মরণোত্তম। সাদাত হোসাইন

মরণোত্তম। সাদাত হোসাইন

ভূমিকা:
‘মরণোত্তম’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম ‘অন্যদিন ঈদসংখ্যায়’। লিখতে গিয়ে মনে হয়েছিল এই উপন্যাসের গল্প কি এক অন্ধকার সময়ের গলিপথ? নাকি এক রুদ্ধ সময়ের প্রতিবিম্ব?
তবে আমার বিশ্বাস, সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের গল্পেও আলোর আভাস থাকে। স্বপ্ন থাকে। কিন্তু এই সময়ের গল্পে সেই আলোর আভাস কই? নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে। আর আছে বলেই এই প্রগাঢ় অন্ধকারেও জ্বলে উঠতে পারে এক চিলতে আলো। সেই আলো ঝলসে দিতে পারে অন্ধকার সয়ে যাওয়া আমাদের অজস্র চোখ। পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারে আমাদের পুরু করে পরা টিনের চশমা। সময়ের গল্প একরৈখিক নয়, বহুরৈখিক। তাহলে সময়ের কোন রেখার গল্প ‘মরণোত্তম’? কখনো মনে হয়েছে ‘মরণোত্তম’ প্রচণ্ড প্রতিবাদের গল্প, আবার কখনো মনে হয়েছে প্রবল হতাশার গল্প।
‘মরণোত্তম’ আসলে কী?
‘মরণোত্তম’ আসলে প্রচণ্ড এক চপেটাঘাত। ঠুলি পরে থাকা অসংখ্য অন্ধ চোখে আঙুল পুরে দেওয়া। একইসঙ্গে হয়তো প্রবল আশা কিংবা হতাশার গল্পও ‘মরণোত্তম’। কিন্তু সেই গল্প মৃত্যুঞ্জয়ী এক মানুষেরও, জীবনজয়ী এক প্রতিবাদেরও। কে জানে, সেই প্রতিবাদের গল্প আমাদের বুকের ভেতরটা ওলট-পালট করে দেয় কি না! নাড়িয়ে দেয় কি না আমাদের বোধ ও বিশ্বাস!

 

সাদাত হোসাইন
শ্যামলী

সেই সে মিছিলে, তুমিও কি ছিলে, নাকি ছিল শুধু একা কেউ?
জেনে রেখো আজ, একা এ আওয়াজ, হবে শত সহস্র ঢেউ।
—সাদাত হোসাইন।


আজিজ মাস্টার ঢাকায় যাচ্ছেন। তিনি দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যের কথা কেউ জানে না। দীর্ঘ বাস যাত্রায় তার খানিক ঝিমুনির মতো এসেছে। ঝিমুনিতে তিনি একটা স্বপ্নও দেখে ফেলেছেন। স্বপ্নে তার মৃত বাবা দবির খাঁ তাকে বলছেন, ‘তুই ঢাকায় যাচ্ছিস কেন?’
‘স্কুল বাঁচাতে।’
‘স্কুলের কি পরাণ আছে নি যে মরণ-বাঁচন থাকবো?’
‘জি আব্বা আছে।’
‘ঢাকায় গেলে স্কুল বাঁচবে?’
‘চেষ্টা করতে দোষ কী!’
‘চেষ্টা করতে দোষ নাই। কিন্তু অযথা চেষ্টায় সময় নষ্ট।’
‘কোনো চেষ্টাই অযথা না আব্বা।’
‘অবশ্যই অযথা। এই যে বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিস, এখন এই বাস যদি রাস্তার মাঝখানে বন্ধ হয়ে যায়। আর তুই একা যদি সেই বাস ঠেলে ঠেলে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা করিস, তাহলে সেই চেষ্টা অযথা হবে না?’

আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। স্বপ্নে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের মাঠে। টাকা পয়সার অভাবে স্কুল প্রায় বন্ধ হতে চললেও মাঠ ভর্তি ছেলেপুলে। আজিজ মাস্টার তাদের ফুটবল কিনে দিয়েছেন। বিকেল হতেই তারা ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে। এই দৃশ্য দেখতেও আজিজ মাস্টারের ভালো লাগে। স্কুলের বেড়া কোনোরকমে টিকে থাকলেও মাথার উপরের টিনের চালগুলো এখানে ওখানে ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই ঝরঝর করে পানি পড়ে। ‘দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুল’ লেখা সাইনবোর্ডখানার রঙও এখানে সেখানে উঠে গেছে। দবির খাঁ হয়ে গেছে ‘দাবর খা’। এই এলাকায় দাবর শব্দের অর্থ ধাওয়া। ফলে আঞ্চলিকভাবে স্কুলের নাম হয়ে গেছে এখন ‘ধাওয়া খা’। এই নিয়ে আড়ালে আবডালে লোকজন হাসাহাসি করে। আজিজ মাস্টার বুঝেও না বোঝার ভান করেন। তিনি চাইলেই নতুন ঝা-চকচকে একখানা সাইনবোর্ড লাগাতে পারেন। কিন্তু যেই স্কুলে ক্লাস হয়না, শিক্ষক-শিক্ষার্থী আসে না, টাকার অভাবে স্কুলের টিনের চাল বেয়ে জল ঝরে, সেই স্কুলে চকচকে সাইনবোর্ড মানায় না। তিনি সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমি শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই আব্বা।’  
দবির খাঁ বললেন, ‘সব চেষ্টাই চেষ্টা না। কিছু কিছু চেষ্টা আছে, যেগুলো অযথা সময় নষ্ট। শ্রম আর মেধার অপচয়। বন্ধ বাসের মতো তোর ওই স্কুলও বন্ধ। স্কুলের ইঞ্জিন নষ্ট। তুই একা একা চেষ্টা করছিস সেই বাস কাঁধে ঠেলে চালাতে। কিন্তু এই কাজ একা সম্ভব না। এর আগেওতো কতবার স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়েছিস। কত নেতা ফেতা ধরেছিস। কাজ হয়েছে? হয়নি। বরং মাঝখান থেকে ঢাকায় যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া বাবদ পকেটের টাকা খরচ হয়েছে। হয় নি?’
‘জি হয়েছে।’
‘তাহলে?’
‘এবার কাজ হবে।’
‘কীভাবে হবে?’
‘এবার স্কুল এমপিওভুক্তির দাবিতে আমি অনশন করবো। আমরণ অনশন। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ সাড়াশব্দ না করবে, দাবি মেনে না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অনশন ভাঙবো না।’
‘যদি তোর অনশন ভাঙাতে কেউ না আসে? তখন কী করবি?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।
দবির খাঁ বললেন, ‘তাহলে কি তখন সত্যি সত্যিই অনশন করে না খেয়ে মারা যাবি?’
‘মারা যাবো কেন? কেউ না কেউ আসবেই। একজন বৃদ্ধ মানুষ, পেশায় স্কুল শিক্ষক, তিনি ঘোষণা দিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে প্রকাশ্যে মারা যাবেন, আর এই নিয়ে কেউ কিছু বলবে না? এমন হবে? কখনোই হবে না। কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে। দেখবেন এই নিয়ে চারদিকে একটা হইচই পড়ে যাবে। পেপার পত্রিকায় খবর ছাপা হবে। টেলিভিশন সাংবাদিকরা চলে যাবে। আর আপনিতো জানেন না, আজকাল ফেসবুক নামে মারাত্মক এক জিনিস এসেছে। আলাদিনের দৈত্যের মতো তার ব্যাপার-স্যাপার। তার পক্ষে সবই সম্ভব। এই খবর যদি একবার ফেসবুকে ছড়াই যায়, দেখবেন চারদিকে মানুষের ভেতর একটা হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার ঘটে যাবে।
‘এইটা কী গ্রামগঞ্জের যাত্রাপালার মতো কোনো ঘটনা নাকি?’
‘যাত্রাপালা হবে কেন আব্বা?’
‘না, আমাদের সময় গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা হইতো। রহিম-রূপবান, গহর বাদশা-বানেছা পরী, সোহরাব-রুস্তম—এইসব। তখন দেখতাম চারিদিকে রিকশা ভ্যানে করে মাইকিং করতো, হই হই কাণ্ড, রই রই ব্যাপার। তোর কথা শুনেওতো সেই অবস্থা মনে হয়। যেন যাত্রাপালার স্ক্রিপ্ট রিহার্সেল করে নিয়া যাচ্ছিস। যাওয়া মাত্র হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার ঘটে যাবে।’
‘আপনারতো কখনোই আমার উপর কোনো ভরসা ছিল না। সব সময় ভাবেন আমার বুদ্ধি কম। আমি একরোখা, জেদি। কিন্তু এইবার দেইখেন আব্বা।’
দবির খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন, ‘কী জানি! আচ্ছা, একটা সত্যি কথা বলতো?’
‘কী কথা?’
‘তুই কি শুধু স্কুলের দাবি নিয়েই যাচ্ছিস? নাকি ভিতরে ভিতরে তোর অন্য কোনো মতলবও আছে?’
‘অন্য কী মতলব?’
দবির খাঁ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোরেতো আমি চিনি। আর চিনি বলেই এতো দুশ্চিন্তা। একবার কোনো কিছু মাথায় ঢুকলেতো আর সেই জিনিস তোর মাথা থেকে বের হবে না! কাজের হোক আর অকাজের হোক, সেটার পেছন তুই ছাড়বি না।’
আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। দবির খাঁ-ই আবার বললেন, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়?’
‘কী কাজ?’
‘তুই নুরুল মোল্লার নামে স্কুলটা দিয়ে দে।’
‘নুরুল মোল্লার নামে!’ আজিজ মাস্টার যারপরনাই বিরক্ত হলেন। কিন্তু বাবার সামনে তা পুরোপুরি প্রকাশ করলেন না।
দবির খাঁ বললেন, ‘হ্যাঁ, নুরুল মোল্লার নামে। তুই বুদ্ধিমান মানুষ হলে এতোদিন তাই করতি।’
এবার বিরক্ত হলেন আজিজ মাস্টার। তিনি খানিকটা বিরক্তিমাখা গলাতেই বললেন, ‘আমি যে বোকা, এইটাতো নতুন কথা না আব্বা। সেই এতটুকুন বয়স থেকেই আপনি আমাকে এই কথা বলে আসছেন। নতুন করে আর বলার কী হলো!’
‘সত্য কথা বেশি বেশি বলতে হয়। মিথ্যা কথা বলতে হয় কম। শোন গাধা, নুরুল মোল্লা এলাকার চেয়ারম্যান। স্কুলের সভাপতিও সে। সামনে এমপি ইলেকশনেও দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তখন কী করবি?’
‘কী করবো?’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন আজিজ মাস্টার।
‘সে এমপি হয়ে গেলে তখন কিন্তু বিপদ আরো বাড়বে। তখন ইহজনমে আর তোর স্কুল এমপিওভুক্ত করতে পারবি না। তারচেয়ে এক কাজ কর, গোয়ার্তুমি ছেড়ে ভালোয় ভালোয় তার নামে স্কুলটা দিয়ে দে। দেখবি তার নামে স্কুলের নাম হলেই স্কুল এমপিওভুক্ত করার জন্য সে উঠে পড়ে লাগবে!’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘এতোদিন এতো কষ্ট করার পর, তার সাথে এতো যুদ্ধ করার পর এখন তার ইচ্ছাই মেনে নিবো?’
‘গাধা না হলে আরো আগেই মেনে নিতি। জলে নেমে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করে কখনো কাউকে জিততে দেখেছিস?’

দবির খাঁর কথা সত্য। এই কথা দবির খাঁ যেমন জানেন, তেমনি আজিজ মাস্টারও জানেন। কিন্তু বিষয়টা তার মেনে নিতে ইচ্ছে করে না। এই স্কুলের জন্য তারা বাপ-ছেলে কী করেন নি! সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি। তারপরও নিজেদের এতোদিনকার সব স্বপ্ন, শ্রম, সামর্থ্য নিঙড়ে দেয়ার পর এখন এখানে এসে এভাবে হার মানতে ইচ্ছে হয় না। আজিজ মাস্টার বাবাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই তিনি দেখলেন মাঠ থেকে জোরালো শটে ফুটবলটা সরাসরি তার কপাল লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। তিনি শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেছিলেন সরে আসতে। কিন্তু পারলেন না। বলটা তার কপালে আঘাত করলো। প্রবল ঝাঁকিতে আজিজ মাস্টারের ঘুম ভেঙে গেলো। বিকট শব্দে বাসের ব্রেক কষেছে ড্রাইভার। আজিজ মাস্টারের মাথা ঠুঁকে গেছে সামনের সিটের সাথে। পেছন থেকে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে গাল বকলো কাঁচা ঘুম ভাঙা যাত্রীরা।

আজিজ মাস্টার অবশ্য কিছু বললেন না। তিনি চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। তার কোলে একখানা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর ভাঁজ করা একখানা ব্যানার। সেই ব্যানারে কী লেখা আছে কে জানে! তিনি তা কাউকেই দেখান নি।

আজিজ মাস্টার বসে আছেন প্রেস ক্লাবের বাইরে। মূল গেট থেকে খানিক দূরে প্রেস ক্লাবের দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাতে মাদুর বিছিয়ে বসেছেন তিনি। তার আশেপাশে কিছু লোক জড় হয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, এরা বড়সড় কোনো মজা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। আজিজ মাস্টার অবশ্য বুঝছেন না, এখানে মজা পাওয়ার মতো কি আছে! বিষয়টি এমন না যে তিনি এখানে কোনো হাস্য রসাত্মক কর্মকাণ্ড করছেন। স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানদের মতো রাস্তার পাশে কোনো ম্যাজিকও দেখাচ্ছেন না। এমনকি ক্যানভাসারদের মতো আদি রসাত্মক কথাবার্তা বলে কোনো গোপন রোগের ঔষুধও বিক্রি করছেন না। তিনি অনশন করছেন। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে একখানা ছোট ব্ল্যাকবোর্ড। ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা ‘ঐতিহ্যবাহী দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের এমপিওভুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন। অনশনে- প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান।’

এখানে হাসি তামাশার মতো কোনো ব্যাপার নেই। একজন স্কুল শিক্ষক তার স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবিতে আমরণ অনশন করছেন, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে! কিন্তু জড় হওয়া লোকজনের ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো সার্কাস দেখতে এসেছে। সার্কাসে দারুণ মজার মজার ঘটনা ঘটছে। আরো মজার ঘটনা ঘটনার অপেক্ষায় তারা অর্ধ বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। আজিজ মাস্টার অবশ্য কোনো কথা বললেন না। তিনি তার পিঠের নিচের ব্যাগখানা খানিক উপরে তুলে দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন। তার মাথা ঠেকে আছে পেছনের ব্ল্যাকবোর্ডে। এই ব্ল্যাকবোর্ড তিনি তার স্কুলঘর থেকে বাসের লকারে করে বয়ে এনেছেন।

ভিড় থেকে খানিক দূরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে চশমা। মাথায় লম্বা চুল। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। সে অন্যান্যদের মতো উশখুশ করছে না বা ভিড়ের মধ্যেও ঢুকছে না। খানিকটা দূরে একা দাঁড়িয়ে আছে। এতো এতো মানুষের ভিড়েও ছেলেটা আলাদা করেই দৃষ্টি কাড়লো আজিজ মাস্টারের। বার কয়েক চোখাচোখিও হলো। যতবারই চোখাচোখি হয়েছে, ছেলেটা বিব্রত ভঙ্গিতে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঢাকা শহরে উটকো লোকজনের অভাব নেই। বিষয়টা আজিজ মাস্টার জানেন। আর জানেন বলেই ছেলেটার এমন তীক্ষ্ণ ও গোপন চোখে তাকিয়ে থাকার বিষয়টা তাকে একধরনের অস্বস্তি দিচ্ছে। আড়াল থেকে নজর রাখাদের সব সময়ই গোপন উদ্দেশ্য থাকে। সরাসরিদের থাকে না। ছেলেটা ওভাবে আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে না থেকে অন্যদের মতো তার সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি চিন্তিত হতেন না। কিন্তু এখন চিন্তিত লাগছে।

ছেলেটা অবশ্য আর বেশিক্ষণ আড়ালে থাকলো না। হঠাৎ কী মনে করে সে সোজা আজিজ মাস্টারের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আজিজ মাস্টার এবার খানিক অবাকই হলেন। ছেলেটা ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বললো, ‘স্যার কি একাই এসেছেন? নাকি সাথে কেউ আছে?’

আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছেন না, এর প্রশ্নের উত্তরে তার কিছু বলা উচিত কী না! তিনি কিছুটা ভয়ও পাচ্ছেন, আবার আগ্রহও জাগছে। আগ্রহ জাগার কারণ ঢাকায় তিনি এসেছেন একা। এখানে তার চেনা পরিচিত কেউ নেই। জানাশোনা কেউ নেই। শহরের হাবভাব বোঝে এমন একজন কেউ সাথে থাকলে খুব ভালো হতো। সমস্যা হচ্ছে, শহর ভর্তি চোর বাটপার। এরমধ্যে তিনি কাকে বিশ্বাস করবেন আর কাকে করবেন না। এই সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি ছেলেটার প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত রইলেন।
ছেলেটা অবশ্য নাছোড়বান্দা। সে বললো, ‘আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন স্যার?’
আজিজ মাস্টার মিনমিন করে বললেন, ‘ভয় পাবো কেন? আপনি কি চোর না ডাকাত? আর চোর ডাকাত হলেও লাভ নেই। আমার কাছে মূল্যবান কিছু নেই।’
ছেলেটা হাসলো, ‘আমি চোরও না, ডাকাতও না। মানুষও মোটামুটি ভালো। তবে একটু পাগলা কিসিমের। তাতে অবশ্য আপনার অসুবিধা হবে না। আপনার পাশে একটু বসি স্যার?’

আজিজ মাস্টার এবারও জবাব দিলেন না। তবে ছেলেটা যে তার জবাবের অপেক্ষা করলো তাও না। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আজিজ মাস্টারের পাশে বসে পড়লো। তারপর আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালো। আজিজ মাস্টার যুগপৎ অবাক এবং আশাহত হলেন। মনে মনে ছেলেটাকে তিনি ভালো ভাবতে চাইছিলেন। ভাবতে চাইছিলেন, ছেলেটা তাকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করবে। কিন্তু তার মতো একজন বয়োঃবৃদ্ধ স্কুল শিক্ষকের সামনে এই বয়সের একটা ছেলে এভাবে সিগারেট ধরাবে এটি তিনি আশা করেন নি। ছেলেটি অবশ্য আজিজ মাস্টারকে আরো অবাক করে দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। তারপর বললো ‘চলবে নাকি স্যার?’
আজিজ মাস্টার হতভম্ব গলায় বললেন, ‘কী!’

ছেলেটা একইরকম হাসি হাসি মুখে বললো, ‘না মানে স্যার এই মুহূর্তে এর চাইতে ভালো ব্রান্ড খাওয়ার পয়সা নাই। যখন পয়সা থাকে তখন ভালো জিনিসই খাই। এই ধরেন বেনসন অ্যান্ড হেজেস, মার্লবোরো। আর যখন পয়সা থাকেনা তখন বিড়িও খাই।’

আজিজ মাস্টার রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। রাগে তার শরীর কাঁপছে। এই বয়সী একটা ছেলে তার সামনে বসে সিগারেট খাচ্ছে, মুখ ভর্তি করে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ছে। আবার এমন আজেবাজে ধরনের কথা বলছে। বিষয়টা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলেটা আজিজ মাস্টারের অবস্থা দেখে বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো, ‘এই ব্র্যান্ড তেমন দামি না হলেও সিগারেটটা খেয়ে কিন্তু খুব মজা স্যার। টেস্ট করে দেখতে পারেন।’

আজিজ মাস্টার কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। প্রচণ্ড রাগে তার শরীর কাঁপছে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে সেই রাগ তিনি প্রকাশ করতে পারছেন না। ফলে তা প্রচণ্ড হতাশায় পরিণত হচ্ছে। অবদমিত প্রবল রাগ থেকে তৈরি এই হতাশাটা ভয়ঙ্কর।

ছেলেটা গলগল করে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো, ‘অনশন কী একাই করতেছেন?’
আজিজ মাস্টার এবারও কথা বললেন না। তবে সে আজিজ মাস্টারের কথা বলার অপেক্ষায়ও থাকলো না। নিজে নিজেই আবার বললো, ‘অনশন করলে সাথে লোকজন থাকতে হয়। একা একা অনশন হয় না।’
আজিজ মাস্টার এবার ক্ষীপ্ত গলায় বললেন, ‘কে আপনি? আপনার পরিচয় কী?’

ছেলেটা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একইরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো, ‘অনশন করতে হলে টিভি ক্যামেরা, পেপার পত্রিকার সাথে ভালো যোগাযোগ আছে, এমন লোকজন লাগে। আছে আপনার এমন লোকজন?’
আজিজ মাস্টার কিছু বলবেন না বলবেন না করেও শেষ অবধি সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘না।’
ছেলেটা খে খে করে হাসলো। যেন এর চেয়ে হাস্যকর কথা আর সে শোনেনি। হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফুটপাতে ছুঁড়ে দিতে দিতে সে বললো, ‘তাহলেতো হবে না স্যার।’

আজিজ মাস্টার কথা না বললেও চোখ তুলে তাকালেন। ছেলেটা বললো, ‘ওইরকম কিছু লোকজন থাকলে তারা খবর দিয়ে সাংবাদিক-টাংবাদিক নিয়ে আসবে। সাংবাদিক ছাড়া এইসব অনশন টনশন করে কোনো লাভ নাই। আপনিই বলেন, সাংবাদিকরা যদি কোনো খবর না করে, তাহলে সেই অনশনের কথা কেউ কোনোদিন জানবে?’
ছেলেটার সাথে কোনোভাবেই কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না আজিজ মাস্টারের। কিন্তু তারপরও তিনি যেন কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘না, জানবেনা।’
ছেলেটা আবারও হাসলো, ‘হে হে হে। এইতো লাইনে আসছেন। এখন তাহলে কী করতে হবে?’
‘কী করতে হবে?’ আজিজ মাস্টার অসহায় ভঙ্গিতে প্রশ্নের ছলে দ্বিরুক্তি করলেন।
‘সাংবাদিকদের খবর দিতে হবে। চা-বিস্কুট খাওয়াতে হবে। যাওয়ার সময় হাতের ফাঁকে সামান্য টাকা পয়সাও গুঁজে দিতে হবে। এইটারে আবার ঘুষ ভাইবেন না স্যার। এইটা হলো তাদের আসা যাওয়ার খরচ। ভাড়া বা নিজেদের গাড়ির তেলের খরচ। নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে তারা আপনার সংবাদ কভার করতে কেন আসবে বলেন? সব কিছুরইতো একটা সিস্টেম আছে, আছে না?’

আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। বিশাল রেইন্ট্রি গাছের ফাঁক দিয়ে শরতের পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশে চক্রাকারে চিল উড়ছে। ঢাকা শহরে এই সময়ে এভাবে চিল উড়তে দেখবেন, তিনি ভাবেন নি।
ছেলেটা খানিক কাছে এসে বললো, ‘শোনেন স্যার, এসব না হলে কিন্তু এই অনশন টনশন করে কোনো লাভ নাই।’
আজিজ মাস্টার ছেলেটার দিকে তাকালেন না। তবে আড়চোখে তিনি তার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছেন। ছেলেটার কথাবার্তা শুনে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত যে এই ছেলে ধান্ধাবাজ টাইপের কেউ। এসব হাবিজাবি বলে সে তার কাছ থেকে টাকা মেরে দেয়ার ধান্ধা করছে। কিন্তু আজিজ মাস্টার এসব বোঝেন। তাকে বোকা বানানো এতো সহজ না।
ছেলেটা বললো, ‘আর যদি এই পরিকল্পনা নিয়ে এসে থাকেন যে স্রেফ লোক দেখানোর জন্য অনশনের অভিনয় করছেন। তাহলেও কিন্তু লোকজন লাগবে। কারণ আপনিতো আর না মরা পর্যন্ত অনশন করবেন না। করবেন? করবেন না। তাহলে? তাহলে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে, আপনারে বুঝিয়ে সুঝিয়ে, জোর জবরদস্তি করেওতো আপনার অনশন ভাঙানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাইনা?’

