এক শীতের রাতে

এক শীতের রাতে

নূরী গুনগুন করে কাঁদছে আর জোরে জোরে হাঁটছে। ও খুব ভীতু একজন মানুষ কিন্তু আজ কী যে হলো এত রাতে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ল। আজকে আর সহ্য হলো না। সোজা রাস্তা ধরে হাঁটলে ও ঠিক পৌঁছে যাবে ভোরের আলো ফোটার আগে। ওখানে কেউ ওকে খুশি মনে আশ্রয় দেবে না, তবুও তো মা-ভাই। নূরী মনে মনে ভাবল, কুটি ভাই ইকটুখানি জায়গা ঠিক দেবেনে। বাঁশঝাড়ের পাশে টিনের ছাপড়ায় আমি আর মা থাকতাম, ওই ঘরের এক কুণায় প্যোড়ে থাকলি কেউ বুঝতিই পারবে নানে, ব্যোসে তো আর খাবো নানে! 
শীতের রাত কুয়াশায় ডুবে আছে পৃথিবী। চাঁদের আলো কুয়াশার নদী পেরিয়ে মাঠঘাট গাছপালায় যখন এসে পড়ছে একেবারে মরা ভুতুড়ে। নূরীর কলিজা কেঁপে উঠছে সামান্য একটু বাতাসে, দূরের একটা রাতজাগা পাখির ডাকে। গৃহস্থ বাড়ির শিশুর কান্না মনে হচ্ছে ভূতের হাসি। শীতের রাত। মানুষজনের দেখা খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না।
একটা শেয়াল ডেকে উঠল, সাথে সাথে অনেকগুলো। আজন্ম চেনা শব্দ। তবুও ভয় করছে।
নূরীর গায়ে একটা পাতলা কাপড়। এই শীত একেবারে চামড়া ভেদ করে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তার ওপর ভয় তো আছেই।
কয়েকজন মানুষ বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। শীতের রাতে খুব দায় না থাকলে কেউ বের হয় না। তাড়াতাড়ি নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় রাত। নূরী গাছের আড়ালে সরে গেল। বলা যায় না কার মনে কী আছে! মানুষগুলো দূরে মিলিয়ে গেলে ও আবার চলা শুরু করল। 
রাস্তাটা ফাঁকা। ভয়ও জেঁকে বসেছে। পা ব্যথা ব্যথা করছে, রাগের মাথায় স্যান্ডেলটাও পরা হয় নি। নূরী ভাবল সামনে যে নিচটা বাঁধানো বটগাছ আছে ওখানে একটু জিরিয়ে নেবে। সেটা কতদূর অনুমান করতে পারছে না। হঠাৎ করেই সামনে পাকুড় গাছটা এসে পড়ল। অনেক জায়গাজুড়ে ঝুরি ছড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে গাছটা যেন ওর পথ আগলে দাঁড়াল, একটা কিছুতে পা বেঁধে হুড়মুড় করে ঝুরির ওপর আছড়ে পড়ে, ‘ও মা গো’ বলে চিৎকার করে উঠল নূরী। ঘুমন্ত গ্রামে কারও কানে সে শব্দ পৌঁছাল না। কুয়াশা ভেদ করে শিশির ভেজা মাঠে ছড়িয়ে পড়ল শুধু আর গাছে ঝুলে থাকা বাদুরগুলো ডানা ঝাপটে উড়ে গেল দূরে কোথাও। সে শব্দে নূরী আরও ভয় পেয়ে গেল।
সামনে বড় আম বাগানের জমাট অন্ধকার, নূরীর ভেতর পর্যন্ত ভয়ে কুঁকড়ে উঠল। দৌড় বাগানের জায়গাটুকু পেরিয়ে এল। কিছু দূর গিয়ে আর পারল না, বাবলা গাছের নিচে বসে পড়ল। বুকের ভেতরের শব্দটা পর্যন্ত শুনতে পারছে নূরী। ক্ষিধেও পাচ্ছে। রান্নাটা কেবল শেষ করেছিল, খাওয়াটা আর হয়ে ওঠে নি। 
বজ্জাত লোকটা কী ম্যারটা ম্যারল্লো! যত রকম গালি জানে মনে মনে সবগুলো আওড়াচ্ছে স্বামীর উদ্দেশে কিন্তু তব্ওু শান্তি পাচ্ছে না নূরী, আরও খারাপ কিছু গালি দিতে ইচ্ছে করছে। এতক্ষণে চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকল। হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে কিছুটা সময় কাঁদল। কে দেখবে ওর দুঃখ! ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে আবার চলতে শুরু করল ও।
