সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে

সম্ভ্রম যখন অশ্লীল হয়ে ওঠে

মধ্যরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর যদি দেখা যায়, বাইরে তুমুল বৃষ্টি, তাহলে যা হয়, পুরো জীবিত পরিবেশ মুহূর্তে বেষ্টন করে ফেলে স্বপ্নের জগৎ।

আমারও হয় সেই দশা, নিজেকে চিমটি দেয়ার কথা ভুলে যাই, মনে হয় খিকখিক শব্দে খুলে গেল জানালার পাল্লা, বৃষ্টির ঝাপটা নয়, এ সহস্র গোখরোর হিসহিস।

আর আমি, যেন গোরস্থান ফুঁড়ে মাথা তুলেছি প্রেত শব, এইভাবে শরীরের ধুলো ঝাড়তে থাকি।

মেঝে হাতড়ে বাতি জ্বালিয়ে সুস্থির হই।

ভয় তাড়াতে নিজেকেই চেপে ধরি।

সারাঘর খালি। রাণু শুয়েছিল আমার পাশেই। বিছানা শূন্য। তখন সেই ছায়াগুলোর কথা মনে পড়ে।

একজন, দুইজন, তিনজন- তারপর মনে নেই। না ঠিক ছায়া নয় তারা। কড়া রোদের আলোয় প্রত্যেকের মুখ জ্বলজ্বল করছিল। শুধু রোদের বিপরীত আভায় ভেসে যাচ্ছিলাম আমিই।

এই বৃষ্টির রাত্তিরে রাণুকেও কি তারা টেনে নিয়ে গেছে?

এরপর আমার সারা দেহের, মনের নানা স্রোত, নানা রঙ গিয়ে মিলিত হয় এক বিন্দুতে- নাহ্! এরপর আর বাঁচা যায় না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সহজতম শান্তি মৃত্যু।

তখনই, যেন ছায়া ঘরে ভূতের মতন আবির্ভূত হয় রাণু। পায়জামার নেড়ির গিঁট খুলতে পারছে না।

বলে, বাথরুমে গেছিলাম। এরপর এমন গিঁট আটকে গেল, দেখো তো চামড়ায় কেমন বসে যাচ্ছে!

আমার শরীর হাঁপ ছেড়ে দেয়ায় মাথা ব্যথা অনুভব করি।

রাণু বলে, তোমাকে এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন?

বিছানায় এলিয়ে পড়তে পড়তে ফিসফিস করি- কাগজের রঙ তো অমনই, এরমধ্যে দেখছিস না কেমন দোমড়ানো, এরচেয়ে আর কী ভালো দেখাবে?

রাণু ভেঙে পড়ে- তোমাকে বাঁচানো আমার সাধ্য নেই! তুমি ওই অসভ্য লোকগুলোর পক্ষের লোক। ওদেরকে তুমি জিতিয়ে ছাড়বে।

এরপর থেকে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে- মৃত্যু। যখন নিশ্চিত টের পেয়ে যাই, আমিই আমার হত্যাকারী, তখন জীবন আমার কাছে হয়ে ওঠে পরম প্রত্যাশিত। ক্রমান্বয়ে জীবন এবং মৃত্যুর যুদ্ধটা আমার কাছে এমন মর্মান্তিক হয়ে ওঠে, আমি আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য মুখে রক্ত তুলে ফেলি। আমি পালাই, হুমড়ি খেয়ে পড়ি, আবার নিজেকে খপ করে ধরে ফেলি। ধরে, নাকের ডগায় পিস্তলের নল ঘুরাতে থাকি, যেন রসিয়ে মারব, এই সংকল্প করে ফের ছেড়ে দিই।

