সাম্যবাদী আদর্শের মানুষ সলিল চৌধুরী। যিনি গানে গানে মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। উপমহাদেশের সর্বকালের সেরা সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। গানের কথা, সুর, চলচ্চিত্রের নেপথ্য সঙ্গীত, সবকিছুতেই তিনি এক উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন, যা যুগ-যুগ ধরে বেঁচে আছে।
সলিল চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর আসামের রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজীপুরে। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন আসামের লতাবাড়ি চা বাগানের ডাক্তার। তিনি সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। তাই বাবার কাছেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয় সলিল চৌধুরীর। পরবর্তীতে নিখিল চৌধুরীর কাছেও তিনি সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তখনই গান লিখতে ও সুর করতে শুরু করেন সলিল চৌধুরী। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে ‘বিচারপতি’, ‘রানার’ এবং ‘অবাক পৃথিবী’র মতো গান। যা তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সলিল চৌধুরী ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্র, ২৬টি মালায়ালাম চলচ্চিত্র, বেশ কিছু মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তার ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান বাংলা সঙ্গীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০-২২ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল।
চলচ্চিত্র ও তিনি রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। তার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘পরিবর্তন’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত দো বিঘা জমিন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে চিম্মিন দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক সলিলের মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
মনে রাখার মতো অনেক বাংলা ছবিতেই কাজ করেছেন সলিল। তবে বাংলায় তাঁর প্রথম বড় ব্রেক 'পাশের বাড়ি' (পরে যা হিন্দিতেও তৈরি হবে 'পড়োশন' নামে, যথারীতি ইতিহাস সৃষ্টি করে) এই ছবিতে গান গেয়ে বাঙালিকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। বাংলা ছবির দর্শক সেই প্রথম সলিল চৌধুরী ম্যাজিকের স্বাদ পেল। তখনকার প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এসব গান গেয়েছেন। লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
তার ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘মহাভারতী’ যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। সলিল চৌধুরীর ছোট গল্প ‘রিকশাওয়ালা’ অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তার কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে, যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। সলিল চৌধুরী সেরা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ১৯৫৮ সালে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। এছাড়া, ১৯৮৮ সালে তিনি সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই বিস্ময়কর বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মানুষটির মহাপ্রয়াণ ঘটে। কিংবদন্তি শিল্পী সলিল চৌধুরীর সুর বিশ্বকে মিলিয়ে দিয়ে করে তুলেছেন বিশ্বজনীন। তাঁর গানে জলোচ্ছ্বাসের শব্দ রয়েছে, যা যুগ যুগ ধরে ধ্বনিত হবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.