দেখা অদেখার বাইরে যিনি

দেখা অদেখার বাইরে যিনি

কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাহিত্য নিয়ে আমি কিছু লিখতে পারব না, শরীর অনেকটা ভালো কিন্তু গভীর বিষয়ে এখনো মাথা ঢুকছে না। অবশ্য সাহিত্য নিয়ে লেখার মতো অনেক বিজ্ঞজন আছেন। তারপরও একেবারেই একটু করে বলি, মনজুর ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়, আড্ডা সবই হয় ২০০০ সালে, নিউইয়র্কে। তার আগে বইমেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হতো, যথারীতি বিনয়ী, ব্যক্তিত্ববান তাঁকে ভালো লাগত আমার। 
যেখানে চারপাশে একই সময়ের একজন লেখক, বিশেষ করে আরেকজন লেখক বা সহকর্মীর বিষয়ে পরশ্রীকাতর থাকে বেশির ভাগ সময়, সেখানে ঢাকা ভার্সিটিতে দেখা হওয়ার পরে জানতে চাইলেন, কার সাথে দেখা করতে গেছি ?
আমি জানালাম, কবি অধ্যাপক কায়সার হক আমার উপন্যাস ‘উড়ুক্কু’র অনুবাদ করছেন। আমি তাঁর কাছে যাচ্ছি। আমাকে মুগ্ধ করে দিয়ে তিনি তাঁর বিভাগের আরেকজন শিক্ষক সম্পর্কে বললেন, ‘কায়সার অনুবাদ করছে ? তুমি তো দারুণ ভাগ্যবান। সে সাধারণত রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করে। অসাধারণ অনুবাদ তাঁর।’
একসময় আমি তাঁর বিভিন্ন ধরনের বই পড়া শুরু করলাম, একটা পত্রিকায় তাঁর গল্প পড়ে মুগ্ধ হই। অবশ্য আমি অনেকটাই কম বয়সে ‘সংবাদে’-এ প্রকাশিত ‘অলস দিনের হাওয়া’ পড়তাম প্রচণ্ড ভালোলাগা নিয়ে। পড়তে পড়তে বিমোহিত হতাম, নৈর্ব্যক্তিকভাবে তাঁর গল্প বলার ধরন আমাকে টানত।
 বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি লিখতেন। দারিদ্র্য, মধ্যবিত্তের বিপন্নতা, মানুষের দুর্দশা, প্রতারণার দাহ, বন্যা, জালনোট, নির্যাতন, রাজনীতির দৈন্য, এগুলো যাতে সস্তাভাবে উদোম না দেখায়, এজন্য তিনি তাঁর অসাধারণ শিল্পের চোখ দিয়ে এসব বিষয়কে বুকে ধাক্কা দেওয়া চমৎকার ভাষার মধ্য দিয়ে তুলে আনতেন। অনেক সময়ই তিনি বড় বড় অনুচ্ছেদে বাক্য তৈরি করতেন, নিরীক্ষা করতেন। তাঁর প্রেমের গল্পে কখনোই প্রথাবদ্ধ প্রেমের প্রকাশ নেই। দারুণ উপস্থাপন!
তাঁর রচিত ‘নন্দনতত্ত্ব’ পড়ে আমার মননের পরিধি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। এরপর পড়েছি, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘আজগুবি রাত’, ‘দেখা না দেখার গল্প’, ‘সেরা দশ গল্প’ আরও অন্যান্য বই। যাই পড়েছি, এক বিষয় থেকে আরেক বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা, অন্যরকম দেখেছি। দারুণ প্রভাবে বিলোড়িত হয়েছি।
এরপর আড্ডায়, তাঁর রচিত গদ্য, তাঁর সাক্ষাৎকারে, কেবল সমৃদ্ধ হয়েছি। তিনি একেবারে সহজভাবে মনোরম ভঙ্গিতে জীবনের সিরিয়াস কথাগুলি বলতেন, সাহিত্যের কোথায় আঞ্চলিক ভাষা, কোথায় শুদ্ধ ভাষায় বলতে লিখতে হবে এত সুন্দরভাবে বলতেন, মুগ্ধ হয়ে যেতাম।
আমাকে আন্ডাররেটেড লেখক মনে করতেন। একদিন ফোনে আমার নিজের সাহিত্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করায়, যথারীতি তিনি আমার লেখার প্রশংসা করে নিজের এই উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলেন। লেখক-পাঠক জগতে যতটা গুরুত্বের সাথে আমার নাম নেওয়া উচিত সেভাবে কেউ নেয় না। 
 মনজুর ভাইয়ের এমন কথা আমার জন্য বিরাট এক প্রাপ্তি ছিল। আমার মনে হয়েছিল, আমার যা পাওয়ার পেয়ে গেছি, আর কী চাই ? কিন্তু তাঁকে নিয়েও আমার আমার একটা সূক্ষ্ম অবজারভেশন এই, যা তাঁর মৃত্যুর পরে আরও গভীর হয়েছে, মনজুর ভাই বহুমাত্রিক হওয়ার কারণে কোট করার মতো অসংখ্য দেশ আর মানুষ নিয়ে, শিল্প নিয়ে অভূতপূর্ব কথা বলার জন্য, যতটা দেশে-বিদেশে পরিচিত, সম্মানিত, তাঁর লেখা অসাধারণ সাহিত্যের জন্য ততটা মূল্যায়িত তিনি হন নি।
এই দেশে যখন সাহিত্য সংকলন বেরোয় তখন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বিশেষ করে ষাটের দশকের অনেক লেখকের লেখা যত গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়, উচ্চারিত হয়, মনজুর ভাইয়ের লেখা ছাপা হয়, কিন্তু তাঁর সাহিত্য নিয়ে ক’জন কথা বলেছে ? বলে ? প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি অবলীলায় এই দেশের ছোট বড় সব ধরনের মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের সাথে একসাথে ছবি তুলেছেন, তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই তাঁর সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন। 
গদ্য ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি ঋদ্ধ, ছাত্রদের প্রিয় অধ্যাপক, সব ধরনের মানুষের সাথে তাঁর নানা রকম ছবি আছে, তাদের মধ্যে হাতেগোনা ক’জন ছাড়া কাউকেই আমি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটা বই নিয়ে বলতে শুনি নি, তারা তাদের সাথে, বেশির ভাগই ব্যক্তিগত মনজুর ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা বলে গেছে। এসব নিয়ে মনজুর ভাই জীবদ্দশায় কোনোরকম পরোয়া করেছেন, আমি শুনি নি, দেখি নি। 
আমার যাতে ভালো হয়, প্রসারিত হয় আমার পথ, তার জন্য অনেক কিছু তিনি করতে চাইতেন। আমার কাছে এটাই অনেক প্রাপ্তি ছিল। 


