গোবিন্দা গ্রামের তেজস্বী মানুষ

গোবিন্দা গ্রামের তেজস্বী মানুষ

অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালকে নিয়ে রচনা-

কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও সমালোচক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়, নারী ও প্রেম। তাঁর প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনা বিশ্লেষণধর্মী। সেখানে তাঁর নিজস্ব ধারণা এবং মন্তব্যও রয়েছে। তবে একজন গীতিকবি হিসেবে তাঁর যে অবদান তা অসামান্য। বেশ কয়েকটি কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি।

‘পথে যেতে দেখি আমি যারে’, ‘আমি সাগরের নীল’, ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে’—এইসব গান তো সুপরিচিত, জনপ্রিয়। এই গানগুলো লিখেছেন কে? আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

হ্যাঁ, এখন আমরা আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্মভূমি গোবিন্দা গ্রামের দিকেই ছুটে চলেছি। কিছুক্ষণ আগে আমরা ছিলাম পাবনার শহরতলীতে রাধানগরে তথা নারায়ণপুরে। সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়ার পৈতৃক বাড়িতে।

আমাদের রিকশা বাণী সিনেমা হলের পাশের গলিতে ঢুকল। অতঃপর ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে। এখানেও গলি। গলির দুই ধারে মানুষের ঘরবসতি, বাড়িঘর। পথের ধারে দুই-একটি দোকান। একটি দোকানের সামনে আমাদের রিকশা থামে। দোকানি উৎসুক চোখে তাকায়। আমি বলি, ‘রাজ্জাক কমিশনারের বাড়ি কোথায়, বলতে পারেন?’ দোকানি সম্মুখে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, ‘সামনে এগিয়ে গিয়ে বাম দিকে মোড় নেবেন। কিছুক্ষণ পরেই দেখবেন একটি অসম্পূর্ণ দোতলা বাড়ি।’

দোকানির নির্দেশ-মতো হেঁটে পেয়ে যাই রাজ্জাক কমিশনারের বাড়ি। আমরা দরজায় কড়া নাড়ি। ভেতরে সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। বড় নির্জন মনে হয় বাড়িটিকে।...সময় পেরিয়ে যেতে থাকে। অধৈর্য হয়ে বিশ্বজিৎ— অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী— সজোরে কড়া ধরে নাড়া দেয়। এবার কাজ হয়। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। দরজা উন্মুক্ত হয়। আট-দশ বছরের এক মেয়ে দরজার বাইরে মাথা গলিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী চান আপনারা?’ আমরা রাজ্জাক কমিশনারের কথা বলি। বলি, তার কাছেই আমরা এসেছি।

কিশোরীটি বাড়ির ভেতর উধাও হয়। একজন মধ্যবয়স্ক লোক বেরিয়ে আসে। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। সংক্ষেপে আমাদের আগমনের কারণ খুলে বলি তাকে। জিজ্ঞেস করি, তিনিই কি রাজ্জাক কমিশনার? তিনি মাথা নেড়ে বলেন, ‘না, আমি তার ছোটভাই। ভাইজান বাড়িতে নাই।’ তারপর তিনি সামনের দিকে হেঁটে যেতে থাকেন। আমরা তাকে অনুসরণ করি। বাড়ির লাগোয়া একটি খোলা জায়গার সামনে এসে দাঁড়ান তিনি। ভেতরের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বলেন, ‘এটাই হেনা সাহেবদের বাড়ি ছিল। ভাইজান কিনে নিয়েছেন।’ আমরা চেয়ে দেখি, চারদিকে বেশ কয়েকটি নারকেল গাছ। এর মাঝে ইট-শুরকির ভগ্নাংশ। একটি কুয়ার ধ্বংসাবশেষ। পেছনে কচুরিপানায় পরিপূর্ণ একটি মরা নদী। পরে জানতে পারি, এটিই সেই বিখ্যাত ইছামতী নদী।

