শম্পা কী চায়? (চতুর্থ পর্ব)

শম্পা কী চায়? (চতুর্থ পর্ব)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন চতুর্থ পর্ব।]

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দু’ সপ্তাহ হয়ে গেছে শম্পার কোনো খবর নেই। হয়তো আর কাউকে ব্ল্যাকমেইল করছে। হয়তো বড় কোনো দাও পেয়ে আমার কথা ভুলে গেছে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

শম্পার ঝামেলায় ফেঁসে আমার টনক নড়েছে। অনেক দিন ধরে আমি শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছি। ইউনিভার্সিটিতে কুলেস্ট প্রফেসরের ইমেজ ধরে রাখতে গিয়ে আর উঠতি বয়সের ছাত্রীদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে গিয়ে কখন যে পতনের শেষ ধাপে নেমে গেছি টেরও পাই নি। এখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে পড়ে পাগলের মতো হারিকেন খুঁজছি।

আমার অবহেলার কারণে সংসারে অনেক দিন ধরেই অদৃশ্য ফাটল ধরেছিল। শম্পা এসে ঝাঁকি দেওয়ায় পুরো সংসারটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আমারও ভালো শিক্ষা হলো। এখন যত্ন করে ভাঙা টুকরোগুলো জোড়া লাগাতে হবে। সংসারে বেশি বেশি সময় এবং মনোযোগ দিতে হবে।

শনিবার দুপুরে রোকসানা মাংস রান্নার আঞ্জাম করছিল। আমাদের কাজের বুয়া সপ্তাহখানেকের জন্য দেশের বাড়ি গেছে। আমি রোকসানার পাশে গিয়ে বললাম, রুকিমণি, পেঁয়াজ কেটে দেব?

কী আশ্চর্য, এই সামান্য কথায় রোকসানার চোখে জল চলে এল। মনে হলো অযত্নে পড়ে থাকা ধূলিমলিন সেতারে মালকোষ রাগের মূর্ছনা তুললাম। আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে রোকসানা বলল, কতদিন পর আমাকে রুকিমণি বলে ডাকলে বলো তো? অথচ বিয়ের পর রুকিমণি রুকিমণি করে মুখে ফেনা তুলে ফেলতে!

তাই তো, আমারও মনে পড়ে না শেষ কবে রোকসানাকে রুকিমণি বলে ডেকেছিলাম। পাঁচ ছ’ বছর আগে তো হবেই। কখন, কীভাবে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের মতো উজ্জ্বল ভালোবাসা ক্ষয়ে গেল?

রোকসানা মাংসের টুকরোগুলো ধুয়ে একটা পাতিলে রাখতে রাখতে বলল, থাক, তোমার পেঁয়াজ কাটতে হবে না, এই যে একটু আদর করে কথা বললে, এতেই আমার কাজের এনার্জি চলে এসেছে।

আমি ওখান থেকে গেলাম না। সাত-আটটা পেঁয়াজ নিয়ে খোসা ছাড়ালাম। চপিং বোর্ডে কুচি কুচি করে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে আমার চোখে পানি চলে এল। রোকসানা আমার প্রয়াস দেখে খুশি হলো। কাবার্ড থেকে গুঁড়া মসলার বৈয়ম বের করতে করতে আস্তে করে বলল, মাঝে মধ্যে সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করলে সংসারের মূল্য বোঝা যায়। সংসারের প্রতি একটা মায়া জন্মায়। শুধু টাকার জোগান দিয়ে দূরে সরে থাকলে সংসারের মালিক হওয়া যায় কিন্তু অংশ হওয়া যায় না। কবে কোন মালিক ভৃত্যকে ভালোবাসে বলো?

যা ক্ষতি করবার করেছি এখন যতটা পারা যায় ক্ষতিপূরণের পালা। আমি কাটা পেঁয়াজগুলো রোকসানার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, রুকুমণি, একুশ তারিখ তোমার জন্মদিন, মনে আছে তো?

বাহ, মনে থাকবে না কেন, তুমিই তো ভুলে গেলে গত বছর।

ভুলি নি, গতবছর ওই দিন রাত পর্যন্ত খাতা দেখার কাজ ছিল, রুটিন উল্টপাল্টা হয়ে গিয়েছিল। এবার তোমার জন্মদিন কক্সবাজার করলে কেমন হয়? কতদিন হয়ে গেল আমরা সমুদ্র দেখি না!

রোকসানা একই সঙ্গে অবাক এবং খুশি হয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার বলো তো? চাকুরি চলে যায় নি তো কোনো কারণে? হঠাৎ এমন পাগলামি!

আমি কি অপরাধ লুকোতে গিয়ে বেশি বেশি নাটক করে ফেলছি? অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ হয়ে যাচ্ছে না তো? কিন্তু আমি তো আসলেই নতুন করে সংসারের যত্ন নিতে চাইছি। ইতস্তত করে বললাম, আসলে কী হয়েছে জানো, কাল রাতে আমাদের ছাদ চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে গেল আর তুমি এত সুন্দর করে গান গাইলে। তোমাকে দেখে কিটসের কবিতাটা মনে এল।

কোন কবিতা যেন?

tender is the night,

And haply the Queen-Moon is on her throne,

Cluster'd around by all her starry Fays;

আহা রে কোমল রাত,

সিংহাসনে সম্রাজ্ঞী চাঁদ,

আর তাকে ঘিরে

বিন্দু বিন্দু নক্ষত্র-পরি।

আমার সাথে এই কবিতার সম্পর্ক কী?

মনে হলো তুমিই সেই চাঁদ। অথচ কতদিন আমরা একসাথে সময় কাটাই না!