বেঁচে আসার পর আমার সর্ব অস্তিত্ব থরথর কাঁপতে থাকে। আমার চারপাশ থেকে খসে যাবে একটি পৃথিবী, আমি খসে যাবো, পৃথিবী দাঁড়িয়ে থাকবে তার জায়গায়- লক্ষ কোটি বছর এতে উদ্দামতা থাকবে, গান থাকবে, আমার কঙ্কালের ছিটেফোঁটা কষও কোনো ধুলিকণায় থাকবে না। বড় বাঁচতে সাধ হয়। শুধু বাঁচতে নয়, লোভ এমন লেলিহান হয়ে ওঠে, মনে হয় যতদিন পৃথিবী আছে, ততদিন না বাঁচতে পারলে এই মুহূর্তে মৃত্যুই শ্রেয়। আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর পতন ঘটুক, এতেই আমার মৃত্যু উল্লসিত হবে। সেই ধ্বংসের সাথে সাথে বিলীন হয়ে যাবে সেই ক’জন জন্তুর ভয়াল শিশ্নগুলি, যা লোভার্তু হয়ে ছুরির মতো আমাকে বিদ্ধ করে মুহূর্তের মধ্যে আমার জীবনের বাস্তবতা পাল্টে দিয়েছে।

এরপর আবার লাল নীল বলের মতন অসুখগুলো আমাকে গ্রাস করতে থাকে।

রঞ্জুকে ভালোবাসতাম।

সে আমার এই পতনের সঙ্গী হয় নি- এটাই স্বাভাবিক। মামুলি এই গল্প এই দুই লাইনেই শেষ হয়। কিন্তু আমার সেই পতনের পর সাতদিনের মাথায় তার তড়িঘড়ি করে বিয়ে করে ফেলাটা কিছুতেই আমার কোনো বিশ্বাসের সাথেই মেলে না।

এই নির্লজ্জ পোশাক পরিহিত উলঙ্গ দেহটা নিয়ে এক সন্ধ্যায় তার বাড়ি গিয়েছিলাম। ওদের বাড়িটা চিরকালই জরাজীর্ণ, ক্ষয়িঞ্চু। কোন অমোঘ টান আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল জানি না। আমার পায়ের শব্দে চিরকালের স্থির ব্যক্তিত্ব রঞ্জুর সারা অস্তিত্ব কেঁপে উঠছিল। তার স্ত্রীর চোখে ঘৃণা দেখব, তাচ্ছিল্য দেখব, এ-ই আমার প্রত্যাশিত ছিল। ঘৃণা, মানুষের অস্বস্তি, যাবতীয় কুশ্রী উক্তিতে এতই অভ্যস্ততা এসে গেছে, মাঝে মাঝে এর তৃষ্ণা অনুভব করি। মানুষ মরে ভূত হলে পচা মাছ-গন্ধ খাবার খায়, ভালো খাদ্যে বমি আসে। যাবতীয় ভূতের গল্প আমার পৃথিবীতে বাস্তব হয়ে ওঠে। আমি সেই নিষ্ঠুর ঘৃণা গেলার প্রত্যাশায় সেই সন্ধ্যায় রঞ্জুর ওখানে গিয়েছিলাম। রঞ্জু শান্ত কণ্ঠে বলেছিল, এই অবস্থায় তোমার বেরোনো ঠিক হয় নি।

আমি নিষ্পলক চেয়েছিলাম।

তুমি শক্ত হও, মনের বল বাড়াও- সে যখন এইসব বলছিল, শ্যাওলা পড়া সিঁড়ির ওপর নেমে মোমবাতি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল তার স্ত্রী। শাদা, পাণ্ডুর মুখ। যেন সে কোনো নারী নয়, কোনো ঘৃণিতা নয় অদ্ভুত অলৌকিক কিছু দেখছে এই রকম বিস্মিত কিন্তু স্থির চোখে আমার দিকে চাইল।

মনে হচ্ছিল, একটি লাশ খাড়া হয়ে আছে।

রঞ্জু ভয়ানক অস্বস্তি নিয়ে বলল, আমার স্ত্রী।

জবাবে সেই লাশের মতন নারী এমন অদ্ভুত কণ্ঠে ‘ভেতরে আসুন’ বলল, আমি উদ্ভ্রান্তের মতন রীতিমতো সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। রঞ্জুর সাথে আমার এক অসাধারণ গভীর সম্পর্ক ছিল। সে একটি শাদামাটা মেয়েকে তার প্রজ্ঞা দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, অনুভূতি দিয়ে নির্মাণ করেছিল। সে কবিতা লিখতো। আমি হয়তো তারই এক অশরীরী উপকরণ ছিলাম। যারা কবিতা লেখে তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক কোমলতাও থাকে, সেই কোমলতা তাকে পরলুটহরণকারী, সন্ত্রাসী করে না যেমন সত্যি, জীবনের দৃঢ় বাস্তবতার সামনে দাঁড়াতে কখনো কখনো তাকে ভীত করে তোলে, সেটাও সত্যি।

