অনুচ্চারিত যন্ত্রণা

অনুচ্চারিত যন্ত্রণা

ভোরের নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে যখন প্রথম আলো ফুটে ঠিক তখনই শেলির ঘুম ভাঙে। ভোরের বারান্দাটা ভীষণই স্নিগ্ধময় লাগে ওর কাছে। একটু ফ্রেশ ব্রিদিং পাওয়া যায়, তা ছাড়া হেঁটে যাওয়া লোকজনের ভিতর এক অমলিনতার ছাপ থাকে।

শেলিও হাঁটতে যায় কিন্তু আজ কেন জানি ওকে সাংসারিকতায় পেল। ও মানুষগুলো দেখতে দেখতে ঠিক করল—আজ পুরোনো শীতের কাপড়গুলো ঝেড়ে, ধুয়ে, শুকিয়ে ভাঁজ করে তুলে রাখবে। ডিসেম্বরের ঠান্ডা সামনে আসবে, আর তাদের ছোট ছেলে শীতলের আবার ঠান্ডার ধাঁচ আছে। ওর বরাবরই হালকা কাঁথা লাগে।

শুভ’র আবার উল্টো। গরম ওর শরীরভর্তি। কনকনে ঠান্ডা না আসা পর্যন্ত ও কাঁথা বা লেপ ব্যবহার করবে না। বাপ-বেটা এক্কেবারে উল্টো।

কোথায় ? একটা লেবু চা দেবে ?

কেন আদা দেই ?

তা দাও, কিন্তু লেবুটা আমার উঁচু পেটের জন্য ভালো।

রান্নাঘরের তাকে রাখা চায়ের বোয়ামটাতে বেশ ময়লা জমেছে। পরিস্কারে বসতে হবে। ধ্যাত! আজ খালি ময়লাই চোখে আসছে। আসলে আমাদের জীবনের আনাচে-কানাচে কোথায় কোন কোনায় কতখানি ময়লা জমেছে, সেটা কি আমরা সব সময় খুঁজে পাই, না পরিষ্কার করি ? অহেতুক সব প্রশ্ন আজ কেন জানি শেলির মনে জাগছে।

অলংকরণ : লক্ষন চন্দ্র নাথ 

 

ছেলে উঠার আগেই আলমারিটা গোছাতে হবে। একেক করে তাকের গুমোট কাপড়গুলো বের করে একে একে সব আলাদা করে রাখল শেলি। তারপর নজরে এল শুভ’র সেই বাদামি রঙের কোটটা। যেটা শুভ বহুদিন পরে নি।

কোটটা বারান্দায় নিয়ে ঝাড়তেই শেলির খেয়ালে এল পকেটে থেকে কিছু একটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! হাত ঢোকাতেই পকেটে একটা মোটা কাগজে হাত পড়ল। টাকা ? নাতো, দেখি তো ?

পকেট থেকে হাতড়ে বেরুলো একটা পুরোনো ছবি। রঙচটা ধূসর কাগজে ছাপা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে শুভ আর একটা মেয়ে। ওরা একটা ঝাড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, দুজনেই চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু মেয়েটার মুখে লাবন্যেভরা রহস্যময় হাসি। ছবিটা উলটিয়ে দেখল একটা লেখা—

‘অপেক্ষায় থাকা দিনটা কি আবার ফিরে আসবে ?—মিরা’।

সাংসারিক জীবনে এতটা সময় তারা পার করেছে, কখনো তো এই নাম শুভ’র মুখে শোনে নি। শেলি আবার ছবিটা পরখ করে দেখল, নাহ, কোনোভাবেই ধরতে পারছে না।

একটা বিষয় ওকে বেশ নাড়াচ্ছে, সেটা হলো, মেয়েটার চোখে যে চাহনি, তা বন্ধুর নয়।

বিষয়টা হয়তো কিছুই নয়। জীবনে নানাধরনের ঘটনা, নানান মুহূর্ত আসতেই পারে অথবা পছন্দের অনেক নর-নারী থাকতেই পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। সে নিজেকে এভাবেই প্রবোধ দিল, আগে জীবনে হয়তো কোনো সম্পর্ক লুকিয়ে ছিল ওদের মাঝে। থাকুক গোপনে কিন্তু পকেটে সেই ছবি বহন করাটা একটু অন্যরকম কিছুর সংকেত বহন করে কি ?

