এই সময়ে আবালবৃদ্ধবনিতা, বিশেষত শিশু-কিশোরদের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ভিডিও গেম। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির খেলায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাও মেতে আছে। মূলত মা-বাবার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত ছেলেমেয়েরাই এতে বেশি মগ্ন থাকে। ফলে বিনোদনের এই মাধ্যমটি একসময় তাদের কাছে হয়ে পড়ে ‘ডিজিটাল মাদক’-এর মতো। তারা পড়ালেখা, নাওয়া-খাওয়া ভুলে ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। ইনসমনিয়াতে আক্রান্ত হয়। পরিণত হয় মনোরোগীতে। এই রোগটির নাম গেমিং ডিসঅর্ডার বা ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডার। এর লক্ষণ হলো, বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বাবা-মায়ের থেকে দূরত্ব, দীর্ঘ সময় ধরে ভিডিও গেম খেলা ইত্যাদি। এ থেকে নানা সমস্যা দেখা দেয়। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, শিশু-কিশোরেরা হিংস্র হয়ে ওঠে, অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং এমনকি মানুষও খুন করে ফেলে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের মাঝে এমন প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে। এ থেকে তাদের মুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এমনই পরিস্থিতিতে অন্যদিন-এর বিশেষ রচনা গড়ে উঠেছে ভিডিও গেম আসক্তিকে ঘিরে। গ্রন্থনা : রওশন মোমেন।
শুরুতে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের মর্মান্তিক একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ের সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া রাহাত ইসলামকে তার চার-সহপাঠী বন্ধু হত্যা করেছে। দুই মাস আগে স্কুলে বসা নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে রাহাতের ঝগড়া হয়েছিল। সেটি মীমাংসাও হয়ে গিয়েছিল। তারপরও সেই ঘটনার জেরে রাহাতকে গত ৩০ এপ্রিল টিফিন ছুটির পর সহপাঠী চার বন্ধু নদীর তীরে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে মেরে নদীতে ফেলে দেয়। উল্লেখ্য, রাহাত ছিল একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার। তার মাঝে আলো ছিল। অন্যদিকে তার খুনি চার কিশোররা ভেতরে বহন করছে অন্ধকার। আর শুধু চট্টগ্রামের এই চারজন কিশোর নয়, দুই শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে চট্টগ্রামে—যাদের মাঝে এমনই অন্ধকার, হিংস্র প্রকৃতি। ঢাকাসহ দেশের অন্য জেলাও এর বাইরে নয়।
কিশোরদের মাঝে এই অন্ধকার তথা হিংস্র প্রবৃত্তির জন্য নানা কারণ দায়ী। যেমন, তাদের নিষ্পাপ শৈশব চুরি হয়ে যাওয়া, সুকুমার বৃত্তিগুলো হত্যা করা, সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ হওয়া, বাবা-মার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ভিডিও গেম আসক্তি
ভিডিও গেমস এবং বাংলাদেশ
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ভিডিও গেমসের আবিষ্কার হয় ১৯৪০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর সত্তর-আশির দশকের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তায় পৌঁছে। সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত আর্কেড টাইপের ভিডিও গেম-এর নাম ছিল কম্পিউটার স্পেস। এরপর আটারি কোম্পানি বাজারে আনে বিখ্যাত গেম পং। তারপর ধীরে ধীরে আটারি, কোলেকো, নিনটেনডো, সেগা ও সনির মতো ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো নানা উদ্ভাবন ও প্রচারণা চালিয়ে কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয় পুঁজিবাদী সভ্যতার এ বিনোদনপণ্য।