সেই মহিলার সেই সন্ধ্যার হিমরূপ দেখে মনে হলো, ভীত রঞ্জুর প্রাণের উত্তাপ থেকে সেই মহিলাও বঞ্চিত। সে এক অর্থে আমার মতনই দুর্ভাগা। আমি নই, এই ঘৃণ্য চক্রের সবচাইতে বড় শিকার হয়েছে রঞ্জুই।

ফের আমার বাঁচার সাধ জুড়িয়ে এলো।

আছড়ে পড়ি, কেন বলেছিলে রঞ্জু, মানুষের কাজ তাকে তৈরি করে পরিবেশ তৈরি করে ব্যক্তিত্ব? আমার সব কিছু কী রকম এক ফুৎকারে নিভে গেল! কঠিন বাস্তবতার পেষণ ছাড়া আর কিছু নেই আমার সামনে। কেন তোমার নির্মিত কথাকে জীবনের সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম?

নিশি... নিশি...

কোন কিশোর জগৎ থেকে ডাক ওঠে! যেন আমাকে ছি কুত কুত খেলার জন্য ডাকছে। হকচকিয়ে মাথা তুলি। সেই কিশোর বয়সে যখন প্রতিটি বিকেলের কোলাহলের আমিও অংশ হতাম, তখন থেকে আজ অব্দি আমি যখন যেখানে থেকেছি, সেই একই শব্দ নানা বর্ণে কানের কাছে ঝুলতে শুনেছি। যখন কৈশোর পেরিয়েছি, কী শীতে কী গ্রীষ্মে জানালা দিয়ে হয়তো তাকিয়ে দেখেছি আশেপাশে শুধু অট্টালিকা, এক চিলতে আকাশ নেই, এক ফিকে মাঠ নেই। তবুও সেই ছায়াচ্ছন্ন বিকেল জুড়ে কোত্থেকে ভাসছে সেই একই কোলাহল, একই ধ্বনি, একই উচ্ছ্বাস। না, এ কল্পনা নয়, এ নস্টালজিক কোনো অনুভব নয়। প্রতি প্রজন্মের কিশোরের বিকেলের ধ্বনিটি এক। একটি বয়সের প্রান্তে গিয়ে এই বাস্তবধ্বনি একটি বিকেলকে কল্পনার মতো বেদনার্ত করে তোলে। টের পাই, সন্ধ্যা আসছে। আগরবাতির ভয়াল ঘ্রাণ! মাটি খুঁড়ে নিঃসীম আঁধারে আমাকে ফেলে যাচ্ছে কারা।

নিশি... নিশি...

মা ডাকছে, উকিল সাহেব এসেছেন! একটু এই ঘরে আয়তো!

ড্রয়িংরুমে যাওয়ার পর সেই একই কথার নানা রকম প্যাচ। আমার জীবনে এখন শ্লীলতা বলে কিছু নেই। গত কয়েক মাসে আদালতে, প্রতিবেশীদের সামনে, উকিলদের সামনে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতি মুহূর্তে নগ্ন হয়েছি। যে বাবা মা ভাই বোনের সামনে প্রেম শব্দটি উচ্চারিত করতে মুষড়ে যেতাম, তাদের সামনে ক’জন পুরুষকে কেন্দ্র করে আমার অভিজ্ঞতার যে অনায়াস, যে সাবলীল বর্ণনায় আমাকে যেতে হয়েছে, এখন আমার চারপাশে সম্ভ্রমই একটি অশ্লীল শব্দ। আমি ইচ্ছে হলে উকিলকে সাহায্য করতে অথবা আদালতেই নিজেকে উন্মুক্ত করে প্রতিটি স্থান দেখিয়ে বর্ণনা বহুলভাবে বলতে পারি, সংজ্ঞা হারানোর আগ পর্যন্ত আমার কোন স্থান কীভাবে অত্যাচারিত হয়েছে। যাতে আর দ্বিতীয়বার আমাকে এইসব বস্তাপচা প্রসঙ্গ কপচাতে না হয়।

