সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৫)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৫)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১৫তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব 

সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব 

পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪

 

রয়েল পরিবারের অন্দরমহল

বিশাল অট্টালিকার সামনে এসে গাড়ি থামে। গাড়ি থেকে নেমে তাকাই এদিক-সেদিক। বুঝতে পারি না—কোথায় এটা, কী এই ভবন? স্বাগত জানানোর জন্য কয়েকজন সামনে। তাদের মধ্যে চোখে পড়ে কালো পোশাকের আবরণে সুন্দরী এক কিশোরী। তার দিকে তাকিয়ে হাসি, তার মুখেও পাল্টা হাসি। তার নাম জুভেন মিলিসা। বিখ্যাত ‘রয়েল প্যালেস’-এর গাইড হিসেবে কাজ করে।

রয়েল পরিবারের রাজা আলেকজান্ডার আর রানি ক্যাথেরিন ফুল দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেন। এরা দেখলাম বেশ ‘শো অফ’ সচেতন। কসরত করে কয়েক ভঙ্গিতে আন্তরিক অভ্যর্থনার ছবি তুলে নিলেন রাজপ্রাসাদের নিজস্ব ফটোগ্রাফার। ভদ্রলোকের নাম না জানার আক্ষেপ রয়ে গেছে। তিনি ২৫ বছর ধরে রয়েল ফ্যামিলিতে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন। কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক দিনের। কিন্তু ‘দক্ষতা’য় প্রশ্ন আছে। আগামাথা ঠিক না করেই ক্লিক ক্লিক, ফ্রেমে মাথা থাক আর না থাক।

ভবনের অভ্যর্থনাকক্ষে ঢুকে অতিথিদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানালেন রাজা ও রানি। দুজনেই বেশ স্মার্ট, মুখে আন্তরিকতার হাসি। তাঁরা জানালেন, ‘গাইড সবকিছু ঘুরে দেখাবে। ছবি ওঠানোর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই। ’

সব দেখা শেষ হলে রাজারানির সঙ্গে চায়ের টেবিলে দেখা হচ্ছে আবার। রানি মিলাচকে সার্বিয়ান ভাষাতে কিছু একটা বললেন।

‘অতিথিদের ভালো করে দেখিয়ো সব’— এটাই হবে হয়তো।

কিং আলেকজান্ডারকে ক্লান্ত মনে হলো। বুঝতে পারছি, বয়সের ভারটা বেশি হলেও শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলতে হচ্ছে।

রাজা দেখতে সুদর্শন। বেশ উঁচু, লম্বায় সাত বা সাড়ে সাত ফুট হবেন নিশ্চয়। ভদ্রলোকের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংঘাতময় সময়ে। ১৯৪৫ সালের ১৭ই জুলাই, লন্ডনের ক্লারিজের হোটেলে। তার বাবা রাজা দ্বিতীয় এইচ এম কিং পিটার ১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন সেই সময়ের ডেনমার্কের রাজকুমারী আলেকজান্দ্রাকে। মজার ব্যাপার হলো, কিং পিটার আর আলেকজান্দ্রা ছিলেন হোটেল ক্লারিজের ২২২ নম্বর স্যুটে। সেই সময়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সম্মান জানিয়ে এই রুমটাকে যুগোস্লাভিয়ার সাম্রাজ্য বলে ঘোষণা দেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ক্রাউন প্রিন্স আলেকজান্ডার যুগোস্লাভিয়া রাজপরিবারের সন্তান হিসেবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হন।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কপালও পোড়ে কিং পিটারের। বেলগ্রেডের ক্ষমতা ততদিনে কমিউনিস্ট শাসকদের দখলে, যারা কিং পিটারদের দেশে ফিরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। লন্ডনে থাকার সময় রাজার মতোই ভাবসাব নিয়ে কিং পিটার দিন কাটাতে থাকেন। তিনি কখনোই আত্মসমর্পণ করেন নি। অবশ্য নিরাপদ দিনযাপনের নিশ্চয়তায় আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, অনেকগুলো দেশে ছোটাছুটি করতে হয়েছে তাঁকে। ক্রাউন প্রিন্সের পড়ালেখার স্থানও ছিল তাই বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরেই। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে তিনি অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। পরে কুইন্স রয়েল ল্যান্সার্সে ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তার দায়িত্বের মধ্যে ছিল পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড। ১৯৭২ সালে তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। ২০০১ সাল থেকে তারা বেলগ্রেডের রয়েল প্রাসাদে বসবাস শুরু করেন।

