ঠোঁটের নিঃশব্দ ভাষা— চুম্বন। এ আনন্দ ও বেদনা মূর্ত করে তোলার স্বর্গীয় ভাষাও। এমনকি প্রেমের তীব্র আকুতি, স্নেহের উচ্ছ্বাস, আশ্লেষের হর্ষ, ব্যথার সমবেদনা, বিদায়ের সংকেতও প্রকাশিত হয় চুম্বনের মাধ্যমে। বলা যায়, জীবনের নানা আবেগের বহু স্তর সম্পৃক্ত এর সঙ্গে। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের এ কথাও জানিয়েছে— চুম্বন সুস্থতার নির্দেশক, জীবনের জয়গান। অবশ্য চুমুর কিছু নেতিবাচক বিষয়ও রয়েছে।... চুমুকে ঘিরে রচিত হয়েছে এ বিশেষ রচনাটি।
'অন্যদিন ঈদ ম্যাগাজিন ২০২১’ পড়তে এখানে ক্লিক করুন...
চুম্বনের ইতিহাস
চুম্বনে উত্তরণের আগে নর কিংবা নারী তাদের প্রিয় মানুষকে সোহাগ জানাতো নাকে নাক ঘষে। সময়কে খুঁড়ে জানা গেছে, যিশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে চুম্বনের সূত্রপাত ঘটেছিল এই ভারতীয় উপমহাদেশে। গভীর আবেগে এক ভারতীয় পুরুষ এবং এক ভারতীয় নারী পরস্পরের মুখ চুম্বন করেছিলেন। এ থেকেই সম্পর্ক উত্তরণের ইতিহাসের সূচনা। পরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ইতিহাস এই কথাও বলে যে, চুমুর বিষয়ে প্রথম আগ্রহী হয়েছিল রোমানরা এবং এক্ষেত্রে তারা নানা অর্থও আরোপ করেছিল। যেমন, বন্ধু, বয়োজ্যেষ্ঠ অথবা দেবদেবীকে সম্মান জানাতো তারা এক ধরনের চুম্বনে, আবার ছোটদের আদর জানাতো অন্য ধরনের চুম্বনে, প্রেমাস্পদকে ভালোবাসা জানাতো ভিন্ন আরেক ধরনের চুম্বনে এবং শরীরী সম্পর্কে পৌঁছানোর আগে গাঢ় চুম্বন। দেশে দেশে রোমান চুম্বনের নানা রীতি আজও দেখা যায়।
চুম্বনের জাতিগত স্টাইল
চুম্বনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তেমনি দেশে দেশে চুম্বনের নানা স্টাইল দেখা যায়। যেমন একটু ঝাঁকুনি মারা—এ হলো আমেরিকান চুম্বন। অন্যদিকে খুব ধীর, নম্র, পরস্পরের মুখে মৃদু চাপ দিয়ে যে চুম্বন সেটি হলো অস্ট্রিয়ার চুম্বন। বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে ইতালির চুম্বনে। কেননা এই চুম্বন হলো ক্রমান্বয়ে স্পন্দনশীল দোলায়মান এবং বেগবান। জার্মান চুম্বনেও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। সেই দেশের নর-নারীরা পরস্পরের ঠোঁট খুব ঘনিষ্ঠ সংলগ্ন থেকে সঞ্চার করে উত্তাপ। আবার ইংরেজদের চুম্বন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় উদাস প্রাণহীন কিন্তু তা ভেতরে ভেতরে সূক্ষ্ম কলাকৌশলে পূর্ণ। ফরাসি চুম্বনে বহুমাত্রিকতা রয়েছে। তারা বহু ধরনে বহুভাবে পরস্পরকে চুম্বন করে থাকে।
চুম্বনের নিঃশব্দ ভাষা
হাজার কথার চেয়েও একটি ছবি অনেক বেশি অর্থময়। একই কথা প্রযোজ্য চুম্বনের ক্ষেত্রেও। ঠোঁটের এই নিঃশব্দ ভাষায় অনেক কিছুই বাক্সময়। মায়ের চুমুতে মমতার ধারা, পিতার চুমুতে দোয়া, প্রিয় বা প্রিয়ার চুমুতে হাজার গোলাপ ফুটে ওঠে—বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলা করে দেহের শোণিতে। এমনকি স্নেহের আন্তরিক প্রকাশ, কুশল জিজ্ঞাসা, সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদিও প্রকাশিত হয় চুম্বনের নিঃশব্দ ভাষায়। যেমন, ইউরোপের অনেক দেশেই প্রবাসীকে কুশল জিজ্ঞেস করা হয় চুম্বনের মাধ্যমে। অতিথিকে সম্মান জানাতে কাঁধে চুম্বন করে পোলিশরা এবং পোশাকে চুম্বন করে চেক প্রজাতন্ত্রের অধিবাসীরা। ইতালি নারীরা পরপস্পরের হাত চুম্বন করে গভীর বন্ধুত্বের কথা জানায়। অনেক-অনেক বছর আগে, কোনো কোনো দেশে, সম্রাটের রাজপোশাকের প্রান্তদেশ চুম্বন করে তাঁর প্রতি সম্মান ও বিশ্বস্ততা প্রকাশ করা হতো। আদিম ইহুদিরা একজন আরেকজনের ঘনিষ্ঠ হলে পরস্পরের হাত, শিরোদেশ ও কাঁধে চুম্বন করে বলত, ‘শান্তিতে থাকো তুমি’। তারা কাউকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান জানাতো পা চুম্বন এমনকি পদচিহ্ন চুম্বন করে। আগের দিনে খ্রিষ্টিয় ভাই-বোনদের মধ্যে প্রীতির সম্প্রর্ক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল চুম্বনকে। পরে এই চুম্বনই এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সকলের মধ্যে আদান-প্রদানের নিয়ম হিসেবে চালু হয়।
