ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে

ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে

মান্দারবাড়িতে মাগরেবের আজান পড়ে, সমস্ত দিনের কঠোর রোজার পরে পুরুষেরা দাওয়ায় পাটি পেতে আধো শুয়ে পাখা করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রমণীদের অবসর নেই, উঠোনের খোলা উনোনে তারা রাতের রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেবল এ বেলার নয়, শেষরাতের রান্নাও তাদের এখনি সেরে রাখতে হয়।

উঠোনে অন্ধকারে রমণীদের মুখে আগুনের হলকা লাল হয়ে পড়ে, নিভন্ত আগুনে চোং দিয়ে ফুঁ দেবার কালে তাদের মুখমণ্ডল ঘিরে স্ফুলিঙ্গ ওড়ে, রমণীদের মুখ নিশ্চিদ্র অন্ধকারে নিরবলম্ব, দেহহীন বলে বোধ হয়; সেদিকে কোনো কোনো পুরুষ তন্দ্রা ভেঙে হঠাৎ তাকায়, তখন রক্তের ভেতরে স্ফুলিঙ্গ ওড়ে তাদেরও, ঈষৎ খেদ হয়; যে, তারাবির নামায পড়বার আগে আবার তাদের ওযু করতে হবে। 

অচিরে তারাবির নামাযের সময় হয়; অন্ধকারের ভেতর দিয়ে মান্দারবাড়ির প্রৌঢ় এবং প্রবীণেরা মসজিদের দিকে হাঁটে; আকাশে তখন তারা, কিন্তু গুনে দেখলে তাদের কাছে ধরা পড়ত যে, আজ তারার সংখ্যা অনেক কম এবং তখন তারা আবিষ্কার করতে পারত, মেঘ আসতে শুরু হয়ে গেছে।

তারাবির নামায শুরু হয়ে যায়, আর তিনদিন পরেই শেষ তারাবি, এই তিনদিনে কোরানের শেষ আয়াত পর্যন্ত পৌঁছতে হবে, তাই ইমাম সাহেব একেক রাকাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে সূরা পড়ে চলেন। ইমাম সাহেবের বয়স পঞ্চাশের বেশি নয়, কিন্তু দারুণ দাঁতের ব্যথার দরুন অনেক আগেই সবকটি দাঁত তাঁকে ফেলে দিতে হয়েছিল। দ্রুতগতিতে উচ্চৈঃস্বরে তিনি সুরা পড়ে চলেন, দাঁত অথবা যতির অভাবের জন্যেই কি না, তার পাঠ কিছুই বোঝা যায় না, বোঝা গেলেও পঠিত অংশের অর্থ কারও বোধগম্য হতো কি না সন্দেহ হয়।

হঠাৎ শীতল বাতাস বয়। নামাযে দাঁড়ানো মানুষেরা প্রথমে কিছু টের পায় না, কিংবা তারা টের পায় এবং দীর্ঘ গ্রীষ্মদিনের রোজার শেষে অকস্মাৎ সেই শীতলতাকে তারা আল্লার রহমত বলে বিবেচনা করে, তারা একবার গ্রীবা সোজা করে চিবুক ঊর্ধ্বে ঠেলে দেয়, বুকভরে বাতাস নেয় এবং আবার চিবুক নত করে আনে, আরাম অথবা কৃতজ্ঞতায়।

ইমাম সাহেবের এ রকম মনে হয়, মসজিদে নামাযরত এই জামাতের ওপর জান্নাত থেকে খুঁতবিহীন হুরীরা এখন আবের পাখায় বাতাস করে চলেছে। তাঁর স্মরণ হয়, পবিত্র কোরানেই তো আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন, তোমরা আমার কোন দানকে অস্বীকার করবে ? এবং তৎক্ষণাৎ অনুমানের সমস্ত নিশ্চয়তাকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে মসজিদের টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যায়; কারবালার শহিদদের রক্তে কেন আকাশ আজ সন্ধ্যায় রঞ্জিত হয়েছিল, অভিজ্ঞ এই মানুষেরা অবিলম্বে তা এখন অনুভব করে ওঠে—সে ছিল মুষলধারে বৃষ্টি নামবার মেঘের নিশান।