তারপর সময় বদলেছে। কম্পিউটার এবং ভিডিও গেমস ক্রমে হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প ইন্ডাস্ট্রি। বিশ্বজুড়ে আজ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভিডিও গেম এবং গেমাররা।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ভিডিও গেম খেলে থাকে। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে অল্প বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। এদের বদৌলতে গ্লোবাল ভিডিও গেম বাজারের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৮.৯০ মিলিয়ন ডলার! এর মধ্যে ‘মোবাইল গেমিং’ই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি অর্থ আয় করা সেক্টর। স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে গেমিং প্রতি বছর ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের অনেক পরিবারের বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ত। এদিকে সন্তান বড় হচ্ছে প্রায় একা একা। অনেক অপরিণামদর্শী মায়েরাই শিশুকে খাবার খাওয়াতে, তার কান্না থামাতে—টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও ভিডিও গেমসের অভ্যাস করাচ্ছেন।
অন্যদিকে শহরের ইট, পাথর আর কংক্রিটের আড়ালে আটকা পড়ছে শিশুদের বর্ণিল শৈশব। গ্রামের শিশুরা খেলাধুলার কিছুটা সুযোগ পেলেও শহরের শিশুদের সেই সুযোগ কম। বড়দের মতো শিশুদের মধ্যেও ভর করছে শহুরে যান্ত্রিকতা। ফলে তারা খেলাধুলার আনন্দ খুঁজে ফিরছে মাউসের বাটন টিপে, কম্পিউটারের পর্দায় গেমস খেলে, কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। অনেক সময় তাদের এ আকর্ষণটা চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। ধীরে ধীরে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কম্পিউটার-মোবাইল-ট্যাব গেমসের ওপর। এজন্য প্রথমেই বলা যায়, ভিডিও গেমস আমাদের শিশু-কিশোরদের প্রকৃত শৈশব-কৈশোর কেড়ে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইদানীং কমবয়সী অর্থাৎ ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ইন্টারনেটে ডুবে থাকার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। ফলে তাদের মধ্যে ভিডিও গেম আসক্তিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দুটি ভয়ংকর ভিডিও গেম
দুটি ভয়ংকর ভিডিও গেম হচ্ছে, ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি।
ফ্রি ফায়ার
ফ্রি ফায়ার গেম হচ্ছে একটি ব্যাটেল রয়েল যুদ্ধ গেম, যা বর্তমানে পুরো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে। বলা যায় বর্তমানে বাংলাদেশ ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় মোবাইল ভিডিও গেম ফ্রি ফায়ার, যেটাকে ফ্রি ফায়ার ব্যাটল গ্রাউন্ডস বা ফ্রি ফায়ার নামেও অভিহিত করা হয়।
আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে সর্বপ্রথম প্রি ফায়ার গেমটি মোস্ট ডাউনলোডেড গেম ইন দা ওয়ার্ল্ড হিসেবে গুগল প্লে স্টোরে পরিচিতি পায়। পরবর্তী সময়ে, ২০২০ সালে, অর্থাৎ এক বছর পরে এই গেমটির ইউজারের সংখ্যা ১০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়, যে কারণে বেশ বড় খেতাব অর্জন করে ফ্রি ফায়ার অনলাইন ভিডিও এই গেমটি।
আর ফ্রি ফায়ার বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের প্রত্যেকটি দেশে ছোট-বড় সকলেরই সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন ভিডিও গেম হিসেবে জায়গা করে নিতে পেরেছে। আর এর অন্যতম কারণ এটা অনেক বেশি অ্যাডভান্স লেভেলের গেম, পাশাপাশি ইউজাররা এই গেমটি খেলতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে এবং নতুন নতুন ভার্সন আসার কারণে এই খেলার প্রতি অধিক বেশি আগ্রহ বৃদ্ধি পায় বা পেয়েছে।
পাবজি
এটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইলন গেম। বর্তমানে উপমহাদেশে কয়েকগুণ বেড়েছে এই গেমের জনপ্রিয়তা।
মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার দুটোতেই খেলা যায় এই গেম। তবে উপমহাদেশে পাবজির কম্পিউটার ভার্সনের থেকে মোবাইল ভার্সনটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে এখন প্রতি মাসে প্রায় ২২৭ মিলিয়ন মানুষ এ গেম খেলে। আর প্রতিদিন খেলে প্রায় ৮৭ মিলিয়ন মানুষ। লাখো গরিবের দেশ বাংলাদেশেও প্রতিদিন এ গেম খেলছেন ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ!
