আমার বিপুলা পৃথিবী। সিদ্দিকা জামান

আমার বিপুলা পৃথিবী। সিদ্দিকা জামান

ছয় দশকের নিত্যসঙ্গী সিদ্দিকা জামান লিখেছেন আনিসুজ্জামানকে নিয়ে। জীবনসঙ্গী হিসেবে কীভাবে দেখেছেন তাঁকে, কীরকম ছিল তাঁদের যৌথ জীবন, ব্যক্তি আনিসুজ্জামানের চারপাশটা কেমন ছিল, কেমনই-বা ছিল তাঁর পথচলা, জানাচ্ছেন সিদ্দিকা জামান। ধারাবাহিক এই লেখার শেষ কিস্তি থাকছে এই সংখ্যায়।

এপ্রিল মাসে বেশ ঘটা করেই রুচির ৫০তম জন্মদিন পালন করা হলো। আনিসুজ্জামানের পরিবারের কেউ এর আগে তাঁদের সন্তানদের ৫০ বছর দেখে যেতে পারেন নি। তাই ও বলেছিল, ‘বেঁচে থাকলে আমি আমার ছেলেমেয়েদের জন্মের এই মাইলফলক বড় করে উদ্যাপন করতে চাই।’ সেই কথামতো বেশ বড়সড় আয়োজন করা হলো, যদিও রুচি কিছুটা ইতস্তত করছিল।

২০১৪ সালের জুনের ৪ তারিখে আমার ভাই আজিজ মারা গেল। ওর চরিত্র ছিল বিচিত্র রকমের। সবার জন্য ওর ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। তা বাপেরবাড়ির লোকজন বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন, বন্ধু-বান্ধব সবার জন্য দুহাতে খরচ করতে ভালোবাসত। কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, নিজে যা বুঝত তার অন্যথা করতে চাইত না। ফলে প্রথম জীবনে সবদিক দিয়ে যে সফলতা অর্জন করেছিল তার সবই নিষ্ফল হয়ে গেল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ও চলে গেল।

এই জন্ম-মৃত্যুর মধ্যেই পদ্মভূষণ উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান, দাওয়াত, সংবর্ধনায় আমরা অংশ নিই। এক-এক অনুষ্ঠানে যাই আর বিভিন্ন মানুষের মূল্যায়ন শুনে ছেলেমেয়েরা বলে, ‘আব্বাকে আমরা নতুন করে জানছি।’ আনন্দ একদিন বলল, ‘আমরাই মনে হচ্ছে আব্বাকে সবচেয়ে কম চিনি!’

১৩ নভেম্বর ২০১৪-তে জওহরলাল নেহেরুর ১২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আনিসুজ্জামান দিল্লিতে আমন্ত্রিত হলে আমি ওঁদের পাঠানো চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে ওকে বলি, ‘আমিও কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?’ বলল, ‘চিঠি লিখে জানতে হবে।’ অনুমতি এলে যাওয়া হলো। আমি যেতে চাইলাম একটাই কারণে, সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিখ্যাত, সংগ্রামী পুরুষ এবং মহিলারা আসবেন। তাই ওকে বলেছিলাম, ওঁদের তো আমি দাওয়াত করে খাওয়াতে পারব না। সুতরাং এই দেখা করার সুযোগ আমি ছাড়তে রাজি না। আমাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীও সফরসঙ্গী ছিলেন।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে সরকার আনিসুজ্জামানকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করে। আশির দশকে একুশে পদক পেয়ে থাকলেও দেশের সর্বোচ্চ এই সম্মান আমাদের সবাইকে খুব আনন্দিত করে। এই পুরস্কার পেতে বিভিন্ন নিয়ম মেনে, প্রাপককে সরকারের কাছে আবেদন করতে হয়, যা আনিসুজ্জামান কখনোই করতে চায় নি। আমরা পরে শুনেছি, এর ঠিক আগের বছর পদ্মভূষণ পাওয়ায় সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এবং যথাশীঘ্র সম্ভব তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পুরস্কার প্রদানের দিন ২৫ মার্চ আমরা সবাই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি। পুরস্কারপ্রাপ্তদের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তৃতায় আনিসুজ্জামান বলেছিল, ‘দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক এই পুরস্কার পেয়ে আমি গর্বিত, তবে তা একসময় স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছিল।’ মঞ্চে উপবিষ্ট প্রধানমন্ত্রী সেটা নোট করলেন ও তাঁর বক্তৃতায় সেটা পুনরুল্লেখ করলেন।

সেই বছরের নভেম্বরে আনিসুজ্জামান প্রাণনাশের হুমকি পেল। যথারীতি নির্বিকার থাকলেও এবার থানায় ডায়েরি করার সিদ্ধান্ত নিল। যত না বিচলিত ছিল তার চেয়ে বেশি হলো ক্ষুব্ধ। ডায়েরি করায় এবং তা জাতীয গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলশান থানা থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাসায় উপস্থিত হন। বাসার নিরাপত্তা, যাতায়াতের ব্যবস্থা— সবকিছু বিবেচনা করে তারা নানারকম পরামর্শ দিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বনের অনুরোধ করলেন। সাম্যর পাশাপাশি ৪ বছরের সখ্য সেই সময় মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

