লাবণ্য ও বনলতা
লাবণ্য বনলতা পথ হারিয়ে বিপথে
উঠেছে বালুঝড় বসন্তবিকেলে
এ কেমন ঝড়, হল্কায় ত্বক পুড়ছে
বিকেলগুলো হয়ে আসে বিভীষিকা
লাবণ্য বনলতা ছোটে দিশাহারা।
এইসব উল্টোপাল্টা দৈবদুর্যোগে
নারী খোঁজে চেনা গলি, বাসনাকুঞ্জ
কেমন বিহ্বল রিক্ত প্রেমাতুরা এরা!
সবশেষে বৈষ্ণব পাড়ায় চূড়োখোঁপা, একতারা।
রাস্তায় ভিনদেশি ছদ্মবেশি রক্তচোষা
সোহাগরাত্রি ছারখার, বাতাসে ছাই।
গিরিখাত থেকে শেষবার অমিত দেখেছিল
রনডেন্ড্রন ছাওয়া উপত্যকা
দিঘিতে ভূতে-পাওয়া নারীর লাশ,
ফাঁকা মঞ্চে প্রেমিক কবির রক্তাক্ত সেরেনাদ
ঝড়ের পরে স্নানশেষে লাবণ্য বনলতা
খোলা ছাদে শোঁকে হাওয়ার বুনো গন্ধ।
এভাবে সত্তর বসন্ত
জন্মান্ধের জীবন কেটে যায় রৌদ্রে-ছায়ায়
গুহাপথ ছেড়ে এসে দেশান্তরীর মিছিলে নামি,
একাত্তরেও গাড়ির পা’দানিতে আছি বেশ
ছুটছে মেইল, এভাবেই ছোটার কথা।
নামতে নেই মাঝপথে, ঘরবাড়ি মাঠ বনানী
ছুটছে পেছনে, চকিত-চেনামুখ কুঁড়ের জানালায়,
এইসব মুখ প্রকৃত মুখ নয়
এরা আমার গতজন্মে আঁকা পোর্ট্রেট থেকে।
একাত্তরে আর কী কী থাকে মানুষের
এসবই তো- আর কিছু? মরীচিকা আলেয়া,
অর্ধসত্য শুনে শুনে সত্তর বসন্ত কেটে গেল
বুকভাঙা শব্দে প্রতিশ্রুতিরা ধূলিতে গুঁড়ো হয়।
সবশেষে কানে বাজুক লালনের ক্রন্দন,
জন্মবধিরের কাছে বাউল-বিটোফেন সবই ও...ম্
ওই ধ্বনিলহরী শুনি জন্মান্তরের নদীতীরে।
খরা-কালের কবিতা
এ কী রকম খরা! মধ্যরাত থেকে উড়ছে ধূলি
ভোরে মরে থাকে বিগত বর্ষার ফুলগুলি
রাতে কেউ এসেছিল, এ সময়ে কারা আসে
রোজ রাতে কেউ, বাতাসে আকালের গন্ধ ভাসে
রাতভর থেমে থেমে দরজায় টোকা
স্বপ্নে থাকি বিভোর, ফোটাই ফুলথোকা
বারান্দায় ওলাদেবীর ঢলানি, গুহাঘরে মৃত্যুহিম
মড়কের মানচিত্র বাছে না রাম ও রহিম।
বৃষ্টিসোঁদা হাওয়ায় ছিঁড়ে ফেঁসে উড়ে যায়
দৈত্য-দানো ডাকিনীরা, থাকি সে-আশায়।
বনবাসে আঁকি শিশু-সদনের ছবি
জানি এতসব রেখা ও রং মুছে যাবে সবই
তবুও সাধ, আসবেই নির্মল হাওয়া
তারপর দলেবলে সমুদ্রস্নানে যাওয়া
হায় রে, লকডাউনে স্মৃতিভ্রংশ, ধু-ধু চারপাশ
ভুলে যাই চৈত্রমাস, আসছে আমার সর্বনাশ।
বৈঠায়, পালে ও দাঁড়ে
ঘাটে থাকা বাঁধা আদিনৌকা, আমাদের ভেলা
ছিল আবহমান, আজও আছে
