গন্তব্য

গন্তব্য

আমি বুঝতে পারছি এই শহরে অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছি। আমার বাইরের অবয়ব আর ভেতরের অবয়ব একটা আরেকটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমি প্রাণপণে আমার নিজস্ব দু’টো অস্তিত্বের ভেতরে যতবার চেষ্টা করছি সমন্বয় করতে, ততবার আমার ভেতরে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে; আর কান পাতলে শব্দ হচ্ছে ঝুরঝুর, ঝুরঝুর। অর্থাৎ ঝরে যাচ্ছে, ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে।

আমি এখন কী করি? কোথায় যাই?

এখন অনেক রাত। কিন্তু যতদূর সম্ভব কালিমালিপ্ত। অনেক রাত আছে, যা কালিমালিপ্ত নয়। আকাশে চাঁদ থাকে, নভোমণ্ডলে তারা, দূরের রাস্তায় হলুদ আবছা বাতি, ফুরফুর বাতাসের বারান্দায় থাকে কোমল নীল আলো, আলোর ভেতরে মানুষ, আর মানুষের ভেতরে প্রেম।

আবার অনেকগুলো দিনও থাকে মানুষের। সেই দিনের ভেতরে থাকে দুপুর। দুপুরের ভেতরে থাকে মানুষের গায়ের গন্ধ। হলুদ পেঁপের মতো যে গন্ধ জড়িয়ে ধরে মন। প্রেমের উজ্জ্বলতায় সে দুপুরগুলো হয়ে যায় সোনা। সোনা ঝিকমিক করে জ্বলে রমনা পার্কের লেকে।

কার অভিশাপে কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেইসব রাত ও দিন?

আমি তো জ্ঞানত দেবতা জিউস্-কে কোনোদিন ক্ষিপ্ত করে তুলি নি? ইকারুসের পাখা রোদে পুড়ে যাবার মতো হঠকারী কোনো কাজ করি নি। নাকি করেছি?

আমি কিছু বুঝতে পারছি নে।

বর্তমানে আমি অন্ধকারে মেঝের উপর উবু হয়ে বসে আছি। আমার দু’ হাঁটুর ওপরে রাখা আছে আমার মুখ। আমার যে মুখ মহিউদ্দিন একদিন দু’হাতের ভেতর তুলে ধরে বলেছিল, তুমি আমার তাহিতি দ্বীপের মেয়ে। তুমি পল্ গঁগ্যার তাহিতি দ্বীপের মেয়ে। তুমি নীল জামা পরে বসে আছ আমার সমুখে, তোমার মাথার পেছনে গাঢ় হলুদ ক্যানভাস। ক্যানভাসের দু’ পাশে উড়ন্ত প্রজাপতির মতো গাঢ় সবুজ পাতা। তুমি বসে আছ লাল ভেলভেট মোড়া চেয়ারে, এক হাতের ওপরে অন্য হাত রেখে। তোমার ডান হাতের দু’আঙুলের ফাঁকে সবুজ পাতার কমলা ফুল।

কিন্তু না, আমি তো তা ছিলাম না। আমি লাল ভেলভেট মোড়া চেয়ারে বসে ছিলাম ঠিকই কিন্তু আমি বসে ছিলাম ন্যুড হয়ে। আমি একপায়ের ওপর তুলে দিয়েছিলাম আরেকটি পা। আমার দু’হাত জড়ো হয়ে নাভির নিচে ঢেকে রেখেছিলাম আমার লজ্জা। আমার মাথার খোলা চুলে গোঁজা ছিল রক্তজবা, বুক ছিল উন্নত। শরীরের চেয়ে ছোট দু’টি স্তনে আমাকে দেখাচ্ছিল কিশোরীর মতো।

আমার মহিউদ্দিন, আমার নিজস্ব পল গঁগ্যা, আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে পাগলের মতো রঙ চড়াচ্ছিল ক্যানভাস-এ।

এমনি করে দিনের পর দিন। দুপুরের পর দুপুর।

আর প্রতিবার কাজ শেষ হলে ঘর্মাক্ত দেহে আমরা দু’জন জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়তাম আধো অন্ধকার ঘরটার ভেতরে। আমাকে কোলে করে সেই ঘরে তুলে নিয়ে যেত মহিউদ্দিন। চুমোয়, আদরে, সঙ্গমে পড়ন্ত দুপুর চিত্রল হরিণের মতো ছুটোছুটি করে ফিরত সেই অন্ধকার ঘরে।

কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল আমার গঁগ্যা? আমার নিজস্ব পল গঁগ্যা কোথায় আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল? গঁগ্যাহীন এই শহরে আমি বাস করি কী করে?

আমার তো নিজস্ব অস্তিত্ব নিয়েই এখন টানাটানি।

সারা শহরভর্তি এত মানুষ। এত অলিগলি, এত রাস্তা; বড় রাস্তা, ছোট রাস্তা, মাঝারি রাস্তা; এত বড় বড় পার্ক, রেস্তোরাঁ, সংগঠন; এত বড় চারুকলা, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি, নিউ মার্কেট; রঙতুলির দোকান, ক্যানভাসের দোকান, ছবি বাঁধাবার দোকান, সাজুর আর্ট গ্যালারিÑ কোথাও আজ সাতদিন ধরে আমার গঁগ্যাকে খুঁজে পাচ্ছি নে। তার স্টুডিও ঘরে মস্তবড় তালা ঝুলছে, বারবার নেড়েচেড়ে সেই তালা দেখি, তালার শরীরে মহিউদ্দিনের হাতের ছাপ আছে ভেবে চুমো খাই, গন্ধ শুঁকি, একে শুধোই, ওকে শুধোই, এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে ওই রাস্তায় যাই, ওই রাস্তা থেকে এই রাস্তায় আসি, আবার সেখান থেকে অন্য রাস্তায় যাই, চারপাশে পাগলের মতো মাথা ঘুরিয়ে তাকাই, সারাদিন আজকাল আমার রাস্তায় কাটছে; কখনো বা রিকশায় চড়ি, কখনো বেবি ট্যাক্সি, পয়সা বেশি থাকলে হলুদ ক্যাব ভাড়া করতেও দ্বিধা করি নে।

কিন্তু ঘুরে বেড়ানোই আমার সার।

আমার আবাল্য পরিচিত এই শহর আমার কাছে যে অচেনা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ আমি তা বুঝতে পারছি। গঁগ্যাহীন এই শহর মূলতই আমার কাছে অচেনা। আজ কতদিন, কতমাস, সেই দু’ বছর আগে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম যেদিন আলাপ হয় মহিউদ্দিনের সঙ্গে, তখন তার বয়স্ক চেহারা, মাথার কাঁচাপাকা চুল, চোখের চশমা, আমাকে আকৃষ্ট করেছিল ভীষণভাবে; আমার ভেতরে, আমার বাইশ বছরের শরীরের ভেতরে আমি নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। আমি তার ছবির প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, এবং প্রতি বিকেলে, যতদিন তার প্রদর্শনী চলেছিল হাজিরা দিতাম একাডেমিতে।

তারপর, কী করে কী করে টেলিফোনের আদান প্রদান, দেখা করার জন্য অনুরোধ, একদিন স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া, তারপর হঠাৎ করে ‘আমি তোমার ন্যুড আঁকতে চাই’ বলে আমার পায়ের কাছে বসে আমার মুখের দিকে অচেনা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, সবকিছু আজকাল বায়োস্কোপের ছবির মতো বারবার আমার মনে এসে ধাক্কা দিচ্ছে, ধাক্কাটা ঢেউয়ের মতো। বড় বড় ঢেউ, ছোট ছোট ঢেউ।

