অষ্টগ্রামের পথে। মোমিন রহমান

অষ্টগ্রামের পথে। মোমিন রহমান

ডেস্কে বসে কাজ করছিলাম, এমন সময় মোবাইলটি বেজে উঠল। কলটি রিসিভ করতেই শুনলাম, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছিস?’ পরিচিত কণ্ঠস্বর। বন্ধু কুফিয়া। বললাম, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। তুই?’ কুশল বিনিময়ের পর কুফিয়া বলল, ‘এই শুক্রবার বাজিতপুর যাচ্ছি। সেখান থেকে হাওড় পেরিয়ে যাব অষ্টগ্রাম। সঙ্গে বাবুও থাকবে। যাবি নাকি?’

মাথায় ভাবনার তরঙ্গ খেলে গেল। অষ্টগ্রাম মানে কিছুদিন আগে যে সড়ক উদ্বোধন হলো। আর ওই সড়কটির বেশ কিছু অংশ চলে গেছে হাওড়ের ওপর দিয়ে। বেশ ইন্টারেস্টিং! কিন্তু শনিবার অফিসে জরুরি কাজ আছে। ছুটি নেয়া যাবে না। তাই বললাম, ‘পরে জানাচ্ছি।’


শুক্রবার। সকাল ৮.৩০। ধানমন্ডি।

২৭ নম্বর সড়কের প্রবেশমুখে, রাপা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কাঁধে একটি ব্যাগ। কুফিয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।

হ্যাঁ, বাজিতপুর যাচ্ছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামীকাল ব্যাক করব। কুফিয়া জানিয়েছে, ওর দোকানের এক কর্মচারীও ঢাকায় ফিরবে।

এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। রাস্তা পেরিয়ে ওপারে যাচ্ছি, পেছনে পরিচিত কণ্ঠস্বর ‘মোমিন...।’

ফিরে দেখি, বাবু। ইকবাল বাবু। মঞ্চ-টেলিভিশন-চলচিত্রের পরিচিত মুখ। আমাদের আরেক বন্ধু।

অগত্যা ফিরে এলাম। দেখলাম, বাবুর সঙ্গেও ব্যাগ। বেশ বড়সড়।

বাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে আবার রওনা দিলাম। রাস্তার ওপারে গিয়ে লালমাটিয়ার একটি জেনারেল স্টোর থেকে চিপস এবং দুটি মামের বোতল কিনলাম। নিরিবিলি এক কোণে মুখের মাস্ক সরিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেলাম।

কুফিয়া এল সাড়ে নয়টায়। বাবু-আমি ঝটপট গাড়িতে উঠে পড়লাম। জানা গেল, ব্যাক পেইনের জন্য গভীর রাতে কুফিয়ার ঘুম এসেছে। সকালে উঠতে দেরি হয়েছে। তাই এই বিলম্ব।

গাড়ি ছুটে চলল। সংসদ ভবন, চন্দ্রিমা উদ্যান, পুরোনো এয়ারপোর্ট রোড, মহাখালী ব্রিজ পেরিয়ে উত্তরা অভিমুখে।

শুনতে পাচ্ছি কুফিয়া বলছে, ‘আমার ছেলে গুরুতর অ্সুখ। চিকিৎসায় কোনো ফল হচ্ছে না। আমি এক পীরের কাছে গিয়ে বললাম, বাবা, আমার ছেলেকে বাঁচান। এ হলো শিরক। গুনাহর কাজ...।’

কুফিয়া সত্যিকারের মোমিন বান্দা। এক ওয়াক্ত নামাজ ওর মিস হয় না। কোরআন-হাদিসের নানা কথা সে জানে আর এ বিষয়ে বলতেও সে ভালোবাসে। ওর কথা শুনতে শুনতে কখন যে গাড়ি পূর্বাচলের ৩০০ ফিট পেরিয়ে ভুলতায় চলে এসেছে, জানি না। গাউছিয়ার ব্রিজ অতিক্রম করার সময় কুফিয়ার মোবাইল বেজে উঠল।

‘হ্যাঁ, বুলবুল ভাই বলুন। আপনারা এখন আড়াই হাজারে?  কী বললেন, নরসিংদীর ভেলানগরের ব্রিজ পেরিয়ে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করব? ঠিক আছে।’

কথা শেষ করে কুফিয়া জানাল, ওর তিনজন ব্যবসায়ী বন্ধুও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে। তারা আরেকটি গাড়িতে যাত্রাবাড়ি থেকে রওনা দিয়েছিল, এখন তারা আড়াই হাজারে।