আজিজ মাস্টার এবারও জবাব দিলেন না। তিনি চুপচাপ ছেলেটার কথা বোঝার চেষ্টা করছেন। ছেলেটা বললো, ‘যেহেতু আপনি মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত অনশন করবেন না। মানে আমরণ অনশন করবেন না, সেহেতুও আপনার কিন্তু কিছু লোক লাগবে। বিশেষ করে নিজের কাছের আপনা লোকজনই লাগবে।’
আজিজ মাস্টার এবার সরাসরি ছেলেটার চোখে তাকালেন। ছেলেটা মৃদু হেসে চোখ টিপে বললো, ‘এরা জোর করে আপনার অনশন ভাঙানোর অভিনয় করবে। এই ধরেন আপনি একদম অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। তখন আপনার জন্য হাসপাতাল থেকে ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য লোক লাগবে। মিছেমিছি স্যালাইন লাগানোর জন্য লোক লাগবে। তারপর শেষ মুহূর্তে এসে জোর জবরদস্তি করে জুস-টুস খাইয়ে তারা আপনার অনশন ভাঙ্গাবে। বুঝলেন?’
আজিজ মাস্টার তাকিয়েই আছেন। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, ছেলেটাকে এখন তার ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। তিনি কৌতূহলী ভঙ্গিতে তাকালেন। ছেলেটা বললো, ‘আর যদি সত্যি সত্যিই আমরণ অনশন করে থাকেন, মানে দাবি-দাওয়া আদায় না হওয়া পর্যন্ত সত্যি সত্যিই অনশন করতে চান। তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যি না খেয়ে মরতে হবে।’
‘কেন?’ আজিজ মাস্টার এবার আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না। ‘একটা মানুষ দাবি আদায় না হলে না খেয়ে অনশন করে মারা যাবে? তবুও কেউ তার কাছে আসবেনা? তার দাবি দাওয়া শুনতে চাইবে না?’ ছেলেটা আরো একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, ‘নাহ।’
‘কেনো?’
‘কারণ এইসব অনশন টনশনে কারো কিছু যায় আসে না।’
‘যায় আসেনা কেনো?’
‘কারণ এই দেশে মানুষ বেশি। হা হা হা। ছোটবেলায় রচনা পড়েন নাই? পপ্যুলেশন প্রবলেম ইন বাংলাদেশ? বাংলাদেশ ইজ আ ওভার পপ্যুলেটেড কান্ট্রি...।’
‘ইজ অ্যান। ওভারের আগে অ্যান হবে। অ্যান ওভার পপ্যুলেটেড কান্ট্রি।’ আজিজ মাস্টার গম্ভীর মুখে বললেন।
ছেলেটা হাসলো, ‘জি স্যার, জি স্যার। এইসব আর্টিকেল ফার্টিকেল ছোটবেলায় পড়েছি। তবে ভুল বললেও ঘটনা কিন্তু সত্য। এটা কিন্তু স্যার বুঝতে হবে। না বুঝলে বিপদ।’

আজিজ মাস্টার এই পরিস্থিতিতে ছেলেটার এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা, প্রগলভতায় বিরক্ত। খানিকটা বিভ্রান্তও বটে। তবে তিনি সেটা প্রকাশ করলেন না। দ্বিধামিশ্রিত চোখে তাকিয়েই রইলেন। ছেলেটা বললো, ‘শোনেন স্যার, এই দেশে মন্ত্রী মিনিস্টার বা তাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ মরলে সেইটা একটা ঘটনা। কিন্তু আপনার আমার মতো আমজনতা রোজ কয়েক শ মরলেও তাতে কারো কিছু যায় আসে না। প্রতিদিন সারা দেশে রোড একসিডেন্টে কত মানুষ মারা যায়, সেই হিসাব করছেন কোনোদিন?’
আজিজ মাস্টার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়লেন। ছেলেটা বললো, ‘বুঝলেনতো? এই যে রোজ কত কত মানুষ রোড একসিডেন্টে মারা যায়, আপনি তার খবরও জানেন না। আপনার তাতে কিছু যায় আসে না। তাহলে আপনি মরলে কার কী যাবে আসবে? আপনি কোন হরিদাশ পাল যে আপনি মরলে লোকজন হই হই করে ছুটে আসবে? আলাপ আলোচনা করবে। বলেন?’
ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি খুব একটা সুবিধার না। একটা প্রচ্ছন্ন বেয়াদবির ব্যাপার আছে। তবে তার কথাগুলো কিন্তু মিথ্যে না। আজিজ মাস্টার তার প্রশ্নের জবাব না দিলেও মনে মনে বিষয়টা ভেবে দেখতে লাগলেন। আগে কখনো এভাবে ভাবেন নি তিনি।। ছেলেটা বললো, ‘এই দেশে রোজ কত শত মানুষ মরে, তাতে কার কী যায় আসে? শোনেন যেই দেশে যেটার অভাব নেই, সেই দেশে সেটার গুরুত্বও নাই। এই দেশে সব জিনিসেরই অভাব। শুধু একটা জিনিসেরই অভাব নাই। সেইটা হলো মানুষ। যেহেতু মানুষের অভাব নাই, সেহেতু মানুষের দামও নাই, কোনো গুরুত্বও নাই। বুঝলেন? হিসেব পরিষ্কার?’

আজিজ মাস্টার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার কাছে এখন ছেলেটাকে খুবই কৌতূহলোদ্দীপক মনে হচ্ছে। ছেলেটা বললো, ‘কি, আছে এই দেশে মানুষের অভাব? এইখানে আপনার অনশন ভাঙাতে কেউই আসবে না। আপনি মরলে কারো কিছু আসে যায় না। রাস্তার মানুষও না। এমনকি আপনি রাস্তার পাশে মরে পড়ে থাকলেও দুয়েকদিন লোকে ভাববে ফুটপাতে ছিন্নমূল কোনো মানুষ ঘুমাচ্ছে। কারণ, এই দেশে হাজার হাজার মানুষ আছে, তারা ছিন্নমূল, গৃহহীন। এরা রাস্তায়, ফুটপাতে, ট্রেন স্টেশনে ঘুমায়। তারা ভাববে আপনিও তাদের একজন। তবে হ্যাঁ, পচে গন্ধ ছড়ালে অবশ্য ভিন্ন কথা। তখন লোকজন একটু হই চই করবে। তার মানে বুঝলেন তো?’
‘কী?’
‘আপনাকে শুধু মরলেই হবে না। লোকজনের নজরে পড়তে হলে পচে গন্ধও ছড়াতে হবে। হা হা হা।’
ছেলেটা হাসছে। আজিজ মাস্টার কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা হাসি থামিয়ে বললো, ‘অযথা আপনাকে নিয়ে কেউই ঝামেলায় জড়াতে চাইবে না। লোকজন ভাববে এখানে এসে আবার কী না কী ঝামেলায় পড়বে। দরকার কী? এমনকি এই যে এখন যারা আপনার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, এরাও না। বরং ধরেন আপনার গায়ে যদি আগুন টাগুন লাগিয়ে মারা যেতে পারেন, তখন সেইটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা হইতে পারে।’
‘মানে? গায়ে আগুন লাগিয়ে মৃত্যু ইন্টারেস্টিং ঘটনা?’ আজিজ মাস্টার হতাশ এবং ব্যথিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
‘অবশ্যই ইন্টারেস্টিং ঘটনা। এই দেশে মৃত্যু কোনো ঘটনা না। তবে ক্যামেরার সামনে যদি জীবন্ত কোনো মানুষ গায়ে আগুন লাগিয়ে মরে, তবে সেটা অবশ্যই ইন্টারেস্টিং ঘটনা। তখন এরা বরং চোখে মুখে আনন্দ নিয়ে আপনার মৃত্যু দৃশ্য দেখবে। কেউ কেউ ছবি তুলবে, ভিডিও করবে। কেউ কেউ সেই দৃশ্য ফেসবুকে লাইভ ভিডিও দিবে। এই দিক দিয়ে অবশ্য আপনি তখন ভাগ্যবান হবেন, লাইভ ভিডিও ডেথ হবে আপনার। সেই ভিডিও ভাইরাল হবে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ লাইক, কেমন্ট, শেয়ার। বুঝলেন?’

আজিজ মাস্টার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ালেন। তিনি বোঝেন নি। ছেলেটা বললো, ‘থাক, আপনার আর বুঝতে হবে না। তবে সমস্যা হচ্ছে, আপনি নিজের কোনো লোকজন নিয়ে আসেন নাই যে তারা এসে অনুনয় বিনয় করে, জোর জবরদস্তি করে আপনার অনশন ভাঙাবে।’

আজিজ মাস্টার থমথমে চোখে তাকিয়ে আছেন। ছেলেটা বললো, ‘আর আপনার দাবি দাওয়া কেউ মানতে আসবে না। এইটা সিওর। তবে সত্যি সত্যিই যদি অনশন করে মরে যান, তখন হয়তো কিছু সাংবাদিক খোঁজ-খবর নিতে আসবে। ভাগ্য ভালো হলে পত্রিকার কোণায় টোনায় দুয়েকটা সংবাদ টংবাদও হতে পারে। সান্ত্বনা বলতে এটুকুই। আমার মতো দুয়েকজন টুটকা ফাটকা কবি তখন আপনাকে নিয়ে কবিতা টবিতাও লিখে ফেলতে পারে। বিদ্রোহী কবিতা।’

আজিজ মাস্টার এতোক্ষণে ভালো করে ছেলেটার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। এতোক্ষণে তার মনে হলো ছেলেটা কবি- লেখক গোছেরই কিছু একটা হবে। তার কাঁধের শান্তি নিকেতনি ঝোলার ভেতর থেকে কাগজ-কলমও উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু কবি লেখকরা কি আসলেই এমন হয়? তাদের একপলক দেখেই বোঝা যায় তারা কবি-লেখক? আজিজ মাস্টার অবশ্য শুনেছেন, আজকাল শহুরে কবি লেখকরা আর আগের মতো এমন বেশভূষায় ঘুরে বেড়ান না। তারা এখন জিন্স, টি শার্ট, কোট টাই পরেও হরদম ঘুরে বেড়ান।
ছেলেটা আজিজ মাস্টারের মুখের কাছে মুখ এনে প্রায় ফিসফিস করে বললো, ‘এই দেশে অনশন-মানব বন্ধন করে কোনো লাভ হয়েছে কোনোদিন? কোনো দাবি-দাওয়া আদায় হয়েছে? হয় নাই। কারণ, ওগুলো এই দেশের জিনিস না। ওগুলা হলো শিক্ষিত, উন্নত দেশের জিনিস। এই দেশের দাবি আদায়ের জিনিস হলো জ্বালাও, পোড়াও, ভাঙচুর, হরতাল-অবরোধ। কথায় আছে না, যেমন ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল? এটাই আসল কথা। এইসব মানব বন্ধন-ফন্দন এই দেশে চলে না। মানুষ ভাবে মশকরা হচ্ছে। তারা বিষয়টাতে বিনোদন পায়, আনন্দ পায়, কিন্তু আন্দোলনটা আর পায় না। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণি হলো লোহা। আর লোহা গলাতে লাগে আগুন। পানিতে লোহা গলে না, গলে আগুনে। যেই জিনিসের যেই নিয়ম।’
আজিজ মাস্টার এতোক্ষণে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পরিচিত কোন সাংবাদিক আছে?’
‘দু চারজন আছে। তাবে তাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘কেন?’
‘কারণ তারা হচ্ছে অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক। ঢাকা শহরে এখন যে পরিমাণ কাক, সেই পরিমাণ অনলাইন পত্রিকা। এদের বেশিরভাগেরই কোনো সাংবাদিক থাকে না। নিজেই সম্পাদক, নিজেই সাংবাদিক। এরা বড় বড় পত্রিকার নিউজ কপি করে হুবহু ছাপায়। ফলে এদের নিজেদের নিউজ কেউ পড়ে না। না পড়ার অবশ্য কারণও আছে। এদের নিজস্ব নিউজ মানেই যৌন সুড়সুড়ি মার্কা খবর। মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বা উত্তেজক হেডলাইন। হেডলাইনের পাশে লেখা থাকে ভিডিও সহ’।
‘আজকাল কি পত্রিকায়ও ভিডিও দেখা যায়?’
‘আরো অনেক কিছুই দেখা যায়, সেসব আপনি বুঝবেন না। এবার আসল কথায় আসেন।’
‘জি’। আজিজ মাস্টার যেন হালে কিছুটা পানি ফিরে পাচ্ছেন। তার ধারণা, এই ছেলে তাকে বুদ্ধি পরামর্শ কিছু দিলেও দিতে পারে। নিজের বোধ বুদ্ধি নিয়ে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী নন তিনি। আগে তা যাও ছিলেন, এখন দিন যত যাচ্ছে, নিজের প্রতি নিজের আস্থা তত কমছে আজিজ মাস্টারের। চারপাশের মানুষ, পৃথিবী কেমন পাল্টে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও এর সাথে খাপ খাওয়াতে পারছেন না তিনি।

প্রেস ক্লাবের সামনে এসে এই অনশন করার বুদ্ধিও তার নিজের না। এই বুদ্ধি আরো বছরখানে আগে তাকে দিয়েছিলো তার স্কুলের অবৈতনিক বাংলা শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। রফিকুল পড়াশোনা করেছে ঢাকার তিতুমির কলেজে বাংলায়। তার জীবনের ‘এইম ইন লাইফ’ বলতে যা বোঝায়, তা হলো গ্রামের কোনো স্কুলে গিয়ে শিক্ষকতা করা। কোমলমতি ছেলে মেয়েদের সে তার শিক্ষায়-আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না।

মাস্টার্স পাশ করার পরও কোনো ভালো স্কুল কলেজে সে চাকরি-বাকরি জোটাতে পারলো না। আজকাল স্কুল কলেজে চাকরি পেতে হলে সার্টিফিকেট ছাড়াও আরো নানান কিছু লাগে। কিন্তু সেসব কিছুই তার নেই।
রফিকুলের সাথে আজিজ মাস্টারের পরিচয়ের ঘটনা খুবই অদ্ভুত। আজিজ মাস্টার ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। আবহাওয়া খারাপ। আরিচা ফেরি ঘাট থেকে ফেরিতে উঠতেই শুরু হলো তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। একই ফেরিতে ফিরছিলো রফিকুলও। তার বাড়ি খুলনায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝড়ো হাওয়া থেমে গেলেও বৃষ্টি আর থামলো না। আজিজ মাস্টারের হাতে ছাতা। তিনি ছাতা মাথায় ফেরির রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বিস্তৃত নদীর জলে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির অজস্র ফোঁটা। ক্রমশই ধূসর হয়ে উঠছে দূরের দৃশ্য। ঠিক এই মুহূর্তে ছেলেটাকে চোখে পড়লো তার। রেলিংয়ের শেষ প্রান্তে একা একা দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বৃষ্টিতে ভিজছে রফিকুল। তার পরনে ইস্ত্রি করা আকাশি রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। কাঁধে ব্যাগ। কিন্তু কোনোদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সে আনমনে নদীর দিকে তাকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তবে তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আসলে কিছুই দেখছে না সে। কেবল শূন্য চোখে তাকিয়েই আছে।
আজিজ মাস্টার ভারি অবাক হলেন। তিনি খানিক ইতস্তত করে ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলেন। কথাও বললেন। রফিকুল তখন মানিকগঞ্জে এক স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরছে। ইন্টারভিউর ফলাফল সাথে সাথেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তার চাকরি হয় নি। রফিকুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার আর সে বাড়ি ফিরে যাবে না। আজিজ মাস্টার সব শুনে বললেন, ‘তাহলে কোথায় যাবে তুমি?’
রফিকুল উদাস গলায় বললো, ‘জানি না।’
‘জানিনা মানে? এতো দারুণ একটা ভাবনা নিয়ে তুমি এখন কিছুই করবে না? তোমার বয়সী আর কোনো ছেলে মেয়ে এই চিন্তা করবে?’
‘করবে না?’
‘মনেতো হয় না। এমন আর কাউকেতো দেখি নাই।’
‘তার মানে আমার ভাবনাটা আসলে দারুণ না। আমার ভাবনা বরং অচল ভাবনা।’
‘অচল কেন হবে?’
‘অচল না হলেতো আরো অনেকের মধ্যেই এই ভাবনা দেখতেন।’
আজিজ মাস্টার রফিকুলের অভিমান ও হতাশার জায়গাটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু নিজের তেমন কিছু করারও নেই। তারপরও তিনি বললেন, ‘শোনো বাবা। তোমার ভাবনা অবশ্যই দারুণ। সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে এই ভাবনা প্রচলিত ভাবনা না। সবাই আগে টাকা পয়সার ভাবনাটা ভাবে। এই কারণে কেউ এমন করে ভাবতে পারে না। সবারতো আর এই সাহসটা থাকে না। তোমার আছে। তুমি সাহসী ছেলে।’
রফিকুল হতাশ ভঙ্গিতে হাসলো, ‘পেটে ভাত না থাকলে সাহস দেখিয়ে লাভ কী? সাহস দেখাতে হলে আগে পেটে ভাত থাকতে হয়।’

রফিকুলের কথা সত্য। আজিজ মাস্টারের খুব ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটাকে তার স্কুলের জন্য নিয়ে যেতে। কিন্তু তার সেই সামর্থ্য নেই। এই ছেলেকে তিনি কোনো টাকা পয়সা দিতে পারবেন না। তার ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। তবে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাটা তিনি করতে পারবেন। দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলে এই মুহূর্তে ভয়াবহ শিক্ষক সংকট। বিনা বেতনে কে-ই বা আর কাজ করতে চায়? এই অবস্থায় রফিকুলের মতো কাউকে পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু শুধু থাকা খাওয়ার বিনিময়ে কি সে রাজি হবে?
অনেক দ্বিধা আর সঙ্কোচ নিয়েই প্রস্তাবটা দিলেন আজিজ মাস্টার। তিনি বললেন, ‘তুমি যদি কিছু না মনে করো, তাহলে তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে পারি বাবা।’

রফিকুল খানিক তাকিয়ে থেকে বললো, ‘কিছু মনে করার মতো অবস্থা আমার নাই। আপনি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারেন। চাইলে ধাক্কা দিয়ে আমাকে পানিতেও ফেলে দিতে পারেন। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও যদি তাতে কমে।’
আজিজ মাস্টার সস্নেহে বললেন, ‘এসব কী বলছো তুমি! এতো হতাশ হলে চলে?’
রফিকুল জবাব দিলো না। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আমার একটা স্কুল আছে। হাই স্কুল। সমস্যা হচ্ছে সেই স্কুল এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। তুমি চাইলে আমার সেই স্কুলে আপাতত জয়েন করতে পারো। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমি আপাতত তোমাকে বেতন টেতন কিছু দিতে পারবো না। কিন্তু তোমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো।’
রফিকুলের কথাটা বিশ্বাস হলো না। এ যেন মিরাকলের মতো ব্যাপার। এমন মন ভাঙা হতাশার দিনে, এই চলন্ত ফেরিতে এমন একটা প্রস্তাব আসতে পারে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। রফিকুল নিশ্চিত হবার জন্য বললো, ‘আমি আপনার কথা বুঝিনি।’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘স্কুল এমপিওভুক্ত হওয়ামাত্রই তুমি তোমার যোগ্যতানুযায়ী বেতন ভাতা সব পেতে শুরু করবে। কিন্তু আপাতত আমি তোমাকে টাকা পয়সা কিছু দিতে পারবো না। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাটা শুধু করতে পারবো। তবে তোমাকে নিচের ক্লাসের কিছু টিউশন ফিউশন জোগাড় করে দেয়ার চেষ্টা করবো। যাতে তোমার হাত খরচটা অন্তত সেখান থেকে আসে।’

এই মুহূর্তে এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর রফিকুলের হাতে নেই। সে এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। সেদিনই রফিকুলকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন আজিজ মাস্টার। রফিকুল দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক হিসেবে বিনা বেতনে চাকুরি পেয়ে গেলো। তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো আজিজ মাস্টারের বাড়িতেই।


আজিজ মাস্টারের তিন মেয়ে। ছেলে নেই। বড় মেয়ে ঝুমুর বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়ে রুমু এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট মেয়ে কুমু পড়ে ক্লাস টেন এ। এই বাড়িতে রফিকুলের বয়সী ছেলে রাখা আর খাল কেটে কুমির আনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু আজিজ মাস্টার তারপরও রাখলেন। রাখার অন্য কারণও অবশ্য আছে। ফেরি থেকেই রফিকুলের সাথে তার কথাবার্তা বেশ জমে উঠলো। রফিকুল স্বল্পভাষী হলেও সে কথা বলে খুব গুছিয়ে, হিসেব নিকেশ করে। স্কুলের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে তার সাথে নানান আলাপ আলোচনাও হলো। রফিকুলের আগ্রহ দেখে আজিজ মাস্টারের ভালো লেগে গেলো। এই ছেলেটা সাথে থাকলে স্কুল বিষয়ক নানান শলাপরামর্শ তিনি করতে পারবেন। তার কেনো যেন মনে হতে লাগলো যে রফিকুল আলমের কারণেই তিনি তার স্কুলের একটা গতি করে ফেলতে পারবেন। এটা তার একধরনের দৈব বিশ্বাসের মতো কাজ করা শুরু করলো। এছাড়া আর কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কে জানে, কাকে দিয়ে কখন কোন উপকার হয়ে যায়!
সেই রফিকুলের পরামর্শেই তিনি ঢাকায় এসেছেন। তবে রফিকুল তাকে এই পরামর্শ দিয়েছিলো আরো বছরখানেক আগে। সে হঠাৎ একদিন পুরনো এক খবরের কাগজ হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। তারপর হড়বড় করে বলতে লাগলো, ‘দেখেছেন স্যার বিষয়টা?’
আজিজ মাস্টার চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন, ‘কী বিষয়?’
‘বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা তাদের স্কুল সরকারি করার দাবিতে অনশনে বসছে।’
আজিজ মাস্টার যতটা আগ্রহ নিয়ে বিষয়টা দেখতে চাইছিলেন। ততটা অনাগ্রহ নিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘এই সব অনশন ফনশনে কিছু হয়না।’
‘হয় হয় স্যার। এগুলাতেই হয়। এই অনশনে প্রথমে কাজ না হলেও এই যে পেপার পত্রিকায় আসলো, এর একটা ইমপ্যাক্ট আছে। এগুলো অনেকের চোখে পড়বে। এটা নিয়ে কথা হবে। ধরেন একজন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলো। বা আরো খারাপ কিছু ঘটে গেলো। তখন কিন্তু আর সরকারের পক্ষে বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে পারা যাবে না।’
‘হুম’। আজিজ মাস্টার খুব একটা আগ্রহী হতে পারলেন না। রফিকুল বললো, ‘তারপর ধরেন কেউ একজন এসে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ট্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের অনশন ভাঙালো। তারপর কী হবে জানেন?’
‘কিছুই হবে না। ওই প্রতিশ্রুতিই সম্বল।’
‘এটা যেমন ঠিক। তেমনি এর উল্টোদিকও আছে।’
‘উল্টোদিক কী?’
‘এরপর শিক্ষকরা দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নামবে। রাস্তা ব্যারিকেড দিবে। তখন পুলিশ বাধা দিবে। সরকারি দলের চ্যালাচামুন্ডরা ঝামেলা পাকাবে। তারপর কী হবে? টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ। তখন এটা একটা ন্যাশনাল ইস্যু হয়ে যাবে। আর তখন দেখবেন ঘটনা সিরিয়াস আকার ধারন করেছে। সরকারের তখন আর দাবি না মেনে উপায় থাকবেনা।’
‘হুম। কী জানি!’ হতাশ গলায় বললেন আজিজ মাস্টার। ‘আমার এখন আর কোনো কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।’
‘কোনো কিছুতে ঠিকঠাক লেগে থাকলে সেটা হয়ই স্যার। পার্থক্য শুধু আগে আর পরে।’
‘লেগেতো আমিও কম থাকি নি বাবা। কই কিছুইতো হলো না।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন আজিজ মাস্টার।  
‘ঠিকঠাক লেগে থাকলে এতোদিনে হয়ে যেতো স্যার।’
আজিজ মাস্টার চট করে রেগে গেলেন, ‘তুমি বলছো আমি ঠিকঠাক লেগে থাকিনি? তোমার কী ধারণা, এই স্কুলের প্রতি আমার মায়া মহব্বত কম? আমি চাই না এই স্কুল এমপিওভুক্ত হোক?’
রফিকুল সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বললো, ‘না না। আমি তা বলিনি স্যার। আমি বলেছি যে অনেক উপায় আছে, যেটা অনুসরণ করা গেলে হয়তো কিছু একটা হয়েই যেতো।’
আজিজ মাস্টার রাগান্বিত স্বরেই বললেন, ‘কী উপায় শুনি?’
রাফিকুল অবশ্য সাথে সাথেই বলার সাহস পেলো না। একটু সময় নিয়ে পুরো বিষয়টা গুছিয়ে নিলো সে। তারপর বললো, ‘যদি একটা কাজ করা যায় স্যার, তাহলে একটা উপায় হয়েও যেতে পারে।’
‘কী কাজ?’
‘ধরেন স্যার আমরা স্কুলের সব ছেলে মেয়ে নিয়ে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষক সহ একটা অনশনে বসলাম। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। সেখানে সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা সবসময়ই থাকে। এটা নিয়ে স্যার তখন একটা শোড়গোল পড়ে যাবে। ছোট ছোট বাচ্চারা অনশনে বসলে বিষয়টা সবার দৃষ্টিগোচর হবে। আলোচনায় চলে আসবে। তখন দেখবেন একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।’
‘তো দেশে যত স্কুল আছে এমপিওভুক্ত হয়নি, সব স্কুলের ছাত্র শিক্ষকরাই এমন করলে তাদের স্কুলের সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে?’

আজিজ মাস্টারের এই কথায় রফিকুল গুটিয়ে গেলো। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘বিষয়টা যদি এতোই সহজ হতো তাহলে এই যে এতো এতো প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা এতো এতো দিন ধরে এতো এতো আন্দোলন করতো না।’
রফিকুল আরো কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু আজিজ মাস্টারের মেজাজ দেখে সে আর কিছু বললো না। আজিজ মাস্টারও তার নানান যুক্তি বিবেচনায় তখন বিষয়টাতে তেমন গুরুত্ব দেন নি। রফিকুলের বুদ্ধিও তার পছন্দ হয়নি। ছেলে মানুষী মনে হয়েছে। তাছাড়া, তিনি নিজেতো জানেন, অনশনটা স্রেফ হুমকি, লোক দেখানো। না খেয়েতো আর সত্যি সত্যিই কেউ মরে যায় না। তিনিও যাবেন না। মাঝখান থেকে অনশনের অভিনয় করে কিছু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবেন কেবল। কিন্তু স্কুল নিয়ে এটা করতে তার মন ভেতর থেকে সায় দিচ্ছিলো না। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত যদি তার এই অনশন নিয়ে কেউ কোনো আগ্রহ না দেখায়, তখন? তখন কী হবে?

তখনতো বিষয়টি রীতিমতো হাস্যকর হয়ে যাবে। প্রথমত, এই এলাকা থেকে এতো ছেলে মেয়ে নিয়ে ঢাকায় যাওয়া তার পক্ষে নানা কারণেই সম্ভব না। নুরুল চেয়ারম্যান এই ঘটনা শুনলেই এই নিয়ে কোনো একটা ফন্দি আঁটবেন নিশ্চিত। তিনি এমন কিছুও করে ফেলতে পারেন, যাতে আজিজ মাস্টার বড় কোনো বিপদে পড়ে যান। তাছাড়া গ্রামের বাবা মায়েরাও এতে রাজি হবেন না। দ্বিতীয়ত, দেখা গেলো তিনি একা একাই অনশন করতে চলে গেলেন। অনশনে বসেও গেলেন কিন্তু তারপর যদি কেউ সেটাকে কোনো গুরুত্বই না দেয়। তার দাবি যদি আদায় না হয়, তখনতো আর তিনি সত্যি সত্যিইতো না খেয়ে মারা যাবেন না! তখন কী করবেন তিনি? নিজে নিজে বেহায়ার মতো অনশন ভেঙে বাড়ি চলে আসবেন?

