ধারাবাহিক রচনা নায়করাজ রাজ্জাক (পর্ব-১০)

ধারাবাহিক রচনা  নায়করাজ রাজ্জাক  (পর্ব-১০)

[এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।

এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।

এবার তুলে ধরা হলো রাজ্জাকের লিপে জনপ্রিয় কয়েকজন কণ্ঠশিল্পীর গানের কথা।]

চলচ্চিত্রে জুটি একটি বিশেষ বিষয়। এখানে নানা ধরনের জুটি দেখা যায়। নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, গীতিকার-সংগীত পরিচালক, এমনকি নায়ক-গায়ক ও নায়িকা-গায়িকা জুটি। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, নায়ক-নায়িকাদের জুটি গড়ে ওঠার পেছনে সাধারণত দর্শকদের দাবি বা চাহিদাই ক্রিয়াশীল। অন্যদিকে, নায়ক-গায়ক অথবা নায়িকা-গায়িকা জুটি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে দর্শক চাহিদা ছাড়াও উভয় পক্ষের কণ্ঠস্বরের বৈশিষ্ট্য প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই বিশেষ নায়ক-নায়িকার লিপে শোনা যায় বিশেষ গায়ক-গায়িকার গান। অবশ্য চলচ্চিত্রের গানে যখন ‘ডিরেক্ট টেক’-এর প্রচলন ছিল, তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই গাইতেন।

বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক-গায়ক তথা ঠোঁট ও কণ্ঠস্বরের অপূর্ব মেলবন্ধন হচ্ছে উত্তমকুমার-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বলা যায় তারা ছিলেন একজন আরেকজনের পরিপূরক। সেই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে আরেকটি জনপ্রিয় জুটি ছিল সুচিত্রা সেন-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সুচিত্রার ঠোঁটে সন্ধ্যার গান এমনভাবে মিশে যেত যে দর্শক মাঝেমাঝে বিভ্রান্ত হত, গানটি বোধহয় সত্যি সত্যি  সুচিত্রা গাইছেন।

এবার মূল প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের লিপে একসময় মাহমুদুন্নবীর অনেক গান শোনা গেছে। যেমন—গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে (স্বরলিপি), প্রেমের নাম বেদনা (নীল আকাশের নীচে), আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন (নাচের পুতুল), তুমি যে আমার কবিতা (দর্পচূর্ণ), নাচে মন ধিনা ধিনা (বেহুলা)।

পরে বশীর আহমেদ ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠের সঙ্গেও মেলবন্ধন ঘটেছিল রাজ্জাকের ঠোঁটের। বহু চলচ্চিত্রে ওই দুজন কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছেন রাজ্জাক। যেমন বশীর আহমেদের গাওয়া—ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না, অনেক সাধের ময়না আমার (ময়নামতি), আমাকে পোড়াতে যদি (মনের মত বউ), এই বৈশাখে লেখা প্রেমের চিঠি (কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি)। এসব গানে ঠোঁট মেলাতে দেখা গেছে রাজ্জাককে। অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর কণ্ঠের—ওইদূর দূর দূরান্তে (দীপ নেভে নাই), আমি কতদিন কতরাত ভেবেছি (মনের মানুষ) এসব গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন রাজ্জাক। এছাড়া খন্দকার ফারুক আহমেদ, এন্ড্রু কিশোরসহ আরও কয়েকজনের গানেও ঠোঁট মেলাতে দেখা গেছে তাকে।

তবে চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের লিপে যে কণ্ঠশিল্পীর গান সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে, তিনি হলেন খুরশীদ আলম।

সুরকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে আজাদ রহমান চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ ছবিতে। ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ওই ছবিতে রাজ্জাকের লিপে খুরশীদ আলমের একটি গান ছিল—‘বন্দি পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’। এটিই ছিল খুরশীদ আলমের প্রথম প্লেব্যাক তথা চলচ্চিত্রের গান। গানটিতে রাজ্জাকের বলার ভঙ্গি যাতে বজায় থাকে, সেজন্য রাজ্জাক খুরশীদ আলমকে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন; যেন খুরশীদ আলম পর্যবেক্ষণ করতে পারেন কীভাবে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে কথা বলেন। রেগে গেলে বা আনন্দ পেলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করেন। শর্ত ছিল গানটি যদি হিট হয়, তাহলে খুরশীদ আলম সম্মানী পাবেন। তাই গানটি চিত্রায়নের সময় রাজ্জাক মন-প্রাণ উজার করে অভিনয় করেছিলেন। ফলে কথা, সুর এবং কণ্ঠ তো বটেই রাজ্জাকের অভিনয় গুণেও গানটি জনপ্রিয় হয়। এরপর খুরশীদ আলমকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয় নি।

