ফেসবুকে কয়েকদিন। হাসনাত আবদুল হাই

ফেসবুকে কয়েকদিন। হাসনাত আবদুল হাই

গুডমর্নিং

রোজ যা হয়, আজও তা-ই হলো, আমি খুব কাছে থেকে দেখেও চিনতে পারলাম না, কারণ এই সকালে আমার চোখে চশমা থাকে না, আর চশমা না থাকলে আমি প্রথমে যে বস্তু বা মানুষকে দেখি তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে না দৃষ্টিতে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে মানুষের চেহারা, বস্তুর আকার এবং গাছপালার ডিটেইলস্ চেনার জন্য যতটুকু দরকার সেই মাপে স্পষ্ট হয়, আগের দিনের পোলারয়েড ক্যামেরা থেকে বের করে আনা ফিল্মের ছবি ফুটে ওঠার মতো।

এতদিনের পরিচিত চেহারা, যা আমার খুব সামনে, যদিও ধীরে ধীরে বদলেছে, বদলাচ্ছে এখনো কিন্তু খানিকক্ষণ চেয়ে থাকার পর অপরিচিত থাকে না আর। আমি হাসিমুখে বলি, গুডমর্নিং। হাউ আর উই ডুইং? প্রশ্নটা আমেরিকান স্টাইল, ওরা পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে এভাবেই বলে, যেন সবাই সব সময় একটা কিছু কাজে ব্যস্ত, অথবা চেষ্টা করছে, যে সম্বন্ধে জানতে চাওয়া। আমার সামনের মুখ একই সঙ্গে বলল, গুড মর্নিং। হাউ আর উই ডুইং? একসঙ্গে মানে ইন রিয়েল টাইম। আমার সুপ্রভাত জানানো আর প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে না, একই সঙ্গে। হতেই হবে, কেননা আয়নায় যাকে দেখে আমি উইশ করলাম সে তো আমিই, আদি অকৃত্রিম ইয়োরস্ সিনসিয়ারলি। আয়নাটার পারদ আগের মতো নেই, তাই প্রতিবিম্বটা খুব স্পষ্ট না, তা ছাড়া ধুলোর একটা প্রলেপ পড়েছে বলে মনে হলো। টয়লেট পেপার দিয়ে মুছে দেওয়ার পর চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হলো। নট ব্যাড। তার মানে আজ আমার সুগার লেভেল মাপলে দেখা যাবে নর্মাল আছে। যেদিন থাকে না, চেহারাটা একটু ভিন্ন রকমের হয়, চামড়া ঝুলে না পড়লেও মসৃণ দেখায় না, আঙুল দিয়ে টেপার পর যে গর্ত হয় তা বেশ কিছুক্ষণ থাকে, স্বাভাবিক হয়ে আসতে সময় নেয়, পুকুরে ঢিল ছোড়ার পর বৃত্তটা ছড়িয়ে গিয়ে আবার আগের নিস্তরঙ্গ উপরিভাগ দেখতে যেমন অপেক্ষা করতে হয়। চেহারাটা নর্মাল দেখালেও বেসিনে ট্যাপ খুলতে খুলতে মুখের প্রসন্ন ভাবটা থাকে না, খিচড়ে যায় কিছুটা, কেননা ট্যাপে গরম পানি পড়ছে না। এই মৌসুমে গরম পানি ছাড়া আমি হাত-মুখ কিছুই ধুতে পারি না, গোসল তো না-ই। অপেক্ষা করছি গরম পানি আসার জন্য, নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছি আর সেই সময় মনে হলো আয়নায় যে মুখটা দেখছি তার একটা ছবি তুললে কেমন হয়? কিছু করার নেই এই মুহূর্তে, তাই যেই ভাবনা, সে-ই কাজ। আমি বাথরুমের খোলা দরজা দিয়ে বেডরুমে ঢুকে স্যামসাং জে-৭ স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে বাথরুমে ফিরে আসি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা দিয়ে ফটো তুলতে গিয়ে দেখি ফোন মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে ফেলছে। ছবি তুললে ক্যামেরা তো দেখা যাবেই, চেনার মতো আমার চেহারার অংশ ধরা পড়বে না। বেশ কিছুক্ষণ আমি ছবি তোলার অ্যাঙ্গেল বদলাতে থাকি। হতাশ হয়ে ছবি তোলা থেকে বিরত হওয়ার আগে একটু নিচু করে ক্যামেরা ধরতেই মুখের তিন-চতুর্থাংশ দেখতে পাই ফোকাসের ভেতর। দেরি না করে প্রেস করি ফোনে ক্যামেরার ডিজাইনের ওপর। খুব মৃদু একটা শব্দ হয়, যেমন শোনা যায় ব্ল্যাংকেটে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি হওয়ার পর। ফোন চোখের সামনে এনে দেখি আমাকে বেশ চেনা যাচ্ছে, যে-কেউ চিনতে পারবে, মুখের তিন-চতুর্থাংশ ফ্রেমের ভেতর বন্দি। আমার গায়ে টিয়ে রঙ টি-শার্ট, যা পরে রাতে শুয়েছি, আলসেমি করে পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়ার পরিশ্রম এড়াতে। শার্টে কোনো ভাঁজ পড়ে নি, ছবিতে গাঢ় সবুজ রং বেশ ফুটে উঠেছে, সেটাই শিল্পীরা যাকে বলেন প্রাইমারি কালার। বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে খাওয়ার টেবিলে বসে নাশতা করতে যাব এই সময় ফোনে পিং করে শব্দ হলো, তার মানে কেউ ফেসবুকে টেক্সট পাঠিয়েছে। হয়তো টেক্সটিংয়ের পর এখন অপেক্ষা করছে আমি উল্টো টেক্সট করে উত্তর দেই কি না দেখার জন্য। ফোন তুলে জায়গামতো প্রেস করার পর দেখি রিফাত মুনির নামে এক ফেসবুক ফ্রেন্ড। নতুন হয়েছে, আমার ভক্ত/পাঠিকা। ফেসবুকে নতুন যারা বন্ধু তাদের অধিকাংশই এই শ্রেণিতে পড়ে। টেক্সটে লিখেছে, স্যার, আপনার ‘নভেরা’ পড়ার পর যে মুগ্ধতা তা এখনো ভুলতে পারি না। অসাধারণ লেখা আপনার ‘নভেরা’। নভেরা, নভেরা। আর কত? কোনো ভক্তের সঙ্গে দেখা হলেই এই বইয়ের নাম বলবে অবধারিতভাবে, যেন তারপর আর কিছু লিখি নি। ‘নভেরা’ লিখেছি সেই ১৯৯৫ সালে আর এখন ২০১৮। দুই দশকের অধিক সময়ে আমার কম করে হলেও আরও বিশটা উপন্যাস বই আকারে বের হয়েছে। কিন্তু হলে হবে কি, সব ‘নভেরা’ আত্মসাৎ করেছে ব্ল্যাকহোলের মতো। নতুন বইগুলো বের হতে পারছে না ব্ল্যাকহোলের ভেতর থেকে। স্টিফেন হকিং বলেছেন, ডোন্ট গিভ আপ। দেয়ার ইজ এ ওয়ে আউট অফ দি ব্ল্যাক হোল। কিন্তু তা তো হচ্ছে না আমার ক্ষেত্রে। আমার উপস্থিতি টের পেয়েছে রিফাত নামের ভক্ত/পাঠিকা, কেননা তার ফোনে আমার নামের নিচে নিশ্চয়ই দেখা যাচ্ছে লেখা: অ্যাকটিভ নাউ। সে আবার টেক্সট করল, কেমন আছেন স্যার? আমি উত্তর দিলাম বেশ সময় নিয়ে, কেননা মোবাইলে মেসেজ পাঠাতে যে দক্ষতার সঙ্গে অক্ষরগুলো প্রেস করতে হয় তা এখনো আমার রপ্ত হয় নি। মোটে তিন মাস হয় এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ঢুকেছি, কোনো কিছুতেই পারফেকশন আসে নি এখন পর্যন্ত। সেদিন এক ভক্ত মহিলা পাঠিকাকে টেক্সট পাঠাতে গিয়ে অসতর্ক হয়ে এক ই-মোজি পাঠিয়ে দিলাম। বিব্রত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে টেক্সটে বললাম, ই-মোজিটা হঠাৎ করে গিয়েছে। ওটার অর্থ জানি না। খারাপ কিছু না তো? মানে মুখ ভেংচি দেওয়া অথবা খারাপ কিছু বলার মতো? মহিলা হেসে (আমার অনুমান) টেক্সট করলেন, বুঝতে পারছি। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করি, এরান্ট ই-মোজিটার অর্থ কী বলতে পারেন? তিনি উত্তর দেন, আমি দেখতে পাই মোবাইলের স্ক্রিনে, সাম কাইন্ড অফ এ্যাফেকশান। শুনে আমি ধন্দে পড়ি খানিকটা। অ্যাফেকশনের ‘কাইন্ড’ আছে বলে জানা ছিল না। বিকেলে ভ্রাতুষ্পুত্র রিংকু, যার হাতে আমার ফেসবুকের হাতেখড়ি, তাকে ই-মোজিটা দেখিয়ে প্রশ্ন করি, এটার অর্থ কী রে? সে দেখে বলে, কিস্। আপনি কিস করছেন। তারপর হেসে বলে, এর মধ্যে এত দূর গড়িয়েছে? অথচ আপনি তো ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতেই চাচ্ছিলেন না। রিংকু ঠিকই বলছে, আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল। যা এতদিন করি নি, এড়িয়ে গিয়েছি, তা করার প্রবৃত্তি ছিল না। সে প্রায় জোর করে আমাকে এই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে ঢুকিয়েছে। এটাও একটা ব্ল্যাক হোল বলে মনে হচ্ছে। ‘নভেরা’র চাইতেও অনেক বড়। এখান থেকে বের হতে চাইলেও বের হওয়া কঠিন। ড্রাগ অ্যাডিকশন এর তুলনায় নস্যি (এখন কেউ নস্যি নেয় না, তাই উপমাটা ঠিক হলো না। থাক)। আমি ভদ্রমহিলার কথা ভাবতে থাকি। তিনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন যে অসতর্কতার জন্য ই-মোজিটা চলে গিয়েছে টেক্সেটের সঙ্গে? নাকি ভেবেছেন চরিত্রহীন এক বৃদ্ধ যার মধ্যে কোনো ভব্যতা নেই? আমার এইসব বিপদের জন্য রিংকুই দায়ী। সে জোর করে অ্যাকাউন্টটা খুলে না দিলে আমি অ্যানালগ দুনিয়ার বাসিন্দা হয়েই থাকতাম আগের মতো।

রিফাত মুনির টেক্সট করল, স্যার কেমন আছেন? দেখে ভ্রু কুঁচকালাম। এই প্রশ্ন দিয়েই তো শুরু করবে আলাপ। তা না করে ‘নভেরা’কে এনে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিল। দুশ্চিন্তাটা এ জন্য যে, নভেরা’র সর্বগ্রাসী আধিপত্যের ফলেই আমার অন্য উপন্যাসগুলো প্রায় অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে। আমি উত্তর দিলাম, অক্ষরগুলো সতর্ক হয়ে টিপে টিপে, না হলে যে টেক্সট করেছে তার পড়তে অসুবিধা হবে ভুল লেখা দেখে। লিখলাম, কেমন আছি এই প্রশ্ন শুনে আমি আজকাল উত্তর দিই যে ভালো আছি। না হলে যে জিজ্ঞাসা করছে তার মন খারাপ হয়ে যাবে। শুনে রিফাত হাসল কি না জানা গেল না। কিন্তু দেখলাম বক্সের ভেতর ফুলদানিতে ফুল পাঠিয়েছে। একটা না, তিনটা। আমার একজন কঠিন ভক্ত, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রসন্নতায় আমার মন ভরে যায়। আমি লিখলাম: ধন্যবাদ। পরে কথা হবে।