তোমার বয়স কত? একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

তোমার ডবল, চুয়াল্লিশ।

এই বলে হেসেছিল সে খুব সেদিন।

আর আমার বাইশ বছরের চোখে তার সে চুয়াল্লিশকে মনে হয়েছিল অপূর্ব। এই তো চাই, এই রকম পুরুষ আমার পছন্দ, এই যাকে আশ্রয় করে আমি নিশ্চিন্তে জীবনের পথে চলতে পারি, যে আমার ভেতরটা, নরম ও কোমল ভেতরটা জল ছলছল করে দিয়ে যেতে পারবে।

হ্যাঁ, আমি ন্যুড হয়েছিলাম।

তার ছবি আঁকার জন্য আমাকে ন্যুড হতে হয়েছিল। তার চেয়েও বড় কথা আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার কিছুই আমার ছিল না। আর সেও কি আমাকে ভালোবাসে নি? কেন সে তাহলে উদ্ভ্রান্তের মতো সমস্ত শহর তার গাড়ি দাবড়ে নিয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াত? একদিন আলিয়াস ফ্রাঁসেস-এ এসে আমাকে খুঁজে পেয়ে বলেছিল, এখানে কেন আসো?

ক্লাস করতে, ফরাসি ভাষাটা শেখার চেষ্টা করছি।

আর কতদিন লাগবে কোর্স শেষ করতে? গাড়ির মুখ মিরপুরের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সে।

অনেকদিন। এই তো সবে শুরু।

বেশ। গম্ভীর হয়ে বলেছিল মহিউদ্দিন। তারপর একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করেছিল, যে ছেলেটি করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, সে ছেলেটি কে?

মহিউদ্দিনের প্রশ্ন শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম। বাচ্চা মেয়ের মতো ফিক করে ওঠা হাসি। আমার হাসি দেখে গাড়ি চালাতে চালাতে সে বলেছিল, হাসছ যে?

হাসি থামিয়ে আমি বলেছিলাম, ওর নাম কাজল। আমার বন্ধু।

শুধু বন্ধু, আর না?

সেদিন তার স্টুডিও ঘরে সে পাগলের মতো আমাকে আদর করেছিল। আর বলেছিল, আমি জানি আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তবু কোনোদিন তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না। আমি ভুলতে দেব না। আমি অনেক ন্যুড এঁকেছি জীবনে, তবু তোমার মতো কাউকে এভাবে ভালোবাসি নি।

আমিও না। এই কথা বলে তার চুলভর্তি মাথা আমার বুকে চেপে ধরে রেখেছিলাম। অনেকক্ষণ।

সে সব কথা থাক। অতীতের কথা অতীতে ফিরে যাক। এখন আমার অস্তিত্বের সঙ্কট। আজ সাতদিনের ওপর হতে চলল আমি মহিউদ্দিনকে খুঁজে পাচ্ছি নে। বাড়িতে টেলিফোন করলে আনসারিং সার্ভিস কথা বলে ওঠে, মোবাইলে আনসারিং সার্ভিস, তার আপিসের ফোনেও আনসারিং সার্ভিস। কিন্তু এগুলোর একটিও মহিউদ্দিনের কণ্ঠস্বর নয়, অচেনা এক স্বর, ঘষা ঘষা, অস্পষ্ট, যেন কেউ একদলা কাগজ পুরে দিয়েছে গলার ভেতরে। আমি ঘোরেপড়া মানুষের মতো আমার মোবাইল দিয়ে বারবার করে এই স্বরগুলো শুনতে থাকি, একমনে, শুনতে শুনতে আমার গা শিরশির করে ওঠে, যেন মৃত্যুমুখী এই গলার স্বর আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যায়, সাবধান ইতি, সাবধান।

কিন্তু আমি তো সাবধান আর থাকতে পারছি নে। আমি জানি মহিউদ্দিনের বাড়িতে আমার ঢুঁ মারা নিষেধ। সেখানে তার স্ত্রী আছে, তের বছরের ছেলে আছে। মহিউদ্দিনের আপিসে যাওয়াও আমার নিষেধ। এই আপিসটা আসলে মহিউদ্দিনের শো-রুম, যেখান থেকে প্রচুর মানুষ তাদের শখের ছবি কিনে নিয়ে যায়, মূল ছবির রিপ্রিন্ট নেয়, ক্যালেন্ডারের ছবির জন্য অর্ডার দিয়ে যায়; কিন্তু বাড়িতে যেতে না পারি আপিসে যাওয়া আমার ঠেকাতে পারবে না মহিউদ্দিন।

কারণ, আমি আর এখন আমাতে নেই।

মহিউদ্দিনহীন জীবন এখন আমার কাছে মূল্যহীন এক ভাঙাচোরা জাহাজের আসবাবের মতো।

আমি খুব সাধারণ পোশাকে, সাধারণ প্রসাধনে, অতি সাধারণ একটা মেয়ের মতো একদিন তার আপিসে গিয়ে হাজির হলাম। মহিউদ্দিনের আপিসটা বড়। এই আপিসে প্রচুর জানালা। হয়তো ছবির জন্যই অনেক জানালা অনেক আলোর প্রয়োজন হয়।

এসে দেখি আপিস বন্ধ। প্রতিটি জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি ঝুঁকে বুক পেতে কাচে নাক ঠেকিয়ে, পায়ের পাতায় ভর দিয়ে দেখতে লাগলাম তার আপিস। প্রথমে রাস্তার পুবদিক থেকে, পরে পশ্চিমদিক থেকে, তারও পরে উত্তর দিক থেকে, সবশেষে দক্ষিণ দিক থেকে দেখতে লাগলাম। কাচে নাক ঠেকাতে ঠেকাতে নাক লাল হয়ে উঠল আমার। জিভ শুকিয়ে গেল, তবু ভালো করে কিছু দেখতে পেলাম না। জানালাগুলো পর্দাটানা, একরঙা হালকা অফ-হোয়াইট, মোটা থান কাপড় দিয়ে তৈরি, র’ কটনের হতে পারে- ভেতরের জিনিস দেখব কী শুধু পর্দা দেখতে দেখতেই চোখ আমার ব্যথা হয়ে গেল। তারপর আমার চোখের সামনেই অফ-হোয়াইট পর্দাগুলো ক্রমে হলুদ হয়ে গেল, তারপর আমার চারপাশের সবকিছুই হলুদ।

রাস্তা হলুদ। চলন্ত গাড়িগুলো হলুদ। মানুষগুলো হলুদ। আমার দু’হাত শূন্যে মেলে ধরে তাকিয়ে দেখলাম- আমার হাত দুটোও হলুদ। যেন ভ্যান গ’র সূর্যমুখী ফুলগুলো থেকে বিচ্ছুরিত হলুদ ক্যানভাসের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে।

অবশেষ আমি ক্রন্দনরত, অতি দ্রুত হলুদের ভেতর দিয়ে ক্রমশ হলুদ হয়ে যেতে যেতে পার হতে লাগলাম পান্থপথের রাস্তা।

