পল্লিকবির অম্বিকাপুরে…

পল্লিকবির অম্বিকাপুরে…

‘পল্লিকবি’ খ্যাত জসীমউদ্দীনের বাংলা সাহিত্যে রয়েছে স্বতন্ত্র অবস্থান। গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র তাঁর কবিতায় কুশলতার সঙ্গে অঙ্কিত। এ অঙ্কনরীতিতে আধুনিক শিল্প-চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট। গদ্যশিল্পী হিসেবেও তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। ১ জানুয়ারি ছিলো তাঁর ১১৬তম জন্মবার্ষিকী।

অম্বিকাপুর আমাদের ডাক দিয়েছে। কবি জসীমউদ্দীনের শেকড় অন্বেষণে আমরা নেমেছি পথে। ঢাকা থেকে আমরা এসেছি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায়, সেখান থেকে রিকশায় চলেছি অন্বিকাপুরের পথে। গোবিন্দপুর অধুনা অম্বিকাপুর গ্রামে পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের পৈতৃক বাড়ি অবস্থিত। তবে এখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন নি। তিনি জন্মেছিলেন নানাবাড়ি তাম্বুলখানা গ্রামে—অম্বিকাপুর থেকে প্রায় আট মাইল দূরে অবস্থিত।...কবি কবে জন্মেছিলেন এটি নিয়ে মতভেদ আছে। জন্মের মাস নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। তবে সবর্জন স্বীকৃত দিনটি হচ্ছে ১ জানুয়ারি, ১৯০৪।

রিকশার চাকা একসময় অম্বিকাপুরের মাটি স্পর্শ করল। চারদিকের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, অবারিত মাঠ ও পদ্মা নদী দেখে আমাদের দু’চোখ মুগ্ধ হলো। মনের মাঝে ভিড় জমাল পল্লিকবি রচিত পঙ্ক্তিমালা: ‘তুমি যাবে ভাই— যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়/গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়…’।

একসময় রিকশার গতি রুদ্ধ হয় একটি বাড়ির সামনে। এটিই আমাদের গন্তব্যস্থান। এটিই পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি।

পথের ধারেই বাড়িটি। বাড়ির চারদিকে নানারকম গাছগাছালি। বাড়ির সামনে জসীমউদ্দীনের পারিবারিক বাগান ও পারিবারিক কবরস্থান। যে-কোনো আগন্তুকেরই দৃষ্টি চলে যাবে প্রথমে এই পারিবারিক কবরস্থানের দিকে।

বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম বড় একটি উঠানের চারদিকে চারটি ঘর। তিনটি টিনের ঘর। একটি একতলা দালান। উত্তর দিকের টিনের ঘরটিতে থাকতেন পল্লিকবির ছোটভাই প্রফেসর নুরুদ্দীন মোল্লা, দক্ষিণ দিকে থাকতেন বড়ভাই আলহাজ মফিজ উদ্দীন মোল্লা (এখন এখানে পাকা দালান), পশ্চিম দিকে থাকতেন সেজ ভাই সাঈদ উদ্দীন মোল্লা এবং পূর্ব দিকের টিনের ঘরে থাকতেন কবি জসীমউদ্দীন। উল্লেখ্য, জসীমউদ্দীন ছিলেন ভাইদের মধ্যে মেজ।

কবি জসীমউদ্দীনের বংশ অম্বিকাপুরে মোল্লা বংশ হিসেবে সুপরিচিত। মোল্লা কবির পারিবারিক উপাধি।

কবির পিতা আনসারউদ্দীন মোল্লা নিজের জমিজমার চাষাবাদ তদারক ছাড়াও স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। যে হিতৈষী এম.ই.স্কুলে কবি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন সেখানে তাঁর পিতা শিক্ষকতা করতেন (জসীমউদ্দীনের শিক্ষাজীবনের শুরু হয় অম্বিকাপুরের পাশের গ্রাম শোভারামপুরের অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায়। সেখান থেকে হিতৈষী এম.ই.স্কুল, তারপর ফরিদপুর জিলা স্কুল— এখান থেকেই তিনি মেট্রিক পাস করেন। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে তিনি আইএ পাস করেন ১৯২৪ সালে। একই কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে স্নাতক ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার’ বিভাগ থেকে এমএ পাশ করেন।)

মা আমিনা খাতুন স্নেহময়ী ও সরলা প্রকৃতির গৃহবধূ ছিলেন। নকশীকাঁথা সেলাই ও নকশী পিঠা তৈরিতে তাঁর সুনাম ছিল।

আমার সঙ্গী, অন্যদিন-এর ফটোগ্রাফার বিশ্বজিৎ সরকার পল্লিকবির বাড়ির চারটি ঘরের আলোকচিত্র ক্যামেরাবন্দি করার কাজে ব্যস্ত হলো। এক সময় সে কবি যে ঘরে থাকতেন এবং যেখানে বসে কবিতা লিখতেন, সেই ঘরের ছবি তুলতে মগ্ন হলো। বর্তমানে এই ঘরে কবির ব্যবহৃত একটি চৌকি রক্ষিত রয়েছে।...আমার মনে পড়ে গেল, জসীমউদ্দীনের কবিতা রচনায় হাতেখড়ি হয় অল্প বয়সেই। সাত-আট বছরে কবির লড়াই প্রত্যক্ষ করে নিজেও কবিগানে উৎসাহিত হন। গ্রামের তাঁতিপাড়ার কণ্ঠশিল্পী রহিম মল্লিকের সঙ্গে ‘সতী যমরাজা’ পালার অনুকরণে তিনি মুখে মুখে পদ রচনা করতে শুরু করেন। অতঃপর বহু জায়গায় কবিগানের আসরে অংশ নিয়ে পদ রচনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি প্রথম কবিতা লিখেন। ১৯২১ সালে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় মুদ্রিত ‘মিলন গান’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। তবে ১৯২৫ সালে ‘কল্লোল’-এ প্রকাশিত ‘কবর’ কবিতাটিই তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোর সামনে নিয়ে আসে। দীনেশচন্দ্র সেন কবির চিঠিতে লেখেন— ‘দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।’

