নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ২৬)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ২৬)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ২৬ ও ২৭তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২  পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব
১৬
 পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ পর্ব ১৯ পর্ব ২০ পর্ব ২১ পর্ব ২২ ও ২৩ পর্ব ২৪ ও ২৫

মানুষের জীবনে প্রেম ভালোবাসা কিংবা ভালো বন্ধুত্ব হঠাৎ করেই আসে।

আবার কোনো না কোনো কারণে, কখনও বা অকারণই সেই সম্পর্কটি ভেঙেও যায়। দীর্ঘদিন প্রেম করার পরও এক সময় মনে হতে পারে সম্পর্কটিই বৃথা। হঠাৎ মনে হতে পারে এত দিনের এত আবেগ, অনুভূতি, একসঙ্গে কাটানো সুন্দর সময়গুলো ভীষণ অর্থহীন। মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন নিজের বহু যত্নে গড়া সম্পর্কটি ব্যর্থ কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। আর যখন নিজের যত্নে লালন করা সম্পর্কটিতে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে যায় তখন সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যায়।

অনেকদিন হলো সিমির কাছে থেকে তেমন কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিল না ফাহিম। হঠাৎ করেই ওদের সম্পর্কে কেমন যেন একটা ভাটার টান দেখা দিয়েছে। অথচ এর কোনো কারণ থাকার কথা নয়। এই কিছুদিন আগেও শত ব্যস্ততার মাঝেও ফাহিমকে একবার অন্তত একটি মেসেজ পাঠাত সিমি। ফাহিমের দিক থেকেও চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকত না প্রতিদিন অন্তত একবার ওর খোঁজ নেওয়ার। ওদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো টানাপোড়েন নেই। মনোমালিন্যও ঘটে নি। তবে কি তৃতীয় পক্ষ? 

কিছুদিন অপেক্ষা করে ফাহিম একটা ইমেইল পাঠাল সিমিকে।

হাই বর্ষা,
অনেকদিন তোমার কোনো খবর নেই। জানি ইন্ডিয়া থেকে ফিরেই অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। কিছুদিন ভ্যাকেশন কাটিয়ে কাজে ফিরে কেমন ব্যস্ত হয়ে যেতে হয়, তা আমি কিছুটা হলেও জানি। দেশ থেকে ফিরে আমারো একই অবস্থা হয়েছিল। তুমি লিখেছিলে, ফাহিম, এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে, একটা মেসেজ তো দিতে পারো। এত ব্যস্ত?

এখন আমি ঠিকই বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা। আমারও মনে হয় লিখি, একটা মেসেজ তো দিতে পারো!

অনেকদিন কথা হয় না। তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নেয়া যাক তোমার। বোঝাই যাচ্ছে ব্যস্ত আছ। সমস্যা নেই। যখন সময় বের করতে পারবে— লিখো। তোমার লেখা মিস করি। তোমাকেও।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী লিখব। মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। শব্দভাণ্ডার কি তবে শেষ হয়ে গেল? কী জানি! অথচ আগে কতকিছু লিখতাম! কোনো কিছু না ভেবেই লিখতাম। তোমাকে লেখার জন্য আমার শব্দভাণ্ডার শেষ হয়ে যাবে— এটা ভাবতেই কেমন লাগছে।

জানি না, এসব কী লিখছি। কেনই-বা লিখছি। বোর হবে জানি। তোমাকে আর বোর করতে চাই না। আজ থাক। অনেকদিন হয়ে গেল বলেই লিখলাম। (দেখেছ, একটা মেইল লিখে সেটিকে জাস্টিফাই করতে হচ্ছে— বুঝতে পারছ কিছু?)