গাড়ির বাইরে সবুজ-প্রকৃতি। বিরান প্রান্তর। মাঝে মাঝে মিল-ফ্যাক্টরি।

মাধবদী, শেখের চর পেরিয়ে আমরা এখন নরসিংদীর পাঁচদোনার চৈতাবায়। এখানে ৩৭ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে ড্রিম হলিডে পার্ক। বিনোদনের একটি স্বর্গরাজ্য।

পাঁচদোনা বাজার। এখানে রয়েছে পবিত্র কুরআনের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ি।  ২ দশমিক ২২ শতাংশ জায়গায় এই বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি জাদুঘর। বছরখানেক আগে এখানে এসে আমি এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছিলাম। পার্ক দেখার পাশাপাশি ইতিহাস-ঐতিহ্যের আধার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ি দর্শন করেছিলাম।

ভেলানগরে ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি থামে। কুফিয়া ফোনে কথা বলে। ওপাশ থেকে বুলবুল সাহেব জানান, তারা অপেক্ষা না করে ঢাকা-সিলেট রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা তাই সামনে এগোই। ইটাখোলায় আসি। ডানদিকে ঢাকা-সিলেট রোড। বাম দিকে শিবপুর।

গাড়ির চালক, লোকমান, সে বলে, ‘বাম দিকে একটি শর্টকাট রাস্তা আছে। এখান দিয়ে গেলে আমরা ফরিদপুর রোড হয়ে কুলিয়ারচরের বাজরা পার হয়ে বাজিতপুরে পৌঁছে যাব।...যাব কি?’

কুফিয়া সবুজ সংকেত দিতেই লোকমান বামদিকের পথে অগ্রসর হয়। এক সময় আমরা পৌঁছে যাই বাজিতপুরের কাছে, একটি সড়কে। চোখে পড়ে সাইন বোর্ড—‘জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ’। আমরা সেই পথে না গিয়ে অন্য পথে ঢুকি। অতঃপর ডানদিকে মোড় নিয়ে আরেক পথে, উজানচরে। এটি সোজা চলে গেছে বাজিতপুর।


পাটুলিঘাট। বাজিতপুর। দুপুর ১২.৫০।

কুফিয়ার ব্যবসায়ী বন্ধুরা এসেছে। বুলবুল, শাহ আলম ও আবেদ। তাদের সঙ্গে আলাপ করে ভালো লেগেছে। তারা এখন ঘাট সংলগ্ন এক দোকানে ঢুকেছে। পানি আর চিপস কেনার জন্য। বাবু ও কুফিয়া এদিক-সেদিক ঘুরছে। কেউ কেউ প্রকৃতির ডাকেও সাড়া দিয়ে এসেছে।

আমি ভাবছি, যে মাটিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেটি বেশ উর্বর। কেননা কিশোরগঞ্জ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনাসহ বিভিন্ন ছোটবড় অসংখ্য নদ-নদীর পলল বিধৌত বেলে দো-আঁশ বা এটেল মাটি দিয়ে গঠিত। ২২৮৮.৬২ বর্গকিলোমিটারের এই জেলার রয়েছে সোনালি ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এক সময় এটি কামরূপ রাজ্যের অধীন ছিল। অতঃপর পাল-বর্মণ-সেনদের রাজত্বের পর দ্বাদশ শতাব্দীতে এখানে কোচ, হাজং, গারো, রাজবংশী প্রভৃতি আদিম সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের পত্তন হয়। ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মোঘল শাসকদের হাতে এগারো সিন্ধুর অহম রাজার পরাজয় ঘটে এবং ১৫৮০-তে  ঈসা খানের কাছে জঙ্গলবাড়ির কোচ প্রধান পরাজিত হন। ফলে তখন পুরো কিশোরগঞ্জ জুড়ে ঈসা খানের প্রবল আধিপত্য ছিল। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, এগারো সিন্ধুতে বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈসা খানের সঙ্গে মুঘল সেনাপতি মানসিংহের যুদ্ধ ও পরাজয়ের কাহিনি। ...কিশোরগঞ্জে সঙ্গে-ছিটিয়ে আছে নানা দর্শনীয় স্থান। মন্দির, মসজিদ, প্রাচীন স্থাপনা। এখানকার কটিয়াদি থানার মসুয়া গ্রাম বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর জন্মস্থান।

‘কী ভাবছিস?’

কুফিয়ার কথা শুনে সংবিত ফিরে আমার। দেখি বাবুসহ অন্যরাও জড়ো হয়েছে। বলি, ‘না, তেমন কিছু না। তা কখন রওনা হব আমরা?’