নাশতা করতে গিয়ে মনে পড়ল আজ সকালে ফেসবুক ফ্রেন্ডদের উদ্দেশে কিছু বলা হয় নি, কোনো স্ট্যাটাস কিংবা কমেন্ট যা এই নতুন সামাজিকতার একটা কর্তব্য বলেই মনে করা হয়। সবাইকে আলাদাভাবে গুড মর্নিং বলে একটা মেসেজ বা পোস্ট পাঠালেই এই কর্তব্য পালন করা হয়ে যায়। অথবা নিজের ছবির আপডেট। পোস্টের সঙ্গেও ছবি থাকতে পারে তার পটভূমি হিসেবে। ভাবছি, এই সময় মনে হলো যে ছবিটা বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুলেছি সেটা পাঠালে কেমন হয়? ভালোই হবে। সবাই আপডেট করে প্রোফাইলের ছবি। আমারটাও অনেকটা সেই রকম হবে যদিও আপডেট বলব না। নিজের ছবি আপডেট করতে গিয়ে আমি বিব্রত বোধ করেছি প্রথম থেকেই। এখনো তা-ই। সুতরাং নতুন কিছু লিখতে হবে। নাশতা শেষ হলে ফোনে লিখলাম: গুড মর্নিং। মাই সেলফ পোর্ট্রেট দিস মর্নিং। এটা লেখার পর টেক্সট করার আগে চিন্তা করলাম যে, আরও কিছু বলা দরকার যাতে মনে না হয় আত্মপ্রচার করছি। বিনয়ী এবং নম্র এমন জানানো যায়, সেইভাবে কিছু লেখা। একটু পর ছবির নিচে লিখলাম: মিরর মিরর অন দ্যা ওয়াল। হু ইজ দি ওল্ডেস্ট অফ দেম অল। লেখার পর টেক্সটটি পোস্ট করে বেশ তৃপ্তিবোধ করলাম। এই সেলফ পোর্ট্রেট পাঠানোর মধ্যে কিছুটা নতুনত্ব থাকবে। সাদামাটাভাবে আপডেট করাটা একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। ছবির নিচে এই যে মিরর মিরর লিখে দিলাম তার ফলে নিজের বয়স নিয়ে একটা রসিকতা করা হলো সেটাও জানতে পারবে সবাই। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে হিউমিলিটি রয়েছে। আশা করি এটা ফেসবুক ফ্রেন্ডদের দৃষ্টি এড়াবে না। টেক্সট পাঠানো শেষ হয়েছে, এ সময় পিং পিং শব্দ করে মোবাইল জানিয়ে দিল যে ফেসবুকে টেক্সট কিংবা কমেন্ট আসা শুরু করেছে। সকালে অনেকে গুড মর্নিং জানায়। তবে আজকের মতো এত ঘনঘন শোনা যায় নি। ফেসবুকে আমার পেজ খুলে দেখি কমেন্টে সয়লাব। সব আয়নায় প্রতিফলিত সবুজ টি-শার্টপরা আমার প্রতিবিম্বের ছবিকে কেন্দ্র করে। ড. তুহিন লিখেছেন: এখনো তারুণ্যে টগবগে। সম্পর্কে বেয়াই কে এম কয়েস লিখেছে: হু ইজ দি মোস্ট ডিগনিফায়েড অফ অল। আমেরিকা থেকে ড. রওনক লিখেছেন: এভারগ্রিন ইন গ্রিন... হোয়াট এ গ্রেট ওয়ার্ক অফ আর্ট! কাকলী আহমেদ লিখেছেন: শুভেচ্ছা। অভিনন্দন। আফরোজা পারভিন লিখেছে: সুপ্রভাত, স্যার। দেখলাম আফরোজা তার ভাষা বদলেছে। এর আগে আমার মেয়ের তোলা ছবি পোস্ট করার পর সে কমেন্ট করেছিল, জীবন্ত দেখাচ্ছে স্যার। আমি ঠাট্টা করে লিখেছিলাম, ও মা, আগে কি মুমূর্ষু দেখাত! সেটা পড়ে সে বিব্রত বোধ করেছে। উত্তর দিয়েছে, না, আগের তুলনায় বেশি জীবন্ত। আমি তাকে আশ্বস্ত করার জন্য লিখেছিলাম, ঠাট্টা করে বলা। ডাইনিং টেবিল থেকে ওঠার আগে মুহুর্মুহু পিং পিং শব্দ করে ফেসবুকে কমেন্ট আসতে থাকল। সব আমার ওই ছবির প্রশংসা করে। কমেন্ট আসছে, তার উত্তরে কিছু বলতে হয়, কম করে হলেও ধন্যবাদ। আমি ড. রওনককে লিখলাম, সব আর্ট ওয়ার্কই অ্যাক্সিডেন্টাল। বাথরুমে গিয়ে যদি বেসিনে গরম পানি পেতে দেরি না হতো তাহলে এই ছবি তুলতাম না। তিনি উত্তর দিলেন (অবশ্যই লিখে): রানিং ওয়াটার হোক কিংবা গিজার একটা সুন্দর ছবি উপহার দিয়েছেন। এক বয়োঃকনিষ্ঠ লিখেছে: ভাই, আপনি কি সেলফিতে মগ্ন? আমি লিখলাম, না হে। সেলফিতে ক্যামেরার ছবি দেখা যায় না। এখানে আমার মুখের সামনে মোবাইল-কাম-ক্যামেরা দেখতে পাচ্ছ। এটা আয়নায় আমার মুখের প্রতিবিম্ব। ফটো তোলা হয়েছে স্বাভাবিকভাবে। সেলফির ভঙ্গিতে না। বিকেল পর্যন্ত যত কমেন্ট পাওয়া গেল তার সংখ্যা এক শ’র ওপর। অ্যান্ড কাউন্টিং। অর্থাৎ অব্যাহত রয়েছে কমেন্ট আসা। খুব অবাক হলাম। তিন মাসে ফেসবুকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পোস্ট দিয়েছি। সেগুলোর ওপর গড়ে পঁচিশটা লাইক এসেছে, কমেন্ট আরও কম। অথচ হেলাফেলা করে তোলা নিজের এই ছবিটা পাঠানোর পর পোস্টটা যাকে ফেসবুকের ভাষায় বলে ‘ভাইরাল’ হয়ে গিয়েছে। ফেসবুকের রিচুয়ালের একটি দিক পরিষ্কার হলো আমার কাছে। ছবি, হ্যাঁ, ছবিই হলো মূল আকর্ষণ। শুধু টেক্সটিং না, ভিস্যুয়াল হতে হবে সেই পোস্ট, তা সে নিজের ছবি হোক, কি অন্যের, অথবা কোনো দৃশ্যের। ফেসবুকের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের এই রিচুয়ালের পেছনে কোন মানসিকতা কাজ করছে? শুধু কথা নয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ চাই। ইলাস্ট্রেশন থাকতে হবে। এটাই কি বলা হচ্ছে অলিখিতভাবে? আমি যে গুড মর্নিং জানালাম তা আরও শক্তি পায় যদি সঙ্গে ছবি থাকে। ফেসবুকের ফ্রেন্ডরা আশ্বস্ত হয় দেখে, বুঝতে পারে যে ‘ফেক’ কিছু নয়। আদপেই তাদের ফ্রেন্ড যোগাযোগ করছে, প্রমাণস্বরূপ পাঠাচ্ছে ছবি। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার থেকে সর্বশেষ হিগসের গডস্ পার্টিকল আবিষ্কারের মতো আমি একটা রহস্য উদ্ঘাটন করার উল্লাস বোধ করি মনে মনে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে ভাষায় কথা বলি শুধু শব্দ ব্যবহার করে সেটা ফেসবুকে অচল। ফেসবুকের সেমিওটিক্সে সিগনিফায়ার এবং সিগনিফায়েড ভিন্ন। সেমিওটিক্সের জনক যাকে বলা হয় সস্যুর (শ্বশুরের মতো শোনালেও শ্বশুর নয়) এ কথা ভাবেন নি। কী করে ভাববেন? তখন তো ফেসবুক ছিল না। সন্ধ্যায় শেষ গণনা পর্যন্ত আমার সেলফ পোর্ট্রেটসহ পোস্টের জন্য লাইক এসেছে ১২০টি, কমেন্ট করেছে ৩০ জন। আমার জন্য এটা একটা রেকর্ড। ভাগ্যিস বেসিনের কল দিয়ে গরম পানি পড়তে সময় নিয়েছিল!

 

দুই

ভিডিও চ্যাটিং

ডাইনিং টেবিলেই আমি আজকাল লেখালেখি করি। অনেক বড় সাইজ টেবিল যার জন্য বইপত্র, কাগজ, কলম এইসব রাখার সুবিধা। পাশে থাকে গরম পানিভর্তি ফ্লাক্স। চায়ের কাপ। টি-ব্যাগভর্তি প্যাকেট। সন্ধ্যার পর লিখছি এই সময় মোবাইলে পিং করে শব্দ হলো। ফেসবুকে কেউ নক করছে। মোবাইল তুলে জায়গামতো টাচ করে পেজ দেখতে পাই। অদ্বিতীয়া সিদ্দিক। পাশে বৃত্তের মধ্যে তার মুখের অংশ। মাথা নিচু করে রেখেছে যার জন্য চোখ দেখা যায় না। একেকজন একেকভাবে প্রোফাইলে এই ছবিটা দেয় যা প্রত্যেক পোস্টের সঙ্গে থাকে। কাউকে দেখেছি কেবলমাত্র একটি চোখ, কপালের অংশ আর নাকের উপরিভাগের ছবি আইডি হিসেবে পাঠাতে। থাক সে কথা। এখন অদ্বিতীয়া কী বলতে চায় পড়ে দেখা যাক। অদ্বিতীয়া আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়েছে সদ্য। অল্প বয়সের মেয়ে, প্রোফাইলে বয়স না দিলেও চেহারা দেখে বোঝা যায়। আমি এইসব ক্ষেত্রে দেখি যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে তার বন্ধু কারা। বন্ধুদের মধ্যে আমার পরিচিত কেউ থাকলে রিকোয়েস্ট গ্রহণ করতে ইতস্তত করি না। মাই ফ্রেন্ডস্ ফ্রেন্ড আর মাই ফ্রেন্ড। তাই না? অদ্বিতীয়ার ক্ষেত্রে কমন ফ্রেন্ড ছাড়াও তার নামটাও আকর্ষণ করেছিল আমাকে। অমন নাম কজনের হয়? প্রথম আলাপেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কে এই নাম রেখেছে? অদ্বিতীয়া বলেছে, নামটা তার এক খালা রেখেছেন। তিনি কবিতা লেখেন। হতেই হবে। শোনার পর আমি মনে মনে বলেছি। কবি ছাড়া এমন সাহিত্যিক নাম কার মাথা থেকে বের হবে?

কেমন আছেন? অদ্বিতীয়ার প্রশ্ন। অক্ষরে।

ভালোই। তুমি? প্রশ্ন করার পর তিনটা ফোঁটা ঢেউয়ের মতো খেলতে থাকে। তার মানে লেখা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখি অদ্বিতীয়া লিখেছে, একটা কথা ছিল। কী? বলো শুনি। আপনার সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করতে চাই। শুনে আমার চোখ কপালে ওঠে। বলে কী মেয়েটা! আমি লিখি, পাগল হয়েছ? জানো আমার বয়স কত?

কত?

আশি। এই বয়সে ভিডিও চ্যাট করা যায়?

ইচ্ছে করলেই করা যায়। অদ্বিতীয়াকে মোটেও বিচলিত মনে হয় না আমার বয়স শুনে। বয়সের তুলনায় বেশ ভারিক্কি তার ব্যক্তিত্ব। প্রথম দিন কথা পড়েই তা বুঝতে পেরেছি। আমি লিখি: আমার তেমন ইচ্ছা হয় না।

কেন হয় না?

বয়সের সঙ্গে যায় না।

বয়স বয়স করেন কেন, মন নেই আপনার? শুনে চমকে উঠি। আরে এ যে দেখছি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ওপরে এক কাঠি! ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় তিনি লিখেছিলেন, শরীর শরীর করো কেন কুসুম, তোমার মন নেই?

