[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ২১তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২
পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ পর্ব ১৯ পর্ব ২০
ছিনতাই
আমার জীবনে আমি মোট দু’বার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছি। একবার ঢাকায় আর অন্যবার নিউইয়র্কে। ঢাকার গল্পটা প্রথমে বলা যাক! সেটা উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই সালের ঘটনা। এর আগে কখনো ছিনতাইকারীর হাতে পড়ি নি, পত্রপত্রিকায় পড়েছি, নিজেও যে পড়ব তা স্বপ্নেও ভাবি নি। একদিন ভোরবেলা কমলাপুর স্টেশন থেকে বের হয়ে বেবিট্যাক্সিতে উঠেছি, গন্তব্য ধানমন্ডি এক নাম্বার রোড। ক্লান্তি আর অঘুমোর কারণে পুরো শরীর ভেঙে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর হাই তুলছি, চোখ জ্বালাপোড়া করছে, ট্রেনে মানুষজন নাক ডাকিয়ে ঘুমালেও আমি ঘুমাতে পারি না! কোনো এক বিচিত্র কারণে ভ্রমণে আমার ঘুম হয় না। বেবিট্যাক্সি চলছে, আমি কখন বাসায় পৌঁছে বিছানায় গা এলিয়ে দেব তাই ভাবছি। আমার সাথে আমার দুই বন্ধু। ওঁরা দুজন সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওদিকে কোথাও নামবে। তাদের মূল গন্তব্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি। একজন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, থাকে তিতুমির হলে, অন্যজন সিলেটের। এঁদের দুজনেই তখন ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত। আর্মস ক্যাডার। সিলেটে যে থাকে তাঁর ঢাকায় আসার মূল উদ্দেশ্য জিনিস কেনা। জিনিস মানে অস্ত্র সাথে বিচি। বিচি মানে গুলি।
যাই হোক, তিন বন্ধু বেবিট্যাক্সি করে রওনা হয়েছি, আকাশ তখনো অন্ধকার। দিনের আলো তখনো ফুটে ওঠেনি। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল, রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। তাছাড়া সেদিন ছিল শুক্রবার। ছুটির দিন। ঢাকাবাসী নিশ্চয়ই কাঁথামুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। আমাদের বেবিট্যাক্সির ড্রাইভার বেচারা হুজুর টাইপের লোক তাঁর মাথায় সবুজ পাগড়ি, গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, শরীর থেকে ভুরভুর করে আতরের গন্ধ আসছে। খুব অল্প সময়ে আমরা এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের কাছে পৌঁছে গেলাম। সিগন্যালের লাল বাতিতে আমাদের বেবিট্যাক্সিখানা দাঁড়িয়ে আছে। আমার দুই বন্ধুর একজন এই সুযোগে একটা গাঁজার স্টিক ধরিয়েছে। সে আবার গাঁজা, ফেন্সিডিলে চরমভাবে আসক্ত। আখাউড়া জংশনে দুজনেই দু’ বোতল ফেন্সিডিল পেটে চালান করেছে। তাদের মতে ফেন্সিডিল খাওয়ার পর গাঁজায় টান না দিলে নাকি নেশাটা ভালোমতন জাঁকিয়ে বসে না। বেচারা এতক্ষণ বেবিট্যাক্সির তীব্র গতির কারণে গাঁজা ধরানোর সুযোগ পায় নি। এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে। আমি নাক-মুখ চেপে আসে আছি, এই বস্তুর গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না, ঠিক তখনই কোত্থেকে দুজন লোক আমাদের বেবিট্যাক্সি ঘিরে দাঁড়াল। দুজনের চেহারা চামচিকার মতন, আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। কী ঘটছে বা কী ঘটতে যাচ্ছে তা টের পাচ্ছি কিন্তু আমার দুই বন্ধু নির্বিকার! ছিনতাইকারীদের একজন বেবিট্যাক্সির ভেতরে উঁকি দিল। তার হাতে বিশাল সাইজের এক ড্যাগার। সে কিছু বলার আগেই আমার বন্ধুটি চোখের পলকে বেবিট্যাক্সির ভেতর থেকে ছিনতাইকারীর বুক বরাবর দড়াম করে একটা লাথি বসিয়ে দিল। পুরো ঘটনাটি ঘটে লাগল বড়জোর কয়েক মিলি সেকেন্ড। আচমকা লাথি খেয়ে ছিনতাইকারী হতভম্ব। সে রাস্তায় ছিটকে পড়ল। আমি বেবিট্যাক্সিওলাকে বললাম, ভাই টান দেন। আমার বন্ধুটি বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, সাইড করে দাঁড়ান। দুজনেই ব্যাবিট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল। আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলাম, ওদের একজনের সাথে ছোট্ট বাহারি পিস্তল। সে পকেট থেকে পিস্তল বের করতেই ছিনতাইকারীরা পগারপার!
দ্বিতীয়বার ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি খোদ নিউইয়র্কে। দিন তারিখ মনে নেই, তবে সাল মনে আছে। সেটি ২০১০ সালের কথা। আমি কাজ শেষে বাসায় ফিরছি। শনিবার বিকেলে কাজে গিয়েছিলাম, এখন রবিবার। আমার মনটা আনন্দে ভরে আছে, কারণ রবিবার আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সপ্তাহের ছুটি রাত হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই একটা দিনই ছুটি। আর সেই ছুটির দিনের অর্ধেকটাই কাটে ঘুমিয়ে, বাজার সদাই করে কিংবা কাপড় ধুয়ে। তারপরও তো ছুটি! বিকেলে কাজে যেতে হবে না। পরিবারের সাথে সময় কাটানো যাবে। আমার দুই মেয়ে, যাদের সাথে এক বাড়িতে বসবাস করা সত্ত্বেও খুব একটা দেখা হয় না। কারণ আমি যখন ঘুমে মেয়ে দুটো তখন স্কুলে, ওঁরা স্কুল থেকে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি কাজে বেরিয়ে পড়ি। ফিরি গভীর রাতে। যাই হোক. দ্বিতীয় ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটে এক গ্যাসস্টেশনে।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.