বহু বৎসর আগে, নিñিদ্র সেই অন্ধকার রাতে, লণ্ঠনের দুর্বল আলোয় পাণ্ডুর হয়ে যাওয়া মসজিদের ভেতরে সেই যুবক দুটিকে দেখেই ইমাম সাহেবের প্রথমে মনে হয়েছিল—পাকিস্তানি সৈন্য। হ্যাঁ, এ রকম তো শোনাই গেছে, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করবার জন্যে গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে ফিরছে। কিন্তু অবিলম্বে, সেই রাতে, ইমাম সাহেবের মনে পড়ে গিয়েছিল যে, রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সৈন্যরা বেরোয় না, এমন কি সাদা সুতো থেকে কালো সুতো যখন প্রথম আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়, সেই ফজর নামাযের আযানেরও অনেক পরে, বেলা যখন প্রায় বুক বরাবর তখন তারা বেরোয় এবং একা নয়, দুজনেরও জোড়ায় নয়, পাকিস্তানি সৈন্যরা ছয়জন আটজন দশজনের দলে পথে নামে।

যুবক দুটি মসজিদের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে, ভেতরে আসে না, ইমাম সাহেব লণ্ঠন পেড়ে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যান, লণ্ঠনের আলো যখন যুবক দুটির দেহে পড়ে, দেখা যায় তাদের পরনে সৈনিকের পোশাক নেই, সাধারণ প্যান্ট-শার্ট; সবাই দেখে এবং একই সঙ্গে সবার হৃৎপিণ্ড ধড়াস হয়ে ওঠে—এরাই তবে সেই মুক্তিযোদ্ধা, এদেরই একজন হয়তো আকবর হোসেন— যে আকবর হোসেন মান্দারবাড়ি ঢুকবার মুখেই অশ্বত্থগাছের ডালে তিনদিন তিন রাত অপেক্ষা করেছিল এবং তিনদিনের পরে সেই অশ্বত্থের নিচে যখন বিশ্রাম নিতে বসেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা, একা সে তাদের প্রত্যেককে খতম করেছিল।

বহু বৎসর আগে, রমযান মাসের সেই রাতে, সেই যুবক দুটি ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাঁচটি মানুষকে। জনাচল্লিশেক মানুষের ভেতর থেকে যুবক দুটি নির্ভুলভাবে বেছে নিয়েছিল পাকিস্তানি লেফটেন্যান্টের এক মাস আগে গঠন করে যাওয়া শান্তি কমিটির পাঁচজন সদস্যকে। হ্যাঁ, আকবর হোসেন তাদের ভেতরে ছিল, দুজনের একজন সে ছিল সে রাতে, যে আকবর হোসেন মান্দারবাড়িরই ছেলে, প্রতিদিন যাকে তারা দেখেছে এই সেদিন পর্যন্ত, লণ্ঠনের আলোয়, একাত্তরে, রাইফেল হাতে, সেই আকবর হোসেনকে তারা চিনে উঠতে পারে নি। 

ইমাম সাহেবের কাছে এখনো এটা রহস্য বলে মনে হয়, শুধু একটি ঘটনার জন্যেই চেনা মানুষও কী করে এমন আশ্চর্য অচেনা হয়ে যায়।

বহু বৎসর পরে, সেদিন বৃষ্টি ছিল না, আজ বৃষ্টি আকাশ ভেঙে নেমেছে; আজ এই যুবক দুটি, যারা সেই রাতের যুবক দুটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু একই রকমে অকস্মাৎ উপস্থিত এবং অস্ত্রসজ্জিত, আজ তারা বসে আছে প্রায় উবু হয়ে, মেঝেতে অস্ত্র নামিয়ে। 

হঠাৎ কড়িকাঠে ঝোলানো লণ্ঠন নিভে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ইমাম সাহেব ভয়ে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘কাঁই বাহে ? তোমরা কী চান?’

অন্ধকারে যুবক দুটি আছে কি নেই বোঝা যায় না, বাইরে এই প্রবল বৃষ্টির ভেতরে তারা যে আবার পথে নামবে তাও অনুমিত হয় না। তবু কেন উত্তর তারা দেয় না?

