অম্লান সালমান

অম্লান সালমান

 

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন চিত্রনায়ক সালমান শাহ। জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর প্রভাব কমেনি। এই নায়কের ২৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি অন্যদিন-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

‘এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন’- এই বাক্যটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য প্রমাণ করেছেন নায়ক সালমান শাহ। সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত রিমেক চলচ্চিত্র ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর মাধ্যমে তিনি এ দেশের তরুণীদের স্বপ্নপুরুষে পরিণত হন (তাকে কেন্দ্র করে যেভাবে তরুণী-উন্মাদনা পল্লবিত হয়েছে এমনটা অতীতে খুব কম ঘটতে দেখা গেছে)। সালমানের রাতারাতি উত্থান ঘটে—তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা পান। তিনি যে কত জনপ্রিয়, দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছেন সেটা সালমানের মৃত্যুর পর মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে দেশীয় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।

'লাভার বয়' ইমেজে সালমান শাহ এ প্রজন্মের মানুষের প্রিয় নায়ক ছিলেন। ‘৯৩-এর মার্চ থেকে ‘৯৬-এর সেপ্টেম্বর—এই সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ারে সালমান শাহ অভিনীত ছবির সংখ্যা ২৭। এর মধ্যে তাঁর মৃত্যুর আগে মুক্তি পায় ১৭টি, মৃত্যুর পরে ১০টি।

সালমান শাহ অভিনীত ২৭টি ছবির অধিকাংশতে তাকে পাওয়া গেছে প্রেমিক চরিত্রে। প্রথম ছবির রাজ চরিত্রটিতে সালমানের মাঝে কখনো কখনো আমির খানের ছায়া উঁকি মারলেও স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষরও সুস্পষ্ট। সেই দৃশ্যটির কথা বলা যেতে পারে—বনে পথ হারিয়ে যখন রেশমী রূপী মৌসুমী আর রাজরূপী সালমান রাত্রিযাপন করছে। রাজ যেহেতু জানে রেশমী তাদের পরিবারের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন পরিবারের মেয়ে, সেহেতু সে সংযত আচরণ করছে। রেশমীর প্রতি তার ভালোবাসা নীরবতায় প্রকাশিত। এই দৃশ্যে রাজরূপী সালমানের অভিব্যক্তিত্বে ভালোবাসার সেই নীরব প্রকাশ স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।

... মা অন্তঃপ্রাণ সন্তান—মার জন্য জীবনও বিসর্জন দিতে রাজি (সত্যের মৃত্যু নেই)... এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র (বিক্ষোভ)... জীবনের তিন অধ্যায়ে [প্রেমিক, স্বামী, পিতা] তিন ডায়মেনশনে প্রোজ্জ্বল এক চরিত্র (কন্যাদান), গ্রামের এক প্রেমিক তরুণ (সুজন সখী), এক ধর্ষিতা মায়ের সন্তান (মহামিলন) ইত্যাদি চরিত্রগুলি সালমানের অভিনয়গুণে হৃদয়গ্রাহী। 

উল্লেখযোগ্য অন্যান্য চলচ্চিত্র হচ্ছে  অন্তরে অন্তরে, স্নেহ, দেনমোহর, স্বপ্নের ঠিকানা, এই ঘর এই সংসার, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, মায়ের অধিকার, প্রেম পিয়াসী প্রভৃতি।

সালমানের প্রথম নায়িকা মৌসুমী। বলা যায়, মৌসুমীর পরেই শাবনূরের বিপরীতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশি। শুরুতে সালমান-মৌসুমী অভিনীত ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘স্নেহ’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘দেনমোহর’ ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করলেও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে এই জুটি আর ছবি করে নি। পরে শাবনূরের সাথে সালমানের জুটি গড়ে ওঠে। 

এছাড়া সালমানের অন্য নায়িকারা হচ্ছেন শাবনাজ, লিমা, শিল্পী, শাহনাজ, শামা, সোনিয়া, কাঞ্চি, সাবরিনা ও বৃষ্টি। অর্থাৎ নতুন নতুন নায়িকাদের প্রাধান্য দিয়েছেন সালমান। পাশাপাশি সিনিয়র নায়িকাদের সাথেও অভিনয়ের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। বিশেষ করে চম্পার প্রতি তাঁর পক্ষপাত বেশি। কিন্তু একসঙ্গে কাজ করা হয় নি।

