১৯৭২। ২০ ডিসেম্বর। শান্তাহার থেকে রাতের ট্রেনে আমার ঢাকা আসা। শেষ রাতে তেজগাঁও ষ্টেশনে আমি। শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুবের আকাশ। ভোরের আলো ফুটল। মনে হলো অচেনা শহর আমাকে স্বাগত জানাল। এরপর সংগ্রাম। চিন্তার সংঘর্ষ। এফ.ডি.সি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! নানারকম সংগ্রাম-সংকট পেরিয়ে অবশেষে ‘মামার’ জোরে এফ.ডি.সিতে প্রবেশ। কাজী জহির নির্মিত ‘অবুঝ মন’ হিটের উষ্ণতায় এফ.ডি.সি সেই সময় কলরব মুখরিত। রাজ্জাক ভাইকে আমার প্রথম দেখা ‘অতিথি’ সিনেমার শুটিং-এ। মামা অর্থাৎ নির্মাতা আজিজুর রহমানের সহকারী হিসেবে অতিথি (১৯৭৩), পরিচয় (১৯৭৪), অমর প্রেম (১৯৭৭), অগ্নিশিখা (১৯৭৮), অশিক্ষিত (১৯৭৮), মাটির ঘর (১৯৭৯), অভিমান (১৯৭৯), ছুটির ঘন্টা (১৯৮০), মহানগর (১৯৮১), ও মায়ের আঁচল (১৯৮৪) মোট দশটি সিনেমা নির্মাণে রাজ্জাক ভাইকে কাছে পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এক জনকে কাছে থেকে দেখা এবং উজ্জ¦ল কিছু স্মৃতির আলোতে ‘তুমি রবে নীরবে’ এই কথামালা ।
আমি এক দুরন্ত যাযাবর
উল্লেখিত গীত শব্দের গান ছিল মতিয়ুর রহমান প্রযোজিত বিচিত্রা কথাচিত্রের ‘অতিথি’ সিনেমায়। যে সিনেমায় রাজ্জাকের চরিত্র ছিল একটি খুনের ভুল আসামি। খুন হয়ে যাওয়া ট্রাকড্রাইভার পরিবারের ভরণপোষণ করা এবং সময়মতো স্থানীয় থানায় এসে যথারীতি হাজিরা দেওয়া ছিল রাজ্জাকের শাস্তি। রাজ্জাক পরিবারটির মাঝে আনন্দ ফিরিয়ে আনতে পরিশ্রম করত দিন-রাত। তবুও মৃত ট্রাকড্রাইভারের স্ত্রী (রোজী ভাবি) তাকে ঘৃণা এবং অপমান করত। ফলে রাজ্জাক সর্বক্ষণই আত্মদহনে কষ্ট পেত। শুটিং সময়ে মনোপীড়নযুক্ত এক ব্যতিক্রম চরিত্রের অভিনয় আমরা লক্ষ করতাম। ‘অতিথি’ সিনেমায় রাজ্জাক ভাইয়ের কণ্ঠে গান ছিল ‘আমি এক দুরন্ত যাযাবর’। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা সত্য সাহার সুরে এই পুরো গান চিত্রায়ন করা হয় ঢাকা-সাভার-ফুলবাড়িয়া রোডে। এই গানের শুটিং-এ রাজ্জাক ভাইকে ভীষণ আবেগপূর্ণ শট দিতে দেখতাম। হয়তো গানের গীত শব্দগুলো সেই ১৯৬৪ সালে উদ্বাস্তু হয়ে তাঁর ঢাকা আসার দুঃখ জাগানিয়া স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিত।
আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অতিথি’ সিমোয় রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে শিক্ষানবীশ সহকারী হিসেবে সিনেমায় আমার প্রথম অংশগ্রহণ। রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ কম ছিল। আমার ঊর্ধ্বধাপে নূরুল ইসলাম মঙ্গল, হাসান আহমেদ এবং শিল্পী চক্রবর্তীসহ তিনজন সহকারী ছিলেন। আমার কাজ ছিল সবার অর্ডার শোনা। অভিনয়শিল্পীদের পোশাক-পরিচ্ছদের হিসাব রাখা। মাঝে মাঝে আউটডোরে রাজ্জাক ভাইয়ের মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। বর্তমানে একজন তারকা শিল্পীর ৩/৪ জন সহকারী থাকে। রাজ্জাক ভাইয়ের একজন মাত্র সেক্রেটারি ছিল। তিনি শুধু প্রতি শুক্রবার রাজ্জাক ভাইয়ের গুলশানের বাসার বাগানে আটকৌণিক চালাঘরে সকল পরিচালকদের নিয়ে বসতেন। রাজ্জাক ভাইয়ের সিডিউল বণ্টন করতেন। কোনো দিন সহকারী হয়ে শুটিং জোনে আসতেন না। রাজ্জাক ভাইয়ের বডিগার্ড অথবা শুটিং স্পটে ব্যক্তিগত সহকারী থাকত না। উনি কখনোই চাইতেন না তার জন্য প্রযোজকদের বাড়তি কিছু অর্থ খরচ হোক। মিতব্যয়িতা ছিল তাঁর জীবনের একটা লুকিয়ে রাখা আদর্শ। হয়তো সেই গুণের আলোতেই রাজ্জাক ভাই অফুরান সম্মান ও সম্পদে সম্মানিত হয়েছেন।