অনলাইনভিত্তিক এই ভিডিও গেমটিতে একসাথে ১০০জন মানুষ একটি পরিত্যক্ত দ্বীপে থাকে। খেলোয়াড়কে প্রথমে প্যারাসুটের মাধ্যমে সেখানে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে একে অপরকে হত্যা করে টিকে থাকতে হয়। ভয়ংকর সব গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে খতম করতে হয় একে একে সবাইকে। এক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতারও আশ্রয় নেয়া হয়। চলে হত্যার ষড়যন্ত্র-পরিকল্পনা।
অনলাইনে বন্ধুরা পরস্পরে কথাবার্তা বলে এ হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে শলা-পরামর্শ করে। কয় পয়েন্ট পাওয়া গেল, কতজন নিহত হলো, বাকিদের কীভাবে হত্যা করা যায়—এসবই এ ভয়ংকর গেমের বিষয়। হত্যাযজ্ঞ শেষে যে ব্যক্তি বা যে গ্রুপ বেঁচে থাকে, তারাই হয় বিজয়ী।
অন্যান্য ব্যাটেল রয়্যাল গেমের মতোই পাবজিও অনেক বেশি হিংস্র গেম। এবং এর ভয়াবহতা এতই বেশি যে শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে এক প্রকার ক্ষিপ্রতা সৃষ্টি করে এই গেম। অত্যধিক মাত্রায় হিংস্রতা থাকায় ১৩ বছরের কম বয়সীদের জন্য এই গেমটি নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত হিংস্রতা শিশু-কিশোরদের মধ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এবং পরবর্তী জীবনে শিশুদের হিংস্র করে তুলতে পারে এই গেম।
অতিরিক্ত হিংস্রতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিমধ্যে পাবজি গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এই গেমটি নিষিদ্ধ করা হয় ভারতে।
ভারতের পর এই গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় নেপালে। অতিরিক্ত হিংস্রতার কারণে দেখিয়ে নেপালে এই গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে গেমটি নিষিদ্ধ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর নেপালের সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন। এবং পরবর্তী সময়ে এই গেমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এছাড়াও ইরাক, জর্ডানেও এই গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে হিংস্রতাকেই। সেই সাথে সাথে টেকনোলজির দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশের থেকে এগিয়ে থাকা চায়নাতেও এই গেমটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশে গেমটি নিষিদ্ধ করা হলেও পরবর্তী সময়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেম নিষিদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশে
সম্প্রতি দুই মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি গেম আবার নিষিদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশে। এরইমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি নিয়ে সুপারিশ করা হয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনাও হয়। এতে গেম দুটি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়।
জানা গেছে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া এড়াতে হঠাৎ বন্ধ না করে বিকল্প পদ্ধতিতে ধীরে ধীরে গেম দুটি বন্ধ করা হবে। যারা এ গেমে আসক্ত তারা ভিপিএনসহ বিকল্প উপায়ে খেলতে পারবেন গেম দুটি। সেগুলোও বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। গেম দুটি খেলার ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তরুণ প্রজন্মের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার ও পাবজি।
গেম দুটির অপব্যবহারের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম ‘কিশোর গ্যাং’ গঠন করছে। চরমভাবে বিপথগামী হয়ে উঠেছে তারা। করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাস করতে অভিভাবকরা সন্তানদের হাতে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সুযোগের অপব্যবহার ঘটছে। এ জন্য গেম দুটি নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
বিশ্বব্যাপী গেমসের প্রতি তীব্র নেশা যে পাবজি গেম থেকে শুরু হয়েছে তা নয়। ইতিপূর্বে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান, মনস্টার হান্টার ওয়ার্ল্ড, ডটা টু, ভাইস সিটি এবং হাঙ্গারগেমসহ নাম না জানা অসংখ্য গেমে মানুষের ভীষণ আসক্তি ছিল।
ডিজিটাল মাদক
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, নেশা মানেই শুধু মদ বা মাদক নয়। নেশা বা মাদকাসক্তি কেবল মদ-গাঁজা, আফিম-হেরোইন ও বিড়ি-সিগারেটের সেকেলে পরিসরে আবদ্ধ নেই। কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির কল্যাণে এবং পুঁজিবাদী সভ্যতার বদান্যতায় নেশার পতিত অঙ্গনেও লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া! ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ধ্বংসাত্মক ভিডিও গেমসে বুঁদ হয়ে থাকার ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ এমন নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে, যা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন।
ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ঘটিত এ আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল মাদক’!