ভালো থেকো। সুস্থ থেকো। তুমি তো শীত সহ্য করতে পারো না। বলেছিলে নতুন ব্লাংকেট কিনতে হবে। কিনেছিলে? ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসো না যেন।

অপেক্ষায়,
ফাহিম।

আরও বেশ কয়েকদিন পর সিমি উত্তর লিখল।

কী চমৎকার আর বোরিং একটা মেইল পেলাম।

ফাহিম,
ঠিকই ধরেছ, সত্যিই, ভীষণই ব্যস্ত আছি আমি ইদানীং। যতটা না অফিসের কাজে তারচেয়েও বেশি বাসার ঝামেলা। আনলিমিটেড ঝামেলা, চলছে ননস্টপ। আমার কাঁধেই কেন সব ঝামেলা এসে চেপে বসে বলতে পারো? সবাই কেন আমাকে ফর গ্রান্টেড হিসেবে নিয়ে নেয়? আমি আর নিতে পারছি না। আমি কেন আমার নিজের মতো করে থাকতে পারি না! আমাকে কেন সবার চাপিয়ে দেয়া ইচ্ছেয় চলতে হবে! ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

তোমাকে অনেক কথাই বলা হয় নি। বলেই-বা কী হবে? সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারবে তুমি। সরি ফাহিম, এসব কথা লেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। হঠাৎ করে কেনই বা লিখছি এসব ছাইপাশ জানি না। আমার মাথা কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। প্লিজ কিছু মনে কোরো না।

আচ্ছা থাক ওসব কথা। মনে হচ্ছে কিছু অর্থহীন কথা বলে এই মেইলটিই বরং আমি বোরিং করে ফেলছি। তোমাকে একটা কথা বলি ফাহিম— তোমার ইমেইলটি কিন্তু অতটা বোরিং ছিল না, আমি যতটা বলেছি। তবে একটা বিষয় লক্ষ করলাম, তোমার লেখায় আগের মতো আর উচ্ছ্বাস নেই। কেমন যেন নির্জীব ধরনের কথাবার্তা। প্রাণহীন। মনে হলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে লেখা। অথবা লিখতে হবে বলেই যেনতেনভাবে কিছু একটা লিখে পাঠিয়ে দেয়া। আমার সাথে যখন তোমার প্রথম ফোনে কথা হয়, তার আগেও তোমার মেইলগুলো ছিল অনেক প্রাণবন্ত। তোমার কী হয়েছে ফাহিম?

এই, তোমাদের না অ্যানিভার্সারি ছিল? কেমন কাটালে দিনটি? অভিনন্দন জেনো। তোমাদের দুজনার জন্য অসীম শুভকামনা। আগামীর দিনগুলি আনন্দে মাখামাখি আর স্মৃতিময় হোক। একটা কাকতালীয় ব্যাপার জানো— তোমার বিয়ের দিন আর আমার মায়ের মৃত্যু দিন একদিনেই। কী আশ্চর্য!

তোমার বউকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো। তোমার জন্য ভালোবাসা।

আজ এ পর্যন্তই। আশা করছি খুব তাড়াতাড়িই আবার লিখতে পারব তোমায়। এই শুক্রবারেও হতে পারে। ভালো থেকো। ভালোবাসায় রেখো।

বর্ষা।

অতঃপর একমাস কেটে গেল— সিমির কোনো ইমেইল এল না।

সিমির জন্য ফাহিম একটি ইমেইলও লিখেছিল, সেটাও প্রায় একমাস আগে। কিন্তু পাঠানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সে মত বদলে ইমেইলটি না পাঠিয়ে ডিলিট করে দিল। কেন ডিলিট করেছিল কে জানে! কিঞ্চিৎ অভিমান কি?

সেদিন মেসেঞ্জারে অনেকদিন পর হুট করেই কথা হলো ওদের দুজনের। কথা বলার সময় প্রসঙ্গক্রমে সেই ইমেইলটির কথা জানাতেই উৎসুক হয়ে জানতে চাইল সিমি, ‘কষ্ট করে একটা ইমেইল লিখলে অথচ না পাঠিয়ে ডিলিট করে দিলে, এটা কেমন কথা ফাহিম?’