আমি লিখি: অবশ্যই মন আছে। সেই মন বলছে তোমার বয়সী মেয়ের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করা মোটেও শোভনীয় হবে না। অদ্বিতীয়া নাছোড়বান্দা। সে উত্তর দেয়, আপনি লেখক। নতুন অভিজ্ঞতা পেতে চান না?

চাই। কিন্তু এটা নয়।

কেন?

অনৈতিক হবে।

উফফ! আপনি সত্যিই বুড়ো।

নতুন কথা নাকি? প্রোফাইলে আমার বয়স লেখা আছে। তোমাকে মুখেও জানালাম। বয়সে আমি তোমার দাদা কী নানার সমান। অদ্বিতীয়া লিখল, অলরাইট গ্র্যান্ড পা ইউ উইন। আমি ফোর্স করব না। তবে আপনে ভেবে দেখবেন। আমার অফারটা থাকল। আমি লিখলাম, ভেবে দেখার কিছু নেই। ইউ হ্যাভ চোজেন দ্যা রং পার্সন। তোমার বয়সী বন্ধু নিশ্চয়ই আছে। তাদের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করলেই পারো। আমার সঙ্গে কেন? অদ্বিতীয়া বলল, ফর নিউ এক্সপেরিয়েন্স।

লাইক?

লাইক মানে? ফেসবুকের লাইক?

না কোন ধরনের এক্সপেরিয়েন্স? নিউ এক্সপেরিয়েন্স লাইক হোয়াট?

হুমম। বয়স্ক একজনের সঙ্গে ভিডিও চ্যাটের অভিজ্ঞতা। দ্যাট ইজ হোয়াই।

এর জন্য আমাকে কেন? আরও বয়স্ক লোক আছে।

ওহহহ। আপনি খুব বেশি কথা বলেন। আমি কমফর্টেবল ফিল করি না। এত প্রশ্ন করবেন না।

বেশ। তুমিও চাপাচাপি কোরো না। শুনে অদ্বিতীয়া লেখে, আমার বুড়ো দাদু। আর বলব না। আমি লিখি, তুমি বেশি বেশি বুড়া ব্যবহার করছ। বুড়া কি একটা গালি?

উফফ। আপনি কথাও বলতে পারেন। জানতাম লেখকেরা শুধু লেখে। আপনি দেখছি একজন বক্তাও। আচ্ছা রাখি। একটু পর লেখে: ইউ আর ড্রাই।

অল্প দিনেই বুঝে গিয়েছি ফেসবুকের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে কোনো কিছুতে অবাক হলে চলবে না। এ হলো আধুনিক যুগের ওয়ান্ডারল্যান্ড। এলিসের মতো র‌্যাবিট হোল দিয়ে না হলেও একটা পোর্টাল দিয়ে ঢুকে পড়েছি। সেটাই র‌্যাবিট হোলের আধুনিক সংস্করণ। এখন থিংস উইল বি কিউরিয়াইজার অ্যান্ড কিউরিয়াইজার। আর এলিস যেমন বলেছে, এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকার জন্য দৌড়াতে হবে ক্রমাগত। অলিতে-গলিতে ম্যাড হ্যাটাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা উপায় ছিল। ফেসবুকের ফ্রেন্ড সম্পূর্ণভাবে পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। এটা যে ভাবি নি তা নয়। দুটো অসুবিধা দেখা দিয়েছে এ ক্ষেত্রে। প্রথমত, পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে মাত্র দুজনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন নেই। সাদামাটা মোবাইলেই সেই কাজ করে এসেছি এবং এখনো করা যায়। দ্বিতীয়টা অসুবিধা না, একটা বিবেচনা। নতুন বন্ধুই যদি না করব তাহলে ফেসবুকে আসা কেন? ফেসবুক হলো আসল ইন্টারনেট হাইওয়ে যেখানে অনবরত গাড়ি যাচ্ছে দ্রুতগতিতে, ভেতরে আরোহী যাদের অনেককেই চিনি না। এদের শুধু দেখেই যাব, পরিচিত হব না, কথাবার্তা বলব না, এমন হলে এই সমান্তরাল জগতের কিছুই জানা যাবে না। অদ্বিতীয়ার ফ্রেন্ডশিপ লিংক করার পর এ কথাটা মনে হয়েছে। একটা সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ দেখতে পেয়েছি সামনে। সুযোগটা হলো নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন আর চ্যালেঞ্জ হলো ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার। শুধু দেখেই যাব, ইন্টারনেট হাইওয়ের যাত্রী কারও সঙ্গে পরিচয় হবে না, কথাবার্তা বলব না, এমন হলে এই অলৌকিক সমান্তরাল জগতের কিছুই জানা হবে না। সারা জীবন লেখক হিসেবে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে জীবনসায়াহ্নে এসে সেই আগ্রহ কি হারিয়ে ফেলব? যদি তা করি তা হবে স্বভাববিরুদ্ধ। স্ববিরোধিতা। ভাবছি, এই সময় পিং করে শব্দ হলো। ফেসবুকে কেউ নক করছে। ফেসবুক ওপেন করে দেখি, মনি হায়দার। কথাসাহিত্যিক। বাংলা একাডেমিতে আছে। খুব ভদ্র আর বিনয়ী। জি টিভিতে আমার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিল। তার আগে আমার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল আমার লেখা কিছু বই। ইন্টারভিউয়ের সময় সে যেভাবে প্রশ্ন করল তাতে সন্দেহ থাকল না যে বইগুলো সে পড়েছে। এটা ব্যতিক্রম। এর আগে টেলিভিশনে অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছি। যারা ইন্টারভিউ নিয়েছে তাদের কেউ নির্দিষ্টভাবে গল্প কিংবা উপন্যাস নিয়ে প্রশ্ন করে নি, কেবল সাধারণভাবে উল্লেখ করে গিয়েছে। সেই থেকে মনি হায়দার সম্বন্ধে আমার ধারণা উঁচু। সে একজন আদর্শ সাক্ষাৎগ্রহণকারী। মনি হায়দার লিখেছে: ফেসবুকে স্বাগতম। আমি লিখলাম: ধন্যবাদ। সে লিখল: কেমন আছেন? পড়ে আমি অবাক হলাম, এর আগে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে টেলিফোনে। কিন্তু এমন অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কুশল জিজ্ঞাসা করে নি সে। কারণটা বুঝলাম, ফেসবুক। এখন আমি তার প্রতিবেশী হয়ে গিয়েছি। তাই তার স্বর বদলে গিয়েছে। শুধু বন্ধুত্ব না, একটা আত্মীয়তার ভাব টের পাচ্ছি তার কথায়। লিখলাম: ভালো-মন্দ মিলিয়ে আছি। অভিযোগ করার মতো কিছু নেই। সে লিখল: বইমেলায় আসছেন তো? আমি লিখলাম: সম্ভবনা কম। মনি হায়দারের প্রশ্ন: কেন? আমার উত্তর: ডাক্তারের নির্দেশ, ধুলো-বালি থেকে দূরে থাকতে হবে। বইমেলায় অনেক ধুলো ওড়ে। মনি হায়দার লিখল: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসার পর থেকে ধুলো ওড়ে না। চলে আসুন। আড্ডা দেওয়া যাবে। আমি লিখি: চেষ্টা করব। মনি এবার জোর দিয়ে বলে: চেষ্টা না, আসুন। তার আন্তরিকতা আমাকে স্পর্শ করে। সেইসঙ্গে টের পাই তার কথার মধ্যে রয়েছে একটা দাবি, যার ভিত্তিতে সে বলছে যেতে হবে। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট না খুললে এভাবে সম্পর্কটা লাফিয়ে ওপরে উঠত না। কোয়ান্টাম লিপ। ম্যাজিক কাকে বলে! আমি মোবাইলটার দিকে তাকাই। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পর এর চরিত্রই বদলে গিয়েছে। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো কাজ করছে সেটা এখন। যেখানে যেতে বলছি নিয়ে যাচ্ছে। যার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি ছবিসহ তাকে দেখাচ্ছে। কথা বলতে দিচ্ছে ইচ্ছেমতো। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, প্রদীপটা কি আমার ভৃত্য, না আমি তার নিয়ন্ত্রণে? এই সংশয় এবং প্রশ্ন মাঝে মাঝে অস্থিরতায় ফেলে দেয়।

শামসুজ্জামান খানের পোস্ট আসে। তিনি লিখেছেন, ওয়েলকাম টু ফেসবুক। তারপর লেখেন আমি সিনিয়রদের এনকারেজ করি ফেসবুকে আসার জন্য। তাঁরা আসতে ইতস্তত করেন। সিনিয়রদের মধ্যে আমার পর আপনি এলেন ফেসবুকে। খুব খুশি হলাম। বুঝলাম শামসুজ্জামানের কাঁধে বাংলা একাডেমির পরিচালনা ছাড়াও আরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। মার্ক জাকারবার্গ নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন। নিজে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার পর অন্যদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। এর কিছুদিন পর বাংলা একাডেমিতে এক সেমিনারে সভাপতিত্ব শেষ করে তাঁর কনফারেন্স রুমে চা পানের সময় তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আপনি দেখি ফেসবুকে খুব অ্যাকটিভ। প্রতিদিনই পোস্ট দিচ্ছেন। কমেন্ট করছেন। কেমন, ভালো লাগছে না? শুনে মনে হলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। চিকিৎসক এসে হাসিমুখে জানতে চাইছেন তার ট্রিটমেন্টে কেমন রেসপন্ড করছি। আমি শামসুজ্জামানকে বলি, অনেক সময় নেয়। প্রথমত, অনেক কিছু রপ্ত করে উঠতে পারি নি। যেমন টাইপিং, অনেক ভুল হয়, সময় নেয়। দ্বিতীয়ত, ফ্রেন্ডদের পোস্ট দেখলে শুধু লাইক না দিয়ে একটা কিছু বলার তাগিদ অনুভব করি। এতে করে বেশ সময় যাচ্ছে। ফলে বইপড়া, লেখালেখির জন্য কম সময় পাচ্ছি। শামসুজ্জামান বলেন, ঠিক হয়ে যাবে। আপনি নিজেই বুঝবেন কীভাবে টাইম রেশনিং করতে হয়। তার পর আবার বলেন, ভালোই তো করছেন দেখছি। বাংলায় লেখাটা শিখে ফেলুন। এক সপ্তাহে দক্ষ হয়ে যাবেন। আমি বললাম, বাংলায় লিখতে হবে। না হলে লোকের কথা, এমনকি গালমন্দও শুনতে হবে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বললাম বটে আসলে শুনতে হয়েছে ইতিমধ্যে। কয়েকজন পাবলিক ডোমেনে ইংরেজিতে বাংলা দেখে বলেছে, বাংলা ইংরেজি বর্ণমালায় লেখেন কেন? তা-ও ফেব্রুয়ারি মাসে? আমি লিখেছি: হবে, সব হবে। আমি নতুন তো! সবে মাত্র ঢুকেছি। সেই কমেন্ট দেখে আফসান চৌধুরী লিখেছেন কীভাবে দ্রুত বাংলায় লেখা শিখতে পারি। ফরিদ কবিরও বাংলায় লেখার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে। এমনি আরও কয়েকজন। ফেসবুক আদপেই একটা কমিউনিটি। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে প্রতিবেশীসুলভ যে মনোভাব সেখানে পরস্পরকে সাহায্য করার ইচ্ছাটা প্রবল। আবার এর উল্টোটাও আছে। বেড়া নিয়ে প্রতিবেশীসুলভ বৈরিতা কিংবা নিদেনপক্ষে উষ্মা প্রকাশ। এক বয়োঃকনিষ্ঠের বেশ কিছু পোস্ট পড়ার পর তাকে লিখেছি: নানা সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে তোমার মতামত খুব প্রশংসনীয়। চমৎকার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছ। তবে মাঝে মাঝে দেখি তোমার লেখায় ভালগার শব্দ থাকে। এটা না করাই ভালো বলে মনে করি। সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর আসে: কারও পরামর্শ নিই না। এই প্রতিক্রিয়া থেকে এমন উপসংহারে আসা যায় যে সামান্যভাবে হলেও ফেসবুকে কারও ইগো স্পর্শ করা যাবে না। ফেসবুকে যারা বিচরণ করেন তারা প্রায় সবাই বিশাল ইগোর অধিকারী। ইগোর ব্যাপারে সবাই স্পর্শকাতর, কেননা তারা জানেন যে অন্যেরা জানতে পারছে। দে নো দ্যাট উই ডোন্ট নো দ্যাট দে নো। পিটার উস্টিনভের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে।