আমরা পল্লিকবির বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখি। বেশ বড় বাড়ি। জানা গেল, ১৪ বিঘা জমির ওপর এই বাড়িটা পত্তন করেছিলেন জসীমউদ্দীনের দাদা ছমির উদ্দীন মোল্লা।...বাড়ির একপাশে পাকা পায়খানাও দেখা গেল। যখন এখানে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসে, তাদের ব্যবহারের জন্যই এই পায়খানা।

‘কবর’ কবিতার অমর স্রষ্টা জসীমউদ্দীন যেখানে শায়িত রয়েছেন— বাড়ির সামনে অবস্থিত সেই পারিবারিক কবরস্থানে আমরা যাই। গিয়ে দেখি— কবরস্থানের ঠিক মাঝখানটায় একটি ডালিমগাছ, তারই নিচে জসীমউদ্দীনের কবর। সংগত কারণেই আমাদের চেতনায় ভিড় জমায় পল্লিকবির ‘কবর’ কবিতার পঙক্তিমালা: ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে/এইটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ/পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।’...জসীমউদ্দীন জীবনের অন্তিম বেলায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চের ভোররাতে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার কিছুক্ষণ পরেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। জসীমউদ্দীনের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ হেলিকপ্টারে করে এখানে, তাঁর এই পরমপ্রিয় গ্রাম অম্বিকাপুরে (গোবিন্দপুর) নিয়ে আসা হয় এবং এখানেই পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

অম্বিকাপুরে পল্লিকবির পারিবারিক কবরস্থানটি লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা, বেশ সুন্দর সাজানো-গোছানো। কবরস্থানও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ‘কবর’ কবিতাটিই যেন এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবিতায় যেমন দেখা যায়, নাতির হাত ধরে বৃদ্ধ দাদা পারিবারিক কবরস্থানে পরিবারের এক-একজন সদস্যের কবরের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন এবং নাতিকে বলছেন, কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে—এই কবরস্থানে তেমনি একই পরিবারের বহু মানুষ অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছেন।

পল্লিকবির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। তবে এখন আর পদ্মা প্রমত্তা নয়। পদ্মার এখন ক্ষীণ স্রোতধারা। যখন পল্লিকবির যৌবন ছিল তখন এই পদ্মারও যৌবন ছিল।...পদ্মা তীর সংলগ্ন সবুজ ঘাসে মোড়া বিশাল এলাকায় প্রতি বছর জানুয়ারিতে—পল্লিকবির জন্মমাসে এখানে ‘জসীম পল্লিমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় থাকে চমৎকার আলোকসজ্জা আর পুতুল নাচ। সার্কাস হয়, নাগরদোলায় শিশু-কিশোররা চড়ে আনন্দের স্রোতে ভাসে। এখানকার স্থায়ী মুক্তমঞ্চে অভিনীত হয় পল্লিকবি রচিত কাব্যনাট্য, আরও কত কী! ফরিদপুরের মানুষেরা তখন মেতে ওঠে। আশপাশের জেলা থেকে কবির গুণগ্রাহীরা আসে। এইসব মানুষের বিশ্রামের জন্যে কিছু ছাউনিও রয়েছে। এ ধরনের একটি ছাউনির নামকরণ করা হয়েছে ‘রূপাই ছায়াঘর’।

পদ্মা পাড়ে ঘুরতে ঘুরতে পল্লিকবির অস্তিত্ব মনে মনে বোধ করলাম। এখনকার এই ক্ষীণ স্রোতের পদ্মা নদীতে এখন আর বেদের বহর দেখা যায় না। কিন্তু জসীমউদ্দীনের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে এই নদীতে দেখা যেত বেদের বহর। ফলে বেদে সম্প্রদায়ের জীবন অত্যন্ত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় পল্লিকবির। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি ‘হোমরা বাদ্যা’ লোকনাট্যটি অবলম্বনে রচনা করেন ‘বেদের মেয়ে’। আর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জসীমউদ্দীন লেখেন কাহিনি কাব্য ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’।

অম্বিকাপুর আমাদের ডাক দিয়েছিল, প্রাণের মাঝে অনুভব করতে চেয়েছিলাম পল্লিকবির প্রাণস্পন্দন— সেই প্রাণস্পন্দন অনুভব করছি প্রাণে।...কবির পারিবারিক কবরস্থানের দেয়ালে কবি রচিত যে পঙ্ক্তিমালা স্থান পেয়েছে—‘এই নদীর তটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে/আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে/সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে অভাগা গাঁয়ের কবি/জীবনের কোন কনক বেলায় দেখেছিল কার ছবি’—কবির এই আক্ষেপ সত্যি নয়, সত্যি হয় নি; আজও এ দেশের মানুষের মনে রয়েছে তাঁর স্থান।

সূর্য ডুবে গেছে। সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। এখন যাওয়ার সময় হলো বিহঙ্গের।

আমরা আবার পথে নামলাম। কিন্তু রিকশায় চড়ে ফেরার পথে চারদিকের আঁধার দেখে কেন যেন মনে হতে লাগল—আমাদের বিদায়ে পল্লিকবির অম্বিকাপুর বড়ই বিষণ্ন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.