নোনাজলের কাব্যঃ উপকূলের মানুষদের লড়াকু জীবনগাথা

নোনাজলের কাব্যঃ উপকূলের মানুষদের লড়াকু জীবনগাথা

তরুণ চলচ্চিত্রকার রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘নোনাজলের কাব্য’। সরকারি ও বিদেশি অনুদানে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছে। ‘নোনাজলের কাব্য’-এ মূর্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী মানুষদের যাপিত জীবন। বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়, রক্ষণশীল মানুষদের বৈরী আচরণসহ নানা কিছুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে তারা। ছবিতে এক ভাস্করের কাজ এবং সংগ্রামও ফুটে উঠেছে। পরিবেশ বিপর্যয় অথবা জলবায়ু পরিবর্তন এ ছবির আরেকটি বিশেষ দিক। ভিন্নধর্মী এই চলচ্চিত্রটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এবারের প্রচ্ছদ রচনা।

তরুণ এক চলচ্চিত্রকার

‘নোনাজলের কাব্য’র পরিচালক রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। এটি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র। তরুণ এই চলচ্চিত্রকারের ধ্যান-জ্ঞান চলচ্চিত্র। ছোটবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। কিশোর বয়সে একটি ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্সে অংশগ্রহণের পর তার মধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ শিল্প সম্পর্কে জানার আগ্রহ জেগে ওঠে। তার নির্মিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সিটি লাইফ’। এটি ডকু-ফিকশন টাইপের একটি চলচ্চিত্র। পরে তিনি নির্মাণ করেন অ্যানিমেশন শর্টফিল্ম ‘মুন ফেইরি’।

সুমিত চলচ্চিত্রের ওপর স্নাতকোত্তর করেছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি টিস স্কুল অব দ্য আর্টস থেকে। ওই সময় শব্দ মিশ্রণের কাজটি তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। ...নিউইয়র্কের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় সুমিত চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন। পরিচালনা করেছেন তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি; রচনা করেছেন দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির চিত্রনাট্য। আর নিউইয়র্ক ও আশপাশের শহরের নির্মিত কিছু স্বাধীন ছবির শব্দ মিশ্রণের কাজ করেছেন।

টিস স্কুলে পড়ার সময় সুমিত প্রথম বছরে নির্মাণ করেছিলেন এমন একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র, যেটি গড়ে উঠেছে আমেরিকার হ্যালোইন উৎসবকে ঘিরে। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যায় একজন মিলিটারি জেনারেল ক্যু করতে চাইছেন, কিন্তু একজন আদর্শবাদী কনিষ্ঠ অফিসারের সঙ্গে চলছে তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। সেটি নিয়েই গল্প। দ্বিতীয় বছরে সুমিত স্বল্পদৈর্ঘ্যরে যে ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রভাব রয়েছে। তৃতীয় বছরে সুমিত একটি কনসেপ্ট ভিডিও নির্মাণ করেন, ‘হাল ২০২২’, যেখানে আগামী দিনের পৃথিবী তথা খেলার জগৎ মূর্ত হয়ে ওঠে। যেখানে মাঠে গড়ানো ফুটবলই পালন করছে রেফারির ভূমিকা। সেই সময়ে সুমিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে দেখা যায়—দুই বন্ধু নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে যায়। সেখানে তারা এক ভিডিও ডিলারের সঙ্গে দেখা করে, যে নাকি হলে গিয়ে কয়েকটি ছবি পাইরেট করেছে। সেইসব ছবি ডিলারটি দুই বন্ধুর কাছে বিক্রি করে। ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে সুমিতের প্রথম সাফল্য আসে সানড্যান্স Alum  বারবারা সিগারোয়ার স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘ডিওস নুনকা মুয়েরে’ প্রযোজনা করে। ছবিটি  Newyork Film Festival (NYFF), AFI Fest, Palm Springs, Aspen Shortfest, Winterthur নামক নামকরা Oscar-qualifing ফেস্টিভালে জায়গা করে নেয়। এ ছবিতে প্রবাসী এক মা ও তার কিশোর ছেলের দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে।

নোনাজলের কাব্য

সুমিতের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘নোনাজলের কাব্য’। ছবিটি বিখ্যাত মার্কিন পরিচালক স্পাইকলির রাইটিং গ্র্যান্ট রাইটিং গ্র্যান্ট পেয়েছে; পেয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় অনুদান। এ ছাড়া ফান্সের জাতীয় অনুদানও পেয়েছে ছবিটি। ছবিটি নামকরা ফরাসি প্রযোজক  ইলান জিরাদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রযোজনা করছেন রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। আর পরিচালনা তো করছেনই।

