সারাবছর তবে কি শুধু বর্ষার জন্য প্রতীক্ষা ? বর্ষা এলেই যেন বদলে যায় সবকিছু। এই যে আমরা রূপাতলী যাচ্ছি তাও বর্ষার টানেই। অদ্ভুত সোনালি রঙের খেজুর ঝুলছে গাছে। অনেক দূর থেকে ভুল করে ফুলও মনে হতে পারে। খুব ভোরে আমরা গাছতলায় পাকা খেজুর কুড়াতে যেতাম। দিনের বেলাও পাখি-খাওয়া দু’একটি ঝরে পড়ত। এসব ভাবনার পূর্বসূরি আরও অনেক স্মৃতি এখনো বিস্মৃত হয় নি। তবে ব্যবধান এটুক—ঢেউয়া কিংবা কাউগাছটি যথাস্থানে নেই। একদা নিñিদ্র বুননের সেই নিবিড় বাগান কবেই লোপাট। তবুও স্মৃতির পাখিরা জেগে থাকে। ওই যে খালের স্বচ্ছ টলটলে পানিতে কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে। আজকাল আর খালে নৌকার আনাগোনা নেই, মরা খালগুলোও হয়তো একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে যাবে। কিন্তু চরম গ্রীষ্মের পর প্রাক্-বর্ষায় তার জল সঞ্চয়ের দৃশ্য প্রতিনিয়তই সঙ্গী হয়।
সারা দিনের বর্ষণ শেষে খানিকটা বিশ্রাম থাকা আকাশের মুখভার। স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি পথের ধারের শুকনো খালটির তলায় বৃষ্টির ঘোলাজল জমেছে। পরের দিন আরেকটু বাড়ে পানি। অল্প পানিতেই শুরু হয় ব্যাঙের উৎসব। আবাহন সংগীতের মাধ্যমে তারা বর্ষাকে ডেকে নেয়। ওদিকে আবার অবিশ্রান্ত জলধারা। ক্রমেই খালটি প্রশস্ত হতে থাকে। এতদিন মাঠের পানিতে পেট ভরিয়েছে খাল, এবার খালের উগরে দেওয়া পানিতে মাঠ ঢেকে যাচ্ছে। পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয় ধান আর পাট। বই-খাতা বগলদাবা করে তুমুল বৃষ্টিতে একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সাকুল্যে ১৫-২০ জন উপস্থিত। প্রথম ক্লাসের পর ছুটি ঘোষণা করলে আমরা ভিজতে ভিজতেই হই হই করে মাঠে নামি। এমন বৃষ্টিতে হা-ডু-ডু খেলাটা না সেরে বাড়ি যাওয়া সমীচীন নয়। অতঃপর খেলা শেষে কেউ কাউকে আর চিনতে পারি না। কাদায় মাখা অপরাজেয় বাংলার মূর্তি যেন একেকটা। দলবেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ি পাশের দিঘিতে। দুপুর ঘনিয়ে এলে আরেক স্তর কালো মেঘ পৃথিবীকে আরও অন্ধকার করে দেয়। পলিথিন মোড়ানো বই-খাতা নিয়ে আমরা বাড়ির পথ ধরি। পিচ্ছিল কাদাময় পথ, একেবারেই নির্জন। নিস্তব্ধ চারপাশ। এই দুর্দিনে নিতান্ত দায়ে না পড়লে কে পথে নামে! এভাবেই একেকটি বর্ষণমুখর অন্তরঙ্গ দিন জীবনের খাতা থেকে হারিয়ে যায়।
আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণে বর্ষা আরও পরিণত। ততদিনে চারপাশের ঘোলাজল স্বচ্ছ আর টলটলে। শাপলা-শালুক-চাঁদমালায় ভরে উঠেছে ধানের মাঠ। ভোরেই দেখি ‘কাজল বিলের শাপলারা’ অমলিন হাসিতে উদ্বেল। শাপলার আজীবন সঙ্গী পদ্ম, শালুক, চাঁদমালাও সেই হাসিকে বর্ণিল করে তোলে। তালের নৌকায় চেপে কেউ কেউ শাপলা তুলতে নামে। কেউ কেউ মাছ শিকারে ব্যস্ত। আর দিন কয়েক পরে কাটা হবে পাট, ধান। ত্রিশ বছর আগে বুকপানিতে নেমে ইব্রাহিম মণ্ডল যে ধান কেটে আমাদের উঠানে জড়ো করত কোথায় গেল সে ধান! এসব ধান কেটে দূরের মাঠ থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে নিয়ে আসা হতো। এক আঁটির সঙ্গে আরেকটা আঁটি গিঁট দিয়ে দীর্ঘ ট্রেনের মতো বানানো হতো, তারপর টেনে নিয়ে যাওয়া হতো গন্তব্যে। অবশ্য তার আগেই কলার ভেলা সাজাতে হবে। কিন্তু সকাল গড়িয়ে গেলেই দিনের সমস্ত আলো যেন কেউ কেড়ে নিয়ে যায়। প্রাণপণ চেষ্টায়ও বাতিঘরটা আর আলো ছড়াতে পারে না। তখন শীতল বাতাস দু’চারটি শিরীষ পাতা নিয়ে খেলা করে।
ভরদুপুরেই ঘন অন্ধকারে বৃষ্টি নামে। মনে হয় সন্ধ্যা সমাগত। দলবেঁধে কলমিভরা পুকুরের পানিতে নেমে এমন ঝমঝমে বৃষ্টি উপভোগ করতে বাধা কোথায়! বৃষ্টির চেয়ে পুকুরের পানি কিছুটা উষ্ণ। সেই পানিতে ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনার সেইসব দিন কি আর ফিরে আসবে! ‘সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে’। তখন বৃক্ষবন্ধুরাও নিশ্চুপ অবগাহনে। পাতার কোলবেয়ে অবিশ্রান্ত জলধারা নামে। সমস্ত নিস্তব্ধতাকে অতিক্রম করে দূরের মাঠ থেকে ভেসে আসে পানকৌড়ির একটানা ডাক, টুব-টুব-টুব। বড্ড নস্টালজিক সেই সুর। এমন গম্ভীর ডাক বর্ষার মৌনতাকে যেন আরও ভারিক্কি করে তোলে। একান্ত ভাবনাগুলোকে বারবার এলোমেলো করে দেয়। মন টেকে না ঘরে। ভেজা বাতাসের সঙ্গী হয়ে কোন সুদূরে হারিয়ে যায়। ঘরের উঠানে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাঁসের দল হঠাৎ বিক্ষিপ্ত কোরাসে বৃষ্টির নিস্তব্ধতা ভাঙে। তারপর আবার নিশ্চুপ চারপাশ। এমন অলস সময়টা হেলায় কাটায় না নারীরা। ঘরে ঘরে কাঁথা সেলাইয়ের হিড়িক পড়ে।
কিছুক্ষণ পরেই ভয়াল কালো মেঘের আবরণটা চটজলদি সরে যায়। ততক্ষণে লাজুক সূর্যটা হেলে পড়ে সুপারি বনের মাথায়। পশ্চিমমুখী গ্রামগুলো ধোয়ামোছা রোদে ঝলমল করে ওঠে। সবুজ পাতার গায়ে রোদ পিছলাতে থাকে দ্রুত। এমন উজ্জ্বল বিকেলে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাওয়া বিপন্ন গ্রামগুলোর চিত্র আমাদের মনেই পড়ে না। বাংলার প্রাণ গ্রাম যেন একেকটি ভাসমান দ্বীপ। বিস্তৃত জলরাশির বুকে ভেসে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে। বিকেল গড়ানোর আগেই প্রান্তিক জেলেরা ছোট নৌকা নিয়ে মাঠে আসে। নৌকায় থাকে মাছ শিকারের অনেক ফন্দি। কই মাছের ফড়িং ধরার দৃশ্যটা কেউ কি মনে রেখেছে এতদিন ?