আনিসুজ্জামানের সার্বিক ও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য সরকার থেকে একজন গানম্যানকে নির্দিষ্ট করা হয়। বাসাতেও ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হলো। আনিসুজ্জামান প্রথমে তাতে আপত্তি জানায়। ও বলল, আমাকে কেউ মারতে চাইলে তো খুব বেশি অসুবিধা হবার কথা না। কিন্তু তারা গানম্যান নিয়ে চলতে অনেকটা বাধ্যই করলেন। দিন কয়েক পরে আবুল হোসেন নামের একজন কনস্টেবলকে এই দায়িত্বে নিয়োগ করা হলো। আনিসুজ্জামানের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে শুধু দায়িত্ব পালনই করল না বরং আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠল। এই ঘটনায় এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল।

২০১৬ সালে আমার নাতি-নাতনিদের বেশ কিছু ভালো খবর এলো। গণিতের একটি প্রতিযোগিতায় (আলোহা) অংশ নিয়ে সাম্য মালয়েশিয়া থেকে প্রথম রানার আপের পুরস্কার নিয়ে এল। এর কিছুদিন আগে আমার বড় নাতনি অরণির বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলো। আগস্টে আনিসুজ্জামান ‘বাংলাদেশ বইমেলা’ উদ্বোধন করতে কলকাতায় গেলে আমিও ওর সঙ্গে যাই। পরে রুচিরা সপরিবারে আমার মেজো বোনের মেয়ে রাবেয়াসহ কলকাতায় যোগ দেয়। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি অরণির বিয়ের কিছু কেনাকাটাও করি আমরা সেখানে। কলকাতায় গেলে বন্ধু-বান্ধবের সান্নিধ্যে আর ভালোবাসায় আনিসুজ্জামানের খুব ব্যস্ত সময় কাটে।

২০১৭-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অরণির বিয়ে হলো ফারহানের সঙ্গে। নাত জামাই দেখে আমাদের মন ভরে গেল। সুন্দর চেহারা, নির্মল হাসি, সহজ-সরল ব্যবহার, ওর সবকিছুই আমাদের নির্ভরতা দিল। বিয়ে ও পরবর্তী বেশ কিছু অনুষ্ঠানে আনিসুজ্জামান অংশ নিল, তবে সেই সময়ই কিছুটা শারীরিক অসুস্থতা বোধ করা শুরু করল। জানুয়ারির ১১ তারিখ পিঠে ব্যথা নিয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি হলো। আর এটাই ছিল ওর দীর্ঘ অসুস্থতার সূচনা। পরের ১০০ দিনে তিন দেশের সাত হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে আনিসুজ্জামান কিছুটা সুস্থ হয়।

তবে এই সময়ে দেশে-বিদেশের নানা হাসপাতালের অভিজ্ঞতা আমাকে খুব পীড়া দেয়। ল্যাব এইডসহ বিভিন্ন হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, ডাক্তারদের কর্তব্যে অবহেলা— সব মিলিয়ে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার বেহাল দশা একেবারে সচক্ষে দেখলাম।

লিটু এমনিতেই আনিসুজ্জামানের অল্প অসুস্থতায় বিচলিত হয়, আর গুরুতর অসুস্থতার কারণে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। ও আনিসুজ্জামানকে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। সিদ্ধান্ত হয় আমরা ২ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকক যাব। রুচিও আমাদের সঙ্গে গেল। বাবুও পরদিন যোগ দিল সেখানে। সেই বছর ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও আনিসুজ্জামান থাকতে পারল না। ২ তারিখে বাংলা একাডেমিতে ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন লেখক সম্মাননা ২০১৭’ দেওয়া হলো। তাতেও ও থাকতে পারল না। আনন্দ ওর হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করল। আমরা ততক্ষণে ব্যাংককের উদ্দেশে যাত্রা করি।

এর কিছুদিন আগে, ১৬ জানুয়ারি, আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ওকে সাম্মানিক ডি.লিট প্রদান করে। আনন্দও আনিসুজ্জামানের সঙ্গে যাবার পরিকল্পনা করে। অসুস্থতার জন্য শেষ পর্যন্ত সেখানেও যেতে পারল না। আনিসুজ্জামানের চেয়ে আনন্দর বেশি মন খারাপ হয়েছিল। কারণ ৩ জন পুরস্কার প্রাপকের মধ্যে একজন ছিল সৌরভ গাঙ্গুলী, আনন্দ যার বিশাল ভক্ত।