কিছু সময় একেবারে দমবন্ধ করা নীরবতা, শুধু একঘেয়ে ঝিঁঝিপোকার ডাক। পথের পাশে জড়ো করে রাখা শুকনো পাতার স্তূপের ওপর পা পড়ে শব্দ করে উঠল। শিশিরে উপরটা ভিজে গেলেও পাতাগুলোর ভেতরটা এখনো মচমচে। সে শব্দে বাড়ির বারান্দা থেকে একজন বুড়ো মানুষ গলা খাকারি দিয়ে বলল, কীডা যায় ? কীডা ? 
নূরী থামল, অবুলা মেয়ে মানুষ গো! 
বুড়ো মানুষটার কাশি উঠল, মনে হচ্ছে জানটা বের হয়ে যাবে, গলা পরিষ্কার করে বলল, এতো রাত্তিরবেলা কনে য্যাস ?
জাহান্নামে, আর কুথায় যাব, যাবা আমার সাতে ?
বুড়ো খুশি গলায় বলল, নিবি ? সেই ভালো জাহান্নামেই নিয়ে চল আমারে। য্যোমেও আমারে চোখি দ্যেখে না রে।
তুমি য্যোমরে ডাকতি থ্যাকো ঠিক অ্যাসে পড়বেনে, এ্যাখোন আমি যাই, ম্যালা রাস্তা এ্যাখোনো যাতি হবেনে আামার। সেই কোন আমল থ্যেকে দেখছি তুমারে, পাহারাদারের মতোন বারান্দাটাতে শুয়ে ব্যসে থাকো, ঘরে জায়গা হয় না তুমার ?
বুড়ো মানুষটা উত্তর দিল না, নূরী ‘যাই’ বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে বলল, ও বু নিলিনে ?
নূরী মজার ছলে বলল, আমার নিয়া লাগবে নানে, য্যোমই তুমার গতি করবেনে।
অকারণ অর্থহীন কথা, তবুও বলে একটু হালকা লাগছে, ভয়ও অনেকটা চলে গেছে। আবার হাঁটতে শুরু করল নূরী।
এবার সামনে বড় দিঘিটা পড়ল। এই দিঘি নিয়ে কত ভয়ের গল্প চালু আছে! চারপাশের পাড় ধরে সারি সারি তাল গাছ, দূর থেকে নূরীর মনে হলো গাছে গাছে ভূত পেত্নী ঝুলে আছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যেটুকু পারে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে দিঘির সামনের রাস্তাটা পার হয়ে গেল। পা টনটন করছে, সারা দিন খেটেখুটে এত রাতে আর কত হাঁটবে! ইচ্ছে হলো পথের ধারে বসে পড়তে কিন্তু সাহস হলো না। আরও খিদে পাচ্ছে। মনে মনে আবারও গালি দিল, খা শাঁকচুন্নি ভালো ক্যোরে খা, আমার রান্না ভাত তারকারি দুই শয়তান মিলে ভালো ক্যোরে খা। আগে জানলি বিষ মিশায়ে রাখতাম। আবার কান্না শুরু করল নূরী।
আরও অবসন্ন ক্লান্ত নূরী। একটু একটু করে ভয় মুছে যাচ্ছে। অনেকটা যা হয় হবে মুড চলে এসেছে ওর ভেতর। চাঁদটা এখন মাঝ আকাশে, প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে জোছনা দিতে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে একটা ভোঁতা ধরনের আলো এসে পৌঁছাতে পারছে। হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়াল বটগাছটা। আর পারল না, কোনো কিছু না পেয়ে নিজেকে নিজে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ‘মারে বাবারে বলে’ বিকট চিৎকার করে উঠল।
একজন মানুষ গাছটা বেয়ে ওপরে উঠছে। মানুষটাও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। এই কীডারে তুই ? এত রাত্তিরি কী ক্যোরছিস এখেনে ?
