শম্পা কী চায়? (দশম পর্ব)

শম্পা কী চায়? (দশম পর্ব)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন দশম পর্ব।]

বিশ্বাস করুন, আমি শম্পাকে খুন করি নি। কে করেছে আমি জানি না।

বারবার বলার পরও মগবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি মকবুল হাসান আমার কথা পাত্তাই দিচ্ছেন না। শেষে নৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করে বললাম, আপনার কি সত্যি মনে হয় দেশের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরজি বিভাগের একজন সংবেদনশীল প্রফেসর একটা সুন্দরী মেয়েকে খুন করতে পারে? আর এই মেয়েকে খুন করে আমার কী লাভ?

জানি না ওসি মকবুল ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ফেলটেল করেছিলেন কিনা। আমার দিকে দাঁতমুখ খিচিয়ে, টেবিলে চাপড় দিয়ে বললেন, আরে রাখেন। আপনার মতো প্রফেসর বহুত দেখছি। দুনিয়ার ঘিরিঙ্গি সব।

পাশের অফিসারটি ফোঁড়ন দিল, স্যার, এইগুলা হইলো হাড্ডিচেরা শয়তান। ধুরন্ধর, ধোঁকাবাজ, আর নারীলোভী। বুদ্ধি বেশি বলে এরা এমনভাবে কুকাম করে যে বাইরে থেকে ধরাই যায় না।

ওসি মকবুল যোগ করলেন, শোনেন প্রফেসর, জেলের ভাত তো খেতেই হবে। তো মাথার পেছন দিয়ে হাত ঘুরায়ইয়া খেয়ে লাভ কী?

আপনারা কী চাচ্ছেন?

জাস্ট বইলা দেন শম্পার ডেডবডি কই রাখছেন। বডি মর্গে আইনা সবাই শান্তিতে ঘুমাইতে যাই।

আমি মরিয়া হয়ে বললাম, আমার ভাল্লাগছে না। কোনো প্রমাণ ছাড়া আপনারা আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারেন না। আমি আপনাদের স্যু করব।

এসব বলে তো মাছ ঢাকতে পারবেন না ভাইজান।

আমি আমার ওয়াইফের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার ওয়াইফের মামা হোম মিনিস্ট্রির অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি।

ওসি মকবুল আর জুনিয়র অফিসারটি সামান্য ভাবনায় পড়ল। পাশের ঘরে গিয়ে কী কথা বলে ফিরে এল। ওসি সাহেব আমাকে ফোন ফেরত দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আপনি একটা কল করতে পারবেন। পাঁচ মিনিটের ভেতর কথা শেষ করবেন।

আমি রোকসানাকে ফোন করতেই রোকসানা বলল, এখন বাজে রাত এগারোটা? তুমি কোথায়? ফোন ধরছ না কেন? আমি তো আরেকটু হলে সব ইমারজেন্সিতে কল করতাম।

রোকসানা, একটা সিরিয়াস সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা? কল লিক করেছে আবার?

শম্পা...

শম্পা কী?

শম্পা খুন হয়েছে।

রোকসানা বোধহয় চা খাচ্ছিল। মেঝেতে কাপ পড়ে কাচ-ভাঙা শব্দ হলো। রোকসানা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল, কী হয়েছে বললা?

শম্পাকে কেউ মেরে ফেলেছে। এখন বেশি কথা বলার সময় নাই। পুলিশ ভাবছে কাজটা আমি করেছি। ওরা আমাকে ইন্টারোগেশনের জন্য মগবাজার থানায় নিয়ে এসেছে। তুমি প্লিজ সিরাজ ভাইকে আসতে বলো।

সিরাজ ভাই নামকরা ব্যারিস্টার। উনি থানায় এলে নিশ্চয় আইনের প্যাঁচ কষে আমাকে আপাতত বের করে আনবেন। রোকসানা ঠান্ডা মাথার মানুষ। যতই আঘাত আসুক সে টলে যায় না, আঘাত হজম করে নেয়। এক মিনিট নীরব থেকে রুকিমণি বলল, তুমি কিছুই স্বীকার করবা না। আমি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে এখুনি কথা বলব। আর আমিও আসব মিলিকে নিয়ে।

