মুক্তিযোদ্ধার মা

মুক্তিযোদ্ধার মা

মেয়েলোকটার নাম মরিয়ম। তবে পাড়ার সবাই তাকে মুক্তিযোদ্ধার মা বলে চেনে। বয়স ষাট নাকি সত্তর কিচ্ছু বোঝা যায় না। গেটের কাছে এসে পাহলোয়ানের মতো হাঁক দেয়; ভিক্ষে দ্যান গো বাবাজি, আমি মুক্তিযোদ্ধার মা।

মরিয়মের রোগা টিঙটিঙে শরীর হলেও গলার স্বর একটু মোটা ঘেঁষে পুরুষালি ধরনের গলার স্বর। তাহের বোধহয় মুক্তিযোদ্ধার মা শুনে একবার এক টাকার জায়গায় দু’টাকার ভিক্ষে দিয়ে ফেলেছিল। সেই থেকে ফি শুক্কুরবার তাহেরের বাসায় বুড়ির আসা চাই। ভিক্ষে পাক বা না পাক, উত্তর দিককার বারান্দায় গিয়ে কাঁথা পুঁটলি নামিয়ে রেখে জুত করে বসে। অনেকক্ষণ বসে বিশ্রাম নেয়। আর যতক্ষণ বারান্দায় মেঝেয় লেপ্টে বসা, ততক্ষণ তার মুখ চলছে।

ইনিয়েবিনিয়ে সেই একই গল্প। তার ছেলে আবু চান রামদার কোপ দিয়ে একজন পাঞ্জাবির মাথা নামিয়ে দিয়েছিল। সেই দিনই মা’কে নিয়ে মধুপুরের জঙ্গলে গিয়ে লুকোয়। ছেলেটা ঘাড়ে গর্দানে খুব জোয়ান ছিল। আর বদমেজাজের একশেষ। বাপের স্বভাব আর কী। জঙ্গলে কয়েকদিন লুকিয়ে পালিয়ে থেকে তারপর চলে গেল শেরপুরের বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়ায়। সেই যে আবু চান গেল, আর তো ফেরে না। কালিহাতি এক চাচার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মরিয়ম খালি দিন গোনে। শেষে জষ্টি গিয়ে আষাঢ়, আষাঢ় গিয়ে শাওন মাসে একদিন খুঁজে খুঁজে ছাওয়াল এসে হাজির। কয়, আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছি মা। বন্দুক দে যুদ্ধ করি। দুশমন মারি।

এইসব কথা ইনিয়েবিনিয়ে বলে মরিয়ম। একই গল্প কতবার যে শুনেছে তাহের! বুড়ির ছেলে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করার সময় মির্জাপুর রণাঙ্গনে মারা যায়। এই দৃশ্য বর্ণনার সময় বুড়ির গলা আরও গমগম হয়ে ওঠে। ছেলের মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনার সময় সে হাঁক দিয়ে বলে : জয় বাংলা জয় বাংলা। কাঁদে না বুড়ি। মুক্তিযুদ্ধ বা তার ছেলের মৃত্যুর কথা বলার সময় সে কখনো কাঁদে না। গলাটা শুধু আরও গমগমে, আরও তীক্ষ্ণ, আরও তীব্র হয়ে উঠে।

কাঁদতে বোধহয় ভুলেই গেছে মেয়েলোকটা। তার রোগা টিঙটিঙে শরীর। মুখ একেবারে ভেঙেচুরে একশেষ। ফি শুক্রবার সকালের দিকটায় গেটের কাছে এসে সে পাহলোয়ানের মতো হাঁক দেয়; ভিক্ষে দেন গো বাবাজি আমি মুক্তিযোদ্ধার মা। কখনো বলে : আমি মুক্তিযোদ্ধার মা মরিয়ম।

মরিয়ম ছিলেন ইসা আলায়হে সাল্লামের মা। যাকে খ্রিষ্টানরা বলে জেসাস যীশু। মরিয়মের ছেলে আবু চান, তাহলে সেই যীশু, যে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করার সময় মির্জাপুর রণাঙ্গনে মারা গিয়েছিল। তাহের মজা করে ভাবে একেকদিন। বুড়ির দিকে তার রাগবিরাগ কিছু নেই। সে ভাবে, অসুস্থ একটা বুড়ি শুক্রবার এসে তার বারান্দায় ঘটা করে বসে থাকে, বসুক না।

