দেশে দেশে নববর্ষ

দেশে দেশে নববর্ষ

আসন্ন বাংলা নববর্ষ ১৪২৮। বাংলা সনের মতো পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে নানা আয়োজনে নববর্ষ পালিত হয়।

নববর্ষের উৎসব ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় শুরু হয়। প্রায় সমসাময়িক কালে ব্যাবিলনে স্পিংকুইনক্স বা মার্চ মাসের মাঝামাঝি চান্দ্র মাসের প্রথম তারিখে আকিতু বা নববর্ষ উদযাপিত হতো। অ্যাসিরিয়ায় নববর্ষের তারিখ ছিল অটাম ইকুইনক্স অর্থাৎ মধ্য সেপ্টেম্বর। মিশর, ফিনিসিয়া ও পারস্যে অটাম ইকুইনক্স বা ২১ সেপ্টেম্বর নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হতো। প্রাচীন গ্রিসে এ উৎসব পালন করা হতো উইন্টার সোলাসটিস বা ২১ ডিসেম্বর। আর প্রাচীন রোমান রিপাবলিকান ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষের তারিখ ছিল ১ মার্চ।

মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্যালেন্ডারবর্ষ সাধারণত ৩৫৪ দিনে হয়ে থাকে। আর বছর শুরু হয় মহরম মাস থেকে। চৈনিক নববর্ষ শুরু হয় জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে। এশিয়ার অন্যান্য দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বিভিন্ন সময়ে তাদের নিজ নিজ নববর্ষ শুরু হয়। প্রাচীন বঙ্গের রাজা শশাঙ্কের শাসন কাল ছিল ৫৯০-৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ। এ সময় তিনি শকাব্দ অনুসরণে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন করেন। এ সময় তিনি চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসে নববর্ষ শুরু করেন এবং দিন ও মাসের নাম অপরিবর্তিত রাখেন।

তারিখ-ই-ইলাহি থেকে জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবর লক্ষ্য করেন যে, তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। অপরদিকে চান্দ্র বর্ষ অনুসারে প্রবর্তিত হিজরি সালের সঙ্গেও সেগুলো সামঞ্জস্যহীন। ফলে সঠিকরূপে দিন, তারিখ ও সময়ের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয়। বিশেষত চান্দ্র ও সৌর বর্ষের দ্বন্দ্বে খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তিনি একটি অভিন্ন, কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যার সাহায্যে তাঁর সাম্রাজ্যের সর্বত্র সঠিকভাবে দিন, মাস ও বছর গণনা করা যায়। এ লক্ষ্যে তিনি প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ ফতুল্লাহ সিরাজীকে এরূপ উপযোগী ক্যালেন্ডার প্রণয়নের জন্য নির্দেশ দেন। চান্দ্রমাসের হিসাবে ৩১ বছর সমান ৩০ সৌরবছর। এর কারণ চান্দ্র বছর হয় ৩৫৪ দিনে অথচ সৌরবছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। এ বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যে ফতুল্লাহ সিরাজী শকাব্দ যা পরবর্তীকালে শশাংক কর্তৃক গৃহীত বঙ্গাব্দ বা বাংলা সৌর ক্যালেন্ডার অধিকতর নির্ভরযোগ্য হিসেবে নির্বাচন করেন। ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এক ফরমান বলে হিজরি সালের পরিবর্তে সম্রাট আকবর তাঁর সমগ্র সাম্রাজ্যে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন করেন। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের রীতিও সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন। তিনি তাঁর রাজত্বকালে ১৪টি নতুন উৎসব উদ্যাপনের প্রচলন করেন। তার মধ্যে নওরোজ বা নববর্ষ উদ্যাপন অন্যতম। চৈত্র মাসের শেষ তারিখে খাজনা থেকে শুরু করে যত প্রকার ব্যক্তিগত বা সরকারি বকেয়া আছে তা পরিশোধ করার প্রথা প্রচলিত হয়। পরদিন নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের ডেকে মিষ্টিমুখ করাত। এ উপলক্ষে হালখাতা ও বৈশাখী মেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান এ উৎসবে যুক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে এ উৎসব পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের আনন্দময় অনুষঙ্গরূপে প্রচলিত হয়।