ফাহিম কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই সিমি আবারো বলল, ‘কী এমন লিখেছিলে যে মাইন্ড চেঞ্জ করে ডিলিট করে দিলে? ভীষণ কষ্ট পেলাম।’

ফাহিম চুপ করে রইল।

‘আমি ইমেইলটি চাই। তুমি আজই পাঠাবে আমাকে।’

‘থাক না, বাদ দাও।’

‘না, বাদ দেয়া যাবে না।’

‘আরে কী যন্ত্রণা, ওটা কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে?’

‘ডিলিট ফোল্ডারে গিয়ে খুঁজলেই পেয়ে যাবে।’

‘আচ্ছা।’

‘কী আচ্ছা?’

‘খুঁজে দেখব।’

‘কোনো রকম এডিট না করেই পাঠাবে। যা লিখেছিলে তাই। আমি দেখতে চাই—’

‘হুম।’

‘কী হুম?’

‘এডিট না করেই পাঠাব।’

‘প্রমিজ?’

‘প্রমিজ করতে হবে?’

‘হ্যাঁ হবে।’

‘আচ্ছা প্রমিজ।’

ফাহিম সেদিন রাতেই ডিলিট ফোল্ডার থেকে মেইলটি উদ্ধার করে পাঠিয়ে দিল সিমিকে। সে ইচ্ছে করেই পুরনো মেইলটি পড়া থেকে নিজেকে নিবৃত করল। সে জানে একবার পড়লেই এই চিঠি সিমির ইনবক্সে আর কখনোই পৌঁছাবে না। আবারও বদলে যাবে তার মন। কী দরকার! দেখাই যাক সিমির প্রতিক্রিয়া কী হয়!

বর্ষা,
প্রিয়তম বন্ধু আমার—

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, আমার ভেতরে ভীষণ রকমের কিছু একটা হচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি। অদ্ভূত সে অনুভূতি। ঠিক এই একই অনুভূতি তোমারও হচ্ছিল। মনে হচ্ছে সেই একই অনুভূতি আমাকেও আক্রান্ত করেছে।   

কেউ একজন আমাকে কানে কানে বলে। সে এক ভয়ংকর অনুভূতিবোধ। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমার মাথা থেকে বের করে দিতে চাই। কিন্তু কিছুতেই পারছি না। অসহনীয় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। নিজেকে সংযত করতে না পারার অনুশোচনা আর অপরাধবোধ আমাকে কুরে খাচ্ছে। আমি দুঃখিত। ভীষণ দুঃখিত।

তোমার ওপরে আমার খুব রাগ বর্ষা। তুমি আমায় কেন বলো নি আগে? আমি ভেবেছিলাম অথবা তোমার কথায় আমার মনে হয়েছিলে ক্রিস শুধুই একজন বন্ধু তোমার। অথচ এখন দেখছি, সে বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। তুমি আমাকে পরিষ্কার করে বলো নি যে তুমি ক্রিসকে ভালোবাসো। তুমি তার সাথেই তোমার বাকি জীবনটা কাঁটাতে চাও। তাই যদি হবে তবে তুমি কেন তোমার এত কাছাকাছি আমায় যেতে দিলে? এর দায় কী আমার একার?

আমার কথায় মনে হতে পারে, আমি তোমাকেই দায়ী করছি সবকিছুর জন্য। অথচ, আমি কী করেছি তা তুমি আমি দুজনেই জানি। অন্যের ওপর দোষ চাপানো আমাদের মজ্জাগত অভ্যাস।

আমি তোমার ভালোবাসার মানুষ নই। তাই বলে ভেবো না আমি হিংসা করি সে কারণে। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। আমি তোমার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সম্মানও। আমার শুভকামনা আছে, থাকবে নিরন্তর।

আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। থাকতে চাই তোমার পাশে। আনন্দের ভাগ নিতে চাই, কষ্টেরও। তুমি কথা দিয়েছিলে যাই ঘটুক নিজেকে লুকিয়ে রাখবে না। বলবে সবই। তাহলে এখন কেন খোলসের ভেতরে বন্দি করে রেখেছ তোমায়? কেন কিছু বলছ না? কিসের ভয়ে বর্ষা?