এক টুকরো স্মৃতি শেয়ার করি। আসলে অনেক স্মৃতি, অনেক প্রাপ্তি মনজুর ভাইকে কেন্দ্র করে, কিছু তিনি চলে যাওয়ায় মনের ভারে সেসব লিখতে পারছি না। তাঁর সাহিত্য নিয়ে, জীবনাচার নিয়ে বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন লেখক কিছু না কিছু লিখছেন, আমি সেদিকে না গিয়ে একটা ছোট্ট স্মৃতি শেয়ার করি।
অর্চি অনার্সে নিজ দায়িত্বে ভর্তি হয় যখন, তখন আমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। আমার এলোমেলো আচরণে সে রীতিমতো সাহিত্যের মানুষের ওপর বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। মনজুর ভাই তখনো আমাদের বাসায় আসেন নি। কিন্তু যেখানেই অর্চিকে দেখতেন, ‘বলতেন ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।’ পরে যখন আমাদের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে গেলেন, হেন কথা নেই তাঁর সাথে হতো না। তিনি অর্চিকে সাংঘাতিক স্নেহ করতেন। 
শুরুতে ইংলিশ মিডিয়াম থেকে যাওয়া স্টুডেন্টরা ভিখারুন্নেসা থেকে পাশ করা অর্চিকে নানাভাবে অপদস্ত করত। অর্চি মন খারাপ করে চুপচাপ পেছনের বেঞ্চে বসে থাকত। ভালো ইংরেজি জানা বাংলা মিডিয়াম থেকে যাওয়া অর্চি একসময় চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইংরেজি মিডিয়াম মেয়েদের সমান্তরালে এসে গেল।
সিনিয়র সাহিত্যিকরা সহসা জুনিয়রদের মন খুলে প্রশংসা করে না। মনজুর ভাইয়ের লেখার ভক্ত ছিলাম, কিন্তু তখনো ভুলো মনে তাঁকে সে কথা বলা হয় নি। 
সেসব যাক। মনজুর ভাই অর্চির ক্লাসের টিচার ছিলেন। একদিন তিনি ক্লাসে আন্তর্জাতিক সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের অনবদ্য প্রকাশ নিয়ে বলতে বলতে কিছু লেখকের নাম নিতে নিতে আমার নামে এসে থামলেন, এরপর আমাকে নিয়ে আবার বলা শুরু করে তাঁর চোখ পড়ল, পেছনে বসা অর্চির দিকে, তিনি মুহূর্তে উজ্জীবিত হয়ে বললেন, ‘অর্চি দাঁড়াও।’ মুহূর্তে সবার ঘাড় চলে গেল অর্চির দিকে। 
তিনি বললেন, ‘ম্যাজিক জাদুবাস্তবতার লেখক হিসেবে নাসরীন জাহানের লেখার প্রশংসা করলাম না ? অর্চি সেই নাসরীন জাহানের মেয়ে!’ এরপর আমার সাহিত্য নিয়ে আরও বেশকিছু কথা বলে অর্চিকে বললেন, ‘অর্চি, তুমি ওদের তোমার মায়ের বইয়ের ব্যাপারে হেল্প করো।’
যথারীতি অর্চি অভিভূত হয়ে বাসায় এসে আপ্লুত হয়ে বাবার সাথে বিষয়টা শেয়ার করল।
এরপর ক্লাসের পরিবেশ বদলে গেল, আমি অর্চির সাথে প্রমিজ করলাম, ও আহত হতে পারে, এমন কাজ আর করব না। সেদিন থেকে আমাদের জীবনটা পজেটিভভাবে বদলে গেল।
এমন অনেক স্মৃতি, অনেক প্রাপ্তি, মনে পড়ছে মনজুর ভাই, আমাদের মহাশূন্যতায় ভাসিয়ে কেন চলে গেলেন ?


