এলিফ্যান্ট রোডের ‘শিশির কণা’ নামের পাঁচতলা বাড়ির ছাদে সাদা কাপড়ের সামিয়ানা পাতা হয়েছে। বাড়িতে ঢুকতে যে সবুজ চত্বর, সেখানে সার বাঁধা চেয়ার-টেবিল, বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য। কার্তিক মাসের রোদের সঙ্গে আগরবাতি, গোলাপজলের গন্ধে রচিত হয়েছে শোকময়তার মেদুর নির্জন প্রেক্ষিত। বাড়ির একসময়ের কর্ত্রী ছয় সন্তানের জননী হাফেজা বেগম ইন্তেকাল করেছেন। পরিণত বয়সেই দেহ রেখেছেন। ফলে অকাল প্রয়াতজনিত হাহাকার নেই। মৃত্যুর চৌত্রিশ দিন পর চেহলাম উপলক্ষে তাই এ আয়োজন। তাঁর পরলোক গমনকে আবর্ত করে পাঁচ পুত্রের আত্মভাবনায় স্থান পেয়েছে এক সূক্ষ্ম গ্লানিবোধ। মাতৃশোকে কাতর পুত্রদের সত্তায় নিঃশব্দ রক্তপাতের মতো নিঃশেষ হতে থাকে অপরাধবোধের ত্রাস। আপাত শোকের মুখোশে তাঁদের গোপন জটিল ভাবনারা প্রকাশিত হয়।
একটি মাত্র মৃত্যু জোয়ার্দার বাড়ির পাঁচ ছেলেকে এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। এক মাস আগেই মাতৃশোকে সন্তাপের সীমানারেখায় হাফেজা বেগমের পুত্রেরা নিমজ্জিত ছিল। জীবিতকালে মাকে যথাযথ সেবা, সময় দেয়া হয় নি। সেই অনুশোচনায় চারদিনের মিলাদ শেষে চেহলাম অনুষ্ঠান সর্বাঙ্গীণ সফল করার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেয়া হয়। তৎপর পাঁচপুত্র এবং পুত্রবধূরা। লোক সমাগমের আধিক্যে, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের আগমনে যেন পুত্রদের মায়ের প্রতি ভালোবাসার বেদনাকুসুম প্রস্ফুটিত হতে পারে। মা বেঁচে থাকতে যে যাবতীয় জাগতিক ভুলে মোহগ্রস্ত ছিল- তাকে বিসর্জন দিয়ে ছেলেরা প্রবলভাবে নিমগ্ন মাতৃবন্দনায়।
পাঁচ ভাইয়ের পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় দিন স্থির হয়েছে বৃহস্পতিবার। পাঁচতলা বাড়ির সামনে উঠোন (এখন বলা হয় লন) বাইশ’শ স্কয়ার ফিটের ছাদে সামিয়ানা পাতা। বাবুর্চিরা আগের রাত থেকেই রান্নার যাবতীয় উপকরণ জোগাড় ও রচনায় ব্যস্ত। যেহেতু দুপুরে খাবারের জন্য সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, ছেলেদের শ্বশুরকুলের কুটুমরা মাতৃবন্দনার এ বিপুল যজ্ঞে আমন্ত্রিত। দূরের-কাছের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে টেলিফোনে, লোক পাঠিয়ে এবং খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছে। এ সমস্ত বিষয়ে মেজছেলের বাস্তব বুদ্ধি প্রখর। ফলে বাড়িতে এতলোকের ভিড় দেখে মনে হতে পারে কোনো মহৎপ্রাণের প্রয়াণ ঘটেছে।