আমার কষ্ট হয়, কষ্ট হচ্ছে। তোমার কারণে। তুমি কি তা বোঝ?

তোমারই,
ফাহিম।

পর্ব-২৭

ফাহিমের ইমেইল পড়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সিমি।

তাৎক্ষণিক কিছু লিখতে পারল না। তবে পরের দিন রাতে সে লিখতে বসল—

প্রিয় ফাহিম,
সত্যিই অনেকদিন হয়ে গেল তোমাকে কোনো মেইল লেখা হয় না। আমি ভীষণ দুঃখিত। যদিও অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম, তোমাকে লিখব, লেখা উচিত। একটা তাড়া অনুভব করছিলাম ঠিকই, অথচ লেখাটাই হয়ে উঠছিল না। আবার ঠিক বুঝে উঠতেও পারছিলাম না, কী লিখব, কী লেখা উচিত। তাই ভেতর থেকে তাড়া অনুভব করা সত্ত্বেও তোমাকে কোনো লেখা হয়ে ওঠে নি। আজ তোমাকে লিখতে বসেছি অথচ তোমাকে লেখার মতো আমার কোনো কথা নেই। ভাবা যায় তোমাকে কী লিখব সেটা নিয়ে ভাবতে হবে কোনোদিন, এটা ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি। তবুও, লিখতে যেহেতু হবেই, একবার না হয় শুরু করেই দেখা যাক।

কেমন আছ তুমি?

তোমার শহর শিকাগো আর তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন নারী—কেমন আছে তারা? অবশ্য যে কারণে তোমাকে লিখতে চাওয়ার তাড়নাবোধ করছি, সেটা বেশ অদ্ভুত। অস্বাভাবিক। বুঝিয়ে বলি। আমি লিখতে চাচ্ছি অথচ সাহস পাচ্ছি না। আমি বলতে চেয়েছিলাম, আমি দুঃখিত। তুমি নিশ্চয়ই জানো, কেন? কারণটা তোমার অজানা নয়।

তোমার সাথে দেখা হওয়ার পূর্বের জীবন আর দেখা হওয়ার পরের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা যে শুধু ঐ একদিনের ঘটনার জন্য তাই নয়। আমি আসলে স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি, আমি এতদূর যাব। কিন্তু আমি গিয়েছি। অন্যভাবেও বলা যায়, সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত হয়েছি।

রাশেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনোই ক্লান্তিকর কিংবা একঘেয়েমি ছিল না। আমাদের বিবাহিত জীবন ছিল চমৎকার। যথেষ্টই রোম্যান্টিক। কিন্তু অন্তর্জালে ক্রিসের সঙ্গে পরিচয় হলো এবং একটু একটু তাকে জানা শুরু করলাম, একই সাথে তাকে আমার ভালোলাগা শুরু হলো। আমি জানি না, একে ঠিক ভালোবাসা বা প্রেমে পরা বলে কি-না, কিন্তু সে আমার কাছে বিশেষ কেউ হয়ে উঠল, এটা নিশ্চিত।

রাশেদের ট্রান্সপ্ল্যান্ট সফল না হওয়ায় যখন আমরা চেন্নাই থেকে ফিরে এলাম, স্বাভাবিকভাবেই আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম রাশেদকে নিয়ে। কেননা, সবকিছু ছাপিয়ে আমিই তখন ছিলাম তার একমাত্র অবলম্বন। সে এতটাই অসুস্থ আর দুর্বল ছিল যে আমার সাহায্য ছাড়া তার একার পক্ষে কিছু করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ওই সময়টাতে ক্রিসের সঙ্গে আমার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্নই ছিল বলা যায়। নেটে বসার সময় পেতাম না একেবারেই। কাজেই যোগাযোগ ছিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। ক্রিসও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের দুজনের কেউই আসলে মেসেঞ্জারে গিয়ে চ্যাট করার জন্য কোনো রকম অস্থিরতা অনুভব করতাম না। অন্তত আমার পক্ষে তো নয়ই।