এরপর বহু সময় চলে গেছে। বিষয়টা একভাবে ভুলেই গিয়েছিলো রফিকুল। এ নিয়ে আজিজ মাস্টারের সামনে কোনো কথা বলার আর সাহস হয়নি তার। কিন্তু দিন দুই আগে রফিকুলকে ডেকে আজিজ মাস্টার নিজেই বললেন, ‘মাস্টার সাব, আমি ঢাকা যাবো।’
‘হঠাৎ ঢাকা কেন যাবেন স্যার?’
‘তুমি না বলছিলা, প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে অনশন করতে!’
রফিকুল অবাক গলায় বললো, ‘সেতো বহু আগে স্যার! কিন্তু তখন তো আইডিয়া আপনার পছন্দ হয় নাই!’
‘তখন হয় নাই বলে যে আর কখনো হতে পারবে না, এমনতো কোনো কথা নাই। আছে?’ আজিজ মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন।’
‘জি না।’
‘তাহলে তর্ক বন্ধ করে, কীভাবে কী করবো, সেই বিষয়ে ধারণা দাও।’

রফিকুল খানিক ধারণা দিলেও পুরো বিষয়টি নিয়েই সে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলো। ফলে সে চাইছিলো, সে নিজেও আজিজ মাস্টারের সাথে ঢাকায় আসতে। কিন্তু আজিজ মাস্টার তাতে রাজি হলেন না। মাস কয়েক আগে এলাকায় এক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর থেকেই চারদিকে একটা থমথমে অবস্থা। এই সময়ে বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ থাকা দরকার। তার স্ত্রী রিজিয়া বেগমও অবশ্য আজিজ মাস্টারকে একা ছাড়তে চান নি। কিন্তু আজিজ মাস্টার কারো কথাই শোনেন নি। তিনি গ্রামের কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে গতকাল ভোরেই চুপিচুপি ঢাকা চলে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে এখন মনে হচ্ছে, এভাবে ঝোঁকের মাথায় একা একা চলে আসা তার ঠিক হয় নি। কোনোকিছুরই আগামাথা তিনি বুঝতে পারছেন না। সাথে জানাশোনা কেউ থাকলে আসলেই ভালো হতো।

ঝোঁকের মাথায় একা একা ঢাকায় এসেছেন তিনি। এখন এখানে এই ফুটপাতে বসে আছেন। কিন্তু কী করবেন না করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। কাঁধে ঝোলাওয়ালা কবি কবি চেহারার ছেলেটা তার পাশে বসে আছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যায়। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে ছেলেটা ধুরন্ধর প্রকৃতির। একে বিশ্বাস করা আর নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারা সমান কথা। ছেলেটা আবার বললো, ‘কী ব্যাপার স্যার? আপনিতো কিছুই বলছেন না? এরকম ধ্যানমগ্ন হয়ে সারস পাখির মতো বসে থাকলে চলবে? আপনার প্ল্যান-পরিকল্পনা কী সেটা বলেন?’
আজিজ মাস্টার হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পাওয়া গলায় বললেন, ‘কোনো প্ল্যান পরিকল্পনাতো নেই।’
‘প্ল্যান-পরিকল্পনা ছাড়া কেউ অনশন করতে বসে?’
‘তাতো জানি না! এর আগেতো কখনো অনশন করি নাই আমি।’
‘এটা অবশ্য ঠিক কথা। তবে স্যার, আপনি সত্যি করে একটা কথা বলবেন?’
‘কী কথা বলবো?’
‘আপনার আসল উদ্দেশ্য কী?’
‘আসল উদ্দেশ্য কী মানে?’
‘না মানে, অনশন করার নাটকটা কেন করছেন?’
‘নাটক করছি?’ আজিজ মাস্টার রীতিমতো অপমানিত বোধ করলেন।
‘নয়তো কী? স্কুল এমপিওভুক্তির দাবিতে এভাবে একা একা কেউ কোনোদিন অনশন করছে? আর করলেও এভাবে কি দাবি আদায় হয়?’
‘হয় না?’
‘ধরেন হলো। তো এভাবে যদি দাবি আদায় হতে থাকে, তাহলেতো যে কেউ যখন তখন, যেকোনো দাবিতে এভাবে রাস্তাঘাটে বসে অনশন করা শুরু করে দিবে। তখন? দেখা গেলো কেউ একজন একটা স্কুল খুলেই এসে অনশন করা শুরু করে দিলো, তার স্কুলের সরকারি হতে হবে। তখন কি সরকারের পক্ষ থেকে সেই সবার সব দাবি পূরণ সম্ভব হবে? অনশন করে সব শিক্ষকরা মরে গেলেওতো সম্ভব হবে না।’
আজিজ মাস্টার খানিক চুপ করে রইলেন। এই কথা তিনি নিজেও ভালোভাবে জানেন। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্যটা তিনি কাউকে খুলে বলতে পারছেন না। সেটা এখুনি সম্ভব নয়। আগে বুঝতে হবে ছেলেটা কেমন। যদি ভালো মনে হয়, তাহলে তিনি তার আসল উদ্দেশ্যটা ছেলেটাকে খুলে বলবেন। আজিজ মাস্টার বিড়বিড় করে বললেন, ‘তা হবে না। কিন্তু আমার দাবির পক্ষেতো যুক্তি আছে।’
‘সবার দাবির পক্ষেই যুক্তি থাকে স্যার। যে লোক চুরি করে, তারও তার চুরির পক্ষে যুক্তি থাকে। যে লোক খুন করে, তারও তার খুনের পক্ষে যুক্তি থাকে। কিন্তু যুক্তি থাকা মানেই সেটা সঠিক বা গ্রহণযোগ্য না।’
কথাটা খুব পছন্দ হলো আজিজ মাস্টারের। ছেলেটার ভাব-ভঙ্গি, পোশাক-আশাক দেখে মনে মনে যতটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তিনি করেছিলেন, এখন তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আমার স্কুল এমপিওভুক্ত না হওয়ার পেছনে অন্য কারণও আছে। গুরুতর কারণ। সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। রাজনৈতিক। একবারতো সবকিছু একদম ফাইনাল হয়েই গিয়েছিলো, কিন্তু এই কারণেই শেষ মুহূর্তে হলো না।’
‘হবে কীভাবে বলেন? আপনার নিজের ইচ্ছাইতো শক্ত না।’
‘ইচ্ছা শক্ত না মানে?’ আজিজ মাস্টার খুবই অবাক হলেন।
‘মানে যেই দাবির কথা মানুষ চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখে, সেই দাবিতো পূরণ হওয়ার কথা না।’
আজিজ মাস্টার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালেন। দীর্ঘ সময়ে তাকিয়ে থেকেও তিনি সমস্যাটা ধরতে পারলেন না। কোথাও কি কোনো ভুল হয়েছে? বানান বা বাক্যে?
ছেলেটা বললো, ‘ব্ল্যাকবোর্ডে মানুষ কি লেখে জানেন?’
‘কী?’
‘যা মুছে ফেলতে হবে তা। মানে এরপর সেখানে অন্য কিছুও লিখতে হবে। এখন বলেন আপনার আসল উদ্দেশ্য কী?’
আজিজ মাস্টার সাথে সাথেই কথা বললেন না। তবে ছেলেটার চোখের দিকে তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এতোক্ষণে তিনি লক্ষ্য করলেন ছেলেটার চোখজোড়া ঝকঝকে। বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার নাম কী?’
‘আসাদ’।
‘কী করেন?’
‘কবিতা লেখি।’
‘তার মানে কবি?’
‘বলতেও পারেন। আবার নাও বলতে পারেন।’
‘মানে?’
‘মানে লোকে অকবিও বলে।’
‘অকবি আবার কী জিনিস?’
‘যে কবিতা লেখার চেষ্টা করে, কিন্তু হয় না বা লিখতে পারে না, সে হলো অকবি।’
‘আপনার কবিতা হয় না?’
‘মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, হয় না।’
‘তাহলেতো আপনার মাঝে মাঝে কবি, আর মাঝে মাঝে অকবি হওয়ার কথা ছিলো।’
‘আমারও তাই-ই মনে হয়। কিন্তু আমার সমসাময়িক আর সব কবিদের ধারণা আমার কবিতা কিছুই হয় না। সব গার্বেজ।’
‘তাদের সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’
‘তাদের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।’
‘কেন?’
‘কারণ তাদের লেখা আমি পড়ি না।’
‘পড়েন না কেন?’
‘পড়ার যোগ্য মনে করি না।’
‘কেন যোগ্য মনে করেন না। না পড়লে যোগ্য-অযোগ্য বুঝবেন কী করে! আগেতো পড়তে হবে। তারপর না ভাবতে পারবেন।’
‘তাদের নিয়ে আমি ভাবতেও চাই না। ভাবিও না।’
‘ভাবেন না কেন?’
‘সময় নষ্ট। কারণ এরা লেখার চেয়ে সারাক্ষণ অন্য কবি-লেখকদের সমালোচনা করা, খিস্তি- খেউড় নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে।’
‘কিন্তু আপনি না ভাবলে লিখবেন কী করে?’
‘তাদের নিয়ে ভাবি না মানে যে আমি কিছু নিয়েই ভাবি না, তাতো নয়!’
‘আচ্ছা, তাহলে আপনি কাদের নিয়ে ভাবেন?’
‘আমি ভাবি নিজেকে নিয়ে। নিজেকে ঠিকভাবে চিনতে পারলেই সবাইকে চেনা যায়। লালন সাঁইয়ের গান আছে না, একবার আপনারে চিনতে পারলে রে যাবে অচেনারে চেনা।’
‘এখন কী লিখছেন?’
‘এখন কিছুই লিখছি না।’
‘কেন?’
‘লিখতে পারছেন না কেন?’
‘তাতো জানি না। তবে অনেকদিন ধরে অনেক চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারছি না। কবিতা আসছে না।’
আজিজ মাস্টারের হঠাৎ মনে হলো তিনি অযথা কথাবার্তা বলছেন। এসব কথাবার্তার সাথে তার অনশনের কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষকদের এই এক সমস্যা, তারা কারণে অকারণে শুধু কথা বলতে চায়। কোথায় তার এখন নিজের কাজের কথা বলা উচিত, তা না করে তিনি এসব কী হাবিজাবি নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন! আজিজ মাস্টার এবার কাজের কথায় এলেন, ‘আমার কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?’
‘ঝেড়ে কাশা উচিত।’
‘ঝেড়ে কাশা উচিত মানে?’
‘ঝেড়ে কাশা উচিত মানে, আসল ঘটনা কী সেটা খুলে বলা উচিত।’
‘আপনার ধারণা আমি এই অনশন নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছি? মিথ্যে কথা বলছি?’
‘উহু, তা মনে হচ্ছে না।’
‘তাহলে কী মনে হচ্ছে?’
‘মনে হচ্ছে, আপনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্যর কথা আপনি প্রথমেই কাউকে বলতে চাইছেন না।’
এবার আজিজ মাস্টার সত্যি সত্যি বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, ‘আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে?’
‘শোনেন স্যার, আমার প্রধান শখ মানুষ দেখা। রাত দিন আমি এই মানুষ দেখার জন্য ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াই। আমার ধারণা ছিলো, এইভাবে মানুষ দেখলে আমি কবিতা লিখতে পারবো। অনেকদিন পেরেছিও। কিন্তু হঠাৎ বেশ কিছুদিন হলো কিছুই লিখতে পারছি না। বুঝতে পারছি না, আমার কী তাহলে মানুষ দেখা শেষ হয়ে গেলো নাকি?’
‘মানুষ দেখা আবার শেষ হয়?’
‘সেটাই কথা। সমস্যাটা কী বুঝতে পারছিনা।’
‘অন্য সব দেখা, সব পড়া একদিন শেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মানুষ দেখা বা পড়া কখনো শেষ হবে না। কারণ মানুষ হলো অফুরন্ত গল্পের উৎস।’
‘বাহ, দারুণ বলেছেন স্যার। তবে একটা কথা কি জানেন? কবিতা লিখতে না পারলেও, এই দিনের পর দিন রাস্তা ঘাটে ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখতে দেখতে একটা লাভ আমার হয়েছে।’
‘কী লাভ?’
‘আমি এখন অল্প-বিস্তর মানুষ চিনতে পারি। কিছুক্ষণ কারো দিকে তাকিয়ে থাকলেই তার হাবভাবে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে যায়। আমি দীর্ঘ সময় রাস্তার ওই পাশে বসে বসে আপনাকে দেখছিলাম। দেখে আপনার সম্পর্কে খুব কৌতূহল তৈরি হলো। এইজন্যই আসা। আপনি আবার স্যার ভাববেন না যে আমার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। আসলে আপনাকে আমার যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মানুষ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে সাদাসিধে হলেও, আপনি মানুষটা সাদাসিধে না’।
‘আমি তাহলে কেমন মানুষ?’
‘আমার ধারণা আপনি খুব জেদী একজন মানুষ। আর এই জেদ আপনাকে সাদাসিধে মানুষ থেকে মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারে।’

আজিজ মাস্টার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তার প্রায় ষাট বছরের এই জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে ভয়ংকর মানুষ বললো। তিনি নিজে খুব ভালো করেই জানেন, তিনি মোটেই ভয়ংকর কোনো মানুষ নন। বরং খুবই সাদাসিধে, নিরীহ গোছের গোবেচরা, নির্ঝঞ্জাট ধরনের মানুষ তিনি। করো কোনো সাতে-পাঁচে তিনি নেই। কোনো ঝামেলা পছন্দ করেন না। কিন্তু এই ছেলের কথা শুনে তার এখন মনে হচ্ছে, যদি সত্যি সত্যিই এই সহজ সাধারণ চেহারার আড়ালে ভয়ংকর কোনো মানুষ হতে পারতেন তিনি! বিষয়টা তাহলে মন্দ হতো না। বরং ভালোই হতো। হঠাৎ হঠাৎ নানান তুঘলকি কাজকর্ম করে লোকজনকে চমকে দেয়া যেতো। আজিজ মাস্টার আবিষ্কার করলেন, নিজেকে ভয়ংকর মানুষ ভাবতে তার ভালো লাগছে। বিষয়টা ভেবে মনে মনে ভারি অবাক হলেন তিনি। খানিকটা ভয়ও পেলেন।
আসাদ বললো, ‘এখন ঘটনা কী খুলে বলেন। এখানে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। রাতে ঘুমাবেন বা আশেপাশে কোথাও বাথরুম করতে যাবেন, এসে দেখবেন আপনার বিছানা বালিশ নেই। ব্যাগ নেই। ব্ল্যাকবোর্ডও নেই।’
‘কেনো?’
‘কারণ এটা ঢাকা শহর। তবে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে ফুটপাতে নানান ধরনের হকারদের ব্যবসা থাকে। আনারস থেকে তরমুজ, আমড়া, জাম্বুরা, শরবত, বাদাম, ছোলা মুড়ি থেকে গেঞ্জি, কসমেটিকস পর্যন্ত এরা এই ফুটপাতে বসেই বিক্রি করে। এতেই তাদের সংসার চলে। সুতরাং এরা কিন্তু বেশিদিন আপনাকে সহ্য করবে না। তাদের ব্যবসায় আপনি ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন। আপনি না উঠলে আপনাকে সহই তারা হাপিশ করে দিবে।’
আজিজ মাস্টার এবার খানিক ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বিচলিত গলায় বললেন, ‘আমার দাবি আদায় না হোক, আমি অন্তত চাই আমার কথাগুলো- দাবি দাওয়াগুলো লোকজনের কাছে পৌঁছাক। কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি পর্যন্ত যাক। কেউ একজন এসে আমার সাথে কথা বলুক। আমার কথা শুনুক।’
‘আপনার এই স্কুলের কথা শুনে লোকজনের লাভ কী?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তবে আসাদের কথা সত্য, তার স্কুলের কথা শুনে আসলেই কারো কোনো লাভ নেই।
আসাদ বললো, ‘আর সাধারাণ মানুষ শুনলেতো আপনারও কোনো লাভ নেই। আছে?’
‘উহু’।
‘তার মানে আপনার কথা শুনতে হবে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। প্রভাবশালী লোকজনের। এমপি মন্ত্রীদের। কিন্তু আপনার কথা শোনার সময় তাদের নেই। তারা অনেক ব্যস্ত মানুষ। তাদের নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজ-কর্ম, মিটিং সিটিং, সভা সেমিনার থাকে। তারা কেন আপনার এই তুচ্ছ বিষয়ে সময় নষ্ট করবে?’
‘একটা স্কুলের অস্তিত্বের প্রশ্ন তুচ্ছ বিষয়?’
‘অবশ্যই তুচ্ছ বিষয়।’
‘তাহলে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী?’
‘এই ধরেন কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেয়া। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা। সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে যাওয়া। টিভি সিনেমার নায়ক নায়িকা, গায়ক গায়িকাদের গানের অনুষ্ঠানে যাওয়া। বিয়ে- বৌভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়া। বা ধরেন আলু কিংবা মুলা চাষ বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আহরণের জন্য পরিবার পরিজন নিয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশ সফর করা। এছাড়াও আছে টেলিভিশন টক শোতে বকবক করা। এমন বহু বিষয় আছে।’
‘কিন্তু আমাকে যে একজন বলেছিলো, প্রেসক্লাবের সামনে যেকোনো দাবিতে অনশন করলে সাংবাদিকরা সংবাদ করে। তখন বিষয়টার একটা গুরুত্ব তৈরি হয়। মন্ত্রী মিনিস্টাররা পর্যন্ত তখন বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়?’
আসাদ বিরক্ত গলায় বললো, ‘এতোক্ষণ কী বললাম আপনাকে! এই যে তখন থেকে বকবক করছি, কী জন্য?’
আজিজ মাস্টার কথা বললেন না। আসাদ বিরক্তি নিয়েই বললো, ‘আরে চাচা, সেজন্যওতো আপনার কিছু চেনা পরিচিত সাংবাদিক লাগবে। কিছু লোকজন লাগবে। যারা এইসব অ্যারেঞ্জ করে দিবে। আপনার আশেপাশে বসার জন্যও দুয়েকজন লোক লাগবে। দাবি দাওয়া সম্বলিত একটা ব্যানার হলে ভালো হতো। কিন্তু আপনি নিয়ে আসছেন ব্ল্যাকবোর্ড। এটা কিছু হলো? সাথে একটা হ্যান্ড মাইক থাকলেও না হয় কিছু একটা করা যেতো! আপনার সাথের লোকরা অন্তত কিছুক্ষণ পরপর মাইকে আপনার দাবি দাওয়া ঘোষণা দিতে পারতো। সেই দাবি দাওয়া পূরণ না হলে আপনি কী করবেন সেগুলোও খানিক পরপর বলতে পারতো। সবচেয়ে ভালো হতো, মাইকে যদি বলা যায়, আগামী তিনদিনের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আপনি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করবেন!’
‘কী বলছেন আপনি! গায়ে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করবো মানে?’ আজিজ মাস্টার রীতিমতো আঁতকে উঠলেন।
‘ঠিকই বলছি। এ ছাড়া কারো টনক নড়বে না, বুঝলেন? এই দেশে সবকিছু দরকার কড়া, কঠিন। এই দেশে কড়া ছাড়া দরজার কড়াও নড়ে না। আপনি যদি একটা কাজ করতে পারেন, কেবল তাহলেই কিছুটা হলেও আপনার আলোচনায় আসার সুযোগ আছে। আপনার দাবি দাওয়া নিয়ে একটা শোড়গোল ওঠার সুযোগ আছে। এছাড়া কোনো চান্স নাই।’
‘কী কাজ?’
‘আপনার দাবি আদায় না হলে একটা হুমকি দিয়ে রাখবেন।’
‘দাবি আদায়ের জন্য হুমকি?’
‘হুম’।
‘কী হুমকি?’ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন আজিজ মাস্টার।
‘কোনো একটা নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার ঘোষণা দিবেন। দেখবেন, এই খবর মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। সবখানে একটা শোড়গোল লেগে যাবে।’
‘কী বলছেন আপনি?’
‘ঠিকই বলছি। এই কাজ করলে দেখবেন লোকজন আগ্রহ নিয়ে আপনার দিকে তাকাবে। বহু লোক জড় হয়ে যাবে। ফেসবুক টেসবুকে আসবে। তখন পেপার পত্রিকাও আগ্রহ দেখাবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই স্যার।’
আজিজ মাস্টারের এবার আসাদকে পাগল মনে হতে লাগলো। এর ভাব ভঙ্গি, কথাবার্তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এই খুব ভালো, গভীর কথা বলছে, আবার পরক্ষণে খুবই এলোমেলো, অসংলগ্ন, হাস্যকর কথাবার্তা বলছে। তিনি হতাশ গলায় বললেন, ‘আপনি একটা কাজ করবেন আমার জন্য?’
‘কী কাজ?’
‘এই যে ভিড় করে আসা লোকগুলোকে একটু সরাবেন?’
‘কেন?’
‘এদের দেখেই আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।’
‘এদের দেখে মাথা ধরলেতো হবে না স্যার। বরং এরাই আপনার সত্যিকারের সম্পদ। যত ভিড়, তত বীর।’
‘মানে?’
‘মানে যত লোক জমবে, তত আপনার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে। আপনার গুরুত্ব বাড়বে। বুঝলেন?’
‘হুম বুঝলাম।’ আজিজ মাস্টার আর কথা বললেন না। তার সত্যি সত্যিই মাথা ধরেছে। তবে আসাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। এইসব জিনিসপত্র রেখে তিনি আশেপাশে কোথাও বাথরুম করতেও যেতে পারবেন না। ফিরে এসে যে আর কিছুই পাওয়া যাবে না, সে বিষয়ে তিনি এখন মোটামুটি নিশ্চিত। সন্ধ্যা পর্যন্ত আজিজ মাস্টার দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলেন। ততক্ষণে ভিড় মোটামুটি কমে এসেছে। আসাদও চলে গেছে। সামনে জনা চারেক পুলিশ দেখে এক ফাঁকে তিনি উঠে গিয়ে বাথরুম সেরে এলেন। পুলিশের সামনে নিশ্চয়ই কেউ কিছু সরাতে সাহস করবে না। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখলেন, কেউ কিছু সরায়ও নি। তবে সেই জনাচারেক পুলিশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কথা বলছে তারা। আজিজ মাস্টারের হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, এই পুলিশগুলো তাকে নিয়েই কথা বলছে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু একমাত্র তিনিই। এ বিষয়ে আজিজ মাস্টার হঠাৎ নিশ্চিত হয়ে গেলেন।। যদিও কারণটা তিনি বুঝতে পারছেন না।
নুরুল মোল্লা কী তাহলে কোনোভাবে এই ঢাকা পর্যন্তও তার প্রভাব খাটিয়ে লোকজন পাঠিয়ে দিয়েছে! এই ভয়টাই তিনি এতোদিন করছিলেন। আর এ কারণেই চুপচাপ কাউকে কিছু না জানিয়েই একা একা ঢাকা চলে এসেছিলেন তিনি।
দুজন পুলিশ সদস্য হঠাৎ তার দিকে এগিয়ে এলো। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে একজনের নাম তিনি পড়তে পারলেন, সাগর।
সাগর অবশ্য কোনো ভদ্রতার ধার ধরলো না। সে সরাসরি বললো, ‘চাচা মিয়া, এইখানে কী করেন?’
আজিজ মাস্টার মিনমিন করে বললেন, ‘কী করি তাতো দেখতেই পাচ্ছেন।’
‘নাহ, দেখতে পাচ্ছি না। আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
আজিজ মাস্টার ঘটনা খুলে বললেন। সাগর বললো, ‘এইসব বাইল চাইল ছাড়েন। অযথা ঝামেলা করবেন না। এমনিতেই নানান জ্বালা যন্ত্রণায় আছি। আর যন্ত্রণা করবেন না। যান, বাসায় যান।’
‘ঢাকায়তো আমার বাসা নাই।’
‘বাসা না থাকলে থাকেন। ফুটপাতে ঘুমান। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নাই। আপনি একা না, আপনার মতো আরো অসংখ্য মানুষই ফুটপাতে ঘুমায়। কিন্তু সেইটা শুধু রাতের বেলা। তখন ফুটপাত ফাঁকা থাকে। লোকজনের চলাচলতি নাই। ভিড় ভাট্টা নাই। কিন্তু চাচা মিয়া, খবরদার দিনের বেলা কিন্তু ফুটপাত আটকাই রাখবেন না।’
‘জি আচ্ছা।’
‘আর ওই সাইনবোর্ড টাইনবোর্ড যেন আর না দেখি।’
‘কিন্তু বাবা...।’
তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই তার সাথের গোঁফওয়ালা পুলিশটা বললো, ‘এমনিতেই নানান ঝামেলায় আছি বুড়া মিয়া। এর মধ্যে উটকো ঝামেলা কিন্তু ভালো লাগে না। এইসব আউল ফাউল নাটক-মাটক বাদ দিয়া, গাট্টি বোচকা গুছ কইরা সকালের মইধ্যে জায়গা ছাড়বেন। না হইলে কিন্তু পিটাইয়া পাছার ছাল লাল কইরা ফেলবো!’
আজিজ মাস্টার হতবুদ্ধের মতো তাকিয়ে রইলেন। তিনি তার কানকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তিনি চিন্তাও করতে পারছেন না পৃথিবীতে এই ভাষায় কখনো কেউ তার সাথে কথা বলতে পারে! তিনি ল্যাম্পপোস্টর হলুদ আলোয় জগতের সকল অবিশ্বাস চোখে নিয়ে পুলিশটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পুলিশ অফিসার অবশ্য এসব থোড়াই কেয়ার করলো। সে খক করে একদলা থুথু ফেললো। থুথুটা পড়লো আজিজ মাস্টারের বিছানার উপরে। আজিজ মাস্টার একবার থুথুর দিকে তাকালেন। একবার পুলিশের লোকটার দিকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি সত্যিই এই ঘটনা ঘটছে। ঘন জমাট থুথুর দিকে তাকিয়ে ঘেন্নায় তার প্রায় বমি পেয়ে যাচ্ছিলো। তিনি কোনো মতে নিজেকে সামলালেন। ফ্যালফ্যাল করে পুলিশ দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। তার মনে হলো তার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি আর কখনোই কথা বলতে পারবেন না। সেই সারারাত আর এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারলেন না আজিজ মাস্টার। কেবল ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে একটা ঘোরের মধ্যে রাত কাটিয়ে দিলেন।
পরদিন ভোরে অবশ্য পুলিশ দুজনকে আর কোথাও দেখতে পেলেন না তিনি। তবে আসাদ এলো আলো ফোটার সাথে সাথেই। সে খুব স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘আমার আইডিয়া কি আপনার পছন্দ হয়েছে?’
‘কোন আইডিয়া?’
‘গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়ার ঘোষণার আইডিয়া।’
‘কী যে বলেন আসাদ সাব! আমি কি সত্যি সত্যিই মরবো নাকি?’
‘সত্যি সত্যি মরবেন না?’
‘আমি ভীতু মানুষ। অতো সাহস আমার নাই।’
‘তাইলেতো আরো বিপদ।’
‘আরো কী বিপদ?’
‘আরো বিপদ হলো, ওইটার ঘোষণা না দিলে সত্যি সত্যিই মরবেন। আর ওইটার ঘোষণা দিলে সত্যি সত্যি মরবেন না। বরং ওইটাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।’
‘কী করকম?’
‘কী রকম? শোনেন, আপনি আগেভাগে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার ঘোষণা দিবেন। কোথায়, কখন আগুন দিবেন এইসবও ঘোষণায় জানাই দিবেন। এতে করে দেখবেন সেই জায়গায় ঠিক ঠিক টাইমে লোকজন জমে গেছে। বিরাট ভিড় ভাট্টা লেগে গেছে। তখন অতো মানুষের সামনে কি আর আপনি সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মরতে পারবেন?’
‘পারবো না?’
‘উহু, পারবেন না। সেটা সম্ভব না।’
‘কেনো?’
‘কারণ তার আগেই দেখবেন সবাই আপনাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। অতোগুলা মানুষের সামনে একটা মানুষ গায়ে আগুন দিয়ে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে আর কেউ তাকে রক্ষা করতে আসবে না। এমনতো আর হবে না, তাই না? কেউ না কেউ ঠিকই আপনাকে নিবৃত করবে। নিরস্ত করবে। কথা বোঝা গেছে?’
‘জি বোঝা গেছে।’
‘কিন্তু এই ঘটনায় একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে।’
‘কী ম্যাজিক?’
‘ধরেন ভাগ্য যদি সহায় হয়, তাহলে দেখবেন আপনার এই গায়ে আগুন ধরিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মরার প্রতিবাদের কথা শুনে মানুষ জনের কাছে আপনি হিরো হয়ে গেলেন। আর যদি সত্যি সত্যিই প্রেসক্লাবের সামনে কেরোসিন আর আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে যান, দেখবেন কেল্লা ফতে।’
‘কেল্লা ফতে কী?’
‘কেল্লা ফতে হলো দূর্গ জয় করা। কিন্তু এইখানে তার অন্য মানে। দেখবেন মানুষ আপনার এই প্রতিবাদ দেখে সবাই আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। আপনার দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করবে। এমনকি লোকজন আপনাকে কাঁধে করে মিছিল টিছিলও করে ফেলতে পারে। আপনার একার দাবি তখন শত সহস্র মানুষের সোচ্চার দাবিতে পরিণত হয়ে যেতে পারে!’
শেষের দিকে এসে আসাদের গলা ভারি হয়ে এলো। যেন কোনো বিশাল জনসমাবেশে সে বক্তৃতা করছে এমনভাবে কথা বলতে লাগলো সে। আজিজ মাস্টার অবশ্য তার কথা শুনলেন কী না বোঝা গেলো না। তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘একটা কাজ করবেন আসাদ সাব?’
‘কী কাজ?’
‘আপনি একটু বসবেন এইখানে? আমি একটু বাথরুম টাথরুম সেরে আসতাম?’
আসাদ হাসলো, ‘আমাকে বিশ্বাস করলেন তাহলে?’
আজিজ মাস্টার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘না করে আর উপায় কী?’
তিনি বাথরুম সেরে ফিরে এসে বললেন, ‘আমার আরেকটা উপকার করতে হবে।’
‘কী উপকার?’
‘আপনি একটু বসবেন, আমি একটু ঘুমাবো। সারারাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি আমার। শরীর খারাপ লাগছে। দেখা গেলো দাবি আদায়ের আগেই টুক করে মরে গেলাম।’
আসাদ বললো, ‘সেটা বরং ভালো স্যার।’
‘ভালো কীভাবে?’
‘এই দেশে বেঁচে থাকলে যাকে নিয়ে হই চই হয় না, মরে গেলে তার চেয়ে বেশি হই চই হয়। মোটামুটি লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যায়। সত্যি সত্যি মরে গেলে দেখবেন আপনার দাবি দাওয়া নিয়ে একটা হই চই লেগে গেছে। এখানে বাঁচার চেয়ে মরাই উত্তম। এই নিয়ে আমি এক কবিতা লিখেছি। কবিতার নাম দিয়েছি মরণোত্তম। মানে মরণই উত্তম। শুনবেন সেই কবিতা?’
‘নাহ। এখন কবিতা শোনার মতো অবস্থা আমার নাই। পরে শুনবো।’
আসাদ আরো কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু আজিজ মাস্টার তার কথা কিছুই শুনতে পেলেন না। বরং তার আগেই তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি স্বপ্নও দেখে ফেললেন। দেখলেন তার বাবা দবির খাঁ বলছেন, ‘তুই শেষ পর্যন্ত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলি?’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আত্মহত্যা কেন বলছেন আব্বা? এটা হলো প্রতিবাদ।’
‘কীসের প্রতিবাদ?’
‘দাবি আদায় না হওয়ার প্রতিবাদ। ন্যায় বিচার না পাওয়ার প্রতিবাদ।’
‘এখন কি ন্যায় বিচার পাবি?’
‘মনে হয় পাবো।’
‘কেন মনে হলো পাবি?’
‘আরে আপনি দেখেন নি? যখন অনশন করতে বসলাম ফুটপাতে, কেউ ফিরেও তাকালো না। কোনো গুরুত্বই দিলো না। বরং পুলিশ এসে পিটিয়ে উঠিয়ে দিলো। পত্রিকার সাংবাদিকতো দূরের কথা একটা পথচারীও এক মিনিটের জন্য আমার দাবি দাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলো না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন তামাশা দেখছিলো। আমি এই বয়সের বুড়ো একটা মানুষ, কীসের দাবিতে অনশন করছি, কী দাবি দাওয়া, কেউ কিচ্ছু জানতে পর্যন্ত চাইলো না! কিন্তু যেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে জ্যান্ত পুড়ে মারা গেলাম, অমনি দেখেন আমার লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল পর্যন্ত হয়ে গেলো।’
দবির খাঁ ধমকের গলায় বললেন, ‘আহাম্মক জানি কোথাকার! তুই আর মানুষ হলি না, অন্যের জন্য আজকাল কেউ আর নিজের জীবন দেয়? যার যার, তার তার। তোর এতো অন্যের জন্য দরদ কিসের?’
আজিজ মাস্টার কাঁচুমাচু গলায় বললেন, ‘অন্যের জন্য কী? এই স্কুল কি অন্যের?’