এ বাড়ির প্রধান গেটে লেখা আছে- ‘শিশির কণা’। নামে কাব্যিক গন্ধ থাকলেও এ বাড়ির চত্বরে সুকুমার কলার কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং রাজনীতি, অর্থ, স্বার্থপরতা, কূটক্যাচালি, ঈর্ষা, ভদ্র সমাজের নৈশকালীন সমস্ত উপাচার অন্দরমহলে চর্চা হয়। বাইরে অবশ্য ছিমছাম উচ্চ মধ্যবিত্তের লেবাস। বাড়িটির প্রকৃত মালিক ছিলেন জোয়ার্দার সাহেবের অকৃতদার চাচা। স্কুলের অংক শিক্ষক ছিলেন। সখ ছিল কবিতা লেখার। গাছ-পালা পরিচর্যার। তাঁর লাগানো গাছ এ বাড়ির সৌন্দর্যকে একসময় বিশিষ্টতা দিয়েছিল। পরে দো-চালা টিনের ঘর ভেঙে যখন দালান ওঠে তখন চমৎকার বাগানটি অনাবশ্যক মনে করে বহুগাছই কেটে ফেলা হয়েছিল। তো চাচার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে জোয়ার্দার সাহেব বাড়ির মালিক হন। বহুবার ভেবেছেন নামফলকটি পরিবর্তন করে ‘জোয়ার্দার মঞ্জিল’ লিখবেন। কিন্তু কৃতজ্ঞতাবশত বা মহত্ত্ব অথবা উদাসীনতায় বাড়ির নামটি অপরিবর্তিতই থাকে।
একসময় কষ্টে, কৃচ্ছতাসাধন করে এ বাড়ির মানুষগুলো দিন কাটিয়েছে। স্বাচ্ছন্দ্য আর প্রাচুর্য এসেছে হঠাৎ করেই এবং অবশ্যই সময় ও পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারে। ফলে বদলে গেছে তাঁদের চাল-চলন, চরিত্র। তখন অর্থাভাব থাকলেও মা-বাবা, ভাই-বোনের মধ্যে যে ভালোবাসা, স্নেহের পূর্ণপ্রাণ ছিলÑ অর্থ এবং পরবর্তীসময়ে স্ত্রীদের আগমনে তা অনর্থ ঘটিয়েছে।
বাড়ির মালিক অর্থাৎ হাফেজা বেগমের স্বামী জোয়ার্দার সাহেব কৈশোর ও যৌবনে স্কুল শিক্ষক চাচার কাছে থেকে পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা শহরের মোটামুটি নামকরা স্কুলে পড়াশোনা করলেও মেধা এবং যোগ্যতার অভাবে প্রায় প্রতিটি শ্রেণীতে তিনি বার দুই অকৃতকার্য হয়েছেন। অবশেষে গ্রামের স্কুল থেকে জীবনের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে কোনোরকমে উত্তরে যান এবং তারপরই তিনি বিশ বছর বয়সে চাচার সূত্রে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন।
যথাসময়ে বিয়ে এবং সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ব্যবসায় তেমন গতি করতে পারেন নি। সংসার চালাতে হিমসিম খেয়েছেন। একাত্তর সালে দেশ যখন আক্রান্ত- জোয়ার্দার সাহেবের ভাষায় দুষ্কৃতিকারীদের নাশকতামূলক তৎপরতায় দেশের শান্তি বিঘ্নিত, তখন সরাসরি শান্তি কমিটির সদস্য না হয়েও কমিটির সদস্যদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন। বাঙালির ঘোরদুর্দিন হয়ে উঠল তাঁর জীবনের পয়মন্তকাল। বড় ছেলের বয়স তখন উনিশ, মেজছেলের সতের, সেজটির চৌদ্দ। নয়মাস দেশব্যাপী অরাজকতার সময় তিনি সপুত্রক ঢাকাতেই ছিলেন। আর দেশটা সহসাই পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে শেয়ালের মতো চাতুর্যে সামলে নেন নিজেকে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেই পাড়ার লোকজন আবিষ্কার করেন মূলত জোয়ার্দার সাহেব একজন প্রকৃত বাঙালি এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্রেরা মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত হয়ে উঠে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পিতার চরিত্রের ভণ্ডামি, নীতিহীনতার বিশেষণগুলো ধারণ করে সুযোগ সন্ধানী ছেলেরা এখন সবাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। সমাজে বিশেষ স্থান নিয়ে আছেন। প্রকৃতির রোদ-ছায়ার মতো তাদের চরিত্রের প্রচ্ছদ বদলেছে দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সমান্তরালে।
