চাষী নজরুল ইসলাম (১৯৪১-২০১৫) এদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য এক চলচ্চিত্রকার। সুস্থ ও রুচিশীল নির্মাণে তার ভূমিকা ছিল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।...মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা ও এর অন্তর্লীন বাণীকে সেলুলয়েডের রুপালি ফিতায় তুলে ধরার ব্যাপারে চাষী নজরুল ইসলামের আন্তরিকতা আমরা লক্ষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পাঁচটি চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারোজন’-এর নির্মাতা তিনিই।...বরণীয় সাহিত্যের স্মরণীয় চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেছেন। বঙ্কিম-শরতের জনপ্রিয় উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ যেমন দিয়েছেন, এদেশের সেলিনা হোসেন ও এম. মহিউদ্দিনের উপন্যাসকেও সেলুলয়েডে বন্দি করেছেন তিনি।...জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার জীবনভিত্তিক ডকু-ফিচার ফিল্ম ‘শিল্পী’-র স্রষ্টা তিনি। ...বাজার চলতি চলচ্চিত্র নির্মাণেও তার দক্ষতা ছিল লক্ষণীয়। কিছু দিন আগে অতিবাহিত হলো তাঁর ৮৪তম জন্মবার্ষিকী। ২০০১-এর জানুয়ারির এক মিষ্টি সকালে মূলধারার এই চলচ্চিত্রকারের মুখোমুখি হয়েছিল অন্যদিন, তার সিদ্ধেশ্বরী লেনের বাসার ড্রয়িংরুমে। তার পরিবার, বোহেমিয়ান জীবন, কেরিয়ার, এখনকার চলচ্চিত্রের হালচাল—নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি মোমিন রহমানের সঙ্গে। এই কথোপকথনের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো এখানে।
জামসেদপুরের সেই দিনগুলি...
বিক্রমপুরে জন্ম হলেও চাষী নজরুল ইসলামের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ভারতের বিহারের জামশেদপুরে। সেখানকার টাটা কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন নজরুলের বাবা।
চাষী নজরুলরা থাকতেন জামশেদপুরের এগ্রিকো এরিয়াতে। এখানে ক্রিকেট, ফুটবল, অভিনয়—নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন নজরুল। স্বনামধন্য ফুটবলার পি.কে. ব্যানার্জী চাষী নজরুলের চেয়ে পাঁচ বছরের সিনিয়ার হলেও একই টিমে খেলতেন তারা।
খেলাধুলার প্রতি চাষী নজরুলের ঝোঁক থাকলেও অভিনয়ের প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ। দিলীপ কুমারের অনুরাগী তিনি বরাবরই। সেই সময় দিলীপ-অভিনীত কোনো ছবিই মিস করতেন না তিনি। কোনো কোনো ছবি একাধিকবারও তার দেখা। দিলীপের ছবি দেখতে দেখতেই চাষী নজরুলের মনে বাসনা জেগে ওঠে অভিনেতা হওয়ার। এ সময়ে পাড়ার ক্লাবের একটি নাটক—জোসন দস্তিদারের ‘দুই মহল’-এর ছোলে রাম চরিত্রে তার প্রথম মঞ্চাভিনয়। এরপর পাড়া ও স্কুলের বহু নাটক ও একাঙ্কিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। শুধু সুন্দর চেহারা, ফিগার ও দীর্ঘ দেহই নয়, তার অভিনয়-কুশলতা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অনেকেরই। এদের মধ্যে একজন হলেন তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনিই সুপারিশ করেছিলেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে চাষী নজরুলের অভিনয়ের ব্যাপারে। স্কুল-ভিত্তিক এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে চাষী নজরুল অভিনয় করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কী করছেন সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। পরে টাটার জন্মদিন উপলক্ষে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি যখন প্রদর্শিত হয়—তখন রুপালি পর্দায় নিজের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। অভিনয়ের প্রতি উৎসাহ বেড়ে যায়। চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেই হবে, নায়ক হতেই হবে—এমন দৃঢ় প্রত্যয় জেগে ওঠে মনে। এই মনোবাসনা দ্বারা তাড়িত হয়েই মায়ের হাতের বালা চুরি করে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান চলচ্চিত্র নগরী বোম্বেতে।
এ হ্যায় বোম্বে মেরি জান...