দবির খাঁ এবার আরো জোরে ধমক দিলেন, ‘আমি তোর বাপ, না তুই আমার বাপ? তুই এইখানে কেনো আসছিস আমি জানি না বুঝেছিস? তোর স্কুলতো একটা ছুঁতা, তুই আসছিস অন্য কারণে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো তোর স্বভাব। এইজন্যই এই জীবনে তোর কিছু হলো না। আরেকজনের জন্য তোর এতো দরদ কীসের, হ্যাঁ? আগে নিজেরটা ভাব। এই যে এখন গায়ে আগুন দিয়ে মারা গেলি, এখন তোর পরিবারের কী হবে? তাদের কে দেখবে? নিজের ভালো মন্দ আগে ভাবতে শেখ রে গর্দভ।’
আজিজ মাস্টার মিনমিন করে বললেন, ‘যার যার তার তার ভাবি বলেইতো আমরা এখন আর কেউ কারো না আব্বা। কারো বিপদে আপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াই না। অন্য কারো উপরে ঘটা কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করি না। ভাবি, আমি নিজেতো নিরাপদ আছি। আমার ঘর, আমার সন্তান, আমার পরিবার নিরাপদ আছে। আমি কেন অন্যের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যাবো? কিন্তু বাবা এতে করে অন্যায়কারী আরো সাহস পায়। একসময় সে আমার ঘরে, আমার পরিবারেও ঢুকে পড়ে। তখন আমার মতোই অন্যরাও চুপ করে থাকে। আমার জন্য প্রতিবাদ করতেও আর কেউ আসে না।’
দবির খাঁ হাসলেন, ‘তুইতো দেখি ছাত্র পড়াতে পড়াতে বাপের কাছেও মাস্টারি শুরু করছিস। এইসব লেকচার ছাড়। বাপের চেয়ে বেশি বুঝলে সমস্যা। এইটা খুব খারাপ অভ্যাস। খুব খারাপ।’
আজিজ মাস্টার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। তিনি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালেন। বিশাল রেইন্ট্রি গাছটার মাথার উপরে উঠে গেছে সূর্য। তার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে আসাদও। তিনি আসাদকে ডাকতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তার পিঠের কাছটায় তীব্র একটা ব্যথা। দীর্ঘ সময়ের গভীর ঘুমের কারণে তিনি এতোক্ষণ বুঝতে পারেন নি। তার সামনে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। রাতের সেই পুলিশ অফিসার সাগরও তাদের মধ্যে আছে। তার হাতে লাঠি। প্রথমবারের আঘাতটা ঘুমের কারণে তেমন টের না পেলেও দ্বিতীয়বারের আঘাতটা টের পেলেন আজিজ মাস্টার। সাগর তার তার কাঁধ বরাবার আঘাতটা করলো।

আজিজ মাস্টারের মনে হলো, তার কাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। একজন বৃদ্ধ স্কুল শিক্ষককে এভাবে কেউ কখনো আঘাত করতে পারে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি। রাজ্যের বিস্ময়, হতাশা, অপমান নিয়ে তিনি অসহায়ের মতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তবে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, তার কাঁধের ব্যথাটা আর তিনি টের পাচ্ছেন না। বুকের ভেতর কেবল কেমন একটা চিনচিনে তীব্র ব্যথা জেগে উঠছে। সেই ব্যথা ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ছে তার সারা শরীরজুড়ে। বুকের বাঁ পাশটা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।পুলিশ অফিসার এবার বিশ্রি ভাষায় গাল বকলো তাকে। তারপর কুৎসিত ভঙ্গিতে বললো, ‘অনশন মারাও না? অনশন? এরপর কী করবা? মিছিল, মিটিং, হরতাল? অ্যাঁ? ঘটনা কী, ঘটনা খুইলা ক...।’
আবারও অশ্রাব্য ভাষায় গাল বকলো পুলিশ অফিসার। আজিজ মাস্টার সবই শুনছেন, কিন্তু কিছুই বলতে পারছেন না তিনি। তার কেবল মনে হচ্ছে এসব কিছুই বাস্তবে ঘটছে না। তার অসুস্থ, ক্লান্ত মনের কল্পনা সবই। পুলিশ অফিসার আবারো খেঁকিয়ে উঠলো, ‘আসল উদ্দেশ্য কী তোর, বল? বল, বল। আসল ঘটনা বল।’
আজিজ মাস্টার বলার চেষ্টা করলেন ঘটনা কিছুই না। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। পুলিশ অফিসারই আবার বললো, ‘তোর বিষয়ে আমাদের কাছে খবর আছে’।’
‘খবর? কী খবর?’ আজিজ মাস্টার অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
‘তুই বিরোধীদলের লোক। তুই একটা বড় এজেন্ডা নিয়ে এইখানে আসছোস। তোর সেই এজেন্ডা কী বল?’
কী বলবেন আজিজ মাস্টার? তিনি হতবুদ্ধের মতো তাকিয়ে রইলেন। অন্য পুলিশটা বললো, ‘বিরোধীদল এই এলাকায় নাশকতার চেষ্টা করবে, তাই না? তুই তাদের পক্ষ হয়ে আগাম খোঁজ খবর নিতে আসছিস, তাইতো? নাকি তোর আলাদা কোনো উদ্দেশ্য আছে? কী উদ্দেশ্য তোর ক? এক্ষণ ক। নো হাংকি পাংকি।’
আজিজ মাস্টার পুলিশের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি একইভাবে তাকিয়ে আছেন। অন্য পুলিশ সদস্যটি জোরে লাথি বসালো তার পাশেই শুয়ে থাকা আসাদের কোমরে। আসাদ ধড়ফড় করে উঠে বসলো। সে কিছু বলার আগেই পুলিশটি বললো, ‘কাইল দেখলাম একজন, আজই দুইজন? এরপর কয়জন? তিন, চাইর, পাঁচ? তারপর দলবল নিয়া আসবি? ঘটনা কী? ঘটনা বল? উদ্দেশ্য কী তোদের? কোন দল করস? নাকি আবার জঙ্গী ফঙ্গি? এইসব ভং ধইরা শেষে আসল ঘটনা ঘটাইবি?’
ঘটনা বেশিদূর গড়ানোর আগেই আসাদ সামলে নিলো। পুলিশের হাতে পায়ে ধরে, চা নাস্তার জন্য পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে কোনোমতে আজিজ মাস্টারকে নিয়ে ভাগলো সে। কিন্তু আজিজ মাস্টার বিষয়টা নিতে পারলেন না। এই অপমান তিনি তার বাকি জীবনে আর কখনো ভুলতে পারবেন বলে মনে হয় না। মানসিকভাবে বড় ধরনের আঘাতে তার চিন্তা ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে গেছে। এতো বড় আঘাত তিনি আর কখনো পেয়েছেন বলে মনে হয় না।

আসাদ থাকে খুপরি মতন এক ঘরে। পুরনো এক বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার মতো এক ঘর, সেই ঘরে থাকে সে। আজিজ মাস্টারকে এনে সেখানেই ওঠালো সে। কিন্তু রাত থেকেই আজিজ মাস্টারের ভয়াবহ জ্বর শুরু হলো। সেই জ্বরে কিংবা দুপুরের ঘটনার প্রভাবে, যে কারণেই হোক, এলোমেলো প্রলাপ বকতে থাকলেন আজিজ মাস্টার। ঘুমের মধ্যেই ছটফট করতে থাকলেন সারা রাত। আসাদও ঘুমাতে পারলো না। রাত জেগে সে আজিজ মাস্টারের মাথায় পানি ঢাললো। জলপট্টি দিলো। আরো নানান সেবা শুশ্রুষা করলো। শেষ রাতে কাছের মসজিদ থেকে ফজরের আজানের শব্দ শোনা গেলো। খানিক তন্দ্রার মতো লেগে এসেছিলো আসাদের। আজানের শব্দে আচমকা তন্দ্রা ভেঙে জেগে উঠলো সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঘুমের ঘোরে বলা আজিজ মাস্টারের এলোমেলো কথাগুলো কানে এলো তার। যদিও সেই কথাগুলোর বেশিরভাগই অস্পষ্ট। জড়ানো গলায় হড়বড় করে একের পর এক কী সব বলে যেতে লাগলেন আজিজ মাস্টার। তার একটাও বুঝতে পারলো না আসাদ। একটা শব্দ থেকে আরেকটা শব্দ আলাদা করতে পারলো না সে। তবে আজিজ মাস্টারের বলা কথা থেকে একটা কথা সে স্পষ্টই বুঝতে পারলো। তিনি বারবার একটি নামই উচ্চারণ করছেন। সেই নামটা তার মাথায় গেঁথে গেলো। আজিজ মাস্টার পাগলের মতো বারবার বলতে লাগলেন, ‘কোহিনুর, ও কোহিনুর। কোহিনুর রে। ও কোহিনুর। মা রে...।’

আজিজ মাস্টার একনাগাড়ে কোহিনুর কোহিনুর বলে চিৎকার করছেন। আর ঘুমের মধ্যেই একনাগাড়ে কাঁদতে থাকলেন তিনি। সেই কান্না স্বাভাবিক কোনো মানুষের কান্না না। যে বোবা এক প্রাণীর জান্তব চিৎকার। সেই রাতেই ভোরের আলো ফোটার আগে আগে আসাদ হঠাৎ আবিষ্কার করলো, তার সন্দেহই ঠিক। আজিজ মাস্টার আসলে দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে ঢাকায় আসেন নি। তিনি এসেছেন অন্য দাবি নিয়ে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই দাবির কথা তিনি বলতে ভয় পাচ্ছেন। তবে ভেতরে ভেতরে বিষয়টা তাকে ক্রমাগত প্রচণ্ড আহত করে চলেছে। তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে না পেরে ভেতরে ভেতরে তীব্র অব্যক্ত যন্ত্রণায় তিনি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন।


আজিজ মাস্টারের জ্বর সারতে সময় লাগলো দিন তিনেক। এই তিনদিন তিনি পুরোটা সময় চুপ করে রইলেন। আসাদের শত সহস্র প্রশ্নের জবাবেও কোনো কথা বললেন না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কেবল। আর মাঝে মাঝে নিঃশব্দে কাঁদলেন। সেই কান্নার জল যেন তিনি কাউকে দেখাতে চাইলেন না। বুকের অব্যক্ত যন্ত্রণা, হতাশা আর অসহায়ত্বের মতো সেই কান্নাও আড়াল করে রাখতে চাইলেন।
পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো সময় লাগলো তার। এক বিকেলে তাকে নিয়ে খোলা হাওয়ায় হাঁটতে বের হলো আসাদ। সে চেষ্টা করছে আজিজ মাস্টারের সাথে নানান বিষয়ে কথা বলার। এতে যদি কোনোভাবে তার সাথে সহজ হওয়া যায়। তার ভেতরে লুকিয়ে রাখা একান্ত গোপন কিন্তু তীব্র যন্ত্রণাময় সেই ঘটনাটা জানা যায়। কিন্তু আজিজ মাস্টার কথা বলছেন খুব কম। সেদিনের ঘটনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে অনেকটাই গুটিয়ে গেছেন তিনি। এক প্রশ্ন দু’বার তিনবার করলেও উত্তর দেন না। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকেন কেবল।
আসাদ তার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করছে তাকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শেষে সরাসরিই কোহিনুরের প্রসঙ্গটা তুললো সে, ‘কোহিনুর কে স্যার?’
এই প্রশ্নে আজিজ মাস্টার যেন আচমকা চমকে গেলেন। তিনি ঝট করে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। তারপর তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। তবে কোনো কথা বললেন না। আসাদ প্রশ্নটা আবারো করলো, ‘কোহিনুর কে স্যার? কি হয়েছিলো তার?’
আজিজ মাস্টার যেন নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘কোন কোহিনুর?’
‘যেই কোহিনুরের জন্য আপনি ঢাকায় এসেছেন’।
‘আমি কেন কোহিনুরের জন্য ঢাকায় আসবো?’
‘সেটা আপনিই ভালো জানেন স্যার।’
‘নাহ, আমি কিছু জানি না।’
‘তাহলে আপনি ঢাকায় এসেছেন কেনো?’
‘কেনো আবার! আমি ঢাকায় আসছি আমার স্কুলের জন্য।’
আসাদ হাসলো, ‘আমার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই স্যার। এই তিনদিন আপনি জ্বরের ঘোরে ঘুমের মধ্যে অনেক এলোমেলো কথা বলেছেন। তাছাড়া আপনার ব্যাগের ভেতর একটা ব্যানারও আছে।’
‘ব্যানার?’
‘হু। হলুদ একটা ব্যানার। সেটার উপর কালো কালিতে বড় বড় অক্ষরে কিছু কথা লেখা। আপনি মূলত ওই ব্যানারটা টানিয়ে, ওই ব্যানারের দাবি আদায়ের জন্যই অনশন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোন কারণে সেটি করতে পারেন নি।’
আজিজ মাস্টার কথা বললেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। তিনি বুঝতে পারছেন যে ধরা পড়ে গেছেন। এখন আর বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। তারপরও তিনি নানাভাবে চেষ্টা করলেন বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার। নানান ব্যখ্যা দেয়ার। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হলো না। কিছুতেই সন্তুষ্ট হলো না আসাদ। বরং আজিজ মাস্টারের কাঁধে হাত রেখে সে নরম গলায় বললো, ‘আপনি আমাকে এখনো অবিশ্বাস করেন?’
আজিজ মাস্টার ম্লান কণ্ঠে বললেন, ‘অবিশ্বাস করবো কেনো?’
‘আমি স্যার মানুষের চেহারা দেখলেই অনেক কিছু বুঝতে পারি। প্রথম যেদিন আমি আপনার সাথে কথা বলতে গেলাম, আপনি খুব ভয় পাচ্ছিলেন আমাকে। কথা সত্য না?’
আজিজ মাস্টার জবাব দিলেন না। আসাদ বললেন, ‘এতে অবশ্য আপনার দোষও নেই। ওই পরিস্থিতিতে ওভাবে কেউ নিজ থেকে গিয়ে ওরকম ভাবভঙ্গি করলে যে কেউই ঘাবড়ে যাবে। আমি হলেও যেতাম। সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু স্যার, এখনতো আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। পারেন না?’
আজিজ মাস্টার কথা না বললেও আসাদের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। তার সেই চোখে আসাদের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতা। আসাদ বললো, ‘আমি জানি আপনি আমাকে এখন আর অবিশ্বাস করেন না। কিন্তু তারপরও একটা দ্বিধা কাজ করছে। আমি জোর করবো না আপনাকে। আপনার যদি নিজ থেকে মনে হয় যে কথাটা আপনি আমাকে বলতে চান। তাহলে বলতে পারেন। কোনো জোর নেই।’
আজিজ মাস্টার তবুও কথা বললেন না। আসাদ হঠাৎ আজিজ মাস্টারকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, ‘আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনি স্যার। আপনি খাঁটি মানুষ। ভেতরে ভেতরে একটা ভয়ংকর যন্ত্রণা আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। এই যন্ত্রণা থেকে আপনার মুক্তি দরকার। আর শুধু এ কারণেই ঘটনাটা আপনার কাউকে বলা দরকার। এমন না যে সেই ঘটনা আপনার কেবল আমার কাছেই বলতে হবে। আপনি যে কারো কাছেই বলতে পারেন। আমার কাছেই বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’

আজিজ মাস্টারের হঠাৎ কী হলো! তিনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আসাদ অবশ্য তাকে বাঁধা দিলো না। কাঁদতে দিলো। কাঁদার পরে নিজেকে সামনে নেয়ারও সময় দিলো। দীর্ঘসময় পর আজিজ মাস্টার ভেজা গলায় বললেন, ‘ওই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যইতো আমি এইভাবে ঢাকা শহরে আসছিলাম আসাদ সাব। গত কয়টা মাস আমি ঘুমাইতে পারি না, খাইতে পারি না। সারাক্ষণ মাথার ভেতর চিনচিন করে ব্যথা হয়। অসহ্য যন্ত্রণা। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায়তো আমার জানা নাই।’
আসাদ আলতো হাতে আজিজ মাস্টারের কম্পমান হাতখানা ধরলো। তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো, ‘কী হয়েছে আমাকে খুলে বলেন?’
আজিজ মাস্টার সাথে সাথেই কথা বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন। তারপর ধীরে সুস্থে বললেন, ‘বাসায় ফিরে রাতে বলি?’
আসাদ আজিজ মাস্টারের হাত ধরে দাঁড়া করালো। তারপর নরম গলায় বললো, ‘আচ্ছা।’