পৃথিবীর কোনো পথে : নরম ধানের গন্ধ, কলমির ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীরা চাল-ধোয়া ভিজে হাত
—জীবনানন্দ দাশ
(রূপসী বাংলা)
অবশ্য এমন দৃশ্য বেঁচে থাকে অনন্তকাল। বাস্তবে না হলেও জলটইটম্বুর সবকটি ভাবুক বিকেলের তাজা ঘ্রাণ আমাকে বারবার বদলে দেয়। কলার ভেলায় শাপলা তোলার ব্যাপারটা এই তো সেদিনের কথা। শেষ বিকেলে আমরা সাঁকোয় গিয়ে বসি। খালের টলটলে পানিতে দু’এক পশলা কচুরিপনা ভেসে যায়। দূরের যাত্রীবাহী নৌকাগুলো আসে, যায়। মাঝে মাঝে মাটির হাঁড়িপাতিল বোঝাই ডিঙি নৌকা বাজারের মধ্যঘাটে নোঙর করে। হাট ফেরতা মানুষের হাতে হাতে কাঁঠাল আর ইলিশ শোভা পায়। ফের বৃষ্টির আগেই সবাই পৌঁছাতে চায় গন্তব্যে। ওদিকে হা-ডু-ডু খেলোয়াড়দের দম ফুরিয়ে আসে। মার্বেল খেলা নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা শুরু হয়। পরের দিন সেকথা আর কেউ মনে রাখে না। বড্ড অসময়ে চলে যাওয়া ক্লাশ ক্যাপ্টেন আবদুর রহিমকে আমরা যেভাবে আর মনে রাখি নি। বৃষ্টি আমাদের ছুঁয়ে যাওয়ার আগেই ঘনায়মান অন্ধকারে বাড়ির পথ ধরি। ধীরে ধীরে হাটফেরত মানুষের অস্পষ্ট কথা মিলিয়ে যেতে থাকে।
বর্ষার এসব বিচিত্র অনুভূতিই আমাদের কল্পনার রঙকে বর্ণিল করে তোলে। ভাবনাগুলোকে উস্কে দেয়। মন ছুটে যায় পুষ্পবিলাসী প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি তার চারপাশে কত রং সাজিয়েছে সেটাই বরং আমাদের কাছে দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভেজা বাতাসে উড়ে বেড়ায় বিচিত্র ফুলের সুবাস। আষাঢ়ের প্রথমভাগেই কদম ফুটতে শুরু করে। কদম ছাড়া কি বর্ষা হয় ? গ্রামের সেই অবহেলিত কদমই বর্ষার সমস্ত প্রাণ-প্রাচুর্যকে ভরিয়ে তোলে। একসময় আমাদের বনবাদাড়ে, পথের ধারে অসংখ্য কলাবতী ও লিলি ফুটত। আজকাল কলাবতী কিছু কিছু দেখা গেলেও লিলি গ্রামে প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। স্পাইডার লিলির পরিস্থিতিই সবচেয়ে নাজুক। গ্রামে ফুলটির নাম গো-রসুন। কবিরাজরা জন্ডিস ও লিভারের সমস্যায় এর কন্দ কাজে লাগান। বর্ষার ভেজা বাতাসে তার মধুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
ছোট ঝোপজাতীয় গাছের মধ্যে বর্ষায় দোলনচাঁপাও উল্লেখযোগ্য। কেয়া বর্ষার প্রধান কয়েকটি ফুলের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন ছড়া-কবিতা ও উপমায় কেয়াকে ‘বর্ষার রানি’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার স্নিগ্ধ উপস্থিতি ছাড়া বর্ষা রূপহীন, গন্ধহীন। ঢাকায় হাতেগোনা কয়েকটি গাছে ফুল ফুটতে দেখা যায়। আমাদের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে কেয়া বন আছে। সাদা ও সোনালি রঙের পাতাভেদে কেয়া দু’রকম। ‘কেতকী’ তার