শেলির বুকে এক নরম নিস্তব্ধতা নেমে আসে।

বারান্দায় গ্রিলের ফাঁক গলে আসা মিঠে রোদ্দুরটা তখনো উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। কিন্তু শেলির মনের কোণে টুকরো একফালি মেঘ লুকিয়ে গেল।

শেলি টুলে বসে আস্তে-ধীরে তোলা কাপড়ের ভাঁজগুলো খুলে একটু ঝেড়ে গ্রীলের পাশে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখল। হালকা বাতাসও বইছিল, তাই ঝুড়ির ভেতরে রাখা ক্লিপগুলো দিয়ে আটকে দিল।

মাঝে মাঝে তোলা কাপড়ের ধুলোতেও এলার্জি হতে পারে। শেলি একটা হাঁচি দিল।

 

সেদিন শুভ অফিস থেকে বাড়ি আসার পর শেলি ওকে কিছুই বলল না। তবে মনের ভেতর প্রশ্নগুলো ক্রমশ ঘুরপাক খেতে লাগল—।

শুভতো জানে, শেলি ভীষণ উদারমনা, তবে সে কোনোদিনই এই বিষয়টা ওকে জানায় নি, কিন্তু কেন ?

আর এই মিরাই-বা কে ? কেনইবা একটি ছবি এত যত্নে কোটের পকেটে রাখা ছিল ?

রাতে খাবার পরে টেবিলটা গুছিয়ে সকালের জন্য সবজি কুটে ফ্রিজে রাখল। হঠাৎই পিছন থেকে শুভ এসে বলল, কী ব্যাপার শেলি, বুয়া কি আসবে না ?

শেলি বলল, আসবে, ইচ্ছে হলো তাই করছি। তুমি যাও ছেলেটাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।

শুভ কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু হয়েছে ?

কই তেমন কিছু নাতো!

শুভ মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘরে চলে গেল।

রাতে যখন ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন শেলি ছবিটা হাতে নিয়ে গিয়ে শুভ’র সামনে দাঁড়াল।

এই ছবির ঘটনাটা কী বলো তো ? কোনোদিনই এ মেয়ের কথা আমাকে বলো নি যে ?

শুভ হঠাৎ থমকে যায়।

চোখে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি জ্বলে আবার যেন নিভে যায়—ভয়, অসহায়তা ? নাকি গভীর কোনো দুঃখ!

শেলি বোঝার চেষ্টা করল।

কয়েক সেকেন্ড পরে স্থির হয়ে শুভ বলল, আসলে এটা...এটা অনেক আগের কথা।

কিন্তু তুমিতো একদিন বলেছিলে তোমার কোনো প্রেম ছিল না, শুধু একটা ছোট বোন ছিল... এখন দেখছি তুমি আমাকে অর্ধেক সত্যি বলেছ। তা ছাড়া আমাকে কি এতই রেস্টিক মাইন্ডসেটের মহিলা মনে হয় ?

কিছু না বলে শুভ ডাইনিং রুমে গিয়ে ঢকঢক করে গ্লাসে রাখা পানি খেল, তারপর ধীরে ধীরে একটা চেয়ার টেনে বসল। ইশারায় শেলিকে কাছে ডাকল।

শেলি বাবুর মশারিটা ভালো করে গুঁজে দিল। মশার উৎপাতটা অসহনীয়ভাবে বেড়ছে। তারপর শুভর পাশে চেয়ারে বসল।

তুমি কি শুনতে চাও ?

শেলি মৃদু হেসে মাথা নাড়ে। ও শুভর পিঠে হাত বুলিয়ে দিল, বোঝাল সে এখন শুধু স্ত্রী নয়, একজন মানুষ, যে তার ভালোবাসার সত্যিকারের গল্প জানতে চায়। শুধু বলল, সত্যি বললে ভালো লাগবে।

ওর নাম ছিল মিরা। আমার ছোট বোন। আমরা বড় হয়েছি কুমিল্লায়। তুমি তো জানো, মা-বাবা ছোটবেলাতেই মারা যান এক বাস দুর্ঘটনায়। আমি তখন রাজশাহী কলেজের ছাত্র। এদিকে মিরা ছিল সম্পূর্ণ একা ও অল্প বয়সী।

একরকম আমার ওপর ও পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও বদলে যেতে লাগল। কেমন যেন ছায়ার মতো হয়ে উঠল। আমার প্রতি একটা অদ্ভুত নির্ভরতা... না, আসক্তি জন্মে গেল ওর মধ্যে। আমি বিভ্রান্তি বোধ করতাম, কিন্তু মা হারা বলেই অনেক সময় অনেক কিছু সহ্য করে নিতে হতো।

