নক্ষত্র-নূপুর (দ্বিতীয় খণ্ড)

নক্ষত্র-নূপুর  (দ্বিতীয় খণ্ড)

[১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় ইংরেজবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন নতুন রূপ পেতে থাকে। বাংলা এবং ভারতবর্ষের এই বিপ্লবের সাথে জড়িয়ে পড়ল জার্মানি এবং রাশিয়া। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিপ্লব-প্রয়াসের প্রায় সমান্তরালে চলতে থাকল বাংলা এবং ভারতবর্ষে ইংরেজবিরোধী বিপ্লবের প্রচেষ্টা। এই উপন্যাসে একই সঙ্গে ধারণ করা হয়েছে রুশ বিপ্লবী এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বাঙালি বিপ্লবীদের প্রেম এবং বিপ্লবের কাহিনি ও এই দুই ভূখণ্ডের বিপ্লবীদের আন্তঃসম্পর্ক। লেখাটির প্রথম খণ্ডের কাহিনি শেষ হয়েছে ১৯১৪-১৫ সালে এবং এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০২৩ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে ‘অন্যদিন’-এ। এই খণ্ডের গল্প আরম্ভ হয়েছে ১৯১৪ সালের রাশিয়ায় আর শেষ হয়েছে ১৯২১-২২ সালে গিয়ে।]

 

১৮

পেট্রোগ্রাড শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে নেভা নদীর পাড় ঘিরে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এ শহরের নাম ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই এই জার্মানঘেঁষা নাম বদলে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে পেট্রোগ্রাড। এই শহরে বিশ লক্ষ মানুষ বাস করে। শহরের উত্তর দিকে ফিনল্যান্ড স্টেশন। এই নামের কারণ, রাশিয়ার ফিনল্যান্ড থেকে ট্রেন এই স্টেশনেই আসে।  ফিনল্যান্ড স্টেশন থেকে একটু দূরেই ভাইবর্গ ডিস্ট্রিক্ট। এরিকসন মেটাল অ্যান্ড মেশিন ওয়ার্কস, স্যামসন স্পিনিং অ্যান্ড উইভিং ফ্যাক্টরি, নোবেল সাহেবের বোমা বানাবার ফ্যাক্টরি—সব বড় বড় কারখানা এই ডিস্ট্রিক্টে। একটু দক্ষিণ-পশ্চিমে সুবিশাল পুলিটভ ফ্যাক্টরি। পুলিটভ ফ্যাক্টরিতে অস্ত্র, গোলাবারুদ আর রেইল ট্র্যাক বানানো হয়। দশ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করে এই এক ফ্যাক্টরিতেই। এত যে বিনিয়োগ হচ্ছে এই শহরে, তবু এখানকার শ্রমিকদের বাড়িঘরের করুণ দশা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। শ্রমিকরা থাকে লোহা আর অস্ত্রকারখানার আশেপাশের ফ্যাক্টরি কোয়ার্টারে। আর সচ্ছল নাগরিকরা থাকে শহরের দক্ষিণে, জারের উইন্টার প্যালেসের আশপাশে। গরিব আর ধনী এলাকাকে ভাগ করেছে নেভা নদী। নদীর ওপর দিয়ে অনেকগুলো ড্র ব্রিজ গরিব এলাকাকে ধনী এলাকার সাথে যুক্ত রেখেছে। কিন্তু চাইলেই যে-কোনো সময় ব্রিজগুলো উঠিয়ে ফেলা যায়। তখন ধনী এলাকা গরিব এলাকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রচুর শরণার্থী আর অভিবাসীরা পেট্রগ্রাডে আসছে। এতে শহরের গরিব এলাকার ওপর চাপ আরও বেড়ে গেছে। এতে নাগরিকদের মাঝে অসন্তোষ বেড়েই চলছে।