‘অতিথি’ সিনেমার একটি দৃশ্য ছিল রাজ্জাক ভাই শাবানাকে বাড়ি থেকে তুলে এনে আলমগীরের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করবেন। এই দৃশ্যে একজন কাজী নায়ক আলমগীর ও শাবানার বিয়ে পড়াবেন। দূরে দাঁড়িয়ে রাজ্জাক ভাই পাহারা দিবেন। দৃশ্যের শুটিংয়ের আয়োজন চলছে। ক্যামেরাম্যান সিরাজ ভাই দুই নম্বর ফ্লোরের সেট-এ লাইট করছেন। আলমগীর, শাবানা ও রাজ্জাক ভাইয়ের মেকআপ শেষ। টি. ইসলাম প্রোডাকশন ম্যানেজার ছুটাছুটি করছে। তখনো কাজী চরিত্রের অভিনেতা যোগাড় হয় নি। সেই সময়ে আজকের মতো এফ.ডি.সিতে অতিরিক্ত শিল্পীদের এত আনাগোনা ছিল না। শুটিং শুরু হবে কাজী সাহেব পাওয়া গেলে। মেকআপরুমে রাজ্জাক ভাইসহ শিল্পীরা বসে আছেন। আমি যথারীতি ফরমায়েশ খাটার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করে মেকআপম্যান সমীর আলীকে রাজ্জাক ভাই বললেন, ‘সমীর এই ছেলেকে কাজীর পোশাক পরাও। মুখে দাড়ি লাগাও।’ হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় কাজী সাহেবের গেটাপ নিয়ে শাবানা-আলমগীরের বিয়ে পড়ানো দৃশ্যে যুক্ত হলাম। সিনেমা নির্মাণে মনে রাখা হয় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সময় ও অর্থ বাঁচানোর মোক্ষম উপায়। কারণ সিনেমা নির্মাণ ক্ষেত্রে বেদবাক্য আছে, TIME IS MONEY। এই ধরনের প্রসঙ্গটি ছিল রাজ্জাক ভাইয়ের কাজের একটা দর্শন।
মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই
পঞ্চাশজন কলাকুশলী ও শিল্পীর টিম নিয়ে পরিচালক আজিজুর রহমান চট্টগ্রামের হাট হাজারি থানায় ফতেপুর গ্রামে এসেছেন। সংগীত সাধক সত্য সাহার বাড়ি। বারো দুয়ারি জমিদার ভবন, পুকুর, পূজামণ্ডপ, শশ্মানঘাট সবই এক সীমানায়। আমাদের দলে এসেছেন হাসান ইমাম, অঞ্জনা, বাবর, আখতার হোসেন, টেলিসামাদ, মাস্টার সুমনসহ রাজ্জাক ভাই। পুরোনো জমিদার বাড়িতে আমরা প্রায় সবাই চটি বিছিয়ে ঢালা বিছানায় ঘুমাতাম। মনে হতো যেন টাঙ্গাইল ময়রা জমিদার বাড়িতে পুলিশ ট্রেনিং-এ এসেছে সবাই। রাজ্জাক ভাইকে দেওয়া হয়েছে দোতলার সিঁড়িঘরে। হাজার হোক নায়করাজ। প্রতিদিন রাতেই নানা কীর্তি করেন রাজ্জাক ভাই। এই জমিদার বাড়িতে ভূত তাঁর ঘরে দরজা ধাক্কায়। তাই একা সেই সিঁড়িঘরে থাকবেন না। পরিচালক আজিজুর রহমান বুঝতে পারলেন রাজ্জাক ভাই সবার সঙ্গে আড্ডায় আনন্দে থাকতে চায়। তবুও তাঁকে সিঁড়িঘরে সম্মানে রাখা হয়েছিল। প্রকৃতই বন্ধুস্বজন ছিলেন রাজ্জাক ভাই। ১৭ দিনের একটানা শুটিং শেষের চ্যালেঞ্জ নিয়ে পরিচালক ‘অশিক্ষিত’ নির্মাণ যুদ্ধে করতেন। দিন-রাত কারও বিশ্রাম নেই। যাদের শুটিং নেই সেই শিল্পীরাও শুটিং স্পটে সহযোগিতায় উপস্থিত থাকতেন। ‘আমি এক পাহারাদার’ গানটি পরিচালক এবং রাজ্জাক ভাই দুইজন মিলে কোরিগ্রাফি করেন। ‘মাস্টারসাব আমি’ গানের শুটিংও একই কৌশলে সমাপ্ত হয়। ‘অশিক্ষিত শুটিং পর্বে’ টেলিসামাদের সঙ্গে কৌতুক অভিনেতা রবিউলও ছিল। দশ বছর বয়সী মাস্টার সুমনের প্রথম সিনেমা ‘অশিক্ষিত’। নায়করাজের সঙ্গে এই বয়সী শিশুর অভিনয় কাজটা ভাবতেই অসম্ভব মনে হবে। কিন্তু রাজ্জাক ভাই সুমনকে সর্বদা সঙ্গে রাখতেন। ‘মাস্টারসাব’ বলে ডাকতেন। রাজ্জাক ভাই শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝতেন। অসাধারণ এই মানবপ্রেমিক রাজ্জাক ভাইয়ের জীবননাট্য যতটা সংগ্রামে ভরা তার চেয়ে বেশি মানবপ্রেমে সমৃদ্ধ। সিনেমায় সংযুক্ত বন্ধুদের এবং সহকারীদের নিজ প্রযোজনা সংস্থা থেকে সিনেমা নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছেন। দুর্দিনে আমাদের মতো পরিচালকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