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, জার্মানি এবং চীনে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আলাদা চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে এধরনের আসক্তদের মানসিক রোগীর মতোই চিকিৎসা দেওয়া হয়। থেরাপিসহ বিভিন্ন চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করা হয়। এধরনের আসক্ত মানুষের সংখ্যা সব দেশেই বেড়ে চলেছে।
ভিডিও গেমে আসক্তি এবং একটি চলচ্চিত্র
এবার একটি চলচ্চিত্রের কথা বলি। চলচ্চিত্রটির নাম ‘হাবজি গাবজি’। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। বাংলা এই চলচ্চিত্রের কাহিনিধারায় দেখা যায়—আদিত্য ও অহনার একমাত্র সন্তান টিপু। বাবা-মা ভীষণ ব্যস্ত। টিপু গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে থাকে। একাকিত্বে ভোগে। খেলনা নিয়ে মগ্ন থাকে। পথের মানুষজন দেখে। টিপু একটু বড় হওয়ার পর বাবার সঙ্গে ফ্ল্যাটেই ব্যাট-বল নিয়ে ক্রিকেট খেলে। তবে অফিস-ফেরত বাবা আদিত্য একসময় ক্লান্ত বোধ করেন। তিনি নিজের মোবাইল ফোন বের করে ছেলেকে শিখিয়ে দেন, কীভাবে মোবাইলে একা একা ক্রিকেট খেলা যায়। এরপর টিপুর জন্মদিনে আদিত্য তাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেন। অতঃপর টিপু মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। বন্ধুদের সঙ্গে রাত জেগে অনলাইনে মোবাইলে গেম খেলে ( অবশ্য টিপুর বাবা আদিত্যও একসময় রাত জেগে খেলতেন)। ফলে টিপু স্কুলে ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখে সমস্যা দেখা দেয়। চক্ষু বিশেষজ্ঞ জানান, এভাবে টিপু গেমে আসক্ত হয়ে পড়লে চোখের পাওয়ার আরও কমবে; কমবে স্মৃতিশক্তিও। শুনে ছেলেকে নিয়ে ফেরার সময় অহনা পথের মাঝে মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টিপুও। ফলে এক পথচারীর সঙ্গে থাক্কা লাগে তার।...একদিন আদিত্য বাসায় ফিরে দেখে ছেলে যথারীতি মোবাইলে মগ্ন। তিনি ছেলের হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে পড়তে বলেন। অহনাও সায় জানায়। তারা ঘর থেকে বের হওয়ার পর শব্দ শুনে ছেলের ঘরে এসে দেখে, একটি লাঠি হাতে নিয়ে টিপু তা কপালে ঠুকছে। রক্ত বের হচ্ছে। অগত্যা টিপুর হাতে মোবাইল তুলে দেন আদিত্য।...রাতে টিপু গেমে শত্রুকে গুলি করে মারা দৃশ্য দেখে। স্বপ্নের মাঝে তাই সে দেখে, বন্ধুতের নিয়ে শত্রুদের গুলি করে মারছে।...ছেলের পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, খোঁজখবর করতে গিয়ে অহনা আবিষ্কার করে, ছেলের হাতের লেখার পরিবর্তন ঘটেছে। বাঁকা হয়ে যাচ্ছে লাইনগুলো। পরদিন স্কুলে গেলে প্রিন্সিপাল জানান, টিপু তিনটি সাবজেক্টে ফেল করেছে। সে বাবা-মা মায়ের সিগনেচার নকল করে প্রোগ্রেস রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এবার আদিত্য-অহনা সাইক্রিয়াটিস্টের দ্বারস্থ হয়। তারা জানান যে, পড়াশোনার ব্যাপারে টিপুকে চাপ দেওয়া যাবে না। মোবাইল আসক্তি থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত করতে হবে তাকে।...অহনা চেষ্টা করে পড়াশোনায় ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য। এজন্য টিপুর মোবাইলে হাত পড়ে তার। কিন্তু টিপু খেপে যায়। টিভি ভেঙে ফেলে। বিষয়টি ফোনে আদিত্যকে জানালে তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু টিপু জানায়, মা মিথ্যে বলেছে। রাতে বাসায় ফিরে আদিত্য ছেলের মোবাইল কেড়ে নিলে সে বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গালিগালাজ করে। অহনা দুজনকেই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।...