এম আই ওয়ান (সি) বা এম আই সিক্স-এর গোয়েন্দা অফিসার স্যামুয়েল হোর মাত্রই ব্রিটেন থেকে পেট্রোগ্রাড এসেছে। স্যামুয়েল এখন পুরো রাশিয়ার ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রধান। কিন্তু কূটনৈতিকভাবে ওকে পেট্রোগ্রাডে নতুন ব্রিটিশ লিয়াজো অফিসার হিসেবে দেখানো হয়েছে।  স্যামুয়েল হোরকে এ সময় রাশিয়া পাঠাবার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। রাশিয়া যুদ্ধ করছে জার্মানির সাথে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধটা রাশিয়া মিত্রশক্তির চাপে পড়ে হেজিপেজিভাবে করছে। জনগণের ভেতর এ যুদ্ধ নিয়ে মোটেও কোনো আগ্রহ কিংবা উন্মাদনা নেই। রাশিয়ার বিরাট পণ্য বাজারটা এতদিন জার্মানির দখলে ছিল। জার্মানি যুদ্ধে হেরে গেলে এই বাজার ব্রিটিশদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। স্যামুয়েল হোর ব্রিটেনে চেলসি থেকে নির্বাচিত এমপি ছিল। তার আগে আর্মি অফিসার হিসেবেও কাজ করেছে। স্যামুয়েল হোরেরের রাজনৈতিক আর সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আশা করা যায় রাশিয়াকে যুদ্ধে জড়িয়ে রাখা যাবে।

স্যার জর্জ বুকানান এখন রাশিয়ায় ব্রিটিশ অ্যাম্বাসেডর। বুকানান স্যামুয়েল হোরকে স্বাগত জানিয়ে বলল, শুনুন, রাশিয়া একটা ভয়াবহ জটিল জায়গা। এখানে খেলাটাও খেলতে হয় জটিল এবং কুটিলভাবে।

আপনি আরেকটু বুঝিয়ে বলুন তো।

এমআই ফাইভের আর স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের মতো রাশিয়ায় কাউন্টার ইন্টেলিগেন্স আর গোয়েন্দা সংস্থা কিন্তু একটা দুটো না।

হোমওইয়ার্ক করে বুঝেছি ওদের সিক্রেট পুলিশ হলো ওখরানা। তবে লন্ডন থেকে বলেছিল বাকি ডিটেলস আপনি আমাকে জানাবেন।

ওখরানা সবচেয়ে কুখ্যাত গোপন পুলিশ বাহিনী। এদের আসল কাজ হলো বিরোধী দলের পেছনে লেগে থাকা। কিন্তু প্রতিটা সামরিক বাহিনী, নৌ মন্ত্রণালয়, আভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের নিজ নিজ গোয়েন্দা দল আছে। 

ইন্টারেস্টিং।

এমনকি চার্চেরও প্রচণ্ড শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা আছে। কেউই কাউকে বিশ্বাস করে না। গোপন তথ্য সংগ্রহ নিয়ে এদের ভেতর আবার চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তবে মজার ব্যাপার কী জানেন ?

কী ?

এরা আমাদের কোনো গোপন তথ্য দেবে না। সুতরাং আপনাকে নিজের মতো করে পথ কাটতে হবে। সেই পথ ধরে হাঁটবেন। আরেকটা কথা।

বলুন।

এদের কারও রোষানলেওপড়া যাবে না। এদের ক্ষ্যাপালে একদিন হঠাৎ আপনাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

রাশিয়ায় এখন যুদ্ধের কারণে খাদ্য এবং পণ্যস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। জিনিসপত্রের দাম চারগুণ বেড়ে গেছে। খাবারের দোকানে সারা দিন লম্বা লাইন লেগে থাকে। জার নিকোলাস সেনাপ্রধান হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে ব্যস্ত। পেট্রোগ্রাডে উনি বলতে গেলে থাকেনই না। তার ওপর উনি সংসদকে কোনো পাত্তা দিচ্ছেন না। কেবল আপার হাউজের সঙ্গেই ওনার দহরমমহরম। আপার হাউজের বেশির ভাগই ধনী, তারা গরিবদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত।। এদের পরামর্শে জার একটার পর একটা ভুল করেই যাচ্ছেন। ১৯১৬ সালের জানুয়ারি মাসে জার বরিস স্টামারকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। বলতে গেলে কেউই বরিস স্টামারকে পছন্দ করে না। দুর্নীতিবাজ এবং প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে তার কুখ্যাতি আছে।