নূরী আরও চিৎকার শুরু করল।
মানুষটা আবার বলল, এই চুপ কর, আমি মানুষরে, পাশের গিরামের সবুজ মণ্ডল, তুই চেঁচাচ্ছিস ক্যান ?
নূরী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, সত্যি কচ্ছো ?
হ্যাঁরে হ্যাঁ। তুই কিডা ? আমারে শান্তি মোতো মোরতি দিলিনে ? তুই ভাগ এ্যাখোন, আমি অ্যাজ গলাই ফাঁস দেবো।
মরার কথা কইয়ো কলাম, আমার ভয় করছে।
মোরতি হয় একা একা। বড্ডো জ্বালালি তুই!
লোকটা গাছ থেকে নেমে এসে বাঁধানো জায়গায় বসে বলল, তোর আবার ভয় কীরে ? এত রাত্তিরি পেত্নীরাই চলাফিরা করে।
ভালো হবে নানে কলাম, আমারে পেত্নী কবা না।
তালি কী কবো তোরে ?
আমার নাম নূরী।
ও নূরী কনে য্যাস ?
জাহান্নামে।
জাহান্নাম শুনে এত কষ্টেও সবুজের হাসি পেল, হো হো করে হেসেও ফেলল।
হ্যাসো না কলাম, আমি আছি আমার জ্বালায়।
জ্বালায় না পড়লি এই জাড়ের মোদ্দি কেউ বেরোই ? হাসপো না ? জাহান্নামে তো আমি যাচ্ছিলাম, মাঝখানে তুই ব্যাগড়া দিলি।
তুমি বিটামানুষ, তুমার আবার কীসির জ্বালা ?
অনেক জ্বালারে নূরী, মোরতি যখোন দিলিনে আয় না এখেনে একটু বোসি, দুটো সুখ-দুকখির কথা কবানে।
তুমি সত্যি ক্যোরে কও কলাম, তুমি মানুষ তো ?
মানুষইরে, বড় ছোট মানুষ। টাকা নেই পয়সা নেই, মানসম্মান কিচ্ছু নেই।
তালি তুমার সাথে মন খ্যুলে দুটো কথা কোতি পারবনে। আমার মোতো তুমিও ছোটো মানুষ, সেই ভালো। ঘিন্না ধ্যোরে গেছে গো জীবনের উপর, ঘিন্না ধ্যোরে গেছে।
জানিস নূরী আমারো ঘিন্না ধ্যোরে গেছে এই জীবোনডার উপোরে। মরতিই তো আসছিলাম। এ সময় তুই না আসলি আমি আমার গার চাদরডা দিয়ে বটগাছে ঝ্যুলে থ্যাকতাম এ্যাতোক্ষণ। 
মরা মরা কচ্ছো ক্যান। আমার খুব ভয় করচ্ছে।
ভয় কীরে ? আমি আছিনে ?
সে ঠিক, তুমারে দ্যেখে একটু সাহস পাচ্ছি। মনে হচ্ছে মানুষডা তুমি খারাপ না।
না রে নূরী আমি ছ্যাচড়া চোর। চোর কি আর ভালো মানুষ কদিনি ?