তাহের একা মানুষ। বাসায় লোক বলতে পার্টটাইম ঝি বাশারের মা। একবার ভোর সকালে আর একবার সন্ধ্যার দিকে এসে কাজকর্ম রান্না-বান্না করে দিয়ে সে চলে যায়। ইদানীং একটা টঙটিঙে শরীর হলেও গলাটা বেশ ভারী ও গমগমে। একটু মোটা ঘেঁষে পুরুষালি ধরনের একাকী তাহের ভালোই আছে। একলা থাকা ও নির্জনতা সে উপভোগ করে। গান শোনে। বই পড়ে। এছাড়া তার আছে যখনতখন পড়েপড়ে ঘুম দেওয়া। শীলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বছর দেড়েক যাবৎ সে এই একাকী জীবনযাপন করছে। প্রথমদিকে খুব খারাপ লাগত। মনে হতো শ্যামলী-আদাবরের একেবারে ওপ্রান্তে বিল আর খেতজমির কাছে তার বাসার এই ভয়াবহ নির্জনতা একদিন ঠিক তাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। নতুবা একলা থাকতে থাকতে আর শীলার জন্য বুকের রক্তক্ষরণ হতে হতে একদিন সে পাগল হয়ে যাবে। দেড় বছরের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে কোনোদিনই হয় নি। সে দিব্বি বেঁচেবর্তে আছে। সকালবেলা ঠিক সময়ে কাওরানবাজার মাল্টিমোর এন্ড কোম্পানির পাঁচতলা অফিসে গিয়ে হাজিরা দেয় এবং বিকেল পর্যন্ত সারা শহরে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে কম্পিউটার বিক্রির চেষ্টা চালায়। কাজটা তাকে বেশ মানিয়ে গেছে। বিক্রি মন্দ হয় না। সে ভবিষ্যতে কোনো একদিন বাংলাদেশের রস পেরো হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কাজকর্ম নিয়ে এবং বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এদিক-ওদিক আড্ডা দিয়ে সময় তার ভালোই কেটে যায়। বাসায় ফিরে এসে খুব এনজয় করে একলা থাকাটা। পশ্চিম ও উত্তরের জানালা খুললেই দেখা যায় বিল ও ক্ষেত জমি। ভাবতেও তার শিহরণ জাগে যে ঢাকা শহরের পশ্চিম সীমানার শেষ সীমানায় শেষ কয়েকটি বাড়ির একটিতে সে থাকে। তার ছোট বাসায় একটু দূরের ঢাকার পুরোনো নদী কালিগঙ্গার ক্ষীণ ধারা। বিল ও ক্ষেতজমির হাওয়া সে বিনে পয়সায় পায়। শীলার দুঃখ এখন তার বুকে আর ততটা লাগে না। টাইম ইজ দ্যা গ্রেট কিলার। সময় হচ্ছে সবচে’ বড় নিরাময়কারী। একদিন সে ধাক্কা সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠে আর একটি মেয়ের দিকে হৃদয়ের রক্তময় অনুভূতি নিয়ে যেন তাকাতে পারে—এই অপেক্ষায় আছে তাহের। আপাতত একলা থাকা ও নির্জনতা সে বেশ উপভোগ করে।

শুক্কুরবার সাধারণত সে বেরোয় না। বেরোলেও বিকেলের দিকটায়। শুক্কুরবার তার যথেচ্ছ আরাম-আয়েশের দিন। বালিশ বুকের মধ্যে চেপে ধরে সে বিছানায় শুয়ে থাকে বেলা আটটা পর্যন্ত। সে আটাশ বছরের স্বাস্থ্যবান যুবক। নারীতৃষ্ণা তাকে কখনো কখনো যথেষ্ট আলোড়িত করে। তবে সেভাবে যে আর উঞ্ছবৃত্তি করা নয়। কম্পিউটার বিক্রির সেকেন্ড টার্গেট পূর্ণ হলে সে দেখেশুনে একটা বিয়েই করে ফেলবে। বউয়ের জন্য সে জমাচ্ছে তার চুমু ও আলিঙ্গনগুলো। আপাতত কাজের ধান্ধা এবং বাসায় ফিরে এসে একলা থাকাই জীবন। এই জীবন তাহের মেনে নিয়েছে। শুক্রবারের যথেচ্ছ আরাম-আয়েশ খাওয়ার সময় কখনো-কখনো ঘরের বাইরে উত্তরের বারান্দায় জুত-হয়ে-বসা মুক্তিযোদ্ধার মা মরিয়মের ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প বলা শোনে সে।

বুড়ির একই গল্প। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পর আবু চান ছিল তার নয়নের মণি। কলিজার টুকরা। গ্রামের খাঁ সাবদের বাড়িতে মরিয়ম কাজ করতে যেত, কোমর ঘুনশি-পরা নাকে-কাঁদুনে আবু চান সর্বক্ষণ তার পেছনে পেছনে। মরিয়ম যায় বাসন-পাতিল নিয়ে পুকুরের ঘাটলায় ধোয়া-পাকলা করতে, পেছনে আবু চান। গোয়ালে গরুর গামলায় ভিজে জাবনা দিতে যাচ্ছে মরিয়ম, তার হাতে মোটে সময় নেই, জাবনা দিয়ে ছুটতে হবে মাইজুম ভাইছাবের নাস্তা নিয়ে ইস্কুল বাড়িতে, পেছন পেছন ইঃ ইঃ করে আর নাকে-কাঁদুনে আবু চান। যেখানে মরিয়ম সেখানেই পেছন পেছন এই ছাওয়াল। মরিয়ম একেকদিন বিরক্ত হয়ে কিল-চাপড়াটা দিত। তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে, মরিয়মের ধরা ছোঁয়ার বাইরে গিয়ে ইঃ ইঃ  করে কাঁদত আবু চান। চোখে কিন্তু পানির চিহ্ন নাই। এই হলো আবু চানের কান্না। কাঁদত আর মরিয়মের পেছন পেছন ঘুরত। যত কিল-চাপড় আর বকুনিই খাক, মরিয়মের পিছু ছাড়ত না ছাওয়ালটা।