ইদানীং আবার পেট্রোগ্রাড শহরে রটে গেছে যে দেশ আসলে কালো শক্তির হাতের মুঠোয়। কিন্তু কী এই কালো শক্তি ? শোনা যাচ্ছে রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে জার্মানরা নিজেদের লোক বসিয়ে রেখেছে। এদের কাজ হলো রাশিয়াকে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করা। রাশিয়া যুদ্ধ থেকে সরে গেলে জার্মানিকে আর রাশিয়া নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ওরা ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সকে সহজেই পরাস্ত করতে পারবে। বন্ধুহীন রাশিয়া জার্মানির কাছে দুর্বল হয়ে পড়বে। অনেকেই বলাবলি করছে রানি আলেকজান্দ্রা সব ষড়যন্ত্রের হোতা। এরকম রটনার কারণ আছে। আলেকজান্দ্রা জার্মান মেয়ে। জার্মানিরর প্রতি তার গোপন আনুগত্য থাকা বিচিত্র নয়। রানি বারবার মন্ত্রী নিয়োগে হস্তক্ষেপ করছেন। অনেকের ধারণা বরিস স্টামারকে রানির কথাতেই প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়েছে। তারপর আবার রানির কাছের লোক আলেকজান্ডার প্রটপভকে অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী বানানো হয়েছে। এতে রানির প্রতি সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। অনেকেই সন্দেহ করে সিফিলিসের কারণে প্রটপভের মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।  স্টকহমে ওকে জার্মান গোয়েন্দাদের সঙ্গেও কথা বলতে দেখা গেছে।

তবে যাকে নিয়ে সবাই সবচেয়ে বেশি সন্দেহে ভুগছে সে হলো রাসপুটিন। রাসপুটিন অনেকদিন ধরেই রানি আলেকজান্দ্রার ঘনিষ্ঠ। আলেকজান্দ্রার ছেলেকে রাসপুতিনই সুস্থ করে তুলছিল। রানিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাসপুটিন। আর রাজা চলেন রানির কথায়। অনেকেই ভাবছে যুদ্ধে রাসপুতিন জার্মানদের পক্ষ নিয়েছে। আলেকজান্দ্রার মাধ্যমে সরকারি অনেক সিদ্ধান্তে রাসপুতিন হস্তক্ষেপ করছে। এই কালো শক্তিকে সরাতে অনেকেই রাশিয়ায় অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে। এম আই সিক্সের গুপ্তচর স্যামুয়েল হোর বুঝতে পারছে কালো শতি উৎখাতের সঙ্গে ওদের স্বার্থ একই সূত্রে গেঁথে গেছে। এ কারণে অ্যাম্বাসেডর বুকানানকে সঙ্গে নিয়ে সেও জড়িয়ে গেছে কালো শক্তি উৎখাতের ষড়যন্ত্রে।

শীতকাল থেকে সারা দেশে খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা খাবারের জন্য দোকানে লম্বা লাইন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে। বাড়িতে জ্বালানির অভাবে মানুষ শীতে কাঁপছে। রানি জার্মান, আর যুদ্ধ চলছে জার্মানির সঙ্গে। তাই অনেকের রাগ রানির ওপর। অবস্থা বেগতিক দেখে জার বরিস স্টামারকে বরখাস্ত করেছেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি শান্ত হয় নি। রেনো ফ্যাক্টরিতে ধর্মঘট আরম্ভ হয়েছে। ধর্মঘট থামাতে আর্মি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এবার একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে। শ্রমিকদের গুলি না করে সৈনিকরা নিজেদের অফিসারদের ওপর গুলি চালিয়েছে। সাধারণ সৈনিকরা আর যুদ্ধ চাচ্ছে না।