সাইক্রিয়াটিস্টের পড়ামর্শে আদিত্য ও অহনা কলকাতার বাইরে একটি পাহাড়ি জায়গায় বেড়াতে যায়, ওঠে এমন এক রিসোর্টে যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই। দেখেশুনে টিপুর মেজাজ বিগড়ে যায়। সে বাড়ি ফিরতে চায়।...বাইরে খেতে যাওয়ার সময় পথের মাঝে দেখা হয় এক সেলসম্যানের সঙ্গে। সে টিপুকে জানায়, অদূরে একটি ছোট বাজার আছে। সেখানে রেস্টুরেন্টের কাছে একটি উঁচু জায়গায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। আর সেখানকার মমোও সুস্বাদু। টিপু এবার বাবা-মাকে বলে, সে মমো খাবে। অহনা ও আদিত্য গাড়িতে চড়ে ছেলেকে নিয়ে মমো খেতে বাজারের সেই রেস্টুরেন্টে আসে। ফ্রেশরুমে যাওয়ার কথা বলে সেখান থেকে টিপু সেই পাহাড়ি এলাকার উঁচু জায়গায় অন্যদের সঙ্গে বসে মোবাইলে গেম খেলায় মগ্ন হয়ে পড়ে। খুঁজতে এসে সেখানে ছেলেকে দেখতে পায় অহনা-আদিত্য। আদিত্য রেগেমেগে টিপুর মোবাইল কেড়ে নেয়। টিপু বলে, সে অনেকদূর চলে যাবে। আর ফিরবে না। আদিত্য পাত্তা দেয় না। কিন্তু টিপু সত্যি চলে যায়। অহনার মোবাইল কলে বিষয়টি শুনে কিছুক্ষণ পরে স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেয় আদিত্য। একজন স্থানীয় লোক পথ নির্দেশ করলে পাহাড়ি উঁচু পথে এগোতে থাকে স্বামী-স্ত্রী। কিছুক্ষণ পরে বনের মতো একটি জায়গায় টিপুর মাফলার খুঁজে পায় আদিত্য। পরে ফোঁপানির শব্দ শুনে ইট-সিমেন্টের একটি কাঠামোর মাঝে বসে থাকতে দেখে টিপুকে। সে তখন শীতে কাঁপছে। রিসোর্টে ফিরে আসে ওরা। এক পর্যায়ে টিপু শত্রু মনে করে রিসোর্টের রিশেপসনের দেয়ালে ঝোলানো বন্দুক দিয়ে ম্যানেজার ও তার স্ত্রীকে গুলি করে মেরে ফেলে। সে এবার কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে। পুলিশের ভয়ে কাতর হয়। অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে তড়িঘড়ি কলকাতায় ফিরে আসে আদিত্য ও অহনা। হাসপাতালে টিপুকে ভর্তি করে।...অহনার মোবাইলে অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। সে মোবাইল বন্ধ করে রাখে। একসময় ডিবির দুজন লোক আসে। আদিত্যকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে স্বামীকে দেখতে এসে অহনাও জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হয়। তাদের দুজনের কথাবার্তায় অসঙ্গতি খুঁজে পায় ডিবির লোকেরা। আদিত্য বলে, সে খুন করেছে রিসোর্টের ম্যানেজার ও তার স্ত্রীকে। ডিবির লোকেরা বিশ্বাস করে না। টিপু কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তারা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং প্রকৃত ঘটনা জানতে পারে।
‘হাবজি গাবজি’ সিনেমার গল্পটি তো শুনলেন। তো এবার বুঝতে পারছেন তো মোবাইল গেম কী ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে শিশু-কিশোরদের জীবনে ? কী কুফল রয়েছে এই ভয়ংকর নেশায় ? যেমন, শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর এই মোবাইল এবং ভিডিও গেমে আসক্তি। চলচ্চিত্রে যেমন দেখা যায়, টিপুর দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। অল্প বয়সেই চশমা নিতে হয়। রাত জেগে গেমস খেলার ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্লাসেই ঘুমিয়ে পড়ে। পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে। হাতের লেখায় পরিবর্তন দেখা যায়। ভার্চুয়াল ও বাস্তব জগতের সীমারেখা মুছে যায়। গেমে মারামারি ও ধ্বংসাত্মক বিষয়আশয় দেখার ফলে ওর আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। সে উগ্র স্বভাবের হয়ে ওঠে। সহিংস আচরণ করে। কাছের দূরের সব মানুষকেই শত্রু মনে করে। ওর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মোবাইলে গেম খেলা। সে নাওয়াখাওয়া, পড়ালেখা ভুলে গেম নিয়ে মেতে থাকে। গেমসের বিষয়গুলোই তার মাথায় ঘুরপাক খায়। সমাজের অন্য বিষয়গুলো থেকে সে দূরে চলে যায়। এভাবে গেমসে আসক্তি টিপুকে অসামাজিক করে তোলে।