বোম্বেতে চাষী নজরুলের সঙ্গে দুই বন্ধু গিয়েছিল—চিমনভাই প্যাটেল ও মোহন রাও। তো কয়েকদিন ওখানে চলচ্চিত্র স্টুডিও-র আশেপাশে ঘোরাফেরার পর ওদের উৎসাহ মরে গেল। চিমনভাই গুজরাটে চলে গেলেন, মোহনও না বলে তার দেশে মাদ্রাজে চলে গেলেন। কিন্তু চাষী নজরুল থেকে গেলেন। মনের মাঝে তখন জেদ—চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেই হবে।
বোম্বেতে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ান, চলচ্চিত্র স্টুডিও-র আশেপাশে ঘুরঘুর করেন, থাকার জায়গা নেই বলে রেলওয়ে স্টেশনে রাতে থাকেন চাষী নজরুল; মা-র বালা বিক্রি করে যে ষাট টাকা পেয়েছিলেন, সেটি নিঃশেষ—খুবই করুণ অবস্থা। তো এমনি অবস্থায় একদিন মোহন স্টুডিও-র সামনে বসে আছেন, সামনে একটি কালো বুইক থামল (এই বুইকটিকে অবশ্য আগেও লক্ষ করেছেন। প্রতিদিন কয়েক বার আসা-যাওয়া করে গাড়িটি)। গাড়ি থেকে একজন ভদ্রলোক ডাকলেন তাকে। কাছে গেলে ভদ্রলোক তাকে নাম-ধাম, প্রতিদিন স্টুডিও-র সামনে দাঁড়িয়ে থাকার হেতু জিজ্ঞেস করলেন। চাষী নজরুল সব কিছু খুলে বললেন। ভদ্রলোক খুবই অবাক হলেন—বিহারের জামশেদপুর থেকে চাষী নজরুল অভিনয় করতে এসেছে শুনে। যাহোক ভদ্রলোক গাড়িতে উঠতে বললেন চাষী নজরুলকে। তিনি গাড়িতে উঠলেন এবং বিশদভাবে লক্ষ করতে লাগলেন ভদ্রলোককে। কালো কোট, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, হাতে কালো কৌটো—যেখানে ব্লাক অ্যান্ড হোয়াইট সিগারেট রক্ষিত; ভদ্রলোক কৌটো থেকে সিগারেট নিচ্ছেন, ধরাচ্ছেন। ভদ্রলোককে তখনো চাষী নজরুল চিনতে পারেন নি—কে তিনি!...এক সময় গাড়ি এসে থামল একটি বাড়ির সামনে। ৫০ পালি হিল বান্ড্রাবন। ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে চাষী নজরুলকে বসালেন, তারপর চলে গেলেন ওপরে।...চাষী নজরুল অপরিচিতি লোকের অপরিচিত একটি ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। এক সময় একজন খানসামা কাছে এল তার। তিনি তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোকের পরিচয়। সে তো অবাক। ‘সে কী তুমি চিন না ? তুমি এলে কী করে এখানে ? উনি তো কামাল আমরোহী’। কিন্তু তখনো চাষী নজরুল চিনতে পারেন নি কামাল আমরোহীকে। ...কিছুক্ষণ পরে ড্রয়িংরুমে এক ভদ্রমহিলা এলেন, তাকে দেখে চাষী নজরুল তো অবাক। তিনি কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন! ভদ্রমহিলা হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত নায়িকা মীনা কুমারী। তাকে দেখে চিনতে পারলেন চাষী নজরুল কামাল আমরোহীকে—‘মহল’ বানিয়ে চারদিকে যিনি সাড়া ফেলে দিয়েছেন।...কামাল সাহেব চাষী নজরুলকে গেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্যে খানসামাকে বললেন। পরদিন দুই সেট জামা-কাপড়, টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিলেন। সেদিন রাতে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার সময়ে মীনা কুমারী এটা-সেটা নানা প্রসঙ্গে কথা বলার পরে চলচ্চিত্রাভিনয়ে নিরস্ত করেন চাষী নজরুলকে। বললেন, ‘এখন তো তোমার বয়স খুবই কম। বাড়ি ফিরে যাও তুমি। আমি কথা দিচ্ছি—তুমি যদি এম.এ পাস করে আসতে পারো, আমি তোমাকে হিরো বানাব।’ তার কথা মেনে নিলেন চাষী নজরুল। কয়েকদিন স্টুডিও, বোম্বের এখানে-সেখানে ঘুরে চলে এলেন জামসেদপুরে। তারপর আর চাষী নজরুল মুখোমুখি হন নি মীনা কুমারীর। ’৭৩ সালে একটি সুযোগ এসেছিল। তখন তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারোজন’ বোম্বে চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে, অন্য একটি ছবির শুটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে তার বোম্বে যাওয়া হয় নি সেই সময়ে। তারপর যখন বোম্বে যাওয়ার কথা ভাবছেন, সেই সময়ে মীনা কুমারী মারা গেলেন। ফলে একটি দুঃখ আজও মনের মাঝে রয়ে গেছে চাষী নজরুলের।
চলচ্চিত্রের আলো-ছায়ার জগতে