হাতের পাঁচ আঙুলের মতো বাড়ির পাঁচ ছেলে। এক হলেও তাদের চাল-চরিত্র পাঁচ-আঙুলের মতোই আকারে গড়নে ভিন্ন। একটি বিষয়ে পুত্রদের মিল- প্রতিটি ছেলে দৈহিক গড়নে চোখে পড়ার মতো। মাঝারি গড়ন, কিন্তু সুদর্শন এবং সেকারণেই জোয়ার্দার সাহেবের সুদর্শন মাকাল ফলস্বরূপ পুত্রদের স্ত্রীভাগ্যও ঈর্ষান্বিত হবার মতো। প্রথম তিন পুত্র তো প্রথম দর্শনেই মোহিত হবার মতো। বছর পনের আগে মৃত্যুকালে তিনি পাঁচ-পুত্রের গর্বিত জনক হিসেবে চোখ বুজেছেন; অন্তরে কিছুটা অতৃপ্তি ছিল। নিজেদের পছন্দের বিয়ে; বিমোহিত ছেলেদের স্ত্রীভাগ্য ভালো। কিন্তু বিদ্যাচর্চায় এরা কেউই সাফল্য অর্জন করতে পারে নি। শৈশব-কৈশোরে ছেলেদের ওপর যতটা শাসন ছিল, সময়ের চোরাস্রোতে তা ভেসে গেছে। ফলে মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত গিয়ে তাদের যোগ্যতা আছড়ে পড়েছে। কেবল চতুর্থ ছেলেটি বি.এ. পাস করে জোয়ার্দার সাহেবের বংশগৌরব বাড়িয়েছে। হোক তৃতীয় শ্রেণীর গ্রাজুয়েট। তবু তিনি জীবিতকালে আত্মীয়-মহলে প্রসঙ্গক্রমে কথাটি উল্লেখ করতেন। বলাই বাহুল্য বাবার মতোই ধর্মভীরু পুত্ররা। জীবনভর অনাচার, অনৈতিক কাজে লিপ্ত থেকেও তিনি ছিলেন পরম খোদাভক্ত। পাঁচওয়াক্ত নামাজ আলসেমি করে পড়া হতো না। বিশেষ করে ফজরের নামাজকালে তাকে কালঘুম পেয়ে বসত। কিন্তু জুম্মার নামাজ নিয়মিত পড়তেন। শুভ্র আচকান-পায়জামা পরিহিত হয়ে পুত্রদের নিয়ে তিনি যখন মসজিদে যেতেন, তখন চরম শত্রুর মুখ দিয়েও উচ্চারিত হতো- ‘খোদার ফজিলত’ এদের ওপর বর্ষিত হচ্ছে।
তো এই পুত্রদের গর্ভধারিণীর চেহলাম উপলক্ষে এ বিশাল আড়ম্বর। একমাত্র বোন দেশে নেই। মৃত্যুসংবাদ পাবার পর থেকে ঘনঘন টেলিফোনে ফুঁপিয়ে উঠেছে সুদূর ডালাস শহর থেকে। একসময় বাড়িতে মেয়ে অস্পৃশ্য ছিল। সুদর্শন ভাইদের মতো সুদর্শনা না হলেও বাপের মুখের আদল, গড়ন আর মায়ের ফর্সা গাত্রবর্ণে মোটের ওপর দেখতে ভালো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই পাড়ার দরজির সঙ্গে প্রেম করে পালিয়েছে। বাড়ির কলঙ্ক ভেবে দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। লটারিতে ভাগ্য বদলে গেছে। মার্কিন দেশে ইমিগ্রেন্ট হয়ে যাবার সৌভাগ্যে সময়ের ক্ষোভ, অসন্তুষ্টি মিটে গেছে। যাবার আগে ভাই-ভাবি, মায়ের গলা ধরে কান্না শেষে পারিবারিক মিলন। বিদেশ, ডলার ইত্যাদি মোহনীয় শব্দের আভাসে দরজি যুবক জামাইর আপ্লুত আদর এবং সচরাচর যা হয়- সময়ে সব গন্ধ চাপা পড়ে যায়। দরজির পেশা রূপান্তরিত হয় ফ্যাশন ডিজাইনারে। আমেরিকা যাবার আগে পাসপোর্টে পেশা লেখা হলোÑ ডিজাইনার। এখন মেয়ে জামাই কাজ করে এক সুপার মার্কেটে।
