছাড়া তিনি গল্প, উপন্যাস, ছড়াও লিখে থাকেন। এইসব লেখায় তাঁর আত্মজৈবনিক উপাদানের পাশাপাশি থাকে মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের যাপিত জীবন, কঠিন বাস্তবতা আর সেই বাস্তবতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই, সামাজিক সংকট, অসংগতি, বৈষম্য ইত্যাদি।

জীবনঘনিষ্ঠ, সংগ্রামী ও সচেতন এই প্রথিতযশা শিল্পীর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘর এবং ধানমন্ডিস্থ গ্যালারি চিত্রকে সম্প্রতি হয়ে গেল একটি চিত্রপ্রদর্শনী। প্রায় মাসব্যাপী (৫ থেকে ৩০ নভেম্বর) এই প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছিল শিল্পীর আঁকা দেড়শটি চিত্রকর্ম। নানা মাধ্যমের এই শিল্পকর্মগুলো রফিকুন নবী এঁকেছেন ১৯৫৭ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত সময়ে। এখানে শিল্পীর চিত্রকর্মের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো।

রফিকুন নবীর ছবি মানেই জীবন ও প্রকৃতির মেলবন্ধন। আর তাঁর আঁকা কার্টুনে খুঁজে পাওয়া যায় হাস্যরস, সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও কৌতুকময়তা, সমাজসচেতনতা ও বুদ্ধির দীপ্তি। তিনি নানা মাধ্যমেই ছবি আঁকেন। যেমন, জলরং, কাঠখোদাই, রেখাচিত্র, তেলরং, অ্যাক্রিলিক ইত্যাদি। এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি দেয়ালচিত্রও সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ছবির দিকে তাকালে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। এক, বৃহদাকৃতির ছবির প্রতি তাঁর ঝোঁক ও তা নানা মাধ্যমের। দুই, ড্রয়িংয়ে তাঁর অসামান্য দক্ষতা। তিন, জলরঙে দারুণ মুন্সিয়ানা। চার, সার্থক কাঠখোদাই চিত্র সৃষ্টি। পাঁচ, তৈলচিত্রে গভীর অভিনিবেশ।

আরেকটি কথা, পূর্ব-নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে তিনি ছবি এঁকে থাকেন। রেখা ও রং ব্যবহারে তাঁর সংযম ও পরিমিতিবোধ স্পষ্ট। আর রং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগিয়ে যান। কোনো কোনো ছবিতে তিনি চড়া রং ব্যবহার করে থাকেন। যেমন, কাঠখোদাই চিত্রে। আর তাঁর ছবিতে কালো রঙের ব্যবহার সৃষ্টি করে এক নতুন মাত্রা। তাঁর এইসব ছবি দেখার পরে আমাদের অন্তরে এই বোধ সঞ্চারিত হয় যে কালো রঙেরও সরস সৌন্দর্যের দীপ্তি রয়েছে। সবচেয়ে আর্কষণীয় বিষয় হলো, রফিকুন নবীর ছবির কম্পোজিশন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও চিত্রসমালোচক সৈয়দ আজিজুল হকের ভাষ্য হলো: ‘চিত্রতলের কতটা পরিসরকে তিনি শূন্য রাখবেন, কতটা পরিসরজুড়ে থাকবে রূপকল্প (ইমেজ) ও মোটিফ, ভরাট পরিসরের (ফরমাল স্পেস) সঙ্গে শূন্য পরিসরের (নেগেটিভ স্পেস) সমন্বয় ঘটবে কীভাবে, কোন বন্তুকে (অবজেক্ট) চিত্রতলের কোথায় স্থাপন করলে তা দৃষ্টিনন্দন হবে, চিত্রতলে আলো আসবে কোথা থেকে, যথেষ্ট আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রক্ষিত হবে কীভাবে—এসব ব্যাপারে শিল্পী সবসময়ই অগ্রসর হন সুপরিকল্পনার মাধ্যমে।’

‘টোকাই’ রফিকুন নবীর অমর সৃষ্টি। বাস্তবের একটি চরিত্র থেকে এর সৃষ্টি। উল্লেখ্য, যে ছেলেটিকে দেখে এই শিল্পী ‘টোকাই’ সৃষ্টি করেছিলেন, সেই ছেলেটি তাঁর অন্য কার্টুনেও ব্যবহৃত হয়েছে। ছবি আঁকার মাধ্যমে যেভাবে তিনি রিজিওনাল রিয়ালিটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, তেমনি কার্টুন আঁকার মধ্যে আরবান রিয়ালিটি তৈরির চেষ্টা করেছেন। আর রিজিওনাল রিয়ালিটির ক্ষেত্রে রফিকুন নবীর ছবিতে ‘মহিষ’ একটি চরিত্র হয়ে দেখা দেয়। কেননা শিল্পী উত্তরবঙ্গের মানুষ। জন্ম চাঁপাই নওয়াবগঞ্জে। অবশ্য তাঁর নানার বাড়ি যশোরে। সেখানে ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন মহিষকে।

তাঁর ভাষায়, ‘মহিষ খুব সুন্দর একটা প্রাণী।’ আর মহিষ কিন্তু কালো নয়। এই প্রাণীটার মধ্যে অনেক রং লুকিয়ে আছে। মহিষকে রফিকুন নবী নানাভাবে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ছবিতে। বিশ্রামও শিল্পীর একটি প্রিয় বিষয়। ছবিতে এই বিষয়টি নানাভাবে তিনি এঁকেছেন। এমনই একটি ছবিতে মহিষের টোনাল ভ্যারিয়েশন চিত্র সমালোচকদেরও বিস্মিত করেছে। আরেকটি কথা, রফিকুন নবী শুধু চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের মানুষ নন, তিনি ঢাকারও। তাই ঢাকা, বিশেষত পুরোনো ঢাকার নানা বিষয় বাক্সময় তাঁর ছবিতে।

১৯৭৩-১৯৭৬ সময়কালে রফিকুন নবী গ্রীক সরকারের বৃত্তিতে এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্টে তিন বছর ছাপচিত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি কাঠখোদাইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেন। যেমন আগে আমাদের ঐতিহ্য ছিল ছোট আকারের কাঠখোদাই। অন্যদিকে রফিকুন নবী বড় আকারে কাঠখোদাই করার চেষ্টা করেছেন। তিনি মাল্টি কালারও ব্যবহার করেছেন। আবার আগে প্রথমে ছাপতে হতো হলুদ, তারপর নীল, এভাবে ধীরে ধীরে একদম শেষে কালো রঙের ব্যবহার ছিল। কিন্তু রফিকুন নবী বিষয়টা বদলে ফেললেন। তিনি শুরু করেন কালো রং দিয়ে। এভাবে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।

জাতীয় জাদুঘর ও চিত্রক গ্যালারিতে রফিকুন নবীর ছয় দশকের শিল্পকর্ম নিয়ে অনুষ্ঠিত চিত্রপ্রদর্শনীটি শিল্প-অনুরাগীরা বেশ উপভোগ করেছেন।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.