‘৫৭ সালে চাষী নজরুলের বাবা মোরশেদুল আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। টাটার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এপার বাংলা তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলেন। কিছুদিন পরে তিনি মারা গেলেন। ফলত বড় ছেলে হিসেবে সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল চাষী নজরুলের কাঁধে।...মামা এস হাফিজুল্লাহর বদৌলতে এজি অফিসে চাকরি হলো।...তখন ১৯৬০ সাল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প সবে মাত্র গড়ে উঠেছে। শিক্ষিত, প্রতিভাবান ব্যক্তিরা এ মাধ্যমটিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।...চাষী নজরুল যে চলচ্চিত্র-পাগল মানুষ এ খবরটি জানা ছিল তার খালাত বোনের স্বামী সৈয়দ মোহাম্মদ আওয়ালের। তিনি নামি অভিনেতা-পরিচালক ফতেহ লোহানীর সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন চাষী নজরুলকে। ফতেহ লোহানী তখন ‘আসিয়া’ ছবিটি নির্মাণ করছিলেন। তিনি চাষী নজরুলকে এ ছবির একটি ছোট্ট চরিত্র চাপরাসির ভূমিকায় মনোনীত করেন। কিন্তু মুভি ক্যামেরার মুখোমুখি হয়ে চাষী নজরুল নার্ভাস হয়ে পড়েন। ‘আপনে তালাক কার নি কিয়াথা, হাম তালাক কার দিয়া’ এই সংলাপটি বলতে গিয়ে বারবার এনজি করেন। এক পর্যায়ে লাইট ফেলে দিয়ে পুরো ফ্লোর অন্ধকার করে ফেলেন। ক্যামেরাম্যান বাদল মহাক্রুব্ধ হয়ে চাষী নজরুলকে বকা দিলেন। চাষী নজরুল উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেড়ে পড়লেন। পরিস্থিতি সামাল দিলেন ফতেহ লোহানী, তিনি চাষী নজরুলকে সাহস জুগিয়ে আবার শট নিলেন এবং শট ওকে হলো। কিন্তু ফতেহ লোহানীর নির্দেশে পরদিন থেকে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন চাষী নজরুল। ক্লাপস্টিক দেওয়া থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রটি পরিচালনার খুটিনাটি সব কাজ শিখলেন হাতে-কলমে।...শুধু ফতেহ লোহানী নয়, ওবায়দুল হক ও মোহসিন (কারিগর)-এর সহকারীও ছিলেন চাষী নজরুল। তিনি বলেন, “এত গুণী এত জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে আমি কাজ শিখেছি, এজন্যে আমি গর্বিত। তবে তাদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারি নি আমি এখনো।”
চাষী নজরুল ‘অন্তরঙ্গ’সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এখনো সতীর্থ-বন্ধুরা অনুরোধ করলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান তিনি।
১৯৭২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘ওরা এগারোজন’-এর মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে চাষী নজরুল নির্মাণ করেন ‘সংগ্রাম’, ‘বাজীমাত’, ‘ভালো মানুষ’, ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, বিরহ ব্যথা’, ‘বেহুলা লখিন্দর’, ‘লেডি স্মাগলার’, ‘মিয়া ভাই’, ‘বাসনা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘শিল্পী’, ‘আজকের প্রতিবাদ’, ‘দাঙ্গা ফ্যাসাদ’, ‘মহাযুদ্ধ’ এবং ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। তিনি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছেন।
চাষী নজরুল ইসলামের চলচ্চিত্রের তিনটি দিক লক্ষণীয়—একদিকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের (ওরা এগারোজন/সংগ্রাম/হাঙ্গর নদী গ্রেনেড) মধ্য দিয়ে ’৭১-এ সেই দুঃসহ দিন-রাত্রিকে তুলে ধরা; আরেক দিকে সাহিত্যের চলচ্চিত্র রূপ (দেবদাস/চন্দ্রনাথ/শুভদা/বিরহ ব্যথা/পদ্মা মেঘনা যমুনা/হাঙর নদী গ্রেনেড) দেওয়া, অবশ্য অধিকাংশ রিমেক চলচ্চিত্র; অন্যদিকে একেবারেই বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রটি নির্মাণ (বাজিমাত/লেডি স্মাগলার/বাসনা...)। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই চাষী নজরুল ইসলাম প্রশংসিত হয়েছেন, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
মোমিন : মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কী সমস্যা বর্তমানে বিরাজ করছে ?