ব্যাংকক হসপিটালের ডাক্তাররা সব কিছু দেখলেও ওর আসল সমস্যা, পিঠের ব্যথার কারণটাই ধরতে পারল না। পিঠের ব্যথা থাকলেও মেরুদণ্ডের ব্যাপারটা বিবেচনায় না এনে, তারাও ল্যাব এইডের মতো হার্টের চিকিৎসা করেছেন। আর কদিন পর, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ওর ৮০তম জন্মদিন ঘটা করে পালন হবার কথা থাকায় আমরা দিন দশেক পর চিকিৎসা শেষে ঢাকায় ফিরে এলাম। কিন্তু ঢাকায় ফিরেও আনিসুজ্জামানের ব্যথা না কমায়, সব অনুষ্ঠান বাতিলের চিন্তা করে।

কাজল তার অনুষ্ঠান স্থগিত করলেও আনিসুজ্জামানের সঙ্গে পরামর্শ করে মাসুদ করিম পূর্বঘোষিত ১৭ তারিখে তার অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিল । সে কলকাতা থেকে পবিত্র সরকারকে আসতে অনুরোধ করেছে আর ঢাকার অতিথিরা তো আছেনই; তাই আর পেছাতে চাইল না। পবিত্রদা ওইদিনই ঢাকা এলেন আর বিমানবন্দর থেকে সোজা আমাদের বাসায় আসেন ওকে দেখতে। আমি ওঁদের সঙ্গে চলে যাই জাদুঘরের অনুষ্ঠানে। ওখানে মাসুদ করিম আনিসুজ্জামানের ওপর যে ডকুমেন্টারি করেছে তার উদ্বোধন করল। ও যেতে না পারায় তার হয়ে আমি অনুষ্ঠানে কিছু কথা বললাম।

পরদিন, ১৮ তারিখ, ওর ৮০ বছরের জন্মদিনের সকালে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো। হাসপাতালের ভিসি থেকে শুরু করে সবাই তাকে দেখতেও এলেন, জন্মদিনের শুভেচ্ছাও জানিয়ে গেলেন। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ এসেও খোঁজখবর নিলেন। আনিসুজ্জামান প্রাথমিক আতিথেয়তা আর অভ্যর্থনায় সন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি বলেন, ‘ওঁরা আমারই অনেক যতœ নেন, আপনার তো নেবেনই’! ওঁর সরলতায় মুগ্ধ হই। আনিসুজ্জামান চাইল কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাসায় যেতে, যাতে শুভাকাক্সক্ষীরা শুভেচ্ছা জানাতে আসতে পারেন। তার কথায় কর্তৃপক্ষ দুপুরে বাসায় যাবার অনুমতি দেয়, রাতে ফিরে আসার শর্তসাপেক্ষে। বিকেলে সামান্য আয়োজনে ওর জন্মদিন পালন করলাম। প্রধানমন্ত্রীও দূত মারফত ফুল-শুভেচ্ছা পাঠালেন। তারপর ৯টার মধ্যে আবার হাসপাতালে ফিরে গেলাম।

নানা পরীক্ষা শেষে পরদিন জানতে পারলাম, মেরুদণ্ডের একটা ডিস্ক সম্পূর্ণ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। অথচ তিন হাসপাতালের কেউ কিছু ঠাওর করতে পারল না! প্রায় আড়াই মাস বা কিছু বেশি সময় এই অসহ্য কষ্ট নিয়ে চলল ও। আনন্দ একদিন বলল, আব্বা কোনোদিন নিজের কষ্টের কথা বলে নি, ব্যথা শব্দটাই শুনি নি আর এখন একবারেই শুনছি বলছে ‘প্রচণ্ড ব্যাথা’।

যাই হোক, মাসখানেক ওখানে থাকাকালে একবার স্কয়ার হাসপাতাল এবং আর একবার গ্রীন লাইফ হাসপাতালে কিছু টেস্ট করতে যেতে হয়েছিল। ডাক্তাররা জানালেন মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপ্রচারের প্রয়োজন। আনিসুজ্জামান ও ডাক্তাররা দেশেই তা করার পক্ষে মত দেয়। তবে এবারও লিটু বিদেশে যাবার পক্ষে যুক্তি দেয়। চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল হবে চিন্তা করে অনেকে সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। একদিন একজন ভদ্রলোক আনিসুজ্জামানকে বললেন, ‘আমার জীবনের সব সঞ্চয় আপনার চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছি।’ এ রকম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কখনোই ভোলার নয়।

৪ এপ্রিল লিটুর ব্যবস্থাপনায় সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে রওনা হই। এবার আনন্দ আমাদের সঙ্গে যায়। লিটু শুধু মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল তা নয়, প্লেনের টিকেট থেকে শুরু করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা সবই সে করল। ৭ এপ্রিল ওর অপারেশন হলো। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক লাগল। আনন্দ ইতিমধ্যে ঢাকায় ফিরে এল আর রুচি সেখানে গেল।

ওখান থেকে ২১ এপ্রিল আমরা ঢাকায় ফিরলাম। সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন রোগীর সবকিছু ভালো আছে, কেবল হার্ট দুর্বল। ঢাকা গিয়ে যেন হার্টের ডাক্তার দেখানো হয়। ১০০ দিনের এই পরিক্রমায় আনিসুজ্জামানের ২২ কেজি ওজন কমে গেছিল। মুখের অরুচিও একটা বড় সমস্যা ছিল সেই সময়। ডাক্তাররা আপাতত বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিলেন।

সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার কয়েকদিন আগে আনিসুজ্জামান আমায় বলল, ওর আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’ এ বছরের আনন্দ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। শুনে খুশি হলাম। ঢাকায় ফেরার পর পর আমায় বলল, ‘২৮শে এপ্রিল আমাকে কলকাতায় যেতে হবে। আনন্দ পুরস্কারের জন্য।’ শুনে আমি স্তম্ভিত। আমায় বোঝাল, ‘আমি মরি-বাঁচি আমার যেতেই হবে কারণ এবার এই পুরস্কারের রজত জয়ন্তী হচ্ছে এবং আমি একজন সম্ভাব্য প্রাপক’। কী আর করি? সাহস নিয়ে গোছাতে শুরু করলাম। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার ৭ দিন পর, ২৮ এপ্রিল, আমরা কলকাতা গিয়ে, ২৯শে অনুষ্ঠান শেষ করে, ৩০শে আবার ঢাকায় ফিরি। আনন্দ আমাদের সঙ্গে গেল এবং ইডেনে আইপিএলের একটা খেলাও দেখে এল।

ঢাকায় ফিরে আসার পর সম্ভবত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ডা. সোহরাবুজ্জামানের কাছে ওকে নিয়ে গেলাম এবং বললাম, ‘সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, ওর সব ভালো আছে কেবল হার্টটা দুর্বল, মাত্র ৩৫-এ চলছে। আপনারা ঢাকায় গিয়ে হার্টের ডাক্তার দেখিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।’ ডাক্তার সাহেব পরীক্ষা করে জানালেন, আগামী সেপ্টেম্বরে ‘পেস মেকার’ বসাবেন। আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে চলে এলাম। ভাবলাম ঠিক আছে ততদিনে ওর স্বাস্থ্যর কিছুটা উন্নতি হবে এবং দুর্বলতা কেটে যাবে। তারপর নানা সমস্যার কারণে বেশ কবার ওর কাছে গেছি এবং কয়েকটা টেস্টের জন্য কয়েক দফায় পাঁচ থেকে সাতদিন ল্যাব এইড হাসপাতালে রেখে ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু কোনোবারই পেস মেকার বসানোর কথা বলেন নি। আনিসুজ্জামানও এ নিয়ে কখনো কোনো কথা বলেন নি। আর ডাক্তারদের আমি বেশি প্রশ্ন করি, সেটাও ও খুব একটা পছন্দ করত না। তাও আনিসুজ্জামানের আড়ালে জিজ্ঞেস করেছি, ‘ডা. সাহেব আবার কবে আসব? ‘সব সময় বলেছেন’, সমস্যা হলেই আসবেন। আমার মনে হয়েছে সবাই বোধ হয় আরেকটা হার্ট অ্যাটাকের অপেক্ষায় ছিল।

২০১৭ সালের ৩ জুন মুচকুন্দ দুবে (প্রাক্তন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব ও হাই কমিশনার) আনিসুজ্জামানকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানালেন ওঁর অনূদিত ও সম্পাদিত বই লালন শাহ ফকিরের গীত গানের প্রকাশনা উৎসবে। লিটু এবং লুভাকেও দাওয়াত দিলেন। সঙ্গে আমিও গেলাম। রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বইটির উদ্বোধন করেন, আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দেয় আর ফরিদা পারভিন গান করেন। আমাদের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সেই বছরের অক্টোবরে শরীর কিছুটা সুস্থ হলে জন্মদিনের স্থগিত অনুষ্ঠানটা করার সুযোগ পায় কাজল। ২৭ অক্টোবর বাংলা একাডেমিতে সেই অনুষ্ঠান হয়। মুহিত ভাই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। আনিসুজ্জামান তার বক্তৃতায় বলেছিল, ‘আমার জীবনে কোনো খেদ নেই’।

২০১৮-এর শুরুটা হয় ভালো খবর দিয়ে। কলকাতা বিশ্বাবিদ্যালয় তাকে ‘জগত্তারিণী পদক’ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আনিসুজ্জামান এই প্রাপ্তিতে অসম্ভব খুশি হয়েছিল। পদ্মভূষণ অনেক বড় পুরস্কার হলেও সাহিত্য জগতে জগত্তারিণী পদকের মুল্য অপরিসীম। এই পদক প্রতি ২ বছরে একজনকে দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে প্রবর্তিত এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তী সময়ে শরৎচন্দ্র, নজরুল এঁরাও সম্মানিত হয়েছিলেন এই পদকে। তবে এবারও অসুস্থতার জন্য নিজে উপস্থিত থেকে পুরস্কার নিতে পারে নি।