আপাতদৃষ্টিতে ফেসবুক খুবই গণতান্ত্রিক। সবারই এখানে সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরই রয়েছে শ্রেণিবিভাজন। পাবলিক ডোমেন সব অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে সবাই সবার কথা জানতে পারছে, বলতেও পারছে। কিন্তু তাতে কৌলিন্য থাকে না। এর জন্য শুধু ফ্রেন্ডদের মধ্যে যোগাযোগ রাখাটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকাংশের জন্য। কিন্তু অরওয়েলস যেমন বলেছিলেন, অল পিগস্ আর ইকুয়াল। সাম পিগস্ আর মোর ইকুয়াল দেন আদার্স। এই আপ্তবাক্যের প্রতিধ্বনি রয়েছে ফ্রেন্ডদের মধ্যে বিশেষ গ্রুপ যেখানে তারা তাদের সাধারণ আগ্রহের বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করে থাকে। সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ ক্লাব হলো মেসেঞ্জার যেখানে যোগাযোগ হয় কেবল দুজনের মধ্যে। টেকনিকাল ভাষায় ইনবক্সে। ইনবক্সটা মনে করা যেতে পারে দুদিকে ধারালো তলোয়ারের মতো। এর ভালো দিক যেমন আছে, তেমনি আছে অন্ধকার দিক। এসব জেনেছি ধীরে ধীরে না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। ফেসবুকে বেশিদিন প্রশিক্ষণার্থী বা শিক্ষানবিশ হয়ে থাকার সুযোগ নেই। শুরু থেকেই হতে হবে প্রফেশনাল, অভিজ্ঞ। এককথায়, টেক স্যাভি। কেউ সবজান্তা হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কেউ দায়ে পড়ে।

তিন

গোয়িং ভাইরাল

মেজভাই বলল, শুনছি তুমি নাকি এই বয়সে ফেসবুক না কী যেন বলে খুলেছ? দিন-রাত ওই নিয়ে থাকো। আমি বললাম: ঠিকই শুনেছ। এর জন্য তোমার পুত্রধন রিংকুই দায়ী। আমি গেলাম তার বাসায় নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে। সে বলল, এর জন্য বাড়ি আসতে হয় নাকি? কতজনের বাড়ি যাবেন? মোবাইলে সবাইকে জানিয়ে দিলেই হলো। ফেসবুকে পাঠালে আরও ভালো হয়। সেখানে কথার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারবেন ই-মোজি এবং নানা রকমের সিম্বল। আমি বলি: আমার ফেসবুক নেই। খুলি নি। অযথা সময় যায় বলে শুনেছি। আমার অত সময় কোথায়? রিংকু বলেছে: কম ব্যবহার করলে সময় বেশি লাগবে না। এটা ফেসবুকের যুগ। এর বাইরে থাকলে আপনি আউটডেটেড হয়ে যাবেন। দেখি আপনার স্মার্টফোন। এর পর আমাকে প্রায় হিপনোটাইজ করে রিংকু আমার নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলে। হাসিমুখে বলে: ইয়োর নিউ উইন্ডো টু দ্যা ওয়ার্ল্ড।

মেজভাই বলল: খুলেছ যখন তখন থাক। বেশি ব্যবহার না করলেই হলো। সময় নষ্ট হবে না। তোমার তো অনেক কাজ। বই পড়া, লেখালেখি, সিনেমা দেখা, গান শোনা, সংবাদপত্রে কলাম লেখা। ফেসবুকে ঢুকে এসব অবহেলা করা ঠিক হবে না। তোমাকে সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে। তারপর বলল: ফেসবুক-টেসবুক টিন এজারদের এলাকা। আমাদের বয়সে মানায় না। আমি বললাম: আমারও তা-ই ধারণা ছিল। এখন দেখি ফেসবুকে অনেকেই আছেন। আমার চেয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু হয়ে গিয়েছেন। তোমার নাতিরা আছে। এমনকি আমাদের একজন দারোয়ানও বন্ধু হয়ে গিয়েছে। ফেসবুক শ্রেণি এবং বয়স-নিরপেক্ষ। জেন্ডার তো বটেই। শুনে মেজভাই খুব অবাক হয়। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে: আমাদের দারোয়ান? কোনজন? তার কথা শুনে মনে হয় এখুনি একটা হেনস্তা করে ছাড়বে। আমি বলি: ডাজ ইট ম্যাটার? মেজভাই চিন্তিতমুখে বলল: তাহলে সবকিছু কী করে সামলাবে? আমি বললাম: মাল্টাই-টাস্কিং। সব একসঙ্গে করতে হবে। শুনে মেজভাই ভ্রু কোঁচকায়। লন্ডন থেকে আসা অর্থোপেডিক্সের সার্জন আমাদের ছোটভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, এমন করা যায়? আমাদের ছোটভাই হাড় জোড়া দেওয়ার বিশেষজ্ঞ। স্বাভাবিকভাবেই সময় আর কাজ জোড়া দেওয়ার ব্যাপারে তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সে বলে: কিছুদিন করে ছেড়ে দিলেই হবে। আমি মাথা নেড়ে বলি: সে গুড়ে বালি। এ হলো খ্রিষ্টানদের বিয়েতে বর-কনের শপথ নেওয়ার মতো: টিল ডেথ ডু আস পার্ট। মেজোভাই একটুও না দমে বলে, ওই ওথ্ সত্ত্বেও তাদের ডিভোর্স হয়। হয় না? তাহলে তুমি কেন এই জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। কোনো চুক্তি হয় নি কারও সঙ্গে যে আমৃত্যু আজীবন ফেসবুকে থাকতে হবে। আমি বললাম: দেখি, কী হয়। ফেসবুক কোথায় নিয়ে যায়। নতুন জগতে ঢোকা মানে নতুন অভিজ্ঞতা শুধু না, দায়িত্ব পালনও। মেজভাই বলে, দায়িত্ব? কিসের দায়িত্ব? আমি বলি, এটা আমাকে উপলব্ধি করতে হবে। এখনো তা করে উঠতে পারি নি। তবে এখন পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার জন্য কোনো আক্ষেপ দেখা দেয় নি। মেজভাই কিছু-একটা মনে করতে পেরে বলে: রিমি বলছিল সবার ছবি দেখি ফেসবুকে। তুমি তোমার ভাইবোনদের নিয়ে ছবি তুলে পোস্ট করো না কেন? ভাইরাল হয়ে যেতে পারে। তারপর আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলে: আমাদের চার ভাইয়ের একটা গ্রুপ ছবি নিয়ে পোস্ট করে দাও তো। ভাইরাল হয় কি না দেখি। রিমি মেজোভাইয়ের মেয়ে, আমেরিকায় থাকে। প্রত্যেক সন্ধ্যায় তার সঙ্গে ভাইবার কিংবা স্কাইপে কথা বলে। বুঝলাম সে তার বাবাকে ফেসবুকের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলেও চাচার মাধ্যমে তার মনোবাসনা পূরণ করতে চায়। তাকে বলি: বেশ তো, এখনই তুলে পোস্ট করে দিচ্ছি। তোমার মেয়ে দেখতে পাবে। তবে ভাইরাল হবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মেজভাই বলে, কেন হবে না? তুমি ওইভাবে লিখবে। আমি বলি: এটা লেখার ওপর নির্ভর করে না, করে ঘটনার ওপর। ঘটনাটা চাঞ্চল্যকর হতে হবে। তাহলে সেই নিউজ ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বাভাবিক ঘটনা নিউজ হয় না। আমরা চার ভাই মিলে ছবি তুলছি এটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা না। মেজভাই হাল ছাড়তে চায় না। বলে: পোস্ট করে দেখো না কী হয়?

ছোটভাইয়ের বাড়ির কেয়ারটেকার মামুনকে ডাকা হয় ছবি তোলার জন্য, কেননা চার ভাইয়ের ছবি সেলফিতে নেওয়া সম্ভব না। হলেও আমার সেই দক্ষতা নেই। মামুন একটু পর আসে। বুক পর্যন্ত দাড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। দেয়ালে ছবি দেখলে মাথা নিচু করে। তাকে যখন বলা হলো আমাদের ছবি তুলতে হবে শুনে সে হতভম্ব। আমতা আমতা করে বলল, আমার তো এসব জানা নাই। প্রকারান্তরে সে যেন জানাল যে তার জব ডেসক্রিপশনে মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার উল্লেখ নেই। সে কোনোদিন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলে নি। আর মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা তার কাছে আরও রহস্যময়। কেননা, ক্যামেরাটা বাইরে থেকে দেখা যায় না, ভেতরে লুকানো। আমি তাকে ছবি তোলার কায়দাটা বুঝিয়ে দেই। ততক্ষণে আমাদের সবচেয়ে ছোটভাইকে ডেকে আনা হয়েছে ব্রাদারহুড কমপ্লিট করার জন্য। টেবিলের তিন দিকে আমরা বসে মামুনের দিকে তাকিয়ে আছি। সে নার্ভাস ভঙ্গিতে মোবাইল চোখের কাছে নিয়ে আমাদের ছবি তুলল। একটা না, কয়েকটা। ছবি তোলার পর মোবাইল আমার হাতে দিলে আমি গ্যালারিতে গিয়ে ছবিগুলো শনাক্ত করি। তিনটার মধ্যে একটা ব্যবহার করা যাবে বলে মনে হলো। আমি শেয়ারে টাচ করে ফেসবুকে গেলাম। টাইপ করার জন্য অক্ষরগুলো বেরিয়ে এল। আমি লিখলাম: উই ওয়ার ফাইভ ব্রাদার্স। নাউ, উই আর ফোর। এলডেস্ট ব্রাদার হ্যাজ গন টু ফ্রম হোয়ার নো ট্রাভেলার রিটার্নস্। উই আর ওয়েটিং ফর আওয়ার টার্ন।