দোষগুণে মানুষ। তবে সিনেমার জন্য আপোষহীন শিল্পীর নাম রাজ্জাক । তাঁর সমস্ত চেতনা জুড়েই ছিল সিনেমা। অভিনয় সৌন্দর্য পিপাসা।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের রচনায় সত্য সাহার সুরে ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই, কোনোদিন কেউ যেন বলতে না পারে আমার কোনো বিদ্যা নাই’, এই গানটির কথা অনেকেরই মনে আছে। হয়তো তাদের স্মৃতিতে সুমনের মৃত্যুদৃশ্যে পাহারাদার রহমত (রাজ্জাক)-এর অভিনয় বিষয়টিও স্মরণে আছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারির ফতেপুর পল্লিগ্রামের মধ্যরাত। শুটিং দেখতে আসা শত শত দর্শনপ্রার্থীর ভিড়। দৃশ্যটি বিয়োগান্তক মুডের ছিল। রাজ্জাক ভাইয়ের গভীর মনোযোগের দরকার। নির্মাতা আজিজুর রহমান দর্শকদের ক্যামেরা ফ্রেমে এসে জড়ো হতে বললেন। রাজ্জাক ভাই সবাইকে বুঝিয়ে বললেন, দৃশ্যটি কান্নার। আপনারা চুপ করে থাকলে আমার অভিনয় ভালো হবে। আশা করছি সবাই আমার অনুরোধটি শুনবেন। ম্যাজিক-এর মতো কাজ হলো। সবাই চুপ। নীরব। দৃশ্যে গ্রাম্যপুলিশ রাজ্জাক ভাইকে সুমনের খুনের তল্লাশিপত্রে স্বাক্ষর করতে বললে, রাজ্জাক ভাইয়ের সংলাপ ছিল ‘যে ওস্তাদ আমারে দস্তখত শিখাইছে তার মৃত্যুর এজাহারে আমি দস্তখত করমু না’। সংলাপ বলছে আর কাঁদছে রাজ্জাক। কাঁদছে হাসান ইমাম, আখতার হোসেন। কাঁদতে শুরু করল উপস্থিত শত জনতা।
রাজ্জাক অভিনীত প্রতিটি দৃশ্য ঘটনা আমাদের মতো শিক্ষানবিশদের জ্ঞানতত্ত্বের আলোর সন্ধান দিত।
একদিন যেতে হবে অচিনপুর একেলা একেলা
১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাস। শাবানা প্রযোজিত প্রথম সিনেমা ‘মাটির ঘর’ নির্মাণে পুরো ইউনিট কলাকুপা বান্ধুরা এসেছে। নদীঘেঁষা গ্রাম, বটের বাগানে গ্রাম্যহাট, খেয়ানৌকায় নদী পারাপার ইত্যাদি ‘মাটির ঘর’ গল্পের জন্য উপযুক্ত লোকেশান ছিল। নির্মাতা আজিজুর রহমান, শাবানা এ.টি.এম শামসুজ্জামান, টেলিসামাদ, খলিল, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, মিজু আহমেদ ও রাজ্জাকসহ প্রায় ৫৫ জনের ইউনিট কর্মী শুটিংযুদ্ধ করত। ইউনিটের জন্য মাছ তরকারি গ্রাম্যবাজার থেকে সংগ্রহ করা হতো। এই খাবার আয়োজন করতেন প্রযোজিকা শামীম রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক টি ইসলাম। প্রতিদিন বাজারে রাজ্জাক ভাইয়ের পছন্দের মাছ-তরকারি তালিকায় থাকত এবং খাবার রান্নায় তার নির্দেশনা থাকত। গ্রাম্য মজলিশের মতো পুরো ইউনিটকর্মীরা রাতের খাবারে অংশ নিত। খাবার বৈঠকে সবার সঙ্গে রাজ্জাক ভাইও বসতেন। একজন নায়করাজের এই সরলতা অথবা নিজেকে সবার মতো মনে করা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ। খাওয়া শেষে বসত এ.টি.এম শামসুজ্জামান এবং খলিল ভাইয়ের চুটকির আসর। আনন্দ-উল্লাশে চলতে থাকে। পুরো দমে শুটিংও হতে থাকে। হঠাৎ খবর এল ডাকাত দল নাকি ইউনিটে রাতে হামলা করবে। ইউনিটের আমরা সবাই ভয়ে কম্পমান। রাজ্জাক ভাই বিষয়টি গুরুত্বে নিলেন। শুটিং ইউনিটে পানি সরবরাহ করা একজন শ্রমিককে সন্দেহ করে পাকড়াও করলেন। চলল কিছুক্ষণ ধোলাই। তারপর শান্ত হলো পরিবেশ। রাত জেগে প্রহর গুণে সবার পাহারায় থাকার পরিকল্পনা হলো। রাজ্জাক ভাইও এই পাহারা দলে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এইরূপ ঘটনায় রাজ্জাক নামের একজনকে আমরা পেয়েছিলাম। একজন নায়করাজ রাতের পাহারা কাজে অংশ নিয়ে রাত না জাগলেও পারতেন। ইউনিটের সবার জন্যই মায়া-মমতা থাকা দরকার আপন পরিবারে সদস্যের মতো। এই ভাবনাবোধ আমাদের মনে গেঁথে দিলেন রাজ্জাক ভাই। রাজ্জাক ভাই ‘মাটির ঘর’ গল্পে ছিলেন খেয়া ঘাটের মাঝি। তার উপার্জনের একমাত্র সম্বলই ছিল খেয়া নৌকা। দুষ্ট লোক (খলিল) ও তার দলের লোকেরা রাজ্জাক-এর নৌকাটি ভেঙে ফেলে।