আবু চানই বুড়ির গল্পের মূল চরিত্র। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পর সে ছিল মরিয়মের নয়নের মণি। কলিজার টুকরা। পনের-ষোল বছর বয়েসেই কী রকম জোয়ানমর্দের মতো টগবগে শরীর হয়ে গিয়েছিল! কথা বলত ছাওয়ালটা দৈত্যের মতো। কাজকর্ম করত সারাদিন। কাজকর্ম মানে লোকের খেতজমিতে কামলা খাটা। পাড়ার বেকার মানুষ বলত যে, যেমন কিনা খাটতে পারে আবু চান পাঁচ বছর দশ বছরের মধ্যে সে ঠিক নিজের অবস্থান ফিরিয়ে ফেলবে। নিজেরই তখন খেত-জমি হাল গরু-টিনের বাড়ি হবে। মরিয়ম এসব কথা শুনে খালি আসমানের দিকে হাত তুলত আর বলত আল্লা, তুমি রহম করো। আল্লা তুমি রহম করো। সারাজীবন বড় দুঃখকষ্টে কেটেছে মরিয়মের। জন্মের পর থেকে বাপের বাড়িতে দেখেছে অভাব। একবেলা খেতে পায় তো আর একবেলা যোগাড় নেই। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসেও সেই ভাত-কাপড়ের কষ্ট। মানুষটা ছিল অলস আর দয়ালু। মরিয়মকে বুঝ-প্রবোধ দিত যে, চিন্তার কারণ নেই; আল্লাহর রহমে সব ঠিক হয়ে যাবে। কীভাবে যে সব ঠিক হয়ে যাবে তা না বুঝলেও মরিয়ম সুদিনের জন্য অপেক্ষা করত। তারপর পোড়া কপাল, আবু চানের চার বছর বয়সে মানুষটাই পাঁচদিনের সান্নিপাতিক জ্বরে ভুগে চিরকালের জন্য চলে গেল।

বুড়ি নিজের কাছেই নিজের গল্প বলে। তার গল্পের প্রধান চরিত্র আবু চান। সে একাত্তর সালে মধুপুর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শেরপুরের বর্ডার দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল। দেশ, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি সে কিছুই জানত না। সে ছিল খুব পরিশ্রমী মজুর। মুখ বুজে সারাদিন কাজ করে যেত। সবাই বলত যে, যেমন কিনা পরিশ্রম করতে জানে আবু চান, একদিন সে ঠিক নিজের অবস্থা ফিরিয়ে ফেলবে, তার নিজের হবে টিনের বাড়ি, হাল-গরু ও খেত-জমি। মরিয়ম আল্লাহর কাছে সেই রহমতই কামনা করত। তারপর একদিন হলো কী, দেশে হৈ-হাঙ্গামা। শেখ সাহেবের দল আর পাকিস্তানের দলের মধ্যে যুদ্ধ। প্রথমদিকে শেখ সাহেবের দলের লোকজন খুব মিছিল করত, খুব চিল্লাপাল্লা করত, বক্তৃতা দিত, গাদা বন্দুক নিয়ে মাঠে যুদ্ধের মহড়া দিত, পরে কী হলো পরিষ্কার বুঝা গেল না, খানসেনারা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আর শেখের দলের লোকজন টিকতে না পেরে পালিয়ে গেল। সেই থেকে যুদ্ধ। খানসেনা আর শান্তি কমিটির লোকেরা সারা তল্লাটের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল, হিন্দুদের মেরে ফেলল, গেরামের সব জোয়ান ছেলেদের ধরে ধরে নিয়ে যেতে লাগল। সে এক ভীষণ কাণ্ড, রক্তারক্তি যুদ্ধ। একদিন শান্তি কমিটির এক মেম্বারের সঙ্গে এক পাঞ্জাবি খানসেনা মরিয়মের বাড়িতে এসে হাঁক দিয়ে বলে : মুক্তি কোই মুক্তি হ্যায় ? শান্তি কমিটির লোকটা খুব মন্দ লোক ছিল না, সে বুঝাতে চেষ্টা করল যে আবু চান মুক্তি নয়, সে নেহায়েতই গরিব কাঙালের ছেলে, মানুষের বাড়িতে কামলা খেটে খায়। তখন পাঞ্জাবিটা শান্ত হয় এবং মরিয়মকে দেখে তার পছন্দ হয়ে যায়। সে জানায়, এই বাড়ি গরিব-কাঙালের হলেও এখানে দুপুরের খানা খেতে ও একটু বিশ্রাম করতে তার বিশেষ আপত্তি নেই। কথা শুনে শান্তি কমিটির লোকটা হি হি করে হাসতে লাগল ও মরিয়মকে দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে পাকিস্তানের স্বার্থে রাজি হয়ে যেতে বলল। মরিয়ম ম্যালাই চিল্লাপাল্লা করতে থাকে এবং আল্লা-রসুলের কিরা দেয়। যত ভয় পায় সে তত শান্তি কমিটির লোকটা মজা পায় এবং রাজি হয়ে যেতে বলে। পাঞ্জাবিটা এর মধ্যে চাটাইয়ের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বসে গেছে। মরিয়মের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে সেও গুনগুন করে গান গায়। এই সময় আঠার বছরের ছাওয়াল আবু চান ‘চুতমারানির পোলা’ বলে চিক্কার দিয়ে ঘরের চাল থেকে রামদাটা নামিয়ে চোখের নিমিষে ঘরে ঢোকে এবং কেউ কিছু বুঝার আগে এক কোপে পাঞ্জাবিটার মাথাটা নামিয়ে দেয়। তখন শান্তি কমিটির লোকটা যেন তাজ্জব হয়ে যায়। সে একবার তাকায় পাঞ্জাবির রক্তাক্ত ধড়ের দিকে, যা চাটাই জুড়ে পড়ে আছে আর একবার তাকায় রক্তমাখা রামদা হাতে সাক্ষাৎ আজরাইলের বেশে দাঁড়ানো আবু চানের দিকে। লোকটা খুব তাজ্জব। সে জানেও না তার অজান্তে তার দু’পা থরথর করে কাঁপছে। আবু চানের একটা লাথি কোমরে এসে পড়তেই সে যেন দেশের স্বার্থে দশের স্বার্থে পাকিস্তানের স্বার্থে মুণ্ডুহীন খানসেনার পাশে গিয়ে ঠাঁই নেয়। পড়েই মূর্ছা। তারপর আবু চান ও আবু চানের মা মরিয়মের পালিয়ে মধুপুরের জঙ্গলে যাওয়া। সেখান থেকে একদিন আবু চানের শেরপুর বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে যাওয়া। ততদিনে আবু চান বুঝে গেছে পাকিস্তান কী, খান সেনারা কী, মুক্তিযুদ্ধ কী, মুক্তিযোদ্ধা কী। প্রথমে ভয়,  পরে অপমান ও জেদ-আক্রোশ তাকে তিলেতিলে তৈরি করেছিল। বহুদিন পরে একদিন খুঁজে খুঁজে ছাওয়াল গিয়ে হাজির কলিহাতি। কয়, আমি মুক্তিযোদ্ধা হয়া গেছি মা। বন্দুক দে যুদ্ধ করি। দুশমন মারি।