আনটিল দেন উই আর এনজইং দি কম্পানি অফ নিয়ার অ্যান্ড ডিয়ার ওয়ান্স। লাইফ ইজ বিউটিফুল। সবাইকে পড়ে শোনালাম। তারা সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ার পর পোস্ট করে দিলাম। মেজভাই বলল, কখন জানতে পারব ভাইরাল হলো কি না? আমি বললাম, একটু পর লাইক আসবে, হয়তো কমেন্টও। সন্ধ্যা নাগাদ বোঝা যাবে হোয়েদার ইট ইজ ট্রেন্ডিং। মেজভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ট্রেন্ডিং? আমি বললাম, কোনো নিউজ বা পোস্ট যখন ক্রমাগত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে এবং তার ওপর মন্তব্য আসে একের পর এক তখন বলা হয় নিউজ বা পোস্টের মেসেজ ইজ ট্রেন্ডিং। আর এটা হলে ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন ভাবা যেতে পারে। সন্ধ্যার পর আমাদের প্রবাসী ডাক্তার ভাইয়ের বাসায় আমরা একত্রিত হয়েছি। মেজভাই খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ট্রেন্ডিং হচ্ছে? কয়টা লাইক আর কমেন্ট এল? আমি বললাম, ট্রেন্ডিং হচ্ছে না। এ পর্যন্ত লাইক এসেছে মাত্র ১৫টা। আর কমেন্ট ৫টা। তারপর ব্যাখ্যা হিসেবে বললাম, জানা ছিল এমন হবে। তোমাদের বলেছিও। আমরা তো কেউ সেলিব্রিটি নই। তা ছাড়া চার ভাই মিলে ছবি তোলা কোনো চাঞ্চল্যকর নিউজ না। শুনে মেজভাই একটু হতাশ হয় এবং তারপর বলে : আচ্ছা তোমার অভিজ্ঞতা বলো। মানে ফেসবুকে ঢোকার পর কী অভিজ্ঞতা হলো তোমার? আমি বললাম, একজন আদিবাসী রোজ সকালে সুন্দর ছবি পাঠিয়ে আমাকে ‘শুভ সকাল’ জানায়। দারুণ সব ছবি। পাখি পলাশ ফুলের মধ্যে ঠোঁট গুঁজে মধু খাচ্ছে। তিনটা সবুজ কবুতর গোটা ফলের ডালে একসঙ্গে বসে আছে। একঝাঁক পাখি চমৎকার অ্যাঙ্গেলে আকাশে উড়ে যাচ্ছে, নিচে নদী এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে। এইসব এবং আরও সুন্দর ছবিসহ সে প্রত্যেক সকালে আমাকে সুপ্রভাত জানায়। আমার সঙ্গে তার কোনো জানাশোনা নেই। জানতে চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছি, কিন্তু সে কোনো কিছু জানায় নি। মেজভাই বলল : আর? বললাম : এক অল্পবয়সী মেয়ে আমাকে ‘বুড়ো দাদু’ বলে মাঝে মাঝে খুনসুটি করে। মেজভাই বলে : আর? তার ভঙ্গি আর কথা শুনে মনে হয় যেন আরব্য রজনীর শেহেরজাদের গল্প শুনছে। আমি বলি, এক মহিলা লিখেছেন তার দুসপ্তাহ যাবৎ ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না। শুনে মেজভাই, প্রবাসী ডাক্তার ভাই এবং সবচেয়ে ছোটভাই সব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেজভাই বলে, এটা তোমাদের জানাবে কেন? তোমরা কি ডাক্তার? আমি বললাম : সহানুভূতি পাওয়ার জন্য। অনেকেই সহানুভূতি জানিয়েছে, কেউ কেউ বলেছে ডাক্তার চেঞ্জ করার জন্য। কেউ আজমির শরীফেও যেতে বলেছে। শুনে মেজভাই বলে : এইসব শোনার জন্য তুমি ফেসবুক ব্যবহার করবে? অযথা সময় নষ্ট। তাও যদি আমাদের ছবিটা ভাইরাল হতো তাহলে বুঝতাম। ফালতু ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। এটা তোমাকে মানাচ্ছে না। বলে সে আমার অন্য দুই ভাইয়ের দিকে তাকায়। দেখলাম তারাও তার সঙ্গে একমত। আমি বললাম, এক কাজ করা যাক। তুমি রিমিকে জিজ্ঞাসা করো আমার এখানে থাকা ঠিক হচ্ছে কি না। মেজভাই মাথা নেড়ে বলল, উঁহুঁ। সি ইজ সোল্ড আউট। ফেসবুক বলতে অজ্ঞান। প্রায় রোজই আমাকে খুলতে বলে। সে তোমাকে সমর্থন করেই মত দেবে। আমি বললাম, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? দেখি না কিছুদিন। মেজভাই এবার দার্শনিক ভঙ্গিতে বলল, এ যে দেখছি এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিস। শেষ পর্যন্ত টেকনলজির প্রভুত্ব মেনে নিতে হবে?

 

চার

দি অ্যাক্সিডেন্টাল বিলিওনেয়ার

সিনেমার সিডিটা আগেই কেনা ছিল, দেখব দেখব করেও দেখা হয় নি। ফেসবুকে যোগ দেওয়ার পর এর প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে নিয়ে ‘নেটওয়ার্ক’ নামে যে সিনেমা তৈরি হয়েছে সেটা কয়েকবার দেখলাম। সিনেমাটা বেন মেজরিক-এর লেখা ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল বিলিওনেয়ার : দি ফাউন্ডিং অফ ফেসবুক’-বইটির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। চিত্রনাট্য এবং পরিচালনার জন্য মনে হয় বইটার তুলনায় সিনেমার শটগুলো তোলা হয়েছে খুব দ্রুতগতিতে। দৃশ্য এবং সংলাপ এত দ্রুত বদলায় সমস্তক্ষণ যে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেখা কষ্টকর। নিচের ইংরেজি সাবটাইটেলও বেশিক্ষণ থাকে না যার জন্য সহজে পড়া যায় না। যেহেতু উপন্যাসে ব্যবহার করব সেই জন্য বোঝার উদ্দেশ্যে সিনেমাটা তিনবার দেখলাম। তবু ডিটেইলস্গুলো মনে রাখতে পারি না, খেই হারিয়ে ফেলি।

প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় থার্স্টি স্কলার্স্ পাব নামে পানশালায় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মার্ক জাকারবার্গ তার বান্ধবী এরিকাকে নিয়ে এক টেবিলে বসে পান করতে করতে কথা বলছে। দুজনেই এত দ্রুত বলছে যে শোনার জন্য কয়েকবার রিভার্সে যেতে হলো। দুজনের ব্যক্তিত্ব একে অন্যের বিপরীত। কিন্তু এক জায়গায় মিল রয়েছে। দুজনারই ব্যক্তিত্ব দৃঢ় এবং অনমনীয়। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছে না। বান্ধবীর সঙ্গে ডেটিং কিন্তু পরিবেশটা মোটেও বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বরং প্রথম থেকেই একটা তর্ক শুরু হয়েছে যা ক্রমেই উচ্চকিত হয়ে উঠল। জাকারবার্গের কথায় এরিকা বেশ মনঃক্ষুণœ এবং শেষ পর্যায়ে সে বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে জাকারবার্গ এই কথা বলে কটাক্ষ করার জন্য মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না। সে সোজা বলে দেয় যে তাদের বন্ধুত্ব এখানেই শেষ। এর পর তাকে সে ডেট করবে না। এরিকা চলে যাওয়ার পর জাকারবার্গ কিছুক্ষণ বোকার মতো একা বসে থাকে। এই দৃশ্য দিয়ে সিনেমা কেন শুরু এই প্রশ্ন মনে জাগার পর বুঝতে পারি যে এর মাধ্যমে জাকারবার্গের গণসংযোগ বিষয়ে যে ঘাটতি রয়েছে সেটা দর্শককে জানাবার জন্যই। এর পর দেখা যায় জাকারবার্গ হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন একটা ওয়েবসাইট খোলার ব্যাপারে ক্যাম্পাসের হার্ভাড ক্রিমসনকে জানায় যে, বর্তমানে নয়টা হোস্টেলে পৃথকভাবে তাদের ছাত্রছাত্রীদের তথ্য নিয়ে অনলাইন সাইট রয়েছে। সবাই চাচ্ছে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সাইট হোক যেখানে তাদের সব তথ্য থাকবে এবং ছবি। এইসব দেখে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সামাজিক জীবন গড়ে তুলবে অর্থাৎ ডেটিংয়ে এইসব তথ্য কাজে লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে তারা করবে কিন্তু এর জন্য দুবছর লাগবে বলে জানিয়েছে। ফুহ। আমি এক সপ্তাহে এটা করে দিতে পারি। ক্রিমসনের সম্পাদক তাকে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে নাও। হ্যান্ডবুকটা পড়েছ তো? সেখানে লেখা আছে কোনো ছাত্রছাত্রী ব্রিচ অফ ট্রাস্ট করতে পারবে না। কোনো নিয়মকানুন ভাঙতে পারবে না। শুনে জাকারবার্গ কিছু বলে না। নিজের ঘরে গিয়ে কম্পিউটার নিয়ে বসে বসে কাজ করে। গভীর রাত হয়ে যায়। তারপর সে বেশ প্রসন্নমুখে উঠে দাঁড়ায়। পরদিন দেখা গেল সে ফেসম্যাশ নামে একটা নতুন সাইট খুলেছে সামাজিক যোগাযোগের জন্য। যে নয়টা হোস্টেলে ছাত্রছাত্রীদের তথ্য নিয়ে ফেসবুক নামে যে অনলাইন গাইড রয়েছে সে সেগুলো একত্রিত করেছে একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। সে দুজন ছাত্রীকে কম্পিউটারে পাশাপাশি রেখে একজনকে বলেছে ‘হট’, অন্যজন সম্বন্ধে কিছু বলে নি। তার উদ্দেশ্য হলো এইসব ছবি দেখে এবং তাদের তথ্য জেনে ছেলেরা ডেটিংয়ের জন্য মেয়েদের বেছে নেবে। এটা খোলার পর দেখা গেল প্রথম দিনেই ৪৫০ জন ছাত্র সাইট ভিজিট করেছে এবং ২২০০ ছবি দেখেছে। জাকারবার্গ মহাখুশি। সময়টা ২০০৩ সাল। সে ক্যাম্পাসের অন্যান্য গ্রুপের লিস্ট সার্ভারের কাছে ফেসম্যাশ পাঠিয়ে দেয়। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে মোটেও খুশি হয় না। বোর্ডের মিটিংয়ে ব্যাখ্যা এবং কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য জাকারবার্গকে ডাকা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা বিঘ্ন করার জন্য এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় অনুপ্রবেশের জন্য। এইসঙ্গে যোগ করা হয় ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অপহরণের অপরাধ। শুনানির সময় তাকে নিয়মভঙ্গের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের উল্লেখ করেন কেউ কেউ। শুনানি শেষে প্রথম অপরাধ বিবেচনা করে তাকে বহিষ্কারের পরিবর্তে ছয় মাসের একাডেমিক প্রবেশনে থাকার সিদ্ধান্ত জানানো হয় অর্থাৎ এই ছয় মাসে তার আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং যদি সে আবার তার অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে বহিষ্কার করা হবে। জাকারবার্গ সেই সেমিস্টারে একটা সোস্যাল স্ট্যাডি গ্রুপ গঠন করে আর্ট হিস্ট্রি কোর্স পড়ার জন্য। সে এইবার কম্পিউটারের সাহায্যে একটা ওয়েবসাইট খোলে সেখানে প্রত্যেকটি আর্ট ইমেজ আপলোড করে যার নিচে থাকে ইমেজটি সম্পর্কে বিষদ বর্ণনা। এই ওয়েবসাইট সে আর্ট হিস্ট্রির ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শেয়ার করে। কর্তৃপক্ষ জেনেও কিছু করতে পারে না। কেননা তার এ ওয়েবসাইট পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত, কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়। সুতরাং কোনো নিয়ম বা ট্রাডিশনের পরিপন্থী, এ কথা বলার উপায় নেই। সেই সময় ছাত্রছাত্রীদের তথ্য নিয়ে প্রত্যেক হোস্টেলে ফেসবুক নামে ওয়েবসাইট ছিল। আগেই বলা হয়েছে তখন হার্ভাডের সকল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সমন্বিতভাবে একটা অনলাইন ফেসবুক তৈরি হয় নি। শুধু অনলাইন ডায়রেক্টরি ছিল। ছয় মাস পার হয়ে গেলে জাকারবার্গ ২০০৪ সালে হার্ভাড ক্রিমসনের সঙ্গে কথা বলার পর নতুন ওয়েবসাইট নিয়ে কাজ শুরু করে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় কোড লেখে। সে এই নতুন ওয়েবসাইটের নাম দেয় ‘দি ফেসবুক’। ক্রিমসনের সম্পাদকীয়তে লেখা হয় কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইট তৈরির প্রযুক্তি ইতিমধ্যে পাওয়া গিয়েছিল জাকারবার্গের তৈরি ফেসম্যাশ ওয়েবসাইটে। এর বহুল উপকার আছে। এরপর জাকারবার্গ তার নতুন ওয়েবসাইট স্থায়ী করার জন্য ফেসবুক ডটকম ব্যবহার করে। এই নতুন সাইট উদ্বোধনের এক দিন পর হার্ভাডের সিনিয়র ক্লাসের দুই ছাত্র, ক্যামেরন উইংকলভস, টাইলার উইংকলভস, দিব্যা নরেন্দ্র জাকারবার্গের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, সে তাদের বলেছিল একসঙ্গে মিলে হার্ভাড কমিউনিকেশন নামে একটা নতুন ওয়েবসাইট খোলা হবে। এই ওয়েবসাইট সম্পর্কে তাদের যে ধারণা এবং কৌশল ছিল সেগুলো তারা সরল বিশ্বাসে জাকারবার্গের সঙ্গে শেয়ার করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে সে তাদের না বলে তাদের আইডিয়া এবং কৌশল নিয়ে ‘দি ফেসবুক’ নামে নতুন ওয়েবসাইট খুলেছে যা তারা যদি এখন নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হার্ভাড কমিউনিকেশন ওয়েবসাইট খোলে তাহলে তার প্রতিদ্ব›দ্ধী হবে। এককথায় তারা জাকারবার্গের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ নিয়ে আসে। এর পর তারা আদালতে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মামলা দায়ের করে। প্রায় চার বছর পর ২০০৮ সালে এই মামলার রায় দেওয়া হয় যার ভিত্তিতে অভিযোগকারীরা ১২ লাখ শেয়ার পায় যার ডলার মূল্য ছিল ৩০০ মিলিয়ন। সেই সময় ফেসবুক থেকে ‘দি’ অপসারণ করা হয়েছে এবং এর মালিক হয়েছে জাকারবার্গ। ফেসবুক তখন স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত হয়েছে এবং শেয়ার বাজারে ছেড়েছে। সেই ইতিহাস যথাস্থানে বলা হবে।