সকলেই তখন একসঙ্গে স্মরণ করে ওঠে যে, বহু বৎসর আগে সেই রাতে পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল যুবক দুটি।

মসজিদের চালে বৃষ্টি কান ফাটানো শব্দে পড়ে চলে, যুবক দুটি কোনো উত্তর দিয়ে থাকলেও শোনা যায় না; শোনা সম্ভব হয় না। শোনার অপেক্ষা কেউ কেউ আর করে না, অবিলম্বে কয়েকজন দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, হঠাৎ তারা বৃষ্টির তীব্র বর্ষণের ভেতর দিয়ে দৌড়–তে থাকে, পিছল পথে আছাড় খায়, কেউ খানায় পড়ে যায়, কারও পরনের কাপড় খসে যায়, তারা তাদের পেছনে যেন স্পষ্ট শুনতে পায়, আগের অভিজ্ঞতা যে সকল সময় মনে পড়বেই এমন কোনো কথা নেই—এটা আরও একবার আবিষ্কার করে তারা মাটির সঙ্গে যেন মিশে যায়। 

সেজদা থেকে মাথা তোলে মানুষগুলো; দ্রুত নামায শেষ করে দেন ইমাম, কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো লণ্ঠন প্রবল বেগে দোলে, হঠাৎ নীল আলোয় মুহূর্তের জন্যে জ্বলে ওঠে জগৎ, মসজিদের বেড়ার ফাঁক দিয়ে তীব্র শুভ্র নীল নিঃশব্দে চিৎকার করে ওঠে যেন, মানুষেরা কানে হাত চাপা দিয়ে অপেক্ষা করে। অচিরে বাজ পড়ার শব্দ অস্তিত্বকে বিদীর্ণ করে হা-হা রবে বয়ে যায়।

বৃষ্টিপাত প্রবল থেকে প্রবলতর হয়; এখন আর কেউ স্মরণ করে না বলেই সন্দেহ হয়, তোমরা আমার কোন দানকে অস্বীকার করবে? কেউ কেউ ব্যাকুল হয়ে ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করে আযান দেবার জন্যে; যিনি বৃষ্টিও দেন সেই আল্লাহ আযান শুনে হয়তো বা অনুভব করবেন তাঁর বান্দার অসহায়ত্ব, রহম করবেন এবং ফিরিয়ে নেবেন বজ্র, বৃষ্টি, বাতাস।

হাতের নীরব ইশারায় ইমাম সাহেব সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেন; তাঁর হাত তোলা অবস্থাতেই দূরে দরজার কাছে কিছু একটা দেখে তিনি চমকিত হন; দরজার দিকে পেছন ফিরে গোল হয়ে বসা মানুষগুলো অবিলম্বে কিছু বুঝে ওঠে না, তারা ইমাম সাহেবের দিকেই তাকিয়ে থাকে আরও কিছুক্ষণ, তারপর তাঁর চোখ অনুসরণ করে সকলেই। 

দরজার ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে দুই যুবক, পরনের জামা ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে, লুঙ্গি মালকোঁচা দেওয়া, টপটপ করে পানি পড়ছে সারা গা দিয়ে, ভালো করে মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু দুটি বুকের বড় দ্রুত ওঠানামা স্পষ্ট চোখে পড়ে। 

এবং সকলেরই চোখে পড়ে তাদের জামার ভেতর থেকে, ভেজা জামার প্রায় স্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে ফুটে থাকা—একজনের একটি দা, আরেকজনের একটি পিস্তল।

যুবক দুটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চল হয়ে, যেন বা বিভ্রম অথবা বৃষ্টির সঙ্গে পতিত কোনো বস্তু যা এক্ষুণি গলে পানি হয়ে যাবে।

কিন্তু যুবক দুজন নড়ে ওঠে, বাইরের বৃষ্টির ঢলের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রবাহিত হবার জন্যে নয়, তারা এগিয়ে আসে বৃষ্টির ছাট থেকে শরীর বাঁচাতে। তারা আড়াল হয়ে দাঁড়ায়, মেঝের ওপর ঝপ করে বসে পড়ে; তারপর তাদের হাতের নড়া দেখে অনুমান করতে কারও বিন্দুমাত্র দেরি হয় না যে, জামার ভেতর কোমরের কাছে গুঁজে রাখা অস্ত্র দুটি বের করে সম্মুখে নামিয়ে রাখে তারা।