শুভ একটু কথা থামিয়ে দেয়। তারপর আবার শুরু করে। বলে, এটা যখন বাড়তেই থাকল তখন বাধ্য হয়ে ডাক্তারের সরণাপন্ন হই। পরে ডাক্তার আমাকে জানায়, ব্যথাবেদনায় ওর মনোজগতে গভীর সংকট জন্মেছে। এটাকে বলে—উরংংড়পরধঃরাব ওফবহঃরঃু উরংড়ৎফবৎ। ওর নিজের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় তৈরি করে ফেলে ও। কখনো নিজেকে ‘মিরা ’ ভাবে, কখনো কখনো আমার স্ত্রী...এমনকি কখনো আমার মা। তুমি যে ছবিটা দেখছ, সেই সময় ও নিজেকে আমার প্রেমিকা মনে করত, তখনই এই ছবিটা তোলা আমাদের ট্রিপে।

শেলি বিস্মিত হয়ে কাঁপা গলায় বলে, তুমি কখনো কাউকে বলো নি এটা ?

না। কারণ আমি নিজেই বুঝতে পারি নি কতটা ভয়ংকর ছিল ওর অবস্থা এবং এটা বাঙালি সমাজে শেয়ার করার বিষয় নয়।

শুভ উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাড়ায়। বাইরে গভীর কালো অন্ধকারের মাঝে টিক টিক করে জ্বলা আর নেভা তারারা সারিবদ্ধ।

সেদিন ছিল ২০১১ সালের এক শীতের সকাল। ট্রেনে করে আমরা চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম, মানসিক হাসপাতালের এক স্পেশালিস্টের কাছে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে ও। তারপর... হঠাৎ ট্রেন থামার আগে দরজা খুলে লাফ দেয়। আমরা কেউ ধরতে পারে নি।

আর কখনো খুঁজে পাও নি ?

একটা চিঠি পেয়েছিলাম কেবল, যা ও নিজের হাতে নিজের নামে পোস্ট করেছিল। আর কিছু নয়।

পরদিন সকালে শেলি কোটটা আবার বের করল। এবার শুধু ছবির পেছনেই নয়, পকেটের ভেতরের সেলাইয়ের নিচে আরেকটা ছোট কাগ পেল। ভাঁজ করা, প্রায় ছেঁড়া। কাগজে লেখা—‘মনে রেখো—আমি এখন আর আমি নই। আমি হয়ে গেছি সেই মেঘ, যে নিজের ছায়াকেও চিনতে পারে না।’

শেলি বুঝে গেল, শুভর ভেতরে এখনো একটা অনুচ্চারিত শোক বাস করে, যা সে কোনোদিন কাউকে বলে নি। কিন্তু তার দাম্পত্যজীবনের ছায়াতেও এখন প্রশ্ন ছড়িয়ে গেছে। শুভ একাকী কেন সেই শোক নিয়ে বসবাস করবে ? ও বুঝতে পারল শুভকে কিছুটা সময় দিতে হবে।

 

দুই সপ্তাহ পর।

শুভ রাতে আটটার দিকে বাড়ি ফিরেছে। শুভ ক্লান্তিতে পোশাক ছাড়তে লাগল। তখন শেলি বলল, জানো, আজ বাবুকে স্কুলে দেওয়ার সময় একটা মেয়ে নাকি এসেছিল বাসায়। বাড়িয়ালা আন্টিকে বলে গেছে—আমি তিশা, শুভ ভাই এলে মেয়েটিকে এই চিঠিটা দিবেন। উনাকে বসতে বললেই সে চলে গেছে।

শুভর মন স্তব্ধ হয়ে যায়। বলে, কী রেখে গেছে ?

শেলি একটা খাম বাড়িয়ে দেয়। খামের ভেতর কালির হরফে লেখা চিঠি।

চিঠিতে লেখা আছে—

শুভ ভাইয়া, এবার আমি নিজের ছায়াকে হারিয়ে এসেছি। তুমি কি এবার বিশ্বাস করবে—আমি ঠিক হয়ে গেছি ? শুধু একবার দেখা করো।

                তিশা

শেলি চিঠিটা অনেকক্ষণ ধরে হাতে নিয়ে বসে ছিল। পাশে দাঁড়ানো শুভ এক্কেবারে থেমে গেছে—তার চোখে এমন এক বিস্ময়, যা ভয়ের থেকেও গভীর।

তুমি কি এখন ওকে চিনতে পারবে ?