শোন, এখন মিলিকে আনার দরকার নেই। এমব্যারেসিং ব্যাপার।

আচ্ছা। আমি একাই আসব।

রোকসানার মামার পরিচয় জানবার পর ওসি মকবুল কিছুক্ষণের জন্য জিজ্ঞাসাবাদে বিরতি দিয়েছে। এই সুযোগে আমি দুঘণ্টা আগের ঘটনা রোমন্থন করবার চেষ্টা করছি।

মিস্ত্রি চলে যাওয়ার পর শম্পা শাওয়ার ছেড়ে গোসল করছিল আর গুনগুন করে গাইছিল, আজ খেলা ভাঙার খেলা...। ওর দেওয়া ডার্ক কফি খাওয়ার পর থেকেই নিজেকে কেমন ফুরফুরে আর ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। এখন মনে পড়ছে এরকম অনুভূতি র‌্যাডিসন হোটেলেও কফি নাকি ড্রিঙ্কস খেয়ে হয়েছিল।

শম্পা যখন শাওয়ার থেকে প্রায় স্খলিতবসনা হয়ে বেরিয়ে এল, আমার মনের সব সামাজিক নৈতিক ইনহিবিশন কীভাবে যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। আমি নির্লজ্জের মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর বিদ্যুৎছটার আজ্ঞাবহ দাস বনে গিয়েছিলাম। তারপর শম্পা আমাকে কোথায় যেন টেনে নিল। ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে শম্পা আমার উপরে উঠে এল। ডান হাত বাড়িয়ে একটা ভেজা সাদা রুমাল চেপে ধরল আমার নাকে মুখে। তারপর সব ব্ল্যাঙ্ক। আধো আলো, আধো অন্ধকার।

যখন জেগে উঠলাম, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। নিজেকে শম্পার বিছানায় আবিষ্কার করে আঁতকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখলাম দেয়ালে রক্তের ছিটা। তাজা রক্ত। মেঝেতেও পড়ে আছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। আতঙ্কিত হয়ে ভাবলাম, এখানে রক্ত কেন? কী হয়েছে?

আমি বেডরুম থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে শম্পাকে ডাকলাম। না, কোথাও শম্পা নেই। তখনই শাওয়ারের ঝরঝর শব্দ কানে এল। ছুটে গেলাম বাথরুমের কাছে, দেখলাম দরজাটা ভেজানো। ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে বললাম, শম্পা তুমি কি ভেতরে? এবারও কোনো সাড়াশব্দ নাই। আস্তে করে দরজা খুলতেই দেখলাম শাওয়ারটা একাই চলছে, বাথরুম খালি। কিচেনেও কাউকে পেলাম না।

এ সময় কলিং বেলটা ডিংডং করে বেজে উঠল। বুঝলাম শম্পা হয়তো কোনোভাবে হাত কেটে ফেলেছে। ও কারণেই দেয়ালে রক্ত ছিটেছে। হয়তো সামনের ফার্মেসিতে গিয়েছিল ব্যান্ডেজ কিনতে, ভুলে সঙ্গে চাবি নিয়ে যায় নি।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ ছ জন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার। কর্তা গোছের গুরুগম্ভীর অফিসারটি বললেন, এটা কি আপনার বাসা?

জি, কিন্তু ভাড়া দেওয়া।

কী নাম আপনার?

প্রফেসর জাহিদ হাসান।

আমি মগবাজার থানার ওসি ইন চার্জ, মকবুল হাসান, ভেতরে আসতে পারি?

কারণ কী বলবেন প্লিজ?

আমাদের কেউ পরিচয় গোপন করে ফোনে জানিয়েছে এখানে একটা মার্ডার হয়েছে। একটু আগেই।

মার্ডার? কী বলছেন এসব?

জি। আপনার বেডরুমের জানালা দিয়ে কেউ একটা মার্ডার হতে দেখেছে বলে দাবি করেছেন। ভদ্রমহিলা সাহস করে নিজের নাম-পরিচয় দেন নি। হয়তো আশপাশের বাড়ি কিংবা ছাদ থেকে লক্ষ করেছেন। কমপ্লেইন যখন এসেছে, আমাদের চেক করতে হবে।

আমার আর কিছুই করার ছিল না, ওদের ভেতরে আসতে দিলাম। ওসি মকবুল সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন, এ বাড়িতে আর কে কে আছে?