বাবা বেঁচে থাকতেই বড় তিনছেলের সংসার ভিন্ন হয়েছে। সেজছেলেটি বরাবরই রগচটা, একগুঁয়ে, ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে বইগুলো নিজে সের দরে বিক্রি করে দিয়েছে এবং পরবর্তীসময়ে এক আশ্চর্য দক্ষতায় ছাত্র-রাজনীতিতে তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে। আশি এবং নব্বই দশকে দলবদলের রাজনীতিতে আসন তৈরি করে নিয়েছে। ফলে সরকারি ও বিরোধী উভয়দলের নেতৃস্থানীয় ভাইদের সঙ্গে তার সখ্যতা। পাড়ায় বন্ধুমহলে এবং পরিবারেও বিশেষ সম্ভ্রম পেয়ে থাকে। অবশ্য তাকে নিয়ে ভাইদের চেয়ে তাদের স্ত্রীদের মাঝে রয়েছে সূক্ষ্ম ঈর্ষাকাতরতা এবং একই সঙ্গে অহংকার। ক্ষমতা, আধিপত্য’র সঙ্গে বসবাসের অহংকার। বাড়ির ছোটছেলে যার বুদ্ধি খানিকটা স্থূল, আড়ালে ভাবিরা যাকে আবাল ডাকে- পড়ালেখায় এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। এসএসসি’তে পরপর তিনবার এবং এইচএসসি’তে দুইবার অকৃতকার্য হয়ে গ্রামের কলেজ থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। জগতের তাবৎ বিষয়ে আগ্রহী। সিনেমা, রাজনীতি, মহিলাদের শাড়ি-গহনা বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের প্রেম, জীবন-কাহিনী সন তারিখ মিলিয়ে মুখস্থ। মা-ভাইদের সাহায্যে বর্তমানে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে শেয়ারসহ মেজভাইয়ের সঙ্গে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা।
ফলে হাজিফা বেগমের মৃত্যু সে অর্থে সংসার, পরিবারকে বিশৃঙ্খল বা বেসামাল করতে পারে নি। ছেলে-বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে ভরা সংসার তিনি দেখে গেছেন। কিন্তু মানুষের আয়ুক্ষয়ের মতো সম্পর্কেরও ক্ষয় হয়। চিড় ধরে। পুত্রবধূদের মনের সুপ্ত ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরতা জাতীয় মারাত্মক ব্যাধিগুলো সহসাই প্রকট হয়ে ওঠে। স্ত্রীদের প্ররোচনায়, কলুষিত প্রবণতায় বাড়ির পরিবেশে প্রতিদ্বন্দ্বীর ছায়া ভাসতে থাকে। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেই মায়ের মৃত্যুদিনে তাঁদের পরস্পরের রক্তের সম্পর্কের অকৃত্রিম ইতিহাস কথা বলেছে। ভদ্রতা, শিষ্টতা, স্মৃতির চিত্রময়তায় নিজেদের হারানো বিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল। প্রত্যেক ভাইয়ের মনে তখন আত্মনিবেদন। আত্মসমর্পণের বিনয়ী ভাব। মাগরেব নামাযের পর মাকে কবরে নামানো হয়, আকাশে তখন প্রশ্রয় মেদুর মেঘ। গ্রামের বাড়ি ঘোড়াশাল থেকে ঢাকায় ফিরতি পথে প্রতিটি ছেলের ভাবনায়- শৈশব, কৈশোর, যৌবনের স্মৃতিরা ছুঁয়ে যায়। শরীর-মন জুড়ে গর্ভধারিণীর জন্য ব্যাকুলতা ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। কিন্তু ইন্তেকালের পরদিনই সকালে খবরের কাগজে হাফেজা বেগমের মৃত্যুর খবরটুকু দেখে ছেলে-বৌদের মাঝে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। স্বামীর ক্ষমতার প্রভাবে স্ত্রী কেয়া সবাইকে