ঠোঁটের স্বরূপ
ঠোঁটের নিঃশব্দ ভাষা চুম্বন। তাই চুম্বনের পূর্ণ তৃপ্তির জন্য দরকার যথোপযুক্ত ঠোঁট। এই ঠোঁট কেমন হবে? এ বিষয়ে প্রাচীন বাংলার ‘খেয়ালী’ পত্রিকার চতুর্থ বর্ষে ‘চুম্বন’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে হৃষীকেশ মৌলিক জানিয়েছেন যে, চুম্বনের জন্য সরস পুরুষ আর কচি কোমল ঠোঁট দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘ঠোট দুটি বেশ পুরু-প্রশস্ত হওয়া চাই, আর তা হবে অতনুর তনুর মতো বাঁকা। চুনির মতো লাল, উজ্জ্বল পরিপূর্ণ ভাদ্রের ভরা নদীর মতো।’ কিন্তু দেখা যায়, কোনো নারীর রূপের দ্যুতিতে মুগ্ধ হয়ে কোনো পুরুষ তার প্রেমে পড়ল, একদিন তার দেহের দুয়ারে ভিখারি হলো, তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলাল কিন্তু কোনো সুখ সে পেল না। অথচ কোনো নারী হয়তো সুন্দরী নয় কিন্তু চুম্বনের জন্য তার ঠোঁটই চমৎকার। আরেকটি কথা, তীব্র আকাঙ্খা অধিকাংশ সুন্দরী নারীরই নেই। অথচ সেটিই প্রাণ-সঞ্চার করে চুম্বনে।
বলাই বাহুল্য, ঠোঁট আর চুম্বন সম্পর্কে এমন ভাষ্য এই সময়ে পুরোপুরি ঠিক নয়।
চোখ খোলা নাকি বোজা অবস্থায়
চুম্বনের সময় কার চোখ খোলা থাকে, কার বোজা থাকে? কেউ কেউ বলেন, যে আগে চুম্বন করে সে চুম্বনের সময় তাকিয়ে থাকে, পরে চোখ বোজে। অন্যদিকে যে চুম্বিত হয় সে আগেই চোখ বুজিয়ে ফেলে। অন্য মতও আছে। এই দলের লোকেরা বলেন, একসঙ্গে নর-নারী চুমু খেতে শুরু করলে অনেক সময় সামান্য সময়ের জন্য তাকিয়ে থেকে পরে চোখ বুজিয়ে ফেলে। আবার কখনো একই সঙ্গে দুজন ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এনেই চোখ বুজে চুমু খেতে শুরু করে। তবে এ ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কী বলেন? তাদের মতে, মানব দেহে যে স্নায়ুগুলো রয়েছে তার ভেতরে Supraorbital এবং Frontal নামে দুটি স্নায়ু চোখের পাশ দিয়ে মগজে গিয়ে ঠেকেছে। তাই কপালের মাঝে চুমু খেলে সেই স্নায়ু দুটিতে চমৎকার একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়। একইভাবে চিবুক আর ঠোঁটে চুম্বন করলে Facial এবং Buccinator নামে দুটি স্নায়ুতে অনুভূতি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তা চলে যায় মগজে। সেই জন্যেই চুম্বন শুরু হওয়ামাত্রই চোখ এমনিতেই বুজে আসে। তবে একটি কথা, চুম্বন যেখানেই করা হোক না কেন, তাতে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয় তার গতি প্রথমত মগজে, পরে মগজ থেকে পেটের কাছে abdomen ganglion-এ আসে। অতঃপর অনুভূতি পৌঁছে বুকের কাছে Thorasic ganglion-এ। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেহের সমস্ত অণু-পরমাণুতে। এই অনুভূতির গতি ভীষণ প্রবল বলেই নর-নারীর সারাদেহ শিউরে ওঠে চুম্বনে।
কামসূত্রে চুম্বন
পৃথিবীখ্যাত যৌনগ্রন্থ ‘কামসূত্র’। এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে চুমুর বিভিন্ন কলাকৌশল সম্বন্ধে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। ডিটেইলসে চুম্বনকে তুলে ধরেছেন বাৎসায়ন। আমরা সেখান থেকে সংক্ষেপে কিছু কথা উল্লেখ করছি।
কামসূত্র অনুযায়ী চুমুর স্থান ললাট, অলক (চূর্ণকুণ্ডল, কোঁকড়ানো কেশদাম), কপোল, চোখ, বুক, স্তন, ঠোঁট এবং ঠোঁটের ভেতরের অংশ।
