এদেশের উত্তর-পূর্ব অংশের একটি অন্যতম আকর্ষণ—হাওর। এই হাওরকে গ্রীষ্মকালে বিশাল মাঠের মতো মনে হয়। মনে হয় বিলের মতো। মাঝে মাঝে সেই বিলে পানিও থাকে। আর সেখানে আটকে থাকে মাছ।
বর্ষায় বাংলাদেশের হাওরগুলোর অন্যরূপ দেখা যায়। তখন কয়েক মাস হাওরগুলো গভীর পানিতে ডুবে থাকে। বিশালাকৃতির কোনো কোনো হাওরকে দেখে মনে ভ্রম জাগে। মনে হয় সমুদ্রের মতো—কূল নাই, কিনার নাই। এইসব হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপরূপ। দিনে তো বটেই রাতেও হাওর মোহময়ী। বিশেষত জোছনা রাতে। তখন হাওরের জলে চাঁদের আলো পড়ে যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয়—তা অপূর্ব। মনে হয়, এ কোনো পৃথিবীর নয়, অন্য ভুবনের ছবি।
এই বর্ষায় ঘুরে আসুন, বাংলাদেশের কয়েকটি হাওর থেকে।
টাঙ্গুয়ার হাওর
বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। স্থানীয়দের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। এটি দেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান হিসেবে পরিচিত, আর প্রথমটি হলো সুন্দরবন।
ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্ষায় এর পুরোটাই পানিতে ডুবে থাকলেও শীতে পানি কমতে থাকে। এর বড় একটা অংশ তখন শুকিয়ে যায়।
টাংগুয়ার হাওরের প্রধান দুটি পাখির অভয়ারণ্য হলো লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল। এ হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়—এটি একটি মাদার ফিশারী। হিজল করচের দৃষ্টিনন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়।
কীভাবে যাবেন ?
প্রথমেই পৌঁছাতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত রিকশায় যান। বর্ষাকালে শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পিডবোটে সরাসরি টাঙ্গুয়া যাওয়া যায়। ইঞ্জিন বোটে ৫ ঘণ্টায় ২৫০০-৩০০০ টাকা ও স্পিডবোটে ২ ঘণ্টা ৭৫০০-৮০০০ টাকা খরচ পড়বে।
রাতে থাকার জন্য নৌকা ভাড়া করলে প্রয়োজনীয় বাজারসদাই করে নেবেন। সেক্ষেত্রে লোকাল ট্রলার বা ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ভাড়া পড়বে ৫০০০ টাকার মতো। আর বিলাসবহুল ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলোতে হাই কমোডসহ বাথরুম, ছাদে তেরপলসহ অনেক সুবিধা আছে সেগুলোর ভাড়া পড়বে ১০০০০-১৬০০০ টাকার মতো।
হাকালুকি হাওর
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর। এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এর আয়তন ১৮ হাজার ১১৫ হেক্টর। তার মধ্যে শুধু বিলের আয়তন ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। এটি মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা (৪০ শতাংশ), কুলাউড়া (৩০ শতাংশ), সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ (১৫ শতাংশ), গোলাপগঞ্জ (১০ শতাংশ), বিয়ানীবাজার (৫ শতাংশ) জুড়ে বিস্তৃত।
ভূ-তাত্ত্বিকভাবে এর অবস্থান উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় ও পূর্বে ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশে। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায় হাকালুকি হাওরে প্রায় প্রতিবছরই আকস্মিক বন্যা হয়। এই হাওরে ৮০-৯০টি ছোট, বড় ও মাঝারি বিল আছে। শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
বর্ষাকালে হাওর এলাকায় পলিমাটি পড়ায় বিলগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর সেখানে কিছু কিছু জায়গায় ধান চাষ করা হয়। ফসল কাটার পর বিলগুলিতে হাজার হাজার গবাদি পশু বিচরণ করে। হাকালুকি হাওরে প্রচুর পরিমাণ মৎস্য সম্পদ রয়েছে।
এই হাওরের বিলগুলো অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাস। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, এই হাওর হলো মাদার ফিশারী। এখানে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির মাছ আছে। হাওর এলাকায় প্রধানত পেশাদার জেলে, মৌসুমী জেলে ও খোরাকি জেলেদের বসবাস আছে।
কীভাবে যাবেন ?