কীভাবে বেঁচে আছি আজকাল প্রায় আমি বুঝতে পারি নে। আমার ভেতরে শুধু ঝরে পড়ার শব্দ। এই চব্বিশ বছরেই আমার শরীরে চুরাশির ছাপ। আমার শরীর থেকে আমার গঁগ্যার শারীরিক দূরত্ব আমাকে ক্রমে ক্রমে করে তুলছে বয়স্ক। আমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যেখানে আমার একদিন আমার নিজস্ব গঁগ্যার নিজস্ব হাত পড়েছিল সেখানে সময়ের শরীর তার অনন্ত ভার চাপিয়ে দিয়ে বসেছে। আমি তাকিয়ে দেখছি আমার চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে, হাতের শিরা বেরিয়ে পড়ছে, কপালে বুড়ো মানুষের মতো অসংখ্য বলিরেখার ছাপ, আর আমি না কল্পনা না বাস্তবে কোথায় আছি বুঝতে না পেরে ইদানীং শুধু হেঁটে যাচ্ছি শহরের পথে পথে। ইভা লুনার মতো কল্পনা করছি- একদিন যে-কোনো সময় যে-কোনো মুহূর্তে এই শহরের যে-কোনো গলি থেকে হঠাৎ করে এসে হাজির হবে আমার ত্রাণকর্তা রিয়াদ হালাবি। মাঝবয়সী শক্ত সমর্থ শরীরে সে দু’হাত বাড়িয়ে পাঁজা কোলে আমাকে মাটি থেকে তুলে জড়িয়ে ধরবে তার বুকে। তারপর পরম মমতার সাথে ‘আমার ছোট্ট মেয়ে’ বলে তুলে দেবে তার মালভর্তি চলন্ত ট্রাকে। বাবার মতো এই রিয়াদ হালাবিকে আমি এক সময় প্রেমিকের চোখে দেখতে থাকব, তারপর বড় হয়ে একদিন নিজেকে মেলে ধরব তার চোখের সামনে। প্রথমে নিতান্ত অনিচ্ছায়, পরে অতিশয় আদরে সে আমাকে তুলে নেবে তার বুকে। জন্মগত ত্র“টির কারণে জোড়া না লাগা তার ওপরের ঠোঁট সে লজ্জাবশত রুমালে লুকিয়ে রাখবে সঙ্গমের সময়, কিন্তু আমি জোর করে সে রুমাল তার মুখ থেকে সরিয়ে পরম সোহাগে চুমো খাব তার ভাঙা ঠোঁটে। তার শরীরের ক্ষত ও বয়স তখন আমার কাছে হয়ে উঠবে গৌণ, মানুষ হিসেবে সে হয়ে উঠবে বিশাল হৃদয়ের মহান একজন মানুষ।

এই শহরে কোথায় আমার সে রিয়াদ হালাবি?

ইসাবলে আয়েন্দের রিয়াদ হালাবি কি বই-এর পাতায় চিরদিন থেকে যাবে? বাস্তবে কোনোদিন সে কি রাস্তায় বেরিয়ে আসবে না তার চলন্ত ট্রাক নিয়ে বেশ্যাপাড়া থেকে আমাকে উদ্ধার করতে?

আমি এসব জানি নে। আমি কিচ্ছু বুঝতে পারি নে আজকাল।

মাঝে মাঝে এমনো হয় হোটেল সোনারগাঁও এর সামনে নিতুন কুণ্ডুর ভাস্কর্যের নিচে দাঁড়িয়ে আমি আমার পাজামা কামিজ পরা চেহারায় দু’পা ফাঁক করে চিৎকার করে উঠি, রি-য়া-দ হা-লা-বি! রি-য়া-দ হা-!

আমার গলা ফাটানো চিৎকার শুনে ট্রাফিক পুলিশ কৌতূহলী ও বিরক্ত মুখে এগিয়ে আসে। আফগানিস্তানে এখন তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ বেঁধেছে। তালেবানদের সমর্থকরা মাঝে মাঝেই মিটিং, মিছিল করে। আমার মুখে অদ্ভুত এই নাম শুনে লোকে ভাবে আমি বুঝি মস্ত বড় কোনো তালেবানের নাম চিৎকার করে মানুষজনদের জানাচ্ছি। লোকটা তালেবান না তুর্কি তা বোঝবার ক্ষমতা যেমন তাদের নেই, তেমনি আমারও নেই। এই যুদ্ধে রিয়াদ হালাবি যদি সত্যিকারের কোনো চরিত্র হতো তাহলে সে কোন দলে যেত? তালেবান না অ্যান্টি-তালেবান?

এরপর আমি গঁগ্যার নাম ধরেও চিৎকার করি। তবে বাংলায় নয়, ইংরেজিতে। আমি বলি, প্লিজ ক্যান অ্যানি ওয়ান গিভ মি নিউজ অ্যাবাউট পল গঁগ্যা, আ নিউ ভিশন অব আর্ট অ্যান্ড লাইফ। পল গঁগ্যা ওয়াজ বর্ন অন ফিফথ জুলাই নাইনটিন ফিফটি সিক্স, থুড়ি হি ওয়াজ বর্ন অন সেভেনথ জুন এইটিন ফোরটি এইট। হিজ রিয়েল নেম ওয়াজ মহিউদ্দিন আহমদে মহি, থুড়ি হিজ রিয়েল নেম ওয়াজ ইউজিন আঁরি পল গঁগ্যা। হি ওয়াজ বর্ন ইন ঢাকা দ্য ক্যাপিটাল সিটি অব আ থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি, আ কান্ট্রি ফুল অব অ্যাট্রোসিটি, ভায়োলেন্স অ্যান্ড ডিসঅর্ডার, থুড়ি হি ওয়াজ বর্ন ইন প্যারি, দ্য ক্যাপিটাল সিটি অব ফ্রান্স, আ কান্ট্রি ফুল অব আর্টিস্টিক ট্যালেন্টস, ফ্যাসিনেটিং ইমাজিনেশন অ্যান্ড অর্ডার। ইট ওয়াজ আ গ্রেট প্রেইন।

এবার ট্রাফিক পুলিশ দৌড়ে এসে আমার কানের পর্দা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, ভদ্রঘরের মাইয়া মাতারিগো লাহান চিক পাড়েন ক্যা? যান, ভাগেন। তার বিকট চেহারা দেখে ভয় পেয়ে আমি ভেগে যাই, বেশ দ্রুতই ভেগে যাই।

এরপর আমি আর্ট কলেজের মাঠে গিয়ে উঠি। এটা বোধ করি আর কলেজ নেই, এতদিনে ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে, আমি এ বিষয়গুলো ঠিক জানি নে, মহিউদ্দিন এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলে যায় নি। বস্তুত আর্ট কলেজের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না, তার দলছুট স্বভাব অনেকের কাছে মনে হতো অসহ্য, আর্টের যে-কোনো বিষয়ে আলোচনার সময় তার নাম থাকত উহ্য, কিন্তু ছায়ার মতো সে ছাপ ফেলে থাকত সকলের মনে, অনেকে অস্বস্তি বোধ করত, অনেকে খুশি হতো মহিউদ্দিনকে ল্যাং মারতে পারছে ভেবে। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমিতে সে যেবার ‘মা ও শিশু’ প্রদর্শনী দিয়েছিল, হু-হু করে রাতারাতি নাম ছড়িয়ে গেল তার, শুধু দেশে না, বিদেশেও। পুরো প্রদর্শনী জুড়ে শুধু মা ও শিশু। বিভিন্ন পরিবেশের মা, বিভিন্ন বয়সের মা; বিভিন্ন পরিবেশের শিশু, বিভিন্ন বয়সের শিশু। এরকমভাবে মাতৃরূপ আর শিশুর আবেগ এর আগে এ দেশে অন্য কোনো শিল্পীর তুলিতে উঠে আসে নি। এ ছিল শিল্পীর আশ্চর্য এক প্রতিভার বিকাশ। নিজের মাকে মহিউদ্দিন কোনোদিন চোখে দেখে নি, তার জন্মের পরপরই সে মাকে হারায়, সৎ মায়ের কাছ থেকে কোনো মাতৃস্নেহ কোনোদিন পেয়েছে বলে আমি শুনি নি, অথচ তারই তুলিতে মাতৃস্নেহের এই প্রতিফলন অনেক শিল্পীই সহজভাবে মেনে নিতে পারে নি। মাতৃহারা শিশুর কাছে মা যে কীভাবে ধরা দিতে পারে তা যাদের মা আছে তারা কী করে বুঝবে?