চুম্বন কী? এ সম্পর্কে বাৎসায়ন বলছেন, দুটি ঠোঁট ছুঁচালো করে অর্থাৎ ‘মুকুলীকৃত’ মুখের সংযোজনকেই চুম্বন বলে। তবে স্থান বিশেষে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের দান ও প্রতিদান। তাই চুম্বনেরও নানা ধরন রয়েছে। অবশ্য চুম্বনে মুখেরই প্রাধান্য বলে এখানে বাৎসায়ন মুখের কথাই বলেছেন।
উপরোষ্ঠ ও নিম্নোষ্ঠ ভেদে অপ্রাপ্ত সঙ্গম (যে নারী আগে কখনো সঙ্গম করে নি) এবং অজাতবিশ্রম্ভা (যে নারী কখনো কারও সঙ্গে প্রেমালাপ করে নি) মেয়েদের চুম্বন তিন প্রকার— নির্মিতক, স্ফুরিতক ও ঘট্টিতক। এ ধরনের চুম্বন মেয়েরাই করে থাকে।
জোর করে পুরুষ যখন কোনো নারীকে চুম্বনে নিযুক্ত করে, তখন সেই নারী পুরুষের মুখে মুখ রাখে ঠিকই কিন্তু অধর পানের চেষ্টা করে না। এ ধরনের চুম্বনকে নির্মিতক বা পরিমিত চুম্বন বলে।
কোনো নারীর মুখে পুরুষ নিজের ঠোঁট প্রবেশ করিয়ে দিলে, সেই নারী লজ্জা কিছুটা ত্যাগ করে তা হালকাভাবে চেপে ধরে ঠিকই পাশাপাশি নিজের ঠোঁট ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং পুরুষের ঠোঁট নিজের ঠোঁটে রাখতে দেয় না। আবার পুরুষ যদি নিজেই নিজের ঠোঁট বের করে আনার চেষ্টা করে তখন নারী নিজের ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে। এ ধরনের চুম্বনকে স্ফুরিতক চুম্বন বলে।
হাত দিয়ে পুরুষের চোখ ঢেকে নারী নিজেও চোখ নিমীলিত করে পুরুষের ঠোঁটের প্রান্ত অল্পভাবে ধরে চারদিক ঘুরিয়ে দেখে। এ ধরনের চুম্বনকে ঘট্টিতক চুম্বন বলে।
যখন নারী নিজের ঠোঁট দিয়ে পুরুষের ঠোঁট স্পর্শ করে মাত্র, তখন তাকে ‘নামমাত্র চুম্বন’ বলে।
যখন লজ্জাহীন নারী নিচের ঠোঁট দিয়ে পুরুষের ওষ্ঠাধরে হালকা চাপ দেয় তখন তাকে ‘স্পন্দিত চুম্বন’ বলে।
চুম্বন নিয়ে মতামতের অন্ত নেই। কোনো কোনো প-িতের মতে, চুম্বন চার প্রকার—সম, বক্র, উদ্ভ্রান্ত আর অবপীড়িতক।
সমান সমান মুখ রেখে একজন আরেকজনের অধরোষ্ঠ গ্রহণ করলে তাকে ‘সমচুম্বন’ বলে। অন্যদিকে, মুখ ঘুরিয়ে অধরোষ্ঠ ছুঁচালো করে যে চুম্বন তাকে বক্র চুম্বন বলে। আবার চিবুক ও মাথা ধরা মুখ ঘুরিয়ে যে অধরোষ্ঠ গ্রহণ, তাকে বলা হয় উদ্ভ্রান্ত চুম্বন। ঠিক সেই অবস্থায় যদি অত্যন্ত পীড়ন করে চুম্বন করা হয় তবে তাকে অবপীড়িতক চুম্বন বলে।
সাহিত্যে চুম্বন
সাহিত্যেও চুম্বন প্রতিভাত। কবিতা, গল্প, উপন্যাস— সাহিত্যের নানা শাখায়ই চুম্বন মূর্ত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে চুম্বন হলো—‘অধরের কোণে যেন অধরের ভাষা,/ দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।/ গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা,/ তীর্থ যাত্রা করিয়াছে অধর সঙ্গমে।’
প্রথম চুম্বনের শিহরণ ধরা পড়েছে দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতায়, ‘না জানি কী নিধি দিয়ে গড়িল চতুর বিধি/ প্রথম চুম্বন।/ কুহরিয়া উঠে পিক,/ শিহরিয়া উঠে দিক,/ ভরে যায় ফলফুলে শ্যামল যৌবন।’... কায়কোবাদ বলছেন: ‘সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম সম্ভাষণ,/ অতৃপ্ত হৃদয় মূলে,/ ভীষণ ঝটিকা তুলে,/ উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,/ মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন।’
চুম্বনের সৌন্দর্য ও আনন্দ ফুটে উঠেছে নজরুলের কবিতায়, ‘যা কিছু সুন্দর হেরি করেছি চুম্বন/ যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর,/ সে সবার মাঝে যেন তব হরষণ/ অনুভব করিয়াছি! ছুঁয়েছি অধর/ তিলোত্তমা তিলে তিলে! তোমারে যে করেছি চুম্বন।’
চুম্বন তথা ঠোঁটের ভাষা বাঙ্মময় হয়ে উঠেছে ওমর আলীর কবিতায় : ‘আমাকে চুমো খেলে/ দেহের স্বাদ পেলে,/ নরম লাল ঠোঁটে/ কী কথা কেঁপে ওঠে।’
চুম্বনের একটি বিশেষ দিক তুলে ধরেছেন হেলাল হাফিজ, তাঁর কবিতায়: ‘থুথুও অমৃত হয়, চুম্বকীয় চিকন চুম্বনে।’