চাষী নজরুল : আর্থিক দিকটি অবশ্যই একটি ফ্যাক্টর। তবে প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ছবি করার জন্যে যে প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি দরকার, সেটাই কারও নেই। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হবে। আমার ইচ্ছা ছিল বলেই আমি মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি এবং সেই ইচ্ছা শক্তির জোরেই আগামীতে আবার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করব।
মোমিন : এটি কি উপন্যাস বা গল্পের চলচ্চিত্ররূপ হবে ?
চাষী নজরুল : না, এটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হবে। প্রয়াত সুমন আহমেদ লিখে গেছেন এ ছবির চিত্রনাট্য।
মোমিন : আপনি ‘দেবদাস’-এর রিমেক করলেন, কিন্তু আপনিও পূর্বসুরিদের মতো দেবদাস-পার্বতী চরিত্রে বয়স্ক অভিনেতা-অভিনেত্রীকে মনোনীত করলেন। কেন ?
চাষী নজরুল : এ প্রশ্নটির উত্তর শরৎচন্দ্র দিলেই ভালো করতেন। কিন্ত তিনি বেঁচে নেই। তিনি উনিশ বছরের ছেলে ও পনেরো বছরের মেয়ের মুখ দিয়ে যেসব কথা বলিয়েছেন—তা এই আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরাও বলতে পারবে না। এ জন্যেই ‘দেবদাস’ যতবার হয়েছে ততবারই নায়কের বয়স চল্লিশোর্ধ্ব ও নায়িকার বয়স ত্রিশোর্ধ্ব।
মোমিন : তাহলে ‘দেবদাস’-এ নতুন কী মাত্রা যোগ করলেন আপনি ? আমি মনে করি, এটি প্রেমের গল্প। কিন্তু দেবদাস ও পার্বতীর পরিবারের মধ্যে যে শ্রেণিগত ও গোত্রগত ব্যবধান ছিল, ছিল সমাজের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি—তাদের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এগুলিই। এইসব বিষয় হাইলাইট করলে কি নতুন মাত্রা যোগ হতো না ?
চাষী নজরুল : এ বিষয়ে আমি চিন্তাই করি নি। আমার আগে যারা ‘দেবদাস’-এর চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন, তাদের ওপর মাতব্বরি করি নি।
মোমিন : কিন্তু রাজ্জাক কেন ‘চন্দ্রনাথ’-এ ? কমার্শিয়াল ভ্যালুর জন্যে ?