বুড়ি উত্তরের বারান্দায় বসে এইসব গল্প নিজের কাছে নিজে বলে। শুয়ে শুয়ে শোনে তাহের এবং সেও গল্পের মধ্যে ডুবে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। নারায়ণগঞ্জ শহরে বাপ-মা ও ছোট বোন নীলার সঙ্গে সে বসবাস করত। তার মনে আছে, ২৫শে মার্চের পর তারা পালিয়ে শহর থেকে বহুদূরে সিলেটের একটা নিভৃত গ্রামে চলে গিয়েছিল। সেই গ্রামের একপাশে নদী আর একপাশে মাইলের পর মাইল জুড়ে হাওর। সেই গ্রামে তারা সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোটামুটি শান্তিতেই ছিল। রাজাকার-আলবদরদের উৎপাত টাকা-পয়সা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল। সেপ্টেম্বরের শেষে হাওরের দিক থেকে তিন নৌকা বোঝাই একদল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এল তাদের সেই নিভৃত গ্রামে। বাবা কী বুঝলেন, তিনিই জানেন। সে রাতেই সবাইকে নিয়ে পাড়ি দিলেন ঢাকার উদ্দেশে। ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ঢাকা ছিল, আরামবাগের একটা ভাড়া বাসায়। পরে দেশ স্বাধীন হলে তারা নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাহেরের বয়স ছিল ন’বছর। তার বাবা, তাদের পরিবার এবং সে নিজে মুক্তিযুদ্ধকে সব সময় একটা ভয়ের চোখে দেখেছে। নিজেদের জান বাঁচানোটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তার মা অবশ্য প্রায় প্রায় রোজা রেখে  দেশ স্বাধীনের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইতেন। বাবা না পক্ষে না বিপক্ষে। পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে তিনি স্যুটকেসে কাপড়চোপড়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন, যদি কাজে লাগে। আবার এও ঠিক, মনেপ্রাণে পাকিস্তানিদের ঘৃণা করতেন তিনি। চাইতেন তাদের সর্বনাশ হোক। বরাবরের তিনি ভীত মানুষ। স্বাধীনের পরেও তার সবকিছুর মধ্যে এই ভয়ই প্রধান হয়ে উঠত। আওয়ামী লীগকে পছন্দ করতেন না। ন্যাপের প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন রাজনীতিতে তার আদর্শ ব্যক্তি। কিন্তু পাছে আওয়ামী লীগ তার এই পছন্দ জেনে ফেলে, সেই ভয়ে কাবু হয়ে সর্বক্ষণ তিনি আওয়ামী লীগের লোকদের তোষামোদ করে বেড়াতেন। তাহের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার বাবার মধ্যে ভয় ও চালাকি দুই-ই দেখত। তার তখন ন’বছর বয়স। কখনো কখনো সে ভাবত, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে। ঘরের মধ্যে তার প্রিয় খেলা ছিল কল্পিত খানসেনাদের ওপর কল্পনার মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং সমস্ত খানসেনাদের মেরে ফেলা। মরিয়ম বুড়ির গল্প শুনে সেইসব দিন তার মনে পড়ে যায়। রাজনীতির ধারে কাছে সে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আদৌ কোনো চিন্তা করে না সে। মরিয়ম বুড়ির গল্প শুনে শুধু ভাবে, মহিলার নার্ভ খুব শক্ত আছে বটে। একমাত্র ছেলের মরে যাওয়া সে দিনের পর দিন সহ্য করে যেতে পারছে। শুধু তাই নয়, ইনিয়ে-বিনিয়ে সে বলে যে মায়ের কারণেই নাকি তার আবু চান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ছেলের মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনার সময় সে চেঁচিয়ে উঠে বলে : জয় বাংলা। নার্ভ খুব শক্ত না হলে কেউ এ রকম পারত ?