ভিডিও গেমসের ক্ষতিকর দিকগুলো এবার বিষদভাবে উল্লেখ করা যাক—
চক্ষু সমস্যা
আজকাল ছোটদের অনেকের চোখেই পাওয়ারি চশমা ঝুলতে দেখা যায়। চশমা ছাড়া শিশুরা চোখে ঝাপসা দেখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর কারণ হলো ডিজিটাল মাদকাসক্তি। দিনরাতের একটা দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্ষীণ দৃষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। চিকিৎসকদের ভাষায় এ রোগের নাম ‘মায়োপিয়া’। ২-৩ বছরের শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
জানা গেছে ঢাকার একটি চক্ষু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জন রোগী দেখা হয়। এর মধ্যে ক্ষীণ দৃষ্টি বা মায়োপিয়ার আক্রান্ত শিশু আসে গড়ে ৫০জন।
বাংলাদেশ আই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশু মায়োপিয়া সমস্যায় ভুগছে। তাদের এখনই রোধ করা না গেলে ৫ বছরের নিচে শিশুদের দূরদৃষ্টিজনিত সমস্যা বেড়ে যাবে এবং তা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে উন্নীত হবে। যা গোটা জাতির জন্য এক ভয়াবহ বার্তা বহন করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা।
মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন
যেসব কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোন বা ইন্টারনেটে বেশি সময় কাটায়, তাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার রেডিওলজি’র অধ্যাপক ইয়ুং সুক-এর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছেন।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫০০ জনের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে যে, যেসব শিশু দিনে সাত ঘণ্টারও বেশি সময় স্মার্টফোন, ট্যাবলেট ও ভিডিও গেমস খেলে, তাদের মস্তিষ্কের শ্বেত পদার্থের বহিরাবরণ পাতলা হয়ে যায়।
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত নিউরোসার্জন বলেন, বিরতিহীনভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিশুদের চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে চাপ পড়ে। ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
নিদ্রাহীনতা
রাতে ঘুমানোর সময় একটা ডিভাইস হাতে নিয়ে শুতে গিয়ে অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে ঘুমায়। এ অভ্যাস আস্তে আস্তে ঘুম না আসার কারণে পরিণত হচ্ছে। এখন তো রাতের ঢাকার চিত্রই বদলে গেছে। অসংখ্য পরিবারে গভীর রাত অবধি জেগে থেকে সকাল দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকাটা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এ আসক্তির কারণে ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো ঘুম, খাওয়া-দাওয়া করতে চাইছে না।
শারীরিক স্থূলতা
শারীরিক পরিশ্রম ছাড়া দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে বড়দের মতো মুটিয়ে যাচ্ছে শিশুরাও। অল্প বয়সে তারা হাঁটু ও কোমর ব্যথায় আক্রান্ত হচ্ছে। শারীরিক অনুশীলন ও খেলাধুলার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক শরীর গঠন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের।
সড়ক দুর্ঘটনা
প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হলো মোবাইল ব্যবহার। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও অনেকে তা দিব্যি করে চলেছেন। দেখা যাচ্ছে, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন যারা বেশি ব্যবহার করছে, তাদের ছয় ভাগের বেশির দুর্ঘটনা হচ্ছে।
