হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর

হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর

মাটির স্থাপত্যের ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রায় ৯০০০ বছরের পুরনো। বাংলা অঞ্চলে মৃৎস্থাপত্য ও মাটির বাড়ির ইতিহাসও কয়েক হাজার বছরের। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বসত-বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনার, বিশেষ করে  বসত-বাড়ির আকার, আকৃতি, ছাউনির ধরন, নির্মাণ উপাদানের পার্থক্য সুস্পষ্ট। ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনার এই ভিন্নতা প্রকারান্তরে মানুষের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐক্য এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার পরিচায়ক; যা প্রধানত মাটির তৈরি স্থাপনাতেই বেশি প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের দেশের গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মাটির তৈরি ঘরগুলো বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। মাটির ঘরবাড়ি আমাদের দেশের সব জায়গায় দেখা যায় না। অঞ্চলভিত্তিক মাটির ঘর দেখা মিলে। বিশেষত  লাল মাটির এলাকাগুলোতে মাটির ঘর বেশি পাওয়া যায়।

এই মাটির তৈরি ঘরের দেখা মিলে সাধারণত নওঁগা, দিনাজপুর, গাইবান্ধা,  ময়মনসিংহের ভালুকা, ত্রিশাল, গাজীপুরের কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ উপজেলা, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল, সিলেট ও শেরপুর জেলায়। শেরপুরের গারো নৃগোষ্ঠীদের অধিকাংশ বাড়িঘরই মাটির তৈরি। বন্যাপ্রবণ এলাকায় মাটির ঘর তৈরি করা সম্ভব হয় না। বন্যার পানির ছোঁয়া পেলে মাটির ঘরগুলো সহসাই ধ্বসে পড়ে কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিগত পাঁচ থেকে ছয় দশক আগে আমাদের গ্রাম-বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে সারা গ্রাম পায়ে হেঁটে এলেও মাটির ঘর ছাড়া একটিও টিনের ঘর চোখে পড়ত না। 

মাটি দ্বারা তৈরি এসব ঘরকে বলা হয় শান্তির নীড় বা বালাখানা। অনেক দীর্ঘ সময় লাগিয়ে ও ব্যয় সাপেক্ষ এই মাটির ঘরগুলোকে যারা বানান, তাদের বলা হয় ‘দেলবারুই’। সচরাচর এঁটেল মাটি দিয়ে এসব ঘর তৈরি করা হতো। পরিচ্ছন্ন মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে ইটের মতো সারি সারি করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হতো। ঘরের দেয়ালের মাটি শুকানোর পর তার উপরে কাঠ, বাঁশ কিংবা তালগাছের চিরানো কাঠের তৈরি কাঠামোর ওপর খড়, ছন  বা টিন দিয়ে ছাউনি দেয়া হতো। প্রতিটি ঘর তৈরিতে দেড়-দুই মাস সময় লাগত। তবে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে সৃষ্ট অতি বৃষ্টি কিংবা ব্যাপক বিধ্বংসী বন্যার কারণে ঘরের স্বাভাবিক কাঠামো নষ্ট হওয়ায় লোকজন মাটির ঘর তৈরিতে আজকাল আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

প্রায় তিন দশক আগে আমাদের ঢাকা শহরের রায়েরবাজার এলাকায় লাল মাটির তৈরি ঘরের অস্তিত্ব ছিল। সেইসব ঘরে সনাতন ধর্মাবলম্বী কুমারদের বসবাস ছিল চোখে পড়ার মতো। যুগের চাহিদার বাস্তবতায় সেইসব মাটির তৈরি ঘরের জায়গায় বর্তমানে বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মিত হয়েছে। আমি আগে মাঝেমধ্যে কুমারদের ফুলের টব ও পোড়া মাটির নান্দনিক তৈজষপত্র  কিনতে যেতাম। সবকিছুই আজ সোনালি অতীত। আমরা ষাটোর্ধ্ব প্রবীণরা এখনও হারিয়ে যাওয়া  অনেক কিছুর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছি। দৃষ্টিনন্দন এসব মাটির ঘর শহর অঞ্চলে আর কখনো দেখা যাবে না। এইসব বাড়িঘর দেখতে হলে যেতে হবে শহর থেকে অনেক দূরের গ্রামে। যেখানে যান্ত্রিকতার দৌরাত্ম্য এখনো নিঃশেষ করে দেয় নি গ্রামের মানুষের সাদামাটা সহজসরল জীবনাচরণকে। সেইসব গ্রামে এখনো মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির কলরবে। নিশির শেষভাগে হাঁস-মোরগের ডাক শুনে ঘুমন্ত কৃষক-কৃষাণিরা বুঝতে পারে ভোর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই। সারা রাত কৃষক তার মাটির ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ভোরবেলায় কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ ও ভর্তা-ভাজি দিয়ে তৃপ্তি সহকারে পান্তা ভাত খেয়ে গরু জোয়াল নিয়ে মাঠে চলে যায়।