২০১৮ সালের ২৫ মে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এক বিশাল দল নিয়ে শান্তিনিকেতন যান বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের জন্য। তারপর ওখান থেকে ২৬ মে আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন ডিলিট নিতে। ফিরবেন ২৮ মে। আমার যাবার কোনো সুযোগ না থাকায় খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরে যখন বলল, ‘চিন্তা কোরো না, হাসনাত যাবে’, তখন আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। বললাম, ‘উনি গেলে আমার কোনো চিন্তা নেই।’ কারণ আগরতলাতেও দেখেছি, উনি আনিসুজ্জামানের কীভাবে খেয়াল রেখেছেন! ফেরার পথে আনিসুজ্জামানকে প্লেনে ঢুকতে দেখেই প্রধানমন্ত্রী তাকে শেখ রেহানার পাশের সিটটি দেখিয়ে বললেন ‘স্যার আপনি এখানে বসেন।’ সেই সিটে বসে থাকা মন্ত্রীকে বললেন, ‘ইয়াংম্যানরা সব পিছে চলে যাও’!

জুন মাসে সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক করে। আনিসুজ্জামান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হব সেই চিন্তাই খুব কম হতো, কারণ আমাদের সময় অধ্যাপক হতেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বিদ্বান মানুষ। আর এখন ন্যাশনাল প্রফেসর হয়ে গেলাম! আমি দেশকে যা দিয়েছি, তার অনেক বেশি দেশ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে।’

সেই বছরের আগস্টে শুচির ছেলে সায়ন জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেয়ে পড়তে চলে যায়। ওর মা সব সময় ওকে বলত, ‘বাইরে যেতে হলে নিজে ব্যবস্থা করে যাবে।’ ও তাই করেছে। আমরা সবাই ওকে নিয়ে আশান্বিত হলাম। আনিসুজ্জামান সব শুনে শুচিকে বলেছিল, ‘ওকে নিয়ে আর কোনো চিন্তা কোরো না।’ সায়ন আমেরিকা যাবার আগে আনিসুজ্জামান ওদের এবং আমাদের কাছের মানুষদের দাওয়াত করে খাওয়াল। কেউ একজন এত বড় আয়োজনের কথা বলায় ও উত্তরে বলল, ‘ওর বিয়ের সময় তো আমি থাকব না, তাই এই আয়োজন।’

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আমরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিই। ওখানের কাজ সেরে সমরেশ মজুমদারের অনুরোধে দিনাজপুরে ওর বাড়ির কাছে ডুয়ার্সের চা-বাগানে বেড়াতে যাই। চা-বাগানের নাম ছিল ‘সুহাসিনী গার্ডেন’। ৫ জানুয়ারি সকালে কলকাতা থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। ওখানে চা-বাগানের ম্যানেজার অণ্বিন্দু রায় ও রাখী এসে আমাদের তিনজনকে নিয়ে যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম আমরা গেস্ট হাউজে উঠব, পরে দেখলাম অণ্বিন্দু আর রাখীর বাসায় উঠেছি। বিশাল বাড়ি, সাজানো গোছানো এবং তার চেয়ে সুন্দর ওদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে আছে মসলাপাতি, ফল, ফুল ও ঔষধীসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ। এবং আমরা যখন গেছি তখন অনেক ফল পেকে গাছে ধরে আছে, আবার মাটিতেও পড়ে আছে। ওঁরা সব সময় আমার খোঁজখবর নেন আর আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছেন। কখনো যাবার সুযোগ হয়তো হবে কিন্তু আনিসুজ্জামান ছাড়া ওই আনন্দ তো আর পাব না। ওখানে থাকতেই ঢাকা থেকে খবর পেলাম যে আমার ছোট শাশুড়ি মারা গেছেন।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে আমার জীবনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। শুচির মেয়ে শামিলার জন্মদিন উপলক্ষে ওর বাসায় গিয়ে ওকে কিছু টাকা দিলাম। ও বলল, নানি এত টাকা দিচ্ছ কেন?’ বললাম ‘ওগো পঞ্চদশী পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে সেজন্য দিলাম।’ ও তখন বলল, ‘নানি এই টাকা যদি অন্য কোনো কাজে লাগাই তুমি কি মন খারাপ করবে?’ আমি বললাম, ‘আমি কাউকে কিছু দিলে সে যেভাবেই খরচ করুক আমি কিছু মনে করি না।’ তখন বলল, ‘আমি ঠিক করেছি আজ যা টাকা পাব তা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিয়ে দেব। তোমার কাছে ‘৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত থেকে আজ পর্যন্ত যাঁরা নির্যাতিত ও বঞ্চিত তাঁদের কথা শুনে শুনে ওঁদের জন্য আমার খুব মায়া হয়।’ কথাটা শুনেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমরা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা সংগঠন করি ‘বীর মাতাদের পাশে’। নাসিমুন আরা মিনুই সব দেখাশোনা করে। ওকে ফোনে জানালাম সব ব্যাপার এবং কখন কোথায় টাকাটা পাঠাব জানতে চাইলাম। ও শুনে খুব অবাক হয়ে বলল, ‘ভাবি আমি ওর হাত থেকে নেব। যেখান থেকেই হোক।’