আমি আর্ট কলেজের প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করছি দেখে একটা ছেলে এগিয়ে এলো কাছে। তার পরনে জিনস্ এর প্যান্ট, গায়ে হাতাঅলা কালো গেঞ্জি, গেঞ্জির গায়ে ‘টরেন্টো’ লেখা। ছেলেটি আমার কাছে আমার আগাপাশতলা দেখে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ? তার ইংরেজি উচ্চারণ খুব সুন্দর। একেবারে ইংরেজদের মতো।

উত্তরে আমি আমার বাঙালি উচ্চারণের ইংরেজিতে বললাম, আই কাম ফ্রম তাহিতি আইল্যান্ড।

হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে?

আমি আবারো বললাম, আই সেড, আই কাম ফ্রম তাহিতি আইল্যান্ড।

হোয়াট ননসেন্স ইউ আর টকিং অ্যাবাউট? ছেলেটি ভীষণ বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল। আমি তার ভুরু কোঁচকানো দেখে একটু ভয় পেয়ে সেটুকু ঢাকার জন্য জোর গলায় বলে উঠলাম, নো, নো ননসেন্স। রিয়ালি আই কাম ফ্রম তাহিতি। লুক অ্যাট মাই ফেস, লুক অ্যাট মাই ফেশিয়াল কনট্যুর, অ্যাজ আ তাহিতি গার্ল আই হ্যাভ গিভেন সো মেনি সিটিংস টু ইওর ফেমাস পেইন্টার মিস্টার-

মাই ফুট! এই কথা বলে আমার পুরো বাক্যটা না শুনেই ঘাড় ঝাঁকিয়ে ছেলেটা চলে গেল। সে পেছন ফিরলে তার গেঞ্জিতে আবারো ‘টরেন্টো’ ছাপা আছে দেখলাম। ভাবলাম, কী চমৎকার ইংরেজি বলল ছেলেটি, আজকাল কি আর্ট কলেজে ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরাও ভর্তি হয়? আশ্চর্য, আর্টের কদর বুঝে কী দ্রুত উন্নত হয়ে যাচ্ছে এই দেশ!

কিন্তু তবু কেন যেন আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আর্ট কলেজ থেকে বেরিয়ে আবার আমি হাঁটতে লাগলাম রাস্তায়। আজকাল রাস্তায় হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগে। ফুটপাত মাড়িয়ে, উঁচু নিচু গর্ত পার হয়ে, লোকের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমি হাঁটতে থাকি। এবরোথেবড়ো ফুটপাত গনগনে সূর্যের নিচে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমার মনে হয় এই ফুটপাত বাংলাদেশের জীবন। আর জীবন মানেই চলন্ত, জীবন মানেই বেঁচে থাকা। মরে যাবার ভয়ে ফুটপাতকেই তাই আমি আজকাল আঁকড়ে ধরেছি, এই ফুটপাত এখন আমার ত্রাণকর্তা। আমার পল গঁগ্যা নেই, আমার রিয়াদ হালাবি নেই, আমার মহিউদ্দিন আহমেদ মহি নেই, আমার সাইকোলজিস্ট নেই; ফুটপাত ছাড়া কে আজ আমাকে বাঁচাবে? থুঁতু, খয়ের, পানের পিক এবং নাকের পোঁটা বাদ দিলে ফুটপাতের এই চলন্ত জীবনের নানাজাতের ফেরিঅলা, ভিখিরি, পকেটমার, উঠতি মাস্তান, ভাঁপাপিঠে, হাতরুটি, ভাজি, হালুয়া নিয়ে বসে থাকা কাজের মহিলা, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শত শত মহিলা ও পুরুষকর্মী প্রায় সবাই এসব ফুটপাত দিয়ে কম করে হলেও দিনে অন্তত দু’বার করে হেঁটে যায় এবং এই গরিব দেশটাকে জীবন্ত করে রাখে। চলতে চলতে ক্ষিদে লাগলে এই ফুটপাতেই উবু হয়ে বসে আমি হাতরুটি, ভাজি আর ডাল খেয়ে নিই। তারপর আবার ক্ষিদে পেলে ফেরিঅলার কাছ থেকে হাতের কারসাজিতে ফুলের পাপড়ি হয়ে যাওয়া আমড়া কিনে খাই। ভাজামুড়ি ও ছোলা ওড়নার ভেতরে পোঁটলা করে নিয়ে খেতে খেতে পথ হাঁটি বা হাঁটতে হাঁটতে খাই। পায়ের স্যান্ডেলের দড়ি ছিঁড়ে গেলে রাস্তার ধারে বসে থাকা জুতো সেলাইঅলার কাছে এসে দাঁড়াই।

এতসব কাজ করি আর ভাবি, আচ্ছা, আত্মহত্যা করতে কেমন লাগে? কোন সব মানসিকতার মানুষ আত্মহত্যা করে কেউ কি আমাকে বলতে পারে? আচ্ছা, মানুষ ছাড়া জীবজগতে আর কেউ কি আত্মহত্যা করে ? কুকুরেরা তাদের মনিব হারিয়ে গেলে আত্মহত্যা করে? আত্মহত্যা করলে সে মানুষ হোক বা কুকুর হোক, তাদের অশান্ত আত্মা শান্তি পায় কিনা আমি জানি নে, তবু রাস্তায় আজকাল বড় দুরন্তভাবে ট্রাক ছুটে যেতে দেখলে ইচ্ছে করে ঝাঁপ দিয়ে সামনে পড়ি। ইচ্ছেটা মাঝে মাঝে এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে, মন আমার হামানদিস্তের নিচে ভাঙচুর হতে থাকে। কী করি, কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ি ভাবতে ভাবতে ট্রাক আমার চোখের সামনে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। আমার তখন ভয় হয়। ভীষণ ভয়। আত্মহত্যা করব বলে নয়, আত্মহত্যার পর ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পোস্টমর্টেমের অপেক্ষায় শুয়ে থাকার ভয়।