ফারসি কবি হাফিজের কবিতায় পাই: ‘প্রেয়সীর ঠোঁট আমার অনন্ত আরাম;/ জয় হোক প্রভুর, চিত্ত লভেছে সুখধাম/ হে নিয়তি, প্রিয়ারে আঁকড়ে ধরো বুকে; / এই ধরো ঠোঁটে পানপাত্রখানি, এই ধরো সে ঠোঁটের পদ্মরাগমণি।’
এবার গল্প প্রসঙ্গ। বহু গল্পে চুম্বনের প্রসঙ্গ এসেছে। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পটি চিরকালের পাঠকের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছে। এখানে দেখা যায়, অপূর্ব বিয়ে করে গ্রামের মেয়ে মৃন্ময়ীকে। এ বিয়েতে অপূর্ব’র মা’র সায় ছিল না। কেননা মৃন্ময়ী ভীষণ চঞ্চল ও ডানপিটে প্রকৃতির। এমন মেয়ে গৃহবধূ হিসেবে আদর্শ হতে পারে না। বিয়ের পরে অবশ্য অপূর্ব’র মা’র কথাই ফলে গেল। সংসারে মৃন্ময়ীকে মনোযোগী দেখা গেল না। ফলে অপূর্ব’র মা-ও পুত্রবধূকে আপন করে কাছে টেনে নিলেন না। এই অবস্থায় অপূর্ব’র কলকাতায় ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। তারপর? রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে তুলে ধরা যাক—“ভোরের বেলায় অপূর্ব মৃন্ময়ীকে জাগাইয়া দিল— কহিল, ‘মৃন্ময়ী, আমার যাইবার সময় হইয়াছে। চলো তোমাকে তোমার মার বাড়ি রাখিয়া আসি।”
মৃন্ময়ী শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলে অপূর্ব তাহার দুই হাত ধরিয়া কহিল, ‘এখন আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমি অনেক সময় তোমায় অনেক সাহায্য করিয়াছি, আজ যাইবার সময় তাহার একটি পুরস্কার দিবে?’
মৃন্ময়ী বিস্মিত হইয়া কহিল, ‘কী।’
অপূর্ব কহিল, ‘তুমি ইচ্ছা করিয়া ভালোবাসিয়া আমাকে একটি চুম্বন দাও।’
অপূর্ব’র এই অদ্ভুত প্রার্থনা এবং গম্ভীর মুখভাব দেখিয়া মৃন্ময়ী হাসিয়া উঠিল। হাস্য সংবরণ করিয়া মুখ বাড়াইয়া চুম্বন করিতে উদ্যত হইল— কাছাকাছি গিয়া আর পারিল না, খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। এমন দুইবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে নিরস্ত হইয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। শাসনচ্ছলে অপূর্ব তাহার কর্ণমূল ধরিয়া নাড়িয়া দিল।”
মৃন্ময়ীকে মার বাড়ি রেখে অপূর্ব কলকাতা চলে গেল। তখন মৃন্ময়ীর মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল। সে কিশোরী থেকে রাতারাতি নারীতে পরিণত হলো। অপূর্বকে সে গভীরভাবে অন্তরে অনুভব করতে লাগল। মা’র বাড়িতে তার মন টিকল না। সে শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। অপূর্ব’র মা-ও মৃন্ময়ীর রূপান্তর টের পেলেন। তিনি পুত্রবধূকে আপন করে নিলেন। অতঃপর কিছুদিন পর দুজন অপূর্বকে না জানিয়ে কলকাতায় উপস্থিত হলো। উঠল অপূর্ব’র বোনের বাসায়। এদিকে একদিন অপূর্ব বোনের বাসায় হাজির হলো। মা’র সঙ্গে কথা হলো। কিন্তু সে মৃন্ময়ীর উপস্থিতি টের পেল না। রাতে ভগ্নি ও ভগ্নিপতির অনুরোধে তাদের বাসায় রাত্রিযাপন করতে সম্মত হলো। বোন তাকে শয়নগৃহের কাছে পৌঁছে দিল। ঘরে তখন অন্ধকার। বোন চলে গেলে অপূর্ব অন্ধকারে সাবধানে খাটের দিকে গেল। তারপর? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘খাটে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইতেছে এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্কণ শব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময় প্রকাশের অবসর দিল না। অপূর্ব প্রথমে চমকিয়া উঠিল, তাহার পর বুঝিতে পারিল অনেকদিনের একটি হাস্যবাধায়-অসম্পন্ন চেষ্টা আজ অশ্রুজল ধারায় সমাপ্ত হইল।’