(গতকাল আমি এই ইমেইলটি লেখা শুরু করেছিলাম, তোমার মেইল পাওয়ার আগেই। আমি ঠিক জানতাম, ইমেইলে তুমি কী লিখবে। তাই আমি আগাম এই মেইল লেখা শুরু করে দিয়েছিলাম। যদিও শেষ করতে পারি নি তখন। আজ তোমার মেইলটি পেয়ে বেশ কয়েকবার পড়লাম। এখন উত্তর লিখছি। আশা করি আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর আজ দিতে পারব। আল্লাহ ভরসা।) 

আমি ভীত। শঙ্কিত। আমার ভয় হয়, তোমাদের দুজনকেই না আমি হারিয়ে ফেলি। তোমাকে আমি হারাতে চাই না, ফাহিম। কোনো কিছুর বিনিময়েই না।

রাশেদ যখন চলে গেল, তখন হঠাৎ করেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম— একা। সম্পূর্ণ একা। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। বিশ্বাস এবং নির্ভর করার মতো এমন কাউকে খুঁজে পেলাম না। ক্রিস তখনও আমার কাছে একজন দূরের মানুষই। শুভাকাঙ্ক্ষী কিন্ত আমায় ভালোবাসে কি-না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে কী, আমি তখন উপলব্ধি করি নাই যে, আমার জীবনে আর কখনো কারও প্রয়োজন আছে।

আমার জীবনে একমাত্র রাশেদই ছিল সবকিছু; তার সাথে যে জীবন আমি কাটিয়েছি, কোনো কিছুর বিনিময়েই তা পূরণ হবার নয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজেই নিশ্চিত ছিলাম না, ক্রিসের ব্যাপারে আমার অনুভূতি কী। যদিও তার সাথে আমার কথা হতো নিয়মিতই।  

আমি হংকং যেতে চেয়েছিলাম। সেভাবে তৈরিও হচ্ছিলাম। কিন্তু যখনই আমি জানতে পারলাম আমি হংকং যেতে পারছি না, দেরি না করে তখনই আমি ইন্ডিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এবং সেটি শুধু যে ক্রিসের সাথে দেখা হবে সেজন্যেই না। আমার আসলে দূরে কোথাও যাওয়াটা তখন জরুরি হয়ে পড়েছিল। ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি। সবকিছু থেকে একটা ব্রেক নিতে চেয়েছিলাম। আমি জানি সেটা ক্রিসের জন্য কতটা আনন্দের ছিল। কিন্তু সত্যিই সেটা বাস্তবে পরিণত হতে পারে, আমি বিশ্বাসই করি নি। তখনো আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, সে আমাকে কতটা কেয়ার করে সে মানুষটি। 

তারপরই, জানি না হঠাৎ কোথা থেকে, দুম করে তুমি এলে আমার জীবনে। রংধনুর মতো— এক পশলা ভারী বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর রঙের আবীর ছড়িয়ে তুমি এলে। আমি আমার জীবনের সবকিছু তোমার সাথে ভাগ করে নিলাম। একবারের জন্যও ভেবে দেখলাম না, আমার পরিণতি কী হবে। এ সম্পর্ক আমায় কোথায় টেনে নিয়ে যাবে। তারপর হুট করেই তুমি ঢাকায় এলে। মাত্র দু’ মাসের পরিচয়েই আমাদের দেখা হলো। অসম্ভব কিছু সুন্দর সময় একসাথে কাটালাম আমরা। অথচ আমার মনের কোণে চুপিসারে সব সময় লুকিয়ে ছিল একজনই— সে ক্রিস।