চিলেকোঠার ঘরটার বাইরে খোলা ছাদ। সেখানে ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পাশাপাশি দু’খানা চেয়ার পাতা। আকাশে অজস্র নক্ষত্র। সেই নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে বসে আজিজ মাস্টার কথা শুরু করলেন, ‘আমার আব্বা মারা গেছেন আজ প্রায় তিরিশ বছর।’
‘দবির উদ্দিন খাঁ?’
‘হুম। আব্বার খুব শখ ছিলো একটা স্কুল হবে ওই এলাকায়। কিন্তু কে করবে স্কুল? দোকান পাট, হাট বাজার, ক্লাব কাচারি করার সময় আছে সবার। কিন্তু একখান স্কুল করার সময় নেই কারো। টাকাও নেই। আমার আব্বা যে অনেক ধনী মানুষ ছিলেন এমন না। তবে পৈতৃক সূত্রে জমি জমা পেয়েছিলেন ভালোই। একদিন কী পাগলামী যে চাপলো তার মাথায়, হঠাৎ জমি জমা বিক্রি শুরু করলেন। বিঘার পর বিঘা’।
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী! সেই জমি বেচা টাকায় স্কুলের কাজ শুরু হলো। কিন্তু এদিক সেদিক থেকে নানান বাধা আসা শুরু করলো।’
‘বাধা কেন?’
‘মানুষের মনস্তত্ব বড় জটিল আসাদ সাব। তারা নিজেরা অন্যের জন্য কিছু করবে না। করবে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। কিন্তু কেউ যখন সমাজের জন্য কিছু করা শুরু করবে, সাথে সাথে সেইখানে দুরভিসন্ধি খোঁজার চেষ্টা করবে।’
‘এখানে দুরভিসন্ধির কী আছে? স্কুলের সাথে দুরভিসন্ধির কী সম্পর্ক?’
‘আছে না, অনেকে রাজনীতি করেন। তাদের বাপ দাদারাও রাজনীতি করতেন। সেই সূত্রে এলাকায় বিরাট প্রভাব। তারা হঠাৎ ভাবলো, আমার আব্বার কী কোনো রাজনৈতিক খায়েশ আছে নাকি! নিশ্চয়ই আছে। না হলে নিজের বাপ দাদার জমি বেচে কেনো সে স্কুল দিচ্ছে? স্কুলেতো আর ব্যবসা বাণিজ্য হবে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো উদ্দেশ্য তার আছে।’
‘ওহ।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো আসাদ। ‘তো তারা ঝামেলা করা শুরু করলো?’
‘হুম। কিন্তু তাতে অবশ্য আব্বা দমলেন না। তিনি কাজ শুরু করে দিলেন। তবে তার ভাগ্যটা খারাপ। কিছুই গুছিয়ে আনতে পারলেন না।’
‘কেনো?’
‘তার আগেই মারা গেলেন।’
আসাদ খানিক থমকে গেলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বাভাবিক মৃত্যু? না অন্য কোনো ঘটনা আছে?’
‘নাহ, স্বাভাবিক মৃত্যু। আব্বার মৃত্যুর পর অনেক কষ্টে আমি স্কুলটা শুরু করি। আব্বার নামেই নাম দেই স্কুলের, দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুল। আব্বার রেখে যাওয়া যত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিলো, তার সবই মনে করেন এই তিরিশ বছরে স্কুলের পেছনে খরচ করছি। কিন্তু স্কুল এমপিওভুক্ত করতে পারি নাই।’
‘কেন? এতো বছরেতো হয়ে যাওয়ার কথা!’
‘কারণ নুরুল মোল্লা।’
‘নুরুল মোল্লা কে?’
‘দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের সভাপতি। স্থানীয় চেয়ারম্যানও সে। রাজনীতিতে ভালো নাম ডাক। ভবিষ্যতে এমপি হওয়ার সম্ভাবনাও তার আছে।’
‘স্কুল এমপিওভুক্ত হলে তার সমস্যা কী?’
আজিজ মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সমস্যা তেমন কিছু না। আবার অনেক কিছুও।’
‘তার মানে কী?’
‘মানে হলো, উনি চান স্কুলের নামকরণটা ওনার নামে হোক। ওনার নামে হলেই উনি বাদ বাকি সব ব্যবস্থা করে দিবেন।’
‘কিন্তু আপনি রাজি হন নি। তাইতো?’
‘হুম। এতো কষ্ট করে এতো বছর, নিজের সব সহায়-সম্পত্তি শেষ করে স্কুলটা করলাম। আর এখন সেইটার নাম হবে অন্য একজনের নামে। বিষয়টা মেনে নিতে পারি নাই আমি।’
‘পারার কথাও না।’
‘এই নিয়েই সমস্যা। তো আমাকে রাজি করাতে না পেরে শুরু হলো তার নানামুখী ষড়যন্ত্র। সরাসরি কিছু না বললেও আড়ালে আবডালে থেকে প্রায় সব উপায়েই সে চেষ্টা করতে থাকলো যাতে কোনোভাবেই স্কুলটা সরকারি না হয়। আমিও অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। কারণ কোনো বড় নেতা, বা কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টারের সাথেও আমার পরিচয় নেই।’
আজিজ মাস্টার একটু থামলেন। আসাদ বললো, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী। একটা সময় এসে আমি তার প্রস্তাব মেনে নিলাম’।
‘মেনে নিলেন!’
‘হুম’। অসহায় গলায় বললেন আজিজ মাস্টার।
‘তাহলে আর কী? সমস্যাতো মিটেই গেলো।’
‘উহু। মিটলো না। আমি আসলে তখনো তাকে কিছু জানাইনি। তবে মনে মনে নিজেই নিজেকে বোঝালাম যে শুধু নামের কারণে স্কুলটা বন্ধ হয়ে যাবে? আমিতো আর একা একা চালাতে পারছিলাম না। তো স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেলে ওই এলাকার হাজার হাজার ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাবে। তারচেয়ে তার প্রস্তাবটা মেনে নেই। নামে আর কী এসে যায়! নামের চেয়ে এই ছেলে মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
‘তো প্রস্তাব শুনে উনি কী বললেন?’
‘উনাকে প্রস্তাবটা দেয়ার আগেই একটা ঘটনা ঘটে গেলো। তখনও আমি পুরোপুরি সিদ্ধান্তটা নিতে পারি নি। নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছিলাম। কিন্তু একটা ভয়াবহ ঘটনা সব ওলট পালট করে দিলো।’
‘ভয়াবহ ঘটনা?’
‘হুম’।
‘কী ঘটনা? কোহিনুর সংক্রান্ত?’
‘হুম’। বলে খানিক থমকালেন আজিজ মাস্টার। তারপর ধীর স্থির ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্কুলে ক্লাস টেনের এক ছাত্রী, নাম কোহিনুর। সে একদিন স্কুল লাইব্রেরিতে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।’
‘কেন?’
‘স্কুলের সামনের রাস্তায় কতগুলো বখাটে ছেলে মিলে রোজ তাকে উত্যক্ত করতো। শুধু যে তাকেই করতো, তাও না। অন্যদেরও করতো। কিন্তু অন্য মেয়েগুলো এসে কখনোই কোনো অভিযোগ করেনি। কিন্তু কোহিনুর যেদিন এসে ওভাবে কান্নাকাটি শুরু করলো, সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, ঘটনা নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু। ছোটখাট কোনো ঘটনা হলে সে ওভাবে আসতো না। সমস্যাটা হচ্ছে ওই ছেলেগুলোর মধ্যে চেয়ারম্যানের ছেলেও ছিলো। সেই ছেলের নাম রাকিব। তো আসল ঘটনা হলো ওই বখাটে ছেলেগুলোর নেতৃত্ব দিতো রাকিব। আর এ কারণেই কেউ তাদের কিছু বলার সাহস পেতো না। দলবল নিয়ে প্রায়ই স্কুলের নানান মেয়েদের উত্যক্ত করতো সে। কাউকেই ভয় পেতো না। যা হয় আর কী, চেয়ারম্যান বাবার অনেক ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি। বাধা দেয়ারও কেউ নেই। আবার পারিবার থেকেও কোনো শাসন-বারণ ছিলো না। ফলে দিন দিন খুব বেপরোয়া হয়ে উঠছিলো সে। তার বাবা নুরুল মোল্লার ভয়ে তাকে কেউ কিছু বলতেও সাহস পেতো না। স্কুলে আসার পথে সে প্রায়ই কোহিনুরকে বিরক্ত করতো। বিষয়টা দিন দিন বাড়ছিলো।’
‘আচ্ছা’।
‘কোহিনুরকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু করারও তেমন কিছু ছিলো না। ওই এক স্কুলের জন্য খাটতে খাটতেই মনে হয় সাহস, শক্তি, আত্মবিশ্বাস যা ছিলো সব হারিয়ে ফেলেছিলাম। বড় গলায় যে কাউকে কিছু বলবো, সেই অবস্থাও আর নেই। তারপরও সাহস করে নুরুল মোল্লার কাছে গেলাম। গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। ভেবেছিলাম বিষয়টা শুনে তিনি উদ্বিগ্ন হবেন।’
‘হননি?’
আজিজ মাস্টার ম্লান হাসলেন। তারপর অসহায় গলায় বললেন, ‘তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, এই বয়সের পোলাপান এমন একটু আধটু করেই। এইটা নিয়া এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নাই। কী মাস্টার সাব, বয়সকালে আপনে এমন কিছু করেন নাই?’
‘কী বলেন!’
‘হুম।’
‘শুনে আপনি কিছু বলেন নি?’
‘বলেছি। আমার হঠাৎ খুব রাগ লেগে গেলো। কিন্তু তারপরও রাগলাম না। যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, চেয়ারম্যান সাব, মেয়ে কিন্তু আমাদের সবার ঘরেই আছে। আপনার ঘরেও আছে, আমার ঘরেও আছে। এখন আমরা যদি এগুলোরে গুরুত্ব না দেই, তাহলে আমাদের মেয়েদের বেলায় কী অন্যরা গুরুত্ব দিবে?’
‘শুনে কী বললো সে?’
‘একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন। কারণ তার ঘরেও দুজন বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে। তাদের একজন তখন কেবল বাইরে থেকে ঘরে ফিরছিলো। তো চেয়ারম্যান সাব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন, এইটা একটা জ্ঞানী মানুষের মতো কথা বলেছেন মাস্টার সাব। ঘর শাসন না করলে আমি পর শাসন করবো কেমনে! মেয়েতো আমার ঘরেও আছে। আপনার ঘরেও আছে। মেয়ের বাপ হিসেবে সবার আগে নিজের ছেলেদের শাসন করাটা জরুরি। আজই আমি ছেলেকে ডেকে শাসিয়ে দিবো।’
আসাদ উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, ‘উনি এই কথা বললেন?’
‘হ্যাঁ। আর তার এই কথা শুনে আমি এতোটাই খুশি হয়েছিলাম যে খুব নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।’
‘তারপর? কাজ হয়েছিলো?’
আজিজ মাস্টার ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ‘উহু। ছেলেকে তিনি কী বলেছিলেন জানি না। কিন্তু এরপর থেকে রাকিব আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠলো। পরদিন বিকেলেই কোহিনুরের গায়ের ওড়না টেনে ছিঁড়ে ফেললো সে।’
‘কী বলছেন স্যার?’
‘হুম।’
‘শুধু তাই-ই না।’ আজিজ মাস্টারের গলা যেন ভারি হয়ে উঠলো। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন ‘রাস্তার মাঝখানে তাকে জাপটে ধরে চুমুও খেলো সে। তারপর সেই দৃশ্য আবার মোবাইল ফোনেও ভিডিও করে রাখলো তার সাঙ্গপাঙ্গরা।’
‘কেউ ছিলো না সেখানে? কেউ কিছু বললো না?’
‘উহু। নুরুল মোল্লা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করেন। কে কী বলবে?’
‘তাই বলে প্রকাশ্য রাস্তায়?’
‘হুম’। আজিজ মাস্টার করুণ ভঙ্গিতে হাসলেন, ‘এই ঘটনাতো আর এই দেশে নতুন কিছু না। অহরহ হয়, হচ্ছে। হচ্ছে না?’
আসাদ সাথে সাথেই জবাব দিলো না। সামান্য চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর বললো, ‘হ্যাঁ, হচ্ছে। পত্রিকা খুললেই এই খবর। টেলিভিশন ছাড়লেই এই খবর। যেন এর বাইরে আর কোনো খবর নেই।’  
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘সেটাই। এবং কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। কেনো যাচ্ছে না জানেন?’
‘জানি।’
‘কেনো?’
‘অনেক কারণই আছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের অপরাধের বিচার হয় না। হলেও নামে মাত্র বিচার হয়। অপরাধী নানা কারণে ছাড়া পেয়ে যায়। যেন অপরাধ করা মাত্রই অপরাধী শক্তিশালী হয়ে যায়। সে চলে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই বিচারহীনতাটাই অন্যতম প্রধান কারণ।’
আজিজ মাস্টার অবশ্য হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। তিনি বললেন কোহিনুরের গল্প, ‘এরপর থেকে কোহিনুরের জীবনটা সত্যিকার অর্থেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। রাকিবের সাঙ্গপাঙ্গরা সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া শুরু করলো। সাথে নানান কুপ্রস্তাবতো রয়েছেই। কোহিনুর যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি না হয়, তাহলে তারা সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দিবে। এক সন্ধ্যায় কোহিনুর তার মাকে নিয়ে আমার বাড়িতে এলো। তারপর হঠাৎ আমার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।’
আজিজ মাস্টারের গলাটা ভারি হয়ে এলো। তিনি খানিক থামলেও আসাদ কোনো কথা বললো না। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘কোহিনুরের কাছে সব কথা শুনে আমি মোটামুটি বোবা হয়ে রইলাম। এতোকিছু ঘটতে পারে, এটা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। কিন্তু কোহিনুরের কান্নাকাটি দেখেও আমি তাকে কিছুই বলতে পারলাম না। কী বলবো? আমারতো কিছু করার ক্ষমতা নেই। একটা অক্ষম অসহায় মানুষ আমি। সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু তারপরও সারাটা রাত আমি ঘুমাতে পারলাম না। নিজেকে খুব অথর্ব আর মেরুদণ্ডহীন মনে হতে লাগলো। পরদিন খুব ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই চেয়ারম্যান বাড়িতে গেলাম। গিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে সব খুলে বললাম। শুনে তিনি আর আগের মতো হেসে উড়িয়ে দিলেন না। এবার যারপরনাই চিন্তিত হলেন। রেগেও গেলেন সাথে সাথে। তারপর বললেন, এরকম হইলেতো ঝামেলা মাস্টার সাব। এটাতো হতে দেয়া যায় না। চেয়ারম্যানের কথা শুনেও আমি কিছু বললাম না। বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম, উনি কতটা মন থেকে কথাগুলো বলছেন। কারণ এর আগেরবারও উনি কথা দিয়েছিলেন। তো চেয়ারম্যান সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজ থেকেই আগের ঘটনার কথা তুললেন। বললেন, আগের ঘটনা পর্যন্ত তাও মেনে নেয়া যেতো। এই বয়সের পোলাপান, একটু এদিক সেদিক করেই। কিন্তু তাই বলে এমন জঘন্য ঘটনা? আমি এই এলাকার চার বারের চেয়ারম্যান। আমার বংশের একটা মান মর্যাদা আছে। আর সেই আমার এলাকায়, আমার এলাকার মেয়েছেলেরা রাস্তাঘাটে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে! আমার জন্য এর চেয়ে আর লজ্জার কী হইতে পারে! আমার একটা মান সম্মান আছে। মোল্লা বাড়িরও আছে। সেই বাড়ির সন্তান হয়ে আমার ছেলে...! চেয়ারম্যান সাহেব নিজে খুবই আপসেট হয়ে গেলেন। যেন ভেঙে পড়লেন একভাবে। বিষয়টা দেখে তার জন্য আমার একভাবে খারাপও লাগতে শুরু করলো। আবার ভালোও লাগতো এটা ভেবে যে লোকটাকে যতটা খারাপ মনে করেছি, ততটা খারাপ সে নয়। বরং ভেতরে ভেতরে একটা ভালো মনও তার আছে। এবার নিশ্চয়ই তিনি কিছু একটা করবেন। আমি আর কিছু বললাম না। বরং তাকে ওইরকম ভেঙে পড়তে দেখে আমি নিজেই তাকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।’
‘তারপর? কী করলো সে?’
‘বললো, এইবার এর একটা বিহিত সে করবেই। তার ছেলে কেন, গ্রামে কেউ আর কোনোদিন এইরকম কিছু করবে না। নিজের ছেলেকে শাস্তি দিয়ে তিনি অন্য সবাইকে শিক্ষা দিবেন।’
‘বাহ! তাহলেতো লোক সে খারাপ না।’
‘হুম। ভালো লোক। এর এক সপ্তাহর মাথায় আত্মহত্যা করলো কোহিনুর।’
‘কী!’ রীতিমতো ধাক্কা খেলো আসাদ, ‘কী বলছেন স্যার? কী হয়েছিলো?’  
আজিজ মাস্টার শান্ত গলায় বললেন, ‘যেদিন রাতে সে আত্মহত্যা করে, সেদিন সন্ধ্যার পরপর সে আমার বাড়িও এসেছিলো।’
‘কেন?’
‘তখনও আমি জানতাম না কেন। কারণ, আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম না। স্কুলের বিষয়ে জরুরি এক কাজে থানা শহরে ছিলাম সেদিন। সন্ধ্যার দিকে আমার মেজো মেয়ে রুমুর কাছে একটা বই দিয়ে গিয়েছিলো কোহিনুর। বলেছিলো, আমি ফিরলে যেন বইটা আমাকে দেয়।’
‘কী ছিলো সেই বইতে?’
‘সেটাতো পরদিন আর জানা যায় নাই। কারণ পরদিন ভোরেই কোহিনুরের লাশ পাওয়া যায় তার ঘরে। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝোলানো লাশ। পুরো গ্রামে একটা হুলস্থুল পড়ে গেলো। তার লাশ, থানা, পুলিশ এই সব নিয়েই সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। সেই বইয়ের কথা আর মনেই রইলো না কারো। খবর শোনার পর থেকে আমার অবস্থা পাগলপ্রায়। জানিনা কেন, আমার মনের মধ্যে একটা সন্দেহ খচখচ করতে লাগলো। আমি তার পরদিন থেকে চেষ্টা করলাম কোহিনুরের বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো তারা কেউই আমার সাথে কথা বলতে চাইলো না। কথাতো দূরের কথা, দেখাই করতে চাইলো না আমার সাথে। যেন কোহিনুরের এই আত্মহত্যার পেছনে আমিই দায়ী।’
‘কী বলেন!’
‘হুম’।
‘কিন্তু তারা কেনো আপনার সাথে দেখা করতে চাইলো না?’
‘জানি না কেন! তবে পরদিন আমি বিষয়টা নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই চেয়ারম্যান সাহেব একদম কেঁদে ফেললেন। হাউমাউ করে কান্না। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, এই বয়সের একটা মেয়ে, কী এমন দুঃখে এইভাবে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেলো মাস্টার সাব? আপনারা স্কুলে বাচ্চা কাচ্চাদের পড়ান। এতো এতো হোমওয়ার্ক দেন। পরীক্ষা নেন। কে কত নম্বর পায় পরীক্ষায়, সেইটা দেখেন। কিন্তু তাদের কার মনে কী চলতেছে, সেইটা দেখেন না। এমন হইলে হবে বলেন? খালি ক্লাসের বই পড়ালেইতো হবে না। সাথে তাদের মানসিক অবস্থাটাও দেখতে হবে। কে কী ভাবছে, কে কী করছে, এইগুলা খেয়াল না রাখলে হবে? হবে না। তাছাড়া শিক্ষকতো শুধু শিক্ষকই না, সে ছাত্র-ছাত্রীর গার্ডিয়ানও। গার্ডিয়ান না?’
‘আপনি কী বললেন?’ আসাদ জিজ্ঞেস করলো।
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আমি কোহিনুরের আর রাকিবের প্রসঙ্গটা তুললাম। আর সাথে সাথেই তিনি ক্ষেপে গেলেন। সেই প্রথম আমি নুরুল মোল্লার আসল চেহারাটা দেখলাম। তিনি প্রায় সরাসরিই হুমকিটা দিলেন আমাকে। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এই ঘটনায় রাকিবের বিষয়ে যেন আর কোনো কথা আমি না বলি। তিনি এ নিয়ে একটা শব্দও শুনতে চান না। কোনো উচ্চবাচ্যও না। এমনিতেই নাকি পুলিশ বিষয়টি নিয়ে নানান সন্দেহ করছে। নানাভাবে খোঁজ খবরও নেয়ার চেষ্টা করছে। এখন কোহিনুরের সাথে রাকিবের ঘটনাটা পুলিশের কানে গেলে বিপদ। তিনি চান না, এ বিষয়ে পুলিশ কিছু জানুক।’
‘আপনি কী করলেন তারপর?’
‘আমি আর কী করবো?’ অসহায় ভঙ্গিতে বললেন আজিজ মাস্টার, ‘আমিতো ওই একটা কাজই পারি। মন খারাপ করা। উল্টাপাল্টা কিছু ঘটলেই রাতের পর রাত ঘুম হয় না আমার। কিছু খেতে পারি না। গলার কাছটায় কী যেন দলা পাকিয়ে আটকে থাকে। এবারও তেমন হতে শুরু করলো। চোখ বন্ধ করলেই কোহিনুরের কান্না জড়ানো অসহায় মুখটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আর মনে হয়, ওইটুক একটা মেয়ে কোন সাহসে, কতটা কষ্টে এইভাবে নিজেরে নিজে শেষ করে ফেললো? আমিতো পারি না। অত সাহসতো আমার নাই।’
‘ওটা সাহস না, দুঃসাহস। মানুষ দুই কারণে দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। ভয়ে আর শক্তিতে। সে ভয়ে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিলো।’
‘হুম। আমিও এটা ভেবেছি। কতটুক ভয় পেলে, লজ্জায়, অপমানে ওইটুক বাচ্চা একটা মেয়ে নিজের জীবনটা এইভাবে শেষ করে দিতে পারে? এই এতোবছরের জীবনেওতো আমি কোনোদিন কোনো সাহসে বা ভয়ে আত্মহত্যা করার কথা ভাবতে পারি নাই! এই বৃদ্ধ বয়সেও এখনো বাঁচতে ইচ্ছে করে। মৃত্যুকে ভয় লাগে। অথচ ওইটুকু একটা মেয়ে! আহারে, আহারে!’
আজিজ মাস্টারের গলা যেন ধরে এলো। তিনি সেই ধরে আসা গলায়ই বললেন, ‘পরদিন ভোরে উঠে আমি স্থানীয় থানায় গেলাম। থানার ওসি সাহেবকে আমি কোহিনুরের সাথে ঘটা ঘটনার কথা খুলে বললাম। রাকিবের কথাও বললাম। আমি ভেবেছিলাম সব শুনে ওসি সাহেব খুশি হবেন। নতুন করে ইনভেস্টিগেশন করতে চাইবেন। কিন্তু আমার কথা শুনে তিনি হাসলেন। বললেন, মাস্টার সাব, আপনি মান্যগণ্য লোক। এমন কিছু করবেন না, যাতে আপনার মান সম্মান না থাকে।’
‘মানে? আপনার মান সম্মানের কী আছে এখানে?’ আসাদ একটু অবাকই হলো।
আজিজ মাস্টার অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘ওসি সাহেব সব শুনে আমাকে বললেন, এই এলাকায় নুরুল মোল্লা সাব মান্যগণ্য লোক না? আমি বললাম, হ্যাঁ। উনি বললেন, আপনিওতো গণ্যমান্য লোক, তাই না? আমি কোনো কথা বললাম না। ওনার উদ্দেশ্য বুঝতে চাইলাম। তখন উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, এখন তার ছেলের বিরুদ্ধে যদি এই সময়ে আপনি এমন একটা অভিযোগ করেন, তাহলে কি বিষয়টা ভালো দেখায়? দেখায় না। বিষয়টা নুরুল মোল্লা সাবের জন্য একদিকে যেমন বিপদের, তেমনি আরেকদিকে মান সম্মানেরও। তাই না? এখন আপনারা যারা সমাজে মান্যগণ্য লোক আছেন, তাদের একজনের উচিত আরেকজনের মান সম্মান রক্ষা করা। আর আপনারাই যদি একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকেন, তাহলে আমরা কী করবো বলেন?’
‘আচ্ছা, এই হলো ঘটনা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো আসাদ। ‘তারপর আপনি কী করলেন?’
‘আমি তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাভ হলো না। বরং শেষের দিকে যেন খানিক উগ্রই হয়ে উঠলেন ওসি সাহেব। আমাকে একভাবে ধমকের গলায়ই বললেন, আজ যানতো স্যার। বহুত কাজ জমে আছে হাতে। আপনাদের মতো ক্লাসে ঘুমাই ঘুমাই আরামের জীবন পার করলেতো আমাদের চলে না। আমাদের দিন রাত জেগে চোর ডাকাত ধরে আপনাদের আরামের ঘুমের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। আমি তারপরও বললাম, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন ওসি সাব। আপনি চাইলে আমি দুয়েকজন সাক্ষিপ্রমাণও হাজির করতে পারবো। সে যে শুধু কোহিনুরের একার জীবনটাই অতিষ্ঠ করে দিয়েছে ব্যাপারটা এমন না। আরো অনেক মেয়ের সাথেই সে রেগুলার এমন করতো। কিন্তু তারা কেউ সাহস করেনি অভিযোগ করার। কেবল কোহিনুরই করেছিলো। আর আমার ধারণা, সেটার কারণেই আজ তার এই পরিণতি। নুরুল মোল্লার ছেলেটার কারণেই মেয়েটার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিলো। আর এখানে নিশ্চয়ই এমন কিছু ঘটেছে যেটা আমরা পুরোপুরি জানি না। যে কারণে মেয়েটা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। আপনি একটু সিরিয়াসলি বিষয়টা দেখেন। আমি প্রয়োজনে সাক্ষির ব্যবস্থা করবো। এবার ক্ষেপে গেলেন ওসি সাহেব। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, সাক্ষি সাবুদ জোগাড় করা তেমন কঠিন কোনো কাজ না। দুই চারটা পয়সা ছিটালেই সাক্ষির অভাব হয় না। কঠিন হলো অকাট্য তথ্য প্রমাণ জোগাড় করা। আছে আপনার কাছে কোনো তথ্য প্রমাণ? আজকাল অডিও ভিডিওর যুগ। ছবির যুগ। আছে এগুলা কিছু? থাকলে নিয়াসেন। তখন আমি দেখবো। এখন যান। বিরক্ত কইরেন না প্লিজ।’
আজিজ মাস্টার একটু থেমে আবার বললেন, ‘আমি তারপরও কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ দিলেন না। একপ্রকার জোর করে থানা থেকে আমাকে বেরই করে দিলেন। প্রচণ্ড মন খারাপ হলো। ভেঙেও পড়লাম। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। কী করা যায়, কী করা যায়, এই ভাবনা চলতে লাগলো দিনরাত। আশেপাশে কারো কাছে যে বলবো, বুদ্ধি পরামর্শ নিবো, সেই সাহসও হচ্ছিলো না। কোন ঘটনাকে কে কীভাবে নেয়, কে জানে! তবে অনেক ভেবেচিন্তে শেষে একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। যদি সাংবাদিকদের ঘটনাটা জানানো যায়, তাহলে কিছু না কিছু একটা হতেও পারে। তখন পুলিশও ঘটনা এড়াতে পারবে না। বাধ্য হয়েই সুষ্ঠ তদন্ত করতে হবে। এই ভাবনায় বড় আশা নিয়েই গেলাম থানা শহরের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে। আমার বিশ্বাস ছিলো, এখানে কিছু না কিছু হবেই। কারণ রোজ রোজ দেশের আনাচে কানাচে এই ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলছে। তাদের বললাম ঘটনা, কিন্তু কিছুই হলো না। তারা বরং আমাকেই উল্টাপাল্টা কথা শোনানো শুরু করলো। তাদের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। সাংবাদিকদের কেউ কেউ উল্টো আমার দিকেই আঙুল তুললো। বললো, স্কুলের নামকরণ নিয়ে নুরুল মোল্লার সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরেই নাকি আমি কোহিনুরের ঘটনায় নুরুল মোল্লার ছেলেকে জড়াতে চাইছি! এটা নাকি আমার ষড়যন্ত্র। এমন আরো নানান কথা। কোনো সহযোগিতাতো তারা করলেনই না, উল্টো আমাকেই দোষারোপ করা শুরু করলেন। বিশ্বাস করবেন কী না জানি না, আমার মনটাই ভেঙে গেলো। প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে সেই রাতে বাড়ি ফিরলাম আমি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এতো অসহায় লাগছিলো! পুলিশ না হয় অমন করেছে কিন্তু সাংবাদিকদের কাছ থেকে অন্তত এমন আচরণ আশা করি নাই আমি।’
হাত বাড়িয়ে আজিজ মাস্টারের একটা হাত চেপে ধরলো আসাদ। আজিজ মাস্টার কাঁপছেন। তার চোখে অশ্রু কী না অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না।
আজিজ মাস্টার ভেজা গলায় বললেন, ‘তবে ঘটনা পরিষ্কার হলো তার পরদিন। আমাদের স্কুলের দপ্তরি জয়নালের কাছে শুনলাম, কোহিনুরের ঘটনার দিন কয়েক পরেই নাকি নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের দাওয়াত দিয়ে ভুঁড়িভোজ করিয়েছেন নুরুল মোল্লা। সাথে হাত খরচতো ছিলোই। যাতে কোহিনুরের ঘটনা নিয়ে এদিক সেদিক কিছু না লেখে তারা। শুধু তা-ই না, কোহিনুরের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়েই সাংবাদিকদের কাছে তিনি তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। আবেগঘন বিবৃতি দিয়েছেন। কোহিনুরের পরিবারের প্রতি গভীর শোক, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। জ্ঞানগর্ভ বাণীও দিয়েছেন। বলেছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র ছাত্রীদের মানসিক ভাবনা বিকাশে শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। আরো যত্নবান হতে হবে। কারণ এই বয়সের ছেলেমেয়োর অনেক সংবেদনশীল হয়, অভিমানী হয়। সুতরাং কথায় কথায় তাদের শারীরিক বা মানসিক আঘাত করা যাবে না। তাদেরও মানসিক অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। বোঝাতে চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষকদেরও স্কুলে আরো সাপোর্টিভ ভূমিকা রাখতে হবে। এমন নানান বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও করেছেন তিনি। পরদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার ছবিসহ সেসব ফলাও করে ছাপাও হয়েছিলো।’
‘বাহ!’ অস্ফুটে আসাদের মুখ থেকে যেন আপনা আপনিই ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে শব্দটা বের হয়ে গেলো।