২০০৪ সালের শেষের দিকে উদ্বোধনীর পর ‘দি ফেসবুক’ ওয়েবসাইটের সদস্যপদ শুধু হার্ভাডের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এক মাসের মধ্যে আন্ডারগ্রাজুয়েটদের মধ্যে অর্ধেকই এই নতুন সোস্যাল নেটওয়ার্কে রেজিস্টার্ড হয়। এডওয়ার্ডো স্যাভেরিন, ডাস্টিন মক্সোভিচ, এন্ড্রু ম্যাককুলাম এবং ক্রিস হিউ জাকারবার্গের সঙ্গে যোগ দেয় তার নতুন ওয়েবসাইট ‘দি ফেসবুক’ পরিচালনায় সাহায্যের জন্য। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ নতুন ওয়েবসাইট খোলার এক মাস পর এটি কলম্বিয়া, ইয়েল এবং স্ট্যানফোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর পর ওয়েবসাইটটি সব আইভি লীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করে। শুধু আমেরিকা না, কানাডার সব ইউনিভার্সিটিও এই ওয়েবসাইটে যোগ দেয়। এইভাবে দ্রুত অগ্রগতি হয়। ২০০৪ সালের মাঝামাঝি জাকারবার্গের আন-অফিশিয়াল উপদেষ্টা সান পার্কার কোম্পানির প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হয়। সে ন্যাপস্টারের প্রতিষ্ঠাতা ছিল যা বেআইনি হিসেবে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৪ সালের শেষদিকে দি ফেসবুকের অফিস ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টোতে স্থানান্তরিত হয়। বিনিয়োগের জন্য কোম্পানি প্রথম পুঁজি পায় পে প্যালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েলের কাছ থেকে। ২০০৫ সালে ফেসবুকের আগে যে ‘দি’ কথাটি ছিল তা বাদ দেওয়া হয়। ফেসবুক নাম গ্রহণ করার আগে ফেসবুক ডটকম, এই ডোমেইন কিনে নেয় জাকারবার্গ দুলাখ ডলার দিয়ে। ফেসবুক ডটকম ডোমেন এবাউট ফেস কর্পোরেশনের মালিকানাধীন ছিল। ২০০৫ সালের মে মাসে এক্সেল পার্টনার্স ১২.৭ মিলিয়ন ডলারস বিনিয়োগ করে ফেসবুকে। এইসময় জিম ব্লেয়ার নিজের তহবিল থেকে ১০ লক্ষ ডলার দেন। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকের হাইস্কুল সংস্করণ খোলা হয়। ফেসবুক কয়েকটি কোম্পানির জন্যও উন্মুক্ত করা হয়, যেমন অ্যাপেল এবং মাইক্রোসফট।

আমি লিখছি এ সময়ে মোবাইলে পিং করে শব্দ হলো। ফেসবুক খুলে দেখলাম রিফাত মুনির। এর আগে আমার এ ভক্ত পাঠিকা ফোন করেছিল এবং যথারীতি কুশল জানতে চেয়েছিল। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেছি যে, ব্যস্ত আছি এখন। এক ঘণ্টা পরে কল করো। লেখায় এত মগ্ন ছিলাম যে সে কল করলেও টের পাই নি। দেখতে পেয়েছি পরে। কিন্তু তখন সে লাইনে ছিল না। আজকেও লেখার জন্য তাকে কথা বলতে না দিলে অন্যায় হবে। সেইজন্য লেখা স্থগিত রেখে বললাম, হাই রিফাত ! কেমন আছ? রিফাত লিখল, ভালো স্যার। আপনি কেমন আছেন? আমি লিখলাম, ভালো। তারপর লিখলাম, সেদিন ফেসবুকে তোমার একটা লেখা দেখলাম। রিফাত লিখল, ধন্যবাদ স্যার। আপনি পড়েছেন? আমার সৌভাগ্য স্যার। এই টুকটাক লেখালেখি করি ১৯ বছর ধরে। আমি লিখি, বই বেরিয়েছে? রিফাত লেখে, না স্যার। আমি মূলত কলামিস্ট, নানা সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ লিখি। বেশ কিছু প্রকাশিত গল্প আছে। আমি বলি, তাহলে বই বের করতে অসুবিধা কী? রিফাত লিখল, নিজের লেখা এখনো ততটা পরিপক্ব হয় নি। অবশ্য প্রকাশকদের কাছ থেকে অফার পেয়েছি। আমি লিখলাম, এত বছর লেখালেখির পর এখন বই বের না করলে হারিয়ে যাবে। তা ছাড়া প্রকাশকদের অফার যখন আছে ইতস্তত কোরো না। রিফাত লেখে, স্যার ইচ্ছে করলেই বের করা যায়। এখন আমার বয়স চল্লিশ। ইনশাল্লাহ যদি বেঁচে থাকি এবং লিখে যেতে পারি তাহলে পঞ্চাশের পর বের করার ইচ্ছে আছে। আমি বিস্ময়বোধক চিহ্ন দিয়ে লিখি, আরও দশ বছর পর! তাহলে আমি দেখে যেতে পারব না। রিফাত লেখে, স্যার আপনি ইনশাল্লাহ আরও অনেকদিন থাকবেন। তারপর লেখে, কে কবে যাবে কেউ জানে না। আমরা সবাই দৌড়াচ্ছি। কেউ কিছুটা আগে, কেউ পেছনে। আমি লিখি, আমার এখন বয়স ৮০ বছর। আমিই আগে পৌঁছাব, কোনো সন্দেহ নেই। তোমার বই দেখে যেতে পারব না। দুঃখ নিয়ে চলে যাব দৌড়াতে দৌড়াতে। আমি আমার মোবাইলে তাকিয়ে দেখি রিফাতের নামের নিচে এখন লেখা, ওয়ান মিনিট এগো। তার মানে সে অ্যাকটিভ নেই। একটু পর লেখাটা বদলে হয় টু মিনিট এগো। তারপর থ্রি মিনিট এগো। আমি বুঝতে পারি রিফাত ফেসবুক ছেড়ে দিয়েছে কোনো কথা না বলেই এবং বিদায় না জানিয়েই। সে কি আমার বয়স আশি বছর এই প্রথম জানল? জেনে ভিরমি খেয়ে পড়ার মতো হয়েছে তার? তাই কিছু না বলে চলে গেল দ্রুত? একজন ভক্ত হারালাম তাহলে। আমার ব্যবহারের জন্য না। বয়সের কারণে। ঘাটের মরার সঙ্গে চ্যাট করে অযথা সময় নষ্ট, হয়তো এ কথা মনে হয়েছে তার। তাকিয়ে দেখি রিফাতের নিচে এখন এইট মিনিটস্ এগো লেখা। রিফাত অনেক দূর চলে গিয়েছে। আমি আবার লেখায় মনযোগ দিই। আমার ভক্ত পাঠিকার প্রতি যে কর্তব্য ছিল তা পালন করেছি। সুতরাং নির্দোষ মনোভাব নিয়ে এখন জাকারবার্গের কা-কারখানার বাকি ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।

২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুক ১৩ বছরের ঊর্ধ্বে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। একটি মাত্র শর্ত : সকলের ই-মেইল থাকতে হবে। ২০০৭-এর শেষদিকে ফেসবুকের এক লাখ বিজনেস পেইজ ছিল যার মাধ্যমে কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিতে পারত এবং কাস্টমার আকর্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিল। এগুলো প্রথমে গ্রুপ পেজ হিসেবে শুরু হয়। ২০০৭-এর অক্টোবরে মাইক্রোসফট্ ফেসবুকের শতকরা ১.৬ ভাগ শেয়ার কিনে নেওয়ার ঘোষণা দেয় এবং এর জন্য মূল্য দেয় ২৪০ মিলিয়ন ডলার। এ নিয়ে ফেসবুকের নেট ওয়ার্থ দাঁড়ায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মাইক্রোসফট আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ পায়। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ফেসবুক ঘোষণা করে যে তার হেড অফিস ডাবলিনে স্থানান্তরিত করা হবে (সেখানে কোম্পানি ট্যাক্স সবচেয়ে কম)। শেষ পর্যন্ত এটা হয় নি, কারণটি জানা যায় নি। ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে ফেসবুক ঘোষণা করে প্রথমবারের মতো কোম্পানির ক্যাশ ফ্লো পজেটিভ হয়েছে। এই সময়ে এক সমীক্ষায় জানা যায় যে, বিশ্বব্যাপী ফেসবুক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সামাজিক মাধ্যম। এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি কপট বিস্ময় প্রকাশ করে বলে যে ফেসবুকের আগে আমরা কী করে প্রাক্তন প্রেমিকাদের ফলো করেছি, সহকর্মীদের জন্মদিন জানতে পেরেছি, বন্ধুদের পিছু নিয়েছি?

২০০৯-এর পর ফেসবুকের ট্রাফিক ক্রমাগত বাড়তে থাকে। জুলাই ২০১০ সালে ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫০০ মিলিয়ন। এদের অর্ধেক (সাইট মেম্বারশিপ) প্রতিদিন ফেসবুক ব্যবহার করেছে গড়ে ৩৪ মিনিট। ১৫০ মিলিয়ন অ্যাকাউন্ট হোল্ডার ফেসবুক ব্যবহার করেছে মোবাইলের সাহায্যে। ফেসবুক ‘নীরব মাইলস্টোন’ বলে আখ্যায়িত করেছে এই অগ্রগতিকে। ২০০০ সালের নভেম্বরে ফেসবুকের সার্বিক মূল্য হয় ৪১ বিলিয়ন। ই-বেকে অতিক্রম করে ফেসবুক গুগল আর অ্যামাজনের পরই বড় কোম্পানি হিসেবে তার স্থান গ্রহণ করে। ২০০৪-এর মার্চ মাসে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেসবুক প্রতিদিন ২০ হাজার প্রোফাইল প্রত্যাহার করে স্প্যাম, গ্রাফিক কন্টেন্ট এবং স্বল্পবয়সীদের ব্যবহারের জন্য। তার সাইবার সিকিউরিটি শক্তিশালী করা ছিল এইসব পদক্ষেপের উদ্দেশ্য। ২০১১ সালে ফেসবুকের সবচেয়ে বেশি সদস্য সংখ্যা এক জরিপে উঠে আসে এবং তার ওয়েবসাইট ১ ট্রিলিয়ন ভিজিট করা হয় বলে জানা যায়। অন্য কোনো ওয়েবসাইটে এত ভিজিটর যায় নি। গুগলের পরই ফেসবুক তার স্থান করে নেয় ব্যবহারকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক তার আইপিও বিক্রির জন্য আবেদন করে স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে। মূল্য হিসেবে শেয়ার-প্রাইস নির্ধারণ করা হয় ৩৮ ডলার। তখন কোম্পানির নেটওয়ার্থ ছিল ১০৪ বিলিয়ন, নতুন লিস্টেড কোম্পানি হিসেবে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। ন্যাসডাকের মাধ্যমে ফেসবুকের শেয়ার কেনা-বেচা শুরু হয়। মে ২০১৩ সালে ফেসবুক প্রথম ফরচুন ৫০০-এর তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু ২০১২ সালের মে মাসে দেখা গেল ফেসবুকের আয় কমে যাচ্ছে আইপিও ইস্যু করা সত্ত্বেও। আসলে তখন শেয়ারের দরপতন শুরু হয়েছে। সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করে এই দরপতন বন্ধের চেষ্টা করা হয়। সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ থেকে ফেসবুকের আইপিওর মূল্য কেন কমছে তা অনুসন্ধানের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তদন্ত করে দেখা যায় ফেসবুকের আইপিও ছিল একটা চাতুর্যপূর্ণ প্রকল্প যা পাম্প অ্যান্ড ডাম্প নামে পরিচিত। ২০১২ সালের মে মাসে ক্লাশ অ্যাকশন মামলা করা হয় ফেসবুকের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ এনে। তদন্তে বলা হয়, ফেসবুকের অন্যতম আন্ডাররাইটার মরগান স্ট্যানলি ফেসবুকের শেয়ারের সংশোধিত মূল্য তাদের বাছাই করা লোকদের জানায় অন্য শেয়ার হোল্ডারদের কাছে থাকে অতিরিক্ত মূল্যের শেয়ার। সব আন্ডাররাইটার্স, ফেসবুকের সিইও, বোর্ড এবং ন্যাসডাকের বিরুদ্ধে ক্লাস অ্যাকশন মামলা রুজু করা হয়। তদন্তে আরও বলা হয় যে সাধারণ শেয়ার ক্রেতাদের অতিরিক্ত মূল্যের শেয়ার দিয়ে আন্ডাররাইটাররা সংশোধিত মূল্যের তথ্য ব্যবহার করে নিজেরা মুনাফা অর্জন করে। ২০১২ সালের মে মাসে ফেসবুকের শেয়ারের মূল্য অর্ধেক কমে আসে। এর ভিত্তিতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলে যে ফেসবুকের আইপিও ইস্যু একটা ফিয়াসকো। জাকারবার্গ সবার নজর অন্যদিকে নেওয়ার জন্য জানায় যে, ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে মাসিক অ্যাকটিভ ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ফেসবুকের নিজের তথ্য অনুযায়ী এ সময়ে ৬০০ মিলিয়ন মোবাইল ব্যবহারকারী ছিল এবং ১৪০ মিলিয়ন ফ্রেন্ড।