সালমান মানেই লাভার বয়। এই ইমেজেই তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। বিশেষ করে নাগরিক ইমেজে। গ্রামীণ চরিত্রে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির ফলাফল আশানুরূপ ছিল না। তবে এটা সত্যি যে, তাঁর মতো ক্রেজ আর কেউ সৃষ্টি করতে পারে নি। তাঁকে বড়পর্দায় দেখার জন্যই মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীরা আবার হলমুখী হয়েছিল। 

দর্শক-হৃদয়ে সালমানের এই আসন কত সুদৃঢ় ছিল তা অনুভব করা যায় তাঁর মৃত্যুর পরে। তখনই বোঝা গেছে যখন সালমান অভিনীত ছবিগুলি হিট/ সুপারহিট হতে থাকল—যেগুলি তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি। অন্যদিকে অন্য নায়কদের ছবি (দু' একটি বাদে) ফ্লপ হতে থাকে— চলচ্চিত্র ব্যবসায় নেমে আসে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব। কখন এবং কীভাবে যে সালমান এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র মানুষ ও মধ্যবিত্ত দর্শকদের কাছে সুপারস্টারে পরিণত হয়েছিল তা জীবিতকালে নির্মাতারা টের পান নি। সম্ভবত সালমান সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই হয়তো পারিশ্রমিক ও প্রভাব—এ দুটি লক্ষ্যের দিকে খেয়াল রাখতেন। এ জন্য তিনি প্রবীণদের তুলনায় নবীন প্রযোজক ও পরিচালকদের প্রাধান্য দিতেন।

সালমানের সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে—ঢাকার ছবিতে নায়কের সম্পূর্ণ নতুন ইমেজের জন্ম। হাইফাই পোশাক ও মাথাভর্তি পরচুলা নয়, সালমান পর্দায় এসেছেন সাধারণ গেটআপে। অর্থাৎ সবচেয়ে ফ্যাশনেবল হিরো হয়েও তাঁর স্টাইলের সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল স্বাভাবিকতা। কখনোই তাঁর মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না। তাঁর পোশাকের তালিকায় এক নম্বরেই রাখা যেতে পারে জিন্স, টিশার্ট ও স্কিন টাইট টিশার্ট। মোটা বুননের ঢিলেঢালা শার্ট ছিল তাঁর ভীষণ পছন্দ। কখনো কখনো মাথায় স্কার্ফ বাঁধতেন, চেইন পরতেন গলায়, সাধারণত লেদার স্ট্র্যাপের রিস্ট ওয়াচ দেখা যেত হাতে। দুর্বলতা ছিল কালো ও সোনালি ফ্রেমের চশমার প্রতি। 

‘মায়ের অধিকার’ পর্যন্ত ছোট চুলের সালমান ছিলেন সুপরিচিত। এরপরে তাঁকে দেখা যায় লম্বা চুলে। এবং পরবর্তী সব ছবিতে চোখে বিভিন্ন রঙের কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে দেখা গেছে। পায়ে কেডস বা প্যাম্পসু। পর্দায় কথা বলেছেন বাস্তবে ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্রের মতো। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন নতুন প্রজন্মের পছন্দের প্রতীক এবং এই স্বাভাবিক ইমেজের দরুনই সালমান সবাইকে ছাড়িয়ে যান জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ফিগার, স্মার্টনেস, তারুণ্য দীপ্ত পার্সোনালিটি এবং অভিনয়শৈলী।

লাভার বয় সালমান শাহের ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল রোমান্সের ছোঁয়া। সামিরার সাথে তাঁর বিয়ে ছিল দীর্ঘদিনের প্রেমের পরিণতি। এক পর্যায়ে শাবনূরকে জড়িয়ে সালমানের নাম উচ্চারিত হয়—যখন সালমান-শাবনূর জুটি নির্মাতাদের কাছে নির্ভরযোগ্য জুটি হিসেবে পরিগণিত হয়। অবশ্য সালমান চেষ্টা করেছিলেন শাবনূরকে এড়িয়ে যেতে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল এটাই যে, সালমানের কাছাকাছি বয়সের নায়িকার সংকট ছিল।
সালমানের অভাব আর কেউ আগামীতে পূরণ করতে পারবেন না হয়তো। নানা কারণেই সালমান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.