‘এই ঘটনায় পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম আমি। মনে হলো পৃথিবীতে আমার মতো অথর্ব, অসহায়, অক্ষম মানুষ বুঝি আর নেই। চোখের সামনে এসব ঘটছে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কিন্তু কী করা যায়? আমি সহসা হাল ছেড়ে দেয়া মানুষ না। অন্য কোনো উপায় খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই মাথায় আসলো না। একটা তীব্র দ্বিধা, সংশয় কাজ করতে লাগলো নিজের মধ্যে। মনে হতে লাগলো যেখানেই যাবো, কেউ না কেউ উল্টো আমাকেই ভয় দেখাবে। হঠাৎ করেই মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এলো। আমাদের এলাকায় তরুণদের একটা সমাজকল্যাণমূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। ক্লাবের মতো। সেই সংগঠন বিভিন্ন সময়ে এলাকার নানা অনিয়ম, অপরাধের প্রতিবাদ করে। ফিলিস্তিনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের হামলার প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং, মানব বন্ধনও করেছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ভূমিকা রেখেছিলো তারা। এগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিলো। কোনো উপায় না দেখে শেষ পর্যন্ত আমি তাদের কাছেও গেলাম। মনে হয়েছিলো, তারা নিশ্চয়ই এমন একটা ঘটনায় রুখে দাঁড়বে। প্রতিবাদ করবে। যেহেতু এই সময়ের তরুণ তারা।’ বলে থামলেন আজিজ মাস্টার। যেন একসাথে এতো কথা বলে হাঁপিয়ে গেছেন তিনি।
কিন্তু আসাদের আর তর সইছিলো না। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, ‘তারপর? কী করলো তারা?’
‘কিছুই করলো না।’
‘মানে?’
‘মানে এরা সরাসরি জানিয়ে দিলো এই বিষয়ে যেন কোথাও আর কোনো কথা না বলি আমি!’
‘মানে?’ খুবই অবাক হলো আসাদ।
আজিজ মাস্টার অন্ধকারেই ম্লান হাসলেন। তার সেই হাসি কান্নার চেয়েও করুণ। তিনি বললেন, ‘মানে ওই ক্লাবটিও রাজনৈতিক। পেছন থেকে নুরুল মোল্লাই ওটার ব্যাকআপ দিচ্ছেন। আসলে আজকাল বোধহয় আর লাভ লোকসানের হিসেব নিকেশ ছাড়া কেউ কিছু করে না। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ও ঠিক হয় লাভ লোকসানের হিসেবের উপর ভিত্তি করে। বাইরে বাইরে ওই ক্লাবটাকে অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন বলা হলেও আসলে ভেতরের ঘটনা অন্য। নুরুল মোল্লা নিজে এই ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। প্রতিবছর ঈদ-কুরবানি, পূজা-পার্বণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এলাকার তরুণরা খুব আয়োজন করে পালন করে। আর এসব আয়োজন করতে এই ক্লাবে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দেয় নুরুল মোল্লা। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এলাকার ছেলেপুলেরা নুরুল মোল্লার বিরুদ্ধে কখনোই কোনো কথা বলবে না। তা উনি যা-ই করুন না কেন! উপরন্তু নুরুল মোল্লার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে বা করলে তারা সবাই মিলে সেটা ঠেকাবে।’
আজিজ মাস্টার থামলেন। আসাদও চুপ। কেবল অন্ধকারে দূর থেকে ভেসে আসছে গাড়ির হর্নের শব্দ। রিকশার টুং টাং ধ্বনি। তারা দুজন চুপচাপ সেই শব্দ শুনতে লাগলো। যেন আর কিছু বলার নেই কারোই। যেন তারা জানে, সবখানে এই একই চিত্র। এই একই গল্প। এই গল্পের বাইরে আর কোনো গল্প নেই। অনেক্ষণ পর আসাদ বললো, ‘তারপর কী করলেন আপনি?’
আজিজ মাস্টার কাঁপা গলায় বললেন, ‘কী আর করবো? কী করার আছে আমার? পুরোপুরি ভেঙে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম কিছুই করতে পারবো না। মনে মনে নিজের অসহায়ত্ব মেনে নিলাম। কিন্তু মনটাকে মানাতে পারলাম না। মাথা থেকে কিছুতেই বিষয়টা তাড়াতে পারিনা। সারাক্ষণ নানান দুশ্চিন্তা। রাতভর ঘুমাতে পারি না। খানিক তন্দ্রার মতো হলেও পরক্ষণেই ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। কতভাবে যে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। নিজেকেই নিজের অসহ্য লাগতে থাকে। এমন সময় একদিন আমার মেজো মেয়ে রুমু হঠাৎ কোহিনুরের দেয়া সেই বাংলা বইখানা আমাকে দিয়ে গেলো। এতোদিন বইখানার কথা সে ভুলেই গিয়েছিলো। এই ঘটনা এতোদিন পর আমাকে জানানোর কারণে রুমুকে আমি গালমন্দও কম করলাম না। রাগও হলো ওর ওপর খুব। কিন্তু আমার সকল রাগ, হতাশা, ক্রোধ, ক্ষোভ সকলই উড়ে গেলো বইটা খোলার পর।। মনে হলো আমার কোনো অনুভূতি নেই। শরীরে যেন সাড় নেই। মৃত একটা লাশ যেন আমি। অথচ সব কিছুই দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু করতে পারছি না।’
‘কী ছিলো সেই বইয়ের ভেতর?’ শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো আসাদ।
‘একটা চিঠি।’
‘চিঠি?’
‘হুম। কোহিনুরের নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি। মাত্র তিন লাইনের চিঠিটা লিখেছিলো সে। তারপর আত্মহত্যা করার আগে দিয়ে গিয়েছিলো আমাকে। কিন্তু সেই চিঠি আমি দেখলাম অতদিন পর।’
‘কী লেখা ছিলো চিঠিতে?’
সাথে সাথেই জবাব দিলেন না আজিজ মাস্টার। দীর্ঘসময় চুপ করে রইলেন। তারপর অকস্মাৎ মুখ তুলে তাকালেন আকাশের দিকে। তারপর চোখ বন্ধ করে স্থির, নিস্তব্ধ বসে রইলেন। যেন বয়ে যাচ্ছে অনন্ত সময়। তারপর বললেন, ‘তাকে ধর্ষণ করেছে নুরুল মোল্লা!’
‘নুরুল মোল্লা! মানে চেয়ারম্যান নিজে! কী বলছেন আপনি?’ আসাদ যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না।
‘হুম’। শান্ত গলায় বললেন আজিজ মাস্টার। খানিক থেমে তারপর আবার বললেন, সে লিখেছে ‘স্যার, আপনে আমারে কার কাছে বিচারের জন্য পাঠাইলেন স্যার? সে তো মানুষ না, সেতো তার ছেলের চাইতেও খারাপ। আস্ত জানোয়ার। সে একটা বুড়া শয়তান, একটা পশু। এই রকম অমানুষের পৃথিবীতে এই নোংরা জীবন নিয়া আমি আর বাঁচতে চাইনা স্যার...।’
আজিজ মাস্টার থামলেন। আসাদ কোনো কথা বললো না। আজিজ মাস্টার কাঁদছেন। নিঃশব্দ কান্নার তীব্রতায় তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আসাদ দুহাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো। দীর্ঘসময়। তারপর নিজেকে সামলে নিলেন আজিজ মাস্টার। তারপর ভেজা গলায় বললেন, ‘চিঠিখানা হাতে পেয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কতক্ষণ বসেছিলাম আমি জানিন না। তবে পুরো ঘটনার জন্য তখন আমার নিজেকেই অপরাধী লাগতে লাগলো। মনে হলো কোহিনুরকে আমি নিজে খুন করেছি। তার এই মৃত্যুর জন্য আর কেউ না, আমি নিজে দায়ী। কারণ, নুরুল মোল্লার কাছে আমিই তাকে যেতে বলেছিলাম।’
‘কেন?’
‘কারণ, রাকিবের বিরুদ্ধে নুরুল মোল্লার কাছে দ্বিতীয়বার বিচার দেয়ার পর তিনি নিজে আমাকে বলেছিলেন কোহিনুরের কাছ থেকে সরাসরি সব ঘটনা শুনতে চান তিনি। এমনকি রাকিবকে কোহিনুরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মাফ চাওয়ানোর কথাও বলেছিলেন তিনি। আমাকে এটাও নিশ্চিত করেছিলেন যে বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথেই দেখবে সে। কারণ এর সাথে তার মান সম্মান জড়িত। তার কথা শুনে আমারও কেন যেন বিশ্বাস হয়েছিলো। আমি তাই কোহিনুরের মাকে বলেছিলাম, কোহিনুরকে তার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু এরপর কী হয়েছিলো সেই খবর আর নেওয়া হয় নি আমার। স্কুলের একটা কাজ নিয়ে কয়েকটা দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম তখন। বাড়িতে ছিলাম না টানা কয়েকদিন। থানা শহরে থাকতে হয়েছিলো।’
‘কিন্তু চিঠিতেতো ধর্ষণের ঘটনা কিছু স্পষ্ট লেখা ছিলো না।’
‘তা ছিলো না। এমনকি ওরকম জঘন্য, নোংরা কথা চিন্তা করতে আমার মনও সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু কোহিনুরের চিঠিতে ঘটনা স্পষ্ট। নুরুল মোল্লার সাথে দেখা হওয়ার পর এমন জঘন্য কিছুই ঘটেছিলো, যার কারণেই সে আত্মহত্যা করেছিলো।’
‘কিন্তু ওই চিঠি দিয়ে কী আপনি তা প্রমাণ করতে পারবেন?’
‘নাহ, পারবো না। যেখানে থানা পুলিশই নুরুল মোল্লার পক্ষে, সেখানে ওই চিঠির চেয়ে শক্ত প্রমাণ থাকলেও কিছু প্রমাণ করা যেতো না...।’
‘একটা কথা।’ আসাদ মাঝপথে থামালো আজিজ মাস্টারকে।
‘লাশের ময়নাতদন্ত করা হয় নি? সেখানে ধর্ষণের কোনো আলামত?’
‘কিছুই হয় নি। কোনো ময়না তদন্ত টতন্দ কিচ্ছুনা। প্রথমে একটু উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলো পরিস্থিতি। কিন্তু তারপর পুলিশ স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবেই লাশ দাফন করেছে। বুঝতেই পারছেন, সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং যা করার সে নিজের ইচ্ছেমতোই করেছে।’
‘ওহ’। যেন দমে গেলো আসাদ, ‘তারপর কী হলো?’
‘কোহিনুরের চিঠিটা পড়ার পর থেকে আমার মাথা খারাপের মতো অবস্থা হয়ে গেলো। পরের কয়েকটা দিন পাগলের মতো এখানে সেখানে ছুটলাম আমি। জানতাম, শুধু এই চিঠি দিয়ে নুরুল মোল্লার বিরুদ্ধে শক্ত কোনো তথ্য প্রমাণ হাজির করতে পারবো না। চিঠিতে কারো নাম নেই, পরিচয় নেই, ঘটনার বিবরণ নেই। আর স্থানীয় প্রশাসনতো এমনিতেই নুরুল মোল্লার পক্ষে। তারপরও অনেক কষ্টে কোহিনুরের বাবা মার সাথে দেখা করলাম। তাদের সাথে কথা বললাম। বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এই ঘটনার একটা বিহিত হওয়া দরকার। কিংবা আসল ঘটনা কী ঘটেছিলো, তারা যেন আমাকে খুলে বলেন। কিন্তু তারা আমাকে কিছুই বলতে চাইলেন না। কোনো সহযোগিতাও করতে চাইলেন না। তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। কারণ, আরো দুটো মেয়ে রয়েছে তাদের। ফলে ভয়ে কোনোভাবেই মুখ খুলতে চাইছিলেন না তারা।’
‘তারাতো আসল ঘটনা জানতো?’
‘হুম, জানতো। আর জানতো বলেই ভয় পাচ্ছিলো তারা। তবে অনেক কষ্টে কোহিনুরের মাকে কিছুটা হলেও বোঝাতে পারলাম আমি। দিন কয়েকের টানা চেষ্টায় অবশেষে তিনি আমার কাছে মুখ খুললেন। ভয়ে ভয়ে কোহিনুরের সাথে ঘটা আসল ঘটনা আমাকে খুলে বললেন।’
‘কী ঘটনা?’
‘কোহিনুরের মাকে যেদিন আমি কোহিনুরকে নিয়ে নুরুল মোল্লার কাছে যেতে বলেছিলাম, সেদিনই তিনি কোহিনুর আর কোহিনুরের বাবাকে নিয়ে নুরুল মোল্লার কাছে গিয়েছিলেন। নুরুল মোল্লা তাদের সাথে অসম্ভব ভালো ব্যবহারও করেছিলেন সেদিন। এমনকি কোহিনুরের পড়াশোনার খোঁজ খবর পর্যন্ত নিয়েছিলেন। অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলোও নির্দ্বিধায় জানাতে বললেন। তিনি কোহিনুরের সব সমস্যা দেখার আশ্বাস দিলেন। তবে জরুরি একটা মিটিং থাকায় রাকিবের বিষয়ে সেদিন আর খুব একটা কথাবার্তা এগুলো না। অন্য একদিন আসতে বলে তাদের বিদায় দিয়ে দিলেন নুরুল মোল্লা। তবে আসার সময় বলে দিলেন যে, রাকিব আর কোহিনুরকে তিনি মুখোমুখি বসাতে চান। যাতে কোহিনুরের কাছে সেদিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা চায় রাকিব। এই ঘটনায় একটা যথাযথ শাস্তি দরকার রাকিবের। আর এ কারণেই পরেরদিন কোহিনুরকে একা দেখা করতে বললেন নুরুল মোল্লা।’
‘ওহ, গড! তার মানে সেদিনই ঘটনা ঘটিয়েছে সে?’
‘হুম। দুর্ঘটনাটা ঘটলো সেদিনই। নুরুল মোল্লার প্রথম দিনের আচরণে মুগ্ধ হয়ে কোহিনুরের বাবা-মা সরল মনেই মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন। কোহিনুর গেলো দুপুরবেলা। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেও কোহিনুরের কোনো খবর পাওয়া গেলো না। ফিরলো না সন্ধ্যাবেলাও। সন্ধ্যার পরপর কোহিনুরের বাবা তাকে খুঁজতে গেলেন নুরুল মোল্লার বাড়ি। বাড়ির কেয়ারটেকার অবশ্য জানালো নুরুল মোল্লা বাড়িতে নেই। তিনি জরুরি মিটিং-এ জেলা শহরে গেছেন। চিন্তিত কোহিনুরের বাবা কেয়ারটেকারের কাছেই কোহিনুরের কথা জানতে চাইলেন। কিন্তু কেয়ারটেকার জানালো, সে কোহিনুরকে দেখেনি। রাজ্যের দুশ্চিন্তা নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরলেন। ঘড়িতে তখন রাত দশটা। বাড়ি ফিরে দেখেন কোহিনুর ফিরে এসেছে। কিন্তু সেই কোহিনুর ফিরে না এলেই বোধহয় ভালো ছিলো।’
আজিজ মাস্টার থামলেন। আসাদ বললো, ‘সেই রাতেই সে আত্মহত্যা করে?’
‘নাহ। টানা বারো ঘণ্টা শুধু মা ছাড়া আর কারো সাথেই কোনো কথা বলে নি কোহিনুর। শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলো সারারাত। মাকে সে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে ঘটনা খুলে বলেছিলো। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো সে। তার মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মরা কান্না কাঁদলেন। কিন্তু পরদিন দিনের আলো যতো বাড়তে থাকলো, কোহিনুরও যেন ততই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগলো। বিষয়টি অস্বাভাবিক ঠেকলেও কিছু বললেন না কোহিনুরের মা। বিকেলের দিকে হঠাৎ আমার বাড়িতে আসতে চাইলো সে। তার মা নিজেই নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তখনো তিনি জানতেন না, অমন ঘটনার পরও এমন শান্ত, স্বাভাবিক কোহিনুর আসলে ঠান্ডা মাথায় কী ঘটাতে যাচ্ছে! সেই রাতেই নিজের ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে সে!’
আজিজ মাস্টার একটু দম নিয়ে যেন শক্তি সঞ্চয় করলেন। আসাদ উদ্বিগ্ন গলায় বললো, ‘তারপর?’
আজিজ মাস্টার ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এরপর আর কী! কোহিনুরের মায়ের কাছে এই ঘটনা শোনার পর আমি যেন আবার নতুন করে মাঠে নামলাম। সেদিনই আবার পুলিশের কাছে গেলাম আমি। সরাসরি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করতে চাইলাম নুরুল মোল্লার বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশ আমার মামলা নিলো না।’
‘কেন?’
‘কারণ আমি ধর্ষিতার কেউ হই না।’
‘কেউ না হলে মামলা করা যায় না?’
‘যাবে না কেন? যায়। কিন্তু এটা একটা বাহানা। তারা আসলে মামলা নিবে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমি থানা থেকে কোহিনুরের মাকে বললাম নুরুল মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা করতে।’
‘সে রাজি হলো?’
‘প্রথমে হয় নি। কিন্তু আমিতো ছাড়ার বান্দা না। অনেক পিড়াপিড়ীতে অবশেষে সে গেলো মামলা করতে।’
‘মামলা হলো?’
‘উহু।’
‘এবার হলো না কেনো? এবারতো কোহিনুরের মা নিজে বাদী হয়ে মামলা করতে গিয়েছেন। তাহলে?’
‘পুলিশ বললো, এই মামলার কোনো ভবিষ্যৎ নাই। কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না যে কোহিনুর ধর্ষিতা ছিলো। সে মারা গেছে ততদিনে মাস পেরিয়েছে। শুধু মুখের কথায়তো হবে না, প্রমাণ থাকতে হবে। এতোদিন পরে কী আর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাবে?’
‘আপনাদের কাছেতো প্রমাণ ছিলোই। কোহিনুরের মায়ের স্টেটমেন্ট আর তার সাথে সেই চিঠিটা!’
‘চিঠিটা আর নেই।’
‘নেই মানে?’
‘সেদিনই আমি ওসিকে বললাম যে আমার কাছে প্রমাণ আছে। তিনি জানতে চাইলেন কী প্রমাণ? আমি তাকে চিঠিটা দেখালাম। তিনি চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলেন। দীর্ঘসময় পর জিজ্ঞেস করলেন, এই চিঠি যে কোহিনুর লিখছে তার প্রমাণ কী? আমি বললাম, কোহিনুরের হাতের লেখা সবাই চেনে। তিনি বললেন, আচ্ছা, এটা চেক করে দেখতে হবে। ততদিন পর্যন্ত চিঠি আমার কাছে থাকুক।’
‘কিন্তু এই কাজতো তার না! এই কাজ কোর্টের। কোর্টের কাজ কি পুলিশের ওসি করতে পারে? পুলিশের কাজ মামলা নেয়া। সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের ভার আদালতের।’
আজিজ মাস্টার ম্লান হাসলেন, ‘চিঠিটা আর আমাকে ফেরত দিলেন না তিনি। মামলাও নিলেন না। উল্টো ভয় দেখালেন।’
‘কীসের ভয়?’
‘সেটা আমি মুখে বলতে পারবো না। এতো নোংরা, এতো জঘন্য!’
‘বলুন, আমাকে শুনতে হবে।’
আজিজ মাস্টার খানিক সময় নিলেন বলতে। তারপর রাজ্যের লজ্জা, সঙ্কোচ, দ্বিধা নিয়ে তিনি বললেন, ‘ওসি সরাসরি হুমকি দিয়ে বললেন, কোহিনুরের মা আর আমার মধ্যে নাকি আপত্তিকর সম্পর্ক আছে, আর সেই সম্পর্কের কারণেই লজ্জায়, অপমানে আত্মহত্যা করেছে কোহিনুর! নুরুল মোল্লার কাছে নাকি এই বিষয়ে তথ্য প্রমাণ আছে। এখন আমি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি, তবে আমাদের দুজনের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক আছে, আর এ কারণেই কোহিনুর আত্মহত্যা করেছে, এই কারণ দেখিয়ে কোহিনুরের মা আর আমার বিরুদ্ধে মামলা দিবে পুলিশ।’
‘কী বলছেন আপনি!’
‘হুম।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী!’ খানিক চুপ করে থেকে আজিজ মাস্টার আবার বললেন, ‘এরপর আর কখনো কোহিনুরের মা আমার সাথে দেখা দিলেন না।’
আজিজ মাস্টার তার কথা শেষ করলেও কথা বললো না আসাদ। চুপ করে রইলেন আজিজ মাস্টারও। ঘড়িতে তখন রাত তিনটা। দূরে কোথাও করুণ সুরে একটা কুকুর ডেকে যাচ্ছে। সেই ডাকে ভারি হয়ে উঠছে রাতের বাতাস।


পরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙলো দুজনেরই। আজিজ মাস্টার ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিলেন বলে আর ওঠার তাড়া ছিলো না। তবে ঘুম থেকেই উঠেই কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়লেন তিনি। আসাদ বললো, ‘এখন কী করবেন?’
‘কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরাবো।’
‘কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন ধরাবো মানে?’
‘এটা ছাড়াতো আসলেই আর কোনো উপায় নেই। এ ক’দিন আমি এই একটা বিষয়ই ভাবছি। আপনার এই বুদ্ধি ছাড়া আর কোনো বুদ্ধি আমার মাথায় আসে নাই।’
আসাদ হতাশ ভঙ্গিতে হাসলো, ‘এই বুদ্ধিও কাজে লাগবে না।’
‘কেন? কাজে লাগবে না কেন?’
‘আগেভাগে ঘোষণা দিয়ে আগুন লাগাতে গেলে পুলিশ প্রেসক্লাবের সামনে আপনাকে দাঁড়াতেই দিবে না। ধরে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।’
‘কিন্তু সেদিন যে বলেছিলেন?’
আসাদ হাসলো, ‘এমনি এমনি বলেছিলাম। সব কথা কি আর সব সময় আমরা সিরিয়াসলি বলি?’
‘তা বলি না। কিন্তু আমি এখন কী করবো তাহলে? ওটা ছাড়াতো আর কোনো উপায় দেখিনা আমি।’
আসাদ আঁতকে ওঠা গলায় বললো, ‘আপনি কি সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন জ্বালিয়ে মরতে চান নাকি?’
‘মরবো কেনো?’
‘তাহলে কী করবেন? কেরোসিন ঢেলে গায়ে আগুন লাগিয়েও বেঁচে থাকার কোনো টেকনিক জানেন নাকি আপনি?’
‘নাহ। তা কেন? কিন্তু আপনিই না বললেন, জাস্ট আগুন লাগানোর ভান করবো। কিন্তু লাগাবো না। আসলে অত মানুষের ভিড়ে সেটা সম্ভবও না। পাবলিকতো আর তাদের চোখের সামনে ওভাবে কাউকে গায়ে আগুন লাগিয়ে মরতে দিবে না, তাই না? তারা কেউ না কেউ থামাবেই। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু প্রতিবাদটা মানুষের কাছে পৌঁছাই দেয়া।’
‘কিন্তু আপনিতো প্রথমেই ভুল করছেন। আপনার উচিত ছিলো প্রথম থেকেই ব্যাগের ভেতরে রাখা ওই ব্যানার টানিয়ে আমরণ অনশনে বসে যাওয়া। তাহলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ হতো সহজে। আপনি সেটি না করে কী এক ব্ল্যাকবোর্ডে স্কুলের এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে অনশনে বসে গেলেন। বিষয়টা হাস্যকর হয়ে গেলো না।’
আজিজ মাস্টার খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি আসলে ভয় পাচ্ছিলাম, প্রথমেই যদি কোহিনুরের এই বিষয়টা নিয়ে বসে যাই, আর তা যদি নুরুল মোল্লা কোনোভাবে জেনে যায়, তাহলে কিছু একটা সে করবেই। এইজন্যই স্কুলেরটা দিয়ে প্রথমে এখানকার হাবভাবটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।’
‘তো হাবভাব কী বুঝলেন?’
আজিজ মাস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই সাধারণ, নির্বিরোধী বিষয় নিয়েই পুলিশ যা করলো, আর ওই বিষয় নিয়ে কিছু করলেতো ভয়াবহ অবস্থা হবে।’
‘কথা সত্য। এই দেশে কোনো এক অদ্ভুত কারণে হয় ধর্ষণকারীরা শক্তিশালী হয়ে যায়, অথবা শক্তিশালী মাত্রই ধর্ষণকারী হয়।’
আজিজ মাস্টার আর কোনো কথা বললেন না। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন। আসাদ বললো, ‘একটা কথা বলি স্যার?’
‘জ্বী বলেন।’
‘যা হয়েছে, তার চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আপনারতো নিজের ঘর, সংসারও আছে, আছে না?’
‘জ্বী আছে।’
‘তাহলে একবার ভাবেনতো আপনার কারণে তারা এখন কত বড় বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?’
আজিজ মাস্টার কথা বললেন না। আসাদ বললো, ‘যদি আপনার এই প্রতিবাদের কারণে আপনার মেয়েদের কোনো সমস্যা হয়? ঘরে এখনো দুটো মেয়ে আপনার। তখন? তখন বাবা হয়ে সেটা মেনে নিতে পারবেন?’
আজিজ মাস্টার এবারও জবাব দিলেন না। আসাদ বললো, ‘যে অন্যের মেয়ের উপর ঘটা এমন ঘটনাই মেনে নিতে পারে না, সে নিজের মেয়ের উপর এমন ঘটনা ঘটলে কী করবে?’
দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে আজিজ মাস্টার কথা বললেন, ‘কী করবো তাহলে?’
‘আপনি বরং বাড়ি চলে যান। দেখেন স্কুলটার কোনোভাবে এমপিও করাতে পারেন কী না!’
‘স্কুলের মেয়েদের যদি নিরাপত্তাই দিতে না পারি, তাহলে আর স্কুল রেখে লাভ কী?’
আসাদ চট করে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলো না। তবে সে আজিজ মাস্টারের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘আপনি ভালো মানুষ। আমি আপনার যন্ত্রণাটা বুঝি স্যার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কোহিনুরতো আপনার নিজের মেয়ে না? তাই না?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। আসাদ আবারও প্রশ্নটা করলো, ‘সে আপনার নিজের মেয়ে?’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘নাহ।’
‘তাহলে যাদের মেয়ে, তাদের উচিত ছিলো না, বিষয়টা নিয়ে অনেক বেশি সোচ্চার হওয়া?’
‘জি, ছিলো।’
‘তাহলে তারা যদি না হয়, আপনার এতো দায় কীসের? অন্যের মেয়ের জন্য চিন্তার আগে কী নিজের মেয়েদের জন্য চিন্তা করা উচিত না?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন না। চুপ করে বসে রইলেন। তবে তার চোখের সামনে তখন সত্যি সত্যিই তার মেয়েদের চেহারা ভেসে উঠেছে। বাড়িতে নিশ্চয়ই সবাই খুব দুশ্চিন্তা করছে। বাবার জন্য অপেক্ষায় আছে তারা। আচ্ছা, ওরা কি তার খোঁজে অস্থির হয়ে আছে? নিশ্চয়ই আছে। কে জানে, হয়তো চারদিকে তার খোঁজে লোকজনও পাঠিয়েছে। আবার ঢাকা শহরেও পৌঁছে যায়নিতো তারা? কিন্তু ঢাকা শহরে পৌঁছালে কোথায় খুঁজবে তাকে? এমন না যে তিনি ফোন ব্যবহার করেন আর সেই ফোনে তারা বাবাকে খুঁজে পাবে! তাহলে? হঠাৎ মেয়েদের জন্য বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেলো আজিজ মাস্টারের। কেমন আঁকুপাঁকু করতে লাগলো।
আজিজ মাস্টার চুপচাপ বসে রইলেন। বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। কিন্তু কোহিনুরের কথা মনে পড়তেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ওই গ্রামটাতে ফিরে গেলেই কোহিনুর তার সামনে এসে দাঁড়াবে। তখন তাকে কী জবাব দিবেন তিনি? স্কুলে ক্লাস টেনের যে বেঞ্চিটাতে রোজ এসে বসতো কোহিনুর, সেই বেঞ্চিটা চোখের সামনে রেখে কী করে পড়াবেন তিনি? যে পথ ধরে মেয়েটা রোজ হেঁটে যেতো, সেই পথ ধরে কী করে হাঁটবেন তিনি?
আচ্ছা, সত্যি সত্যিই কি কোহিনুরের ঘটনার কোনো বিচার হবে না? কোনো বিহিত হবে না? কিচ্ছু করতে পারবেন না তিনি? অন্তত একটু প্রতিবাদও না? এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না আজিজ মাস্টার। ভাবতেই বুকের ভেতরটা কী এক অক্ষম আক্রোশে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। জানেন, কিছুই করার নেই তার। তারপরও ডুবে যাওয়া মানুষ যেমন খড়কুঁটো ধরে বাঁচতে চায়, তেমন করেই তিনি আসাদকে বললেন, ‘আপনি কি কিছু করতে পারেন না আসাদ সাহেব? আপনিতো লেখেন। কবিতা, গল্প। লিখেওতো কত কিছু হয়! কত প্রতিবাদ, কত দাবি আদায়। হয় না?’
আসাদ ম্লান হাসলো, ‘এই দেশে হয় না। এখানে লিখে, গান গেয়ে, মানব বন্ধন করে প্রতিবাদ করলে মানুষ ভাবে প্রতিবাদের শক্তি নেই বলে এগুলো করা হচ্ছে। কিংবা যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হচ্ছে সেটা গুরুতর কোনো অন্যায় নয়। এগুলো লোক দেখানো। আর নীতি নির্ধারক বা শাসকরাও এগুলোকে গুরুত্বহীন ভাবেন। ফলে এগুলো করে কিছু হবে না।’
‘আসলেই হবে না?’
‘কোনো একদিন হয়তো হবে। এখনতো হয় না। দেখেন নি, সাগর রুনি হত্যার ঘটনায় কত লেখালেখি হলো, কত মানব বন্ধন হলো, কই তাতে কিছু হলো? আজ কত বছর? হলো নাতো কিছুই! তনু ধর্ষণ হত্যার ঘটনা জানেন? জানেন নিশ্চয়ই। এমন আরো কত শত ঘটনা যে রয়েছে। কই? কিছুইতো হয়নি! এই যে কত লেখালেখি, কত মানব বন্ধন, প্রতিবাদ হলো কিন্তু কিছু হলো নাতো!’
‘তাহলে?’

