রাবেয়া খাতুন: জীবনঘনিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক

রাবেয়া খাতুন: জীবনঘনিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক

ছয় দশক ধরে লিখেছেন রাবেয়া খাতুন। মেধা ও অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে জীবন ঘষে আগুন জ্বেলেছেন, বাংলা সাহিত্যে রেখেছেন প্রোজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর কয়েকটি বই ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর লেখায় এ দেশের সর্ববিত্ত মানুষের জীবন ফুটে উঠেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ ও নানা সম্প্রদায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। গল্প-উপন্যাসের ভৌগোলিক সীমানাও সম্প্রসারিত করেছেন তিনি। আজ ২৭ ডিসেম্বর তাঁর ৮৬তম জন্মবার্ষিকী।

রাবেয়া খাতুনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, তৎকালীন বিক্রমপুরের পাউসার গ্রামে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে। বাবা মৌলবী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ, মা হামিদা খাতুন। স্বামী চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক ফজলুল হক। চার সন্তান—ফরিদুর রেজা সাগর, কেকা ফেরদৌসী, ফরহাদুর রেজা প্রবাল ও ফারহানা কাকলী। লেখালেখির পাশাপাশি একদা রাবেয়া খাতুন শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেছেন। 

১৯৫৯ সালে সাপ্তাহিক যুগের দাবিতে প্রকাশিত হয় রাবেয়া খাতুনের প্রথম গল্প ‘প্রশ্ন’। গল্পের বিষয়বস্তু ছিল নারী নির্যাতন। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এটি এদেশের ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনের দলিল, যা এদেশের উপন্যাসে প্রথমবারের মতো উঠে আসে। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৭), মন এক শ্বেত কপোতী (১৯৬৭), রাজাবাগ শালিমারবাগ (১৯৬৯), সাহেব বাজার (১৯৬৯), ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), নীল নিশীথ (১৯৮৩), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪), মোহর আলী (১৯৮৫), ই ভরা বাদর মাহ ভাদর (১৯৮৮), বাগানের নাম মালনিছড়া (১৯৯৫)। শিশুতোষ ও ভ্রমণ সাহিত্যেও রাবেয়া খাতুন রেখেছেন সৃজনশীলতার ছাপ।...তাঁর গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র। তিনি নিজেও একদা বেতার ও টিভির জন্য নাটক লিখেছেন।

বাংলা সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রাবেয়া খাতুন পেয়েছেন বহু পুরস্কার, সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), একুশে পদক (১৯৯৩), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), শের-ই-বাংলা স্বর্ণ পদক (১৯৯৬), নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭)।

২০১৯ সালে রাবেয়া খাতুন পান ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, “আমাদের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, নানা বিবেচনায় আজ তিনি এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হলেন। লেখক হিসেবে রাবেয়া খাতুনের যে শক্তি ও দ্যুতি, সে-সম্পর্কে আমরা জানি। গত ৭০ বছর ধরে তিনি নিজ মহিমায় ভাস্বর। নিজ মহিমায় ভাস্বর হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো কাজ করে, তার অন্যতমটি তিনি তাঁর লেখালেখি শুরুর সময়েই সম্পন্ন করেছিলেন। আমরা সে-সময়টা সম্পর্কে জানি, যখন তাঁর লেখালেখির শুরু। সে-সময়ে নারী-লেখক থেকে লেখক হয়ে ওঠা ছিল অনেক বড় একটি ব্যাপার। লিঙ্গভেদে, যাঁরা লিখতেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা নারী, তাঁরা পরিচিত হতেন নারী-লেখক বা মহিলা লেখক হিসেবে। তাঁদের লেখক হিসেবে গ্রহণ না করে মহিলা লেখক বা লেখিকা হিসেবে আলাদা করে রাখার এক অঘোষিত মানসিকতা প্রবলভাবে কাজ করত সে-সময়। পুরুষতান্ত্রিকতার এই ব্যুহ ভেদ করে, কলজের জোরে যাঁরা সে-সময়ে এই পরিস্থিতি বদলে দিলেন—রাবেয়া খাতুন তাঁদের অন্যতম।

গত ৭০ বছরে রাবেয়া খাতুনের যে রচনা, তা বিপুল ও বহুমাত্রিক। তাঁর লেখা প্রথম থেকে যারা পড়বেন, তাঁরা আমাদের সমাজের পরিবর্তনের চিত্র পাবেন, সমাজের ভাঙাগড়ার ইতিহাস পাবেন, মনোজগতের বিবর্তনের চিত্রটি পাবেন, নতুন শ্রেণির উত্থানের আভাস পাবেন। তিনি আধুনিক। তাঁর বিষয় আধুনিক, তাঁর কাহিনি নির্মাণ আধুনিক, তাঁর ভাষা সেই কাহিনির সঙ্গে মানানসই। আমরা খেয়াল করে দেখি, এগোতে এগোতে তিনি আমাদের চারপাশের প্রায় সর্বত্রই আলো ফেলেছেন।

সে আলোয় শুধু যে তাঁর রচনাই আলোকিত হয়েছে তা নয়, আলো পেয়েছি আমরা, যারা পাঠক, আলো পেয়েছে আমাদের সাহিত্য।”

এ বছরের ৩ জানুয়ারি রাবেয়া খাতুন না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সাহিত্যকর্মের মাঝে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.