শুক্কুরবার সকালে অনেক সময় বিছানায় শুয়ে তাহের বুড়ির এসব প্যাচাল শোনে। তার দুঃখের কথা শোনার কেউ নেই, তাই সে নিজের দুঃখের গল্প নিজেকেই বলে। বুড়ি যখনই আসুক, বারান্দায় জুত হয়ে বসে-টসে আড়াইটা তিনটার মধ্যে চলে যায়। কেনো কোনোদিন বাশারের মা তাকে চাট্টে খেতে দেয়। মহিলাটা একটু খুুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। বাড়ির দরজায় দরজায় গিয়ে গমগমে গলায় হাঁক দেয়; ভিক্ষে দ্যান গো বাবাজি, আমি মুক্তিযোদ্ধার মা।

বুড়ি বসে থাকে, বাজারের এক কোণে। যাওয়া-আসার পথে তাহেরের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। বুড়ি বেশিরভাগ সময়ই বসে বসে ঝিমোয়। হঠাৎ একেক সময় ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে গমগমে পুরুষালি গলায় বলে : ভিক্ষে দ্যান গো বাবাজি আমি মুক্তিযোদ্ধার মা। খুব যে তাতে কাজ হয়, তা নয়। মুক্তিযোদ্ধার মা’র লব্জ নেওয়ায় কেউ কেউ তাকে ঠাট্টামশকরাও করে। পিচ্চিরা তো খুবই জ্বালায় বুড়িকে। দূর থেকে ইটের কণা ছুড়ে মারে। একেকদিন বুড়ির শানকি থেকে ভাত ও রুটি কেড়ে নিয়ে হি-হি করে হাসতে হাসতে তারা পালিয়ে যায়। অকথ্য অশ্রাব্য ভাষায় তখন দুনিয়ার সবাইকে গালি দিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধার মা।

একদিন সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফেরার সময় তাহের দ্যাখে রাস্তার পাশে মরিয়ম বুড়িকে ঘিরে একটা জটলা। পাড়ার কয়েকজন যুবক ও মধ্যবয়সি চেয়ার-মোড়া নিয়ে বসে আছে। এভাবে বসে থেকে গরমের দিনে বাতাস খাওয়া হয়, একটু আড্ডাবাজিও হয়। শ্যামলী-আদাবরে যারা বাড়ি করেছে তারা অনেক বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে এসব আড্ডায় বসে সময় কাটায়। তাহেরও দু’একদিন এসেছে। টুথপেস্ট ব্লেড কিনতে পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে জটলার মাঝখানে হাত বাঁধা মরিয়মকে দেখতে পায় তাহের।

ক, তুই গালিগালাজ করস ক্যান ? ধমক দিয়ে বুড়িকে জিজ্ঞেস করে পাড়ার বেশ প্রভাবশালী লোক রুস্তম আলী। বুড়ি যে ম্যালাই ভয় পেয়েছে তা তার ফ্যালফ্যাল করে তাকানো থেকে বুঝা যায়। টুথপেস্ট ও ব্লেড কেনার পরও ল্যাম্পপোস্টের একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে তাহের বিচারের ব্যাপারটা শুনতে চেষ্টা করে। কিছু না, কৌতূহল। শোনে পাড়ার মধ্যবয়সি মোহাইমেন বলছে, দে ওর চুলগুলো কাইটা দে। ঠোঁটটা সেলাই কইরা দিলে কেমন হয়। হাসতে হাসতে আর একজন জিজ্ঞেস করে।

বাঁধা হাত দুটি করজোড়ের ভঙ্গিতে রেখে বুড়ি ফ্যালফ্যাল করে এর-ওর দিকে তাকায়। সে বুঝতে পারছে মজলিসে তার বিচার চলছে। দারোগা পুলিশ কীভাবে আসামিকে ধরে মারে তা সে জানে। খুবই ভয় পেয়ে সে করজোড় এর-ওর দিকে তাকায়, সে জানে মানুষের দয়া ছাড়া আর রক্ষা নেই।

রুস্তম আলী বলে, চুল কাইটা দিলে ওরই লাভ। বিনা পয়সায় একটা পালোয়ানি ছাঁট হয়া গেল। রুস্তমের কথা শুনে হাসাহাসির ধুম পড়ে যায়। একজন বলল, তার চাইতে মুক্তিযুদ্ধ ভুলায়ে দিলে কেমন হয় ? মুক্তিযোদ্ধার মা কইয়া চিল্লায় আমাগো মহান মুক্তিযুদ্ধেরই বেশুমার অপমান করতেছে এই বুড়ি। অন্ধকারের আড়াল থেকে কেউ একজন বলল যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিকৃতি কোনোমতেই সহ্য করা হবে না।

চিল্লাপাল্লা, হাসাহাসি ও ধমকধামক থেকে ব্যাপারটা উদ্ধার করা গেল। ছয় নম্বর রোড়ের শাহনাজ সাহেবকে খুবই অশ্লীল ভাষায় অমুকের বাচ্চা, তমুকের বাচ্চা বলে গাল দিয়েছে বুড়ি মরিয়ম। কারণ আর কিছুই নয়। শাহনাজ সাহেব তাকে মুক্তিযোদ্ধাটোদ্ধা বলতে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, ভিক্ষে করছিস কর, আবার এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধটুদ্ধ কী। বুড়ির দিকে একটু মুখিয়েই গিয়েছিলেন বটে শাহনাজ সাহেব। তিনি একজন পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র। বছর দুই হল সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। এখন তার কাজ হলো দেশের চিন্তা করা। স্বাধীনের বিশ-একুশ বছর পর এসব আদিখ্যেতা তিনি একদম পছন্দ করেন না। এত বছর পর কীসের মুক্তিযুদ্ধ ? কিসের গোলাম আযমের বিচার ?