আগে গ্রামাঞ্চলে ডাকাত ও সিঁধেল চোরের  অত্যাচার অনেক বেশি ছিল। গ্রামের  বিত্তবান গৃহস্থরা ডাকাত ও চোরদের হাত থেকে বাঁচতে ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে মাটির প্রশস্থ দেয়ালের উপর শক্ত করে দোতলা ঘর বানাতেন। দোতলার মেঝে বানাতে  তালগাছের মোটা চৌকাঠের ওপর কাঠের পাটাতন বিছানো হতো। রাতের বেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঘরের দরজা শক্ত কাঠের ঢাসা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হতো। তৎকালীন বিত্তবানদের শৌখিন ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে তৈরি হতো দোতলা বা তিনতলা  মাটির ঘর। ভূমিকম্পে মাটির ঘরের খুব একটা ক্ষতি হয় না। গোবরের সঙ্গে কালো ছাই ও পানি মিশিয়ে মাটির ঘরের যত্ন করেন গ্রামের কৃষানিরা। ফুল, পাখি, বিভিন্ন আলপনা ও জীবজন্তুর ছবি মাটির ঘরের দেয়ালে আঁকার কাজটি ছিল পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সম্মানের ব্যাপার।

ঠিক মতো যত্ন নিলে মাটির ঘর এক থেকে দেড় শ’ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।

এক সময় গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জে এই ধরনের মাটির তৈরি বাড়ি হরহামেশা দেখা যেত। এখানকার অধিকাংশ প্রাচীন মাটির বাড়ি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় সেই বাড়িগুলো ভেঙে সেখানে নতুন করে আধুনিক দালানকোঠা নির্মিত হয়েছে। তবে আমাদের পাশের উপজেলা কাপাসিয়ার গ্রামগুলোতে এখনো অনেক পুরনো মাটির ঘরের দেখা মিলে। সেখানে কোনো কোনো মাটির ঘরের বয়স প্রায় দেড় শ’ বছর। এই মাটির ঘরগুলো সাধারণত এক থেকে দোতলা হয়ে থাকে। তা ছাড়া নওগাঁ জেলায় নিভৃত গ্রামাঞ্চলে এখনো বহু দৃষ্টিনন্দন মাটির ঘর চোথে পড়ে। এই দুটি জেলায় মাটির ঘরগুলোর ওপর টিন দিয়ে ছাওয়া হয়ে থাকে। ঘরের ভেতরে সূর্যের তাপ নিঃসরণ নিরোধ করতে টিনের নিচে বাঁশের তৈরি বেড়া দিয়ে ঘরের সিলিং বানানো হতো। আমাদের কালীগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় ঘরের সিলিংকে ‘কার’ বলা হয়ে থাকে। এই ‘কারে’ গৃহস্থরা নানাবিধ হালকা ওজনের গৃহস্থালি জিনিস সহজেই মজুদ করে রাখত। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতাল নৃগোষ্ঠীদের মাটির ঘরের ছাদ অধিকাংশই খড় কিংবা টিন দিয়ে ছাওয়া হয়ে থাকে। 

আমার দাদার আমলে আমাদের কালীগঞ্জের গ্রামের বাড়িটি দোতলা মাটির ঘর ছিল। দোতলায় ওঠার জন্য  ঘরের ভেতরে একটি কাঠের সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়ি বেয়ে অনায়াসে আমরা দোতলায় উঠে যেতে  পরতাম। দোতলায় ঘুমাবার জন্য সুন্দর একটি বড় চৌকি পাতা ছিল। সেখানে বড় মাপের গোলার ভিতরে ধান, চাল, বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য, ধান ও পাটের বীজ মজুদ করে রাখা হতো। অনেক যত্ন ও শক্ত করে আমার প্রয়াত দাদা দোতলা সেই মাটির ঘরটি নির্মাণ  করেছিলেন। এই ঘরের মেঝে ইট-সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা ছিল। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিগত নব্বই দশকের শেষের দিকে ইঁদুরের সৃষ্ট গর্তের কারণে সেই ঘরটি একদিন বিকেলে ধ্বসে পড়ে। অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যান আমার ছোট চাচি। তারপর সেই জায়গায় নতুন দালান নির্মিত হয়েছে। চিরতরে হারিয়ে গেছে আমার দাদা-দাদির স্মৃতি বিজড়িত সেই সুদৃশ্য মাটির ঘরটি।

ইদানীং মাটির ঘর তৈরির পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে মানুষ। কাদামাটির পরিবর্তে শুকনো ঝরঝরে মাটি, খড় ও পাঁচ শতাংশ সিমেন্ট মিশিয়ে ব্লক তৈরি করে দুরমুজ দিয়ে পিটিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই মাটির ঘর তৈরি করা হচ্ছে।

গরমে হালকা ঠান্ডা আমেজ ও শীতে হালকা গরম থাকে এই মাটির ঘরগুলো। ফলে মাটির ঘরকে বলা হয়ে থাকে ‘গরিবের এয়ার কন্ডিশন’। ‘কাদা’ /মাটি/আর্থ ‘সিমেন্ট’ /কংক্রিট / ইটের তুলনায় অনেক ভালো অন্তরক। তাই মাটির ঘর গ্রীষ্মকালে শীতল (তুলনামূলক) এবং শীতকালে উষ্ণ থাকে। আধুনিকতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, রুচিবোধ পরিবর্তনে মানুষ মাটির ঘর রেখে দালানঘর গড়ে তুলছে। মাটির বাড়িগুলো গ্রামের সহজ-সরল মানুষের জীবনযাত্রা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আমরা আরও হারাচ্ছি গ্রামীণ জীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতি। সময়ের দাবি মানতে গেলে পরিবর্তন আসতেই পারে, তাই বলে নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চোখের সামনে থেকে ক্রমশ বিলীন হয়ে যাবে, সেটাও মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির জীবন্ত জাদুঘর মাটির ঘরগুলো কালের বিবর্তনে একেবারে যেন হারিয়ে না যায় আমাদের সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।  

Leave a Reply

Your identity will not be published.