বৈঠাই ধরেছি অবশেষে, ধরতে হয়।
পারাপারে কিছু বাকি থেকে গেছে।
ওই পাড়ে কবে থেকে দাঁড়ানো নারী ও শিশু
ঝড় থেমে গেলে অন্ধকার নামে
বনে বনে পিশাচের নরবলি, প্রেতপূজা
নৌকা ডুবে গেলে ইতিহাস পাল্টায়
অশ্বারোহীরা ঢোকে কালো আলখাল্লায়
মশাল নিভেছে, রাত্রি ঢাকে গুহাচিত্রাবলি
এইসব প্রক্রিয়ার কারণে বড় সহজে
লেখা যায় নৌকার এপিটাফ আর শোকগাথা
নদী তবু থেকে যায় খরার দেশেও
বসি গিয়ে নির্ভুল নৌকার গলুইয়ে।
নদীজলে পাহাড়ের নুড়ি, ডালার ফুল, রেশম
গিয়ে বসি নির্জন পাড়ে, নৌকাটি থাকে
নাকে পাই জলগন্ধ, পানাগন্ধ
এইসব নেশাজালে কবিতা ভুলে থাকি।
বলো কবিতার নামে কেন এইসব বর্জ্য
নৌকার বৈঠায়, পালে ও দাঁড়ে চাহি নির্বাণ।
পর্দা উৎসবে ছিন্ন পর্দা
ছাতার আড়ালে মুখ ঢেকে
কারা যায় বড়ো পথ থেকে ছোটো পথে
কলিযুগে উল্কি আঁকা জাদুমুখ সব,
মুখ ঢেকে আছে মুখোশে, মায়াবাস্তবে
বাহারি পর্দা ঝোলে না আর জানালায়
কে বলে বাইজিরা না খেয়ে আছে,
যাও, শহরের বারোতলা ঘুরে এসো
ওরা সুরা দেবে, দ্রাক্ষা দেবে, আরও কিছু ...
কাউকেই তোয়াক্কা না ক’রে
গাড়লেরা যত্রতত্র ঢেলে আসে
কবিতাবর্জ্য, মাথাভরা চৈত্রের রোদ
ছাতার আড়ালে মুখ ঢেকে যারা চলে,
জানে মাথার ভিতরে কালো মেঘ
কানাগলি ধরে হেঁটে হেঁটে বেপাড়ায়
খুঁজছিল নিরিবিলি নদীতীর
পথ শেষ হয় অন্ধকারে
জানালায় ছিন্ন পর্দা, পর্দা উৎসবে।
পরিরাও কুঞ্জে ফেরে
কেন যে আসে ওরা, কোথা পাব আরও মেওয়া
গহিনে আজও বাজে ঝুমুরের ধ্বনি,
পরিরাও শিখে গেছে দেওয়া-নেওয়া,
ধূলির পৃথিবীর নারীরা পথঘাট ভোলে
বাড়ি ফিরে গিয়ে করজোড় ক্ষমা চায়,
কেউ কেউ গোখরার ঝাঁপি খোলে।
পরিরাও কুঞ্জে ফেরে, গোপনে সুরায় নেই মানা
সুরার চুমুকে সুগন্ধী বিষ, পরিরা তা জানে না,
নেশার ঘোরে মানুষের অস্পষ্ট মুখ
পৃথিবীর সব বাগানে ছাদে অলীক জ্যোস্না-সুখ।
পরি জানে না বিষ আর অমৃতের তুলনা
কষ্ট খুব পায়, বুক জ্বলে খাক হয়,
ঝুড়ি ভরা ছিল মেওয়ায়; গ্লাস ভরা ছিল জলে
মাটিতে নামছে নিশাচর, পরিদের অগোচরে
পিরানারা সাঁতরায় শান্ত সরোবরে।
মেওয়া নষ্ট, জল বিষাক্ত মানুষই তার হেতু
পরিরা বাঁচুক, থাকুক পরাবাস্তবের সেতু।
Leave a Reply
Your identity will not be published.