কাহিনি

‘নোনাজলের কাব্য’র কাহিনিধারায় দেখা যায়— ভাস্কর রুদ্র। সে চারুকলার ছাত্র। স্নাতকোত্তর করেছে বিদেশে। বড় একটি অনুদান জিতেছে। সে অনুদানের টাকায় ভাস্কর্যের একটি সিরিজ করার জন্য বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি দ্বীপে যায়। সেখানে সে পরিচিত হয় স্থানীয় একটি মেয়ে—টুনি ও তার ভাই তাহেরের সঙ্গে। টুনি রুদ্রকে দ্বীপের নানা জায়গা ঘুরে দেখায়। দ্বীপ ও সেখানকার মানুষদের সম্পর্কে জেনে-বুঝে সিরিজটি করতে উদ্যোগী হয় রুদ্র। এই কাজ করতে গিয়ে দ্বীপের রক্ষণশীল এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় সে। অন্যদিকে দ্বীপের সাধারণ মানুষ, জেলেরা, শুরুতে রুদ্রকে স্বাগত জানালেও পরে দূরে সরে যায়। আবার যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, তখন তারা আবার কাছে আসে। রুদ্র জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলে এবং জানায়, এই সময়ে তাদের একতাবদ্ধ থাকাটা খুব জরুরি। অন্যদিকে নেতৃস্থানীয় রক্ষণশীল মানুষেরা এই একতাকে ভয় পায়, নিরুৎসাহিত করে। শুরু হয় রুদ্র এবং দ্বীপের রক্ষণশীল মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। ...টুনি এবং রুদ্র-র মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা কাজ করে। তবে কেউই তা মুখে প্রকাশ করে না।

চিত্রনাট্য

সুমিত ‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্যের প্রথম খসড়াটি লিখেন নিউইয়র্কে বসে, যখন তৃতীয় বর্ষের ফল সেমিস্টারে শিক্ষক সমস্ত শিক্ষার্থীদের চিত্রনাট্য লিখতে বললেন এবং জানালেন সবচেয়ে ভালো হয় তা যদি হয় দেশ, জাতি এবং শেকড়ের সন্ধানে। একদিন তাই সুমিত চলে গেলেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ববস্ট ((Bobst)) লাইব্রেরিতে। তার চোখের সামনে তখন ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্ক, এম্পায়ার স্ট্রেট বিল্ডিং—তথাকথিত সভ্যতার চূড়া। আর আটতলায় জানালার বাইরে এই পরিবেশের মাঝে বসে সুমিত তখন ডুব দিলেন মনের মাঝে। চলে গেলেন অতীতে এবং তুলে আনলেন কিছু মণিমুক্তা; নিজের মাতৃভূমি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু ইমেজ, প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা কয়েকজন মানুষের জীবনসংগ্রাম। বিষয়টি খুলে বলা যাক। ২০০৮ সালে সুমিত গিয়েছিলেন কুয়াকাটায়। তখন দুটি ইমেজ তাকে আলোড়িত করেছিল। এক. স্যালো ইঞ্জিনচালিত ডিঙি নৌকায় করে চার-পাঁচজন জেলের মাছ ধরার জন্য সমুদ্র যাত্রা, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা কখনো কখনো সুউচ্চ ঢেউয়ের মাঝে নৌকা ডুবে যায়। দুই. সিডর পরবর্তী কুয়াকাটার বিধ্বস্ত অবস্থা, এখানে-সেখানে পড়ে আছে গাছ। কিছু কিছু বাড়ি-ঘর ভেঙে গেছে বা সাগরে ভেসে গেছে। এই দুটি ইমেজই ‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্য লিখতে সুমিতকে তাড়িত করেছে। যেমন কখনো কখনো কোনো এক বা একাধিক বিচিত্র চরিত্র একটি ছবির চিত্রনাট্য রচনার মূল উৎস হতে পারে।

নিউইয়র্কের ববস্ট ((Bobst)) লাইব্রেরিতে বসে আড়াই দিনে পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লিখে ‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্যের প্রথম খসড়ার অর্ধেক শেষ করেন সুমিত। বাংলায়। আগের পৃষ্ঠায় কী লিখেছেন তা না দেখেই  অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চিত্রনাট্য লিখে যাওয়া, যাকে বলে মাসেল ড্রাফট। নিখুঁত চিত্রনাট্য এটিকে বলা যাবে না। বলা যায়, মূল ভাবনা বা ইমেজগুলো কাগজের বুকে বন্দি করে রাখেন সুমিত। তবে ছবির পুরো চিত্রনাট্য নয়। এটি শেষ করতে দু’মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কেননা এ সময়ে সুমিতকে রাইটার্স ব্লকে পেয়ে বসেছিল। কিছুতেই লিখতে পারছিলেন না। যাহোক, এ অবস্থা কেটে যাওয়ার পরে মাত্র তিন দিনে সুমিত চিত্রনাট্যের বাকি অংশ লিখে শেষ করেন। প্রথম খসড়া। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে।

‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্যের প্রথম খসড়া টিস স্কুল-এর ক্লাসে পড়ে শোনান সুমিত। তার সঙ্গে ছিল আরও ন’ জন সহপাঠী। তারাও তাদের চিত্রনাট্য পড়ে শোনান। অতঃপর বেশ কয়েকদিন তারা পরস্পরের চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা করেন। এ থেকে সুমিতের চিত্রনাট্যের যে আরও উন্নতি ঘটে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

২০১৫-এর মে’তে সুমিত দেশে ফিরেন। ঢাকায় পা দিয়েই সরাসরি চলে যান কুয়াকাটা। গবেষণা আর যেসব মানুষদের জীবন তিনি চলচ্চিত্রে তুলে ধরতে চাইছেন, তাদের সম্পর্কে আরও জানার জন্য কুয়াকাটায় গিয়ে সেখানকার জেলেপল্লি দেখেন তিনি। সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেন। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শোনেন। তারা কী মাছ পাচ্ছে? না পেলে কেন পাচ্ছে না— এসব জানার চেষ্টা করেন। কুয়াকাটায় এই দ্বিতীয়বার সফর করার ফলে চিত্রনাট্যের চরিত্রদের মুখে যে সংলাপ ছিল, সেগুলো আরও বাস্তবধর্মী হয়। নতুন আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়।

টিস স্কুলে সুমিত যে থিসিস জমা দিয়েছিলেন সেটির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন ‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্যও। এখানে একজন চিত্রনাট্য উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। তিনি চিত্রনাট্যের উন্নতির জন্য চিন্তার খোরাক জুগিয়েছিলেন সুমিতকে। ...২০১৭ সালে আবারও কুয়াকাটায় গিয়েছিলেন সুমিত। আরও গবেষণার দরকার ছিল। এছাড়া অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র ‘মাট অব দ্যা পেঙ্গুইন’-এর প্রযোজক ইলান জিরাদের গঠনমূলক সমালোচনা এবং পরামর্শও সমৃদ্ধ করেছে সুমিতের ছবির চিত্রনাট্যকে। ইলান অবশ্য মূল চিত্রনাট্য নয়, ব্যাকরণ সম্পর্কে পরামর্শ দিয়েছেন। চরিত্র এবং তাদের একে অপরের সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলেছেন। এভাবে বারবার লেখা এবং নানাজনের আলোচনা-সমালোচনা ও পরামর্শের মধ্য দিয়ে ‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্য চূড়ান্ত করেছেন সুমিত। অবশ্য চিত্রনাট্য বাইবেল নয়। তাই চূড়ান্ত বলে কিছু নেই। ফলে নানা সময়ে এটির পরিবর্তন হয়েছে, নতুন কিছু যোগ হয়েছে। অবশ্য এগুলো টুকিটাকি বিষয়, ছোটখাট জিনিস। যেমন টেবিল রিড অর্থাৎ শহরের অভিনেতাদের মাঝে যখন চিত্রনাট্যটি পড়া হয়েছিল, তখন সুমিতের নিজের কানেই ধাক্কা দিয়েছিল কিছু সংলাপ। তিনি বোধ করেছিলেন, ওইসব সংলাপ অন্যভাবে লেখা যেতে পারে। আর তা তিনি লিখেছিলেনও। এটি তিনি করেছিলেন ইমোশন এবং প্র্যাক্টিক্যাল কারণেও। আবার কুয়াকাটায় নির্মিত সেটে শুটিং-এর আগে রিহার্সেল করার সময়ও কিছু নতুন বিষয় চিত্রনাট্যে যোগ হয়েছে।

আর হ্যাঁ, ইলান জিরাদ এ ছবির সহ-প্রযোজক। তার সঙ্গে সুমিতের দেখা হয়েছিল ২০১৬-এর নভেম্বরে, ভারতের গোয়াতে, এনএফডিসির আয়োজনে ফিল্ম বাজারের প্রোডাকশন্স মার্কেটে আমন্ত্রিত হয়ে যখন সেখানে গিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ছবিটির চিত্রনাট্যে আমেরিকার স্পাইক লি রাইটিং গ্র্যান্ট-এরও ভূমিকা রয়েছে। এই গ্র্যান্টটি সুমিত পেয়েছিলেন ছবিটির গল্প জমা দেওয়ার সূত্রে। ফলে নিউইয়র্কে যাপিত জীবনের বিভিন্ন খরচের বিষয়টি তাকে আর ভাবতে হয় নি। কয়েক মাসের জন্য নিশ্চিন্তে মন দিয়েছিলেন চিত্রনাট্যের উৎকর্ষের কাজে।