সে তুমি যা ইচ্ছে হওনা ক্যান, মানুষডা খারাপ না। একটা কথা তুমারে কই, টুকটাক চুরি আমিও করি, যাগের যাগের বাড়ি কাজ করি, রসুনডা, পিয়াঁজডা, সুযোগ পালি রান্না করা মাছের টুকরো গোসের টুকরো। আমার স্বামী শয়তানডারে কত যত্ন ক্যরে খাওয়াইছিগো সেইসব।
নূরী আবার হুহু করে কাঁদতে শুরু করে।
নূরীর কান্না দেখে সবুজ মিয়ার হাসি পাচ্ছে, হো হো করে হাসতেও শুরু করল।
হাসি দেখে নূরীর গা জ্বলছে, হাসছো ক্যান মিয়া, তুমার কি হাসির ব্যারাম আছে ?
না রে, তোর কপাল আর আমার কপালের মিল দেখে হাসি আ্যাসলোরে।
মণ্ডল, আমারে তুমার চাদরের এককুনা দিবা ? জাড়ে হাতে পায়ে কোনো সাড় পাচ্ছিনে।
আয় না কাছে, চাদরটা দুইজনে জড়ায়ে নিই।
নূরী সবুজের একদম কাছে সরে আসে আর শিউরে উঠে বলে, উহ! শানডা কী ঠাণ্ডা!
কুয়াশা ঘন হয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে অশ্বত্থের ডাল আর ছোট ছোট পাতা বেয়ে।
নূরী ঠান্ডায় কেঁপে উঠে বলল, নিয়ের প্যোড়ছে।
দুজনের মাঝের ফাঁক গলে হুহু করে বাতাস ঢুকছে। সবুজের শরীরের ওম এই শীতে নূরীকে খুব টানছে কিন্তু সারা জীবনের সংস্কার ভেঙে আরও কাছে এগোতে কেমন বাঁধো বাঁধো লাগছে।
সবুজ বলল, নূরীরে তোর গার ওম শীত যে বাড়ায়ে দিল!
নূরী বলল, চুপ থাকো মিয়া পাপ হবেনে।
দূর থেকে একটা আলোর আভাস আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আলোটা একেবারে কাছে চলে এল। হুশ করে সামনে এসে আবার দ্রুত চলে গেল।
সবুজ বলল, ওহ গাড়ি! 
হ্যাঁ, আমাগের গিরামের শুভ মুন্সি, বড় নেতা। ধনী মানুষ। খুব ইতরও। ঢাকায় থাকে। গিরামে আলি কাজকাম আর রান্না ক্যোরে দিতাম। একদিন রাত্তির বেলা আমারে সাপের মতো প্যাচায়ে ধ্যোইলো। আমি যখন ছাড়ানোর জন্যি ছটফট করছি, ক্যোলো টাকা দেবে। সব একএকটা হারামি!
সবুজ মিয়া রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আবার হা হা করে হেসে ওঠে।
সত্যি তুমার হাসির ব্যামো!
দেখ নূরী ও কিন্তু একটা চোর, গরমেন্টের টাকা ম্যারে খায়, গরিবের রক্ত চ্যুসে খায় আরও কত কী করে, তাও ওর কত দাম। মানষিরা কত কদর করে। ও চোর আমিও চোর কিন্তুক আমি ছ্যাঁচড়া চোর ব্যোলে বৌ পালায়ে যায়, যে সে যখোন তখোন ম্যারধ্যোর করে, কোনো মানসম্মান নেই আমার। দুনিয়ার কী বিচার দেখো!
তুমি ওরে চেনো ?
চেনবো না ক্যান ? সাত গিরামের সবাই চেনে।
তুমি তুমার বৌরে কত ভালোবাসো তাও চ্যোলে গ্যেছে আর আমার স্বামী দেখো আমারে তাড়ায়ে দিল। আমি কি কোম ভালোবাসতাম শইতানডারে ? এরে কয় কপাল!
নূরী, তুই কিন্তুক মানুষ ভালো, তাড়্যালো ক্যান ?
