আনিসুজ্জামান, সকলের প্রিয় ‘স্যার’, ‘বাংলাদেশের শিক্ষক’ সশরীরে আমাদের মাঝে নেই চার বছর হলো। ২০২০ সালের ১৪ মে চলে গেছেন তিনি না-ফেরার দেশে। আজ তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।
সময়ের বাতিঘর হিসেবে গণ্য মহীরুহসম এই মানুষটি শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পালন করেছেন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, শিক্ষা-চিন্তক, সংস্কৃতিসাধক, মুক্তিসংগ্রামী, মানবাধিকার সংগঠক, সর্বোপরি জাতির বিবেক।
ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন আনিসুজ্জামান। তিনি সেই সময়ে যুবলীগের পক্ষ থেকে লিখেন ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন/ কি ও কেন ?’ এটি ছিল ভাষা-আন্দোলনকে নিয়ে লেখা প্রথম পুস্তিকা। বায়ান্ন’র ২৫ ফেব্রুয়ারি ডাকা সাধারণ ধর্মঘট সফল করার জন্য লিফলেট ড্রাফট, প্রকাশ এবং বিতরণের কাজও করেন আনিসুজ্জামান। শুধু তাই নয়, ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-র উৎসর্গপত্রটিও নিজের হাতে লিখেছিলেন আনিসুজ্জামান। সেখানে লেখা ছিল, ‘যে অমর দেশবাসীর মধ্যে থেকে জন্ম নিয়েছেন একুশের শহীদেরা, যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট রয়েছে একুশের প্রতিজ্ঞা, তাদের উদ্দেশে।’ ১৫ বছরের এক কিশোর পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন নিজের হস্তাক্ষর মুদ্রিত করতে দিয়ে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।
পাকিস্তান আমলে এদেশে যত রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলন হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনো যোগাযোগ ছিল আনিসুজ্জামানের। চৌষট্টি সালে দাঙ্গাবিরোধী কাজকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন; কাজ করেছেন শরণার্থী শিবিরেও। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় বাংলাদেশের শিক্ষকদের কল্যাণে কাজ করেছেন; তাদের সংগঠিত করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সংগ্রহের কাজে ছিলেন নিয়োজিত। প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য হিসেবেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
স্বাধীনতাত্তোরকালে সংবিধানের বাংলা ভাষ্যের রচয়িতা হিসেবে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন, যেখানে জোর দেওয়া হয়েছিল সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। আর বাংলাদেশের সংকটকালে, বিপর্যস্ত অবস্থায় তিনি ছিলেন প্রতিবাদী ভূমিকায়।
আন্তর্জাতিক বিদ্বৎ সমাজে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন পাঁচ দশকের অধিক সময়। এক্ষেত্রে তাঁর মেধা ও মননশীলতার দ্যুতি ছড়িয়েছে সবগুলো মহাদেশে।
গবেষক হিসেবে আনিসুজ্জামান ছিলেন অসাধারণ। পঁচিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই তিনি ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনা করেছিলেন। যেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলিম লেখকদের অবদান।
পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কেও আনিসুজ্জামানের গবেষণা বাংলা গদ্যের ইতিহাস পুনর্গঠনে যোগ করেছে অনেক নতুন উপাদান। এ প্রসঙ্গে তাঁর Factory Correspondence and other bengali documents in the india office library and records (1981), আঠারো শতকের বাংলা চিঠি (১৯৮৩), পুরোনো বাংলা গদ্য (১৯৮৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক সম্পর্কে আনিসুজ্জামান গবেষণা করেছেন, করেছেন গ্রন্থ রচনাও। এর মধ্যে মুনীর চৌধুরী, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, অজিত গুহ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ লেখক সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের গবেষণা প-িতজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাঙালি নারী বিষয়েও তাঁর গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই তাঁর দখল ছিল কিংবদন্তিতুল্য। অনুবাদক হিসেবেও রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। অস্কার ওয়াইল্ড, আলেক্সেই আরবুঝভের নাটক রূপান্তর করেছেন আনিসুজ্জামান। প্রথম যৌবনে লিখেছেন ছোটগল্প। জীবনের শেষ বেলায় লিখেছেন তিনি ‘কাল নিরবধি’ ও ‘বিপুলা পৃথিবী’। এই দুটি গ্রন্থ বাংলা ভাষার আত্মজীবনীর ধারায় বিশিষ্ট সংযোজন।
আনিসুজ্জামান দীপ্র মনীষা। এ আলো কখনো নিভবে না। জাতির সংকটে ও দুর্যোগে দিশা প্রদান করবে। প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি অন্যদিন পরিবারের শ্রদ্ধার্ঘ।
Leave a Reply
Your identity will not be published.