এই দৃশ্যের শুটিং ছিল কুয়াশা ঢাকা ভোরের নদীতে। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ ছিল। ক্যাামেরা নিয়ে রেজা লতিফ ও পরিচালক আজিজুর রহমান কোমর পর্যন্ত পানিতে নেমে বললেন ‘টেক’। বরফ শীতল পানিতে নামলেন শাবানা ও রাজ্জাক। দৃশ্যটি করুণ ভাবের নাটকীয় উপাদানের। রাজ্জাক ভাইয়ের পরনে ছিল প্যান্ট আর সাধারণ পোশাক। সিনেমার দৃশ্যের পূর্ণতা ফুটিয়ে তুলতে সহযোগিতা করা, সকল কষ্ট সয়ে যাওয়া রাজ্জাক ভাইয়ের অভ্যাস অথবা কর্তব্যগত দায় ছিল প্রখর। ভালো কাজের জন্য কতটুকু নিবেদিত হতে হয় সেদিন রাজ্জাক ভাই আমাদের প্রত্যক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। প্রমাণ হলো সিনেমার জন্য একমনে সয়ে যাওয়া শিল্পীর নাম রাজ্জাক।
শাবানা তুমি চিন্তা কোরো না
২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ ছিল নায়করাজের স্মরণস্মৃতি সভা। চলচ্চিত্র পরিবারের সবাই ছিল আমন্ত্রিত। রাত পোহালেই বসবে শিল্পীদের বেদনা গাঁথার হাট। পূর্ব দিন রাত নয়টায় আমায় ফোন করলেন আমেরিকা থেকে নায়িকা শাবানা। কুশল বিনিময় করে রাজ্জাক ভাইয়ের প্রসঙ্গ এল। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেল। কত কথা। কত স্মৃতি। কত মান-অভিমান। কান্নায় সুরে শাবানা এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিলেন। বলতে বলতে একদিনের শুটিং পর্বের ঘটনা বললেন, “সম্ভবত তিন নম্বর ফ্লোর হবে। পরিচালক কামাল আহমেদ ভাইয়ের সিনেমার শুটিং। দূপুরে লাঞ্চ ব্রেক-এ সিনিয়র শিল্পীদের জন্য খাবার এসেছে মেকআপ রুমে। আমার শট গ্রহণ একটু আগে শেষ হয়েছে। আমি মেকআপ রুমে এসে খেতে বসেছি। তখনো ৩নং ফ্লোরে রাজ্জাক ভাইয়ের ক্লোজআপ শট কামাল ভাই টেক করছিলেন। আমার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। প্রোডাকশন বয়ের হাতে খাবারের বাটি ও মেকআপ আ্যসিসটেন্ট হাত ধোয়ার সাবান ও তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় রাজ্জাক ভাই মেকআপ রুমে প্রবেশ করেন। আমাকে লক্ষ করে হঠাৎ বলে, ‘শাবানা তুমি এখনো খাচ্ছো। উঠে পড়। আর খেতে হবে না’। সংলাপগুলো একটু চড়া সুরে ছিল। আমি তো হতবাক। খাবারের শেষ অংশটুকু আর খেতে পারলাম না। মেকআপ আ্যাসিসট্যান্ট ও প্রোডাকশন বয়দের সামনে আমি মনে মনে খুবই অপমান বোধ করলাম। থালা রেখে বাথরুমে গিয়ে ক’ মিনিট কাঁদলামও। এর পর তিন দিন পার হলো শুটিং চলছে। আমি রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে দৃশ্যের সংলাপ ছাড়া কথা বলছি না। রাজ্জাক ভাই বুঝতে পারলেন। শুটিং ফ্লোরের একপাশে ডেকে আমাকে বললেন, ‘দেখো শাবানা কিছু দিন ধরে আমি লক্ষ করছি তুমি কিছুটা মুটিয়ে যাচ্ছ। তোমার স্বাভাবিক সৌন্দর্য কমে যাচ্ছে। আমি চাই তুমি সুন্দর ফিগারে থাক। আমাদের চোখে গাঁথা শাবানার মতো থাকো। তাই সবার সামনে তোমাকে আমি বেশি খেতে বারণ করেছি। সবার সামনে না বললে তুমি কষ্ট পেতে না। আমার কথার গুরুত্ব দিতে না। মনে করো এটা আমার শাসন ছিল।’ কিছু স্থির চোখে চেয়ে থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের হাতটা ধরে আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। সেই কান্না আমার অভিনয় ছিল না। রাজ্জাক আমার বড়ভাইয়ের মতো ছিল। আমার বিয়ে, আমার সংসার সবকিছুতেই রাজ্জাক ভাইয়ের পরামর্শে প্রাধান্য ছিল।” এই ঘটনা বর্ণনা করার কিছুক্ষণ পর শাবানা কান্না জড়ানো কণ্ঠে আরও অস্পষ্ট কথা বললেন। তারপর আবার স্মৃতি চয়নে ফিরে গেলেন। আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, “মতি, তোর মনে পড়ে ‘মাটির ঘর’ শুটিং-এর কথা ? তুই তো ছিলি আমাদের ইউনিটের প্রধান সহকারী পরিচালক। সারা দিন-রাত শুটিং স্ক্রিপ্ট নিয়েই তোর সময় কাটত। আজকে কী শুটিং হলো কাল কী শুটিং হবে এই নিয়ে তোর টেনশন। শুটিং সমাপ্ত করা নিয়ে আমারও চিন্তা ছিল। তার চেয়ে বেশি চিন্তা ছিল, শুটিং খরচের টাকা কীভাবে সংগ্রহ হবে। শুটিং শেষে ঢাকা ফিরলেই রাজ্জাক ভাইকে পেমেন্ট দিতে হবে। যখন ফেরিঘাটে আজিজ চাচা রাজ্জাক ভাইয়ের নৌকা দৃশ্যের শুটিং করছিল। আমি অবসরে খেয়া পাড়েরঘাটে চুপ করে বসে ছিলাম। শট শেষে রাজ্জাক ভাই আমার পাশে এসে বসলেন। আমাকে বলল, ‘শাবানা তোমার সিনেমার শুটিংতো খুব সুন্দর হচ্ছে। আমারা সবাই সাধ্যমতো শ্রেষ্ঠ কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তাহলে তুমি বসে কী নিয়ে চিন্তা করছিলে ?’ আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘না রাজ্জাক ভাই তেমন কিছু না’। রাজ্জাক ভাই বললেন, “শাবানা শোন, একজন শিল্পীর শুধু অভিনয় চিন্তা থাকে । কিন্তু শিল্পী যখন নিজে প্রযোজক হয় তখন বহু ধরনের চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে। নার্ভাস করে ফেলে। আমি যখন ১৯৭৭ সালে ‘অনন্ত প্রেম’ পরিচালনা করি তখন সেই সিনেমার নায়ক হয়েও এই ধরনের চিন্তা করতাম। শোন, ঢাকা ফিরেই সব শিল্পী-কুশলীদের পারিশ্রমিক দিয়ে দিবে। তোমার সুযোগমতো আমাকে পরে পারিশ্রমিক দিও”। এই ছিল একজন শিল্পীর জন্য রাজ্জাক ভাইয়ের দরদ, ভালোবাসা অথবা সহমর্মিতা। শাবানা পুনরায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আগামী কাল তোরা যখন দিনের আলোতে ৭নং ফ্লোরে স্মরণসভায় রাজ্জাক ভাইকে স্মরণ করবি, সবাই মিলে চোখের পানি ফেলবি, আমি তখন প্রবাসে রাতের অন্ধকারে থাকব। নীরবে রাজ্জাক ভাইয়ের জন্য কাঁদব। চোখে পানি ঝরবে। কেউ জানবে না। কেউ দেখবে না রাজ্জাক ভাইয়ের জন্য শাবানার চোখের পানি।’ এই ছিল রাজ্জাক ভাইয়ের দীর্ঘদিনের সহকর্মী শাবানার প্রতিক্রিয়া।
একদিন ছুটি হবে অনেক দূরে যাব
‘ছুটির ঘণ্টা’ সিনেমা এই কথায় গানটি আজও সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। গানটি দুটি ভার্সানে রেকর্ড করা হয়েছিল। এই গানের হ্যাপি পোরেশানে যতটা আনন্দের তার চেয়ে বেশি বেদনায় ভরা। স্কুলদপ্তরির (রাজ্জাক) ভুলের কারণে স্কুল ছুটিতে বাথরুমে আটকে পড়ে স্কুল ছাত্র খোকন (সুমন) মারা যায়। প্রিয় ছাত্রের লাশসহ স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের শোকযাত্রার দৃশ্যটি আজও মনে পড়ে। শুটিং করা হয়েছিল কাপ্তাই লেক সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। রাজ্জাক ভাই সুমনকে দুই বাহুতে নিয়ে ক্যামেরা অভিমুখে হেঁটে আসছে। দূর আবহে টেপরেকোর্ডারে গান বাজছে, ‘একদিন ছুটি হবে’। পেছনে দাঁড়িয়ে টেপরেকর্ডার প্লে করার দায়িত্ব ছিল আমার। সাধন রায়ের ক্যামেরা চলছে। রাজ্জাক ভাই কাঁদছে। শোকযাত্রার দৃশ্যে স্কুল ছাত্ররা কাঁদছে। প্রযোজিকা রমলা সাহা, সত্য সাহা সবাই যেন কান্নার কলরবে ডুবে যায়। সূর্যবিদায় কালে শুটিং প্যাকআপ হয়। পরিচালক পুরো ইউনিট নিয়ে ফিরে এলেন কাপ্তাই পর্যটন হোটেলে। খোকনের (সুমন) বিদায়যাত্রায় রাজ্জাক ভাইয়ের অভিনয়ে সবাই এত বেশি আবেগপ্রবণ ছিল যে, শুটিং শেষে প্রতিরাতের আড্ডা আর বস না।