লোকেশনের সন্ধানে

২০১৭ সালে সুমিত দেশে ফিরেন, ‘আমেরিকান ড্রিম’ পেছনে ফেলে। যদিও সেখানে তিনি ভালো করছিলেন। তবে এটাও সত্যি যে আমেরিকা থেকে তিনি প্রত্যাবর্তন না করলে ‘নোনাজলের কাব্য’ নির্মিত হতো না। ...সেই বছরের ডিসেম্বরে সুমিত সিদ্ধান্ত নেন, ছবিটির শুটিং করবেন ২০১৮-এর মে-জুনে।

২০১৮-এর জানুয়ারিতে সুমিত লোকেশন খোঁজার জন্য বের হন। হ্যাঁ, এর আগে তিনি কয়েকবারই লোকেশনে গিয়েছিলেন, তবে একা। এবার স্থানীয় দুজন মানুষ তথা লোকাল গাইড তাকে সাহায্য করে। অনেক কিছু তাকে দেখায়। বিকল্প লোকেশনের সন্ধান দেয়। সুমিত সেইসব জায়গার ছবি তোলেন। ছবি অনুযায়ী লোকেশন নির্বাচন করেন। আর এই ছবির জন্য সুমিতকে সাহায্য করেছে স্বনামধন্য নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান হাফ স্টপ ডাউন। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে অফিসিয়ালি যুক্ত হয়েছে ‘নোনাজলের কাব্য’র সঙ্গে। তারা শুটিংসহ ফিল্মের নানা কাজে সাহায্য করেছে, যুক্ত থেকেছে। অন্য কথায় লাইন প্রোডাকশন্স সাপোর্ট দিয়েছে তারা। উল্লেখ্য, এক সময় সুমিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ’র ইন্টার্নসিপ করেছিলেন অমিতাভ রেজা চৌধুরীর চৌধুরীর এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তিনি সুমিতকে জানেন, বোঝেন এবং ওর প্রতিভা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। তিনি তাই তার স্নেহধন্য এই তরুণকে আগেই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘কখনো যদি সিনেমা করো, হাফ স্টপ ডাউনের সাহায্য নিতে পারো। আমরা যথাসাধ্য সাহায্য করব।’ আরেকটি কথা, ২০১৭-এর মে তে ‘নোনাজলের কাব্য’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুদান পেয়েছে। আর ২০১৮-এর এপ্রিলে ফ্রান্স থেকে পেয়েছে সিএনসি সিনেমা ডু মন্ড তথা ওয়ার্ল্ড সিনেমা গ্র্যান্ট, যার মূল্যমান ৮০ হাজার ইউরো।

কলাকুশলী

‘নোনাজলের কাব্য’র কলাকুশলী নির্বাচন করতে গিয়ে সুমিত অনুসরণ করেছিলেন পরিচালক স্পাইক লি’র একটি পরামর্শ। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার জীবনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র বানাতে যাচ্ছ, তাও বাংলাদেশে, বর্ষার মৌসুমে, পানির মধ্যে। বলা যায়, জীবনের বড় একটি চ্যালেঞ্জ নিতে যাচ্ছ। তাই তোমার চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিভাগে যারা কাজ করবে—ক্যামেরা থেকে লাইটিং পর্যন্ত—এইসব বিভাগের প্রধান যেন অনভিজ্ঞ না হয়। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে অভিজ্ঞ মানুষদের নির্বাচন করতে হবে তোমাকে। যারা তোমাকে সাহায্য করবে।’ এক্ষেত্রে অবশ্য সুমিতের নিজস্ব ভাবনাও ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তার ছবিতে দেশি-বিদেশি টেকনিশিয়ানদের সমাবেশ ঘটবে। যেমন ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি বিদেশি হলে অ্যাসিস্ট্যান্ট সিনেমাগ্রাফার দেশি, প্রোডাকশন ডিজাইনার বিদেশি কিন্তু আর্ট ডিরেক্টর দেশি, আলোকনির্দেশক বিদেশি কিন্তু লাইটম্যান দেশি। বিদেশি টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কাজ করার পরে দেশি টেকনিশিয়ানরাই হয়তো হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট হিসেবে কাজ করবে সুমিতের আগামী ছবিতে।

