বিদায় আহমদ রফিক

বিদায় আহমদ রফিক

ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ প্রয়াত আহমদ রফিককে আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা শেষে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মরদেহ বারডেম হাসপাতালে দান করা হয়। উল্লেখ্য, রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) গত ২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, রাত ১০টা ১২ মিনিটে আহমদ রফিক ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।

আহমদ রফিক ছিলেন বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। সেই সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে তিনি সেখান থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জীবনসদস্য। কয়েক বছর ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। ২০১৯ সাল থেকে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে শুরু করলে অস্ত্রোপচার করা হলেও ফল আশানুরূপ হয় নি। ২০২৩ সাল থেকে তিনি প্রায় দৃষ্টিহীন। ২০২১ সালে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকে। অবশ্য চিকিৎসা চলছিল। কিছুটা সুস্থও হয়েছিলেন। কিন্তু গত মাসে শারীরিক অবস্থা অবনতি হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। গত ১ অক্টোবর, বুধবার, বিকেলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বারডেম হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. কানিজ ফাতেমার তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিডনির সমস্যার পাশাপাশি সম্প্রতি কয়েকবার তাঁর ‘মাইল্ড স্ট্রোক’ হয়।

আহমদ রফিক নিউ ইস্কাটনের গাউসনগরের একটি ভাড়া বাসায় একাই বসবাস করতেন। ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে জন্ম নেওয়া এই ভাষাসংগ্রামী ২০০৬ সালে স্ত্রীকে হারান। তিনি নিঃসন্তান।

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাবন্ধিক ইতিহাসবিদ এই লেখক শতাধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি জীবন (১৯৫৮), আরেক কালান্তরে (১৯৭৭), ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য (১৯৯১), রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প (১৯৯৬), রবীন্দ্রভুবনে পতিসর (১৯৯৮),  কবিতা আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা (২০০১), রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায়, মৃত্যুহীন বিপ্লবী চে-গুয়েভারা (২০১১) ইত্যাদি। কবিতাগ্রন্থের মধ্যে নির্বাসিত নায়ক (১৯৬৬), রক্তের নিসর্গে স্বদেশ (১৯৭৯), বিপ্লব ফেরারী, তবু (১৯৮৯), নির্বাচিত কবিতা (২০০১) ও ইচ্ছামতির ঘরে উল্লেখযোগ্য। গল্পগ্রন্থ : অনেক রঙের আকাশ (১৯৬৬)। এছাড়া তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক কয়েকটি বই লিখেছেন, অনুবাদও করেছেন। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যপত্র ‘নাগরিক’ ও ‘সুজনেষু’। কয়েকটি মেডিকেল জার্নালও।

আহমদ রফিক পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। দুই বাংলার রবীন্দ্রচর্চায় তাঁর অবদান অনন্য; কলকাতার টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে তাঁকে দেওয়া হয় ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি।

আহমদ রফিক ছিলেন ‘অন্যদিন’ ও ‘অন্যপ্রকাশ’ পরিবারের একান্ত আপনজন। তাঁর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রকাশক অন্যপ্রকাশ। বইগুলো হলো-নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০২), রবীন্দ্র-সাহিত্যের নায়িকারা : দ্রোহে ও সমর্পণে (২০০৩), বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ (২০১২), রবীন্দ্রনাথ, ‘গীতাঞ্জলি’ ও নোবেল পুরস্কার (২০১৫), শিশুদের রবীন্দ্রনাথ (২০১৬), কিশোরদের রবীন্দ্রনাথ (২০১৬), নির্বাচিত রবীন্দ্রনাথ (২০১৬), ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের কথা (২০১৭), কিশোরদের নজরুল (২০১৭), জীবনানন্দ : কবি প্রেমিক ও গৃহী (২০১৮)। এই গ্রন্থটি ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জীবনানন্দ দাশ : সময় সমাজ ও প্রেম’ নামে।

আহমদ রফিক প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক। তিনি বেঁচে থাকবেন এদেশের মানুষের হৃদয়ে, চেতনায়। বেঁচে থাকবেন ‘অন্যদিন’ পরিবারের সদস্যদের কাছে।

তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.