কাপ্তাই পর্যটন হোটেলের সিঁড়িতে বসে রাজ্জাক ভাই প্রতিদিন ভোরে এবং শুটিং শেষে রাতে আড্ডায় মেতে উঠতেন। সব ইউনিট সদস্যদের নিয়ে হাসি-তামাশা করতেন। মনে হতো আমরা পারিবারিক কেনো বৈঠকে আছি। মাঝখানে আছে আমাদের বড়ভাই। রাজ্জাক ভাই কৌতুক অভিনেতা রবিউলকে নিয়ে খুব মজা করতেন। রবিউল ছিল ‘ছুটির ঘন্টা’য় আতর আলী নামের এক আচার বিক্রেতা। ঝাড়ুদার চরিত্রে ছিল শাবানা। আজকাল প্রায় শোনা যায় তারকা শিল্পীরা পরিচালককে টেনশনে রাখে। শিডিউল নিয়ে ঘাপলা করে। ‘ছুটির ঘন্টা’ সিনেমায় নির্মাতা আজিজুর রহমানকে কখনোই রাজ্জাক ভাই সিডিউল টেনশনে থাকতে দেন নি। এছাড়া সত্য সাহা সংগীত পরিচালক হলেও বেটার সিনেমার জন্য খুবই নিবেদিত সিনেমা প্রযোজক ছিলেন। ‘ছুটির ঘন্টা’ ইউনিটের জন্য বড় বিষয় ছিল। যে-কোনো সমস্যা হলে সত্যদা নিজের মাথায় চুল ধরে টানাটানি করতেন। সত্যদার এটা মুদ্রা-দোষ ছিল। আর তার পাশে থাকা বৌদি (সত্য সাহার স্ত্রী) গায়ত্রী সাহার দিকে ফিরে ফিরে চাইতেন। শুটিং ইউনিটে অনেকেই এই বিষয় লক্ষ করত। সিরিয়াস হয়ে যেত।
গল্পে ছিল, স্কুল ছুটির পর ঝাড়ুদারনি (শাবানা) বাথরুম পরিষ্কার করতে গিয়ে খোকন (সুমন)-এর মৃতদেহ দেখে চিৎকার দিবে। চিৎকার শুনে সিঁড়িতে উঠতে দপ্তরি (রাজ্জাক)-এর হাত থেকে স্কুলে বাজানো পিতলের ঘণ্টা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে। চক্রাকারে ঘুরে স্থির হবে। লোকেশনে স্কুলের করিডোরে লাইটিং চলছে। শেষ বারের মতো সত্য সাহা ও এ.টি.এম শামসুজ্জামান সংলাপ নিয়ে আলোচনা করছেন। একটা বিষয় প্রকাশ না করলেই নয়, এ.টি.এম শামসুজ্জামান (এ.টি.এম ভাই অথবা খোকন ভাই) একজন গুণী সংলাপ লেখক। যার তথ্য অনেকেরই জানা নেই। আমার প্রথম সিনেমা শামীম রহমান প্রযোজিত ‘লাল কাজল’ (১৯৮২)-এর কাহিনি-সংলাপ ছিল এ.টি.এম ভাইয়ের লেখা। এই নির্লোভ, প্রচারবিমুখ শিল্পী যে ইউনিটে শুটিং-এ থাকত প্রায় সব নির্মাতাগণই এ.টি.এম ভাইয়ের পরামর্শে সংলাপ সংশোধন করে নিত। প্রতিষ্ঠিত তারকারাও অভিনয়ভঙ্গি কেমন হবে, এ.টি.এম ভাইকে প্রশ্ন করত। যথারীতি ছুটির ঘণ্টার শেষ নাটকীয় দৃশ্যের সংলাপ সংশোধন শেষে শুটিং মনিটর শুরু হয়। সবাই বেশ ঘন আবেগে স্থির হয়ে দাঁড়ানো। কায়েস ভাই, সুজাতা ভাবী, আখতার ভাই ও এ.টি.এম ভাইসহ সবাই। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে পরিচালক এবং প্রযোজক সত্য সাহা। সত্য সাহা নিঃশব্দে মাথার চুল ধরে টানাটানি করছে। শট গ্রহণের পূর্বে রাজ্জাক ভাইয়ের নজরে পড়ে সত্যদার চুল টানাটানির ঘটনা। নিঃশব্দে রাজ্জাক ভাই সত্যদাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, নো টেনশন। যথারীতি আজিজুর রহমানের নির্দেশে ৩৫ মি. মি.-এর থ্রিসি ক্যামেরা কর কর আওয়াজে চলা শুরু করল। অনর্গল রাজ্জাক ভাই সংলাপ বলে যাচ্ছে। তার হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো। ইমোশনের চূড়ান্ত পর্ব। রাজ্জাক ভাই লোহার হ্যান্ডকাপ কপালে ঠুকতে থাকে। পুরো ইউনিট স্তব্ধ। সংলাপ চলছে। অভিনয় মগ্নতায়, আবেগে লোহার হ্যান্ডকাপ দিয়ে কপাল ঠুকতে থাকে রাজ্জাক ভাই। আজিজুর রহমান দেখছেন কিন্তু একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। হয়তো রাজ্জাক ভাইয়ের কপালটাই কেটে যাবে। এই সংকট মুহূর্তে সবাই বোকার মতো দাঁড়িয়ে। রাজ্জাক ভাইয়ের ইমোশনে ব্রেক হচ্ছে না। শটও কাটা যাচ্ছে না। একসময় রাজ্জাক ভাই কাঁদতে থাকলে দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটে।