আরেক নাম। ঝুমকো বর্ষার রূপসী ফুল। জ্যৈষ্ঠের শেষ বৃষ্টিতেই ফুল ফুটতে শুরু করে। লতানো গাছের এ ফুল দেখতে মেয়েদের কানের ঝুমকার মতো। তিনকোনা পাতা দেখেও এগাছকে শনাক্ত করা সহজ। ফুল ভারি সুন্দর, গড়নটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো, পাপড়ি মোটা সুতার মতো চারদিকে বৃত্তাকারে সাজানো থাকে। পাপড়ির গোড়া নীল, আগার দিক ক্রমশ সাদা। মাঝখানে সাদা বৃত্তটি নীলের মধ্যে বিচিত্রতা তৈরি করে। কাঁঠালিচাঁপার নতুন শাখায় পাতার কোলে যখন বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে তখনই তার ফুল ফোটানোর কথা মনে পড়ে। শক্ত লতার ঝোপাল এই গাছে পাতার বুনন এতটাই ঘন যে ফুল খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে পাকা কাঁঠালের গন্ধ ধরেই তাকে খুঁজে বের করতে হয়।
কবির কথায়-‘বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে’। অর্থাৎ বাদলদিনে মালতী ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। সত্যিই তো, আষাঢ়ের অঝোরধারার মধ্যেই মালতী ফোটে। সামান্য মোড়ানো পাঁচ পাপড়ির অপূর্ব সুগন্ধি সাদা ফুল।
বর্ষা আসার আগেই লতা-পাতায় বেশ ঝোপালো হয়ে ওঠে গাছটি। রাতের শেষ প্রহরে বাসি ফুল ঝরে পড়ে গাছতলায়। মালতী নামের সঙ্গে আমরা যতটা পরিচিত ফুলটির সঙ্গে ঠিক ততটা নয়। কারণ ফুলটি দুর্লভ।
বর্ষায় কিছু ওষুধি গাছেও ফুল ফোটে। সেরকম দুটি ফুল হচ্ছে সর্পগন্ধা ও উলটচণ্ডাল। নিশিন্দাও এ মৌসুমে বেশি ফোটে। উলটচণ্ডাল লতানো গাছ। কয়েক রঙের মিশেলে ফুল ভারি সুন্দর। তবে গন্ধহীন। সর্পগন্ধা গুল্ম শ্রেণির গাছ। লালচে রঙের গুচ্ছ ফুল ফোটে পাতার কোলে।
মেঘ-মেদুর বর্ষায় আমাদের চারপাশে কিছু ভিনদেশি ফুলও ফোটে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিলেতি জারুল ও ক্রেব বা ফুরুস। ক্রেবকে এখানে চেরি নামে চালানো হচ্ছে। সাদা ও গোলাপি রঙের ফুলগুলো ভারি সুন্দর। বড় জাতের নীলচে বেগুনি রঙের আরেকটি ফুলও ইদানীং এখানে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ষার স্নিগ্ধ প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে আরও কিছু ফুল—নাগলিঙ্গম, হাসনাহেনা, চালতাফুল, নিশিপদ্ম, বাওবাব, জুঁই, সুখদর্শন, চামেলি, হংসলতা, সুলতানচাঁপা ইত্যাদি।
আমরা কি কখনো নদীর কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখেছি, কিংবা ওপারের প্রলয় মেঘ, শুধু টাপুরে কিংবা গয়নায় চেপে ভয়ার্ত সেই বৃষ্টিকে অতিক্রম করার সাধ্য হয়তো আমার নেই। সাগরের কাছেও যেতে পারি, বৃষ্টিস্নাত ঝাপসা ঢেউগুলো কী অবলীলায় পাড় ভাঙে। কিংবা ক্ষণিক বৃষ্টির জন্য পাহাড়ের কাছে, যেখানে নেবু পাতা আর পেয়ারার গায়ে জমে জলকণা।
Leave a Reply
Your identity will not be published.