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না আসাদ। সে চুপ করে রইলো। চুপ করে রইলেন আজিজ মাস্টারও। সারাদিন আর কোনো কথা বললেন না তিনি। তবে বিকেল নাগাদ বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন আজিজ মাস্টার। তার এখন সত্যি সত্যিই নিজের মেয়েদের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। অস্থির লাগছে।
পরদিন ভোরে তাকে বাড়ি যাওয়ার গাড়িতে তুলে দিলো আসাদ। তবে পুরোটা সময় সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই অদ্ভুত মানুষটাকে সে কোনোদিন ভুলবে না। এই মানুষটার সাথে এই জীবনে আর কখনো দেখা হবে কী না আসাদ জানে না, তবে সে এটা জানে, এই মানুষটা হুটহাট তার গল্প, কবিতা, ভাবনায় বিচরণ করে যাবেন। সে হঠাৎ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, মাঝেমধ্যেই আজিজ মাস্টারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সে মানুষটার সাথে দেখা করে আসবে। আর ফেরার সময় নিয়ে আসবে অদ্ভুত এক শক্তি।
আজিজ মাস্টারকে বিদায় দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি হঠাৎ আসাদের হাত চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘একটা কথা?’
‘কী কথা?’
‘আপনি যে বললেন কোহিনুর আমার মেয়ে না। এইজন্য আমার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত, তাই না?’
আসাদ এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে সে জানে না। তারপরও সে বললো, ‘ঠিক তা না। আমি আসলে বলতে চেয়েছি, আপনার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে তারা কী করবে?’
‘কী করবে?’
‘আপনিই জানেন, তারা কী করবে!’
‘হ্যাঁ জানি। তারা কান্নাকাটি করবে। পিতৃহারা হয়ে কষ্ট পাবে। কিন্তু আসাদ সাহেব...।’
‘জি বলুন?’
‘তাদের কারো কিছু হলে আমি কী করবো?’
‘কিছু হলে মানে?’
‘ধরুন, যদি কোহিনুরের মতো কিছু হয়ে যায়?’
‘এমন কিছু হবে না। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।’
‘কিন্তু যদি হয়ে যায়? কোহিনুরের বাবা মাও কি কখনো ভেবেছিলেন যে তাদের মেয়ের এমন কিছু হয়ে যেতে পারে?’
‘উহু, ভাবেন নাই।’
‘তাহলে?’
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না আসাদ। চুপ করে রইলো। আজিজ মাস্টার নিজেই বললেন, ‘আল্লাহ না করুক, ধরেন আমার মেয়েদের ক্ষেত্রেও যদি এমন খারাপ কিছু ঘটে যায়, তখন কিন্তু অন্য সব বাবারাও এটাই ভাববে যে তাদের ঘরে তাদের মেয়েরাতো ভালো আছে, নিরাপদে আছে। তাই না? তারা কেনো আমার মেয়ের বিচারের দাবিতে এগিয়ে আসবে? আমার মেয়ের জন্য রাস্তায় নেমে তারা কেনো নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে? তখন তাদের সন্তানরাওতো তাদের জন্য দুশ্চিন্তা করবে, তাই না? তাদের কিছু হয়ে গেলে তাদের ছেলেমেয়েরাওতো তাদের জন্য কাঁদবে, পিতৃহারা হবে। তখন এইসব ভেবে তারাও আমার মতো এভাবে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকবে। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করবে। কিন্তু আমি একা তখন কী করবো? আমিতো বাবা, তাই না?’
আসাদ এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। আজিজ মাস্টার হঠাৎ হাসলেন, ‘ওহ, আমি বারবার শুধু ভুলে যাই, আমিতো শুধু আমার মেয়েদের বাবা। আমিতো অন্য মেয়েদের বাবা নই। আমিতো কোহিনুরেরও বাবা নই। তাই না আসাদ সাহেব?’

আসাদ এই প্রশ্নেরও জবাব দিলো না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আজিজ মাস্টারের দিকে। লোকটাকে কেমন উদ্ভ্রান্ত লাগছে। কেমন অচেনা অন্যরকম লাগছে। তবে এই অচেনা অন্যরকম মানুষটা তার ভাবনার জগতটাকেও এলোমেলো করে দিচ্ছে। যদি এমন অচেনা মানুষে এই দেশটা পরিপূর্ণ হয়ে যেতো, তবে এই দেশটাও কি অচেনা হয়ে যেতো? যেই অচেনাটা চেনার চেয়ে ভালো? অন্য এক আলো ঝলমলে মানুষের দেশ!
আসাদ ঘরে ফিরলো তার কিছুক্ষণ পরেই। তার ঘরের মেঝেতে আজিজ মাস্টারের রেখে যাওয়া হলুদ ব্যানারখানা পড়ে আছে। কোহিনুরের হত্যার বিচার চেয়ে এই ব্যানারখানা তিনি বানিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও এটা প্রদর্শনের সুযোগ তার হয়নি। আর কোনোদিন হবেও না। হয়তো এ কারণেই ব্যানারখানা ফেলে রেখে গিয়েছেন আজিজ মাস্টার। কে জানে, এই ব্যানারের সাথে সাথে হয়তো তিনি ফেলে রেখে গেছেন তার যাবতীয় ক্ষোভ, ক্রোধ আর প্রতিবাদের শক্তিও। তাহলে যে শক্তিমান মানুষটা এই শহরে পা রেখেছিলো অসম্ভব প্রতিবাদের এক স্বপ্ন নিয়ে, সেই মানুষটাই ফিরে যাচ্ছেন স্বপ্নহীন, শক্তিহীন, নিঃস্ব, ন্যুব্জ এক মানুষ হয়ে! আসাদ ব্যানারের ভাঁজটা খুললো।
ভেতরে স্পষ্ট বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘কোহিনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই।’
প্রতিবাদমুখর এই শব্দগুলো পেছনে ফেলে রেখে শূন্য বুকে ফিরে গেছেন আজিজ মাস্টার। এক পরাজিত, বিধ্বস্ত, নিঃসঙ্গ একা মানুষ।


শেষের আগে-
স্থান: ঢাকা প্রেসক্লাব।
সময়: বিকেল সাড়ে পাঁচটা।
এই সময়ে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় অফিসছুট ক্লান্ত মানুষের সারি থাকে। আজও রয়েছে। তবে আজকের ভিড়টা আর আট-দশদিনের ভিড়ের মতো নয়। প্রেস ক্লাবের সামনে লোকজন জমে গিয়ে বড়সড় একটা জটলা লেগে গেছে। সেই জটলার ভিড় ক্রমশই বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে ভিড় চলে এসেছে রাস্তা অবধি। অফিস ফেরত বাসযাত্রীদের বাসগুলো ধীরে ধীরে আটকে পড়তে শুরু করেছে সেই ভিড়ে। ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে রাস্তার জ্যাম। কৌতুহলী মানুষ তাদের জরুরি কাজ ফেলে রেখে ভিড়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে সামনের উঁচু মাথাগুলোর জন্য তারা আসল ঘটনার কিছুই দেখতে পারছে না। ফলে কেউ কেউ উঠে গেছে ওভার ব্রিজের ওপরে। দুয়েকজন তরতর করে রেইন্ট্রি গাছের ডাল বেয়ে উঠে গেছে ওপরে। আশেপাশের বাসা, অফিসের ছাদেও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা কী?
ঘটনা হলো ভিড়ের মাঝখানে দাঁড়ানো শীর্ণাকায় শরীরের মানুষটা। মানুষটার নাম আজিজ মাস্টার। আজিজ মাস্টার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দাঁড়িয়ে আছেন প্রেসক্লাবের সামনে। তার বাঁ হাতে ধরা একখানা মশাল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সেই মশাল থেকে গায়ে আগুন ধরাবেন। কিন্তু একটু দেরি করছেন। কারণ তার গলায় একখানা ছোট ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো। সেই ব্ল্যাকবোর্ডে চক ঘষে স্পষ্ট বড় বড় অক্ষরে লেখা,
‘আমি কোহিনুরের বাবা। কোহিনুর আমার মেয়ে।
আমি তার ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই।’
নিচে ধর্ষকের নাম পরিচয়সহ বিস্তারিত লেখা।
এই ঘটনার কথা আসাদ এখনো জানে না। সে ভোরে আজিজ মাস্টারকে বাসে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিলো। কিন্তু আজিজ মাস্টার শেষ অবধি বাড়ি ফিরে যান নি। আসাদ তাকে বাসে রেখে ফিরে চলে যেতেই তার হঠাৎ কী যে হলো! কিছুদূর যেতেই তিনি কন্ডাক্টরকে বললেন, ‘বাস থামান।’
‘বাস থামাবো কেনো?’
‘কারণ আমার বাথরুম চেপেছে।’
‘বাথরুম বাসা থেকে করে আসতে পারেন নি? দশ মিনিট হয় নাই বাস ছাড়ছে, এর মধ্যেই আপনার বাথরুম চাপছে। পুরা পথ কী করবেন?’
‘সেইটা পুরা পথেই দেখতে পাবেন।’ বলেই তিনি বাস থেকে নামলেন। তারপর পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে কন্ডাক্টরকে ধরিয়ে দিলেন। কন্ডাক্টর বললো, ‘ঘটনা কী? টাকা দিয়ে আমি কী করবো?’
‘তেমন কিছু না। শুধু বাসের লকার থেকে আমার ব্ল্যাকবোর্ডটা একটু বের করে দিবেন।’
‘মানে কী? আপনে কি ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে বাথরুম করতে যাবেন নাকি?’
আজিজ মাস্টার বিগলিত ভঙ্গিতে হাসলেন, ‘নাহ। ব্ল্যাকবোর্ড নিয়ে বাথরুমে যাবো না। আমি ঢাকায়ই থাকবো। জরুরি কাজ পড়ে গেছে। আজ বাড়ি যাওয়া যাবে না। আপনি ভাই দয়া করে আমার ব্ল্যাকবোর্ডটা একটু নামিয়ে দেন।’
কন্ডাক্টর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আজিজ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তবে শেষ পর্যন্ত সে তার ব্ল্যাকবোর্ড নামিয়েও দিলো। আজিজ মাস্টার সেই চলন্ত বাস থামিয়ে রাস্তার মাঝখানে নেমে পড়লেন। আসলে তার মাথায় তখনো কিলবিল করছিলো আসাদের সেই কথাটা। কথাটা তিনি কোনোভাবেই তার মাথা থেকে তাড়াতে পারছিলেন না।। বাসে ওঠার পরপরই হঠাৎ তার মনে হলো, এভাবে তিনি বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন না। এমনকি এভাবে ফিরে গেলে তিনি মরেও শান্তি পাবেন না। বাকি জীবনও বেঁচে থাকবেন প্রবল অশান্তি নিয়ে। স্বস্তিতে ঘুমাতে পারবেন না আর কখনো। যেকোনো উপায়েই হোক, এই ঘটনার প্রতিবাদ তিনি করবেনই। এই ঘটনার বিচার তিনি চাইবেনই।
আজিজ মাস্টার সিএনজি ভাড়া করে সোজা চলে এসেছেন প্রেস ক্লাবের সামনে। একটিন কেরোসিন কিনে গায়ে মেখেছেন। একটা মশাল জ্বালিয়ে ধরে রেখেছেন এক হাতে। তবে তিনি গায়ে আগুন লাগানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারেন নি। আসাদের মতো তারও ধারণা, শেষ মুহূর্তে এসে আশেপাশে জড় হওয়া জনগণ তাকে নিবৃত্ত করবে। কিন্তু তার এই প্রতিবাদ, তার এই চেষ্টা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে।
আজিজ মাস্টার প্রথম দিকে লোকজনের উপস্থিতি, আগ্রহ দেখে খুবই খুশি হয়েছিলেন। মাত্র ক’দিন আগেই তিনি প্রেসক্লাবের দেয়াল ঘেঁষে যে বসে ছিলেন, কেউ তা গ্রাহ্যই করে নি। অথচ আজ, মাত্র কয়েক ঘণ্টায়ই এভাবে মানুষ জড় হয়ে যাবে তা তিনি ভাবেন নি। আসাদ ছেলেটার বুদ্ধি ভালো। সবচেয়ে ভালো হতো আসাদ ছেলেটাকে সাথে নিয়ে এলে। সে কবিতার ভাষায় কিছু প্ল্যাকার্ড নিয়ে এলে আরো ভালো হতো। সমস্যা হচ্ছে এই মুহূর্তে তার পক্ষে আসাদকে খবর দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তার কাছে মোবাইল ফোন নেই। আসাদের ফোন নম্বরও নেই।

যদিও আজিজ মাস্টারের চারদিকে অসংখ্য মোবাইল ফোন। তার চারপাশে চক্রাকারে যে বিশাল জন জমায়েত, তাদের প্রায় সবার হাতেই একটা করে মোবাইল ফোন। কারো কারো হাতে একাধিক ফোনও রয়েছে। তারা সমানে আজিজ মাস্টারের ছবি তুলছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে আজিজ মাস্টার কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। অনেকটা ঘাবড়েও গেছেন। তার কেনো যেন মনে হচ্ছে, প্রতিবাদের বার্তা পাওয়ার চেয়ে মানুষের মধ্যে তামাশা দেখার একটা প্রবল আগ্রহ কাজ করছে।
যদিও তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। চারপাশে একটা হই হই রব উঠে গেছে। শতশত মানুষ এসে জড় হয়েছে। আরো মানুষ আসছে। তাদের প্রায় সবার হাতেই মোবাইল ফোন, ক্যামেরা। এই মোবাইল ফোন, ক্যামেরার কারণে অবশ্য আজিজ মাস্টারের লাভও হয়েছে। অনেকেই ফেসবুকে আজিজ মাস্টারের ছবি, ভিডিও পোস্ট করছেন।

তবে আজিজ মাস্টারের কেনো যেন মনে হচ্ছে উপস্থিত মোবাইল ফোন হাতে জনতা প্রবল আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে ঘটনা ঘটার অপেক্ষা করছে। প্রতিবাদের চেয়েও তারা যেন আজিজ মাস্টারের জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা দেখতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিষয়টা নিয়ে আজিজ মাস্টার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। যদিও তাদের এমন আগ্রহ দেখে প্রচুর সাংবাদিকও জড় হয়েছেন। তারাও ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। টিভি সাংবাদিকদের অবশ্য আসতে একটু দেরি হচ্ছে। তারা আজিজ মাস্টারের এই অভিনব প্রতিবাদ সরাসরি সম্প্রচার করবে। সাংবাদিকরা বিষয়টা খানিকটা হলেও গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। এটি একটা আশার ব্যাপার।
তবে চারপাশের মানুষের পরিস্থিতি, উত্তেজনা, প্রতিক্রিয়া দেখে আজিজ মাস্টার ক্রমশই ভীত হয়ে পড়েছেন।
এতো এতো মানুষের জমায়েত দেখে প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, তার এই প্রতিবাদ এমপি-মন্ত্রী অবধি পৌঁছে যাবে। তারা তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে ছুটে আসবেন। কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী কাউকে পাঠাবেন। ভাগ্য ভালো হলে প্রধানমন্ত্রীও তার দাবির স্বপক্ষে বিবৃতি দিয়ে ফেলতে পারেন। অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি, তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা এবং এতো এতো সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে এ বিষয়ে তিনি মোটামুটি নিশ্চিতই ছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার হিসেবে বড় ধরনের গড়মিল ছিলো। কেউতো আসেই নি বরং উপস্থিত সকলেই যেন অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন আজিজ মাস্টার তার গায়ে আগুন ধরাবেন!
আজিজ মাস্টারের পেছনে কতোগুলো চ্যাংড়া ছেলেপুলে দাঁড়ানো। তাদের হাতে মোবাইল ফোন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তারা উসখুশ করছিলো। এবার পেছন থেকে তাদের একজন বলেই ফেললো, ‘কী হইলো স্যার? দেরি করতেছেন কেন?’
আজিজ মাস্টার তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ওই ছেলে কীসের দেরির কথা বলছে? তার গায়ে আগুন ধরানোর? তার মানে তারা তার জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে? কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর!
অন্য একটা ছেলে পেছন থেকে বললো, ‘আমার ইন্টারনেটের ডাটা কিন্তু শেষ হয়ে যাবে চাচা মিয়া, আর কতক্ষণ এমনে ফেসবুকে লাইভ ধইরা থাকবো? ঘটনা ঘটাইলে তাড়াতাড়ি ঘটান। আপনি ঘটনা শুরু করলেই দেখবেন লাইভের ভিউয়ার সংখ্যা সাইসাই করে বাড়তে থাকবে। ধরাইলে এখনি ধরান। দিনের আলো থাকতে থাকতে। একটু পর কিন্তু অন্ধকার নেমে যাবে।’

আজিজ মাস্টারের চিন্তা করার শক্তি যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। মানুষ যে বিষয়টাকে এভাবে ভাবতে পারে, এটা তার চিন্তার ত্রি-সীমানায়ও ছিলো না। এই মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের বিষয়টা সম্পর্কে তিনি অল্পবিস্তর শুনেছিলেন। কিন্তু তাও খুব ভালোভাবে না। তবে এই ডাটার বিষয়টি তিনি একদমই কিছু বোঝেন না। ফেসবুকের কথা কিছু কিছু তিনি শুনেছেন। তার ছোট মেয়েটা বায়না ধরেছিলো মোবাইল ফোনের। তাও আবার ইন্টারনেটওয়ালা মোবাইল ফোন। আজিজ মাস্টার কিনে দিবেন দিবেন করেও আর দিতে পারেন নি। দিবেন কী করে? বাপ দাদার ভিটে বাড়ি যা ছিলো, তার সব বিক্রি করেতো ওই স্কুলখানাই তিনি করেছেন। বছরের পর বছর সেই স্কুল চালাতে গিয়ে তার দিশেহারা অবস্থা!

দিশেহারা অবস্থা এই মুহূর্তেও। মানুষজন ক্রমেই যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। টিভি ক্যামেরাও চলে এসেছে। তারা আজিজ মাস্টারের এই অভিনব প্রতিবাদ লাইভ সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে যন্ত্রপাতিও নিয়ে এসেছে। আরো টিভি চ্যানেল আসছে। আজিজ মাস্টার তার বাঁ দিকে একটা ছোটখাট জটলা দেখতে পেলেন। কিছু তরুণ শিক্ষার্থী সেখানে জড় হয়েছেন। তাদের মধ্য থেকে ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো, পাঞ্জাবি পরা এক ছাত্র উঁচু এক স্তম্ভের উপর উঠে গেলো। তারপর গলার রগ শক্ত করে, উঁচু গলায় বক্তৃতা দেয়া শুরু করলো। আজিজ মাস্টার অবশ্য তাদের বক্তৃতার কারণ বুঝলেন না। তবে মনে মনে খানিক শঙ্কিত বোধ করলেন তিনি। যদি কোনো কারণে তার প্রতিবাদের বিষয়টি থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে যায়!  যদিও তেমন কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। বরং মনে হলো তাদের কারণেই আরো অনেক বেশি মানুষ আজিজ মাস্টারকে কেন্দ্র করে জটলা বাড়িয়ে চলেছে।
আজিজ মাস্টারের শরীর খারাপ লাগছে। এতক্ষণ প্রচণ্ড রোদ ছিলো। আর এখন ভিড়ের কারণে ঘামে, গরমে তার নাভিশ্বাস অবস্থা। মনে হচ্ছে, যে কোনো সময় তিনি মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে পড়ে যাবেন। তাছাড়া তার হাতের মশালটিও এভাবে এতক্ষণ উঁচু করে ধরে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটু উল্টোপাল্টা কিছু হলেই ভয়াবহ বিপদ ঘটে যেতে পরে।