রোকসানা আবার বিস্মিত এবং আনন্দিত হলো। সংসারে একঘেয়ে কাজে ওর নিশ্চয় ক্লান্তি চলে এসেছে। শি নিডস অ্যা ব্রেক। পাতিলে মাংস কষাতে কষাতে রোকসানা বলল, আচ্ছা দেখি মিলিকে জিজ্ঞেস করে, ওর পড়ালেখার চাপ এখন কেমন কে জানে!

মাঝের দু’দিন ভীষণ ব্যস্ততায় কেটে গেল। শম্পা আর যোগাযোগ করে নি। মনে হচ্ছে এ যাত্রা রাহু কেটে গেছে। মঙ্গলবার দিন দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িংটা আকাশে উড়তেই আমার মন তুলার মতো হালকা হয়ে গেল। মিলির সামনে পরীক্ষা আছে, ও এবার আর আসতে পারল না। রোকসানার ধারণা মিলি ইচ্ছে করেই আমাদের দুজনকে একান্ত সময় দিতে চাইছে।

কক্সবাজারে পৌঁছেই আমরা ইনানী সৈকতের দিকে মারমেইড বীচ রিসোর্টে চলে গেলাম। ফ্যামিলি রুম উইথ সি ভিউ বুকিং দেওয়া ছিল। একটা বড় বেডরুম, একটা ড্রইং-কাম-ডাইনিং আর সামনে বড় বারান্দা। দেয়াল থেকে শুরু করে দরজা, জানালা, আসবাব, সবই কাঠের। রিসোর্টজুড়ে একটু পরপর ছোট ছোট কোর্টি ইয়ার্ড, হাত বাড়ালেই বিশাল নীল সমুদ্র। রোকসানা আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, এটা তো মনে হচ্ছে অনেক এক্সপেন্সিভ, মিড রেঞ্জের হোটেল নিলেই হতো।

এক্সপেন্সিভ হয় হোক, আমরা দুজন একটু আনন্দ করি। জীবন মানে তো কতগুলো সুন্দর স্মৃতি, তাই না? আমরা তো স্মৃতি জমানোই ভুলে গেছি।

সন্ধে হওয়ার আগে আগে আমরা মারমেইড রিসোর্টের বেলাভূমির উপর দিয়ে হেঁটে সমুদ্রের কাছে চলে এলাম। দূরে কমলা সূর্যটা তখন প্রায় ডুবে গেছে। হঠাৎ প্রবল ঢেউ এসে রোকসানার পা আর সালোয়ার ভিজিয়ে দিল। একই সঙ্গে কোত্থেকে বুনো বাতাসে ওর রেশমের মতো চুল ওড়নার মতো উড়তে লাগল। রোকসানা বাচ্চা শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে দিল। মনে হলো পরিচর্যার অভাবে ওর ভেতরের এই শিশুটা এতদিন দমবন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিল।

আমি হাত দিয়ে রোকসানার এলোমেলো চুল ঠিক করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, ওর একটা দুটো চুলে পাক ধরেছে। আহা কতদিন ওর দিকে ভালো করে তাকাই নি! তাকালে নিশ্চয় ওই সাদা চুল আর চোখের দু’ পাশে জেগে ওঠা সময়ের ভাঁজগুলো নজর এড়াত না!

সন্ধ্যার দিকে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে বার্মিজ মার্কেটে গেলাম। বার্মিজ মার্কেট আগে বার্মিজ মেয়েরাই চালাত, এখন আর সেরকম নেই। রোকসানা শখ করে অনেক ধরনের বার্মিজ আচার আর কাঠের চিরুনি কিনল। রাতে রিসোর্টে ফিরে দুজন গলদা চিংড়ি দিয়ে ভাত খেলাম। সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে আমি রোকসানাকে বললাম, এখন থেকে প্রতি ছয় মাসে আমরা কোথাও বেরিয়ে পড়ব। তা হলে আর সংসার বদ্ধ ডোবা হয়ে যাবে না আর ওতে কান্নার কচুরিও জন্মাবে না।

রোকসানা ঝলমল করে বলল, উফ, তাহলে যে কী মজা হবে!

সেদিন রাত বারোটায় রোকসানার আঙুলে একটা হীরের আংটি পরিয়ে বললাম, হ্যাপি বার্থডে রোকসানা।

রোকসানা গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সেই রাতটা কীভাবে কীভাবে হয়ে গেল আমাদের দ্বিতীয় মধুচন্দ্রিমা।

পরদিন ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল এগারোটা বেজে গেল। এরকম একটু আধটু আলস্য না হলে ছুটির মজা কোথায়? আমরা আস্তেধীরে নাস্তা সেরে মারমেইড রিসোর্টের বেলাভূমির কাছে একটা টেবিলে বসলাম। একটু পরই রোকসানার জন্য সারপ্রাইজ আছে। সেই সারপ্রাইজের নাম মিলি। আমি মোবাইল টেবিলের নিচে ধরে মিলিকে টেক্সট করলাম, মিলি, কোথায় তুই, আসছিস না কেন এখনো?

এই তো চলে এসেছি, আর পাঁচ মিনিট।

মিলি আজ ভোরেই কক্সবাজার চলে এসেছে, রোকসানা সেটা জানে না। ঠিক পাঁচ মিনিট পর দেখলাম অনেকগুলো লাল নীল সবুজ হলুদ বেলুন নিয়ে মিলি এদিকে এগিয়ে আসছে। রোকসানা যেন দূর থেকে চিনে না ফেলে সে জন্য মিলি বেলুনগুলো সামনে ঝুঁকিয়ে মুখ আড়াল করেছে। টেবিলের কাছে এসেই ও বেলুনগুলো একপাশে সরিয়ে বলল, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ!

কিন্তু এ তো মিলি নয়, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শম্পা। আমি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শম্পার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

(চলবে...)

উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.