যুবকদের আড্ডা যে শাহনাজ সাহেবের সব কথা মেনে নিয়েছে, এমন নয়। তাদের কথা হলো, তুই একটা সম্মানিত লোককে অমুকের বাচ্চা তমুকের বাচ্চা বলে গালাগালি করলি কেন ?

বুড়িকে তারা জিজ্ঞেস করে : ক, গালাগালি করস ক্যান ?

বুড়ি এর-ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলে : জে ?

রুস্তম আলী বলে: ক, আর গালাগালি করবি না। ক, হারামজাদি। নইলে মাইরাই ফেলামু...

বুড়ি কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলে: আর গালাগালি দিয়াম না।

মুক্তিযোদ্ধার মা বইলা চিল্লাবি না...

মুক্তিযোদ্ধার মা বইলা চিল্লামু না...

ক,...খাই...

বলে একটা মনুষ্য-বর্জ্য বস্তুর নাম বলে রুস্তম আলী, সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি বলে...খাই।

সবাই হো-হো হি-হি করে হাসতে থাকে। কে একজন দয়াপরবশ হয়ে বুড়ির হাতের বাঁধনটা খুলে দেয় এবং দুটো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বলে: যা ভাগ। বলতেই বুড়ি ভাঙা কোমর নিয়ে যতটা পারে দৌড়ে পালায়। আড্ডার সবাই বুড়ির এই প্রায় প্রাণভয়ে পালাবার ভঙ্গি দেখে হেসে কুটিকুটি হয়।

দু’দিন পর সন্ধ্যার দিকে বাজারের পথ ধরে বাসায় ফেরার সময় তাহের দ্যাখে, বাজারের সবই ঠিকঠাক আগের মতো, সেই ধুলোয় পড়া ঘিঞ্জি দোকাটপাট, সার-সার উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল আলোর ছড়াছড়ি, রাস্তাজুড়ে রিকশার দঙ্গল, সবকিছু ছাপিয়ে ওঠা মসজিদের মিনার। কাজের মেয়েদের মুখপিঠ ঢেকে মুদির দোকানে ও বাজারে যাওয়া-আসা, পাড়ার উঠতি ছোকরাদের রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ও জেল্লা দেখিয়ে হাঁটা, বাজারের ভীষণ ভিড়বাট্টা ভ্যাপসা পচা গন্ধ ইত্যাদি সব ঠিকঠাক মতো এবং এর মধ্যে সেই আগের মতো রাস্তার ধারে বসে বুড়ি মরিয়ম পুরুষালি গলায় বলে: ভিক্ষা দ্যান গো বাবাজি, আমি মুক্তিযোদ্ধার মা...

তাহেরের আজ মন ভালো নেই। কম্পিউটার বিক্রি করতে দিলকুশার এক অফিসে গিয়ে শীলার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। শীলা বসেছিল অফিসের বড়কর্তার ঘরে। শীলা বারবার তাকাচ্ছিল তার দিকে। সেও, দু’একবার তাকিয়েছে বটে। বুঝা যাচ্ছিল শীলা আগের চাইতে অনেক ম্লান। তার চেহারা ও স্বাস্থ্য দুইই আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। বড়কর্তা তাহেরকে পরিষ্কার না বলে বিদায় করতে চাচ্ছিল। শীলা হাসতে হাসতে বড়কর্তাকে বলল, কেন, এক্স ও এল কোম্পানি তো বেশ ভালো, নিলেই হয়। বড়কর্তার ইচ্ছে ছিল না অন্য কেউ এই বিকিকিনির মধ্যে নাক গলায়। তবে তিনি বয়সে প্রৌঢ়, আকাক্সক্ষা বোধহয় তাকে জ্বালাচ্ছে পোড়াচ্ছে খুব, নতুবা শীলার মতো যুবতী তার অফিসঘরে এভাবে বসে থাকবে কেন, এ রকম ঢলেপড়া ভঙ্গিতে কথা বলবে কেন এবং তিনিই বা তার কথায় আমতাআমতা করে কম্পিউটার নিতে নিমরাজি হয়ে যাবেন কেন ? মোটামুটি ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই—শীলা এখন তাহেরের পর মঞ্জুরকেও ছেড়েছে। খুব সম্ভব একটা বাজে রাস্তায়ই এসে নিক্ষিপ্ত হয়েছে বোকা মেয়েটা।