ঢাকা থেকে হাকালুকি হাওরে যেতে প্রথমে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া আসতে হবে। কুলাউড়া থেকে অটোরিকশা বা রিকশা ভাড়া করে সরাসরি হাওরে যাওয়া যায়। রাত্রিযাপনের জন্য হাওরে বিল ইজারাদারদের কুটিরগুলোতে বিল মালিকের অনুমতি নিয়ে ২-৪ জন অনায়াসেই থাকা যায়। তবে বিল এলাকায় জোছনা রাতে তাঁবু ফেলে ক্যাম্পিং করার মুহূর্তগুলো ভ্রমণকে স্মৃতিময় করে তোলে।
হাকালুকি হাওর ভ্রমণের সময় নৌকার মাঝির সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় বাজার করে নিলে মাঝিই রান্না করে খাওয়াবে। এছাড়া নৌকায় উঠার সময় বিস্কুট, চা, পাউরুটি, খাবার পানি ইত্যাদি হালকা খাবার নিয়ে ভ্রমণ করা উচিত। হাওরে স্বল্পমূল্যে গরু-মহিষের দুধ পাওয়া যায়।
নিকলী হাওর
বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। এর নাম এসেছে নিকলী উপজেলা থেকে, যেখান থেকে হাওরটির উৎপত্তি হয়েছে। নিকলী ছাড়াও এই হাওরের পরিধি পার্শ্ববর্তী মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার।
এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি ও জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। ঢাকার সাথে সহজ সড়ক ও রেল যোগাযোগ এই হাওরের পর্যটন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। নিকলীতে একাধিক আবাসিক হোটেল গড়ে উঠায় পর্যটকরা এখন একাধিক দিন হাওর ভ্রমণের সুবিধা পাচ্ছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসই হলো নিকলী হাওর ভ্রমণের সেরা সময়।
কীভাবে যাবেন ?
প্রথমেই পৌঁছাতে হবে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে। এরপর কালিয়াচাপরা সুগার মিল এলাকা থেকে সিএনজি করে নিকলী হাওর চলে যাবেন। সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। আবার পুলের ঘাট নেমেও আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছাতে পারবেন হাওরে।
নিকলীতে থাকার জন্য বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে। চাইলে সেখানে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তবে অনেকেই সারা দিন হাওর ভ্রমণ করে সন্ধ্যা হতেই ফিরে যান নিজ গন্তব্যে।
হাইল হাওর
সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। পাহাড়, টিলা, চা-বাগান আর ঝরনা বেষ্টিত চিরসবুজ এ উপজেলায় এসবের পাশাপাশি রয়েছে বিস্তৃত হাইল হাওর। বর্ষায় এ হাওর পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সিলেটের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত এ হাইল হাওর। এই হাওরটির মোট আয়তন ১০ হাজার হেক্টর। এরমধ্যে ৪ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি, ৪ হাজার ৫১৭ হেক্টর হাওর, ১ হাজার ৪০০ হেক্টর বিল, ৪০ হেক্টর খাল এবং ৫০ হেক্টর নদী। এতে রয়েছে ১৪টি বিল এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য ১৩টি নালা। প্রচুর লতা ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ থাকার কারণে স্থানীয়দের কাছে এটি লতাপাতার হাওর নামেও পরিচিত। এ হাওরে প্রায় ৯৮ প্রজাতির মাছ ও প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির বিচরণ লক্ষ করা যায়।
হাওরের চিরায়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীল আকাশ ও পানির মিতালী যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির বাস্তব রূপ। সেকারণে হাওড়ের বুকে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে সারাদেশের ভ্রমণকারীরা এই ভূস্বর্গে ছুটে আসেন। হাইল হাওরের অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যেরও কোনো ঘাটতি নেই।
কীভাবে যাবেন ?
ঢাকার ফকিরাপুল অথবা সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে হানিফ, শ্যামলী ও এনা পরিবহনে শ্রীমঙ্গল পৌঁছাতে পারবেন। এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পারাবত, জয়ন্তিকা, উপবন ও প্রগতি আন্তঃনগর ট্রেনে চলে আসা যায় শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে সিএনজি বা অটো ভাড়া করে সহজেই ঘুরে আসতে পারবেন হাইল হাওর থেকে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.