শারীরিক ঝুঁকি
এছাড়াও চিকিৎসকদের মতে, মোবাইল ফোন পকেটে রাখলে ভ্রুণের কোয়ালিটি কমে যাওয়া, বুক পকেটে রাখলে হার্টের সমস্যা দেখা দেওয়া, আঙুলে ও ঘাড়ে ব্যথা, কানে কম শোনা এবং ডিসপ্লে থেকে জীবাণু ব্যাকটরিয়ার সংক্রমণসহ অসংখ্য শারীরিক ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্নতা
এ প্রজন্মের শিশু-কিশোরেরা আগের মতো বাইরে খেলাধুলা করে না। গল্পের বই পড়ে না। এমনকি কারও সঙ্গে মন খুলে কথাবার্তাও তেমন বলে না। এ বিষয়টি ক্রমেই বাড়ছে। সারা দিন দরজা বন্ধ করে কম্পিউটার ও স্মার্টফোন নিয়ে পড়ে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই নিজের একটা জগৎ তৈরি করে নেয়। ফলে মা-বাবা আত্মীয়স্বজন থেকে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে এবং ভীষণ একাকিত্বের শিকার হয়ে পড়ছে তারা। দেখা যায়, সবার মাঝে থেকেও সে একা। তার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সবই হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রকেন্দ্রিক।
কল্পনার জগতে বাস এবং আত্মকেন্দ্রিকতা
এ ধরনের ছেলেমেয়েরা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডিজিটাল এক কল্পজগতে বাস করতে শুরু করে। বদলে যায় তাদের মানসিক গঠন। তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যেও যান্ত্রিকতার একটা ছাপ দেখা যায়। কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের মাঝেই তারা জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা ও সমস্যার সমাধান খুঁজে বেড়ায়। ফলে তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ হয় না। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ ও সহমর্মিতার অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে তাদের দুর্বল হতে থাকে। নিজেকে ছাড়া কারও প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ জাগে না। নিজের অজান্তেই স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় আক্রান্ত হয় তারা।
মারমুখী প্রবণতা এবং অপরাধ
অনুকরণপ্রিয় স্বভাবের কারণে ছোটরা যা-ই দেখে, তা-ই অনুকরণ করতে পছন্দ করে। দেখা যায়, গেমের সুপারম্যান চরিত্র দেখে সে ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করে। কারও ওপর রাগ হলে হাতকেই বন্দুক বানিয়ে গুলি করা শুরু করে। সারা দিন বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক খেলা খেলতে খেলতে তাদের আচরণও ক্রমশ আক্রমণাত্মক ও মারমুখী হয়ে ওঠে। দিনের একটা বড় সময় এইসব খেলায় কাটানোর ফলে তাদের কাছে ওই জগতটাই বাস্তব বলে মনে হয়। সাম্প্রতিককালে ব্লু হোয়েলসহ বিভিন্ন গেম খেলে বহু কম বয়সী শিশু-কিশোরের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। ভিডিও গেমসে বিদ্যমান রক্তাক্ত হামলা, সহিংসতা, চুরি, যৌনতা ও প্রতারণা শিশুদের অন্যায় ও অপরাধকর্মে মারাত্মকভাবে উৎসাহিত করছে।
পড়াশোনায় নেতিবাচক প্রভাব
ভিডিও গেমসের মধ্যে শিশুরা এতই সময় ব্যয় করছে যে, তাদের পড়াশুনা, খাওয়া-দাওয়া সবই শিকেয় উঠেছে। বর্তমানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর পড়াশুনায় ধ্বস নেমেছে পাবজি খেলায় আসক্তির কারণে। শিক্ষক-অভিভাবকেরা এ নিয়ে এখন পেরেশান।
অস্থিরতা, অবিশ্বাস, ধৈর্যহীনতা এবং পরাজয়কে না মানার প্রবণতা