ফেসবুকের মার্কেট প্রাধান্যের জন্য এই কোম্পানি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বহুল আলোচিত। অনেক প্রতিবেদনে তার দুর্বল দিকগুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। যেসব সমস্যা আলোচনায় এসেছে তার মধ্যে রয়েছে প্রাইভেসি রক্ষা, লাইক বাটন ব্যবহার করে তৃতীয়পক্ষের ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করা, কোনো তথ্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য রেকর্ডভুক্ত করে রাখা এবং কর্মস্থলে কোম্পানির সেন্সরশিপ। ২০১৪ সালে হাফিংটন পোস্ট-এর ব্লগ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘ফেসবুক, পৃথিবীর সবচেয়ে সময়ক্ষেপণকারী’। বিল রবিনসনের মতে ফেসবুক ব্যবহার সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে না। তিনি এর প্রতি আসক্তি জন্মানোর প্রতিও ইঙ্গিত করেন। অনেকে বলেছেন ফেসবুক ব্যবহার করার মাধ্যমে হিংসা বৃদ্ধি পায় এবং কাজে মনোযোগ ব্যাহত হয়। ক্লান্তিও আসে একসময়। কেউ কেউ ফেসবুকের প্রতি আসক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন মাদকাশক্তির। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া, কর্মস্থলে সেন্সরশিপ এবং আমেরিকান সরকারের নজরদারি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য ফেসবুক সমালোচিত হয়েছে। ব্যবহারকারীদের নিজেদের লেখা প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে সন্ত্রাস এবং অসাধুতার প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য ফেসবুক সমালোচিত হয়েছে। ‘ফেক নিউজ’ এবং নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগও এসেছে।

ফেসবুক একাধিক মামলায় জড়িত হয়েছে প্রথম থেকেই। ক্যামেরন উইংকলভস, টাইলার উইংকলভস এবং দিব্যা নরেন্দ্র জাকারবার্গের বিরুদ্ধে ছাত্র অবস্থাতেই হার্ভাডে থাকাকালীন যে মামলা দায়ের করে তার উল্লেখ করা হয়েছে। নভেম্বর ২০১৭-তে জানা যায় প্যারাডাইস পেপার নামে পরিচিত প্রতিবেদন অনুযায়ী রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় এজেন্সি, যার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্পর্ক আছে, ফেসবুক এবং টুইটারে বিশাল অংকের বিনিয়োগ করে এক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে। এই মধ্যস্থতাকারী রাশিয়ান ব্যবসায়ী জাকারবার্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ট্রাম্পের জামাই জেরার্ড কুশনারের ব্যবসায়-সহকারী। ‘দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ অনুযায়ী ফেসবুক অফশোর কোম্পানি খুলে কয়েক বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে। রাশিয়ার গজপ্রম কোম্পানি ফেসবুকের শেয়ার কিনে অসাধু উপায়ে অনেক আয় করে বলে জানা যায়। মার্চ ২০১৮ ব্ল্যাকবেরী ফেসবুক এবং তার সাবডিভিশন ইনস্টাগ্রাম এবং হোয়াটস্ এ্যাপ-এর বিরুদ্ধে তার মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনের গুরুত্বপূর্ণ ফিচার অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ আনে। ব্ল্যাকবেরীর অভিযোগ, ফেসবুক এবং তার সাবসিডিয়ারী কোম্পানিগুলি তাদের মেসেজিং-এর মূল কৌশল কপি করে ব্যবহার করেছে।

ফেসবুকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকট দেখা দিয়েছে বর্তমানে। ২০১৮-এর মার্চে তথ্য প্রদানকারীরা প্রকাশ করে যে ৫০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর ডাটা ফেসবুক কেমব্রিজ এনালিটিকা নামে এক রাজনৈতিক তথ্য বিশ্লেষণী কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়। এই কোম্পানি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করেছে। লন্ডনের ‘অবজার্ভার’ পত্রিকা যেন ফেসবুকের ডাটাসম্পর্কিত খবরটি ফাঁস করে না দেয় তার জন্য ফেসবুক খুব চেষ্টা করে। এর পর ব্যর্থ হয়ে ফেসবুক ডাটাগুলির গুরুত্ব নেই বলে প্রচার করে এবং এইসব তথ্য কেমব্রিজ এনালিটিকার কাছে এখন নেই বলে জানায়। কিন্তু ফেসবুকের প্রাক্তন কয়েকজন কর্মকর্তা এবং ডকুমেন্ট পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে কেমব্রিজ এনালিটিকার কাছে এখনো তথ্য আছে। ফেডারেল ট্রেড কমিশনের সঙ্গে ফেসবুক যে সম্মতি-সম্পর্কিত চুক্তি করেছে এই ডাটা দেওয়া তা লঙ্ঘন করেছে। যদি এটা প্রমাণিত হয় তাহলে ফেসবুককে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে। লন্ডন অবজার্ভার পত্রিকা অনুযায়ী ফেসবুক এবং কেমব্রিজ এনালিটিকা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে হুমকি দিয়েছিল। খবর ছাপার পর ফেসবুক বলেছে যে তাদের প্রতি মিথ্যাচার করা হয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদনকারী ক্যারল ক্যাডওয়ালডার বলেছেন যে, ফেসবুক এখন সব দোষ তৃতীয় এক পক্ষের ওপর চাপাতে উদ্যত। ব্রিটিশ হাইকোর্ট ইনফরমেশন কমিশনের এক আবেদন অনুমোদন করে কেমব্রিজ এনালিটিকার অফিস তল্লাসির পথ সুগম করে দিয়েছে। এর ফলে ফেসবুকের ডাটা নিয়ে ইনফরমেশন কমিশনের সঙ্গে যে মুখোমুখি অবস্থান ছিল তার অবসান হয়েছে। তদন্ত এখন চলছে। ২০ মার্চ জাকারবার্গ ইংল্যান্ডের প্রধান সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিশ্বাসভঙ্গের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। বিজ্ঞাপনে তিনি বলেছেন যে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ২০১৪ সালে কয়েক মিলিয়ন অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের তথ্য প্রকাশ করেছিল। তার মতে, ‘এটাই ছিল বিশ্বাসভঙ্গের কারণ, এর জন্য ফেসবুক প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নয়। এমন ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য ফেসবুক কাজ শুরু করেছে, আমি দুঃখিত। আমরা এখন থেকে অ্যাপস্ বিষয়ে ব্যবহারকারীদের জানাব যেন তারা প্রাইভেসি রক্ষার জন্য অ্যাপস্গুলো প্রয়োজনে বন্ধ করে দিতে পারে’।

২১ মার্চ আমেরিকার ফেডারেল ট্রেড কমিশনার ফেসবুকের বিরুদ্ধে কেমব্রিজ এনালিটিকায় তথ্য দেওয়ার জন্য তদন্ত শুরু করেছে। শেষ খবরে প্রকাশ জাকারবার্গ ১০ এপ্রিল সিনেট হিয়ারিং কমিটির সামনে জেরার মুখোমুখি হয়েছে। সে খুব চতুর, লোভী এবং অসৎ তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই, এই বিশ্বাস এখন অনেকের মধ্যে হয়েছে।

পাঁচ

কাকলীর মনকথন

কাকলী আহমেদ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। তিনিই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড আর আমাদের কমনফ্রেন্ড দেখে তাঁর রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়েছেন, সেটাও তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার একটি কারণ, কেননা আমিও ওই বিভাগের ছাত্র এবং সেখানে এক বছর শিক্ষকতা করেছি। একদিন ফেসবুকে ওয়ালে তাঁর একটা পোস্ট দেখলাম। একটা ব্যক্তিগত প্রবন্ধ, তবে ভিন্ন ধরনের। নাম ‘মন কথন’। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। একটু পরেই লেখাটা সামনে টেনে নিল, বিষয়টা এমন। লেখার ভঙ্গিতে অন্তরঙ্গতার সুর। যেন নিভৃতে নির্জনে মনের কথা বলছে কেউ। নিবিষ্ট মনে পড়তে থাকি আমি : মন ভালোর ঠিকানা নেই কোনো। এদিক ওদিক চারদিক খুঁজেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। বাউলেপনায় অথবা হেসে খেলে বন্ধু বেশে কখন যে হেসে কাছে দাঁড়ায়। কাছে এসে গায়ে হেলান দেয়। চুল দিয়ে বিনুনি না খোঁপা বাঁধবে তা-ও জিজ্ঞাসা করে। মন ভালোর আয়েশি বড্ড বেশি। ঘুমকাতুরে। এক ঘুমে দিনের ওপরে দিনান্তে চলে যায়। কবে আসবে ফিরে, এই বলে তো যায় না। ঘরের দেউরিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় না জানাতেই ফুরুৎ। মনের আড়ালে আবডালে ঘুপচি নাকি শ্যাওলা চাতালে সে পড়ে থাকে কে-ই না জানে। মন ভালোর না আছে সীমানা, না আছে আকার। কখন যে এসে মনের ডালে বসে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানে সবাই চিত্তে বাড়ি বাঁধবে বলে দোলা দিয়ে পালায়, কে জানে।

মন ভালোর নাম নেই কোনো। খামের ওপরে ঠিকানাহীন মন ভালোকে পুরে অজানা ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়। মন ভালো করা নেই তার উপায়। এইটুকুই লেখা কিন্তু তার মধ্যেই একটা চমৎকার আবহ সৃষ্টি হয়ে যায় যেমন একটা মৃদু হাওয়া ঘরে এসে ছুঁয়ে চলে যায় বাইরে। কিন্তু তার রেশটা রেখে যায়। একজনের মন্তব্যের উত্তরে কাকলী লিখেছেন : আপা, মন খারাপের আগের টুকরো লিখেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। যদি পাই তুলে দিচ্ছি। মন্তব্যকারী : তাই নাকি? দাও গো।