ইমাম সাহেব গলা খাঁকারি দেন; হয়তো কিছু বলতে চান, কিন্তু স্বর ফোটে না; গলা পরিষ্কার করার সেই শব্দে আশা করা গিয়েছিল বা, যে, যুবক দুজন ফিরে তাকাবে; তারা পরস্পরের কাছে মাথা এগিয়ে এনে নিচু গলায় কী যেন বলে।

মানুষগুলো মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, মাথার ওপরে ভীষণ বেগে দুলতে থাকা লণ্ঠন পেড়ে আনবার কথা কারও মনে হয়, কিন্তু মনের নির্দেশ দেহ আর শোনে না; বরং একাধিক দেহ থেকে ওযুর পবিত্রতা অকস্মাৎ নষ্ট হয়ে য়ায় এবং অনিচ্ছায়।

ইমাম সাহেবের মনে পড়ে যায়, বহু বৎসর আগে কারও একটি রোজার মাসে আরও এক তারাবির নামাযের কালে, তখন বৃষ্টি ছিল না, মুসল্লিরা সেজদায় গিয়েছে, নিঃশব্দে মাটি ফুঁড়ে যেন বা দেখা গিয়েছিল এই মসজিদের ভেতরই দুটি যুবক; কখন তারা উপস্থিত হয়েছিল কেউ জানে না, তারপর নামায শেষে ইমাম সাহেব জামাতের উদ্দেশে কিছু উপদেশ দেবার জন্যে যখন পশ্চিম থেকে মুখ ফেরান পুব দিকে, দরজায় স্থাপিত দেখতে পান মূর্তি দুটি।

যুবক দুটির হাতে ছিল উঁচিয়ে ধরা দুটি রাইফেল।

বহু বৎসর আগে সেই রাতেও সকলে ইমাম সাহেবের চোখ অনুসরণ করে পেছন ফিরে দরজার দিকে তাকিয়েছিল এবং আজ রাতের মতোই তারা কেউ কেউ নিজের ওযু নষ্ট হয়ে যাওয়া অনুভব করতে পেরেছিল অকস্মাৎ।

কেউ ধাওয়া করে আসছে; এদের একজনের স্মরণ হয় এক যুবতীকে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে রাখবার কথা, আরেকজনের স্মরণ হয় রিলিফের গম বিক্রি করে দেবার কথা, অপর একজনের স্মরণ হয় জমি আত্মসাৎ করে একটি পরিবারকে গ্রামছাড়া করবার কথা, এবং আর একজনের স্মরণ হয় দেশের সর্বাধুনিক রাজনৈতিক দলের মান্দারবাড়ি শাখা স্থাপন করবার কথা।

মসজিদের ভেতর এখনো যারা রয়ে যায়, বৃষ্টির প্রবল পাতের ভেতরে এখনো যারা একটি আশ্রয়ের অন্তর্গত থেকে যায়, তাদের একজন পকেট হাতড়ে দিয়াশলাই বের করে; ধূমপানের প্রয়োজনে রাখা দিয়াশলাই মসজিদের ভেতর বের করতে সে বড় সংকোচ বোধ করে, কিন্তু এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আলোর প্রয়োজন তাকে সাহসী করে, সে দিয়াশলাই থেকে কাঠি বের করে, খস করে শব্দ হলেও বৃষ্টি সেই শব্দটিকে গোপন করে ফেলে।

ফলে, মনে হয় ইমাম সাহেব ও মুসল্লিদের প্রত্যেকেরই এমন বোধ হয়, লণ্ঠনটি আপনা থেকেই জ্বলে ওঠে আবার।

তখন আরও একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বসে থাকা যুবক দুটিকে লক্ষ করে বলেন, ‘কন, বাহে, শুনি হামরা। মুক্তিযুদ্ধ কি ফির শুরু হয়া গেইছে?’

Leave a Reply

Your identity will not be published.