‘এই তো, লোকমানরা ফিরে এলেই।’

গাড়িচালকদের কথা বলছে কুফিয়া। আশ্বস্ত হই। তখনই গাড়ির শব্দ কানে আসে। তারপরই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে দুটি গাড়ি আমাদের অদূরে থামে।

লোকমান নেমে আসে। দরজা লক করে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অন্য গাড়ির চালকও। এদিকে কুফিয়ার অফিস এক্সিকিউটিভ, পরান, সে-ও আমাদের সঙ্গী হয়।

আমরা ঢালু পথে নেমে ঘোড়াউতরা নদীর তীরে দাঁড়াই। কুফিয়ার রিজার্ভ করা একটি বজরায় উঠি।

বজরাটি তিন স্তরের। পাটাতনের নিচে শ্যালো-মেশিন। ওপরে যাত্রীদের বসার জায়গা। এর ওপরে ছাদ। আমরা সবাই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সেখানে গিয়ে বসি। কেউ প্লাস্টিকের চেয়ারে, কেউ নিচে বিছানো পাটিতে। উপরে শামিয়ানা। তাই খর রোদেও প্রশান্তি বোধ করি। আর যখন বজরা চলতে শুরু করে, তখন সেই প্রশান্তি আরও গাঢ় হয়। মাস্ক খুলে ফেলি। দীর্ঘ সাত মাস পরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে বুকভরে শ্বাস নিই।

বুলবুল সাহেবদের কিনে আনা চিপস এবং পানির সদ্ব্যবহার হয়। রাক্ষুসে ক্ষুধার উপশম ঘটে।

কুফিয়া সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়ে। আমি শামিল হই না। কেননা উন্মুক্ত স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় পানি বা কুলুখ ব্যবহার করা হয় নি। ওরা জোহর ও আসর ওয়াক্তের ফরজ নামাজ একসঙ্গে আদায় করে (পরে কুফিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, নবিজি ভ্রমণকালে দুই ওয়াক্তের নামাজ একসঙ্গে পড়তেন। তাই এমনটি করা যেতেই পারে)। তখন এক অপরূপ দৃশের সৃষ্টি হয়— উন্মুক্ত আকাশের নিচে, অন্তহীন জলের মাঝে একদল মানুষ সৃষ্টিকর্তার ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন। তাদের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত হতে পারলাম না বলে গ্লানি বোধ করি।

নামাজ পড়ে সবাই ছবি তোলায় মেতে ওঠে। বাবু ভিডিও করে। কেউ কেউ চারপাশের প্রকৃতিকে উপভোগ করে। আমিও। দেখি, চারদিকে শুধু জল আর জল। মাঝে মাঝে জেগে ওঠা একটুকরো ভূখন্ড, যা দ্বীপের মতো মনে হয়। আসলে বর্ষাকালে কিশোরগঞ্জে নদী আর হাওড় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার হাওড়গুলো জেগে উঠছে। ...চারদিকে জলের মাঝে এমনই একটি জায়গা দেখে আমি চমকে উঠি। ঘাস, গাছ; ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে; উঁচু একটি স্থানে এক ঘর। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি, ‘এ যে মনপুরা ছবির মতো।’

কথাটি সবাই শুনতে পায়। বাবু’র মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে জলের কাছে গিয়ে ছবি তোলে। সামনের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে। যেন সে-ই মনপুরার সোনাই, পরীর দিকে হাত বাড়িয়েছে।

আমার মধ্যেও ছেলেমানুষি জেগে ওঠে। আমিও নিজেকে ক্যামেরাবন্দি করি। অনুকরণ করি বাবুকে।

ছাদে উঠে আবার প্রকৃতির মাঝে মগ্ন হই। হ্যাঁ, আমরা এখনো বাজিতপুরে আছি। বজরার নিচে হুমাইপুর হাওড়। এখান থেকে নিকলী পর্যন্ত নানা জায়গায় নানা হাওড়। যেমন, অষ্টগ্রামের সোমাই হাওড়, মিঠামইনের বাড়ির হাওড়, নিকলী-বাজিতপুর-অষ্টগ্রামের তল্লার হাওড় ইত্যাদি।

মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বাড়িঘর। উঁচু জায়গার এইসব বাড়ির প্রান্তে ইটের গাঁথুনি। বন্যা আর বর্ষার প্রবল জল থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা। এইসব বাড়ির কম বয়সী ছেলেমেয়েরা কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখে। নারীরাও ঘরকন্নার কাজ করতে করতে আড় চোখে তাকায়। তবে বেশির ভাগ পুরুষই নির্বিকার। 