তাহেরের মন ভালো নেই। বাসায় এসে চুপ করে বসে থাকে সোফায়। অনেকক্ষণ। শীলার সঙ্গে দেখা না হলে খুব ভালো ছিল তার। এই রকম প্রায় পতিতার স্তরে নেমে যাওয়া, তার চেহারা-স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়া তাহের দেখতে চায় নি। এখনো শীলার ভালো চায় তাহের। হ্যাঁ ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তাদের দু’জনের দেড় বছর আগে। তবু সব সময় সে শীলার ভালোই চেয়েছে। মেয়েটা খুব বোকা ও অস্থির। তাহেরকে একঘণ্টা পরপর টেলিফোন করে তার খোঁজ-খবর নিতে হতো। একঘণ্টা পরপর টেলিফোন করে খোঁজ-খবর নিতে যাওয়ার অর্থ পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ওই ছিল শীলার কথা। যেখান থেকে হোক যেমন করে হোক, এক ঘণ্টা পর টেলিফোন করতে হবে তাকে। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় এক ঘণ্টা পর। একটু এদিক-ওদিক হলে চলবে না। তাহেরের ধান্ধা সারাদিন কম্পিউটার বিক্রি করা। কী যে প্রচণ্ড অসুবিধা হয়ে যেত। এই রকম চাপের মধ্যে সেলসম্যানের কাজ করা যায় না। ফলে প্রায়ই অফিসে ও শীলার কাছেও ফেল করত তাহের। একেকদিন এই নিয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে যেত শীলার সঙ্গে। শীলা বলত, কী এমন কাজ তোমার যে একটা টেলিফোন করারও সময় পাও না ? আসলে সারাদিন তুমি বাজে আড্ডায় ঘোরো। শীলার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পারাই গেল না। বহুদিন এরকম ঝগড়াঝাট আর প্রচণ্ড মন কষাকষির পর একদিন একেবারে তামাম শোধ—চিরদিনের মতো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তাদের।

দেড় বছর পর শীলার জন্য আবার তার রক্তের ভেতর তোলপাড়। এই একটা মেয়ে, তাহেরের খুব ভালো লেগেছিল। একটু বখে যাওয়া বটে। নিজেদের বাড়ির ছাদের ঘরে একটা টেলিফোন নিয়ে একা একাকী থাকা শুরু করেছে প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরপরই। বিয়েটা ছিল বাপ-মায়ের ঠিক করা। লোকটা তাকে ব্যবহার করতে চাইত। বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে চলে যেত ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, কলকাতা। শীলার ভালো লাগত না। কখনো কখনো সে বিদ্রোহী হয়ে উঠলে লোকটা অদ্ভুত কায়দায় মানসিক নির্যাতন করত। যেমন তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য মেয়ে-মহিলার স্েঙ্গ বিছানায়। উড়ো টেলিফোনে ‘খানকি’ বলে গাল দেওয়া ইত্যাদি। শেষে শীলা তালাক নিয়ে চলে এল। সে ছিল খুব উষ্ণ, খুব প্রাণবন্ত, খুব সবুজ সজীব ধরনের মেয়ে। গোলাম আলী ও জগজিৎ-এর গানের খুব ভক্ত। শীর্ষেন্দু তার প্রিয় লেখক। এককালে বেশ ভালো ছবি আঁকত। শীলার স্বপ্ন ছিল সেই আদিকালের কঙ্কাবতীর মতো ঘর বাঁধার স্বপ্ন। তাহের ও শীলা দু’জনে চেয়েছিল সেই স্বপ্ন বাস্তব করে তুলতে। তাহেরের রক্তের মধ্যে চলে গিয়েছিল শীলাকে চাওয়া, শীলাকে পাওয়া, শীলাকে স্বপ্ন দেখা। কিন্তু শীলা নিজেই মাঝেমধ্যে অন্যরকম হয়ে যেত। কঙ্কাবতী নয়, শীলাবতীদের সঙ্গে তখন মিলে যেত তার চাওয়া ও চালচলন। তাহেরের জন্য খুব অসম্ভব হয়ে উঠেছিল সে।

কয়েকদিন খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটল তাহেরের। দেড় বছরে সে সামলে উঠেছিল বটে। একটা নিরুদ্বিগ্ন জীবনের ভেতর চলে গিয়েছিল সে। সারাদিন পরিশ্রম ও কাজের ধাক্কা, বিকেলে আড্ডার খোঁজে যাওয়া, বাসায় এসে পড়ে-পড়ে ঘুম। এছাড়া আছে দুই আশ্রয়; বই পড়া ও গান শোনা। বাসার নির্জনতাটুকু এবং একলা থাকা সে উপভোগ করতে বেশ শিখে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সে তৈরি হচ্ছিল আর একটি মেয়ের জন্য, যাকে সে কম্পিউটারের সেকেন্ড টার্গেট পুরো হওয়ার পর বিয়ে করে ফেলবে বলে স্থির করছিল। একলা জীবনের আকাক্সক্ষা, চুমু ও আলিঙ্গনগুলো সে জমাচ্ছিল সেই অদেখা অজানা মেয়েটির জন্য। এই সময় শীলার সঙ্গে তার আবার দেখা হওয়াটা খুবই খারাপ হয়েছে। শীলা যেন একটা ঝড়। তাহেরের শান্ত জীবনটা তোলপাড় ও তছনছ করে দিতে চায়।

