নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (তৃতীয় পর্ব)

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিওয়ালা (তৃতীয় পর্ব)

[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।]

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

ট্যাক্সিড্রাইভার হিসেবে প্রথম দিনটি কেমন ছিল?

নিউইয়র্ক শহরে সত্তুর ভাগ ট্যাক্সি গ্যারেজই কুইন্সে বিশেষ করে এস্টোরিয়া বা লং আইল্যান্ড সিটিতে। এই দুই এলাকা বাংলাদেশি অধ্যুষিত। দুই একটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে, আছে বেশ কিছু গ্রোসারী শপ (মুদির দোকান) আর চার-পাঁচটি মসজিদ।

আমি থাকি এস্টোরিয়ায়। ম্যানহাটানের খুব কাছাকাছি। ট্যাক্সিগ্যারেজের মালিকরা কেন এই দুই এলাকায় তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন তা সহজেই অনুমেয়। কিছু কিছু গ্যারাজের ফ্লিট বিশাল। ট্যাক্সির সংখ্যা হাজার দেড় হাজার, আবার এক শ’ দেড় শ’ গাড়ির ছোট গ্যারাজও আছে। নিউইয়র্ক শহরকে বলা হয় ‘দ্য সিটি নেভার স্লিপস’ কথাটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য। এখানে মানুষজন দুই শিফটে কখনো তিন শিফটে কাজ করে। ট্যাক্সির বেলায়ও তাই। ডে শিফট আর নাইট শিফট। ভোর পাঁচটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত দিনের শিফট আর বিকাল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত রাতের শিফট। ফোর্ড ক্রাউন ভিক্টোরিয়া গাড়িগুলো ক্লান্তিহীনভাবে দিনরাত চলে, কোনো নিস্তার নেই।

আমি ট্যাক্সি নিয়ে মাঠে নামার আগে পরিচিত অনেকেই নানান উপদেশ দিলেন। দেখা গেল নানা মুনির নানান মত!

কেউ বললেন, ‘হঠাৎ করে কাজে নামবে না, আগে একটা গাড়ি নিয়ে ম্যানহাটানে যাও, রাস্তাঘাট চেন!’

আরেকজন বললেন, ‘রোববারে কাজে নামবে। রোববার ছুটির দিন। রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে।’

আমার বাসার একেবারে কাছেই বিলি আর সালেমির ট্যাক্সি গ্যারাজ। হেঁটে গেলে দুই মিনিট। বিলি লোকটা গ্রিক আর সালেমি আফগানিস্তানের। দুজনেই চেইন স্মোকার। ট্যাক্সিগ্যারেজের ছোট্ট অফিসটায় ঢুকলে মনে হয় গ্যাস চেম্বারে ঢুকেছি, ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার! কাজে যাওয়ার আগের দিন দুপুরবেলা গেলাম সেই গ্যারাজে। দেখলাম বিলি চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে, চোখ বন্ধ। হাতে আধখাওয়া সিগারেট। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে জেগে উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মে আই হেল্প ইউ?

ওকে বললাম, আমি নতুন লাইসেন্স পেয়েছি। আগামীকাল থেকে কাজে নামব বলে ভাবছি। তোমার এখানে কি গাড়ি আছে?

বিলি বলল, অবশ্যই আছে। কোন শিফটে কাজ করতে চাও? ডে শিফট না নাইট শিফট?

বললাম, ডে শিফট।

তোমার হ্যাক লাইসেন্স আর ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দাও।

আমি ওকে লাইসেন্সগুলো দিলাম। বিলি লাইসেন্স দুটো ফটোকপি করে ফাইলে রেখে দিয়ে আমাকে বলল, কালকে ভোর পাঁচটায় চলে এসো।

ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এক শিফটের জন্য ট্যাক্সির ভাড়া কত?

বিলি বলল, ষাট ডলার।

আমি ওর হাতে তিনটি বিশ ডলারের নোট ধরিয়ে দিলাম। টাকা হাতে নিয়ে বিলি বলল, টাকা পরে দিলেও পারতে। ড্রাইভাররা কাজ শেষ করে টাকা দেয়। পরেরবার কাজ শেষে টাকা দিয়ো।

কাজে যাওয়ার আগের রাতে আমি আগেভাগেই বিছানায় গেলাম। ঘড়িতে ভোর সাড়ে চারটার অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি। আমার রাত জাগার বিশ্রী অভ্যাস আছে। দেড়টা দুটোর আগে কখনোই ঘুমাই না। ঘরের বাতি নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছি। আমি কিছুটা চিন্তিত এবং উত্তেজিত। নতুন এই কাজটি কেমন হবে? মানুষজনের ব্যবহার কেমন? যদি রাস্তাঘাট চেনায় ভুল করি? এসব ভাবনায় প্রায় অর্ধেক রাত কেটে গেল। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রার মতন এল, ঠিক তখনই অ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গ্যারাজের পথে হাঁটা দিলাম। দিনটি ছিল দুই হাজার চার সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখ। রোববার। গ্যারাজে পৌঁছানোর পর দেখলাম বিলি তাঁর ছোট্ট অফিসটায় বসে আছে। এক হাতে কফি অন্য হাতে সিগারেট। ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়ছে। আমাকে দেখে বলল, ‘গুড মর্নিং’।

আমি ‘গুড মর্নিং’ বলার পর আমার হাতে ট্যাক্সির চাবি আর ট্রিপশিট ধরিয়ে দিল। ট্রিপশিট নিয়ে দুটো কথা লেখা উচিত। প্রতিটা শিফটের আগে গ্যারাজ ড্রাইভারদের হাতে একটা করে ট্রিপশিট ধরিয়ে দেয়, তাতে ড্রাইভারদের লাইসেন্স নাম্বার, ওই দিনের তারিখ, গাড়ির প্লেট নাম্বার, প্রতিটা যাত্রীকে কোথা থেকে ওঠানো হয়েছে কোথায় নামানো হয়েছে, ভাড়া কত ছিল, টোল কত ছিল, গাড়িতে ক’জন যাত্রী ছিল  ইত্যাদি লিখতে হয়। শিফট শেষে গ্যারাজে সেটা জমা দিতে হয়।

ট্রিপশিট আর চাবি হাতে নিয়ে বিলিকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি কোথায় পার্ক করব? (রাতের শিফটের ড্রাইভাররা কাজ শেষে গাড়ি গ্যারাজের আশপাশে কোথাও রেখে যায়।)

বিলি বলল, আমি তোমার সাথে আসছি। ট্যাক্সিমিটার কীভাবে চালাতে হয় জানো?

না। এর আগে তো কখনো ট্যাক্সি চালাই নি।

বিলি হেসে বলল, তা ঠিক। চল, তোমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিই।

(চলবে)

Leave a Reply

Your identity will not be published.