ফাহিম, এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক বলো নি যে তার কথা তোমায় আমি বলি নি। তুমি জানতে ক্রিসকে আমি ভালোবাসি। মনে করে দেখো, তার প্রতি আমার অনুভূতির কথা আমি তোমায় বলেছি। ক্রিসকে বিয়ে করার সম্ভাবনার কথাও কিন্তু আমি তোমাকে বলেছিলাম। সব শুনে তুমি আমায় বলেছিলে, আমার আমেরিকা কিংবা কানাডা চলে যাওয়া উচিত যাতে কেউ আমাদের এই অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করার ব্যাপারটা নিয়ে কথা না বলে। মনে নেই? হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, আমি বলেছিলাম, আমি তার রাধা নই। কারণ, আমার প্রতি তার ফিলিংস কী, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আমি হয়তো এখনো বলব, আমি কৃষ্ণর রাধা নই। যদিও ইতিহাস বলে, কৃষ্ণ কখনো রাধাকে বিয়ে করতে পারে নি। কিন্তু আমি তা চাই না। যদিও সেটা ভিন্ন গল্প এখন।

এখন ফিরে আসি সেই প্রসঙ্গে। তুমি আমাকে সাবধান করেছিলে। আমার আত্মসম্মানের প্রতি আমার আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রকট ছিল যে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম কিছুই ঘটবে না। আমার সাথে এমন কিছু হোক তা আমি কিছুতেই চাইব না। আমার সাথে এমন কিছু হতেও দেব না। মনে আছে ফাহিম, আমি বলেছিলাম, আমি না চাইলে আমার সঙ্গে কিছুই করা সম্ভব না। অথচ, শেষ পর্যন্ত কী হলো? আমি এখনো জানি না, কী হয়েছিল আমার। কেন আমি আমার নীতি আর ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজেই সম্মতি দিলাম।

শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হলো। আমি পারি নি তোমাকে থামাতে। নিজেকেও। আমি যখন নিজেকেই প্রশ্ন করি, কেন পারি নিÑআমি এর কোনো সদুত্তর পাই নি, আজ অবধিও। আমি জানতাম, রাশেদের পরে যদি কারও জীবনে আমি যাই, সে ক্রিস। অথচ, আমি এমন একজনের সাথে জড়িয়ে গেলাম যার সাথে আমার পরিচয় মাত্র দু’ মাসের। হ্যাঁ দুই মাস! দুই মাসই। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারি নি আজও। আমাদের মাঝে যা ঘটেছে তার দায় থেকে আমি আমাকে আলাদা করতে পারছি না। আমিও সম অপরাধী। তাহলে তুমি একা কেন গ্লানিবোধে ভুগবে? জবাবদিহিতা করবে নিজের বিবেকের কাছে?

শুধু শুধু একা নিজেকে দোষী বানিয়ো না, ফাহিম। এতে তোমার কোনো দায় নেই। আমারও নেই। আমরা দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার। আর আমার কী মনে হয় জানো, এটা হওয়ারই ছিল। তাই হয়তো পরিবেশটা তৈরি হয়েই ছিল। স্ক্রিপ্ট লেখা ছিল সেভাবেই। আমরা এই স্ক্রিপ্টের দুজন চরিত্র ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না।

ফাহিম, আমি তোমাকে পছন্দ করি। শুধু পছন্দ করি বললে ভুল বলা হবে। খুবই পছন্দ করি। আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করি। সম্মান করি। কোনো পরিস্থিতিতেই তোমাদের দুজনের মাঝে দেয়াল হতে আমি চাই নি। ধরো, ক্রিস আমার জীবনে নেই। তুমি কি আমায় বিয়ে করতে পারতে? পারতে এই সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যেতে? আমি জানি, পারতে না। তুমি যেমন জানো, আমিও জানি তুমি তোমার স্ত্রীকে কত গভীরভাবে ভালোবাসো। আর আমার পক্ষেও তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। আমি যে সব সময় বলে আসছি, ইউ আর নট মাই কাপ অব টি। তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। আচ্ছা ঠিক আছে, কথাটি আমি কেন বলি তার একটা ব্যাখ্যা আজ দেয়া যেতে পারে।