কয়েকদিন খুব অস্থিরতার মধ্যে কাটল তাহেরের। তার পর সে মনে-মনে বুঝে যায় শীলার সঙ্গে তার কখনো মিলবে না। হ্যাঁ, উষ্ণতাটুকু দু’জনের খুবই মিলেছিল আর সর্বক্ষণ দু’জনের কথাবার্তা বলাটা। পরস্পরকে তাদের কখনো বোরিং মনে হয় নি। সারাজীবন তারা বোধকরি একটি ঘরে শুয়ে বসে কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারত। এদিক দিয়ে খুবই মিলেছিল বটে। কিন্তু শীলা খুবই রগচটা ও অস্থির। তাহেরকে যে সারাজীবন কাজ করে যেতে হবে, কাজই যে তার উন্নতি ও সহায়, এটা সে বুঝতে চাইত না। শীলা চায় কারু কাছ থেকে সর্বক্ষণের এটেনশন। একা থাকলে সে হয়ে পড়ে অস্থির এমনকি কিছুটা বিকারগ্রস্ত। যাকে কম্পিউটার বিক্রি করে জীবনে উন্নতি করতে হবে, তার এমন মেয়ে দিয়ে চলে না। কিংবা বলা যায় শীলারও চলে না তেমন লোককে দিয়ে, যে লোক দিনের বেশিরভাগ সময় কম্পিউটার বিক্রির ধান্ধায় থাকে। কাজেই চাওয়া রক্তের মধ্যে যতই মিশে যাক, তাহের মনে মনে বুঝে যায় শীলার সঙ্গে এক হাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। যত কষ্ট হোক, নিজেকে দমন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

কয়েকদিন পরের কথা। তাহের লাঞ্চের পর তার টেবিলে বসে আছে, এ সময় তার টেলিফোন এবং টেলিফোনে শীলা। তাহেরের বুকের রক্ত তোলপাড় হয়ে আছড়ায় হৃৎপিণ্ড।

তাহের।

বলো শীলা।

একটুখানি চুপ করে থাকে শীলা। তারপর বলে আমরা কি আর একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি না...

না, শীলা যতবারই চেষ্টা করি, রেজাল্ট একই হবে।

টেলিফোনে বুঝা যায় শীলা উদ্গত অশ্র“ ও আবেগ দমনের চেষ্টা করছে। ভারি খারাপ লাগে তাহেরের। একটা ভালো, উষ্ণ সজীব ও সুন্দর মেয়েকে কীভাবে নানা স্বার্থের যাঁতাকলে পিষ্ট করে অস্থির, রগচটা ও অসুখী করে তোলা হয়েছে। তার খুব মায়া লাগে শীলার জন্য।

তাহের আবার বলে, শীলা, আই লাভ ইউ। চিরকালই তোমাকে ভালোবেসে যাব। দূর থেকে। আমাদের এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়।

শীলার সঙ্গে এই তার শেষ কথা। আর কোনোদিন শীলা তাকে টেলিফোন করে নি। তাহের এখন বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে পশ্চিমের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে। পশ্চিমের দিকটা খেত-জমি ও হাওর। অদূরে দেখা যায় ঢাকার ইতিহাসের প্রাচীন নদী কালিগঙ্গার বয়ে যাওয়া ক্ষীণ ধারা। রাতের অনেকক্ষণ বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকে তাহের। শীলা নামটা দিনে দিনে তার আরও প্রিয় হয়ে উঠেছে। সে শীলাকে বারবার জানাতে ভুলে না, শীলা আই লাভ ইউ। শীলাও তাকে ফিসফিস করে বলে, আই লাভ ইউ তাহের। এইভাবে বহু সময় কেটে যায়। শুক্কুরবারের সকাল আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে বালিশটা বুকের ওপর চেপে শীলার কথা ভাবে সে। কখনো কখনো বুকের রক্ত ফিনকি দিয়ে ছোটে, তাহের টের পায়, কিন্তু ভ্রƒক্ষেপ করে না। তার সেই চুপচাপ একলা থাকার আনন্দ এখন কেমন যেন চোট খেয়ে গেছে।

একদিন অফিসে চিফ ম্যানেজার তার রুমে ডেকে পাঠিয়ে তাহেরকে অভিনন্দন জানায় কম্পিউটার বিক্রির ফার্স্ট টার্গেট পূর্ণ করার জন্য। তাহের ম্যানেজারকে সশ্রদ্ধভাবে ধন্যবাদ দেয়। ম্যানেজার হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, পারবেন না বছর দেড়েকের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার টার্গেটটা ফুলফিল করতে ? তাহের বলে, পারব স্যার। জীবনের যে কী অর্থ  তা সে বুঝতে পারছিল না যদিও।

দিন দুই পরে শুক্কুরবার। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় ম্যালা লোকের চেঁচামেচি শুনে। চেঁচামেচিটা তার বাসার সামনে, কাজেই তাকে উঠে বাইরে আসতে হলো। দ্যাখে কয়েকজন লোক মরিয়ম বুড়িকে ধরে মারছে। একজন ধরে রেখেছে তার হাত, আর দু’জন সামনে বসাচ্ছে চড়, চাপড়, লাথি। হারামজাদি, তুই গালাগালি করস, তোরে আইজ মাইরাই ফেলামু। পাড়ার বলবান এক যুবক বলছিল আর মারছিল। বুড়িটা মার খাচ্ছে আর চেল্লাচ্ছে। বলছে ওরে আমার পুতরে। ওর আমার আবু চানরে। বুড়িকে কোনো সময় কাঁদতে দেখে নি তাহের। এই প্রথম শুনল রোগাবুগা বুড়িটা কাঁদছে আর বলছে : ওরে আমার পুতরে। ওরে আমার আবু চানরে।...

Leave a Reply

Your identity will not be published.