উপন্যাসে দৃষ্টি দেওয়া যাক। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’-এ দেখতে পাচ্ছি শবনমকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছে নায়ক। নির্জন ঘরে রাতের বেলায় দুজন কথা বলছে। শবনম জানাল কান্দাহারে প্রতি রাতে স্বপ্নে আহ্বান করত সে নায়ককে। এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে ড্রইংরুমের আলো নেভাল। তারপর? নায়ক বলছে—‘আমার ছোট্ট চারপাইটির কাঠের বাজুতে হালকাভাবে বসে সেই আধো-আলো-অন্ধকারে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল—আমি বন্ধ চোখে সেটা চোখের তারাতে তারাতে দেখতে পেলুম।
এবারে তার নিঃশ্বাস আমার ঠোঁটে এসে লাগছে।
ভীরু পাখির মতো একবার তার ঠোঁট স্পর্শ করল, দুবার, শেষবারে একটু অতি ক্ষীণ চাপ।
এ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম নয়।
কৈশোরে যখন ওষ্ঠাধরের গোপন রহস্য আধা আধা কল্পনায় বুঝতে শিখেছি তখন আমি আকাশের তারার সঙ্গে মিতালী পাতাবার জন্য রাত্রিযাপন করতুম খোলা বারান্দায়। শরতের ভোরবেলা দেখতুম পাশের শিউলি গাছের চিরবেদনা—ফোঁটা ফোঁটা জলের শিউলি আমার চতুর্দিকে ছড়ানো।
এক ভোরে অনুভব করলুম ঠোঁটের উপর তারই একটি।
এ সেই হিমিকা-মাখা, শবনম-ভেজা শিউলি।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসে দেখতে পাই, একদিন রিণিদের বাসায় গিয়ে রাজকুমার টের পেল বড় হলঘরে সে গান গাইছে। গান শেষে রাজকুমারের হাত ধরে রিণি তাকে আরেকটু কাছে টানল, নিজের মুখখানা আরও উঁচু করে ধরল তার মুখের কাছে। প্রথমে রাজকুমার বুঝতে পারে নি, কিন্তু রিণির চোখ ও মুখের আহ্বান এত স্পষ্ট যে বুঝতে বেশিক্ষণ সময়ও লাগল না। রাজকুমার ‘না, ছি’ বলে উঠল। রিণি উঠে দাঁড়িয়ে একটু তফাতে সরে গেল। সেদিন আর গল্প জমল না। কয়েক মিনিট পরেই রাজকুমার বিদায় নিয়ে ঘরের বাইরে চলে এল। রিণি আবার তার গানের প্রাকটিস শুরু করে দিল, যেন চুম্বনের বদলে ধিক্কার শোনাটা তার কাছে তুচ্ছ।
রিণিদের বাড়ির রেলিং ধরে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে গিয়ে রাজকুমার অনুভব করল যে, রিণি হয়তো তাকে বর্বর মনে করেছে তার মনের সংকীর্ণতার পরিচয় পেয়ে। রাজকুমার ভাবল, ‘কী আসিয়া যাইত রিণিকে চুম্বন করিলে? চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার চেয়ে এমন কী গুরুতর ব্যাপার নরনারীর আলগা চুম্বন? একটু প্রীতি বিনিময় করা, একটু আনন্দ জাগানো, মৈত্রীর যোগাযোগকে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্পষ্টতরভাবে অনুভব করা। রিনি তাই চাহিয়াছিল।’ রাজকুমার আরও ভাবে, চুম্বনের জের চরম মিলন পর্যন্ত টেনে না চলাটাও যে যুবকযুবতীর পক্ষে সম্ভব এ ধারণাটাও তার নেই, তাই সে ভাবতে পারে নি রিণির আহ্বানে সাড়া দিলেও তাদের সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বজায় থাকবে, অসঙ্গত ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়ে যাবে না।
এমনিভাবে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোটাকম্বল’, বুদ্ধদেব গুহ’র ‘মাধুকরী’সহ নানা উপন্যাসে চুম্বন মূর্ত হয়ে উঠেছে।
চলচ্চিত্রে চুমু
চুম্বনের ব্যাপারে ভারতীয় চলচ্চিত্র দর্শকরা একদা ছিল খুবই রক্ষণশীল। তারা অশ্লীল নৃত্য উপভোগ করেছে অথচ নির্দোষ চুমুকে ছি ছি। অথচ আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে, গত শতকের চল্লিশ দশকেই ভারতীয় চলচ্চিত্র দর্শকরা রুপালি পর্দায় দেখতে পেয়েছিল চুম্বন। থ্রো আ ডাইস-এ সেই সময় হিমাংশু রায়কে চুমু খেয়েছিলেন দেবিকা রাণী। অবশ্য পঞ্চাশের দশকে, রোমান্টিক ছবির স্বর্ণযুগে, বৃষ্টিতে ভেজা নৃত্যগীতি চালু থাকলেও চুমু একেবারেই নয়। ব্যতিক্রম একমাত্র ‘আওয়ারা’। এ ছবিতে নার্গিসকে চুমু খেয়েছিলেন রাজকাপুর। তবে ঠোঁটে নয় ঘাড়ে। পরে সত্তর দশকে সুভাষ ঘাইয়ের ‘রামলক্ষণ’-এ চুমু খেতে দেখা গেল মাধুরী ও অনিল কাপুরকে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে, বলাই বাহুল্য, চুমু আরও বেড়েছে। ‘এক দুজে কে লিয়ে’-তে রতি অগ্নিহোত্রীকে চুমু খেয়েছেন কমল হাসান। ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এ জুহিকে আমির, ‘দিল’-এ মাধুরীকে আমির। ‘যো জিতা ওহি সিকান্দার’-এ পূজা বেদীকে আমির এবং ‘রাজা হিন্দুস্থানী’তে কারিশমা কাপুরকে আমির। পরেও বিভিন্ন চলচ্চিত্রে আমিরকে চুমু খেতে দেখা গেছে এবং এ ব্যাপারে তিনি সত্যি ওস্তাদ। পরিচালকদের মধ্যে চুমুর ব্যাপারে উল্লেখ করতে হয় যশ চোপড়ার নাম। তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘যাব তাক হ্যায় জান’-এও দেখা গেছে চুম্বন। এই ছবিতে কাটারিনা কাইফকে চুমু খেয়েছেন শাহরুখ খান।
নব্বই দশকের হিন্দি চলচ্চিত্রে নায়িকা সোনম ছিলেন চুমুর ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ত। ‘বিজয়’-এ তিনি ঋষি কাপুরকে এবং ‘আখরি আদালত’-এ জ্যাকি শ্রফকে অধরোষ্ঠে গ্রহণ করার সময়ে ছিলেন অত্যন্ত উষ্ণ ও আন্তরিক। অবশ্য এক্ষেত্রে সোনমের চেয়ে আগুয়ান ছিলেন জিনাত আমান। তিনি সত্তর দশকেই ‘হীরা পান্না’, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে নিঃসংকোচে চুমু খেয়েছেন দেব আনন্দ, শশি কাপুর ও অন্য সব নায়ককে।
চুমুর ব্যাপারে নায়িকা পুনম ধীলনও ছিলেন দ্বিধাহীন ও উদার। ‘তেরি কসম’ ও ‘নাম’-এ তিনি কুমার গৌরবকে চুমু খেয়েছেন অত্যন্ত সহজভাবে। তবে প্রথম ছবিতে চুমুর ব্যাপারটি ছিল স্বামীকে সংজ্ঞাহীনতা থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য। চুমু এখানে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ‘নাম’-এ চুমুর প্রয়োজনীয়তা পরিষ্কার নয়। এক সাক্ষাৎকারে তখন পুনম ধীলন জানিয়েছিলেন যে, চলচ্চিত্রে যখন তিনি নায়ককে চুমু খান তখন কোনো প্রেম বা আবেগ থাকে না। স্রেফ প্রফেশনের খাতিরে তিনি চুমু খেয়ে থাকেন।
শুরুতে মীনাক্ষি শেষাদ্রি অবশ্য চুমুর বিপক্ষে ছিলেন। তবে তার বরফশীতল মনোভাব কেটে যায় ‘ইনাম দশ হাজার’-এ সঞ্জয় দত্তকে চুমু খেতে গিয়ে। সেন্সরের কাচিতে দৃশ্যটি অবশ্য বাদ পড়ে। যা হোক, পরে ‘আওয়ারা বাপ’ ছবিতে রাজেশ খান্নাকেও চুমু খান মীনাক্ষি।
চুম্বনের ব্যাপারে আপত্তি ছিল মাধুরীরও। ক্যারিয়ারের শুরুতে যখন তার পায়ের নিচে মাটি শক্ত ছিল না, তখন প্রতিবাদ করতে পারেন নি তিনি। তাই ‘ভার্দি’, ‘দয়াবান’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রের চুম্বন দৃশ্যে অংশ নিয়েছেন তিনি। পরে অবশ্য চুমু খেতে তেমন দেখা যায় নি তাকে।
চুমুতে আপত্তি ছিল হেমা মালিনী ও শ্রীদেবীরও। ‘জোশিলে’ ছবিতে শ্রীদেবী সানি দেউলকে এবং ‘গুরু’-তে মিঠুন চক্রবর্তীকে চুমু খেতে অস্বীকার করেন শ্রীদেবী। কেননা অচেনা কাউকে চুমু খেতে অনীহা তার।
চুমু খেতে অনীহা দেখিয়েছেন ডিম্পল, অমৃতা সিং, নীলমও। যদিও ডিম্পল ‘জানবাজ’-এ অনিলকে এবং ‘ববি’ ও ‘সাগর’-এ ঋষি কাপুরকে চুমু খেয়েছেন। অমৃতাও। কিন্তু ‘আয়না’-তে তার ঠোঁট জ্যাকির ঠোঁটকে স্পর্শ করে নি।...‘টারজান’-এ খোলামেলা দৃশ্য এবং চুমুতে আগুয়ান দেখা গেছে কিমি কাটকারকে। পরে আরও কয়েকটি ছবিতে তাকে চুমু খেতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘হাম’। এ ছবিতে কিমি’র নায়ক ছিলেন অমিতাভ বচ্চন।
নব্বই দশকের শেষ পর্যায়ে অবশ্য হিন্দি চলচ্চিত্রে চুম্বন দৃশ্য অনেক সহজ হয়ে গেছে। যেমন, ‘ইস রাত কি সুবাহ নেতি’ কিংবা ‘তারাজু’। ‘সবসে বড়া খিলাড়ি’-তে অক্ষয় কুমার আর মমতা কুলকার্নী টানা দুই মিনিট চুমু খেয়ে রেকর্ডই গড়ে ফেলেছিলেন।