‘নোনাজলের কাব্য’-এ ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি হিসেবে যিনি কাজ করেছেন, তিনি চানানুন চোতরংগরজ। সুমিতের টিস স্কুলের সিনিয়র বন্ধু। সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শুট করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ছবি হলো ‘থার্ড ওয়াইফ’। তার ছবি টরেন্টো, ভেনিস, সানড্যান্স ইত্যাদি চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছে। পুরস্কৃত হয়েছে। তিনি হলিউড অভিনেতা জেমস ফ্রাঙ্কোর দুটি ছবিতেও সিনেমাট্রোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন। তার দেখার চোখ আলাদা। ‘নোনাজলের কাব্য’র চিত্রনাট্য পড়ার পরে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি সুমিতকে জানান, থাইল্যান্ডের জেলেপল্লির মানুষদের নিয়ে তিনিও গল্প লিখতে চেয়েছিলেন। যা’হোক তখন তিনি আমেরিকাতে নয়, থাইল্যান্ডে ছিলেন। তাই সহজেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন সুমিতের ছবিতে কাজ করার জন্য। এরপর শুরু হয় একের পর এক স্কাইপ সিটিং, চরিত্র, লোকেশন, ডিজাইন আলোচনা, পর্যালোচনা। এছাড়া ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান হিসেবে এ ছবিতে কাজ করেছেন সুমিতের এক সহপাঠী বন্ধু—টিস স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশে আর্ট ডিরেক্টররাই সাধারণত প্রোডাকশন্স ডিজাইনারের কাজ করে। সুমিত এমনটি চান নি। তাই ওর ছবিতে প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন সিলভা নাহমিয়াস। ফ্র্যান্সের এই মানুষটির পা পড়েছে বাংলাদেশে বহুবার। নানা কাজের সূত্রে। তিনি তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ও ‘অন্তর্যাত্রা’র সঙ্গেও একই ভূমিকায় সম্পৃক্ত ছিলেন। এমনকি তারেকের নির্মিতব্য চলচ্চিত্র ‘কাগজের ফুল’-এর কাজও অনেকখানি করেছিলেন। তিনি ‘নোনাজলের কাব্য’র স্ক্রিপ্ট পড়ার পরে এর মধ্যে তারেকের ছবির ছায়া দেখতে পান; ছবির রক্ষণশীল এবং প্রগতিশীল মানুষদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তাকে আকৃষ্ট করে।

ছবির কাস্টিং ডিরেক্টর রাফি সুমন। তাকে ঠিক করে দিয়েছিলেন স্বনামধন্য নির্মাতা এবং চলচ্চিত্রকার অমিতাভ রেজা।

সম্পাদক রুমানিয়ার লুইজা পারভু ও কলকাতার শঙ্খজিৎ বিশ্বাস। সংগীত পরিচালক অর্ণব। কাস্টিংস ডিজাইনার এদিলা ফরিদ তুরিন। তিনি কাজ করেছেন ‘ন ডরাই’-এ। বাংলাদেশের প্রথম সার্ফিং চলচ্চিত্র। পোস্ট প্রোডাকশন সুপারভাইজার গি কু’তে কুইস। সিনিয়র কালার গ্রেডার অলিভিয়ার গার্সিয়া। রি-রেকর্ডিং মিক্সার ব্রুনো মারসিয়ে। সাউন্ড ডিজাইন টিয়াগো কার্দোস এবং ডিনিস হেনরিকুইস।

এবার অভিনয়শিল্পীর প্রসঙ্গ। ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র টুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তাসনোভা তামান্না। তিনি ‘লাইফ ফ্রম ঢাকা’র প্রধান নারী চরিত্রের অভিনয়শিল্পী। ছবিটির ট্রেলার দেখে সুমিত তাকে পছন্দ করেন। পরে তিনি অডিশনেও চমৎকার অভিনয় করেন। আরেক প্রধান চরিত্র রুদ্র-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিতাস জিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপক মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বেছে বেছে কাজ করেন। ‘রিজওয়ান’ নামের মঞ্চনাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ‘মৃত্তিকা মায়া’ চলচ্চিত্রের সূত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন।

ছবিতে অশোক ব্যাপারী হয়েছেন টুনির বাবা। বায়োস্কোপের ‘অস্থির সময়ের স্বস্তির গল্প’র ‘শ্যাওলা’ শীর্ষক এপিসোডে ব্যবসায়ীর ভূমিকায় তার অভিনয় দেখে সুমিত মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই সূত্রে তিনি অশোক ব্যাপারীকে নির্বাচিত করেন ‘নোনাজলের কাব্য’র জন্য। পরে তিনি পটুয়াখালী অঞ্চলের মানুষদের ভাষা আয়ত্ত করার বিষয়ে ছবির অন্য অভিনয়শিল্পীদের সাহায্য করেন। চেয়ারম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্বনামধন্য অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু। তার সহকারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শতাব্দী ওয়াদুদ। রোজী সিদ্দিকী এবং আজিজুর রহমান মুকুলও অভিনয় করেছেন এ ছবির দুটি চরিত্রে। আর বাকি সব চরিত্রে অভিনয় করেছেন কুয়াকাটার জেলেরা বা বরিশাল থেকে আসা মানুষেরা। তাদের অধিকাংশের মুখেই সংলাপ খুব অল্প। অবশ্য তাদের কারও কারও সংলাপ প্রক্ষেপণ এমন চমৎকার এবং বাস্তবানুগ হয়েছে যে, চলচ্চিত্রকার সুমিত তাদের সংলাপ বাড়িয়েছেন।