সত্যিকারভাবেই রাশেদই আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র পুরুষ। টিনেজ বয়সে দু’ একজনের প্রতি আবেগায়িত হয়েছিলাম, কারও কারও সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু সে পর্যন্তই। কারও সাথে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় নি। রাশেদ আমার জীবনে কী ছিল তুমি নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝেছ। নতুন কারও সাথে আমার পরিচয় আর সম্পর্ক একটু গভীর দিকে মোড় নিলেই আমি তাকে রাশেদের সাথে তুলনা করি— মনের অজান্তেই। বলতে দ্বিধা নেই, এ যাবৎকালে আমি রাশেদের সমকক্ষ দূরে থাক, কাছাকাছিও কাউকে পাই নি। এমনকি ক্রিসও নয়। নট মাই কাপ অব টি মানে, তুমি কোনোভাবেই রাশেদের সমকক্ষ নও। আবার কিংবা ক্রিসও নয়। তারপরও এর মধ্যে আমি ক্রিসকে বেছে নিয়েছি কারণ তাকে আমি ভালোবাসি। ওর প্রতি আমার যে ফিলিংস তৈরি হয়েছে— তা অন্য কারো সাথেই হয় নি। ক্রিসের সাথে আমার ছয় বছরের সম্পর্ক—রাশেদের পরে যদি কাউকে আমি একটু হলেও চিনি, সে ক্রিস। আমি জানি, আমার জন্য সে কতদূর যেতে পারে। আমি জানি তার জীবনে আমি কী। পুরো বিষয়টা আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না, তবে এ কথা ঠিক বলতে পারি— যদি ক্রিস আমার জীবনে নাও আসত, তবুও তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারতাম না।

ফাহিম, আমার এমন সরাসরি কথায় তুমি যদি কষ্ট পাও, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো। তবে কষ্ট দেয়া আমার অভিপ্রায় নয়। এই কথাগুলো বলার জন্য আমাকে প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। আশা করি তুমি আমাকে বুঝবে।

আমার মনে হচ্ছে আমি ট্র্যাকের বাইরে চলে যাচ্ছি। আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আমি জানি না, আমি কেন তোমার সাথে এটা করেছি। তাই বলে আমি নিজেকে দায়ী করতে চাই না এ জন্য। তোমাকেও না। আমার গভীর দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তবে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। 

আমি জানি আমি ক্রিসকেও ঠকিয়েছি। আমার বাকি জীবনে এই অপরাধবোধ আমাকে কুরে কুরে খাবে। তবে তুমি ভয় পেয়ো না। আমি এই ব্যাপারে ক্রিসকে কিছুই বলব না।

ফাহিম, তুমি আমার জীবনে সেই বন্ধু হয়েই থাকবে। আমি তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা আর সম্মান করি। এ কথা আমি তোমায় বলেছি বহুবার। সম্ভবত এখানেও লিখেছি একবার। আমি এখনো তোমার ইমেইলের অপেক্ষায় থাকি। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝো না। আমি ক্রিসকে অনেক ভালোবাসি। সে মুসলমান নয়, সে কথা জেনেও আমি তাকে ভালোবেসেছি। তার প্রতি আমার আবেগ কোনো অংশেই কম নয় বরং বেড়েই চলেছে। আর এবার ইন্ডিয়া ট্রিপে তার সঙ্গে আবার দেখা হবার পর থেকে আমি এই প্রথমবারের মতো অনুভব করছি, সে কতটা ভালোবাসে আমাকে। ক্রিসের মতো একজন সুন্দর মনের মানুষ আমার জীবনে এসেছে, এটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের বিষয়।

তুমিও আমার জীবনে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। তোমার মতো বন্ধু মেলা ভাগ্যের ব্যাপার। ফাহিম, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো। আবারও বলছি, তোমাকে আমি হারাতে চাই না। তবুও, তুমি যদি চলে যেতে চাও, আমি তোমাকে বাধা দেব না। শুধু জেনে রেখো, আমাদের বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কিছু নেই। আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্লিজ এটাকে ভেঙে দিয়ো না।

তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত ফাহিম। ভীষণ দুঃখিত। সত্যিই।

অফুরান ভালোবাসা,
বর্ষা।

Leave a Reply

Your identity will not be published.