ওই মুবাইলি এক পেত্নীর সাথে প্রেম ক্যোরেছে, আজকে সোন্ধ্যেবেলাই সেইটেরে বাড়ি অ্যানেছে। তুমিই কও, কীভাবে ম্যানে নেবো ? তাতিই এমন ম্যারডা ম্যারলো! সইজ্জো হ্যোলো না, এক কাপুড়ি বেরোয়ে পড়লাম।
ভালো কোরিছিস। আমি নাই ছ্যাচড়া চোর, যার যখোন ইচ্ছে বেদম মারে, তোরে ক্যান মারবে ? বলেই সবুজ মিয়া কাঁদতে শুরু করল।
নূরী খুব অবাক হলো, ও মিয়া তুমার তো হাসার ব্যারাম, ক্যানতেছো ক্যান ?
মনডা খুব প্যুড়তেছেরে। চুরির দায়ে মানষিরা আমারে মারলি বৌ আমার ক্যান্দে হারেজারে হ্যোতো, সে কী ক্যোরে আমারে ছ্যাড়ে চোলে গ্যালে ?
কনে গ্যালো ?
পলায়েছেরে, পাশের গিরামের বুলু সর্দারের সাথে। সে ঢাকায় কাজ করে।
কী কাজ ?
ছিনতাই করে। বড় ছিনতাই দলে কাজ করে।
এবার নূরী হাসল, খুব হাসল, বাড়ি ছাড়ার পর এবার প্রথম হাসল নূরী।
এই তুই হাসছিস ক্যান ?
হাসি লাগছে। 
হাসি লাগলিই হাসতি হবে ? আমি ম্যোরে যাচ্ছি দুঃখির জ্বালায়।
যাও আর হাসবোনানে। ছিনতাইকারী পালি ছ্যাচড়া চোরের সাথে থ্যাকবে ক্যান, তুমিই কও ?
আমি যে ওরে এত ভালোবাসতাম, সুহাগ করতাম, তার কোনো দাম নেই ? জানিস আমাগোর গিরামের একটা বাড়িতি একখান সুনার হার চুরি কোরছিলাম, লোকজন কত মাইরলো! দাঁতে দাঁত চ্যাপে থাকলাম, স্বীকার যাই নি। সেডাও ওরে দিলাম, বেচলি কত টাকা পাতাম কদেখিন ? যাওয়ার সুমায় নিয়ে পালায়েছে।  
নূরী হাসতে হাসতে বলল, মোন পোড়ছে হারডার জোন্যি ?
নারে, সত্যি কোচ্ছি বৌডার জোন্যিই মোনডা পোড়ছে।
দুজন সুখ-দুঃখের গল্প করতে করতে কখন আরও কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এক চাদরে জড়াজড়ি করে দুজনের শরীরের ওমে একটুখানি স্বস্তিতে গল্পে মগ্ন হয়ে গেছে খেয়াল করে নি কেউই। হঠাৎ খেয়াল হলো নূরীর।
ছিঃ ছিঃ তুমার কত কাছে চ্যোলে আসিছি!
মুখে বলল ঠিকই কিন্তু উষ্ণতার লোভটুকু ছাড়তে পারল না নূরী, দূরে সরে গেল না। ঘন কুয়াশায় চারিদিকে একটা পরাবাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এখানে পাপপুণ্য সব শিশিরের টুপটাপ শব্দের সাথে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে!
দ্যাখ নূরী আমার বৌ গ্যালো সে তো আমারই গ্যালো, লোকজন আবার আমারেই কত ক্ষিতেলি ক্যোরলো। ওরা সব ব্যোললো আমি নাকি কোনো বিটাছেলেই না। চোর ব্যোলে কি আমার দুককো অপ্মান নেই ? সেই জোন্নি মোরতি আসছিলাম, তুই অ্যাসে না পোড়লি ম্যোরে ভূত হ্যোয়ে যাতাম রে এত্তোকক্ষণে!
আচ্ছা মিয়া ছিনতাইআলারে জুট্যালে কন থেকে ?
আমার জানের দোস্ত ছিলরে।
দোস্তোর এই কাজ ? কারে বিশ্বেস করবা কও!