এই দৃশ্যের প্রেক্ষিতে বলা যায়, রাজ্জাক ভাই একজন খেয়ালী, ভোজনরসিক, মৎস্যশিকারি ও আমোদপ্রিয় পরিবার বান্ধব মানুষ হলেও সত্যিকার অর্থেই তিনি মনে প্রাণে একজন নিবেদিত অভিনয়শিল্পী ছিলেন।
আমিও নদীর মতো হারিয়ে যাব
১৯৯০ সালে রাজ্জাক অভিনীত মাত্র ৩টি সামাজিক সিনেমা মুক্তি পায়। এই সালের শুরুর ভাগ থেকেই এস. এস. প্রোডাকশনের ‘অন্ধ বিশ্বাস’ সিনেমার শুটিং শুরু হয়। ‘অন্ধ বিশ্বাস’ ছিল আমার পরিচালিত সিনেমা। শাবানার এস. এস. প্রোডাকশনের প্রথম সিনেমা ‘মাটির ঘর’-এর মাধ্যমেই এই প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে সাখ্যতা এবং নির্মাতা আজিজুর রহমানের সহকারী হয়ে আমার পথচলা শুরু। ‘মাটির ঘর’ নির্মাণ পর্বেই রাজ্জাক ভাইয়ের মতো গুণী শিল্পীর পরম সান্নিধ্যে আমার আসার সুযোগ ঘটে। এর প্রধান কারণ হতে পারে, ‘মাটির ঘর’ সিনেমার গল্প কথন এ.টি.এম শামসুজ্জামানের হলেও গল্পটির নির্মাণ ও লেখন সময়কালে আমার সংযুক্তি ও মনোনিবেশ ছিল একান্তভাবে ঘনিষ্ঠ। ‘মাটির ঘর’ শুটিং এ চিত্রনাট্য ও সংলাপ বিষয়ে ত্রুটি হলে রাজ্জাক ভাইয়ের প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকেই হতে হতো। আমার আপ্রাণ মনোযোগের কারণেই তার নজরে পড়ার পরিবেশটা তৈরি হয়।
‘অন্ধ বিশ্বাস’ সিনেমার গল্প ছিল আমার বন্ধু চিত্রনাট্যকার কমল সরকারের। যিনি সেই সময় দীলিপ বিশ্বাসের মতো সফল পরিচালকের একান্ত চিত্রনাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘অন্ধ বিশ্বাসে’র গল্পটি ত্রিভুজ প্রেমের ছিল। বরাবরই এস.এস. প্রোডাকশন বড় তারকা নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করত। ‘অন্ধ বিশ্বাস’ নির্মাণে ব্যতিক্রম হলো না। প্রাথমিক নির্বাচনে রাজ্জাক ভাই, আলমগীর ভাই, শাবানা, আনোয়ারা নূতন, প্রবীর মিত্র, রাজিব, আমির সিরাজী ছিল। রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে আমার পরিচালনায় এই প্রথম ও শেষ সিনেমা ‘অন্ধ বিশ্বাস’। গল্পের কাহিনি বিন্যাসে রাজ্জাক ভাইয়ের চরিত্র ছিল প্রেম আকাক্সক্ষা তাড়িত এক ধনবান যুবকের। যার আচরণ ছিল বেশ জোরালো ভিলেন অ্যাটিচুডের। গল্পটি শুনে রাজ্জাক ভাই চুপ করে থেকে বললেন, আমার সিডিউল দেখে নেই। তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হলেন না। না হওয়ারই কথা। আমাদের সিনেমায় জনপ্রিয় নায়করা ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করলে দর্শকরা গ্রহণ করতে চায় না।
আমিও নাছোড়-বান্দা—রাজ্জাক ভাইকে ‘অন্ধ বিশ্বাসে’ আমার চাই। রাজ্জাক ভাইয়ের চরিত্রটি নিয়ে আমি আরও ভাবতে শুরু করলাম। পোশাক, চরিত্রের নিচুলয়ের অভিনয়ভঙ্গিসহ তাঁর বিশেষ ও করুণ দৃশ্যের জন্য আমার প্রয়োগ ভাবনায় নির্বাচিত সংগীত ধ্বনি নিয়ে। নানামাত্রিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে সর্বদা সংযোগ রক্ষা করে চললাম। আমার এই গভীর মনোযোগ এবং গল্পে তাঁর কিছু বিষণ্ন ও শেষ বিদায় দৃশ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আমিও নদীর মতো হারিয়ে যাব, আসব না ফিরে আর কোনোদিন’ গানটি ব্যবহার হবে শুনে রাজ্জাক ভাই খুশি হলেন। ‘অন্ধ বিশ্বাস’ নির্মাণ পর্বে তার কাছে পাওয়া সহযোগিতায় মনে হয় নি আমি একজন জুনিয়র পরিচালক। বড় কথা পুরাতন হোক, নতুন হোক সবাইকে