টেক্কা দিয়ে শাশুড়ির মৃত্যুসংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছে, নিপুণ কৌশলে, সবাইকে চমৎকৃত করতে। বাংলা, ইংরেজি প্রতিটি দৈনিকে মৃতার ছবিসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে জানাযা অনুষ্ঠিত হবার সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ প্রেস বিজ্ঞপ্তি। মায়ের মৃত্যুতে সম্পর্কের শিথিলতা যখন সম্মিলিত শোক, অনুভূতির গাঢ়তায় সিক্ত, তখন স্ত্রীদের চতুরতার গোপন সুড়ঙ্গ পথে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ে।
কাফনের কাপড়, গোরখোদকদের অর্থসংস্থান, গ্রামে তিনদিনের মিলাদ- সব ব্যবস্থা বড়ছেলে করেছে। তো মেজছেলে চল্লিশদিন ধরে মায়ের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দু’জন মৌলভীসহ তিনজন মাদ্রাসা ছাত্রকে নিয়োগ করলেন সকাল-সন্ধ্যা বাড়িতে কোরআন তেলওয়াতের জন্য। চতুর্থ ছেলের বউ রুবি পরপর দুই বৃহস্পতি-শুক্রবার শাশুড়ির কবর জেয়ারত করে গ্রামের বাড়ির আত্মীয়দের নিয়ে কাঙালিভোজসহ মসজিদে মিলাদ দিয়েছে।
প্রতিটি মানুষই কম-বেশি মহত্ত্ব-নিচতা, উদারতা-ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা-পরার্থপরতা নিয়ে জীবন কাটায়। কিন্তু ‘শিশির কণা’ বাড়ির বাসিন্দারা ব্যতিক্রম। সংসারের সমস্ত বৈষম্য, অনাচার ধারণ করে তারা মায়ের চেহলামকে কেন্দ্র করেও নীরব প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সেজ-ছেলে রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রায় নেতাগোছের ক্ষমতাধারী। সে কারণে চারদিনের মিলাদে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ বিরোধীদলেরও দু’চারজন এসেছেন। টেলিফোনে প্রতিমন্ত্রীর সেক্রেটারি জানিয়েছেন মন্ত্রী মহোদয় চেহলাম অনুষ্ঠানে আসছেন। শুনে অব্দি জা’দের মাঝে কয়েকবারই আলাপ হয়েছে। দুপুরে কী শাড়ি পরা হবে। এ তো কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান নয়, শোক আয়োজন। তা বলে যেনতেনভাবে থাকা যায় না। প্রতিমন্ত্রী জাতীয় পতাকা শোভিত গাড়িতে আসবেন, জোয়ার্দার বাড়ির গেটে গাড়ি ঢোকাবেন। বহুদিনের সঞ্চিত আশা পূরণ হতে যাচ্ছেÑ এই আনন্দে রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী স্বামী স্ত্রী কেয়াকে কথা দিয়েছেন- সব ভালোভাবে চুকে গেলে মালয়েশিয়া ঘুরে আসবেন সপরিবারে। আগে ভাবতেন নেপাল। কিন্তু ইংরেজিসাহিত্য পড়া স্ত্রীর সুবাদে জেনেছেন এখন মালয়েশিয়া ট্যুরই লেটেস্ট ফ্যাশন।
বাড়ির দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখেই মায়ের প্রমাণ সাইজের সাদা-কালো ছবি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। বড়বউ রীনার কল্যাণে। বড়ছেলের ঘরের দু-নাতনি যাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় সময়গুলো কেটেছে দাদিকে নিয়ে- তারা ছবিতে টাটকা চাঁপাফুলের মালা জড়িয়ে দিয়েছে। মেজছেলের ঘরের একমাত্র নাতি দাদির নির্বাক ছবির নিচে বিরতি দিয়ে আগরবাতি ধরিয়ে দিচ্ছে।