টেবিল রিড এবং কস্টিউম ট্রায়াল

শুটিংয়ের আগে টেবিল রিড-এ অভিনয়শিল্পীদের ডাকেন সুমিত। তাদের সামনে চিত্রনাট্য পড়ে শোনান। এতে তিনি যেমন উপকৃত হয়েছেন (চিত্রনাট্যে ছোটখাটো পরিবর্তন করেছেন, বিশেষত সংলাপে) তেমনি অভিনয়শিল্পীরাও একাত্মবোধ করেছেন নিজেদের চরিত্রের সঙ্গে। নতুন অভিনয়শিল্পীদের জড়তা কেটে গেছে। তারা সহজ ও সাবলীল হয়েছেন। এছাড়া কস্টিউম ট্রায়ালের মাধ্যমেও চরিত্রের মধ্যে ঢোকার সুযোগ পেয়েছেন অভিনয়শিল্পীরা।

শুটিং

‘নোনাজলের কাব্য’র অধিকাংশ শুটিং হয়েছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটাসহ সেখানকার বিভিন্ন উপজেলায়। এছাড়া চট্টগ্রাম শহর এবং আনোয়ারা উপজেলায়ও এ ছবির কিছু অংশের শুটিং হয়েছে।

ছবিটির বেশির ভাগ শুটিং হয়েছে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট স্পট থেকে এক ঘণ্টা দূরবর্তী চরের মতো একটি জায়গায়। সেখানে শুটিং উপযোগী করে চারটি ঘর বানানো হয়েছিল। একটি চেয়ারম্যান, আরেকটি রুদ্র এবং অন্যটি বাসারের ঘর। অন্য ঘরটি ছিল মসজিদ। এই লোকেশনে শুটিং করার সময় ফ্রেমে ধরা পড়েছে কুয়াকাটার জেলেপল্লি তথা জেলেদের ঘর, যা এফডিসিতে শুটিং করলে দেখা যেত না। যা হোক, এই বাস্তবতার জন্য অবশ্য বেশ অর্থ খরচ করতে হয়েছে সুমিতকে। আরেকটি কথা, সুমিত টানা শুটিং করেন নি। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে তিনি দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করেছেন। সপ্তাহের সাত দিনও শুটিং করেন নি। একদিন ইউনিটের সবাইকে বিশ্রাম করতে দিয়েছেন।

কুয়াকাটার যে গ্রামে ছবিটির শুটিং হয়েছে, সেখানকার মানুষজন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের অনেকেই এ ছবিতে জেলের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছে। তারা খুব খুশি যে তাদের যাপিত জীবন এ ছবিতে তুলে ধরা হচ্ছে।

ক্যামেরা ওপেন হয়েছিল ২০১৮-এর ১৩ জুলাই। কুয়াকাটার নিকটবর্তী একটি চর এলাকায়। প্রথম দিন ছয়বার বৃষ্টি হয়েছিল, প্রতিবার দশ মিনিট করে। যেহেতু উন্মুক্ত স্থানে শুটিং হয়েছিল, প্রতিবার আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিল না, গাছ ছিল না, মাথার ওপরে ‘আচ্ছাদন’ ছিল না সেহেতু ক্যামেরা, লেন্সসহ শুটিং-এর সরঞ্জামের সুরক্ষার বিষয়টি সবাইকে মাথায় রাখতে হয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজলে কোটি টাকা মূল্যের এইসব জিনিস নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সুমিত, ‘নোনাজলের কাব্য’র পরিচালক, তিনি ভেবেছিলেন ভালোয় ভালোয় শুটিং করতে পারবেন তো ? তা তিনি পেরেছিলেন। বৃষ্টির কারণে কোনোদিন শুটিং বন্ধ থাকে নি। প্রকৃতি সহায় হয়েছিল। বেশিক্ষণ থাকেনি বৃষ্টি।

শুটিং হয়েছে দুইভাবে—কখনো মেঘ ও রোদের খেলাকে মাথায় রেখে; কখনো আবার এ বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে। হ্যাঁ, ক্লোজআপ শটের বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়েছে। কেননা দু’রকম হলে কালার গ্রেডিংয়ে তা মেলানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে মাস্টার শটে এই বিষয়টি মাথায় না রাখলেও চলে। কখনো সূর্যকে মেঘ ঢেকে দিলে গ্যাফার (লাইটম্যান) এবং ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি তারাই হিসাব করে—সেই মেঘ কতক্ষণ থাকতে পারে। সে অনুযায়ী শুটিং হয় এবং হয়েছে।

