[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব...]
৬ মার্চ ১৯৭১, বিকেল পাঁচটা। শেখ মুজিব তার হাইকমান্ডদের নিয়ে সভায় বসেছেন। ইদানীং অবশ্য ঘরে-বাইরে নিয়মিতই সভা হচ্ছে। কিন্তু আজকের সভাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান ভাগ হতে চলেছে, কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেটি বুঝতে চাইছে না। এমনকি পশ্চিম-পাকিস্তানের জনগণের রায়ে নির্বাচিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও এটা বুঝতে নারাজ। তাদের ধারণা কষে ধমক ধামক দিলে বাঙালি ঠান্ডা হয়ে যাবে।
কিন্তু ধমকের দিন শেষ। ২৪ বছর ধরে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের ধমক খেয়ে খেয়ে বাঙালির কান ঝালা-পালা হয়ে গেছে। একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাদের। এখন রুখে দাড়ানো করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। লড়াইটা এখন একেবারেই বাঁচা-মরার লড়াইয়ের পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ডু অর ডাই।
সভার স্থান ৩২ নম্বর ধানমন্ডি, শেখ মুজিবের বাসস্থান। বাড়িটি নিয়ে মজার ইতিহাস আছে। ১৯৫৪ সালে যুবক শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে মন্ত্রিসভার সদস্য হন। শেখ মুজিব ছিলেন প্রথমে কৃষি, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী। পরে তাঁকে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৫৬ দিনের মাথায় উনিশ মে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়।
এরপর আবার মাঠে নেমে পড়েন তাঁরা। দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে আবার তাঁরা প্রাদেশিক সরকার গঠন করেন। এবার কোয়ালিশন সরকার হয়েছিল আওয়ামী লীগ, তফসিলি ফেডারেশন এবং গণতন্ত্রী পার্টির। শেখ মুজিবুর রহমান সেই মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন।
মন্ত্রী হিসেবে তিনি নবাব আবদুল গণি রোডের সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া ১৫ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। সেই সময় পিডব্লিউডি ঢাকার নতুন গড়ে ওঠা অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে নানা পেশার কর্তাব্যক্তিদের ৯৯ বছরের চুক্তিতে কিছু সরকারি প্লট বরাদ্দের অনুমোদন দেয়। অনেকেই এই বহুমূল্য প্লটগুলোর জন্য আবেদন করেছিলেন। এ রকম কোনো প্লটের জন্যে কোনো আবেদনের চিন্তা শেখ মুজিবের মাথায় আসে নি।
শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত সহকারী নুরুজ্জামান সেই খবরটি বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে এনে দেন এবং বুদ্ধি করে একটি আবেদনপত্রও সংগ্রহ করে আনেন। ফজিলাতুন্নেছা জানতেন নীতির প্রশ্নে অটল, সৎ ও নির্লোভ শেখ মুজিব কখনোই বাড়ির জন্যে আবেদন করবেন না। কিন্তু আজীবনের রাজনীতিবিদ, মাঠের সৈনিক শেখ সাহেবের ভবিষ্যৎ কী হবে, প্রতিদিনের এই মিটিং-সিটিং কোথায় হবে, সেটা ভেবে বেগম ফজিলাতুন্নেছা চিন্তিত ছিলেন।
তাই নুরুজ্জামানের আনা ফর্মটি পূরণ করে সেটি জমা দেন। এরপর ৬ হাজার টাকার বিনিময়ে এক বিঘা বা ২০ কাঠা আয়তনের এই প্লটটি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে সরকারিভাবে বরাদ্দ করিয়ে নেন।
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। এর আগেই গ্রেপ্তার বরণ করলেন শেখ মুজিব তাঁর পুরানা পল্টনের ভাড়াবাড়ি থেকে।
সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চাপে তিন দিনের মধ্যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন তাঁর স্ত্রী। তারপর দলের নিবেদিত কর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টায় মাসে ২০০ টাকা ভাড়ায় বেশ দূরের সিদ্ধেশ্বরীর একটি ভাড়াবাড়ি জোগাড় করলেন তিনি। বাড়িটি খুবই ছোট, দুই রুমের। গোপনেই উঠেছিলেন তারা।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সিদ্ধেশ্বরীর সেই বাসার কথা জানাজানি হয়ে গেল। ভয়ে ও চাপে বাড়ির মালিক ফজিলাতুন্নেছাকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলেন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও এতটুকু টললেন না বেগম মুজিব। এমন সংকট জীবনে বহুবার মোকাবিলা করেছেন তিনি। আবার বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। শেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর সেগুনবাগিচার একটি ভাড়াবাড়িতে গোপনে উঠলেন তারা।