দীর্ঘকাল দেশের বাইরে থাকলেও চিন্তাচেতনায় সব সময় গণতান্ত্রিক ছিলেন প্রিন্স আলেকজান্ডার। মানবাধিকার রক্ষায় তাঁর সক্রিয় সমর্থন ছিল। সার্বিয়ায় কয়েক দশকের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে দেশের বাইরে থেকেই তিনি আন্দোলনে সমর্থন দেন। দেশে এসে গণতান্ত্রিক নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন, বক্তব্য দেন, আন্দোলন করেন। তার উদ্যোগে বুদাপেস্ট, বসনিয়া, অ্যাথেন্সসহ কয়েকটি দেশে আন্দোলনকারীদের নিয়ে সভা-সেমিনার, সমাবেশের আয়োজন করা হয়। মিষ্টভাষী এই ভদ্রলোক সময় পেলে গান করেন, গান শোনেন। থিয়েটার, নাটক, তথ্যপ্রযুক্তি, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তাঁর আগ্রহ। বরফে স্কিটিং, রাস্তায় স্কিটিং, সাঁতার কাটা তাঁর নেশা।  

রাজপ্রাসাদের ভেতরেও ঠান্ডার প্রকোপ টের পাই। ঘুরে দেখি। সার্বিয়ার রাজকীয় এই রাজপ্রাসাদটি বেশ পুরোনো। এর নির্মাণে সময় লাগে পাঁচ বছর, ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ সাল। বিশাল এই প্রাসাদ নির্মাণের ব্যয়ের খরচ এসেছিল কিং প্রথম আলেকজান্ডারের কাছ থেকে। তিনি আবার সম্পর্কে এখনকার রাজা আলেকজান্ডারের দাদা। পছন্দমতো করে প্রাসাদ বানানোর পর সেখানেই বসবাস শুরু করেন প্রথম আলেকজান্ডার। তাঁর ছেলে রাজা দ্বিতীয় পিটারও এখানেই থাকতে শুরু করেন। উত্তরাধিকারের এই ধারা বজায় রেখে বর্তমান রাজা আলেকজান্ডারও এখানেই বসবাস করছেন।

আমাদের গাইড মিলাচ ক্লাস টিচারের মতো লেকচার শুরু করে দিলেন।

‘বাড়ির ডিজাইনটি আর কটা বাড়ির মতোই মনে হতে পারে। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে মুনশিয়ানা দেখাতে হয়েছে কারিগরদের। স্থপতি জিভোজিন নিকোলিচ আর নিকোলে ক্রাসনফের কসরত বাড়ির ডিজাইনকে করেছে ব্যতিক্রম। এটি নির্মিত হয়েছে সার্বিয়ান বাইজান্টাইন শৈলীতে। প্রাসাদটির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে একটি রয়েল চ্যাপেল। যা রয়েল পরিবারের পৃষ্ঠপোষক বন্ধু সেন্ট অ্যাপোস্টেল অ্যান্ড্রুর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।’

বাইরে বৃষ্টি, সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। আমি বারান্দায় যাই, জানালার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়াই। এত বড়ো ভবন, রাজপ্রাসাদ কোনো নদীর তীরে হলেই ভালো হতো। উঁকিঝুঁকি দিয়ে নদী খুঁজি, নদী নাই। গাছের ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টি যায় যতদূর, সাদা কুয়াশার মতো। এরপর আবছা। তবে একটা সুইমিংপুলের দেখা মেলে। অন্যপাশে পারগোলাস, পার্ক টেরেস, প্যাভিলিয়ন আর প্ল্যাটফরম দিয়ে ঘেরা। সব মনে হয় বৃক্ষের সমাহার। শুধু গাছ আর গাছ। চারদিকে গাছের মধ্যে বড়ো একটি আলো ঝলমলে প্রাসাদ। ছাদে উঠতে পারি নি। কাকে বলব—লোক খুঁজে পাই না। শুধু দেখার জন্য হলে ক্যামেরা নিয়ে ঝটপট ছবি তোলা, দৌড় দিয়ে এদিক-সেদিক যাওয়া—সবই করা যায়। ছাদে গেলে ডেভিঞ্জে পর্বত, কোশুতঞ্জাক ফরেস্ট, টপচিডার আর আভালা পর্বতের চূড়া অন্তত দেখা যেত।