জোহরের নামাযের পর খাবার আয়োজন। দোতলার বসার ঘরে প্রতিমন্ত্রীর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে ঘরে চোখে পড়বে, এমন প্রশস্ত দেয়ালে কালো ফ্রেমে কাচে বাঁধানো হয়েছে মায়ের মৃত্যু সংবাদ। বাংলা-ইংরেজি ভাষায় মোট পাঁচটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি কেটে সাদা কাগজে পেস্ট করে লাগানো। তাতে প্রতিমন্ত্রীর শোক-বাণীও স্থান পেয়েছে। হাফিজা বেগমের সৌভাগ্য হলো না- তাঁকে ঘিরে ছেলে বউ, নাতি-নাতনিদের এমন উৎসাহী, বিপুল আয়োজন স্বচক্ষে দেখার। বেঁচে থাকতে জীবন কাটিয়েছেন ঠেলা-ধাক্কায়। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগী শাশুড়িকে নিয়ম করে ডাক্তার বা হাসপাতালে নিতে সময়ের অভাব ছিল সকলের। বড় বউ রীনা সমাজকল্যাণ দফতরে কাজ করেন। মেজবউ শায়লা স্কুলে পড়ায়, সেজ পুত্রবধূ কেয়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্মার্ট শিক্ষিকা, ছোট বধূ রুবির বান্ধবীর সঙ্গে বুটিকের ব্যবসা। তাই ব্যস্ততার চাপে বড়বউ ছোটকে, ছোট মেজকে ঠেলেছেন।
শেষপর্যন্ত তিনি হয়ে পড়েছিলেন ভাগের মাল। বড়বউ হবার সুবাদে রীনা দীর্ঘদিন শাশুড়ির দায়িত্ব পালনে বাধ্য ছিল। পরে অন্য বউদের আগমনে সে দায়িত্ব প্রতিটি বউয়ের পালনের প্রথাগত নিয়ম থাকলেও এ ব্যাপারে তাদের নিষ্ঠতার অভাব ছিল। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে একটি ব্লাউজের জন্য তিনি ছেলের বউদের বলেছিলেন। তিনজা’ মিলে নিজেদের শপিং শেষে জিনিসটি আনতে ভুলে গেছে। কিন্তু তুখোড় বধূরা শাশুড়িকে আশাহত করেন নি। নিজেদের জন্য কেনা একটি ব্লাউজ ধরিয়ে দিয়েছেন। একটু মোটা-ঘেঁষা মেজ জা শায়লার সাদা ব্লাউজটি। বলাই বাহুল্য মেদ-সর্বস্ব দেহে ঢুকাতে ব্যর্থ হয়েছেন শাশুড়ি। এবং কুশলী বধূরা সাইজের ভুল, বদলে আনতে হবে বলে উপস্থিত বুদ্ধিতে শাশুড়িকে সামলেছেন। কিন্তু বৃদ্ধা হাফেজা বেগম বউদের এই মেকি প্রলাপ বা মানসিকতাটুকু শেষ বয়সে ধরতে পারতেন না।
আসলে সংসার, লোভ, কাম, প্রতিপত্তি পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে, মায়ের প্রতি কর্তব্যবোধ ক্রমশ তাঁদের শোণিতে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে বৃদ্ধা মা অকস্মাৎই পরকালের সিঁড়িতে পা রাখলেন। নইলে বাহাত্তর বছর বয়স এমন কী? রোগ ছিল, কিন্তু তিনি অথর্ব ছিলেন না। একাই গোসল, বাথরুম সারতেন। কেবল রাতে তার শোবার ঘরে একজন কাজের মহিলা মেঝেতে ঘুমাত। ছোটছেলে অবিবাহিত। মায়ের পাশের ঘরেই থাকে। বিয়ের ব্যাপারে মায়ের উৎকণ্ঠা, ভাবিদের তাড়ায় মেয়ে দেখা হয়েছে বহুবার। কিন্তু হিন্দিছবির পরমভক্ত তেত্রিশ বছর বয়সী যুবকের কোনো মেয়েকেই মনে ধরে না। এমনকি তার কোনো প্রণয়ঘটিত ব্যাপারও ঘটে নি। কেবল সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অব্দি গাদা গাদা হিন্দি ছবি দেখা হলো তার বিনোদন এবং প্রার্থনাও। নায়ক-নায়িকার প্রেম-বিরহ-মিলনের দৃশ্য সে বেহুঁশ হয়ে দেখে এবং একধরনের আত্মরতি লাভ করে বলে ভাবিরা দেবরকে ঠাট্টা করে, মজা পায়।