একটা মেয়েই থাকে, নাম শম্পা, আমাদের ভাড়াটে।

তো আপনি এখানে কী করছেন? ভাড়া নিতে এসেছেন?

নাহ, আমি বাথরুমের কল সারাতে এসেছিলাম।

আপনি কল সারান? আপনি কি মিস্ত্রির কাজও করেন?

না, আমি মিস্ত্রি নিয়ে এসেছিলাম। মিস্ত্রি কল ঠিক করে চলে গেছে।

আর আপনি একা মিস শম্পার সঙ্গে থেকে গেছেন?

জি।

আপনি কি ম্যারিড?

জি। কিন্তু সে প্রশ্ন করছেন কেন?

বাহ, বেশ। শম্পা কোথায় এখন?

জানি না, ঘুম থেকে উঠে দেখলাম শম্পা নেই।

ঘুম থেকে উঠে মানে? আপনি শম্পার সঙ্গে ঘুমিয়েছিলেন?

আমি কোনো জবাব দিলাম না, কী বলব, আমি তো নিজেই জানি না ওর সঙ্গে ঘুমিয়েছি কিনা। ওসি মকবুল গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললেন, আমরা এখন অ্যাপার্টমেন্ট সার্চ করব।

ওসি মকবুল সঙ্গে আসা পুলিশদের সবগুলো ঘর তল্লাশি করতে বললেন। আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল। দু’ মিনিট পর বেডরুম থেকে একজন অফিসার চেঁচিয়ে উঠল, স্যার এই রুমে তাড়াতাড়ি আসেন।

ওসি মকবুল তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। আমি ওসি মকবুলের পেছন পেছন গেলাম। পুলিশ অফিসার ওসি মকবুলকে দেয়ালের রক্ত দেখিয়ে বললেন, ফ্রেশ ব্লাড, স্যার।

দেয়ালে রক্তের দিকে তাকিয়ে ওসি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে রক্ত কীভাবে এল একটু ব্যাখ্যা করবেন?

আমি জানি না, ঘুম থেকে উঠে আমিও রক্ত দেখে অবাক।

ওসি আমার দিকে কটমট করে তাকালেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। রক্ত পেয়ে ওরা আরও জোরেশোরে তল্লাশি আরম্ভ করল। বাথরুমে একটা ফলস সিলিং ছিল, তার ঝাঁপি কেউ অর্ধেক খুলে রেখেছে। একজন পুলিশ ওর ভেতর থেকে একটা রক্তমাখা দা বের করে ওসিকে দেখিয়ে বলল, স্যার, এইটা দিয়ে মার্ডার করা হয়েছে মনে হচ্ছে।

ওসি সেটা এভিডেন্স ব্যাগে ভরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শম্পার সঙ্গে আপনার কী হয়েছিল বলুন তো?

কিছুই তো হয় নি, আমি জাস্ট কল সারাতে এলাম।

জাস্ট কল সারাতে এলেন? তাহলে ওনাকে খুন করলেন কেন? অবৈধ সম্পর্কের টানাপড়েন?

বুঝলাম না।

আপনাকে উনি ব্ল্যাকমেইল করছিলেন? ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিলেন?

আমি জানি এগুলো পুলিশি কৌশল। শুরুতেই ভয় দেখিয়ে, উত্তেজিত করে বেফাঁস কথা বের করে নেবে। ওসি যা বলছেন তার তিনভাগই সত্য। হ্যাঁ, আমাকে শম্পা ব্ল্যাকমেইল করছিল, ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল, টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু আমি শম্পাকে খুন করি নি। অন্তত জ্ঞাতসারে করি নি।

আমি কী জবাব দেব ভাবছিলাম এমন সময় আরেকজন পুলিশ খাটের নিচ থেকে কালো একটা লোহার ট্রাঙ্ক বের করল। ট্রাঙ্কটা খুলতেই দেখলাম সেখানে শম্পার অর্ধস্বচ্ছ নাইট গাউন দলামোচড়া করে রাখা। রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে আছে গাউনটা। এক পাশে শম্পার মাথার একগাছি রক্তমাখা চুল গোল্লা পাকিয়ে ছোট বলের মতো বানানো। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। মগবাজার থানার ওসি আমার দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে একজন পুলিশকে বললেন, এই শয়তানটারে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে থানায় নিয়ে যান। আমি সব আলামত জব্দ করে একটু পরে আসছি।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.