স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ১৮ অক্টোবর। এ উপলক্ষে আমাদের এই আয়োজন।
১৯৪৬ সালে ফরিদপুর শহরের নিলটুলীতে জন্মগ্রহণ করেন কালিদাস কর্মকার। ১৯৬২-৬৪ এই তিন বছর তৎকালীন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে দুই বছরের সূচনা কোর্স শেষ করে ১৯৬৯ সালে কলকাতায় সরকারি আর্ট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে চারুকলায় স্নাতক করেন। দেশে-বিদেশে আয়োজিত শিল্পী কালিদাসের একক চিত্রপ্রদর্শনীর সংখ্যা এ দেশের চারুশিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক। ১৯৭৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্স শিল্পী হিসেবে দেশে-বিদেশে কাজ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে ছাপচিত্র-শিল্পের প্রচার ও প্রসার আন্দোলনে গ্রাফিকস আঁতেলিয়ার-৭১-এর মাধ্যমে তার ভূমিকা স্মরণীয়। ভারত, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কোরিয়া, আমেরিকায় আধুনিক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে উচ্চতর ফেলোশিপ নিয়ে সমকালীন চারুকলার নানা মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। জীবদ্দশায় একুশে পদক, শিল্পকলা পদকসহ অসংখ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন বরেণ্য এই চিত্রশিল্পী।
কালিদাস কর্মকার বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর তিনি দেশে ফেরেন। সেই বছরের ১৮ অক্টোবর চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকারকে ঢাকার বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকেরা কালিদাসকে মৃত ঘোষণা করেন। দুই মেয়ের অপেক্ষায় ছিল তার শেষযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা। তারা আসার পরে সম্পন্ন হয় শেষকৃত্য। শিল্পীর মরদেহের দাহ হয় সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালীমন্দিরে।
কালিদাস কর্মকারের ‘পাললিক’ সিরিজ যেন বাংলার মানুষ ও ঐতিহ্য অন্বেষণের এক ধারাবাহিক চিত্রমালা। শিল্পীর সব প্রদর্শনীর সঙ্গে ‘পাললিক’ শব্দটি জড়িয়ে থাকত। পলিমাটির এই দেশ তার চিন্তায় মিশে ছিল সব সময়। তারই প্রকাশ যেন তিনি ঘটাতে চাইতেন সেই শব্দের মধ্য দিয়ে। শিল্পী এক সাক্ষাৎকার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ—এই ভূখণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে পলি জমে জমে। এই অঞ্চলে মানুষের মনও তাই পলির মতোই নরম। এই সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বঞ্চনার শিকার এসব মানুষের মন মরে যাচ্ছে। কিন্তু এত অস্থিরতার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই মানুষ জেগে উঠেছে তার স্বকীয়তায়। তার আদি চরিত্রে। জীবনে এই কথা, এই উপলব্ধি সব সময় আমার কাজে তুলে আনতে চেয়েছি।’
তিনি বড় ক্যানভাস ও ডিটেইল কাজের জন্য সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ আলোচিত ছিলেন। তার ছবিতে গহিন প্রশ্ন আছে, যুক্তির বেড়াজালের বাইরে বেরিয়ে তার ছবিতে মুখ্য হয়ে ওঠে অতল আবেগ। রূঢ় বাস্তবতা যেমন নিঃসংকোচে প্রকাশ করেছেন, তেমনি নান্দনিকতার স্পর্শ তার ছবিকে করে তুলেছে মোহময়, রহস্যময়। কালিদাসের ছবিতে শুধু বেদনা এবং বেদনা প্রকাশের ব্যাপারটিই মুখ্য নয়, বরং এটি সময়, স্থান এবং অবিশ্রান্ত মানবীয় অভিজ্ঞতার মধ্যকার সম্পর্ককে মূর্ত করে তোলে। তার কাজে সামান্য উপাদান, বুনট, আকার এবং রঙের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ দেখা যায়। প্রকাশ পায় শিল্পীর উচ্ছ্বাস, অভিব্যক্তি, শুদ্ধতা, বেদনা, স্মৃতি আর একাকিত্ব।
শিল্পী কালিদাস কর্মকার অ্যাবস্ট্রাক্ট ইম্প্রেশনিজম এবং সুররিয়ালিজম উভয় ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর সঙ্গে তার ভিসকসিটি প্রিন্টিং-এ প্রশিক্ষণ নেয়ার বিষয়টিও সম্পৃক্ত। ভিসকসিটি প্রিন্টিং আসলে অয়েল-বেজড কালি যা একটি প্লেট থেকে তিন বা তার বেশি রঙের বিন্যাস ঘটায়। রিলিফ প্রিন্টের সর্ম্পূণ বিপরীত এই কৌশল উদ্ভাবন করেন ব্রিটিশ শিল্পী স্ট্যানলি উইলিয়াম হেইটার। কালি থাকে প্লেটের নিচে। উপরিতলে এচিং পেপার বা মেটাল বিছানো হয়। স্ট্যানলির এই উদ্ভাবন প্রিন্টিং-এর যুগে নতুন অধ্যায় সূচনা করে। শিল্পী কালিদাস কর্মকার ব্রিটিশ শিল্পী স্ট্যানলির সংস্পর্শে আসেন। প্রশিক্ষিত হন। একসঙ্গে কাজ করেন। আর নিজের দেশে দিয়ে যান এই আবিষ্কারের ফসল, যা প্রিন্টিং ও স্থাপত্যকলায় অভাবনীয় অবদান রাখতে সক্ষম।
পাখি নেই, তবে তার পালক পড়ে আছে। কালিদাস কর্মকারও তার শিল্পকর্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.