আমার তখন ইয়াসমিনের কথা মনে হয়। না, দশ রাস্তার মোড়ের ইয়াসমিনের কথা নয়, যে ইয়াসমিনকে পুলিশ গং ধর্ষণ করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলেছিল তার কথা নয়, এ আরেক ইয়াসমিন, যে প্লেনের একজন কো-পাইলট ছিল, ঝড়বৃষ্টির ভেতরে প্লেন যখন একদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় উড়ে এসে পাইলটের হঠকারিতায় রানওয়ের বাইরে এক ডোবায় ল্যান্ড করেছিল এবং পুরো যাত্রীসহ হাহাকার করে নিমজ্জিত হয়েছিল, সেই প্লেনের কো-পাইলট ইয়াসমিনের কথা মনে হয়। তার মরদেহ যখন বিমানের ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আনা হয়; আমার ফুপাতো ভাইয়ের সাথে, সে তখন মেডিকেলের ছাত্র, আমি ছোট মানুষের কৌতূহল নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। অনেক লম্বা একটা করিডোর পার হয়ে পড়ে আছে অসংখ্য নারী ও পুরুষ, সবাই উলঙ্গ। এবং তাদের মাঝখানে শুয়ে আছে উলঙ্গ ইয়াসমিন। খোলা জানালার বাইরে অসংখ্য কৌতূহলী চোখের পুরুষ ও আমার মতো ছোট ছেলেরা জানালার শিক আঁকড়ে তাকিয়ে দেখছে ইয়াসমিনকে।

সেদিন আমি যত ছোটই হই আমার গা-মাথা-মন ঘুলিয়ে দলা পাকিয়ে ভেজা কাগজের মণ্ড হয়ে গিয়েছিল। উলঙ্গ ইয়াসমিনের আব্রু হারাবার লজ্জায় আমার চোখ দিয়ে পানি পড়েছিল অবিরাম আর আমার ফুপাতো ভাই আমার ভেজা গাল হাত দিয়ে মুছিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে করুণার স্বরে বলেছিল, কী, এবার সখ মিটল তো! কতবার করে তোকে মানা করলাম না যে খবরদার আসিস নে আমার সাথে, দেখে ভয় পাবি।

হ্যাঁ, ভয়ও আমি পেয়েছিলাম। কারণ আমার ফুপাতো ভাই জানত না যে আমিও মনে মনে একদিন পাইলট হব ভেবেছিলাম। খবরের কাগজ থেকে প্লেনের ছবির কাটিং জমিয়ে রেখেছিলাম আমার বইয়ের ভেতরে। প্রথমে আমি কো-পাইলট হব ভেবেছিলাম, পরে পাইলট। প্রথমে দেশের ভেতরে প্লেন চালাব ভেবেছিলাম, পরে পাড়ি দেব ট্রান্সআটলান্টিক। আমার ভেতরে সম্ভাবনা ছিল সে রকম একজন পাইলট হবার, কিন্তু ইয়াসমিনের আব্রু নষ্ট হতে দেখে সেই যে আমার মনে ভয় ঢুকে গেল, তা আজও শেষ হয়ে যায় নি।

হাঃ তৃতীয় বিশ্বের নরককুণ্ডে যেখানে জীবন্ত মানুষের মর্যাদা নেই, সেখানে মৃত মানুষের কীসের সম্মান, কীসের আব্রু?

ভাগ্যের কী পরিহাস, এত যে আমার মনের ভেতরে আব্রু হারাবার ভয়, সেই আমিই ন্যুড হয়ে আমার পল গঁগ্যার স্টুডিওতে সিটিং দিয়েছি। হা, কেন আমার এতবড় অধঃপতন হলো? কেন আমি দূর থেকেই একজন বিবাহিত, সম্ভ্রান্ত ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীকে ভালোবেসে গেলাম না? যেমন আমি জয়নুলকে ভালোবেসেছি, কামরুলকে ভালোবেসেছি, শাহাবুদ্দিনকে ভালোবেসেছি, পিকাসোকে ভালোবেসেছি, যেমন আমি ভালোবেসেছি টার্নার, মনে, কনস্টেবল, মাতিস ও সালভেদর দালিকে।

হা, আমার এ ভালোবাসা কি সেরকম কোনো ভালোবাসা ছিল? আমি যে মহিউদ্দিনকে আমার প্রেমিক বলে জেনেছিলাম। আমার দেহ ও মনের একচ্ছত্র মালিক বলে জেনেছিলাম। এমনকি আমি মনে মনে তার ঔরসের সন্তানকে আমার জরায়ুতে স্থান দেব বলেও প্রস্তুত ছিলাম।

কিন্তু কোথায় যেন আমার অজান্তে হঠাৎ করে কিছু একটা ঘটে গেল।

আজ কতদিন, প্রায় তিন সপ্তাহ হতে চলল, আমার মহিউদ্দিনকে খুঁজে পাচ্ছি নে। আমাকে ফেলে সে কোথায় চলে গেল? আমি লজ্জার মাথা খেয়ে যাকেই জিজ্ঞেস করি তার কথা, সে মুখ টিপে হাসে। হাসে নাকি মুখ বাঁকায়, আমি বুঝতে পারি নে। আজকাল আমি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের ব্যবহার, ভাবভঙ্গি, চালচলন কিছু বুঝতে পারি নে। আমি যত মন দিয়ে দেখতে চাই, আমার চোখের সামনে ঝিলমিল করে পর্দা ঝুলতে থাকে। সেই পর্দা ভেদ করে আমার দৃষ্টি বেশি দূরে যেতে পারে না। কিন্তু অন্তরের গভীরে তীব্র একটা অনুভব হয়, তা হলো বেঁচে থাকার। আত্মহত্যার পর্ব শেষ হয়ে, আমি বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যে ভাবেই হোক আমাকে এখন বেঁচে থাকতে হবে। আমার একটা দুঃখী বুড়ো মা আছে, আমি তার শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান। আমার দুর্বিনীত বাবার লাথি থাপ্পড় খেয়ে সারাটা জীবন কাটিয়েছেন এই মহিলা। মহিউদ্দিনকে হারিয়ে আমি যত কষ্ট পাচ্ছি, আমাকে হারালে সে এর চেয়ে চারগুণ বেশি কষ্ট পাবে। তাকে প্ল্যান প্রোগ্রাম করে আর জীবন হারাতে হবে না, আমাকে হারালে খুব সাধারণভাবেই মরে যাবে শিগগির।

ফুটপাত আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়েছে বর্তমানে। হাঁটতে হাঁটতে আমি আজকাল মহাখালির গাড়ির গ্যারেজের পেছনে চলে যাই। সেখানে এক কুষ্ঠরোগী ছালা পেতে ভিক্ষে করে। বড় রাস্তায় সে ভিক্ষে করতে ভয় পায়, লোকে লাঠি পিটিয়ে তাড়ায় বলে। আমি তার কাছে প্রায় প্রতিদিন সেখানে হাজিরা দিই। এত কাছে কুষ্ঠরোগীদের হাসপাতাল- তাকে সেখানে যেতে বললে সে বিড়বিড় করে বলে, এই দুনিয়ায় গরিব মাইনসের চিকিৎসা নাই। আল্লার ইচ্ছায় আমার এই বিমার হইছে, আল্লার ইচ্ছায় সারব।