অথবা, ওই অবদমনের ভারে কাতর পুরুষগুলোকে, যারা দীর্ঘ ক্ষুধার্তে পাগল ছিল, ওদের ক্ষমা করে দিতে পারি।

এই কথা বলতেই রাণু হামলে পড়লো। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? দুনিয়াসুদ্ধ লোক জানার পরে এ হয়? তুমি এমন মুষড়ে পড়ছো কেন? তোমার আর হারানোর কী আছে?

এমন বেদম হাসি ঠেলে ওঠে।

সব হারিয়ে ফেলেছি? তাহলে আর মানুষের শত্রু হওয়া কেন? সবই যদি হারিয়েছি আর কী পাবার আশায় এই নিরন্তর ঘর বাহির করছি?

সতীত্ব!

সে তো আমি রঞ্জুর কাছেই প্রথম হারিয়েছি। যেটা ঢাকঢোল পিটিয়ে হয়, সেটাতেই কেবল বুঝি মানুষ হারায়? আজ যদি ওই ঘটনা না ঘটতো! রঞ্জুর সেই স্মৃতি নিয়েই অন্য কারো সংসারে যেতাম, সেই সংসারের কোনো নিঃশ্বাসের শব্দও টের পেতো, আমি কিছু হারিয়েছি?

তবে আমি কী হারালাম?

বিছানায় খামচে ধরি, গলা দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ হয়, হাতের কাছে যা পাই ছুড়ে ফেলতে ফেলতে এক সময় এলিয়ে পড়ি।

এরপর মৃত্যু তাড়া করে।

আমি ভয়ে বিবমিষায় ছটফট করে জীবনের তলায় আশ্রয় নিই। দেখি, পাতলা শাদা চাদরে আমার দেহটা ঢেকে দেয়া হলো। সবচেয়ে ভয়াবহ বিছানায় আমার সেঁটে থাকা। এরকম সেঁটে থাকলে মৃত্যুকে স্পষ্ট দেখা যায়। এই রোগ আমার দীর্ঘদিনের। বিশেষত ঘোর বর্ষায় প্রাণের ভেতর ঠাণ্ডা ঢুকলে পৃথিবীর সব নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে। নিজেকে না জীব না জড় মনে হয়। শিরশিরে একটা অনুভূতি শিরদাঁড়া অতিক্রম করে পায়ের পাতা অব্দি ছুটে চলে।

এখন এটা রীতিমতো প্রাণান্তকর পর্যায়ে চলে গেছে। চাদর ছুড়ে ওঠে বসি। বাইরে তো বৃষ্টি নেই। কোত্থেকে ঢুকছে এত শীত?

রাণুর বন্ধুরা এসেছে।

ড্রয়িংরুমে আড্ডা হচ্ছে। ওদের কণ্ঠে হাসি আছে, প্রাণ আছে। ওদের সত্তার ভেতর আমার মতন একজন আত্মঘাতক নেই। ঈর্ষায় মুষড়ে পড়ি। ওই উচ্চকণ্ঠ ওই হাসি তীব্র শীতের চেয়েও ভয়াবহ। আমি সুন্দর কিছু ভাবতে চেষ্টা করি। কিন্তু কম্পিত দেহ ঠেসে যায় বিছানায়। কী রকম চক্কর খাচ্ছে ছায়া। তার মধ্যে সমস্ত পৃথিবীটা বেলুন হয়ে উড়তে থাকে। চারটিকে ফের গায়ে টেনে তুলে দেখি এর রঙ ফ্যাকাশে। সেই মোমবাতি হাতে দণ্ডায়মান রঞ্জুর স্ত্রীর মতো। আশ্চর্য মহিলার মুখ। চামড়ার নিচে শুধুই দুধের স্রোত। মনে হচ্ছিলো, গায়ের যে স্থানেই খোঁচা দেয়া হোক, শাদা মাংস কিংবা শাদা তরল জল ফিনকি দিয়ে বেরোবে। যেভাবে তাকিয়েছিল, মনে হচ্ছিল, কবর থেকে উঠে এসেছে। রঞ্জুও আমার মতন একজন মৃতাকেই বিয়ে করেছে। তাহলে আমাকে পেছনে ফেলে যাওয়ায় ওর আত্মতৃপ্তি কোথায়?