শেলির গলা সোজা, স্বাভাবিক, কিন্তু ভেতরে টান টান।

শুভ চোখ খুলে তাকায়, ধীরে মাথা নাড়ে।

শেলি চিঠিটার শেষ লাইন আবার পড়ে—

‘...আমি ঠিক হয়ে গেছি। শুধু একবার দেখা করো।’

তুমি কি দেখা করবে ?

এবার শেলির কণ্ঠ একটু শীতল।

শুভ কোনো উত্তর দেয় না। শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরের রাস্তার আলোয় যেন হালকা ধুলোর মতো কুয়াশা জমে আছে। চোখে মুখে যেন এক বিভ্রম কাজ করছে। ও কেবলই ভাবতে থাকে, এবার কি তবে মিরা ওদের সাংসারিক জীবনের স্বাভাবিক সুরে বিঘ্ন ঘটাবে ? একসময়ে যেটা তার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আবার গভীর থেকে কে যেন বলে উঠল, মিরা তো আমার বোন!

শেলির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুভ প্রেশারের ওষুধটা খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পরদিন ভোরে শুভ শেলিকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়ে। হাতে ওর বোন মিরার লেখা ঠিকানাটা।

ঠিকানাটা ঢাকার মিরপুরের একটা পুরোনো ফ্ল্যাট বিল্ডিং—অর্ধেকটা জীর্ণ, অর্ধেকটা ভালোই আছে। দোতলার একটি দরজায় শুভ কাঁপা হাতে টকটক শব্দ করে।

ভেতর থেকে একজন আধা বয়সী মহিলা দরজা খোলে। চোখে গোল কালো ফ্রেমের চশমা, মুখে হালকা কালো দাগ।

শুভ ভাই ? আরে, আমি মনে প্রাণে আপনাকে খুঁজছিলাম। মহিলার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে।

আপনি ?

আমি রাবেয়া খাতুন। আপনি যার খোঁজে এসেছেন, সে এখন আর নেই। যদিও সে আমার ক্লায়েন্ট মাত্র। আমি তার কেস হ্যান্ডেল করছি। আমি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।

শুভ স্তব্ধ।

মানে ?

শুভর চোখের দিকে স্পষ্ট চেয়ে রাবেয়া বলে, আপনার বোন, মানে মিরা...এখন ‘তিশা’ নামে নিজেকে পরিচয় দেয়। এবং বর্তমানে সে নিজেকে একজন স্কুলশিক্ষিকা ভাবে। সে চায় না কেউ তাকে ‘মিরা’ ডাকুক। কারণ ও মনে করে, মিরা নামটা একটু প্রাচীন। এটুকু বলে রাবেয়া, একটা খাম বাড়িয়ে দিল শুভ’র দিকে।

শুভ খামটা নিল। তাতে একটা ছবি—মেয়েটা একটি ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে মুখে প্রশান্ত ভাব।

কিন্তু সে কি সত্যিই মিরা ?

বহু বসন্ত পার হয়ে গেছে। পাতা ঝরা অনেক বৃষ্টি ঝরে গেছে আর তার নিজের চেহারারও বেশ চেঞ্জ হয়েছে। এখন এই নিজেকে চেনাই ভারী দায়!

শুভ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবার মিরার ছবিটা দেখল, শুধু বলল, আমার বোন মিরা ?

 

আজ শুভর ফিরে আসতে অনেক রাত হলো। শেলি টেবিল সাজিয়ে রেখে অপেক্ষা করছিল।

গিয়েছিলে ?

হ্যাঁ।

দেখা হয়েছে ?

শুভ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে—না। দেখা হয় নি। কিন্তু একটা কথা শুনে এসেছি—ও এখন নিজের একটা নতুন পরিচয়ে শান্তিতে আছে।

শেলি একটু চুপ করে থেকে বলে—তুমি জানো, আজ দুপুরে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছিল। মেয়ের গলা। শুধু বলল—আপনার স্বামী শুভ ভাইয়া ? তারপর ফোন কেটে দিল।

শুভর মুখে ছায়া নামে।

 

এক রাতে শেলি ঘুম ভেঙে দেখে, শুভ বিছানায় নেই।

সে উঠে দেখে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুভ বিড়বিড় করে কিছু বলছে।

শেলি ধীরে কাছে যায়। শোনে শুভ বলছে—

তুমি ফিরে এসেছো, তাই না ? আবার আমার ছায়ার মধ্যে মিশে গেছ। মিরা না হয়ে উঠলে তো তুমি কেউ নও।

শেলির গা ঘেমে ওঠে।

তার মনে পড়ে যায়, শুভ’র তো সেই সময় অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারত না। নিজে নিজে কথা বলত। সে ভেবেছিল, এটা হয়তোবা অফিসের ব্যস্ততায় মানসিক চাপ। কিন্তু...