ভিডিও গেমসের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে রঙ-বেরঙের দৃশ্যপট পরিবর্তন, সারাক্ষণ অবিশ্বাস্য গতিতে ছোটাছুটি, জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে থাকা—এসব শিশুদের মানসিকতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। দেখা যাচ্ছে, কোনো কিছুতেই তাদের স্থিরতা থাকছে না। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা তাড়াহুড়ো করছে। অযথা সন্দেহ-অবিশ্বাস তাদের মধ্যে জেঁকে বসছে। অল্পতেই তারা ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছে। বাস্তব জীবনেও নিজের পরাজয়কে তারা মেনে নিতে পারছে না। আর এসব প্রবণতা শিশুদের ক্রমেই নেতিবাচক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
খেলাধুলা এবং সংস্কৃতিচর্চায় অনীহা
অনলাইন গেমের আসক্তি বাড়ায় শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার মানসিকতাও কমে যাচ্ছে, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চাও হচ্ছে না তাদের।
সন্তানকে আসক্তি থেকে মুক্ত করার জন্য করণীয়
আপনার শিশুকে ভিডিও গেমসের ভয়াবহ থাবা থেকে মুক্ত করার জন্য কী পদ্ধতি অবলম্বন করবেন ? এ বিষয়ে কয়েকটি টিপস দেওয়া হলো। আশা করা যায় এগুলো অনুসরণ করলে আপনার সন্তান ভিডিও গেম আসক্তি থেকে মুক্ত হবে।
একা থাকার সময় কমিয়ে দিন
বাচ্চা যদি একা একা থাকে, তবে সে বেশি সময় ধরে গেমসের প্রতি মন দেবে। কিন্তু গেমস খেলার সময়ে যদি পরিবারের অন্যরাও তার আশেপাশে থাকে, তবে সে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না এবং একটু একটু করে খেলার প্রতি বিরক্তি এসে যাবে।
পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখুন
অনেক গেমস আছে যেখানে বাচ্চারা আপনার ফোন ব্যবহার করে গেমসের বিভিন্ন পয়েন্ট কিনতে পারে। এ কাজটি যেন তারা না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখুন। খেলার এসব পয়েন্ট কিনতে না পারলে গেমসের প্রতি বাচ্চার আকর্ষণ কমে আসবে।
সময় বেঁধে দিন
বাচ্চারা যখন একটা গেমস নিয়ে পড়ে আছে, তখন তাকে সময় বেঁধে দিন। কতক্ষণ সে গেমসটা খেলতে পারবে, এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিন। যেমন রাতের খাবারের আগে ১০ মিনিট খেলতে পারবে, এমন নিয়ম করে দিন। এতে তার আসক্তি কমে আসবে।
বেশি সমস্যা হলে কঠোর হন
মনে রাখবেন আপনি তার অভিভাবক এবং আপনার কথাই তার মেনে চলতে হবে। সুতরাং যদি দেখেন বাচ্চা গেমসে বেশি আসক্ত হয়ে গেছে এবং আপনার কোনো নিয়মই মানতে চাইছে না, তাহলে অবশ্যই ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করতে হবে।
অন্য কোনো দিকে তাদের মনোযোগ সরিয়ে নিন
বাচ্চাদের অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত রাখলে তারা আর গেমস নিয়ে ভাবার সময়ই পাবে না। সে গেমস খেলছে বিরক্তি দূর করার জন্য। আপনি যদি শুধুই তার থেকে ফোন নিয়ে নেন এবং তার করার মতো আর কিছু না থাকে তবে খুব একটা লাভ হবে না। তাদের কোনো একটি খেলা (ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, সাইকেল, সাঁতার, মার্শাল আর্টস) বা কোনো শিল্প (গান, নাচ, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা) শেখার ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিন।
উদাহরণ স্থাপন করুন
বাচ্চার বাবা-মা নিজেরাই যদি সারাক্ষণ ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তবে বাচ্চাও অবধারিতভাবে সেই অভ্যাস গ্রহণ করবে। সুতরাং বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে হলে মোবাইল ফোন বা স্মার্টফোন নামিয়ে রাখুন।
নিজের আচরণ ঠিক করুন
আপনি নিজেই কি দায়ী বাচ্চার এই আসক্তির জন্য ? ভেবে দেখুন। অনেক অভিভাবক বাচ্চাকে সময় দিতে চান না। বাচ্চা যখন তাদের সাথে খেলতে চায়, তখন তারা বিরক্ত হয়ে বাচ্চার হাতে ফোন ধরিয়ে দেন। এই কাজটা করা থেকে বিরত থাকুন। বাচ্চাকে সময় দিন। এতে আপনার এবং বাচ্চার, উভয়েরই উপকার হবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.