তখনই ফজিলাতুন্নেছা ঠিক করলেন এভাবে ভাড়াবাড়িতে অন্যের গলগ্রহ হয়ে আর নয়। ধারদেনা করে হলেও ৩২ নম্বরের প্লটটিতে একটা একতলা ঘর তুলে তারা ওখানে উঠে যাবেন। যেভাবেই হোক ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী, নুরুল ইসলাম, ছিলেন ফজিলাতুন্নেছার প্রিয়ভাজন। তিনি প্রায়ই ‘ক্রস ওয়ার্ড’ লটারি খেলতেন। লটারিতে তখন নাম-ঠিকানা দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। একবারের লটারিতে নুরুল ইসলাম শেখ রেহানার নাম দিয়েছিলেন। সেদিনই পেয়ে গেলেন ৬ হাজার টাকা। সেই আমলে অনেক টাকা।
এই বিপুল টাকা জমা রাখা ছিল ফজিলাতুন্নেছার কাছে। ৩২ নম্বর বাড়িটি তৈরির সময় নুরুল ইসলাম সেই টাকাগুলো দিয়ে সাহায্য করলেন। শেখ মুজিব এই ঋণের কথা কোনোদিন ভোলেন নি এবং সেটি শোধ করেছিলেন।
পিডব্লিউডির তখন নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মাঈনুল ইসলাম। তিনি পরে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছিলেন। বিনা পারিশ্রমিকে ভালোবাসার টানে, এক টাকাও সম্মানী না নিয়ে, সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি পুরো বাড়ির নির্মাণকাজ তদারক করেছেন।
বাড়ির কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলে জানালার গ্রিলগুলো তৈরি করে বানিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মতিউর। আর নির্মাণের সময় কেয়ারটেকার ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের জেলা গোপালগঞ্জের পাঁচকহনিয়া গ্রামের আরজ আলী। তাকে কাজ তদারকির জন্যে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। এভাবে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নেতার ঠিকানা তৈরি হলো রাজধানীতে। এটা আওয়ামী লীগেরও ঠিকানা।
আজকের এই সভায় আছেন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ, নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, কামাল হোসেন, খন্দকার মোশতাক ও আরও অনেকে।
ফর্মাল মিটিং শুরু হওয়ার পর দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন গোটা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। ইয়াহিয়া তার চক্রান্ত অনুযায়ী ১ মার্চ এক বেতার ভাষণে রাজনৈতিক সংকটের কারণে ৩ মার্চ যে পার্লামেন্ট অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল সেটি বাতিল করেছেন এবং পরবর্তী অধিবেশন কবে হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেন নি।
এদিকে সেদিনই আবার ভুট্টো হুমকি দেন তাঁর দলের উপস্থিতি ছাড়া গণপরিষদের অধিবেশন হলে তিনি পশ্চিম-পাকিস্তানে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলবেন।
ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণার সাথে সাথেই বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। এবার ছাত্রদের সাথে রাস্তায় নেমে আসে সকল শ্রেণির পেশাজীবী মানুষ, এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও।
পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের কাছে পশ্চিম-পাকিস্তানের শোষণের চক্র স্পষ্ট হয়ে গেছে, পশ্চিমাদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার সব রকম মোহ কেটে গেছে। এখন স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে সারা দেশ- বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। সেদিনই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
১ মার্চ শেখ মুজিব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক শেষে ঘোষণা করেছিলেন, ২ মার্চ ঢাকায়, ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হবে। আর ৭ মার্চ জনসভা হবে রেসকোর্সের মাঠে। মূলত এর পর থেকেই পূর্ব-পাকিস্তান চলতে শুরু করেছে শেখ মুজিবের নির্দেশে।
এদিকে ৩ মার্চ ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। সবুজ পতাকা, মাঝখানে লাল সূর্যের ওপর সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র। পতাকার ডিজাইন করে দেন শিবনারায়ণ দাস।
৩ মার্চ হরতালের সেই দিনে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সভায় নূরে আলম সিদ্দিকী উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, সেই সঙ্গে গাওয়া হয় জাতীয় সংগীত- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
এইভাবেই ছাত্র-জনতা ঠিক করে নিয়েছে তাদের ভবিতব্য। এখন আর পেছনে তাকাবার সময় নেই। সমস্ত মোহ, সমস্ত বাধা, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঙালি জেগে উঠেছে, রাস্তায় নেমে পড়েছে। দেশ স্বাধীন না করে তারা ঘরে ফিরবে না।
তাজউদ্দীন বললেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা স্বাধীনতা ঘোষণা শোনার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.