আজিজ মাস্টার এখন সত্যি সত্যিই ভয় পাচ্ছেন। আর যাই হোক, জীবন্ত আগুনে দগ্ধ হয়ে মরার মতো সাহস তার নেই। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, কেউ তাকে নিবৃত করতে আসবে। বরং সকলেই যেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা করছে। কখন আজিজ মাস্টার তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিবেন। দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে আগুন। সেই আগুনে পুড়তে থাকবে একটি জীবন্ত মানুষ। আর অপেক্ষমান এই শত শত মানুষগুলো তার গায়ে আগুন লাগানোর সেই দৃশ্য ক্যামেরায়, মোবাইল ফোনে ধারণ করবেন। তারপর ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশনে ছড়িয়ে দিবেন। অজস্র মানুষ সেই ঘটনায় কমেন্টস, লাইক, শেয়ার করবে। কী ভয়ংকর!
আজিজ মাস্টারের শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। তিনি খুব করে চাইছেন, কোনো এক অলৌকিক উপায়ে হলেও কবি আসাদ যদি এখানে ছুটে আসতো! তাহলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা সে করে ফেলতে পারতো। কিন্তু এই তুমুল ভিড়ের মধ্যে কোথাও আসাদকে দেখতে পেলেন না তিনি। পেছন থেকে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি ঠিক ক’টা নাগাদ গায়ে আগুন লাগানোর পরিকল্পনা করেছেন?’
আজিজ মাস্টার ঘুরে সাংবাদিকের দিকে তাকালেন। সাংবাদিক তার মুখের কাছে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিলেন। তার পেছনে একজন ক্যামেরা ধরে আছেন। আজিজ মাস্টার তার কথার উত্তর দিচ্ছেন না দেখে সাংবাদিকটি আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘এখনো কি সংশ্লিষ্ট কেউ আপনার সাথে কোনো যোগাযোগ করেছেন?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলেন না। পেছন থেকে এক সাংবাদিক বললেন, ‘আপনার সাথে যোগাযোগ করার উপায় কী? কোনো ফোন নম্বর আছে আপনার সাথে যে ফোন নম্বরের কেউ আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে? থাকলে ফোন নম্বরটি দিন, আমরা সেটি টিভি স্ক্রলে দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারি। তাতে যদি সংশ্লিষ্ট কেউ আপনাকে ফোন করেন। কিংবা কেউ কোনো প্রশ্ন করতে চান আপনাকে?’
আজিজ মাস্টার বুঝতে পারছেন না তিনি কী করবেন। এর মধ্যে অবশ্য আরো একজন সাংবাদিক এগিয়ে এলেন। তিনি আজিজ মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, ধরুন যদি এমন হয় যে আপনার দাবি মেনে নিতে কেউই এগিয়ে এলো না, তখন আপনি কী করবেন? আপনি কী তখন সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করবেন?’
আজিজ মাস্টারের শরীর খুবই খারাপ লাগছে। চারধারে মানুষের ভিড় আরো বাড়ছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এই সময়ে একজন তার প্রায় মুখের সাথে মাইক্রোফোন চেপে ধরে বললেন, ‘যদি আপনি গায়ে আগুন ধরিয়ে সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করেন, তবে সেটি ঠিক কখন মানে ক’টা নাগাদ হতে পারে? আপনি কি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো সুনির্দিষ্ট টাইমলাইন বেঁধে দিয়েছেন?’
আজিজ মাস্টার এই প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিলেন না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। একগ্লাস পানি পেলে ভালো হতো। কিন্তু যে মানুষ গায়ে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করার হুমকি দিয়েছে, সেই মানুষটি এই অবস্থায় কারো কাছে তেষ্টা নিবারণের জন্য জল চাইতে পারে না। সেটি ভালোও দেখায় না।
সাংবাদিকটি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেন না। আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি সত্যি সত্যিই গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করবেন? নাকি এটি কেবলই একটা আইওয়াশ?’
আজিজ মাস্টার কারো কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি চোখে ঝাপসা দেখছেন। তার মাথা টলমল করছে। যেন যে কোনো মুহূর্তে তিনি ঢলে পড়বেন মাটিতে। তার কাছে কোনো জবাব না পেয়ে এক সাংবাদিক আবার রিপোর্টিং এ ফিরে গেলেন। তিনি তার টেলিভিশনের দর্শকদের উদ্দেশ্যে আবেগঘন কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘প্রিয় দর্শক, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, একজন স্কুল শিক্ষক কতোটা মহান, কতোটা সৎ, কতোটা বিবেকবান হলে তার ছাত্রীর ধর্ষণের প্রতিবাদে এমন তীব্রভাবে সোচ্চার হতে পারেন। নিজেকে সেই ছাত্রীর বাবা হিসেবে দাবি করতে পারেন। এমন একনিষ্ঠ, আদর্শবান হতে পারেন। এ দেশের ঘরে ঘরে যদি তার মতো শিক্ষক, তার মতো মানুষ থাকতো তবে এই দেশ বদলে যেতো। হতে পারতো এক আদর্শ রাষ্ট্র। কিন্তু আফসোস, এমন সোনার মানুষ এ দেশে নেই। আপনাদের জানাতে চাই যে তিনি এমনকি শুধু মানুষকে দেখানোর জন্যই যে এমন প্রতিবাদ করছেন, তা কিন্তু নয়। বরং সত্যি সত্যিই তিনি এই প্রতিবাদ করছেন। তার এই নির্বিকার, নির্বাক প্রতিক্রিয়াতেই সেটা স্পষ্ট। তিনি আমাদের মত কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। এ যেন আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মুখে এক তীব্র চপেটাঘাত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সংশ্লিষ্ট মহলের কাউকেই এখনও এখানে দেখা যাচ্ছে না। কেউই এখনো তার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগই করেনি। মিডিয়ার মাধ্যমেও না। এভাবেই আমাদের...।’
আজিজ মাস্টার আর শুনতে পেলেন না সাংবাদিকটি কী বলছেন! তবে তিনি বুঝতে পারছেন তার চারপাশের মানুষগুলো আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না। তারা ক্রমেই আরো অস্থির হয়ে উঠছে। যেন মজার, আকর্ষণীয় কোনো দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় তারা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে এতোক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই সবকিছুই অর্থহীন। আজিজ মাস্টার আসলে কিছুই করবেন না। বরং সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি নিজেই এক ধরনের মজা লুটছেন। শেষ পর্যন্ত গায়ে আগুন তিনি ধরাবেন না। ফলে শুধু শুধু এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
লম্বা লেন্সের ক্যামেরা হাতে এক লোক দূর থেকে আজিজ মাস্টারকে ডাকলো, ‘স্যার, স্যার।’
আজিজ মাস্টার বুঝলেন না কোন দিক থেকে কে তাকে ডাকছে। তবুও তিনি শব্দ লক্ষ্য করে ফিরে তাকালেন। লোকটা আবারো চিৎকার করে বললো, ‘স্যার। এইদিকে স্যার। এই যে, আপনের ডানে, একটু তাকান স্যার। জি, স্যার। একটু মুখটা শক্ত করে হাতটা উঁচু করেন স্যার, জি স্যার। মানে স্যার আঙুল তুলে বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গি করবেন স্যার। একবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। একবার তর্জনী উঁচিয়ে স্যার। খুব সুন্দর একটা ছবি হবে স্যার।’

আজিজ মাস্টার কিছুই বুঝলেন না। তিনি কিছু করলেনও না। তবে ছেলেটা একের পর এক ক্যামেরার শাটার টিপতে লাগলো। আজিজ মাস্টার দেখলেন অসংখ্য মানুষ একের পর এক মোবাইল ফোনেও তার ছবি তুলছে। অনেকে ধীরে ধীরে তার একদম কাছেও চলে এসেছে। তারা আজিজ মাস্টারের সাথেও ছবি তোলার চেষ্টা করছে। আজিজ মাস্টার না বুঝলেও তিনি অসংখ্য মানুষের সেলফিতে স্থান পেয়ে যেতে থাকলেন। একটি মেয়ে তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়ে লম্বা সেলফি স্টিক বের করে সেলফি তুলতে লাগলো। কিন্তু সে তার সেলফিতে মোটেই সন্তুষ্ট হচ্ছিলো না। বরং ডানে বাঁয়ে মাথা, মুখ, ঠোঁট কাঁত কিংবা আঁকা-বাঁকা করেও সে তার কাঙ্ক্ষিত ছবিটি কোনোভাবে না পেয়ে অবশেষে আজিজ মাস্টারকে ডাকলো সে। বললো, ‘আংকেল, একটু এদিকে তাকাবেন প্লিজ?’
আজিজ মাস্টার হতভম্ভ চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা এতোক্ষণে সম্ভবত বুঝতে পারলো যে এখানে এই মুহূর্তে এমন আবদার করাটা তার ঠিক হয় নি। তাছাড়া সে সময়ও নিয়ে ফেলেছে অনেক। ফলে তার চারপাশের লোকজনও তার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছিলো। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে দূরে সরে গেলো। তবে এরপরই শুরু হলো সেলফি তোলার হিড়িক। আজিজ মাস্টার অবশ্য জানেন না কী ঘটছে। তার খুব অসুস্থ লাগতে লাগলো। মাথা ঘোরাচ্ছে। তিনি ভিড় থেকে খানিক দূরে সরে যেতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। কেউই তাকে সামান্য জায়গাও দিচ্ছিলো না।
আজিজ মাস্টার সবার মাঝখানে আচমকা হড়বড় করে বমি করে ফেললেন। তার পাশের লোকটা ছিটকে দূরে সরে গেলো। কিন্তু আজিজ মাস্টার আর তাল সামলাতে পারলেন না। তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। তিনি দু’পা এলোমেলো সামনে বাড়ালেন। তারপর ধপাস করে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, তার হাতের মশালটা ছিটকে এসে পড়লো তার শরীরে। আর মুহূর্তেই কমে এলো চারপাশের ভিড়। মোবাইল হাতের সেলফি শিকারীরা ছুটে সরে গেলো দূরে। টেলিভিশন সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যানরা নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলো। কারণ ততক্ষণে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন। আজিজ মাস্টারের তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার গায়ে সত্যি সত্যিই আগুন লেগে গেছে! প্রথমে কিছুক্ষণ তিনি তেমন কিছুই বুঝতে পারলেন না। তারপর হঠাৎই তীব্র চিৎকার করতে চাইলেন তিনি, ‘বাঁচান, আমাকে বাঁচান।’ কিন্তু সেই চিৎকার করে সাহায্য চাইতে গিয়েও আবার থমকে গেলেন আজিজ মাস্টার। শত শত মানুষ তার চারপাশে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সকলের হাতেই মোবাইল ফোন, স্থির ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা। তারা প্রবল আগ্রহ আর একাগ্রতার সাথে আজিজ মাস্টারের ছবি তুলছে। এমন দৃশ্য এর আগে কখনো কোথাও তারা দেখে নি। তাদের চোখের সামনে জীবন্ত একজন মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। এমন দৃশ্য হয়তো আর কখনো কোথাও তারা দেখতেও পাবে না। ফলে এই বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখা উচিত, এই অভূতপূর্ব স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখা উচিত। ফলে তারা একের পর এক নানা অ্যাঙ্গেলে, নানা কম্পোজিশনে ছবি তুলে রাখতে লাগলো। ভিডিও করে রাখতে লাগলো।
একজন জীবন্ত মানুষের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটনা টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারিত হচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য তাদের ব্রডকাস্ট পলিসি মেনে পোড়ার এই দৃশ্য ঝাপসা করে দিয়ে প্রচার করছে। তবে স্পষ্টভাবেই লাইভ হচ্ছে ফেসবুক ইউটিউবেও। অসংখ্য মানুষ দেখছে একজন প্রতিবাদী স্কুল শিক্ষক তার স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের প্রতিবাদে সত্যি সত্যি গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করছেন। তারা সেই ভিডিও ছবির নিচে তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া, আবেগঘন মতামত জানাচ্ছেন। লাইক শেয়ার করছেন। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে। আজিজ মাস্টার তাকিয়ে আছেন, তার চোখের সামনের দৃশ্য ক্রমশই ঝাপসা হয়ে উঠছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, খানিক আগেও যে তীব্র যন্ত্রণা তিনি পেতে শুরু করেছিলেন, সেই যন্ত্রণা এখন আর তিনি অনুভব করছেন না। এক ধরনের ঘোরের মতো হচ্ছে তার। যেন কোনোকিছুই ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে পারছেন না তিনি।
আজিজ মাস্টারের হঠাৎ মনে হলো, এই ঘটনা বাস্তবে ঘটছে না, এই ঘটনা ঘটছে তার স্বপ্নে। তিনি প্রায়ই অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখার অসুখ তার আছে। তার বাবা দবির খাঁকে তিনি প্রায়ই স্বপ্নে দেখেন। তার সাথে নানা কথাবার্তাও তার হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে দবির খাঁকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। আজিজ মাস্টারের হঠাৎ খুব দবির খাঁকে দেখতে ইচ্ছে করতে লাগলো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার মুখটা তিনি মনে করতে পারলেন না। তবে দবির খাঁর মতো কাউকেই যেন আচমকা দেখতে পেলেন আজিজ মাস্টার। হ্যাঁ, ওই যে, ওই যে তার বাবা দবির খাঁ। তিনি দবির খাঁকে দেখতে পাচ্ছেন। দবির খাঁ লাঠি হাতে তার দিকে এগিয়ে আসছেন। বাবাকে দেখে আজিজ মাস্টারের খুব ভয় লাগতে লাগলো। তিনি নিশ্চিত এই অবস্থায়ও তার বাবা তাকে বকাঝকা করবেন। বলবেন, ‘কীরে বেকুব, শেষ পর্যন্ত অন্যের মেয়ের জন্য নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিলি! নিজের মেয়েদের কথা একবারও ভাবলি না?’
আজিজ মাস্টার তার বাবা দবির খাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পারলেন না। তার আগেই পুরো পৃথিবী তার কাছে অন্ধকার হয়ে গেলো। নিঃশব্দ হয়ে গেলো। মিলিয়ে গেলো তার চারপাশের তুমুল কোলাহল। অসংখ্য মানুষের মুখ ও মুখোশ।

আজিজ মাস্টারের লাশ রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। তিনি মারা গেছেন গতকাল রাতে। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে রফিকুল এসেছে। রফিকুলের সাথে এসেছে আজিজ মাস্টারের স্ত্রী এবং সন্তানরাও। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তারা কেউই এখনও লাশ দেখতে পারেন নি। এমন কি হাসপাতাল থেকে লাশ বেরও করা যায় নি। না করার পেছনে সঙ্গত কারণও রয়েছে। হাসপাতালের বাইরে অসংখ্য মানুষ ভিড় করেছে। মানুষের ভিড়ে গিজগিজ করছে চারপাশ। হাজার হাজার মানুষ। আজিজ মাস্টারের মৃত্যুর ঘটনা এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ভিডিও ও ছবিসহ এই সংবাদ প্রচার হয়েছে।
গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় আজিজ মাস্টারকে নিয়ে অসংখ্য পোস্ট গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টুইটার, ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রমসহ সকল মাধ্যমে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্পেশাল বুলেটিন প্রচার করেছে তাকে নিয়ে। দেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবীরা একের পর এক টকশোতে কথা বলেছেন তার প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে। মুহূর্মূহু স্লোগান উঠেছে রাজপথে।
সংবাদপত্রগুলো তাদের খবরের প্রধান শিরোনাম করেছে আজিজ মাস্টারের ছবি ও আত্মহত্যার খবর দিয়ে। ফেসবুকে হাজার হাজার প্রতিবাদী ইভেন্ট খোলা হয়েছে। সেই ইভেন্টে সাড়া দিয়ে ঢাকা শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। একজন শিক্ষক তার ছাত্রীর ধর্ষণের বিচার না পেয়ে প্রতিবাদ হিসেবে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে, এরচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা আর কী হতে পারে!
মানুষের মুখে মুখে একই প্রশ্ন, ‘কোন বিচারহীনতার দেশে আমরা বাস করছি? এ কোন দেশ, যেখানে ধর্ষক মাত্রই শক্তিশালী হয়ে ওঠে? আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়! অপরাধী মাত্রই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে? আরো শক্তিশালী হয়ে আরো অপরাধ করার ম্যান্ডেট পেয়ে যায়!’
আজিজ মাস্টার জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার সময়ও বোঝা যায় নি ঘটনার প্রভাব এতো তীব্র হতে পারে! পুলিশ ভেবেছিলো, আর দশটা অপঘাতে মৃত্যুর মতোই আজিজ মাস্টারের মৃত্যুও খানিক আফসোসের হবে, খানিক হাহাকার, আক্ষেপ আর প্রতিবাদের হবে। তারপর সব শান্ত হয়ে যাবে। ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু আজিজ মাস্টারের মৃত্যুর তৃতীয় দিন সকাল নাগাদ বোঝা গেলো এই ঘটনা আর আট দশটা ঘটনার মতো নয়। রাতভর ঢাকা মেডিকেল থেকে শহিদ মিনার, টিএসসি থেকে শাহবাগ। বুয়েট থেকে পলাশি, ইডেন, নিউমার্কেট হাজার হাজার মানুষ জেগে রইলো রাজপথে। তাদের মিছিলে- স্লোগানে প্রকম্পিত হতে লাগলো শহর। অবরুদ্ধ হয়ে রইলো রাজপথ। কিন্তু তা নিয়ে মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। বরং স্বতস্ফূর্তভাবেই মানুষ অংশ নিতে থাকলো এই জন জমায়েতে।
আজিজ মাস্টার যেন মুহূর্তেই হয়ে উঠলেন সমগ্র বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রতিবাদের এক ও অদ্বিতীয় প্রতিনিধি।
পুলিশ কমিশনার জরুরি সভা ডাকলেন। কিন্তু সেই সভায় এই সমস্যার কোনো সমাধান মিললো না। বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হলো। পরপর দুদিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট বন্ধ থাকার কারণে যানজটে স্থবির হয়ে গেলো শহর। সকল অফিস আদলত বন্ধের উপক্রম হলো। রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও সম্পাদিত হতে পারলো না। অফিস-আদালত অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগন্তি বাড়লো অনেক মানুষের।
পুলিশ প্রথম দিকে চেষ্টা করেছিলো লাঠিচার্জ, টিয়ারশেলের মতো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে রাস্তা থেকে মানুষকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু এটি হিতে-বিপরীত হলো। মানুষ আরো বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠতে লাগলো। শুরু হলো গগন বিদারি স্লোগান। সেই স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগলো শহরের রাজপথ, গলিমুখ, বিষণ্ন আকাশ। মিছিলে আজিজ মাস্টারের বড় বড় ছবি দেখা গেলো। সেই ছবির নিচে কবিতার দুটো লাইন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠলো।
‘সেই সে মিছিলে, তুমিও কি ছিলে, নাকি ছিলো শুধু একা কেউ?
জেনে রেখো আজ, একা এ আওয়াজ, হবে শত সহস্র ঢেউ!’
কবিতাটা লিখেছে কবি আসাদ। সেদিন আজিজ মাস্টারের ঘটনা টিভিতে শোনার পর সে পাগলের মতো ছুটে এসেছিলো প্রেসক্লাবে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। আজিজ মাস্টারকে সরাসরি একপলক দেখতেও পারে নি সে। তবে ততক্ষণে ফেসবুক, ইউটিউব, টেলিভিশন সহ সবখানে অসংখ্য ছবি ছড়িয়ে পড়েছে আজিজ মাস্টারের। ফেসবুকের ভায়োলেন্স সংক্রান্ত পলিসির কারণে তার আগুনে পোড়া বেশিরভাগ ছবিই মুছে ফেলেছে তারা। তবে গায়ে কেরোসিন ঢেলে এক হাতে মশাল আর গলায় ‘আমি কোহিনুরের বাবা। কোহিনুর আমার কন্যা। আমি তার ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চাই’ লেখা ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো আজিজ মাস্টারের ছবিটি আসাদ দেখেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই ছবি দেখে বহুকাল পরে তার মাথায় কবিতা চলে এলো। সে ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করে তার নিচে সে সেই দুই লাইন কবিতা লিখে দিলো-
‘সেই সে মিছিলে, তুমিও কি ছিলে, নাকি ছিলো শুধু একা কেউ?
জেনে রেখো আজ, একা এ আওয়াজ, হবে শত সহস্র ঢেউ!’
সত্যি সত্যি নিঃসঙ্গ এক আজিজ মাস্টারের একা মিছিলের নিঃশব্দ আওয়াজ যেন ক্রমশই শত সহস্র মানুষের কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদের ঢেউ হয়ে উঠতে লাগলো।
ঘটনার তৃতীয় দিন রাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে ডাকলেন। দীর্ঘ মিটিং শেষে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে থমথমে মুখে বের হয়ে এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেইদিন রাতেই কোহিনুর ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ চেয়ারম্যান নুরুল মোল্লা। সাথে গ্রেপ্তার হলো তার ছেলে রাকিব ও তার সাঙ্গপাঙ্গরাও। অভিযুক্তের মামলা না নেয়া ও ভয় ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করা হলো স্থানীয় ওসিকেও।
সপ্তাহখানেকের মাথায় দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুল এমপিওভুক্ত করলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতোকিছুর পরও অবশ্য আজিজ মাস্টারের ঘটনা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদ স্তিমিত হলো না। তাকে নিয়ে ক্রমাগত লেখা হতে লাগলো পত্রিকায়। টেলিভিশন টক শোর অবধারিত টপিক হয়ে উঠলেন মৃত আজিজ মাস্টার। তার সাহস, সততা, প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে গল্প, কবিতা, গান, নাটক, বই প্রকাশিত হতে লাগলো। ঘটনার মাস দুয়েক পর সরকার থেকে ঘোষণা দেয়া হলো দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের পাশেই আজিজ মাস্টার মেমোরিয়াল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। কারণ এই অঞ্চলে বহুদিন ধরেই একটি কলেজের খুব প্রয়োজন ছিলো। যত দ্রুতসম্ভব সেই প্রয়োজন মেটানো হবে। কলেজের সামনে আজিজ মাস্টারের একটি আবক্ষ ভাস্কর্যও স্থাপন করা হবে। দেশসেরা একজন ভাস্কর সেই ভাস্কর্য তৈরি করবেন।

কবি আসাদের অদ্ভুত একটা অসুখ করেছে। সেই অসুখের নাম আজিজ মাস্টার অসুখ। সে আজিজ মাস্টারকে না দেখলে কবিতা লিখতে পারে না। আজিজ মাস্টারকে বাস্তবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাকে দেখতে হয় স্বপ্নে। স্বপ্নে তিনি আসাদকে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। সেইসব কথাই কেমন কেমন করে যেন আসাদের কলমে কবিতা হয়ে যায়। সমস্যা হচ্ছে, ইচ্ছে করলেই যখন তখন আজিজ মাস্টারকে স্বপ্ন দেখতে পারে না আসাদ। আজিজ মাস্টারকে স্বপ্ন দেখতে হলে তাকে আজিজ মাস্টারের গ্রামে যেতে হয়। গিয়ে তার কবরের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তা আসাদ যায়ও। প্রায়ই সে আজিজ মাস্টারের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার কবরের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার সাথে মনে মনে কথা বলে। খুবই আশ্চর্য ঘটনা, সেই রাতেই সে আজিজ মাস্টারকে স্বপ্ন দেখে। আর তার পরদিন খাতা ভরে কবিতা লিখতে থাকে সে।
মাঝেমধ্যে আসাদের সাথে রফিকুলের কথা হয়। রফিকুল আজিজ মাস্টারের মেজো মেয়ে রুমুকে বিয়ে করেছে। দবির খাঁ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক হিসেবে তার সুনামও হয়েছে। শোনা যাচ্ছে আজিজ মাস্টারের নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হলে রফিকুল সেখানে বাংলার প্রভাষক হিসেবে চাকরিও পেয়ে যাবে।
আসাদ এলে রফিকুল প্রায়ই আসাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। আজও এলো। অনেক্ষণ আজিজ মাস্টারের কবরের পাশে আসাদের সাথে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে বললো, ‘একটা ঘটনা শুনেছেন আসাদ ভাই?’
‘কী ঘটনা?’
‘স্যারকে নাকি পুরস্কার দেয়া হবে?’
‘কোন স্যারকে?’
‘যার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।’
‘ওহ, আচ্ছা।’ আসাদ আগ্রহ দেখায় না।
রফিকুল আবার বলে, ‘কথা সত্যি। আমাকে সেদিন আমাদের লোকাল এমপি সাহেব জানালেন। তিনি বড় মন্ত্রী-আমলাদের কাছে এই নিয়ে তদবিরও করেছেন। বিষয়টিকে সবাই পজেটিভলি নিয়েছে।’
‘হুম’।
‘আরে বুঝলেন না! এটার একটা পলিটিক্যাল ভিউও তো আছে!’
‘কী রকম?’
‘স্যারতো এখন একভাবে জাতীয় আইকন। উনাকে একটা পুরস্কার দেয়ার মানেতো সরকারেরই লাভ। পাবলিক সিম্প্যাথিও পেলো। বুঝলেন না?’
‘হুম।’
‘তবে যেই সেই পুরস্কার না কিন্তু, দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার।’
‘পুরস্কার উনাকে কীভাবে দিবে?’
‘কীভাবে দিবে মানে?’
‘না মানে উনার লাশ কবর থেকে তুলে পুরস্কার প্রদানের মঞ্চে নিয়ে যাবে? নাকি উনারা কবরের কাছে এসে লাশের গলায় পরিয়ে দিয়ে যাবেন?’
‘মানে! কী যা তা বলছেন আপনি?’ রফিকুল যেন খানিক বিরক্ত হলো।
আসাদ অবশ্য জবাব দিলো না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ। যে কোনো সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হবে। রফিকুল বললো, ‘স্যারের এতো বড় প্রাপ্তিতে আপনি খুশি হন নি?’
‘খুশি হবো না কেন? হয়েছি।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কী?’
‘এমন নির্বিকারভাবে জবাব দিচ্ছেন কেন?’
‘কী করবো তাহলে?’
‘একটু খুশি হবেন। মুখ ভার করে থাকবেন না।’
‘আপনার কী মনে হয়, আপনার স্যার এই খবর পেলে তিনি কীভাবে জবাব দিতেন?’
‘উনি খুবই খুশি হতেন?’
‘কী কী কারণে খুশি হতেন?’
‘এই যে কোহিনুরের ঘটনার বিচার হলো, নুরুল মোল্লার যথাযথ বিচার হলো। উনার স্কুল এমপিওভুক্ত হলো। কলেজ হলো। উনি এতো বড় পুরস্কার পেলেন।’
‘আচ্ছা।’
‘আচ্ছা মানে?’
আসাদ একদলা থুথু ফেলে বললো, ‘আচ্ছা মানে আচ্ছা।’
সে পেছন ফিরে হাঁটা দিলো। রফিকুল তার পিছু পিছু আসতে লাগলো। আসাদ আচমকা রফিকুলের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনার স্যার কেমন লোক ছিলেন?’
‘তার মতো ভালো লোক আমি আর এই জীবনে দেখি নাই।’
‘তাহলে আপনার স্যারকে যদি বলা হতো, এই দেশে একটা ধর্ষণের বিচার পাবার বিনিময়ে, একজন জঘন্য অপরাধির অপরাধের শাস্তি পাওয়ার বিনিময়ে একজন নিরপরাধ মানুষকে প্রকাশ্যে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরতে হবে, তাহলে আপনার স্যার খুশি হতেন?’
রফিকুল চোখ তুলে তাকালো। আসাদ বললো, ‘সব শর্ত পূরণ করার পরও, যোগ্য হওয়ার পরও কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে কেউ একজন সেই স্কুলটা বন্ধ করে রাখবে দিনের পর দিন। আর সেই স্কুলের এমপিওভুক্তির জন্য সেই স্কুলেরই একজন শিক্ষককে গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মরতে হবে, এটা শুনলে আপনার স্যার খুশি হতেন?’
রফিকুল জবাব দিলো না। আসাদ বললো, ‘তিনি আগুনে পুড়ে আত্মহত্যার করার পর তার সেই মৃত্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের কাজে ব্যবহার করার জন্য কেউ তাকে এতোবড় একটা পুরস্কার দিবেন, এটি শুনলে তিনি খুশি হতেন?’
রফিকুল এবারও জবাব দিলো না। আসাদ বললো, ‘ওই পুরস্কারের গায়ে এটা লেখা থাকবে না যে ‘আজিজুর রহমান, মরণোত্তর?’
‘জি, তাতো থাকবেই। মৃত্যুর পরে পেলেতো মরণোত্তরই লেখা থাকবে। সেটাইতো স্বাভাবিক।’
‘ওটা কেটে একটা শব্দ লিখে দিতে বলতে পারবেন?’
‘কী শব্দ?’
‘মরণোত্তম।’
‘মরণোত্তম?’
‘হুম।’
‘কেনো? মরণোত্তম মানে কী?’
‘মরণোত্তমের কোনো মানে নেই। কিংবা আছে।’
‘কী মানে?’
‘যেখানে জীবনের চেয়ে মৃত্যু উত্তম। মরণই উত্তম। জীবিত মানুষটির চেয়ে মৃত মানুষটি যেখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেখানে মরণইতো উত্তম। কি উত্তম না?’
রফিকুল জবাব দিলো না। তবে আসাদ আবারো থুথু ফেললো। একদলা থকথকে থুথু। থুথুটুকু পড়েছে ঘাষের ওপর। থকথকে গা ঘিনঘিনে এক দলা থুথু। ততক্ষণে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তারা দুজনই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই গা ঘিনঘিনে থুথুটুকুর দিকে। এই বুঝি বৃষ্টিতে ওই গা ঘিনঘিনে থকথকে থুথুটুকু ধুয়ে যায়!

অন্যদিন ঈদ সংখ্যা ২০১৯-এ প্রকাশিত।

Leave a Reply

Your identity will not be published.