সাম্প্রতিক হিন্দি চলচ্চিত্রে সাহসী চুম্বন দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে ‘হেট স্টোরি’, ‘জিন্দেগি না মিলে গা দোবারা’, ‘শুদ্ধ দেশী রোমান্স’, ‘আশিকি টু’ ‘রাজনীতি’, ‘বি.এ.পাস’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কথা বলা যায়।
আর হ্যাঁ, ভারতের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে তো অনেক আগে থেকেই চুম্বন ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও নান্দনিক। যেমন, ‘পার’, ‘এক পল’, ‘আস্থা’, ‘দৃষ্টি’ ইত্যাদি।
এ ছাড়া ‘মিসিসিপি মাসালা’, ‘কামসূত্র’, ‘লা নুই বেঙ্গলি’, ‘লিটল বুদ্ধ’, ‘সিদ্ধার্থ’সহ নানা চলচ্চিত্রে চুমু খেতে দেখা গিয়েছে ভারতীয় নায়িকাদের।
বাংলা চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে বলা যায় যে, চুমুর ব্যাপারে অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল দুই বাংলাই। গত শতকের চল্লিশ দশকে অবশ্য কানন দেবীকে প্রথম চুমু খেতে দেখা গেছে। পরে চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে চুমুর দৃশ্য দেখা গেছে সত্যজিৎ রায়ের ‘পিকু’, ‘দেবী’ এবং ‘ঘরে বাইরে’-তে; দেখা গেছে অপর্ণা সেনের ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’, ‘পরমা’ এবং ‘যুগান্ত’-এ। গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কিংবা প্রসেনজিৎ-ঋতু দাশ অভিনীত ‘এক পশলা বৃষ্টি’-তেও চুমু দৃশ্য দেখা গেছে।
গত বেশ কয়েক বছরে অবশ্য সাহসী চুমুর দৃশ্য দেখা গেছে। যেমন, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’, ‘অন্দরমহল’-এ। ‘হঠাৎ নীরা’সহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রেও।
এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। এ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র অর্থাৎ নির্বাক যুগের ‘লাস্ট কিস’য়েই ছিল চুম্বন দৃশ্য। পরে অবশ্য বহু বছর চুমুর ব্যাপারে রক্ষণশীল মনোভাব দেখিয়েছে পরিচালক ও দর্শকরা। কখনো কখনো সরাসরি চুম্বন না দেখিয়ে একটু অন্যভাবে তা দেখানো হয়েছে। যেমন, রাজ্জাক পরিচালিত ‘অভিযান’-এ দেখা যায়, নদী থেকে অজ্ঞান অবস্থায় নায়িকা রোজিনাকে উদ্ধার করে রাজ্জাক। তখন তার জ্ঞান ফেরানোর জন্য তথা পেট থেকে পানি বের করার জন্য রোজিনার অধর চোষে রাজ্জাক। যা হোক, রাজ্জাকই নিজের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘অনন্ত প্রেম’-এ চুমু খেয়েছিলেন ববিতাকে। কিন্তু পরে ববিতার অনুরোধে তিনি দৃশ্যটি চলচ্চিত্র থেকে বাদ দেন। অতঃপর ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘স্বপ্নের ঠিকানাসহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে চুম্বন দৃশ্য দেখা গেছে।
উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রে প্রথম চুম্বন দেখা গেছে ১৮৯৬ সালে, ‘দ্য কিস’ ছবিতে। আর সর্বাধিক চুম্বন দেখা গেছে ‘ডন জুয়ান’ ছবিতে, ১৯২৭ সালে। এ ছবিতে মোট চুমুর সংখ্যা ১২৭।
চুম্বনের ইতিবাচক দিক
চুম্বনের নানা গুণ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা শরীর ও মনের জন্যও অত্যন্ত সহায়ক। এ প্রসঙ্গের ওপরই আলো ফেলা হচ্ছে এখানে।
জার্মানির একদল সাইকোলজিস্ট ও ফিজিশিয়ান দীর্ঘ সমীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যারা চুমু দিয়ে দিন শুরু করেন তাদের সারা দিনের কাজে অনেক কম ভ্রান্তি হয়। শরীর থাকে ঝরঝরে, কর্মদক্ষতাও অন্যদের থেকে কিছুটা বেশি থাকে। আর যারা প্রতিদিন সকালে প্রেমাস্পদকে চুমু খেয়ে কাজে বের হন, তারা ড্রাইভিং করেন খুবই ভালো। দুর্ঘটনার আশংকাও কম থাকে। শুধু তাই নয়, যাদের দিন শুরু চুমুতে, তাদের আয়ু অন্তত পাঁচ বছর বেড়ে যায়।