মায়ের মৃত্যুর পর স্মৃতি, দুঃখ, শোকে মাখামাখির সময়। অথচ মৃত্যুর সপ্তাহের মাথায় লুপ্ত হয়েছে আদর্শ- তার মৃত্যুর সমান্তরালে পরিবারের ছেলে-বউদের মানবিক সম্পর্কের মৃত্যুর পর্বটিও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। পুত্রদের সংযমের সীমাবদ্ধতা সংকুচিত হয়েছে; ভোগের চিন্তায় মগ্ন। নৈতিকতাকে পরিপূর্ণ হৃদয়ে ধারণ করার আগে, গভীরভাবে আত্মস্থ করার পূর্বেই তাদের বিচ্যুতি ঘটেছে। ফলে শোকের বাড়িতে অজান্তেই ছোট-খাটো অশ্লীল বিপর্যয় ঘটে গেছে।
মা যাবার চারদিন পর ছোটছেলে টিভিতে হিন্দি প্রেমের ছবি দেখেছে। বদ্ধ ঘরে বসে পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি ও মানসিক চাপ ঘুচাতে উঠতিনেতা ছেলেটি শোবার ঘরে বসে হুইস্কি ঢেলেছে। ক’দিন থেকেই চতুর্থ ছেলের মাথায় আসা চিন্তাটা বড় ভাইকে বলেছে। পাঁচতলা বাড়ির প্রতিতলা নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করা। বোন যেহেতু বিদেশে। কাজেই তার দেশে স্থায়ী বসবাসের সম্ভাবনা কম। তাহলেও তাকে যেন ঠকানো না হয় সেই সম্পর্কে বুদ্ধি বাতলেছে বড় ভাবি। শাশুড়ির নামকোয়াস্তে যেটুকু গয়না আছে তা ননদকে দিয়ে দেয়া। এ সমস্ত আলোচনার ফাঁকেই চার বউ মিলে চেহলামের দুপুরে শাড়ি পরার বিষয়টিও ভেবে রেখেছে। বড়’জা শাশুড়ির দেয়া হালকা আকাশি সিল্ক, মেজ’জা পেঁয়াজ রঙের টাঙ্গাইল, ছোট’জা পরবে সাদার উপর সাদা সুতোর কাজ করা শাড়ি। সেজ’জা নিজেকে সাধারণের মাঝে অসাধারণ করে তুলতে ধূসর বর্ণের নীল পাড় ঢাকাই পরবেন এবং মনে মনে স্থির করেছেন গলায় শুধু তাহিতির কালো মুক্তোর লকেটটি ঝুলাবেন।
গতরাতে ননদ টেলিফোন করে মায়ের চেহলাম অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে। একমাত্র কন্যা মাকে স্মরণ করে মৃত্যুর একমাস পরও অঝোরে কেঁদেছে। কাজে ছুটি পাবে না বলে দেশে আসা সম্ভব নয়। তবে মায়ের আত্মার শান্তি কামনায় দীন-দুঃখীদের দান খয়রাতের জন্য পাঁচশ’ ডলার পাঠাচ্ছে। সে শুনে মাথামোটা ছোটছেলে ঘোষণা দিয়েছে, চেহলামের সকালেই সে দশ হাজার টাকার মিষ্টি কিনে কবরস্থান, এতিমখানায় বিতরণ করবে।
এভাবেই গর্ভধারিণীর মৃত্যুকে ঘিরে পুত্রদের বিষণ্ণতা আর শোকের ক্ষতগুলো ক্রমে পরিণত হয় বিষাক্ত কীটে। মায়ের শূন্যতার মাঝে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো তাদের আত্মায় ভর করে আঁধার।
চেহলামের সকালে রোদের পায়ে পায়ে বেলা বেড়েছে। ছেলে-বউদের মুখের মিহিন সুষমায় মূর্ত হয়েছে এজিদের বিষাদ। মনে হবে এরা সর্বরিক্ত হয়ে মানবিকতার সীমান্ত দিয়ে হেঁটে চলছে।
বর্ষ ৮ সংখ্যা ২০, ঈদসংখ্যা ২০০৩
Leave a Reply
Your identity will not be published.