একটি বড় জায়গাকে পাশ কাটায় বজরা। দেখতে পাই, মসজিদ-বাজার-বাড়িঘর।... জলের দিকে দুই সীমন্তিনী। কাপড় ধোবার সময় তাদের শুভ্র শাঁখা নড়ে ওঠে। ...একটি বাড়ির উঠোনে এক তরুণী তার আজানুলম্বিত কেশ রোদে শুকাচ্ছে।

অন্তহীন জল পেরিয়ে বজরা এগিয়েই চলে। দেখি দুই গ্রাম্য বালিকার অবাধ সাঁতার। একদল বালকের দুরন্তপনা। একটি নৌকায় রঙিন ছাতার নিচে বসে আছে এক কিশোর। বাতাসে তার পাঞ্জাবির হাতা দুলছে।

চোখে পড়ে বিশাল চিংড়ির ঘের। প্রচুর মাছ এখান থেকে পাওয়া যায় সন্দেহ নেই। এইসব চিংড়ি রপ্তানিও হয়। বিদেশি মুদ্রার একটি উৎস। আর শীতকালে হাওড়ে জল সরে গেলে সেখানে উৎপাদিত হয় শস্য আর নানা ধরনের সবজি।

আমরা হাওড়-নদীর আরও প্রসারিত স্থানে যাই। আকাশে ওড়ে গাংচিল। জলে পরিযায়ী পাখির দল। এক সময় চোখে পড়ে, দুই রঙের পানির ধারা। কুফিয়ার কর্মচারী পরান বলে ওঠে, ‘পদ্মা ও মেঘনা এখানে মিশেছে।’

আমি ওর কথা কান পেতে শুনি। আমার চেতনায় ভেসে ওঠে কিশোরগঞ্জের আরও কয়েকটি নদীর নাম—কালনী, নরসুন্দা, ধনু, ঘোড়াউতরা, পিয়াইন...। 

এক সময় পরানের চিৎকার শুনতে পাই—‘ওই তো নতুন রাস্তা!’


অষ্টগ্রাম। বিকেল ৩.২৫।

গন্তব্যস্থলে কিছুক্ষণ আগে আমরা পৌঁছেছি। কুফিয়ারা ব্যাটারি-চালিত সিএনজিচালকদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কথা বলছে।

আমরা দেখতে যাব ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের অষ্টগ্রাম অংশটি। ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটির নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেছিলেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, ২০১৬ সালে। আর গত ৮ অক্টোবর এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, গণভবনে, এক ভিডিও প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে। এই সড়কটির নির্মাণ খরচ পড়েছে ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা। কিশোরগঞ্জের তিনটি উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে এটি। ইটনা উপজেলার সদর থেকে মিঠামইন হয়ে সড়কটি চলে গেছে অষ্টগ্রামে। পাশাপাশি এটি এই অঞ্চলের বিস্তৃত হাওড়ের ওপর দিয়েও গেছে, যেখানে রয়েছে ধনু এবং বাউলা নদী। সাধারণের কাছে পরিচিত এই ‘হাওড় রোড’টি আগামীতে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রোডের সঙ্গে যুক্ত হবে। বলা যায়, মুজিব বর্ষে এটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি চমৎকার উপহার।

‘মোমিন...।’ কুফিয়া ডাকে।

আমি হাত তুলে সাড়া দিই। কুফিয়াসহ অন্যদের কাছে যাই। জানতে পারি, চোদ্দ শ’ টাকায় রফা হয়েছে দুজন সিএনজিচালকের সঙ্গে। তারা আমাদের মিঠামইন ঘুরিয়ে আনবে।

আমরা ভাগ হয়ে দুটি সিএনজিতে উঠি। শুরুতে যাই কাছের আবদুল হামিদ সেতুতে। রাষ্ট্রপতির নামাঙ্কিত এই সেতুটি সাদামাটা। পুবে অষ্টগ্রাম, পশ্চিমে সাদিয়া নগর গ্রাম।

আমরা সেতুর ওপর দাঁড়াই। ছবি তুলি।

এবার পশ্চাৎমুখী যাত্রা। গন্তব্য মিঠামইন। পিচ ঢালা চমৎকার পথ। ঝকঝকে এই পথের শেষে নীল আকাশ উঁকি দেয়। মনে হয় ‘এই পথ শুয়ে আছে পথের ওপর/ওই নীলে মিশে আছে আরও নীল।’ আসলে সুদীর্ঘ সোজা পথ  বিভ্রম সৃষ্টি করে। মনে হয় পথের সঙ্গে আকাশ মিশে গেছে। পথের দুই পাশে হাওড়। নানা চিত্তাকর্ষক দৃশ্য।