সে যখন অসীম বিশ্বাসে এ কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়ে তার গলে যাওয়া নাক, গলে যাওয়া মুখগহ্বরের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি তার পাশে আমার পাজামা কামিজ পরা পা গুটিয়ে নিয়ে বসে যাই। তার গলিত ক্ষত থেকে যে দুর্গন্ধ বেরোয়, আমার তাতে গা গুলোয় না, বমি আসে না। সে গোল বাটার বানের ভেতরে শুকিয়ে চিমসে ধরা গরুর মাংসের বার্গার খেতে ভালোবাসে, এটা তার বিলাসিতা; প্রতিবার তার সাথে দেখা করতে যাবার আগে আমি তাই মহাখালির মোড় থেকে বার্গার কিনে নিয়ে যাই তার জন্যে। সে একদিন একজন পুরুষ মানুষ ছিল, এখন সে লিঙ্গহীন, কুষ্ঠ আক্রান্ত মানুষ নামধারী জীব মাত্র। আমার কাছে এই চলন্ত জীবনটাকেই বর্তমানে সবচেয়ে কাছের মানুষ বলে মনে হয়। সে যখন তার দুঃখের কথা বলে কাঁদে, আমি তার সাথে কাঁদি। সে যখন তার গ্রামের ফেলে আসা ছেলেবেলার হাসি-খেলার দিনগুলোর কথা বলে হাসে আমি তখন হাসি। আমার ইচ্ছে হয় একে জিজ্ঞেস করি, শরীরের কুষ্ঠের মতো মানুষের মনেও যে কুষ্ঠরোগ হয় তার খবর সে রাখে কিনা? মানুষের মনও যে অন্য এক কুষ্ঠরোগে গলে যায়, ক্ষয়ে যায়, পচে যায় এ খবর কি আমার এই বন্ধুটি জানে?

না জানে না। আমি জানি আমার এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না। আজকাল তাই বাড়ি ফিরে প্রায়ই আমি ঘর অন্ধকার করে বসে থাকি। পাজামা হাঁটুর ওপরে তুলি, পা ভাঁজ করে, বাঁ হাতে গালে ভর দিয়ে খালি মেঝের ঠাণ্ডায় বসে থাকি। কল্পনায় দেখি আমার গায়ে কামিজের বদলে হাতাকাটা ঢোলা জামা, চুলের মাঝখান থেকে সিঁথি, আমার ডান হাত কনুই ভাঁজ হয়ে কোমরে বসানো, নিজের অজান্তেই আমি প্যারির পল গঁগ্যার ‘ব্রুডিং উওম্যান’ হয়ে যায়। তখন মহিউদ্দিনের কথা আবার আমার মনে পড়ে। আমার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়ে যায়। মনে পড়ে মহিউদ্দিন সখ করে একদিন আমার গায়ে গাঢ় নীল ভেলভেটের এক ফ্রক চড়িয়ে, আমার মাথার লম্বা চুলে সাদা তিনটে ফুল গুঁজে, ডান হাতে আমার লাল সিঁদুরে একটা আম ধরিয়ে, আমাকে গঁগ্যার ‘উওম্যান উইথ অ্যা ম্যাঙ্গো’ সাজিয়ে রেখেছিল।

আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হেসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে, যেন আমি সত্যিই এক দ্বীপ থেকে উঠে এসেছি তার ঢাকার স্টুডিওতে।

ক’দিন বাদে ফুটপাতও আর ভালো লাগল না আমার। মনে হতে লাগল ফুটপাতের জীবন বড় মানবেতর জীবন। বড় লাঞ্ছনার জীবন। এ জীবন আমাকে আর আকৃষ্ট করতে পারল না। এখন ঘরই আমার একমাত্র সম্বল। আমার দুর্ধর্ষ ও নিষ্ঠুর বাবার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া এই ছোট্ট বাড়িটার অন্ধকার এক কোণে আমি মাথা গুঁজে পড়ে থাকি আজকাল। অন্য কোণে, আরেকটা ঘরে থাকে আমার দুঃখী মা, আমাকে ভালোবাসলেও যে আমার সাথে কথা বলতে ভয় পায়। মৃত্যুর আগে আমার বাবা তার মনের ব্যাকবোন ভেঙে দিয়ে গেছে। তার সমস্ত শরীরে অ্যান্টার্কটিকার শৈত্য জড়ানো। মাঝরাতে বাবা যখন তাকে ঘর থেকে রাস্তায় বের করে দিত, বন্ধ করে দিত বাড়িতে ঢোকার দরজা, তখন আমাকে কোলে নিয়ে অন্ধকারে শীতের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে থাকত চুপ করে। কোনো প্রতিবাদ না, প্রতিরোধ না। বরফে শীতল করে রাখা মৃত মাছদের মতো শীত আমাদের দু’জনের শরীর জড়িয়ে ধরত ঠেসে। তার মাতৃহৃদয়ের উষ্ণতাও আমার শরীর গরম রাখতে পারত না, যদিও সে চেষ্টা করত তার বুকের ভেতরে আমাকে গুঁজে রাখতে। আমি কেন আজকাল আর ইউনিভার্সিটিতে যাই নে, কেন ঘরের পর্দা টেনে চুপচাপ শুয়ে থাকি, কেন আমি তার সাথে আর কথা বলি নে, সে এসবের কিছুই আমাকে জিজ্ঞেস করে না। আমি তাকে কাছে না ডাকলে সে কোনোদিন আমার কাছে আসবে না, আমার বাবা তাকে এই নিয়ম শিখিয়ে দিয়ে গেছে। মৃত বাবার আদেশ যে এখনো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে। এর জন্য বাবার চেয়ে মায়ের প্রতিই আমার ঘৃণা বেশি হয় আজকাল। আমি সে ঘৃণা চেপে রাখি এবং নিজেকে শাসন করি। আমার বাবার বায়োলজিক্যাল জিনসের ভেতরে অপরাধবোধের ছিটেফোঁটা না থাকলেও তার মেয়ে আমি সর্বক্ষণই জর্জরিত হয়ে থাকি এক গভীর অপরাধবোধে এবং সেটা আমার মায়ের জন্য।

আমার মনে হয় আমার গায়ে আজকাল সর্বক্ষণই একটু একটু জ্বর থাকে। মুখের ভেতরে তেতো বিষ। জিভ খড়ের মতো শুকনো। আমার কোনো ক্ষিদে লাগে না। তৃষ্ণাও নয়। আমার শরীরের যাবতীয় অনুভূতি ক্রমশ ভোঁতা হয়ে আসছে আমি সেটা টের পাই। এখন আর আমার দিন ও রাতের হিসেব নেই। আজকাল কত তারিখ, কী বার, ঘড়ি, সময়, রোদ সবকিছু থেকে আমি যোজন মাইল দূরে বসে থাকি।

এ রকম একটা সময়ে, একদিন যখন আমি বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে, আমার বন্ধ চোখের ওপরে আড়াআড়ি করে ধরে রাখা দু’হাত, তখন হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার মতো জোর ধাক্কায় দরজা খুলে আমার ঘরে ঢুকল যেন কে।

আকস্মিকতায় মানুষ যেমন সিঁটিয়ে যায়, তেমনিভাবে সিঁটিয়ে পড়ে থাকলাম আমি বিছানায়। তখনো আমার চোখ বন্ধ। চোখের ওপরে হাত।

দুর্ধর্ষ এক গোঁয়ারের মতো প্রথমেই সে টান মেরে দূরে সরিয়ে ফেলল আমার জানালার পর্দা। ঘরে বসে লেখালেখি করার চেয়ারটা এক লাথি মেরে ছুড়ে ফেলল দূরে।

কানে শব্দ পেলাম আমার পড়ার টেবিলের ওপরে থুপ্ থাপ করে পড়ল একগাদা বই।

এরপর একটুক্ষণের জন্য পিনপতন স্তব্ধতা।

সেই স্তব্ধতাও এবার লাথি মেড়ে গুঁড়িয়ে ফেলে অতি কর্কশ স্বরে সে বলে উঠল, অ্যাই ইতি, চোখ থেকে হাত সরা, চোখ খোল।

কিন্তু আমি এত সহজে চোখ খুলব কী করে?