মিরা কি শুধু একজন ? নাকি মিরা আর শুভ—দুজনেই বহুরূপী! দুজনেই সাইকো পেশেন্ট ?

অস্থিরতার মাঝে শেলির রাত কাটে।

পরেরদিন দুপুরে শেলি আলমারির গোপন তাকে একটি পুরোনো ডায়েরি খুঁজে পায়। শুভ আগে অনেক কিছু লিখত, বিয়ের পর বন্ধ করে দিয়েছিল। ডায়েরির পাতাগুলো হলদে, তবুও অক্ষরগুলো তীক্ষè।

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০

সেদিন মিরা আমার খুব কাছে এসেছিল। আমি সরিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু সে বলল, আমি শুধু তোমার নীলা, তোমারই ছায়া। আমি ভয় পাই। আমার নিজেরই ঘর, নিজেরই শরীর আমার কাছে কি অচেনা হয়ে গেছে ?

২৮ এপ্রিল, ২০১০

আমি নিজেই কি ভুল করে ফেলেছি ? হয়তো ওর ব্যাধির উৎস আমিই। ওকে আমি ছায়ার মতো পেছনে টেনে রেখেছি—নির্ভরতা, এক অন্ধ ভালোবাসা দিয়ে, যেখানে মুক্তি নেই।

শেলি ডায়েরি বন্ধ করে দেয়। তার মনে হয়, এই ডায়েরি শুধু মিরার মানসিক রোগের কাহিনি না—এ এক সমান্তরাল বিকার যেখানে শুভ নিজেও আবদ্ধ ছিল।

এরপর রাবেয়ার কাছ থেকে একটি চিঠি আসে।

সেখানে লেখা—

তিশা এখন স্থিতিশীল। সে আপনাকে একবার দেখতে চায়, কিন্তু মুখোমুখি নয়—কারণ সে বিশ্বাস করে, আপনি এখনো তাকে প্রেমের চোখে দেখেন।

শুভ দ্বিধা করে, কিন্তু রাজি হয়।

রাবেয়ার ঘরে শুভ ও মিরা বসে আছে। পিছনে ফিরে মিরা বলে, ভাইয়া, আমি তোমার মতো নয়। তুমি ভালোবাসা আর দায়বদ্ধতার মাঝখানে ডুবে গিয়েছিলে। আমাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলে, অথচ তুমিই ছিলে আমার বিকৃতি। এখন আমরা দুজন দুজনকেই ক্ষমা করি। আমাদের দুজনের স্বাভাবিক জীবনের জন্য দূরে থাকতে হবে, ডাক্তার আপা বলেছে।

রাবেয়া বলে, মি. শুভ, জীবন সুন্দর রাখতে চাইলে দূরে থাকুন। আর মিরা আমাদের ফাউন্ডেশনের আন্ডারে থাকুক।

শুভর চোখ ভিজে ওঠে। সেই ভালো, শুধু বলে, বোন, তুমি ভালো থেকো, মিরা...তিশা। এবার সত্যি সত্যি বিদায়।

বাড়ি ফিরে শুভ এবার সেই ছবিটা হাতে নেয়, চুপচাপ বসে থাকে।।

শেলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে, শুভ অন্য রুমে হাতের ছবি আর ডায়েরিটা একসাথে পুড়িয়ে দিচ্ছে। পরে পাশে বসে শতীল ছাইয়ে ফুঁ দিচ্ছে। আগুনের আঁচে কেবল ছাই উড়ছে না, যেন কোনো দীর্ঘ সময়ের অপরাধবোধ, চাপা প্রেম, বিকৃতি আর আত্মার জট ছিঁড়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ হচ্ছে শুভ।

শেলি কাছে এসে চুপচাপ শুভর হাত ধরে। ও কিছু বলে না। শুধু বুঝে যায়, শুভ আজ সত্যিই ফিরেছে। মিরার গল্পের ছায়া শেষ হয়েছে।

কিছু ছায়া থাকে, হারিয়ে যাওয়ার জন্য। আর কিছু মানুষ ফিরে আসে, একেবারে সত্যি হয়ে।

 

‘অন্যপ্রকাশ লাখ পেরিয়ে উদযাপন গল্পলেখা প্রতিযোগিতা’-য় এই গল্পটি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.