সামাজিক যুদ্ধ থেকে মুক্তি।

আর?

ওর স্ত্রী শুদ্ধ।

কিন্তু রঞ্জু যে আমার দ্বারাই অশুদ্ধ হয়েছিল? ও সেদিন সেই ঘোরগ্রস্ত মুহূর্তে উচ্চারণ করেছিল, এই আমরা পুণ্যে প্রবেশ করলাম। আমার মাথা খারাপ হয়ে ওঠে। আমি সেই ধর্ষক লোকদের দলে রঞ্জুকে ফেলে মনে মনে ফের মামলা দায়ের করি, জজ সাহেব, ওই যে কবি কবি চেহারার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ লোকটা, আমাকে ওই প্রথম।

মৃত্যু তাক করেছে আঙুল।

বাঁচাও বাঁচাও বলে উঠে বসি। এই ঘরে কেউ নই কোনো? কোনো জ্বর না, রক্তপাত না, শুধু একটা শিরশিরে অনুভূতিকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে মরে গেলে পাশের ঘরের লোকগুলো যে মরণ কোরাসে মেতেছে অন্তত বিস্ময়ের ঘোরে হলেও কি তাদের কণ্ঠ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হবে?

আয়... ফিসফিস করে ডাকতে ডাকতে সে বহু বছর আগে আমাকে জঙ্গলের ভেতর টেনে নিয়েছিল সৃতিলতা। সব কিছুতেই ও রহস্যের গন্ধ পেতো। ঘন জঙ্গলের ভেতর গিয়ে আমাকে বলেছিল, শ্বাস টেনে দেখ গাছ গাছালির মধ্যে দুর্গা পুজোর গন্ধ পাস কী-না?

দুর্গাপুজোর আবার গন্ধ কী?

আছে, আছে, স্মৃতিলতার সে কী রোমাঞ্চকর মুখ! সন্ধ্যায় দেবী এসে জঙ্গলে বসেন। সঙ্গে সঙ্গে গাছগাছালির মধ্যে পুজোর উৎসব শুরু হয়। কেউ দেখে না, আমি দেখি।

এরপর সে আরো দূরে, ভগ্ন মন্দিরে আমাকে দেখিয়েছিল কী ভয়ানক, মিশকালো শিবলিঙ্গ।

যমের ঘোরে বিড়বিড় করি, আমি দেখেছি স্মৃতিলতা এর রূপ। কী বিচিত্র, কুৎসিত, মর্মান্তিক ছুরির মতো।

রঞ্জুর সাথে অনুভবের সময় কী মিথ্যা ঘোরে একে আমার অপার্থিব মনে হয়েছিল। যে-ই খোলস খুলে গেল, দেখলাম এর বিকট আসল চেহারা।

সম্ভবত তন্দ্রা এসেছিল।

বাতাসের ধাক্কায় চায়ের কাপটি মেঝেতে আছড়ে পড়ে। ধড়ফড় কর উঠে বসি।

মা ছুটে আসে, সেই পুরনো একঘেয়ে কান্নার সুর তুলেন, এইসব দেখার আগে আমি বিষ খেয়ে মরলাম না কেন? তোকে আমি কোথায় লুকাই?

এদের সহমর্মিতা আছে, মায়া আছে। কিন্তু আমার শরীরের ঘিনঘিনে ঘৃণা এদের শরীরে এমনভাবে লেপটে গেছে, এঁরা ঠিক কীভাবে বাঁচবে, সে পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আচ্ছা? আমার মা কি অবচেতনে প্রত্যাশা করেন না কোনো একটা অঘটনে যেন আমার মৃত্যু হয়? তাহলে এই ধিকৃত ঘিনঘিনে জীবন্ত শবকে সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর হাত থেকে মুক্তি?

কেন এইভাবে ভাবছি?