ফিলেম্যাটোলজি মানে চুম্বন বিজ্ঞান। সায়েন্স ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় ফিলেম্যাটোলজিস্টরা চুমু বিষয়ে জানিয়েছে, এক মিনিটের চুমুতে ২৬ ক্যালরি শক্তি খরচ হয়। সুতরাং কোনোদিন দুপুর বা রাতে বেশি খাওয়াদাওয়া হলে দশটি চুমু খাওয়া যেতে পারে। এতে অনেকটাই ক্যালরি ঝরে পড়বে।
বার্ধক্যকে প্রতিরোধ করতে, মুখের সতেজতা ধরে রাখতে মুখের ব্যায়াম অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকেরই অনীহা বা আলসেমি কাজ করে। এই ধরনের মানুষদের জন্য সুসংবাদ, চুমু খেলেও কিন্তু মুখের ভালো ব্যায়াম হয়। বিশেষত গাঢ় চুম্বনে মুখের চৌত্রিশটি মাসলই নড়াচড়া করে। হ্যাঁ, গভীর গাঢ় চুম্বন ব্যায়ামের বিকল্প হতে পারে। এমনকি তা দৌড় কিংবা প্যারাসুটিংয়ের মতো বিষয়ের সমকক্ষ। কেননা গভীর গাঢ় চুম্বনের সময় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে এমন কিছু নিউরো হরমোন নিঃসৃত হয় যা হৃৎস্পন্দনকে বাড়িয়ে দেয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগকে করে তোলে দ্রুততর।
আমাদের মুখের লালায় থাকে দশ মিলিয়ন থেকে এক বিলিয়ন জীবাণু গোষ্ঠী। অথচ চুমু খাওয়ার আগের মুহূর্তে স্যালাইভাতে এমন কিছু কেমিক্যালস তৈরি হয় যা মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে ফেলে শরীরের অনিষ্টকারী সব ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়াকে। দেখা যাচ্ছে জীবাণুর বংশ ধ্বংস করতে চুমুর ভূমিকা অনন্য।
আমাদের সন্তানরা অনেক সময় ভুল করে। অকারণে দুঃখ পায়। তাদের আশস্ত করতে বা সান্ত্বনা যোগাতে চুমু একটি চমৎকার মাধ্যম। অনেক না-বলা কথাই তখন তারা বুঝে যায় এর মাধ্যমে।
একটি তথ্য, চুম্বনের সময় চুম্বনকারীর মস্তিষ্কে বিশেষ কিছু নিউরো হরমোন নিঃসৃত হয়, যা সাময়িকভাবে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস কাটাতে সাহায্য করে। বলা যায়, বাবা-মায়ের ডিপ্রেশন কাটতে পারে সন্তানের চুম্বনে, সন্তানের উৎকণ্ঠা দূর হয়ে যায় বাবা-মা’র চুম্বনে।
চুমুর নেতিবাচক দিক
কিসিং ডিজিজ বা চুমুর অসুখ বলে একটি বিষয় আছে। এর উপসর্গের মধ্যে রয়েছে— জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরে ম্যাজম্যাজে ভাব ইত্যাদি। কারও অবশ্য গলার ভেতরে বিশেষত টনসিল গ্ল্যান্ডের ওপর সাদাটে প্যাচ হতে পারে। অনেক সময় এ অসুখকে ডিপথেরিয়া বলে ভ্রম হয়। যা হোক, এই অসুখের জীবাণুরা স্যালাইভাতে বাসা বাঁধে। তাই কপাল বা গালে চুমু খেলে সমস্যা হয় না।
চুম্বন অনেক সময় অসুখের বাহনও। ধরা যাক, নারীটির অসুখ হয়েছে। জ্বর-সর্দি। এই অবস্থায় তাকে চুমু খেল পুরুষটি। ব্যস সেও-ও জ্বর ও সর্দিতে আক্রান্ত হবে। এ ছাড়া পেটের অসুখ সৃষ্টিকারী রোটা ভাইরাস এবং নরওয়াক ভাইরাসও স্যালাইভাতে থাকে। সুতরাং কোনো পেটরোগা মানুষ যদি তার ভালোবাসার মানুষকে গাঢ় চুম্বন করেন, সেই মানুষটিও দুদিন পর পেটের সমস্যায় ভুগবেন। এমনিভাবে মাঢ়ির অসুখ জিঞ্জিভাইটিস, জিভের আলসার গ্লসাইটিস, টনসিলাইটিস, হাম, জলবসন্ত, ডিপথেরিয়া, মাম্পস ইত্যাদি জীবাণুঘটিত অসুখবিসুখগুলো চুম্বনের সময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে। তাই এ বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। বাচ্চাদের আদর করার সময় কপালে কিংবা গালে চুমু দেওয়া দরকার।
পোষা প্রাণী থেকে সাবধান। অনেকে বাড়ির পোষা কুকুর ও বিড়ালকে মুখে মুখ দিয়ে আদর করে। এ ক্ষেত্রে কুকুর-বিড়ালের শরীরে যদি জলাতঙ্ক বা রেবিস ভাইরাস থাকে, তাহলে তার লালার মাধ্যমে সংক্রমিক হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিড়াল থেকে ডিপথেরিয়ার আশংকার কথা তো সবার জানা। এ ছাড়া কুকুর-বিড়ালকে চুম্বন করলে ছোট-বড় সবারই হাইডিড্যাটিক ডিজিজ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.