রাজ্জাকের লিপে খুরশীদ আলমের দ্বিতীয় গান ‘মানুষের মন’ চলচ্চিত্রে। পরিচালক মুস্তাফা মেহমুদ। গানটি ছিল ‘ছবি যেন শুধু ছবি নয়’। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং সুরকার সত্য সাহা।

‘সমাধি’ ছবিতে রাজ্জাকের লিপে রয়েছে খুরশীদ আলমের গাওয়া ‘মাগো মা’ (গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও সুরকার সত্য সাহা ) গানটি। এই গানটি খুরশীদ আলমের চলচ্চিত্র জগতে পদচারণা করার রাস্তাটি আরও প্রশস্ত করে দিয়েছিল।  ছবিতে দেখা গিয়েছিল, মা সুমিতা দেবীর উদ্দেশে নেচে নেচে গানটি গাইছে রাজ্জাক। অশোক ঘোষ পরিচালিত ‘মতি মহল’ ছবিতে খুরশীদ আলম গেয়েছেন ‘সোনা চান্দি মতিমহলের সুন্দরী’। গীতিকার রাহাত খান সুরকার শেখ আজিজুর রহমান। এই গানটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ১৯৭২ সালে কবির আনোয়ার নির্মাণ করেন ‘স্লোগান’। ওই ছবিতে একটি গান ছিল ‘তবলার তেরে কেটে তাক/আজকাল সব হয়ে গেছে বরবাদ’। এটা রাজ্জাকের লিপে ছিল। একটা বার-এর মধ্যে গানটি চিত্রায়িত হয়েছিল। গীতিকার মুকুল চৌধুরী এবং সুরকার আলম খান।

আজিম পরিচালিত ‘প্রতিনিধি’ ছবির গান ‘যৌবনটা একটা প্রেমপত্র’। ডুয়েট এই গানটি গেয়েছিলেন খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিন। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও সুরকার সত্য সাহা। রোমান্টিক গান ছিল। অংশগ্রহণ করেছিলেন রাজ্জাক ও সুজাতা। আরেকটি গান হলো ‘শহর থেকে অনেক দূরে চলেছি’। ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ছবির গানটি ট্রেনের মধ্যে চিত্রায়িত হয়। সুরকার আলম খান। গীতিকার মুকুল চৌধুরী। খুরশীদ আলমের গাওয়া এই গানটি ছবিতে রাজ্জাককে গাইতে দেখা যায়। তিনি গাইছিলেন সহযাত্রী কবরীর উদ্দেশে। ...‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ছবির ‘ও দুটি নয়নে স্বপনে চয়নে’ গানটিও জনপ্রিয় হয়েছিল। গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সুরকার আলী হোসেন। ছবিতে গানটি রাজ্জাকের লিপে ছিল।

‘ঘরসংসার’ ছবিতে ছিল খুরশীদ আলমের গাওয়া আরেকটি প্রেমের গান ‘হায়রে কী সৃষ্টি দেখে এ দৃষ্টি’। গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সুরকার আলী হোসেন। ছবিতে নায়িকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য রাজ্জাককে এই গানটি গাইতে দেখা গেছে।

সাইফুল আজম কাশেম পরিচালিত ‘সোহাগ’ ছবির একটি গান ‘এ আকাশকে সাক্ষী রেখে, এ বাতাসকে সাক্ষী রেখে’। গীতিকার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সুরকার আলী হোসেন। কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলম। ছবিতে নায়িকা ববিতার মানভঞ্জনের জন্য গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন রাজ্জাক।...‘জোকার’ ছবির ‘বাপের চোখের মণি নয়’ গানটির শিল্পীও খুরশীদ আলম। ছবিতে এ গানে রাজ্জাকের সঙ্গে তার মেয়ে ময়নাও অভিনয় করেছিল। আরেকটি চিরায়ত গান হলো  ‘ও চোখে চোখ পড়িল যখনই’। ডুয়েট এ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিন। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুরকার আজাদ রহমান।  ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে ব্যবহৃত এ গানে অংশগ্রহণ করেছেন রাজ্জাক ও ববিতা।

খুরশীদ আলমের গাওয়া এ রকম অসংখ্য গান বিভিন্ন চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের লিপে ব্যবহৃত হয়েছে, হয়েছে জনপ্রিয়। খুরশীদ আলমের ভাষ্য অনুযায়ী রাজ্জাকের ঠোঁটে তার গাওয়া গান প্রায় পঞ্চান্ন ভাগ।

Leave a Reply

Your identity will not be published.