মায়ের স্তনপান থেকে শুরু করে তার প্রতি মুহূর্তে নিঃশ্বাস মাখা বর্ণ গন্ধ শুষে এই আকৃতিতে রূপান্তরিত হওয়া, আমার কোনো বিপর্যয়ে পৃথিবীর আর কেউ স্বার্থপর হলেও, আমার মা কী করে হয়? আমি কেন তার অসহনীয় বেদনাকে ভার মনে করছি?

সেই সন্ধ্যার পথটি এগিয়ে আসে।

আমাকে রঞ্জু হাঁটতে হাঁটতে বলেছিল, সন্ধ্যা হলো দিনের সবচেয়ে পরিণত, প্রাজ্ঞ সময়।

আমি বলেছিলাম, কেন বলছ না, দিনের মৃত্যুর সময়?

নিশি, জীবনকে কখনও এভাবে দেখো না।

শেষ যেদিন এসেছিল, আমার তখন অসংলগ্ন, বেসামাল অবস্থা। ওর হাতটি এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছিলাম, যেন সেটা সমুদ্রের মাঝখানে ডুবতে ডুবতে পেয়েছি।

দাঁতের চাপে ওর ঠোঁটে রক্ত এসে গিয়েছিল। ক্রুর মুখে চেপে ধরেছিল আমার গলা, আমার সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করার কোনো অধিকারই কারো নেই। ওর আঙুলের চাপে যখন আমি অন্য এক আতঙ্কে তীব্রভাবে পিষে যাচ্ছি, তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে কী অর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলাম, মৃত্যুকে দেখেছ?

পরদিন ঘুম ভেঙে দেখি বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে, নিজেকে টেনে হিঁচড়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। প্রতিটি রোদ তরঙ্গের বৃক্ষে তন্নতন্ন করে খুঁজি কোথায় আমার জীবনের স্পন্দন, মুক্তি কোথায়? যেন আমার দেহটা খুলে পড়লো ঝুল বারান্দায়। এখন শুধু মন দাঁড়িয়ে আছে। পরিত্যক্ত দেহটি ছেড়ে যখনই মন ওপর দিকে উঠতে চাইলো, তখনই দেহ তাকে টেনে নিলো। সর্ব অস্তিত্ব এক হতেই রোদের মধ্যে বিটকেলে দাঁত বের করলো মৃত্যু। ছুটে ঘরে ঢুকে দেখি, কে এক যুবক বসে আছে চেয়ারে।

রোদঘোর কেটে গেলে- রঞ্জু।

আমাকে পরামর্শ দেয়, তুমি অন্য কোন শহরে চলে যাও, হোস্টেলে থাকবে, পড়বে।

আমি হেসে ফেলি, তুমি চিরকালই পলায়নবাদী।

তুমি নিজেও, রঞ্জু বলে, এ যুদ্ধটা তোমার জন্য সহজ নয়, তাই শুধু উন্মাদ হতে বাকি আছে তোমার। এমন জায়গায় যাও, যেখানে পুরনো ক্লেদ স্পর্শ করবে না।

আমি বলি, সব ক্লেদ আমি হারাতে চাই না। বিশেষ করে তোমাকে কেন্দ্র করে যা আমি সংগ্রহ করেছি।

তার কণ্ঠ বিপন্ন শোনায়। চলো আমরা পালিয়ে যাই।

মুহূর্তে আমাকে আক্রান্ত করে সেই শব্দ। তার তাৎক্ষণিক আবেগ রোগে আমিও অবশ হই। পরক্ষণেই মাকড়সার জাল বিছানো ধূসর ভেজা ঘর থেকে ঝাপসা বারান্দায় এসে দাঁড়ানো তার স্ত্রীর মুখ মনে পড়ে।

সেই মহিলার চোখে মৃত্যু ছিল, কেন? এরপর আমার হত্যাকারী ছুরি শাণাতে থাকে। সবাই মরে যাক। সেই ধ্বংসস্তূপে যখন আমি দাঁড়িয়ে থাকব একা, তখন আমাকে ছায়া দেবে শুদ্ধতা। আমার নির্দাগ শরীর দেখিয়ে কেউ বলতে পারবে না, আমি কলুষিত। তখন আমার ওপর যে অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে, তার মর্যাদা পাল্টে যাবে। সেই নিঃসঙ্গ প্রকৃতি এই অত্যাচারকে দেখবে জ্বলন্ত রড দিয়ে প্রহার করার দৃষ্টিতে।