আমাদের বাসায় একদিন সবাইকে ডাকলাম। মিনু ও রোজী একগুচ্ছ ফুল দিয়ে ওর কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে ওকে আশীর্বাদ করে চলে গেল। রাতে আমায় ফোন করে জানাল, ‘ভাবি আপনি যা বলেছিলেন তার থেকেও বেশি টাকা আছে।’ পরে শামিলার কাছে ফোন করে জানতে পারলাম, আর একজন যা দিয়েছেন সেগুলোও দিয়ে দিয়েছে। আমি মিনুকে তা জানিয়ে দিলাম।

১৮ ফেব্রুয়ারি আনিসুজ্জামানের ৮২তম জন্মদিন উদ্যাপিত হলো। তার ১০ দিন পর আমার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে আনিসুজ্জামান আর ছেলে-মেয়েরা অনেক বড় অনুষ্ঠান করে। এর কিছুদিন পর খবর পেলাম সার্ক সংস্কৃতি কেন্দ্র আনিসুজ্জামানকে ২০১৯ সালের ‘সার্ক সাহিত্য পুরস্কার’ দিবে। আনন্দসহ আমরা ভুটান যাবার সব প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু খবর এল রাজার কোনো আত্মীয়ের মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে, অতএব অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে।

জুন মাসে আনন্দ আমেরিকা বেড়াতে যাবার পর জানা গেল, ও যেদিন ফিরবে সেদিনই এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। ফলে ওকে ছাড়াই আমরা জুনের শেষে ভুটান গেলাম। এর আগে ১৭ জুন আমার মেজ ননদ মারা যান। আর ওঁর বড় মেয়ে সেই সময় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ছিল। সেও ৩০ জুন মারা যায়। মায়ের মৃত্যুর খবর সে জানতেও পারল না, আর দুই সপ্তাহের ব্যবধানে সে চলে গেল মায়ের কাছে।

এই দুই মৃত্যুর মাঝে আমরা ২৩ জুন থিম্পু যাই। কী মনে করে আনিসুজ্জামান আমাকে বলল, ‘এই আমার শেষ বিদেশ যাত্রা।’ হলোও তাই। এবং বিদেশে পাওয়া শেষ পুরস্কারও ছিল এটি। নভেম্বরে পাওয়া ‘খান বাহাদুর আহছানউল্লা স্বর্ণপদক’ ছিল তার জীবনের শেষ আনুষ্ঠানিক প্রাপ্তি।

ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমির ৬৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শেষ স্মারক বক্তৃতা দেয়। এই বয়সেও প্রতিদিন ওর দুই-তিনটা অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। সেই সঙ্গে দাওয়াত তো থাকতই। দিনশেষে যখন ঘরে ফিরত, এক একদিন ওর ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকানো যেত না। ঘরে ঢুকে পা টেনে টেনে হাঁটত।

মনে পড়ে, ২৯ জানুয়ারি সকাল ৯.৩০টায় বের হয়ে, ১১টায় একটা মিটিং সেরে, দুপুরে বাইরে খেয়ে আবার ৪টায় মিটিং করে, ৭টা থেকে দাওয়াত খেয়ে রাত ১১.১৫তে বাসায় ফিরেছে। আমি শুচির বাসায় ছিলাম। কথা ছিল ফেরার সময় আমাকে ও নিয়ে আসবে। কিন্তু সে ভুলেই গেছে যে আমাকে নিয়ে যাবে। কোনোদিন এরকম ভুল হয় না। পরে বুঝলাম শরীর এতই খারাপ ছিল যে আমায় নিয়ে যাবার কথা বলতে পারে নি। রাত বেশি দেখে আবুল হোসেনকে যখন ফোন করলাম তখন ও বলল, ‘খালাম্মা স্যারকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গাড়িতে থাকা অন্যদের পৌঁছাতে যাচ্ছি। ওঁদের নামিয়ে দিয়ে আপনাকে নিয়ে আসব। রাত ১১.৪৫-এ বাসায় এসে দেখি, আনিসুজ্জামান আধা অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। কোনো কথা হলো না। সকালে উঠে মাঈনুকে যখন জিজ্ঞেস করলাম ওর কথা, তখন বলল, ‘নানা কোনো রকমে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে ভীষণ হাঁপাচ্ছিলেন। কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। পানি খাবেন কিনা তারও উত্তর দিতে পারেন নি। কিছুক্ষণ পর যখন জিজ্ঞেস করলাম পীঠ টেনে দেব কিনা তখন মাথাটা সামান্য নাড়িয়ে রাজি হলেন। একটু পরে যখন পানি ও ওষুধের কথা বললাম তখন শুধু পানি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। নানাকে এই অবস্থায় কখনো দেখি নি।’