হাওড়ের জলে হাঁসের দল...জাল ফেলে এক বালক মাছ ধরছে...জেগে ওঠা হাওড়ে একদল মানুষ কাজ করছে...।

পঁয়ত্রিশ মিনিট পর আমরা মিঠামইন পৌঁছি। দেখি কয়েক দল পর্যটক নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। তাদের কলহাস্যে জায়গাটি মুখরিত।

আমরা সামনে এগোই। ভাঙাচোরা পথের দেখা পাই। সিএনজি থেকে নেমে হাঁটি। আবার সিএনজিতে চড়ি। পৌঁছি বাজারের মতো একটি স্থানে।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কাঁচালঙ্কা নামের একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ  করি। ভর্তা আর মাছ দিয়ে। আইল, চিংড়ি, বাইন...। সবই হাওড়ের মাছ।

খেয়েদেয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ি দর্শন করি। সামনে-পেছনের অংশে পুরোনো বাড়ি, মাঝে আধুনিক স্থাপত্যের মনোরম বাড়ি। আরেকটি বাড়ির নির্মাণ কাজ চলছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো বাড়ির মসজিদটি।

এবার ফেরার পালা। পথের মাঝে গাড়ি থেকে নেমে নানা জায়গায় ছবি তুলি আমরা। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের ঢালু পথে নামতে গিয়ে দুর্গম পথ দেখে পিছিয়ে যাই। চোখে পড়ে, একটি বক্স কালভার্টস। হ্যাঁ, এই ২৯.৭৩ কিলোমিটার পথের সঙ্গে সংযুক্ত আছে তিনটি পিসি গার্ডার ব্রিজ, ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ, ৬২টি আরসিসি বক্স-কালভার্টস, রোড প্রোটেকশন ড্রাম ইত্যাদি।

হঠাৎ চোখে পড়ে একটি দুর্লভ দৃশ্য। পথের দু পাশে—পুব ও পশ্চিম আকাশে উদয় ও অস্তের খেলা; ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’। একদিকে চাঁদ উঠছে, অন্যদিকে সূর্য ডুবছে। আমরা দু দিকেই দাঁড়িয়ে ছবি তুলি।

কিছুক্ষণ পরে দৃশ্যপটের পরিবর্তন। পশ্চিম আকাশে লাল আভা, পুবে জ্বলজ্বলে চাঁদ।

এই চাঁদকে সঙ্গী করেই পথ চলি। মনে মনে নানা কথা বলি। আর বজরায় রাতের বেলায় চাঁদ তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আমার সামনে দেখা দেয়। ঢেলে দেয় তার সবটুকু আলো।

মনে পড়ে, তিন-চার বয়সের কথা। মা আমাকে ‘আয় আয় চাঁদমামা’ বলে ঘুম পাড়াচ্ছে আর আমি জানালা দিয়ে দেখছি পূর্ণিমার চাঁদ। ...বালক বয়সে রাতে পথ চলার সময় সবখানে চাঁদকে দেখে অবাক হচ্ছি। ভাবছি, চাঁদ কি আমার পিছু নিয়েছে? ...কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে কত চাঁদমুখের পিছু নিচ্ছি, কিন্তু সবাই চাঁদের মতোই অধরা। তারপর ঢাকা শহরে দুর্লভ চাঁদ। জানালার এক চিলতে আকাশ আর সোডিয়াম লাইটের আলো। চাঁদের আলো অদৃশ্য।

চার দশক পরে আমি এখন নদী আর হাওড়ের বক্ষের মাঝে চাঁদকে দেখছি। জোছনা উপভোগ করছি। জলের বুকে চাঁদের আলো পড়ে এক অপার্থিব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে। মন্ত্রমুগ্ধ আমি সেই দিকে চেয়ে আছি, অন্য কোনো দিকে তাকাচ্ছি না।

কিন্তু আমি তো হুমায়ূন আহমেদের মতো চাঁদে-পাওয়া মানুষ নই; নই তাঁর নানাবাড়ির কামলা আলাউদ্দিনের মতো—যার চাঁদনি পসর রাত খুবই প্রিয় ছিল। সে সেই রাতে আকাশের দিকে চেয়ে চাঁদের আলো খাওয়ার ভঙ্গি করত। ...আমি  ক্ষণিকের চন্দ্র-প্রেমী। তাই যখন বজরা পাটুলিঘাটে পৌঁছে, আমি আবার নাগরিক মানুষে পরিণত হই। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.