চাষী নজরুল : আসলে আমার পূর্বসূরিদের অনুসরণ করেছি আমি। পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। ‘চন্দ্রনাথ’ যখন উত্তম করেন তখন তিনি চল্লিশোর্ধ।
মোমিন : উত্তমের প্রকৃত বয়স কিন্তু পর্দায় বোঝা যায় নি। অন্যদিকে রাজ্জাককে দেখে বোঝা গেছে, তার বয়স হয়ে গেছে।
চাষী নজরুল : মেকাপের ক্রুটির কারণে এমনটি হয়েছে।
মোমিন : বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’-এর চলচ্চিত্ররূপ ‘বিরহব্যথা’-য় শিল্প মান অক্ষুণ্ন থাকে নি—
চাষী নজরুল : একজন চলচ্চিত্রকারের সব কর্মই ভালো হবে—এটা আশা করা ঠিক নয়।
মোমিন : কিন্তু ‘বিরহ ব্যথা’-য় শিল্পীদের মেকাপ-গেটাপও তো সেই যুগ অনুযায়ী হয় নি।
চাষী নজরুল : মোটামুটি ঠিক আছে। আসলে আমাদের শিল্পীদের গ্ল্যামারের প্রতি দুর্বলতার কারণে আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা সময় ও চরিত্রানুযায়ী মেকাপ-গেটাপ রাখতে পারি না।
মোমিন : জহির রায়হানের ‘বেহুলা’-র রিমেক করেছেন আপনি ‘বেহুলা লখিন্দর’ নামে, কিন্তু রঙিন এ ছবিতে হাস্যকর সেট প্রকটভাবে উপস্থাপিত, সাদা-কালোতে কিন্তু এ ক্রুটি ঢাকা যেত। আপনি কী বলেন ?
চাষী নজরুল : ঠিকই বলেছেন।...যেমন, পৃথিবী যখন রঙিনের দিকে ছুটছে, তখন স্পিলবার্গ ব্লাক এন্ড হোয়াইট ছবি তৈরি করছেন। আসলে ব্লাক এন্ড হোয়াইটে চলচ্চিত্র ভাষার প্রয়োগ, আলো-ছায়ার খেলা চমৎকারভাবে করা যায়।...কালো সাপ ঢুকছে বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘরে, তখন আলো-আঁধারির ব্যঞ্জনার মাধ্যমে দর্শকদের আকর্ষণ—সম্মোহিত করা যেত। এটা সাদা-কালোতেই নিখুঁতভাবে সম্ভব।
মোমিন : রুনা লায়লার জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘শিল্পী’—যেখানে নিজের ভূমিকায় রুনা লায়লা স্বয়ং অভিনয় করেছেনÑএখানে প্রামাণ্যতা নেই। সত্য ঘটনার পাশাপাশি কল্পনারও অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
চাষী নজরুল : ‘শিল্পী’ মোটামুটি রুনা লায়লার জীবনভিত্তিক। বলা যেতে পারে ডকু-ফিচার ফিল্ম।
মোমিন : আপনার সর্বশেষ ছবি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মাত্র তিনদিন প্রদর্শিত হয়েছিল কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে। কখন ছবিটি মুক্তি পেল কখন চলে গেল অনেকেই জানে না।...ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগে যথাযথ প্রচার হয় নি কেন ?
চাষী নজরুল : এটা আমারও দুঃখ। তখন কিন্তু মিডিয়া এগিয়ে আসে নি। কেউ জিজ্ঞেস করে নি—কবে ছবিটি রিলিজ হচ্ছে। এ বিষয়ে কেউ লেখে নি পত্র-পত্রিকায়। তখন মনে হয়েছিল আমি কি এতই বাজে মেকার ? তিনদিন চলবে ?...মিনিমাম সাতদিন চলবে। তারপর ছবি চলল কি চলল না, এটা ভিন্ন ব্যাপার।
মোমিন : ‘ওরা এগারোজন’ বা ‘সংগ্রাম’ করে যতটা তৃপ্তি পেয়েছেন, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নির্মাণ করেও কি তেমনি তৃপ্ত ?
চাষী নজরুল : না। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সেলিনা হোসেন যেমন চমৎকারভাবে লিখেছেন, তেমনভাবে সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলতে পারি নি। এটা আমারই ব্যর্থতা।
মোমিন : ভালো ছবির জন্যে কী কী করা দরকার ?