ও ঢাকা থেকে অ্যাসে আমার বাড়ি ছিল কয়দিন। আমারে ট্রেরনিং দিতি চাইছিল।
কীসির ?
ছিনতাই করার।
ছিনতাই করার আবার ট্রেরনিং লাগে না কি ?
লাগেরে লাগে। সব কাজই শিকতি হয়।
উচিত শিক্কা হ্যোয়েছে তুমার। শেকো, ভালো করে শেকো চুরিবিদ্যে।
ওরা দুজন আরও নিবিড়ভাবে কাছে সরে আসে।
কিছু সময় কথা থেমে যায় ওদের। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কুয়াশায় ঢাকা ঘোলাটে মাঠের দিকে।
আস্তে করে অনেকটা ফিসফিস করে সবুজ বলে, না রে নূরী গিরামে আর ফেরবো নানে। এবার শহরে যাব।
সেই ভালো শহরে যাও। কোনো আড়তে কাজ ন্যাও, গারমেন্টে কাজ ন্যাও, না হোলি রাজমিস্তিরির জুগালো হও কিন্তুক চুরি আর ক্যোরো না। তুমি মানুষডা তো মোন্দো না। চুরি ছিনতাই তুৃমারে মানাই না গো!
হু, ব্যোলে সবুজ মিয়া আরও জোরে জড়ায়ে ধরে নূরীকে। ক্লান্ত অবশ নূরী কোনো প্রতিরোধ করে না।
বেশ কিছুটা সময় ওভাবেই চলো যায়।
নূরী সবুজ মিয়ার কাঁধে মাথা রেখে অদূরে ভঙ্গিতে বলে, ও মিয়া ঘুমি যে চোক ভ্যাঙে যাচ্ছে।
আমারো, চল ঘুমায়।
নূরী মুখে কিছু বলল না। গায়ের ওড়নাটা খুলে বাঁধানো শানের ওপর বিছাল। তারপর শুয়ে পড়ল। সবুজ মিয়া কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, কী করবে বুঝতে পারছে না।
নূরী বলল, ও মিয়া চাদরডা দ্যাও না ক্যান, শিতি যে ম্যোইরে যাচ্ছি!
সবুজ কিছু বলল না, গায়ের থেকে চাদরটা খুলে নূরীকে ঢেকে দিল। আর শীতে কাঁপতে থাকল।
সবুজ মিয়ার অবস্থা দেখে নূরীর হাসি পেল। 
ও নূরী হাসিস ক্যান ?
তুমার অবস্থা দেখে। আসো, একটু ফাঁক রাখে চাদরের মোদ্দি শোও দেখি।
তুই রাগ কোরবিনানে ?
এই কি একটা চোরের কথা হ্যোলো ?
এই তুই কিন্তুক আমারে চোর কোচ্ছিস!
কবো না ? চোররা মানষির জিনিস নিয়্যে ন্যেয়
আর তুমি আমারে চাদর দিয়্যে জাড়ে কাঁপতিছো।
তখোন যে তুই কোলি কাছে গেলি পাপ হবেনে।
অ্যাসো পাপের ইশকুলি ছুটির ঘণ্টা বাজায়ে দিই। অ্যাজ আর পাপ হবেনানে, জাড়ে যে ম্যোরে যাচ্ছি!
একটুখানি সংকীর্ণ জায়গায় যতটুকু ফাঁকা রাখা সম্ভব সেটুকু রেখে নূরীর পাশে সবুজ মণ্ডল একরাশ দ্বিধা নিয়ে শুয়ে চাদরে ঢেকে নিল নিজেকে। ফাঁকাটুকু একসময় মুছে গেল। দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমের গভীরে হরিয়ে গেল, ততক্ষণে মাঝ আকাশ থেকে চাঁদ অনেকটা ঢলে পড়েছে।
কাল সকালে পুরোনো সূর্যটা নতুনভাবে আবার উঠবে আর একটা সুন্দর জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে জাগবে দুজন মানব-মানবী, ভোরের আলো মেখে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.