উতল হাওয়া (পর্ব ১৪)

উতল হাওয়া (পর্ব ১৪)

[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন ১৪তম পর্ব...]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব  

ষষ্ঠ পর্ব  সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব  নবম পর্ব দশম পর্ব 

পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩

শেখ মুজিব ফারলেন্ডকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। মুজিব ফারলেন্ডকে একে একে তার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তাজউদ্দীন আহমেদ, নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, কামাল হোসেন, খন্দকার মোশতাক প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফারলেন্ড সব উপদেষ্টাদের সাথে করমর্দন করলেন। একমাত্র খন্দকার মোশতাককে এ সময় খুব বিগলিত মনে হলো, বাকিরা সবাই গম্ভীর। তাজউদ্দীন আহমেদের গম্ভীরতা যেন একটু বেশি। তাজউদ্দীন ভালোভাবেই জানেন ফারলেন্ড কেন এসেছেন। আওয়ামী লীগের এই অসহযোগ আন্দোলন আমেরিকা ভালো চোখে দেখছে না।

ইন্ডিয়া বহু আগে থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ের দিকে ঝুঁকে আছে। এ সময় ইস্ট পাকিস্তানের কোনো আন্দোলনকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে হলো ইন্ডিয়া আর রাশিরার হাতকে শক্তিশালী করা। নিক্সন আর হেনরি কিসিঞ্জার চাইছে পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চায়নার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে। এজন্যে এ সময় ইয়াহিয়ার হাতকে শক্তিশালী করা খুব প্রয়োজন।

ফারলেন্ড শেখ মুজিবের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু শেখ মুজিব পার্টির সেক্রেটারি তাজউদ্দীনকে ছাড়া ফারলেন্ডের সাথে কথা বলতে রাজি হলেন না। অগত্যা ফারলেন্ড দুজনের সঙ্গেই নিভৃতে বসলেন।

ফারলেন্ডে গলা খানিকটা পরিষ্কার করে বললেন, দেখুন মিঃ মুজিব, আমি নিজেকে আপনাদের পূর্ব-পাকিস্তানের একজন অত্যন্ত কাছের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করি। যদিও আমি এক হাজার মাইল দূরে থাকি কিন্তু আপনাদের সব খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখি। আপনার নিশ্চয়ই মানে আছে গত বছর আপনাদের ভয়াবহ বন্যার সময় আমি ইসলামাবাদ থেকে এখানে এসে সাত দিন ছিলাম। আমি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দুর্গত এলাকার জন্যে খাদ্য, ওষুধ এবং জরুরি ত্রাণ পাঠাতে অনুরোধ করি। আমেরিকার বিমান ঘাঁটি থেকে পাঁচটি বিমান এসেছিল জরুরি ত্রাণ নিয়ে। 

মুজিব বললেন, হ্যাঁ আপনার তখনকার অবদানের কথা আমার মনে আছে। থ্যাংক ইউ এগেইন অ্যান্ড থ্যাংকস মিঃ ব্লুাড ফর ইউর কাইন্ড হেল্প।

নো মেনশন মিঃ মুজিব। আমেরিকা সব সময় অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে আছে।

তাজউদ্দীন ফারলেন্ডের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আর যদি ইয়াহিয়ার একগুঁয়েমির কারণে আমরা খণ্ডিত হয়ে যাই?

তাজউদ্দীনের আচমকা এই কথার উত্তরে ফারলেন্ড কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তিনি কাটায় কাটায় ৩০ সেকেন্ড সময় নিলেন। এ সময় তাকে খুব বিচলিত দেখাল। ফারলেন্ড নিচু গলায় বললেন, উই মে নট রেকগনাইজড ইউ ইফ ইউ ব্রেক আপ ফ্রম ওয়েস্ট। আই নো ইউর ‘ছয় দফা’ অ্যান্ড ‘এগারো দফা’ বাট এগেইন উই মে নট রেকগনাইজ ইউ ইফ ইউ ব্রেক আপ।

তাজউদ্দীন মুচকি হেসে বললেন, ইটস নট ইউ অর মি টু ডিসাইড, ইটস আওয়ার পিপল টু ডিসাইড এবং কারা থাকবে কারা যাবে সেটা আমাদের জনগণ অলরেডি ডিসাইডেড। ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০ আসনে উইন করেছে। হোয়াট এলস ইউ ওয়ান্ট?