এখানেই তাহলে জন্মেছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল! মানুষটির অবয়ব আমার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।

মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। মাথার চুল লম্বা। আর সেই চুলের কয়েকগুচ্ছ কিছুক্ষণ পরপরই ললাটে লুটিয়ে পড়ছে আর তিনি হাত দিয়ে বা মাথায় একটি ঝাঁকি দিয়ে তা যথাস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। চোখ দুটোয় ফোলা ফোলা ভাব আর কী তীক্ষè দৃষ্টি! চোখের মণি দুটো জ্বলজ্বল করছে। এই মানুষটিকে আমি দেখেছি টেলিভিশনে। আশির দশকের শেষ পর্যায়ে ‘আমার যত গান’ নামের একক গায়ক-গায়িকা নির্ভর সঙ্গীতানুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে। তখন বাংলা একাডেমির চত্বরেও এক-দুই ঝলক দেখেছি তাকে। তিনি যে একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। আর এই পদে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি মারা যান। এর আগে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। তারও আগে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। মাঝে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত জনসংযোগ পরিদপ্তর ইডেন বিল্ডিংসে কর্মরত ছিলেন।

রাজ্জাক কমিশনারের ভাইকে জিজ্ঞেস করি, বাড়িটি (চোখের  সামনে অবশ্য দেখতে পাচ্ছি খোলা জায়গা, বাড়িটির অস্তিত্ব বলতে প্রায় কিছুই নেই) কার কাছ থেকে কিনেছেন আপনার ভাই?

বাড়িটির বর্তমান ওয়ারিশ যারা— তাদের কাছ থেকে। হেনা সাহেবের ছেলেমেয়েরা, তার বোন সাবেরা মুস্তফা এবং ভাই হায়াৎ সাহেব।

হ্যাঁ, আবু হেনা মোস্তফা কামালরা তিন ভাই-বোন। সাবেরা মুস্তফা (স্বামী বিশিষ্ট সাংবাদিক কে. জি. মুস্তফা), আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং আবুল হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল। হেনার বড়বোন সাবেরা মুস্তফা একদা বেতার ও মঞ্চে নাট্যাভিনয়ে সম্পৃক্ত ছিলেন, সংস্কৃতি সংসদ ও ড্রামা সার্কেলে সক্রিয় এবং ডাকসুতে এফ এইচ হলের প্রতিনিধি ছিলেন। আর আবুল হায়াৎ মোহাম্মদ কামাল খুলনা রেডিওর কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে অবসর নিয়েছেন। তিনি একজন গীতিকার।

যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি এই গোবিন্দা গ্রামে ১২ মার্চ ১৯৩৬ সালে আবু হেনা মোস্তফা কামাল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শাহজাহান আলীর পৈতৃক নিবাস ছিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার নাগরূহা গ্রামে। তিনি বিএ পাসের পর গ্রামে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন, পরে পাবনা জেলা স্কুল বোর্ডের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দেন। এই পদেই তিনি আমৃত্যু (১৯৫০) কাজ করেন। পাবনা শহরেই তিনি স্থায়ী ঘর-সংসার গড়ে তোলেন।