তিনি ‘অন্যদিন’-এর উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। 
আমাদের বাসায় প্রায়ই তাঁর সাথে আড্ডা হতো। তিনি বলতেন, আমাদের বাসার আড্ডা তাঁর অনেক বেশি পছন্দের। তাঁর সাথে আড্ডা আমাদের কাছেও মনোরম ছিল। আমরাও আকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম, কবে মনজুর ভাই ফ্রি থাকবেন, কবে আমাদের বাসায় আড্ডা হবে ? 
এই আড্ডার টিমের মধ্যে অপরিহার্যভাবে ‘অন্যদিন’ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহ্ নাসের, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সিরাজুল কবির চৌধুরী, আরও দুই-তিনজন থাকতেন। আমরাও গণহারে কেবল আমাদের পছন্দের মানুষদের একসাথে দাওয়াত কখনোই দিতাম না। যাঁকে কেন্দ্র করে দাওয়াত, আমরা তাঁর সাথে টিউনিংয়ে যায় এমন বন্ধুদের দাওয়াত দিতাম।
তিনি আমাদের বাসায় আসবেন মানে সেদিনটা অন্যরকম হয়ে যেত, আড্ডায় দেশ, রাজনীতি, ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট এবং একেবারেই ভেতরের কথাগুলো আমরা অনায়াসে বলতাম। বিশেষ করে দেশ নিয়ে মানুষ নিয়ে অসাধারণ সব পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি এমন কিছু কথা বলতেন, আমি নানাজনকে সেসব কোট করতে দেখেছি।
যাওয়ার আগে ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আশাবাদী মানুষটিকে হতাশার সাথে বলতে শুনলাম, তিনি বলেছেন, ‘কেউ শোনে নি কথা, আমি বহুদিন যাবৎই বলে যাচ্ছি, কেউ একটা কথাও শোনেন নি।’
অথচ এই দেশের অনেক পোলাপান, সাহিত্য জগতের মানুষ কিছু একটা হলেই বিদ্রƒপ করে বলে, ‘এখন বুদ্ধিজীবীরা কোথায় লুকিয়েছে ? এখন কোন কথা বলে না কেন ?’
এই অন্ধ দেশে বুদ্ধিজীবীদের কথায় কোনো মানুষের আঙুলও নড়ে না।
প্রতিদিন যতবার মনে পড়ছে সেইসব আড্ডার কথা, চোখ ভিজে যাচ্ছে...

Leave a Reply

Your identity will not be published.