শুটিংয়ের সময় জোয়ার-ভাটার হিসাবও রাখতে হয়েছে। যেমন একটি দৃশ্যে রয়েছেÑসমুদ্র ফুঁসছে। তখন তো ভাটা থাকলে চলবে না। আর সেই দৃশ্যগ্রহণের কাজ যদি বিকেলে শুরু হয় এবং তারপরেই সমুদ্রে ভাটা লেগে যায়, তাহলে পরদিন খুব সকালে সেই দৃশ্যের কাজ শেষ করতে হবে এবং তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। যা হোক, জোয়ার-ভাটার বিষয়ে শুরুতে এ ছবির পরিচালক, সুমিত, স্থানীয় একদল জেলের প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু তাদের কথার সঙ্গে জোয়ার-ভাটার সময়টি পুরোপুরি মিলত না। সময়ের হেরফের হতো। তাই একপর্যায়ে যখন মোবাইলে এই বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের অ্যাপ পাওয়া গেল, তখন কাজটি অনেক সহজ হয়ে গেল। এতে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যেত—কখন জোয়ার হবে, কখনই বা ভাটা লাগবে। আর হ্যাঁ, আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখতে হয়েছে। সেটি হচ্ছে, জোবা। এটি হচ্ছে অনেক বড় জোয়ার। পনেরো দিন পর পর হয়। তখন প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং প্রবাহিত হয় প্রবল বাতাস।

উল্লেখ্য, ছবিটির শুটিং শুরু হওয়ার পনেরো দিন পেরুতে না পেরুতেই জানা গেল, যে গ্রামে শুটিং হচ্ছে সেই গ্রামের একটি অংশ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে জোবা। শুনে ইউনিটের অনেকেই ছুটে গেল সেখানে। দেখা গেল, চারটি বাড়ি নেই। কলামগুলো দাঁড়ানো। একটি খাট পড়ে আছে। কয়েকটি থালাবাসন চারদিকে ছড়ানো। পরিচালক সুমিত ঘরহারা বাসিন্দাদের বললেন, ‘আমরা যে মসজিদ বানিয়েছি, সেখানে আপনারা থাকতে পারেন।’ সেই মসজিদে মাত্র দুদিন ছিল তারা। এরই মধ্যে বনের এক প্রান্তে নতুন করে ঘর বানিয়ে তৃতীয় দিনে সেখানে চলে যায় তারা। আসলে এই ধরনের ঘটনা তাদের জীবনে নতুন নয়। এ হলো নিত্য দিনের ঘটনা। তাই তারা প্রতিনিয়তই প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়; আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে।

ঝড়

এ ছবিতে দেখানো হয়েছে সিডর বা ঝড়ের রুদ্ররূপ। এর জন্য অবশ্য পরিশ্রম করতে হয় নি প্রোডাকশন ডিজাইনারকে, কোনো কিছু সৃষ্টি করতে হয় নি। কেননা দেখা গেছে, কুয়াকাটার বনে প্রতিদিনই গাছ পড়ছে। ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যাবে—টুনি গাছের একটি ডাল কাটছে। চারদিকে ছড়িয়ে আছে নানা গাছের গুঁড়ি। এটি শুটিংয়ের জন্য সৃষ্টি করা হয় নি। এ প্রকৃতিরই কাজ। উল্লেখ্য, গ্রামের মুরব্বিদের কাছ থেকে জানা গেছে, বিশ বছর আগে সেখানকার বন আরও এক কিলোমিটার পানির ভেতরে ছিল।

সাজসজ্জা

এ ছবির অভিনয়শিল্পীরা হালকা মেকাপ নিয়েছেন। শুটিংয়ে ঘেমে-টেমে গেলে মুখটা একটু ঠিক করা, এটুকুই ছিল মেকআপম্যানের কাজ। উল্লেখ্য, এ ছবির জন্য ফজলুর রহমান বাবু, যিনি চেয়ারম্যানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তিনি দাড়ি রেখেছিলেন। তার সঙ্গে চুক্তি করার সময় এ বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন সুমিত। তবে এ ধরনের প্রস্তুতির জন্য অভিনেতাকে তার অন্যান্য কাজ যেমন ধারাবাহিক ও একক নাটক থেকে বিরতি নিতে হয়। আর এর জন্য যে ধরনের পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত তা কখনোই একটি স্বাধীনভাবে নির্মিত চলচ্চিত্র দিতে পারে না। তাই সুমিত মনে করেন, এখানে পরিচালক ও অভিনেতার একে অপরকে বোঝার একটি ব্যাপার রয়েছে, যা টাকার অঙ্কের হিসেবে বোঝানো যাবে না।