চাষী নজরুল : ভালো ছবি নির্মাণের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রচণ্ডভাবে দরকার। সরকারি অনুদান প্রথা ছিল—যা আপাতত বন্ধ। এটাতেও ক্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। যে পঁচিশ লাখ টাকা দেওয়া হতো—সেটা যথেষ্ট নয়। আবার শুরুতে অংশবিশেষ শুট করে দেখাতে হবে অনুদান কমিটিকে, তারপর টাকা দেওয়া হবে—সেই টাকা পাবেন কোথায় একজন নির্মাতা ?...অনুদানের টাকা ষাট-সত্তর লাখ টাকা করতে হবে, তৎসঙ্গে থাকতে হবে এফডিসির সুযোগ-সুবিধা। এছাড়া শিল্পী ও কলাকুশলীদের সহযোগিতারও প্রয়োজন রয়েছে। ছবি রিলিজের সময়ও সরকারের ভূমিকা থাকতে হবে। ট্যাক্স ফ্রি করতে হবে। এতে দর্শক সংখ্যা বেড়ে যাবে। সরকারি মাধ্যম বিটিভিতে ছবিটির প্রচার করতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর চিত্রনাট্য দেখে নয়, ভালো নির্মাতাকে সিলেক্ট করে অনুদানের টাকা দেওয়া দরকার।...সরকারি অনুদান বিকল্প ও মূলধারা দু’ধারার নির্মাতাদেরই দেওয়া উচিত। কোনো বছর হয়তো একজন বিকল্পধারার, দু’জন মূলধারার; আবার আরেক বছর দু’জন বিকল্প ধারার ও একজন মূলধারার নির্মাতা এই অনুদানের অর্থ পেতে পারে। এভাবে এই দুই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা যেতে পারে যে, কোন ধারার নির্মাতারা ভালো ছবি নির্মাণ করল অনুদানের অর্থ দিয়ে। এতে ভালো ছবি অবশ্যই নির্মিত হবে।
মোমিন : অধুনা চলচ্চিত্রের যে দুঃসময়, অশ্লীল চলচ্চিত্রের দাপট—এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না, এই বিষবৃক্ষের উদ্ভব হতো না, যদি না চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট লোকেরা গোড়াতেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিত। আপনি কী বলেন ?
চাষী নজরুল : আমাদের চলচ্চিত্রে যে সংগঠনগুলো রয়েছে, সেগুলো যদি একত্রিত হয়, তারা যদি সত্যিই চায় এ অবস্থার অবসান—তাহলে তারা তা পারে কিন্তু।
মোমিন : এখনকার চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলেন যে, স্যাটেলাইটের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যে তারা এমন ছবি নির্মাণ করছেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের মূল দর্শকরা তো স্যাটেলাইট দেখে না।
চাষী নজরুল : এটা খোঁড়া যক্তি। তাছাড়া তারা যা দেখাচ্ছে তা স্যাটেলাইটে নেই। ফিল্মের এই দুরবস্থার জন্য মাত্র চার-পাঁচজন নির্মাতা দায়ী। বাকি যে নির্মাতারা রয়েছেন তারা যদি এদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তাহলে বিলীন হয়ে যাবে এদের অস্তিত্ব। তাছাড়া শিল্পীরা যদি বলে যে, আমরা এ ধরনের ছবিতে অভিনয় করব না, তাহলে তাদের কেউ জোর করে অভিনয় করাতে পারবে ? অশালীন পোশাক পরাতে পারবে ?
মোমিন : শিল্পীদের কেউ কেউ বলেন যে, আমরা এ ধরনের ছবিতে অভিনয় না করলে বাইরে থেকে শিল্পীরা এসে অভিনয় করবে।
চাষী নজরুল : এটা ভুল কথা। কোন নায়িকা ? আপনি তার নাম বলুন।...এটা খোঁড়া যুক্তি তাদেরই সদিচ্ছা নেই।
মোমিন : রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্প অবলম্বনে ‘কাঠগড়া’ নির্মাণ করেছিলেন আপনি। ছবিটির খবর কি ?
চাষী নজরুল : এটা অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।...ছবিটি আমি নতুন করে আবার তৈরি করব।
মোমিন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।
চাষী নজরুল : হেলাল খানের সঙ্গে আমার চূড়ান্ত কথা হয়ে গেছে, ‘হাসন রাজা’ নির্মাণ করব আমি। বর্তমানে চিত্রনাট্য লেখার কাজ চলছে। লিখছেন অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। হাসন রাজার চরিত্রে হেলাল খান অভিনয় করবেন। বাকি চরিত্রগুলোতে কারা থাকবেন—এখনো তা চূড়ান্ত হয় নি।
Leave a Reply
Your identity will not be published.