তারা ঘৃণায় বিষিয়ে উঠে ভাববে দুজনের ছেড়ে দেয়া ঘিনঘিনে বিষাক্ত বীর্যের ভেতর কী করে প্রবেশ করে তৃতীয় জন? ওই মানুষটা নিজের কাছে কি এতটাই অসহায় যে, সে কখনো নর্দমার মল পর্যন্ত পান করতে বাধ্য হয়?

বলবে, আহারে, মেয়েটাকে কী মারটাই না মারলো!

তখন একজন নারীর হাত, মুখ, চুল, স্তন- সব হয়ে উঠবে এক মর্যাদার চামড়ায় ঢাকা মাংস। হ্যান্ডসেক করার মতন হবে দুটি মানুষের মিলিত হওয়ার দৃশ্য। ফলে অস্বাভাবিক কোনো অত্যাচার, যা যৌন, যাতে একটি মেয়ে জ্ঞান হারায়, তার প্রতি বেদনা প্রকাশে কারও কোনো আলাদা রোমাঞ্চ থাকবে না।

আমি রঞ্জুকে বলি, তুমিই একদিন বলেছিলে, মানুষ সবচেয়ে বিপন্ন একটি জায়গাইতেই, সে কী চায় তা সে জানে না। তুমি এখন যাও, বড় করুণা হচ্ছে তোমার জন্য।

রঞ্জু চলে গেলে দেখি, রাণু মরিচ গাছে জল ঢালছে।

আমি দেখি, প্রাণভরে দেখি রাণুকে, যেন রাণুকে নয়, কোন মৃত্যু তাকিয়ে দেখছে জীবনের অদ্ভূত সঞ্চালন।

আমি ডুকরে কেঁদে উঠি।

আমার চারপাশে সব সময়ই ছিল অসংখ্য গাছ। এর মধ্যে একটি ছিল দীর্ঘ। আমাকে ছায়া দিতো। সেই দীর্ঘ গাছটি উপড়ে পড়েছে। আমার চারপাশের প্রতিবেশী গাছ লতা বাড়িয়ে নিন্দায়, অবহেলায় আমার শ্বাস আটকে ধরছে। এরমধ্যে আমার দ্বৈত সত্তার শক্তিশালী অংশটি আমার হত্যাকারী। প্রায়ই আমি নিজেকে হত্যার নানা সহজ কৌশল খোঁজার রোমাঞ্চে বিভোর থাকি।

ঘরের ঘুরন্ত ফ্যান, গ্যাসের আগুন, বাথরুমের শাওয়ার সব আমার হত্যাকারী। এদের হাত থেকে পালাতে পালাতে বিছানায় নিজেকে ঠেস দিতেই সেই ভয়ানক রোগ। দেহকে শিরশিরে অনুভূতিতে ডুবিয়ে ওপর দিকে ঠেলে দেয়। উঠে বসতেই চক্কর খায় মাথা। পুনরায় এলিয়ে পড়ি। রঞ্জুর স্ত্রী শাদা চোখে চেয়ে থাকে। তার চোখে ঘৃণা খোঁজার তৃষ্ণায় আমার অন্তরাত্মা ছাড়খার হয়ে যায়। এরপর বাঁচতে ইচ্ছে করে। লক্ষ, কোটি বছর। পৃথিবীর কোথাও এক সময় আমার কোনো চিহ্ন থাকবে না- এই বোধ আমাকে উন্মাদ প্রায় করে তোলে।

স্লিপিং পিল খেয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি।

চারপাশে অসংখ্য মুখ। সবগুলো ঝুঁকে পড়েছে আমার চোখের ওপর, কেউ কেউ বলে, মাথা তুলে দাঁড়াও। যে বাবাকে গত কয়েক মাস বাসায় ফিরতে দেখিই নি প্রায়, তিনি শিশুর মতন আমার দেহকে কোলে তুলে নেন, এরপর জলে ছেড়ে দেন।

আমি সাঁতার কাটি।

মা বলে, তুই শুদ্ধ হয়ে আয়।

ঘুম ভাঙলে ব্লেড দিয়ে হাত ছিঁড়ে ফেলি। কী অপূর্ব বিন্দুরক্ত! চেতনা ফিরতেই ওড়না চেপে ধরি। জানালায় মুখ বাড়িয়েছে ঘাতক। আমি সম্পূর্ণ পোশাক খুলে তাকে দেখাই, কেন হত্যা করতে চাও? কোথায় আমার দাগ?