শিল্প নির্দেশনা

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ ছবির প্রোডাকশন্স ডিজাইনার হলেন সিলভা নাহমিয়াস। তিনি শুটিং শুরু হওয়ার এক মাস আগে কুয়াকাটায়—শুটিং স্পটে গিয়েছেন। পরিচালকের নির্বাচিত স্থানে চারটি ঘর নির্মাণ করেছেন। এ কাজে তিনি স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করেছেন, এমনকি নির্মাণেও। আর আর্ট ডিরেক্টর  সিহাব নুরন্নবী তত্ত্বাবধান করেছেন কাজটির। সেইসব ঘর হুবহু জেলেপল্লির মতো। ভেতরের জিনিসপত্রও। কোনো কোনো আসবাব বা তৈজসপত্র জেলেদের কাছ থেকেই ধার করা হয়েছিল। আর ঘরের মেঝে লেপে দিয়েছে জেলেদের বউ-ঝিরা। তারা মাটির চুলাও বানিয়েছে। অন্যদিকে অবারিত প্রকৃতির মাঝেও সিলভার কাজ ছিল। যেমন পরিচালক নৌকা নির্বাচিত করেছেন। আর সেই নৌকাটিকে সাজিয়েছেন তিনি। পতাকা লাগিয়েছেন। রং দিয়েছেন। এমনকি কোনো শটে হয়তো দেখা গেছে কয়েকটি নৌকা। সেখানে সিলভা জানিয়েছেন, কোন কম্পোজিশনে নৌকাগুলো থাকবে; ফ্রেমটি কোন দিক থেকে কীভাবে থাকলে ভালো হবে। ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফির চাহিদা অনুযায়ী নানা সময়ে নানা জিনিস সরবরাহ করেছেন সিলভা। যেমন তাকে বলা হয়েছে একটি শটে ক্যামেরার ফোরগ্রাউন্ডে গাছ থাকবে। তখন সেই গাছ সরবরাহ করেছেন সিলভা। ছবির জন্য একটি চায়ের দোকানও তৈরি করেছিলেন তিনি। একেবারে বাস্তবের চায়ের দোকানের মতো।

সম্পাদনা

শুটিংয়ের পরে দেখা গেল, টাকাপয়সা শেষ। কিন্তু ছবিটির সম্পাদনা তো করতে হবে। এখন উপায় ? এ সময় ভারতের তরুণ সম্পাদক শঙ্খজিৎ বিশ্বাস, যার সম্পাদিত চলচ্চিত্র বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছে, প্রশংসিত হয়েছে—তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন ‘নোনাজলের কাব্য’-এর বিষয়ে। জানালেন, আপাতত টাকাপয়সা দিতে হবে না। শুধু যাওয়া-আসার টিকিট এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই হবে। সেই ব্যবস্থা করা হলো। তারপর ৭২ ঘণ্টার শুট করা ফুটেজ থেকে সেটিকে ৪ ঘণ্টার ব্যাপ্তিতে দাঁড় করালেন শঙ্খজিৎ। সেখান থেকে চলচ্চিত্রটি বের হয়ে আসবে। এটি একটি কঠিন কাজ। একজন ভাস্করের একটি ভাস্কর্য খোদাই করার মতো। কিন্তু হঠাৎ নিজের একটি প্রামাণ্যচিত্রের কাজ পড়ে যাওয়ায় শঙ্খ আর সময় দিতে পারেন নি। তাই ছবিটির চূড়ান্ত সম্পাদনা করেছেন লুইজা পারভু।

গান

ছবিতে গান রয়েছে দুটি। দুটিই লোকেশনে গাওয়া। এ দুটো গান আরোপিত নয়, গল্প এবং সিকোয়েন্সের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে এবং গান দুটি চলচ্চিত্রটিকে থমকেও দেয় নি। ছবিটির আবহসংগীতের কাজ করেছেন অর্ণব।

শেষ কথা

‘নোনাজলের কাব্য’ একটি জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র। নান্দনিক তো বটেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, এটি তরুণ চলচ্চিত্রকার রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র। ছবিটি চলচ্চিত্র-মনস্ক দর্শক এবং সমালোচকদের ভালো লাগবে, তাদের মুগ্ধ করবে—এমন প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। তবে ছবিটি আগে দেখতে পাবেন বিদেশের দর্শকেরা। এটি প্রথম প্রদর্শিত হবে কোনো একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, হয়তো আগামী বছরের শুরুতে। পরে এটি দেশীয় প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে।

ছবিটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে— facebook.com/mypixelstory.

Leave a Reply

Your identity will not be published.