আই ওয়ান্ট এ পিসফুল সল্যুশন।

তাজউদ্দীন ফারলেন্ডের চোখে চোখ রেখে বললেন, উইদাউট ডেমোক্রেসি দেয়ার উইল বি নো পিস মিঃ ফারলেন্ড। ইউর ফাউন্ডিং ফাদার মিঃ আব্রাহাম লিংকন সেইড, ডেমোক্রেসি ইস দ্য গভরনমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল।

তাজউদ্দীনের কথা শুনে ফারলেন্ড হেসে ফেললেন। তিনি বুঝে গেছেন এ মানুষ অন্য ধাতুতে গড়া। শারাব আর নারী নিয়ে উন্মাদনায় মেতে থাকা পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ আর জেনারেলদের মতো ইস্ট পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা নয়। এরা শিক্ষিত এবং ত্যাগী রাজনীতিবিদ। তবু এ মুহূর্তে যে ভাবেই হোক অখণ্ড পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য দরকার দু’ পক্ষের আলোচনা। এর কোনো বিকল্প নেই। সে জন্যেই আজকের দিনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। 

ফারলেন্ড এবার কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, আই হোপ ইউ নো ভেরি ওয়েল হোয়াই আই এম হিয়ার। আমি আমার দেশের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে যে বার্তাটি নিয়ে এসেছি সেটা হলো- আজ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সামরিক বাহিনী যদি গুলি চালায় তাহলে আমরা সেটিকে ওয়েস্ট পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নবাদীদের দমন করার একটা অভিযান হিসেবেই দেখব। শুধু আমেরিকা নয়, আমেরিকান এলায়েন্স এবং সারা পৃথিবী এটাই জানবে। ডোন্ট গো সো ফার অ্যান্ড ডোন্ট ডিক্লিয়ার এনি থিং... ফ্রম হয়ার ইউ কান্ট ব্যাক।

ফারলেন্ডের কথা শুনে শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে গেলেন, হুঙ্কার দিয়ে বললেন, আর ইউ ট্রাইং টু থ্রেটেন মি?

ফারলেন্ড দাঁড়িয়ে মুজিবের হাত ধরে বললেন, নো মিঃ মুজিব, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি আলোচনার পথটি যেন খোলা থাকে, সেটি যেন বন্ধ হয়ে না যায়। আরেকটি শেষ কথা, সেটি আমি কেবল আপনাকেই বলতে চাই।

ফারলেন্ডের কথা শুনে, মুজিব তাজউদ্দীনের দিকে তাকালেন। তাজউদ্দীন মুজিবকে চোখের ইশারায় সম্মতি দিয়ে ব্লাডকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ফারলেন্ড মুজিবের হাত ছাড়েন নি। তিনি এবার দুহাতে মুজিবের হাতখানি চেপে ধরে বললেন, আর্মিরা খুব ব্রুটাল হয় ইউ নো দ্যাট, তাদের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে। আনফরচুনেটলি পাকিস্তান শাসনভার এখন আর্মিদের হাতে। আমরা চাই না আরেকটা জালিয়ানবাগের মতো কাণ্ড এখানে ঘটুক। আরেকটি শেষ কথা...ইফ...ধরুন যদি পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যায়... আমি আশা করছি যাবে না...কিন্তু যদি যায়...আমি জানি আপনি একজন নির্ভীক গ্রেট লিডার, আপনি বহুদিন জেল খেটেছেন, জেল জুলুমের তোয়াক্কা করেন না। ইফ সামথিং হেপেন ওয়ার্স তাহলে আপনি যেন পালিয়ে যাবেন না। অন্যেরা যাক, আপনি যাবেন না। আমরা আপনাকে প্রোটেক্ট করব। গুডলাক মাই ফ্রেন্ড...এই বলে ফারলেন্ড আর দাঁড়ালেন না।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.