বাংলা দিনপঞ্জি

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ‘লিপ ইয়ার’ বা অধিবর্ষের প্রচলন থাকলেও বাংলা ক্যালেন্ডারে তা ছিল না। ফলে সময়ের কিছুটা তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এ জন্য বাংলা ক্যালেন্ডার সংশোধনের উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ ১৯৯৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি গৃহীত হয়।

গ্রেগোরিয়ান নববর্ষ

রোমান ক্যালেন্ডারে নতুন বছর শুরু হতো ১ মার্চ থেকে। ল্যাটিন ভাষায় সেপ্টেম্বরের অর্থ সাত, অক্টোবর আট, নভেম্বর নয় এবং ডিসেম্বর দশ। সেই সময় রোমান সরকারের নতুন অধিবেশন শুরু হতো জানুয়ারি মাস থেকে। জুলিয়াস সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালে এ ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি করেন। এতে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালে মার্ক অ্যান্টোনির কনসুল এক দফা পরিবর্তন করার পর খ্রিষ্টপূর্ব ৮ সালে এম্পরর অপাসটাস সিজার আরেক দফা পরিবর্তন করেন। সর্বশেষ পোপ ১৩তম গ্রেগোরি ১৫৮২ সালে এই ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন করে বর্তমান কাঠামোতে নিয়ে আসেন। এই পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় ১ জানুয়ারি। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনটি মধ্যযুগে ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

চীনা নববর্ষ

চীন দেশে ২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ‘ইউয়ান তান’ অর্থাৎ নববর্ষ শুরু হয়। চাঁদ দেখে সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা হয়। প্রথম চাঁদ দেখার দিন থেকে প্রতি চান্দ্র বছরের মাস শুরু হয়। পূর্ণিমার শুরুর দিন থেকে শুক্লপক্ষের পনেরো দিন উৎসব চলে নববর্ষ উপলক্ষে। চীনারা নববর্ষ পালন করে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করে নানা উপাসনা-উপাচারে, দ্বিতীয় দিন পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনা করে। ‘ওয়েইলু’ নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এ দিন। পক্ষব্যাপী আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের মধ্যে সপ্তম দিনটি পালিত হয় ‘শস্য দিবস’ নামে।

নওরোজ

ইরানের নববর্ষ উৎসব বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো পরবগুলোর মধ্যে একটি। এটির শুরু ইরানে হলেও এখন বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এই উৎসব উদ্যাপন করে। এটি বাসন্তী উৎসবও বটে। ইউনেস্কো নওরোজকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকায় তুলে নেয় ২০ বা ২১ মার্চ, রাত আর দিন যখন সমান হয়, তখন নওরোজ উদ্যাপিত হয়। নওরোজের মানে নতুন ঘাস, প্রকৃতিতে নতুন পল্লবের ছোঁয়া।

সংক্রান

প্রতিবছর ১৩ এপ্রিল থাইল্যান্ডে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়। তবে ১৪ ও ১৫ তারিখেও ছুটি থাকে। পানি ছিটিয়ে একে-অপরকে ভিজিয়ে দেওয়া এই উৎসবের একটি অংশ। অনেক থাই নাগরিক এই ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বয়স্কদের সঙ্গে দেখা করেন।

রাঙ্গলি বিহু

আসামের নববর্ষ উৎসব এটি। ১৪ কিংবা ১৫ এপ্রিল এটি উদ্যাপিত হয়। রাঙ্গলি বিহুর একটি অংশ ‘গরু বিহু’। গরু যেহেতু কৃষকের জীবিকা আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই এই সময় গরুকে গোসল করিয়ে তার পূজা করা হয়। এছাড়া সেসময় রঙের খেলা আর নাচ-গানেরও আয়োজন থাকে।

বৈশাখী

শিখ ধর্মের অনুসারীরা প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উদ্যাপন করে। এটি একটি ফসল তোলারও উৎসব। এদিন সকালে ভক্তরা ফুল নিয়ে গুরুদুয়ারায় হাজির হন। সেখানে গান-বাজনার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

আলুথ অভুরুদ্দ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের মতো শ্রীলংকাতেও ১৩ কিংবা ১৪ এপ্রিল নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। গরুর গাড়ির দৌড় এই উৎসবের একটি অংশ।