মনে পড়ে, আবু হেনা মোস্তফা কামালের অম্ল-মধুর শৈশব-কৈশোর কেটেছে পাবনাতেই। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী ও ঘরকুনো টাইপের। বন্ধু-বান্ধব বলতে গেলে ছিলই না। আর অল্প বয়স থেকেই তিনি ছিলেন বইয়ের পোকা। বই পেলে নাওয়া-খাওয়া, দুঃখ-কষ্ট, মানসিক যাতনা—সব কিছু ভুলে যেতে। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির মধ্যেই পড়ে ফেলেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রসহ আরও অনেক লেখকের বই। সেই বয়সে আরও দুটি বিষয়ের প্রতি তার ঝোঁক ছিল— গান শোনা, ছবি আঁকা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রচুর গান তিনি শুনেছেন, প্রচুর ছবি তিনি এঁকেছেন।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল পাবনা জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলে তাঁর নাম-ডাক ছিল। গানে-কথায়-লেখায়-অভিনয়ে-পড়াশোনায় তিনি পটু ছিলেন। যদিও নবম শ্রেণির আগে তিনি ছিলেন অতি সাধারণ ছাত্র, দুই-এক বিষয়ে ফেল করার রেকর্ডও রয়েছে। একবার আবু হেনার বাবা মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে উপরের ক্লাসে তুলে দিয়েছিলেন। নবম শ্রেণিতে ওঠার পরই আবু হেনার মধ্যে দেখা গেল আশ্চর্য পরিবর্তন— একজন ভালো মেধাবী ছাত্রের মধ্যে যেসব গুণের সমাবেশ থাকে— তার সবগুলোই তাঁর মধ্যে দেখা গেল। এর কারণ কী? বোধহয় বাবার মৃত্যু। যখন আবু হেনার বয়স মাত্র তেরো, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র—তখন তাঁর বাবা শাহজাহান আলী মারা যান। পিতৃহীন বালক আবু হেনা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, এই কঠিন পৃথিবীতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হলে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে একটি অস্ত্র দরকার। আর তা হচ্ছে পাণ্ডিত্য এবং প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ভালো করা। আর ভালো ছাত্রের যে লক্ষণ তার মধ্যে নবম শ্রেণিতে দেখা গেল, লন্ডনে গিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া পর্যন্ত সেই লক্ষণের ঘাটতি দেখা যায় নি। মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ত্রয়োদশ স্থান, আই.এ পরীক্ষায় সপ্তম স্থান, অনার্স (বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) ও মাস্টার্স-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম।

ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছে বিশ্বজিৎ। শোবার ঘরের কোনোই চিহ্ন নেই। শুধু বাথরুম ও রান্নাঘরের একাংশ ভগ্ন অবস্থায় বিদ্যমান। এসবই ক্যামেরাবন্দি করতে লাগল বিশ্বজিৎ। রাজ্জাক কমিশনারের ভাই পাশ থেকে বলে উঠলেন, আর দু’দিন পরে এলে এইসব কিছুই দেখতে পেতেন না। মনে মনে বললাম, সে কি বলতে হয়! এ তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।

রাজ্জাক কমিশনারের ভাই আবার বলল, ‘কিছু দিনের মধ্যে ভাইজান এখানে ফ্ল্যাট-বাড়ি তৈরি করবেন।’ তা তিনি করুন। এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। কালস্রোতে সবই বিলীন হয়। শুধু বেঁচে থাকে কীর্তিমান মানুষের উজ্জ্বল কীর্তি।

আবু হেনার পৈতৃক বাড়ির অস্তিত্ব এখন আর নেই, আমার চারদিকে খোলা জমিতে শুধু কয়েকটি নারকেল গাছ এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সেগুলোর দিকে চেয়ে আমার চেতনায় ভেসে ওঠে কবিতার পঙ্ক্তিমালা: ‘তারা ছিল/ তারা নেই/ তাদের প্রতীক হয়ে তবু/ কয়েকটি প্রাচীন গাছ আছে।’ এই প্রায় বিলুপ্ত হওয়া বাড়িটিও একদা মুখর ছিল কয়েকজন মানুষের পদচারণায়। যেন তাদের অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করছি চেতনায়। ওই তো সন্ধ্যা নেমেছে এই পাবনা শহরে। আর এই বাড়িতে আবু হেনার মা খালেসুননেসা গৃহকর্মে ব্যস্ত। আর বাবা শাহজাহান আলীকে ঘিরে ধরেছে আবু হেনা, সাবেরা, আবুল হায়াৎ। হারিকেন জ্বলছে তাঁদের মুখের সমুখে। হারিকেনের সেই ম্লান আলোয় ঘরের দেয়ালে চারজন মানুষের ছায়া পড়েছে। গা ছমছম পরিবেশ। আর এমনি পরিবেশে আবু হেনারা তিন ভাইবোন মিলে নিবিষ্ট মনে গল্প শুনছে বাবার মুখে। রোমাঞ্চকর সেই গল্প শুনে তাঁদের মুখের ভাব ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে।...

দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়। দেখতে পাই বিকেলবেলায় এই বাড়িতে ঢুকছেন প্রখ্যাত বামপন্থী অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী। তাঁর হাঁক-ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শাহজাহান আলী। সমাদর করে ঘরে বসান অমিয় চক্রবর্তীকে। তারপর দুজনে আড্ডায় মেতে ওঠেন। রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাম্প্রতিক ঘটনা—কোনো কিছুই বাদ যায় না তাঁদের আলোচনা থেকে। পাশের ঘর থেকে সাবেরা, আবু হেনা, আবুল হায়াৎ-এরও কান এড়ায় না তাঁদের আলোচনা। কোনো কোনো প্রসঙ্গে তাঁদের মনের মাঝেও জেগে উঠছে নানা অনুভূতি, নানা প্রশ্ন।... বিশ্বজিতের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে সংবিত ফিরে পাই। এই বোধ মনের মাঝে সঞ্চারিত হয়— হ্যাঁ, এই পাবনা শহরে, সংস্কৃতিমনা পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিলেন আবু হেনারা তিন ভাই-বোন।

‘নয়ন ভরা জল গো তোমার...’ কোন বাড়িতে যেন বাজছে এই নজরুলসঙ্গীতটি। এই সূত্রে মনে পড়ে গেল যে, আবু হেনা মোস্তফা কামালের বড় ছেলে সুজিৎ মোস্তফা—স্বনামধন্য নজরুলসঙ্গীত শিল্পী। তার অন্য সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন—কাবেরী মোস্তফা (শিখা), কাকলি মোস্তফা (কেকা), শ্যামলী মোস্তফা (পাখি) এবং সৌমী মোস্তফা (পিনু)। আর এইসব ছেলেমেয়েদের মা অর্থাৎ আবু হেনা মোস্তফা কামালের স্ত্রী হচ্ছেন—হালিমা মোস্তফা।

আবু হেনার রক্তের গভীরে খেলা করত  গান। গান তিনি শুনতে ভালোবাসতেন (বিশেষত নজরুলসঙ্গীত), গাইতে ভালোবাসতেন এবং লিখতে ভালোবাসতেন। যৌবনের প্রথম বেলা থেকেই এই তিন দিকে তার ঝোঁক ছিল। আর এই কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, তার সৃজনশীল কর্মের মধ্যে গানই তাকে মানুষের হৃদয়ে বাঁচিয়ে রাখবে। ‘ভ্রমরের পাখনা যত দূরে থাক না’, ‘তুমি এতো সুন্দর’, ‘পথে যেতে দেখি আমি যারে’, ‘সেই চম্পা নদীর তীরে’, ‘আকাশের ঝিলমিল’, ‘শালিক শালিক ময়না’, ‘আমি সাগরের নীল’, ‘আকাশে তোমার নামে প্রদীপ জ্বেলে’, ‘তোমার কাজল কেশ ছড়ানো বলে’ এইসব গান কি কালজয়ী আবেদনে সমৃদ্ধ নয়? সহজেই তিনি গভীর কথা বলেছেন গানে। আর সেই কথা বা গানের ভাবটি মূলত রোমান্টিক। এই কথা শোনা মাত্র কানকে প্রীতি করে, হৃদয়কে করে ব্যাকুল। তবে শুধু প্রেমের গান নয়, অন্য সকল গানেও আবু হেনা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতাও উল্লেখযোগ্য। তিনি মৌলিক কাব্য প্রতিভাসম্পন্ন একজন কবি, তবে সমকালের মুখ্য কবি নন। তার নিজস্ব বাণীভঙ্গিও ছিল না। তার কবিতার প্রধান বিষয় হচ্ছে, নারী ও প্রেম।