তোমার আত্মায়।

সে ভার তো আমিই বহন করছি। কেন তোমাদের এত ধিক্কার? আমি কি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত? কেন সবাই সটকে পড়েছে।

দরজায় শব্দ হয়।

খুলে দেখি সৌম্য সুন্দর একজন যুবক। চোখে চশমা। পেছনে রাণু, মা। কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝি, এ আমার মানসিক চিকিৎসা করতে এসেছে। সে বোঝায়, কেন আমি মৃত্যু চাইছি, সতীত্বের হাস্যকর কনসেপ্ট পৃথিবী থেকে বহু আগেই বিলুপ্ত হয়েছে, এইসব এইসব।

তার এই তত্ত্বকথা কি আমার আগের জীবনকে ফিরিয়ে দেবে?

সে বলে, আশ্চর্য সুন্দর চোখ আপনার। জীবনের এই রূঢ় অভিজ্ঞতা সম্বল করে জীবনকে নতুন করে দেখুন। জীবন তো নিরন্তর পাল্টায়, হাজারো ঘাত প্রতিঘাতে, কেউই কি তার আগের মুহূর্তে জীবনটা ফিরে পায়? আনন্দ, বিপন্নতা সঙ্গী করে জীবন সামনে এগোনোর জন্যই।

রাতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়। জীবন সামনে এগোনোর জন্য? না, জীবন, মৃত্যুর দিকে এগোনোর জন্য- আসলে এটাই সত্য। ওইসব নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মিথ্যা সব ফাঁপানো প্রলোভন। এরপর নিজের কণ্ঠনালি নিজেই চেপে ধরি। ওই বধ্যভূমিতে যারা আমার শব ছিঁড়ে খেয়েছিল তাদের মুখ প্রলম্বিত হয়।

রাণু দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

দেয়ালে মাথা ঠুকতে থাকি। কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়াই। লুকিয়ে রাখা কীটনাশক জিভে ঢালতে যাওয়ার মুহূর্তেই বড় মায়ায় জীবন এগিয়ে আসে। আমার মৃত্যু এবং পৃথিবীর মৃত্যু সমান হয়ে ওঠে আমার কাছে।

আমি মরব, আর ওই কুৎসিত ঘৃণ্য মুখগুলো সদর্পে নাচবে এই পৃথিবীর ওপর? কোনো ছায়া থাকবে না, কোনো পালক থাকবে না আমার এই পৃথিবীর কোথাও? সেই আমাকেই কেন আমি এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি?

পরদিন সকালে আমি যখন সারি সারি বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে সুস্থির মাথা তুলে হাঁটছি, কাঁধে ব্যাগ, কষে চুল বাঁধা, তখন দেখি প্রকৃতিতে অদ্ভুত এক হাওয়া উঠেছে।

মনে হচ্ছে এই পথ ধরে কোনোদিন হাঁটি নি। এই নতুন বিপন্ন পৃথিবী আমাকে শোনালো, কখনো আগের মুহূর্তটি ফিরে পাওয়া যায় না, আগের জীবনও না।

যে নিঃসঙ্গ- তার ভেতর বাস করে হাজারজন। তাদের সাথে আমার পথের কথা ফুরোতেই চায় না।

কেবল রঞ্জুদের পোড়ো বাড়ির সামনে এসে পা আটকে যায়। শ্লথ পা বাড়াতেই দেখি, ওদের জানালার নতুন পর্দা তুমুল বাতাসে ফরফর শব্দে উঠছে।

বর্ষ ১ সংখ্যা ১২, ১-১৫ জুলাই, ১৯৯৬

Leave a Reply

Your identity will not be published.