থিনজান

মিয়ানমারের নববর্ষ উৎসব এপ্রিলের মাঝামাঝি পালিত হয়। পানি নিয়ে খেলা এই উৎসবের একটি বড় অংশ। চার-পাঁচদিন ধরে চলা এই উৎসবে তরুণ-তরুণীরা নাচে-গানে মেতে ওঠে।

চউল চনাম থিমে

কম্বোডিয়ার নববর্ষ। সাধারণত ১৩ কিংবা ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। তবে ছুটি থাকে তিনদিন। সংক্রান আর থিনজানের মতো পানি খেলা এই উৎসবেরও মূল আকর্ষণ। এই সময় ঘরে ঘরে বিশেষ খাবারও রান্না করা হয়।

লোসার

তিব্বতের নববর্ষ ‘লোসার’ নামে পরিচিত। তিব্বতের জনসাধারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের নেতা দালাই লামা যখন মৃত্যুবরণ করেন, পুনরায় তিনি শিশু হয়ে জন্মগ্রহণ করেন—এমনই ধারণা তিব্বীদের। কাজেই লামার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সদ্যজাত শিশুর অন্বেষণ করা হয়। এরকম শিশুকে যতেœর সঙ্গে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং বয়োপ্রাপ্ত হলে তাকে ধর্মীয় দায়িত্ব দেওয়া হয়।

টেট

ভিয়েতনামের নববর্ষ ‘টেট’ নামে পরিচিত। এর দাপ্তরিক নাম ‘নুয়েন-ডান’। কৃষিবর্ষের অন্তবর্তীকালে অত্যন্ত গুরুত্বসহ টেট উৎসব উদ্যাপিত হয়। সাধারণত পুরাতন ফসল ঘরে তোলার পর নতুন ফসল বপনের মধ্যবর্তী সময়ে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাড়িঘর, তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং যাবতীয় ঋণ বা বকেয়া দেনা পরিশোধ করে ভিয়েতনামের লোকজন নববর্ষ উদ্যাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

বৈসাবি উৎসব

চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাতেই ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। ওদেরকে বলা হয় পাহাড়ি আদিবাসী। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলেও আদিবাসীরা গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে বসবাস করে। আর বাস করে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে। ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’—এই তিন উৎসবের নামের প্রথম অক্ষর থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসবের নাম এসেছে। তিনটিই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। ফলে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীরা সবাই মিলে বৈসাবি উৎসবে অংশ নেয়ার মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। এই উৎসবের নানা দিক রয়েছে, এর মধ্যে একটি হলো মারমাদের পানি উৎসব। পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এটিও বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে আদিবাসীরা সবাই পরস্পরের দিকে পানি ছুড়ে উল্লাসে মেতে ওঠে যেন গত বছরের সকল দুঃখ, পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় জলপূজা।

তঞ্চঙ্গ্যাদের বৈসুক

তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ষবরণ অনেকটা চাকমাদের মতোই। উৎসবের প্রথম দিন মেয়েরা ফুল সংগ্রহ করে ঘর সাজায়। পরদিন সবাই গোসল করে নতুন জামা-কাপড় পরে আনন্দ-ফুর্তি করে। ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী খাবার আর পিঠার আয়োজন করা হয়। রাতে ‘ঘিলা’ নামের এক খেলায় মেতে ওঠে সবাই আর নববর্ষের দিন তরুণ-তরুণীরা বয়স্কদের গোসল করায়।

ম্রো বা মুরংদের চাক্রান বা চাংক্রান

ম্রো বা মুরংরা বর্ষবরণের এই উৎসবকে বলে ‘চাক্রান’ বা ‘চাংক্রান’। ওরা কিন্তু সবগুলো পার্বত্য জেলায় বাস করে না, ওরা বাস করে শুধু বান্দরবানে। ওরা আবার আরাকানি পঞ্জিকা মানে, তাই ওরা ম্রাইমাব্দ অনুযায়ী চাক্রান উদ্যাপন করে। তবে ওরাও তিন দিন ব্যাপী বাংলা নববর্ষ পালন করে। মূল উৎসবের দিন মুরংরা বাঁশি বাজিয়ে ‘পুষ্প নৃত্য’ করতে করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করে। ম্রো সমাজে লাঠি খেলা খুবই জনপ্রিয়। তাই চাংক্রানের মূল দিনে তারা এই খেলা খেলে থাকে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.