সম্মান দেওয়ার মানবিক গুণ ছিল রাজ্জাক ভাইয়ের। আমার কাজে ত্রুটি দেখলে কখনো তিনি ইউনিটকর্মীদের সামনে বলতেন না। অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে নীরবে ত্রুটিযুক্ত বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করতেন। প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেন। নায়িকা নূতন ও চম্পা রাজ্জাক ভাইয়ের স্মরণ সভায় বলেছিলেন, রাজ্জাক ভাই ছিলেন শিক্ষক। আমিও সেটা উচ্চারণ করি। একজন মহান শিল্পী রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে শেখা হয়েছে শিল্পী ও শিল্পের মানুষকে কতটা সম্মান করা উচিত। ‘অন্ধ বিশ্বাসে’র একটি নাটকীয় দৃশ্য শুটিং-এর কথা না লিখলেই নয়। গল্পে দেখানো হয়েছে রাজ্জাক ভাই শাবানা অর্থাৎ আলমগীর ভাইয়ের প্রেমিকাকে গৃহবন্দি করে নানারকম শর্তে আটকে রাখে। শাবানা নিজের জীবন দিয়ে হলেও এই কারাবন্দি থেকে মুক্তি পেতে চায়। দৃশ্যে রাজ্জাক ভাই বাড়িতে প্রবেশ করে দেখতে পায় বন্দুক হাতে শাবানা সিঁড়িতে দাঁড়ানো। রাজ্জাক ভাই উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারে না। দীর্ঘ সংলাপের পর জানা যায় বন্দুকটি গুলি শূন্য। শাবানা রাজ্জাকের কাছে বন্দুকের একটা গুলি চায়। সে আত্মহত্যা করবে। দৃশ্যটির শুটিং-এর কথা ভাবলে একজন শিল্পীর সিরিয়াসনেস-এর কথা মনে পড়ে। দৃশ্যে রাজ্জাক ভাইয়ের দীর্ঘ একক সংলাপ ছিল। সার্কুলার ট্রলিধর্মী শট ছিল। সংলাপগুলো তাঁর নিজের প্রারম্ভিক জীবনের সংগ্রাম, অর্থকষ্ট ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গের ছায়া ছিল। চলল মেকআপ রুমে সংলাপ রিহার্সেল। ৪নং ফ্লোরে সেটে ক্যামেরাম্যান মাহফুজুর রহমান লাইট-এর কারুকাজে ব্যস্ত। সংলাপ শুনে মনে মনে রাজ্জাক ভাই নিজেকে তৈরি করছিলেন। মেকআপ রুম টেবিলে রাখা টেপ রেকর্ডারে ধীর লয়ে বেজে চলেছে ‘আমিও নদীর মতো হারিয়ে যাব, আসব না ফিরে কোনোদিন’। সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে সেট-এ রাজ্জাক ভাই আসলেন। পিনপতন নীরবতা। রাজ্জাক ভাইয়ের নীরব ইশারায় ক্যামেরা অন হলো। সার্কুলার ট্রলিতে ক্যামেরা রাজ্জাক ভাইকে ফলো করে চক্রাকারে ঘুরল। গ্লিসারিন ছাড়া হৃদয় স্পর্শ করা কান্না জড়িত কণ্ঠে অভিনয় করলেন। শট শেষে রাজ্জাক ভাই চার নম্বর ফ্লোরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর সুস্থ হলেন। নীরবে সবাইকে সালাম জানিয়ে গাড়িতে করে বাসায় চলে গেলেন। মাত্র একটা দৃশ্যের শট গ্রহণেই সেদিনের ‘অন্ধ বিশ্বাসে’র শুটিং প্যাকআপ হয়েছিল।
লোকে বলে ‘অন্ধ বিশ্বাসে’র পর রাজ্জাক ভাইয়ের নায়ক চরিত্রের অভিনয়ের সুযোগ আর আসে নি। তবে ১৯৯৭ সালে তাঁর পরিচালিত ‘বাবা কেন চাকর’ সিনেমায় এ দেশের দর্শক আদর্শবান পিতা, সর্বত্যাগী এক মানব সত্তার সন্ধান পায়। নায়করাজ রাজ্জাক সিনেমা প্রেমিকদের কাছে নতুন রূপ চরিত্রে অবির্ভূত হন। সেই ১৯৬৬ সালের লক্ষ্মীন্দর, ১৯৬৯ সালে মতি, ১৯৯৭ সালে বাবা কেন চাকর সিনেমায় গাইলেন ‘আমার মতো এত সুখী আছে কজন’।
এই গান যদিও করুণ দৃশ্যর আবহে রচিত। তবুও এদেশের লক্ষ সিনেমা প্রেমিক জানে নায়করাজ রাজ্জাক সিনেমা জগতে প্রকৃতই সুখী একজন মানুষ ছিলেন। সেই সুখী মানুষটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা সুখের ঘটনার সমাপ্তি টেনে লেখাটির ইতি টানলাম।
‘আর যাহা আছে, তাহা প্রকাশের নয়, মরমে মাঝে বহে যাহা রক্তময়
বাহিরে তাহা কেমনে দেখাব’।
Leave a Reply
Your identity will not be published.