ব্রিটিশ স্পাই হোর বেশ বুঝতে পারছে, রাশিয়ার অবস্থা দিন দিন ওদের বিপক্ষে যাচ্ছে। রাসপুটিনের মতো যারা প্রচণ্ড ক্ষমতাধর আবার যুদ্ধ থামানোর কথা বলছে তাদের যে-কোনো মূল্যে থামাতে হবে। স্যামুয়েল হোর ব্রিটেনে টেলিগ্রাম পাঠাল,

এখন রাশিয়ায় যা হচ্ছে সেরকম যদি চলতেই থাকে তাহলে কিন্তু রাশিয়া আগামী শীতকালের ভেতরেই যুদ্ধ থেকে সরে আসবে। 

হোরের জরুরি বার্তা পাঠাবার সপ্তাহখানেকের ভেতর রাসপুটিনকে একটা মিটিংয়ে ডাকা হলো। সে মিটিংয়ে স্যামুয়েল না থাকলেও ব্রিটিশ অ্যাম্বাসেডর বুকানন এসেছেন। গল্প করতে করতে রাসপুটিনের মদে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হলো। রাসপুটিন বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ল, কিন্তু মরল না। তখন একজন ওকে গুলি করল। রাসপুটিন তাতেও মরল না। ঘাতকরা তখন রাসপুটিনের বিশাল দেহটা বরফের ওপর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নেভা নদীতে ফেলে দিল। 

কিন্তু যুদ্ধের ঝামেলার ভেতর রাসপুটিনের মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ কারোই নেই।

 

১৯

জারের ইন্টালিজেন্স ওখরানা কম করে হলে বারোজন ইনফর্মার ঢুকিয়ে রেখেছে বলশেভিক দলে। এর আগেও ইনফর্মারের কারণে দলের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। স্টালিন জেলে গিয়েছিল, ‘প্রাভদা’ পত্রিকার অফিস বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। একবার পেট্রগ্রাডের বাইরে বলশেভিক সেন্ট্রাল কমিটির গোপন মিটিং থেকে পাঁচ জনকে তুলে নিয়েছিল। এর মাঝে লেনিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কামেনেভও ছিল।

এ কারণে বলশেভিক দল ইনফর্মারের ব্যাপারে এখন ভীষণ সতর্ক । ওরা লিখিত যোগাযোগ একদম কমিয়ে দিয়েছে। একটা জায়গায় ওরা একবারের বেশি দুবার মিটিং করে না। অনেক সময় পথে হাঁটতে হাঁটতে জরুরি আলাপ সেরে নেয়। তারপরও বিপদ এড়ানো যাচ্ছে না। পেট্রোগ্রাডের বলশেভিকদের কমিটির নাম পিটার্সবার্গ কমিটি। পিটার্সবার্গ কমিটির অফিসে হানা দিয়ে ওদের প্রিন্টিং প্রেসটা পুলিশ কেড়ে নিয়েছে।  প্রেস হারিয়ে দল বিরাট ঝামেলায় পড়েছে। আন্দোলনের জন্য কোনো ইস্তেহার, এমনকি ব্লাডি সানডে উদ্যাপনের জন্য কোনো লিফলেট ছাপানো যাচ্ছে না। পত্রিকাগুলোর ওপরেও সরকার কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করেছে।