আজ কতদিন আমি আলোর দিকে তাকাই নি। আলোর চেহারা আমি ভুলে গেছি।

আমি তাহিতি দ্বীপের মেয়ে ছিলাম একদিন।

আলো, সমুদ্র, আকাশ, সবুজ ও শঙ্খচিলের ডানার গন্ধ ছিল আমার সারাদিনের সঙ্গী; সারাটা দিন আমি বুক ভরে টেনে নিতাম সমুদ্রের বাতাস; সমুদ্রের ঢেউ ছিল আমার প্রেম; সমুদ্রের তীর ছিল আমার নুড়ি কুড়িয়ে কোঁচড়ে তোলার খেলাঘর; আমার একটা গঁগ্যা ছিল তখন; ইউজিন অ্যাঁরি পল গঁগ্যা ওরফে মহিউদ্দিন আহমেদ মহি; আজ আমার সে গঁগ্যা নেই; সেই প্রেম নেই; আজ আমার দ্বীপ সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে অতল গভীরে নিমজ্জিত; আজ আমি পঙ্গু, বধির, কুৎসিত ও কুষ্ঠের ছোঁয়ায় অসাড়।

ইতি, অনেক ঢং হয়েছে। আজ দু’মাস ধরে এই ঢং দেখছি। এবার চোখ খোল বলছি।

নিষ্ঠুর এক চামারের মতো আমার চোখের ওপর থেকে হাত টেনে সরিয়ে দিয়ে বলে উঠল দুলু। এই সেই দুলু। যাকে আমি এতদিন আমার বন্ধু বলে জেনে এসেছি।

দুলু আমার বন্ধু হলেও জানে না এ চোখ আর খোলার নয়! খোলার পর মুহূর্তে তীব্র বেগে ঘরে ঢোকা সূর্যের আলো আমার চোখের মণি ভেদ করে রেটিনায় রক্তক্ষরণ করাবে।

কতদিন আমি সূর্যের দিকে তাকাই নি। কতদিন হলুদ রোদ এসে পড়ে নি আমার ঘরের মেঝেয়।

অন্ধকারের ভেতরে জন্ম নেয়া এবং অন্ধকারেই বড় হয়ে ওঠা জীবেরা যেমন আলোয় এলে চোখে দেখতে পায় না কিছুই, আমার অবস্থাও এখন সে রকম। দুলু আবার বলল, শোন ইতি, তোর নাম কেন ইতি রেখেছিলেন তোর বাবা-মা আমি জানি নে, সাতটা মেয়ে পরপর সংসারে জন্ম নিলে তবেই শেষ মেয়ের নাম রাখে ইতি, আর তুই সংসারের প্রথম ও একমাত্র মেয়ে হয়েই ইতি হয়ে গেলি, বিষয়টা রিসার্চের সন্দেহ নেই, তা যা হোক শোন এবার, অনেক হয়েছে। আজ থেকে তোর গত জীবনের সবকিছু ইতি। আবার সবকিছু নতুন করে শুরু কর।

আমি অতি কষ্টে শুকনো জিভ টেনে টেনে ভেজাবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, দুলু, তুই এখান থেকে চলে যা। কে তোকে বাসায় ঢুকতে দিল ?

কেন যাব রে লুলা? দুলু খেঁকিয়ে উঠল আমার কথা শুনে।

দুলুর ভগবান দুলুর গলার স্বরে মিষ্টত্ব দিতে ভুলে গিয়েছিল বলেই দুলু যেন তার প্রতিশোধ নিতে যত্রতত্র খেঁকিয়ে কথা বলে। রাগ তার ভগবানের প্রতি, কিন্তু শাস্তি ভোগ করে নিরীহ মানুষ।

খেঁকিয়ে উঠে দুলু আরো বলল, এ বাড়িতে আমার ঢোকার পথ আটকাবে কে? তুই? তুই তো তোর বুড়ো প্রেমিক হারাবার কালাজ্বরে কাহিল। এই অসুস্থ প্রেমের প্লীহা এখন তোর সমস্ত পেট-বুক জুড়ে রাজত্ব করছে। এ প্রেম যে আর নেই, হারিয়ে গেছে বাতাসে, মিলিয়ে গেছে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, এটুকু বোঝবার ক্ষমতা তোর আর নেই। তোর মায়ের মুখের দিকে ইদানীং কখনো তাকিয়ে দেখেছিস?

না দেখি নি। এই পৃথিবীতে কারো দিকে আমি চোখ তুলে দেখি নি কতদিন। যেন কতকাল।

তবু নিষ্ঠুর দুলুর কথা শুনে আমার বুক দিয়ে আর্তনাদ বেরিয়ে এলো।

আমি চোখ বুজে রেখে বলে উঠলাম, প্লিজ দুলু, পর্দা টেনে দে। আর এভাবে কথা বলিস নে। আমি আমার প্রেম হারাই নি, আমার প্রেমিককে শুধু আমি খুঁজে পাচ্ছি নে। আমার বিশ্বাস তার কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে। নইলে প্রতিবার সে তো আমার ন্যুড আঁকবার পরে...

ননসেন্স। তুই এতটা ননসেন্স!

আমার কথা শেষ না হতেই দুলু বলে উঠল।

দুলু গলার স্বর এবার ভিন্ন। যেন কী এক ম্যাজিকে কর্কশতা হারিয়ে কোমল ও ভারি হয়ে এলো। যেন দুধের সরের মতো ধবল ও মসৃণ হয়ে এলো তার কণ্ঠ।

নিচু স্বরে বড় দুঃখী হয়ে দুলু বলল, এই শহরে তুই আর লোক খুঁজে পেলি নে, একটা পটুয়াকে ভালোবাসতে গেলি। কামরুলের দেয়া কি বিশ্রী নাম এই পটুয়া, কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করে না। আদতে এখন ভেবে দেখছি এই নামই ওদের জন্য উপযুক্ত সম্বোধন। ওরে মূর্খ, মহিউদ্দিনের মতো পটুয়ারা কাউকে ভালোবাসে না, ওদের গন্তব্য হলো কালোত্তীর্ণ খ্যাতির চুড়োয় আরোহণের পর বাড়ি ফেরা। প্রেম ভালোবাসা ওদের জীবনে নিত্যদিনের খাদ্য-পানি-মদ-মধুপানের মতো প্রয়োজনীয় একটা বস্তু। ওদের কাছে ভালোবাসা একটা শব্দ মাত্র, প্রেম হলো নড়বড়ে সম্পর্কের এক খোলস। বরং তোর জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে যে মিজান, এতকিছু জেনেও যে তোকে কাছে টেনে নিতে চায়, তাকেই বলে হয়তো ভালোবাসা। তবু আমি এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নই; কারণ এখনো আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি নি। বা কেউ আমাকে।

দুলুর শেষ বাক্যটা অবশ্য সত্যি।

কিন্তু দুলুকে কেউ ভলোবাসবে কী, ভালোবাসার কথা কেউ বলতে এসেছে আন্দাজ করলেই দুলু এমন মারমুখী হয়ে ওঠে যে, কেউ আর কাছেই ঘেঁসে না। ক্লাসের সবাই এখন দুলুর নাম দিয়েছে গার্ডিয়ান।