একজন প্রবন্ধকার ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে আবু হেনা ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মানের। মেধা ও জ্ঞানচর্চার সুযোগে এক্ষেত্রে তিনি তার স্বকীয় বিদ্যা ও বুদ্ধির উৎসারণ ঘটিয়েছেন অবলীলায়, অবাধে অকপটে। সাহিত্য সমালোচনামূলক তাঁর যে দুটি গ্রন্থ রয়েছে— তা সাহিত্যের রূপতাত্ত্বিক কিংবা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়, লেখকের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের সমষ্টিও নয়, বাংলা সাহিত্যের কতকগুলো নির্বাচিত বিষয়ের ওপর তাঁর নিজস্ব ধারণা ও মন্তব্যাদিসহ বিশ্লেষণমূলক আলোচনা। দুটো গ্রন্থই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা।

আবু হেনা মোস্তফা কামালের গ্রন্থসমূহ হচ্ছে (কবিতা) আপন যৌবন বৈরী (১৯৭৪), যেহেতু জন্মান্ধ (১৯৮৪), আক্রান্ত গজল (১৯৮৮); প্রবন্ধ গবেষণা: শিল্পীর রূপান্তর (১৯৭৫), কথা ও কবিতা (১৯৮১), The Bengali Press and Literary Writing 1818-31 (১৯৭৭), অনুবাদ: জর্জ ওয়াশিংটন কার্ভার (১৯৬৬), সম্পাদনা: পূর্ব বাংলার কবিতা (মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ’র সঙ্গে যৌথভাবে, ১৯৫৪), কলিকাতা কমলালয়: ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৭৫)।

আবু হেনা ছিলেন ঠোঁট কাটা। নিজেকে নিজে, পরিবার-প্রিয়জনদের নিয়ে, অন্য সবাইকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। উচিত কথা বলতে তার বাধত না। যেমন, বাংলা একাডেমি পুরস্কার সম্পর্কে তার তীর্যক মন্তব্য, ‘এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাদের তিরস্কৃত হওয়ার কথা ছিল’। এটা খুবই সত্যি কথা।

একটি ঘটনা আবু হেনাকে সারা জীবন তাড়া করেছে। সেটি হচ্ছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোক তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর প্রাণ রক্ষা করে বটে, কিন্তু রাজশাহী বেতারে কয়েকটি প্রোগ্রাম করতে তাঁকে বাধ্য করে। ১৯৭৩ সালের ২১ মে থেকে ৩ জুন তিনি রাজশাহীতে কারাভোগ করেন। ছাত্রদের দাবি ও শুভাকাক্সক্ষীদের প্রচেষ্টায় তিনি খুব দ্রুত কারামুক্ত হয়েছিলেন বটে কিন্তু রেডিও-টিভি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের দরজা ১৯৭৪-এর আগে উন্মুক্ত হয় নি তাঁর জন্যে।

রাজ্জাক কমিশনারের ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা হাঁটতে থাকি। আমাদের পেছনে পড়ে থাকে গোবিন্দা গ্রাম। আবু হেনার শৈশব-কৈশোরের বিচরণভূমি, মরা ইছামতী।

‘পাখি উড়ে যায়, তাঁর পালক পড়ে থাকে’ কবিতার এই পঙ্ক্তিমালা মনে উদয় হয়।

হ্যাঁ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ সালে বিকেল ৩-৪৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তাঁর স্মরণীয় কিছু গান রয়েছে, রয়েছে কয়েকটি কবিতা। এইগুলোর মাঝেই তিন বেঁচে থাকবেন এ দেশের মানুষের হৃদয়ে।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.