অনেকদিন ধরে লেনিন সুইজারল্যান্ড থেকে একটা পত্রিকা বের করছে। নাম ‘সোশালডেমোক্রেট’। রাশিয়ায় যেহেতু পত্রিকা ছাপানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে, লেনিন সোশালডেমোক্রেট পত্রিকায় লেখা বাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ায় এই পত্রিকা চালান করা কঠিন ব্যাপার, তবে একেবারে অসম্ভব না। প্রথমে পত্রিকা পাঠানো হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়। বাল্টিক কোস্টের জেলেদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের ভালো যোগাযোগ আছে। আলেকজান্দ্রা কোলোন্তাই আর শ্লিয়াপনিকভ সেই যোগসূত্র ব্যবহার করে পত্রিকা পাঠায় ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের জুতার ব্যবসায়ীরা পত্রিকাগুলো জুতোর বাক্সের ভেতর ভরে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়। কেউ কেউ আবার কোটের লাইনিং-এর ভেতর ঢুকিয়ে বিদেশ থেকে বিপ্লবী বই আর পত্রিকা রাশিয়ায় নিয়ে আসছে। লেনিনের লেখাগুলোর কারণে রাশিয়ায় সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও প্রবাসী বলশেভিক নেতাদের সাথে রাশিয়ার সমর্থকদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। কারণ দেশের বাইরে বসে দেশের হৃদস্পন্দন ঠিকঠিক টের পাওয়া যায় না। প্রবাসী নেতাদের নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে স্থানীয় দলগুলোকে অনেক সময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পেট্রগ্রাডের রাজনৈতিক দলগুলো একটা জয়েন্ট ক্যাম্পেনের চিন্তা করছে। এদের মাঝে বলশেভিকদেরও কেউ কেউ আছে। এই সিদ্ধান্তগুলো লেনিনকে ছাড়াই নেয়া হচ্ছে।

শ্রমিকশ্রেণির মাঝে এখন তীব্র খাদ্য সংকট। অনেকেই সামান্য রুটি পর্যন্ত কিনতে পারছে না। এর কারণ হলো ক’দিন ধরে শহরে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে। যে সব পরিবারে শিশুরা খেতে পাচ্ছে না সেই পরিবারগুলো চাইছে তাড়াতাড়ি এই বাজে যুদ্ধের অবসান হোক। শহরে আবার শান্তি ফিরে আসুক। সরকার ময়দা বাঁচানোর জন্য কেক বানানো এবং বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফ্যাক্টরি আর শ্রমিকদের ক্যান্টিনে ময়দার সরবরাহ সীমিত করে ফেলা হয়েছে। এতে সমস্যার সমধান তো হলোই না, উল্টো শ্রমিকরা সরকারের ওপর ক্ষেপে গেছে। যেহেতু অনেকের ভোটের অধিকার নেই, তাই প্রতিবাদের উপায় হলো, বিক্ষোভ প্রদর্শন কিংবা ধর্মঘট করা। শ্রমিকদের ক্ষোভ দিনদিন বেড়েই চলছে, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কাছে যেন সবাই দাঁড়িয়ে আছে। বামপন্থীরা খাদ্যাভাবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করল। শিপইয়ার্ডে, ফ্যাক্টরিতে, ব্যারাকে সমাজতন্ত্রী দলের কর্মীরা বক্তৃতা দিয়ে, লিফলেট বিলিয়ে জানাচ্ছে যুদ্ধ এবং স্বৈরাচারের কারণেই আজকের খাদ্য সংকট। পেট্রোগ্রাডে এখন দুই লক্ষ গ্যারিসন সৈন্য বিভিন্ন ব্যারাকে ছড়ানো। এদেরও সুযোগ-সুবিধা কমে গেছে। যুদ্ধের কারণে এরাও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

জার্মানির সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন্স যুদ্ধের আগেই জার্মানিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস চালু করেছিল। সেটা এবার ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়াতেও পালিত হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে উৎসবে খুব বেশি মেয়ে যোগ দেবে কিনা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু লেনিনের ইচ্ছে ছিল এই উপলক্ষে বলশেভিকদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দেওয়ার। সমস্যা হলো এই মুহূর্তে ওদের কোনো প্রিন্টিং প্রেস নেই। লিফলেট ছাপা যাবে না। ওদিকে অন্য দলগুলো ঠিকই সুযোগটা লুফে নিয়েছে। ওরা লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছে। লিফলেটে লেখা,

সরকার অপরাধী, তারা এমন একাট বাজে যুদ্ধ আরম্ভ করেছে যা এখন আর থামাতে পারছে না। সারা দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মানুষ না খেয়ে মরছে। যথেষ্ট হয়েছে, আমরা এই খুনি জোচ্চোর সরকারের পতন চাই!

Leave a Reply

Your identity will not be published.