৫ আগস্ট ছিল কবি মহাদেব সাহার ৮০তম জন্মদিন। ১৯৪৪ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন সিরাজগঞ্জের ধানঘড়া গ্রামে।
মহাদেব সাহা—পাঠকনন্দিত এক কবি। বাংলা কাব্যধারায় তাঁর কবিতা নমনীয় স্রোতের মতো বহমান। উচ্চনিনাদে উচ্চকিত নন তিনি। কখনো তিনি বেদনার্ত ও বিধুর। দুঃখ ও কষ্টকে নানাভাবে আবিষ্কার করেন। তাঁর কবিতায় মানুষেরই জয়গান। প্রকৃতিপ্রেমিক এই কবির কবিতায় অসংখ্যবার এসেছে গোলাপ, স্বর্ণচাপা, আকাশ, রোদ আর জলের উপমা।
মহাদেব সাহা মূলত প্রেমের কবি। হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার বারবার তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। এ ছাড়া নাগরিক জীবনের জটিলতা, কৃত্রিমতা আর যান্ত্রিকতাও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতা কবে থেকে লিখতে শুরু করেন, এ প্রসঙ্গে মহাদেব সাহা এক সাক্ষাৎকারে অন্যদিনকে বলেছিলেন, “কবিতা লেখা শুরু করি ছোটবেলা থেকেই। সাত-আট বছর বয়সে। আমার সেইসব কবিতা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়—ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে, আজাদের মুকুলের মাহফিলে, খেলাঘরে, কলকাতার লোকসেবক পত্রিকার সবুজ পাতায়। অষ্টম শ্রেণিতে যখন পড়ি, তখন গ্রামে রীতিমতো কবি হয়ে উঠেছি। সেই কবিকেই আমি বয়ে চলেছি সারা জীবন।”
মহাদেব সাহা যে প্রকৃতিমগ্ন এক কবি, তার কারণ তাঁর শৈশব কেটেছে অফুরন্ত সবুজ আর জলধারার মাঝে। বৃহত্তর পাবনা জেলার ধানঘড়া গ্রামে ছিল সেই সবুজ আর জলধারা। প্রচুর গাছপালা ও ফুলজোড় নদী। সেই নদীতে কবি নৌকায় চড়তে পছন্দ করতেন। বিশেষত গহনার নৌকায়। কেননা ওই নৌকার মাঝিরা যে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত, এ বিষয়টি তাঁকে টানত। মোষের গাড়ি, শস্যখেত, মাঠ, হাটখোলা, খেয়াঘাট, জোছনা রাত্রি, ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক, রাখালের বাঁশি, ভাটিয়ালি গান— এ সবই বালক, কিশোর মহাদেবের মনে গভীর দাগ কেটে গেছে, তাঁর কবিসত্তাকে করেছে প্রভাবিত। জীবনে প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখেছেন। এ জন্যই কি তার কবিতায় প্রকৃতি-মগ্নতা বারবার ছায়াপাত করে? এ প্রসঙ্গে অন্যদিনকে মহাদেব সাহা জানিয়েছিলেন, “আমার মধ্যে হয়তো সেই জীবনের প্রতি এক ধরনের নস্টালজিয়া আছে। তবে কবিকে তো প্রকৃতির বাইরেও আসতে হয়। যা কবিতায় থাকে—তা প্রকৃতির সত্য নয়, কিছুটা মিথ্যেও থাকে। পুরোটাই সত্য নয়। তবে প্রকৃতির ভেতর থেকে সম্পদ-ঐশ্বর্যগুলো পাওয়া এবং এগুলোকে কবিতা বা শিল্প করে তোলা যায়। প্রকৃতিমগ্নতা কবিকে ঐশ্বর্যশালী করে, সমৃদ্ধ করে বলে আমার ধারণা। এটি শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সব কবির ক্ষেত্রেই সত্য।” কবি মহাদেব সাহা কখনো কখনো বেদনার্ত ও বিধুর। দুঃখ-যন্ত্রণায় জড়িত। এমনকি ‘দুঃখ’ এই শব্দটিই তাঁর কবিতায় অসংখ্যবার এসেছে। যেমন, “হে আমার দুঃখগুলি তোমার জন্য অমল রোদনে/ মালা গাঁথার সময় তো নেই”, কিংবা “আমার এ-বুকে বাঁধা এই সেই দুঃখের পাথর/ সে কি গীর্জের গভীরে আলো, খ্রিষ্টের দর্শনলাভ...”।
কবিতায় দুঃখ বহন করা প্রসঙ্গে মহাদেব সাহা বলেন, “এটি ঠিক বুঝিয়ে বলা কঠিন। কবির জীবনে যেমন অপার দুঃখ আছে তেমনি অপার সুখও আছে। অপার দুঃখ ও অপার সুখের মিলিত জীবন হচ্ছে কবির জীবন।...শিল্পের সাথে বিষাদ জড়িত। বিষাদই শিল্পের উৎস। সব মানুষের মনের মধ্যেই শূন্যতাবোধ, হাহাকারবোধ, অপ্রাপ্তি আছে। কবি সেইসব মানুষের বেদনা নিজের কবিতায় তুলে আনে।”
মহাদেব সাহার কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, প্রেম ও ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য হলো, “ভালোবাসায় বাৎসল্য থাকে, স্নেহ থাকে, সেটা তো যে কারও যে কিছুর প্রতি হতে পারে। কিন্তু প্রেমে একজন থাকতে হয়—নারী—এককেন্দ্রিক, ভালোবাসা বহুমুখী কিন্তু প্রেম একমুখী অথচ গভীর।” ভালোবাসার শক্তিতে বিশ্বাস করেন মহাদেব সাহা। তিনি মনে করেন, ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা সম্ভব। তাই তো কবিতায় তিনি লিখেছেন: “হিংসার অস্ত্রগুলি হতে বলি বাঁশি বা বেহালা।”
মহাদেব সাহার মতে প্রেম তো সৃজনশীলতা। আর যৌনতা ও কামকেই আমরা শিল্পিত করেছি প্রেমে। তাই তো মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় লিখেছেন: “তোমাকে ভালোবাসি, রক্তমাংসসহ ভালোবাসি।” অন্য কথায়, যৌনতার বিষয়টি মহাদেব সাহা খোলাখুলিভাবে কবিতায় আনেন নি। মহাদেব সাহার কবিতায় দুজন নারীর উল্লেখ পাই বারবার—সীতা ও রাধা। কেননা প্রেম তো একদিকে থেমে থাকে না, তাই কখনো সীতা কখনো রাধা, আসলে বহু নারীর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করা যায়; কিন্তু নারী হচ্ছে সৌন্দর্যের উৎসও। বলা যায়, নারী না থাকলে শিল্পের ধারণাই তৈরি হতো না।
কবিতার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মহাদেব সাহার ভাষ্য হলো, “মানুষের যে ভবিষ্যৎ—কবিতারও তাই।” অন্যদিকে কবিতায় আধুনিকতার প্রভাব প্রসঙ্গে মহাদেব সাহার কথা হলো, “আমার মনে হয় কম্পিউটার আসুক ই-মেইল আসুক, যত কিছুই হোক না—তার জন্য মানুষের হৃদয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে না। টেকনোলজি তৈরি করবে কবিতাকে কিন্তু টেকনোলজি কবিতা লিখবে না, লিখবে হৃদয়।”
Leave a Reply
Your identity will not be published.