মিলাচ ওই দিকে অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত। আমি তাদের কয়েকটি ছবি উঠাই। চলে আসি, নিজের মতো করে ঘুরতে থাকি। নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষগুলো বেশ পরিপাটি, সুন্দর করে সাজানো। প্রধান ফটকের দরজাগুলি পাথর দিয়ে তৈরি। আস্ত সাদা পাথর। ভেতরে রয়েছে বিশাল হলরুম। সেটি নির্মিত হয়েছে মধ্যযুগের সোপোচানির মঠের ফ্রেস্কো দিয়ে। যে ড্রয়িংরুমটি আছে, তার রং নীল। নীলাভ পাথরের আবরণ মনে হয়। নীল যে কষ্টের রং! স্থপতিদের মনে বেদনার রং ছিল নাকি! রুমটি বারোক শৈলীতে সাজানো, পছন্দ হয়ে যায়। সোনালি রঙের রয়েছে আরেকটি ড্রয়িংরুম। এটি আর ডাইনিং রুমটি কাঠের ওপর মধ্যযুগের রেনেসাঁ শৈলীতে আচ্ছাদিত। উপরে ব্রোঞ্জের ঝাড়বাতি। এই রুমগুলো পুরোনো মাস্টারদের পেইন্টিং আর রাজকীয় সংগ্রহ থেকে রেনেসাঁ শিল্পীদের আঁকা ফ্লোরেন্টাইন ক্যাসোনির ছবির সমারোহ। রয়েছে ছোটো বড়ো অনেকগুলো লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতেও অনেক পেইন্টিং। 

আমি এদিক-সেদিক ঘুরি। নোট নিয়ে রাখি, পরে লিখতে হবে। শ্রীলঙ্কা পররাষ্ট্রমন্ত্রী থারকা বালাসুরিয়ার স্পাউস মালিন্থা বালাসুরিয়া বেশ ফ্যাশনসচেতন। সব জায়গায়, প্রতিটি দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে তার ছবি থাকতে হবে। আমাকে দেখা মাত্রই চোখের ইশারা, ফোন এগিয়ে দেবেন, ‘ছবি তুলে দাও’।

আমার ক্যামেরায় ছবি ওঠাতে থাকি। হোয়াটস আপে ছবি পাওয়ার আশ্বাসে তিনি স্বস্তি পান। এর পর থেকে, আমাকে দেখলেই পোজ দিয়ে দাঁড়ান। আমি ছবি ওঠাই। তার হাতের মোবাইল দেখি, স্যামসাংয়ের পুরাতন মডেলের ফোন, স্ক্রিনটাও ফেটে চৌচির। শ্রীলঙ্কার ঋণজর্জরিত অবস্থা টের পাই। তিনি বেশ স্মার্ট আর ফ্যাশনসচেতন। ‘বিউটিফুল’ শব্দটি তার সঙ্গে একদমই মানানসই। যার আভিধানিক অর্থ সৌন্দর্যের সঙ্গে চটপটে আর করিৎকর্মাও।

রয়েল প্যালেস দেখা শেষ হয়। এবার ‘দ্য হোয়াইট প্যালেস’-এর পালা। বেলি ডভোর নামের এই ভবনটি একই রয়েল কম্পাউন্ডের মধ্যেই অবস্থিত। রাজা আলেকজান্ডারের নির্দেশেই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত ফান্ডের অর্থ দিয়েই এটি নির্মাণ করা হয়। তার মনে হয়েছিল, তিন ছেলে বড়ো হলে তাদের বসবাসের আবাসন দরকার হবে, যার চাহিদা মেটাবে এই ভবন। যদিও ১৯৩৪ সালে আলেকজান্ডারের হত্যাকাণ্ড এসব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়।

তরুণ রাজা দ্বিতীয় পিটার এই কম্পাউন্ডের নতুন অধিকর্তা হন। মা এইচ এম কুইন মারিয়া ও ছোটো দুই ভাইকে নিয়ে এখানে বসবাস করতে থাকেন তিনি। প্যালেসের বাকি নির্মাণকাজ তার চাচা প্রিন্স রিজেন্ট পল শেষ করেন। হোয়াইট প্যালেসের নির্মাণকাজ ১৯৩৪ সালে শুরু হয়, শেষ করতে লাগে চার বছর। ৩৫ হাজারেরও বেশি বইয়ের সম্ভার নিয়ে বিশাল লাইব্রেরিটা রয়েছে এই ভবনেই।