মাঈনুর কাছে সব শুনে মনে হয়েছিল, আমাদের ভাগ্যের জোরে ওকে আর কিছুদিন পেলাম নয়তো সেদিনই শেষ হয়ে যেত। ৮৩ বছরের একজন মানুষ যদি সকাল ৯.৩০টায় বাসা থেকে বের হয়ে রাত ১১.১৫তে বাসায় ফেরে, তাহলে তার এ অবস্থা হওয়াটাই স্বাভাবিক। দিনের পর দিন এভাবে চলেছে। সকালে আমি কিছুই বলি নি। সারা জীবন যেমন ধৈর্য ধরে ছিলাম আজও তাই করলাম। অনেক আগে একবার ওকে বলেছিলাম ব্যস্ততা কমাতে। তখন বলেছিল, ‘অনেকদিন বেঁচেছি, তাছাড়া মানুষেরও একটা প্রত্যাশা আছে আমার কাছে। সুতরাং এভাবেই চলতে চাই।’ আমিও আর বেশি কিছু বলি নি।

এর ২/৩ দিন পর, ২ ফেব্রুয়ারি, বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গেল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরল। আনিসুজ্জামান হাঁপাচ্ছে দেখে উনিও নাকি বলেছিলেন ‘স্যার আপনি আর হেঁটেন না!’ কিন্তু উনি গাড়িতে না উঠা পর্যন্ত ও তাঁকে সঙ্গ দিল। উনি চলে যাবার পর পর ও আর হাঁটার মতো অবস্থায় ছিল না। উপস্থিত সকলে একটা চেয়ার এনে ওকে গেটের কাছেই বসিয়ে দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল হলে আনন্দ এসে দেখে, একটা ছোট জটলা আর আনিসুজ্জামান মাঝে বসে আছে। আর ও কোনো কথা বলতে পারছে না। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ আনন্দকে বললেন, ‘এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ শেষদিকে এত বেশি ও নিয়মিত হাঁপাত যে আনিসুজ্জামান আর আনন্দ তেমন গুরুত্ব দিল না। তবে অন্যরা খুব ঘাবড়ে গেছিল।

৪ তারিখে স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হলো। অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পর আনিসুজ্জামান হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করায় আমরা বাসায় চলে এলাম। বুঝলাম খুবই খারাপ লাগছিল নয়তো প্রিয় বন্ধুর এই অনুষ্ঠান ছেড়ে ওর আসার কথা না। পরদিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ায় তিনি আবারও ভর্তি হতে বললেন। আনিসুজ্জামান জানাল, ৭ ফেব্রুয়ারি বুয়েটের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি সে। তাই এর আগে ভর্তি হওয়া সম্ভব না। ফলে ৭ তারিখ বুয়েট অ্যালামনাই অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি এসে খাওয়া-দাওয়া সেরেই বিকেলে ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি হলো। ৮ তারিখে দিল্লীর একজন ডাক্তারকে নিয়ে ডা. সোহরাবুজ্জামান ওর হার্টের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন যে উনি এপ্রিলে ঢাকা এলে ওর অপারেশান করবেন। করোনা আর লক ডাউনের কারণে সেই সুযোগ আর মিলল না।

 ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে বাসায় ফিরে আবার একের পর এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে থাকল। ১৮ তারিখ ওর জন্মদিন থাকায় সেই উপলক্ষেও নানা দাওয়াতে অংশ নিল। মারুফ ১৭ তারিখ বড় আয়োজন করল। ১৯ তারিখ নবা ভাইও বিশাল আয়োজন করলেন। আমরাও ১৮ তারিখ বাসায় পারিবারিকভাবে সামান্য আয়োজন করলাম। যদিও সারাদিন লোকজনের যাওয়া-আসা লেগেই ছিল।

৮ মার্চ সকালে বাংলা একাডেমিতে ওর সভাপতিত্বে শেষ ভাষণ দিয়ে ফিরে আসে। ১৬ মার্চ গুলশান ক্লাবে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ উদ্বোধন করে। এটাই সম্ভবত তার অংশ নেয়া শেষ অনুষ্ঠান ছিল। এর পর পরই করোনার কারণে লক ডাউনের ঘোষণা আসে, ফলে আর তেমন কোনো অনুষ্ঠানে যাবার সুযোগও হলো না। এপ্রিলের ৫ তারিখে আবার ল্যাব এইডে ভর্তি হলো। ২/৩টি পরীক্ষার জন্য। ৬ দিন সেখানে থেকে আবার ফিরে আসে। প্রতিবারের মতো এবারও ফিরে আসার পর কিছুদিন একটু ভালো ছিল, কিন্তু আবারও সেই একই অবস্থা হলো।

২৫ এপ্রিল সকাল থেকে কিছু খেল না। বেশি কষ্ট হওয়ায় পরদিন আনন্দকে বলল, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফোন করে ডা. আশীষকে ওর অবস্থা জানিয়ে কাউকে পাঠাতে। উনি এলেন কিন্তু তেমন কোনো কাজ হলো না। রাত ১২টা পর্যন্ত খুব অস্থিরতা প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে পারকিনসন্স-এর জন্য ওর হাত-পা খুব জোরে জোরে কাঁপছিল। কিছুক্ষণ ধরে রেখেছিলাম ওকে। রাত ৩টার দিকে আবার উঠে খুব অস্থিরতা প্রকাশ করছিল। সকালে (২৭ এপ্রিল) আনন্দকে বলল, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স আনতে। অ্যাম্বুলেন্স এল এবং হুইল চেয়ারে করে ওকে এত দ্রুত নিয়ে গেল যে আমি জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে যাবার অবকাশ পেলাম না। জীবনে এই প্রথম আমি ওর সঙ্গে হাসপাতালে গেলাম না।

ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে ওকে দুইদিন রাখার পর একটু সুস্থ হলে কেবিনে আনে। ওখানে ২/৩ দিন থাকে। একদিন ওকে খাওয়াতে গিয়ে খাবার লাংস-এ চলে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি আবার সিসিইউতে নিয়ে যাওয়া হলো। সিস্টারের সঙ্গে একটু রাগ করলেন ডাক্তার সাহেব। ওরা সঙ্গে সঙ্গে সিসিইউতে নিয়ে গিয়ে রাইসটিউব দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। শুচি কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, ‘আব্বাকে টিউব দিতেই আব্বা চিৎকার করছিল। আমি একটু অস্থির হয়েছিলাম বলে ডাক্তার সাহেব আমাকে চলে আসতে বললেন।’ মনে কষ্ট চেপে দুজনে চুপ করে বসে থাকলাম। ওখানে ওর খুব কষ্ট হয়েছে। একদিন গিয়ে দেখি মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া, হাত দুটো বিছানার সঙ্গে বাঁধা, রাইসটিউব লাগানো, কথা বলার চেষ্টা করছে। সিস্টারকে বলে কথা বলার ব্যবস্থা করলাম। খুব আকুলভাবে বলল, ‘আমাকে ডাক্তাররা ছেড়ে দেবেন বলেছেন, আমায় তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে চলো।’ বললাম, ‘কেমন করে যাবে? তোমার শরীরে এত যন্ত্রপাতি লাগানো আছে! বলতে বলতে আমারও কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। এই হাসপাতালে ওঁরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন নিজেদের ডাক্তার এবং বাইরে থেকে ডাক্তার আনিয়ে। আনিসুজ্জামান ধীরে ধীরে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছেলে, মেয়ে, জামাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল অন্য কোনো হাসপাতালে নেওয়ার। সবাই চাপ দেওয়ায় আমরা পারিবারিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তী সময়ে ৯ মে সি.এম.এইচ-এ স্থানান্তরিত করি। ডাক্তাররা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের আশার আলো দেখালেও একজন ডাক্তার আনন্দকে ডেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে বললেন, আপনার আব্বা ‘রেড জোনে’ আছেন। ১২ তারিখ থেকে আনিসুজ্জামান বুকে ব্যথার কথা বলছিল। ১৩ তারিখ থেকে অবস্থার অবনতি ঘটল। ওই রাতেই ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। সকালে একদিন রুচি একদিন শুচি যাচ্ছিল। সেদিন শুচি পৌঁছে আমায় ওর অবস্থা জানানোর পর আমার মন ভেঙে গেল, শঙ্কিত হয়ে পড়লাম শুচির কাছে শুনে যে বারবার পানি চেয়েছে আর ওর হাতটা বুকে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে বলেছে। আনন্দ খবর শুনে অন্যদিনের তুলনায় আগেই বের হয়ে পড়ল। ওখানে আনন্দ পৌঁছাবার পর শুচি বাসায় ফেরত গেল। আর আমি একটু পর যাবার প্রস্তুতি নেবার সময় আনন্দ জানাল ওকে সিসিসি-তে (ক্রিটিকাল কেয়ার সেন্টার) নিয়ে যেতে হবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে ওখানে পৌঁছে দেখি আনিসুজ্জামান নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম, ‘আমি এসে গেছি’ আমায় দেখে সে চোখটা বন্ধ করল। তার ৫ মিনিট পরেই ওকে অতি দ্রুত সিসিসিতে নিয়ে যাওয়া হলো। ওটাই আমার সঙ্গে ওর শেষ দেখা।

আমি আর আনন্দ সিসিসি-র বাইরে বসে থাকলাম। আনন্দ বোনদের খবর দিল এবং চলে আসতে বলল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তাররা আনন্দকে ডেকে জানালেন একাধিক অ্যাটাক হয়ে গেছে এবং তারা যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে আমরা বুঝতে পারছিলাম যে সম্ভাবনা কমে আসছে। একটু পর ডাক্তাররা সংকোচের সঙ্গে জানালেন, তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। ৪:৪৫-এ আমি তিন ছেলেমেয়ে ও রায়হানকে নিয়ে সিসিসি-র ভেতরে ঢুকে আনিসুজ্জামানকে অচেতন অবস্থায় দেখলাম। তারা জানালেন, ১০ মিনিট পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর রেফেরেন্সে ওখানে ভর্তি ছিল, তাই ইতিমধ্যে তাঁর অনুমতি চাওয়া হয়েছে। এখন তাঁরা পরিবারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আমরা সম্মতি দিলাম। বর্ণহীন হতে শুরু করলো আমার বিপুলা পৃথিবী।

শেষপর্ব

Leave a Reply

Your identity will not be published.