দুলু কথাটা জেনেও ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখায়।

তবে আমার নিজের সমস্যাটা এত প্রকট যে, দুলুর কথা বেশিক্ষণ ভাবতে পারলাম না।

আমার বুকের ভেতরে আবারো বুক ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ঝুরঝুর, ঝুরঝুর, ঝুরঝুর।

শব্দ শুনতে শুনতে বেদনার্ত স্বরে আমি বলে উঠলাম, এই তুই কী যা তা বলছিস দুলু? আমার মহিকে তুই এত হেনস্তা করিস নে। সে শিল্পী বটে তবে অমানুষ নয়।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই মুহূর্তে আবার ভোল পাল্টে গেল দুলুর।

চেঁচিয়ে উঠে সে বলল, অমানুষ নয়? কী ঘটেছে তা তুই নিজেও কি নিজের ভেতর অনুভব করতে পারছিস নে? না পারলে, আজ দু’মাস এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছিস কেন? তোর ভালোবাসার সেই শিল্পী, সেই পল গঁগ্যা, মাই ফুট, সেই পটুয়া বউ বাচ্চা নিয়ে হঠাৎ করে পাড়ি দিয়েছে ফ্রান্স। সেখানে সে তার সংসার গুছিয়ে আবার নতুন করে কাজে মন বসাবে বলে ছেড়ে গেছে দেশ।

এই তুই কী বলছিস দুলু?

আমার গলা চিরে প্রশ্নটা বেরোল খসখসে হয়ে।

মহিউদ্দিনের রেখে যাওয়া আনসারিং সার্ভিসের মতো গলার স্বর আমার হয়ে উঠছে, আমি তা বুঝতে পারছি নে। আমার ভেতরটা যে ক্রমশ শূন্য হয়ে উঠছে আমি তাও বুঝতে পারছি। আমার যুদ্ধ করার শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে সেটাও বুঝতে পারছি।

আর যত বুঝতে পারছি ততই আমার চারপাশে শুধু শূন্যেরা লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে।

দুলুর কানে হয়তো আমার গলার স্বর পৌঁছল না। হয়তো সে আপন মনে জানালার বাইরে চোখ ফেলে পেয়ারা গাছের পাতা দেখতে শুরু করেছে। সে পাতাগুলো হয়তো এখনো কচি ও সবুজ। এখনো হয়তো সময়ের চাপে, বয়সের চাপে, ঝড়-বৃষ্টি-রোদ মোকাবেলা করতে করতে রুক্ষ ও খসখসে হয়ে ওঠে নি।

দুলু এবার আপন মনে বলতে লাগল, বিদেশে গিয়ে আরো অনেক ভালো ছবি আঁকবে সে। আরো অনেক সমুদ্রের ছবি আঁকবে, বেলাভূমির ছবি আঁকবে, আরো অনেক বেলাভূমিতে নুড়ি কুড়িয়ে তোলা মেয়েদের আঁকবে। তার ক্যানভাসে জড়ো হবে আরো অনেক সবুজ ও হলুদ, নীল ও লাল। আরো অনেক ন্যুড আঁকবে সে, সে সব ন্যুড তুই না, অন্য মেয়েদের, অন্যসব নতুন মুখের মেয়েদের, নতুন সব শরীরের মেয়েদের। তাদের শরীরের বাঁকে বাঁকে চোখ ফেলে একমনে তুলি টেনে যাবে তোর গঁগ্যা তার ক্যানভাসে। আঁকা শেষ হলে তাদের অনেককেই সে নিয়ে যাবে তার স্টুডিওর কোণে ডিভানে, প্রবিষ্ট হবে সে তাদের ভেতরে, প্রেম হবে, শীৎকারও হবে; অনেক ন্যুড তোর মতো তাকে ভালোও বাসবে, কিন্তু শিল্পীর কাজ যেই শেষ হবে, ফিরে যাবে তার ডেঁরায়। যার নাম সংসার, যেখানে আছে তার পথ চেয়ে থাকা স্ত্রী, নয়নমণি পুত্র সন্তান। সে সংসারে সে তার স্ত্রীর ফেলে রাখা কাপড় মেঝে থেকে যত্ন করে তুলে গুছিয়ে রাখবে আলমারিতে, যেমন সে স্টুডিওতে গুছিয়ে রেখে আসে তার তুলি। তারপর চুম্বন করবে ছেলের মুখ।

কথা বলতে বলতে থেমে গেল এবার দুলু। আমার যেন মনে হলো, দুলু এখন ভাবছে। ভাবতে ভাবতে যেন অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে দেখছে বিছানায় লেপ্টে পড়ে থাকা আমার কালো ও ক্ষীণ শরীর বর্তমানে লাবণ্যহীন, অথচ যা মাত্র কিছুদিন আগেই ছিল যে কোনো পুরুষের চোখে লোভনীয়।

দুলু এবার বলল, ইতি, তোকে একটা কথা বলি, কিছু মনে করিস নে, আর এ কথাটা বলতেই আমি জাহাঙ্গীরনগর থেকে ছুটে এসেছি ভার্সিটির শেষ ক্লাসটা না করেই। শোন, শিল্পীদের এমনিতে দেখতে লাগে বোহেমিয়ান, যেন সব কাছাখোলা ভাব, কিন্তু মনের গভীরে ওরা বড় হিসেবি, বড় চুল-চেরা হিসেব। ওদের ব্যক্তিগত জীবনের শেষ গন্তব্য সব সময়ই হলোÑ বাড়ি। সে বাড়ি যদি আঁস্তাকুড় হয়, তবু। প্যারির পল গঁগ্যা যতই তাহিতি দ্বীপে যান না কেন, সিফিলিস জর্জরিত হয়ে, বেওয়ারিস সন্তানের জন্ম দিয়ে যত জীবন নিয়ে বাজি খেলুন না কেন, মৃত্যুর আগে ঠিকই ফিরে এসেছিলেন বাড়ি, যে বাড়ির নাম দিয়েছিলেন সখ করে, হাউজ অব প্লেজার। তুই কি এত ভ্যাবলা যে, এসব খবর রাখিস নে? তুই কি জানিস নে গঁগ্যা নিজে এতবড় একজন শিল্পী হয়েও নিজের ছেলেকে বলেছিলেন, শিল্পী না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে, কারণ তাতে পয়সা বেশি।

না, আমি এসব কথা জানি নে। দুলু সত্যি কথা বলছে কিনা তাও জানি নে। এখন আমার ভেতরের শূন্যতা জুড়ে কতগুলো প্রশ্ন জোরেসোরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রশ্নগুলো দুলুকে করতে আমি সাহস পাচ্ছি নে, তাই নিজের মনের ভেতরে রেখেই করছি। এক নম্বর হলো, অমানুষ একজন শিল্পীর হাতের ভেতর দিয়ে এত আলো ঝলমল শিল্পের সৃষ্টি হয় কী করে? দু’নম্বর, অমানুষ এক শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের আসল গন্তব্য কি শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ি? নাকি তার গন্তব্য হলো একজন মানুষ?

বর্ষ ৬ সংখ্যা ২২, ঈদসংখ্যা ২০০১

Leave a Reply

Your identity will not be published.