কত সময় হবে, দুই ঘণ্টারও বেশি। আমরাও ক্লান্ত। কিন্তু অতিথিদের সহজে ছাড়লে নাকি পাপ (!) হয় হোস্টদের (নিমন্ত্রণকর্তা)। মিলাচকে দেখি অতিথিদের নিয়ে এগিয়ে আসছেন। তার ব্রিফিং চলছে তখনো। ভবনের ডাইনিং রুমে আবার স্বাগত জানালেন প্রিন্সেস। প্রিন্সেসের দিকে তাকাই। বয়স নিয়ে আমি বরাবরই ধোঁয়াশার মধ্যে থাকি। কারও বয়স যে ৭০-এর বেশি হতে পারে, সেটা মনেই হয় না। মধ্যবয়সে বয়স হবে ৪০ থেকে ৫০-এর ঘরে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরই কেবল বয়স হতে পারে ৬০-এর বেশি, এই ধারণার বাইরে যেতে পারি না কখনো। প্রিন্সেস ক্যাথারিনকে দেখেও তা-ই মনে হলো। দেখতে কম হলেও বয়স আসলে ৭৯ বছর। এই বয়সেও উনি দিব্যি সুস্থভাবে হাঁটছেন, হাসছেন, কথা বলছেন, ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন। চেহারায় বার্ধ্যকের ছাপ নেই, নেই ক্লান্তি-অবসন্নতাও। তিনিও উচ্চশিক্ষিত। সুইজারল্যান্ড আর আমেরিকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি ব্যবসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে ২০০৭ সালে তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড থেকে অনারারি ডিগ্রি লাভ করেন। এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের সংসার। আগের ঘরে ডেভিড আর এলিসন নামে দুটি সন্তান রয়েছে।

রানি ম্যাডামদের নিয়ে ডাইনিং রুমে বসেন। তাদের বিকেলের নাশতা দেওয়া হয়। চা শিঙাড়ার মতো কোনো অনুষঙ্গ। বাইরে বৃষ্টি, সময়টা ভরসন্ধ্যার। এক্কেবারে সঠিক সময়ে উপযুক্ত খাবার। রাজপ্রাসাদ হলেও সেই সময়ের ঢাল-তলোয়ার নেই, নেই উজির-নাজিরের ভিড়। তবে কয়েক জন গৃহস্থালি কাজের সহযোগী আছেন। বাড়ির আয়তনের তুলনায় গৃহস্থালি সহযোগী কম। দুজন নারী প্লেটে করে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন ডাইনিং রুমে। সেই টেবিলে জায়গা হয় নি আমার, মিলিসা আর সিকিউরিটি অফিসারদের। আমরা পাশের রুমে বসি।

স্রদজান রিসটিচকে দেখি বরাবরের মতোই মিলিসার পেছনে ঘুরঘুর করতে। পাত্তা পাচ্ছেন না। আমার পাশের চেয়ারে বসে মিলিসা মোবাইল ফোন হাতাতে থাকে। তার সঙ্গে কথা বলি। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, বৃষ্টিতে ভেজা নির্জীব গাছের মতো। যেন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। বেশ ফরমাল কথাবার্তা। পর্যটন বিষয়ে স্নাতকের পর সে রয়েল হাউজের গাইড হিসেবে কাজ করছে। রাজপ্রাসাদের ইতিহাস, রাজারানির ব্যক্তিগত জীবন, সার্বিয়ায় রাজপরিবারের প্রভাবসহ কতগুলো বিষয়ে তার কাছে জানতে চাই। খটখট করে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়। যেন টেলিভিশন চ্যানেলের সামনে সাক্ষাৎকার। দশ মিনিট বললেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিক দেখাবে ৩০ সেকেন্ডের বাইট। পালটা প্রশ্ন তার, কেন এত কিছু জিজ্ঞাসা করছি। দেশে গিয়ে যদি ভ্রমণকাহিনি লিখি— উত্তর পছন্দ হয় তার। ইমেইল আইডি দেয়, প্রয়োজন হলে তাকে যেন মেইল করি।

বুঝতে পারি পেটে টান পড়েছে। এক কাপ চা হলেও তেষ্টা মিটত! যারা খাবার সার্ভ করছেন, ডাকি। গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখে বিরক্ত হলেন। বলি, ‘টি প্লিজ।’

‘শিওর।’ বলে সেই যে ডাইনিং রুমে গেলেন, ফেরার নাম নেই। আরেকজনকে মিনিট দশেক পর বলি, ‘ওয়াটার প্লিজ।’

‘ওয়েট।’

তিনিও যে হারালেন, ঢুকে গেলেন কিচেনে, আর ফিরলেন না। ঠান্ডাময় পরিবেশে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেল।

এবার ফেরার পালা। অভ্যর্থনাকক্ষে আবার। রাজপরিবারের পক্ষ থেকে অতিথিদের স্যুভেনির গিফট তুলে দেওয়া হয়। রাজারানির পাশে গিয়ে দাঁড়াই আমিও, একটি স্মৃতি হয়ে থাক। রোমন্থন করার সুযোগ হাতছাড়া কে করতে চায়!

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.