কাকলী : খুঁজে পাই না। আপা জীবনে আমি কোনো লেখা কপি করে রাখি না।

মন্তব্য : আল্লাহ! কেন? এত্ত সুন্দর লেখাগুলো হয়।

কাকলী : আপা আমি তো ছটফটে। এজন্য মার কাছে কী যে বকা খেতাম।

মন্তব্য : আর খালাম্মা ছিলেন ঠিক তোমার অপোজিট।

কাকলী : পেয়েছি। নাম ‘মন বাড়ির খবর’। পড়ে শোনাচ্ছি।

মন খারাপের কোনো বাপের বাড়ি নেই। মনে টুকটাক ব্যথা পেলে মন খারাপ করে সে দুই-তিন দিন বাপের বাড়ি গিয়ে বাঁ কাতে শুয়ে ‘মায়াবন বিহারিনী’ ধরনের গান শুনে বাড়ি ফিরবে সে উপায় নেই। মন খারাপ আড়মোড়া ভেঙে আবার সেই কুকুরকু-লী মেরে মনের চিলেকোঠায় বা তেকোণ বারান্দায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শীতের কুয়াশার বাড়াবাড়ি, ঝলমলে রোদ, মেঘের ভেতরে ভাল্লুকের মুখ খোঁজা, কিছুই মন খারাপকে তাড়িয়ে দিতে পারে না। কেবল সে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। মন খারাপের কোনো যমজ বোন নেই। নেই কোনো ভাইবোন। মন খারাপের পাশাপাশি বসে থেকে চুলে বিলি কাটা যায় না, বাঁধা যায় না দুটো বিনুনি।

মন খারাপ কেবল গলা জাপটে ধরে। সেই কবেকার মন খারাপগুলো কেবল পিলপিল ছুঁয়ে এসে জমা হয়।

মন খারাপের সঞ্চয়ের ঊর্ধ্বগতি ধাই ধাই করে বাড়ে।

মন খারাপের কোনো বিদায় নেই কখনো।

মন্তব্য : এটা আরও বেশি ভালো।

আর একজনের মন্তব্য : মন খারাপ তুমি মন ভালোকে পাঠিয়ে দেবে কাকলী আপুর কাছে?

কাকলী : দরজায় কড়া নাড়ছে আপা।

আরেকজন : মন ঘুরে দেখা যায়? মন বড় জটিল জিনিস। তার নাগাল কেউ পায়?

চমৎকার অনুভূতি, তার চেয়েও অভিনব লেখার শৈলী। আমি মুগ্ধ হই। এমন লেখা আগে পড়ি নি। আমি আমার ওয়ালে কাকলীর উদ্দেশে লিখি, এ দুটো লেখা কমেন্টসহ আমার কোনো লেখায় ব্যবহার করতে পারি? আপনার নাম না দিতে চাইলে ছদ্মনামে? কাকলী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে লিখলেন : অবশ্যই ব্যবহার করতে পারেন। ছদ্মনামে কেন, আমার নামেই ব্যবহার করতে পারবেন। আমি লিখে দিচ্ছি। আপনি ব্যবহার করুন। যে গল্পে ব্যবহার করবেন তার নাম জানালে খুশি হব। আমি লিখি : এখনো কিছু শেপ নেয় নি। একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। দেখি কী হয়। আপনাকে ধন্যবাদ। কাকলী : না না, ঠিক আছে। সালাম রইল। আমি খুব খুশি হব। আমি : আপনি শুধু ফেসবুকেই লেখেন? কাকলী : জি-না। অনলাইন কিছু ম্যাগাজিন। আর টুকটাক। আমি ব্যাংকে কাজ করি। ফলে এত অনুমতি নিতে হয়। আমি : আপনার লেখার খুব ভালো হাত। নিজস্ব শৈলী তৈরি করেছেন। আর খুব আন্তরিক এবং সৎ। বড় পত্রিকায় ছাপান, বই বের করুন। আমার প্রকাশককে বলব যদি চান। আমি ফেসবুকে নতুন তাই আপনার সঙ্গে আগে পরিচয় হয় নি। কাকলী : কী যে বলেন স্যার! সত্যিই বই বের করতে হবে? আমার বাবা-মার এত ইচ্ছে ছিল। দুই বছরের ব্যবধানে দুজনে চলে গেলেন। তাই আরও মনে হয় কোনোদিন বই বের করব না। আপনি যা বললেন এইটুকুন আমার বিরাট পাওয়া। আমি : কেন বই বের করবেন না? কত বাজে লেখা নিয়ে বই বের হচ্ছে। আপনি জাত লেখক এই একটা লেখা পড়েই বুঝেছি। কাকলী : আমার লেখা ছোটগল্প পড়তে দেব আপনাকে। অনলাইনে ছাপা হয়েছে। স্যার আপনি প্রশংসা করেছেন তাতেই আমি যারপরনাই খুশি। আমি আপনার উপন্যাস ছোটবেলা থেকে পড়তাম। ‘নভেরা’ আমার শেষ পড়া (এই সেরেছে। আবার নভেরা?)। জি, প্রকাশককে বলবেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে (বুঝলাম প্রকাশকদের ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই), আমি তৈরি হব লেখা নিয়ে। স্যার, সালাম দিয়ে শেষ করি। নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বিরক্ত করছি। আমি : জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি কোথায় থাকি। আমি ধানমন্ডি থাকি। কাকলী : খুব ভালো। স্যার ভালো থাকেন। আমি এত ভয়ে আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছিলাম। আপনি গ্রহণ করেছেন। আমি খুশি। আমি : মোটেও বিরক্ত হই নি। অনেক ধন্যবাদ। কাকলী : আচ্ছা স্যার ভালো থাকেন।

এর পর কাকলীর সঙ্গে ফেসবুকে ফোনে আলাপ হয়েছে। তাকে জানিয়েছি আমিও অর্থনীতির ছাত্র। অনেক বছর আগে পাস করে বেরিয়েছি। ১৯৬০ সালে এমএ পরীক্ষা দিয়ে বিদেশে চলে যাই। আপনি তো ১৯৯২ সালে এমএ পাস করেছেন। তাহলে বয়সে আমি প্রায় আপনার বাবার সমান। ফ্রেন্ড হয়েছি ফেসবুকে কিন্তু আমি আপনাকে পিতার অপত্য স্নেহের চোখেই দেখব। তারপর লিখি : আমাকে সবাই ভয় পায়। ভাবে রাগী। আমি সত্যিই রাগী। কিন্তু ভেতরে একটা নরম মনও আছে। লোকে টের পায়, কিন্তু বেশ পরে। নাহলে কাছে আসতে চাইবে কেন? গ্রিক দেবতা জেনাসের মতো আমার দুটো মুখ, দুটো স্বভাব। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কাকলী : কথা বলার পর ভয় পাচ্ছি না। ধন্যবাদ স্যার।

কয়েকদিন পর ফেসবুকে কাকলীর পোস্ট দেখতে পেলাম। গালে হাত দিয়ে মুখ অর্ধেক ঢেকে আছে। তাকিয়েছেন সামনাসামনি না, এক পাশে। মুখে একধরনের সূক্ষ্ম হাসি। কমেন্টে লিখেছেন লোকে বলে আমি হাসি না। তাই হাসিমুখে ছবি তুলে পোস্ট করলাম। আমি কমেন্টে লিখলাম : দুষ্টুমি ভরা হাসি।

আর একদিন তার পোস্টে তাঁকে সাদামাটা নীল শাড়ি পরে, এল চুল কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল। এক গালে বেশ বড় টোল। নিচে লিখছেন : ছবিটা আমাকে অনেকটাই প্রকাশ করে। অত্যাধুনিকতায় বয়ে চলা আমার ধাতে নেই, তেমন আটপৌরে আসলেই আমি। আর একদিন একটা পোস্টে তিনি লিখেছেন : দিন সাতেক ধরে টঙের চা পান করবার ইচ্ছা গলায় ফাঁস দিল আজ সন্ধ্যায়। এর কিছুদিন পর তাঁর আর একটা ব্যক্তিগত লেখা পড়লাম, ওপরে ফুল কুড়োনোর ছবি। লিখেছেন : বেছে বেছে শুধু ভালো ফুলগুলিই নিলে...কই কুড়োবার সময় তো বেছে উঠাও নি। যত তার লেখা পড়ি কাকলীর ব্যক্তিগত ছোট প্রবন্ধ আমাকে মুগ্ধ করে। এর পর তার এক লেখায় পড়লাম : আমরা কেবলই আমাদের সাফল্যের সঞ্চয় করে রাখি। ব্যর্থতা ঢাকি ভাগ্যে ছিল না বলে। তাই কি? এমন অন্তরঙ্গ স্বর হৃদয়ে স্পর্শ করে যায়। অথচ এই লেখকের কোনো বই নেই। প্রকাশকেরা এদের মতো লেখককে খুঁজে বের করে তাদের বই ছাপায় না কেন? দেখলাম কাকলী তাঁর গালে হাত দিয়ে মুখ অর্ধেক ঢেকে মোনালিসা হাসি ঠোঁটে নিয়ে যে ছবি পোস্ট করেছেন তার জন্য পেয়েছেন ২৭৭ লাইক। কমেন্ট ৪২। ফ্যান্টাস্টিক।

 

ছয়

সালাম, মি. নাইস

সালাম সালাহ উদ্দিন ফেসবুকে খুব তৎপর। সবার লেখা পড়ে আর লাইক না দিয়ে লেখে, নাইস। শুধু লাইক দেওয়ার মধ্যে যে দায়সারা তার মধ্যে না গিয়ে সে ওই একটি কথা দিয়ে জানিয়ে দেয় পোস্টটি সে পড়েছে। এমন সৌজন্যবোধ বেশ বিরল। বিশেষ করে যেখানে ‘বন্ধুদের’ সংখ্যা অনেক। নিজে যেসব ছবি পোস্ট করে তার বেশির ভাগই নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে। বোঝা যায় মেয়ে দুটির জন্য তার স্নেহের শেষ নেই। এর পর যেসব ছবি সে পোস্ট করে সেসব প্রায়ই কোনো না কোনো পার্কে তোলা। মনে হয় তার প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস আছে। কখনো কখনো সে সঙ্গে মেয়েদেরও নিয়ে যায়। আর একশ্রেণির ছবিতে তাকে দেখা যায় নতুন ধরনের জামা গায়ে। অনেকে সেই জামার প্রশংসা করে, আমিও করি। সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করি তার মেয়েদের। খুব লক্ষ্মী আর শান্ত। বড় মেয়েটি ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সে একটি রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিল। অল্প বয়সেই তার গায়কিতে দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছে।

সন্জীদা খাতুনের ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে সালাম একটা পোস্ট দিয়েছে। লিখেছে : সন্জীদা খাতুনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আমাদের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা ও বিকাশে যে কজন নিবেদিতপ্রাণ প্রায় নীরবে কাজ করে চলেছেন, তাদের একজন সন্জীদা খাতুন। সাংস্কৃতিআন্দোলনের মধ্য দিয়েই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সংগীত সুধায় পূর্ণপ্রাণ তিনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতির অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক-গবেষক, সংগঠক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে সভাপতি। এ ছাড়া তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পড়ার পর আমি লিখি : তিনি এখন অন্যতম নন, শীর্ষস্থানীয় এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের পুরোভাগে রয়েছেন। ‘অন্যতম’ বললে তার যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। আর তিনি কখনোই নীরবে কাজ করে যান নি। বেশ জানান দিয়েই বৈরী শক্তির তোয়াক্কা না করে তাদের নাকের ডগার সামনে দিয়ে কাজ করে গিয়েছেন। তাকে নীরব কর্মী বা সাধক বললে খাটো করে দেখা হয়। এই মন্তব্য করে আমি সালামের সমালোচনা করতে চাই নি। কেবল সে যা বলতে ইতস্তত করেছে সেই কথা বলেছি। সাংবাদিক বলেই তাকে হয়তো নিরপেক্ষ হয়ে কথা বলতে হয়েছে। কিন্তু সবক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা যায় না, থাকলে সত্যের অপলাপ হয়।

 

সাত

অপরাহ্ন সুস্মিতের কবিতা

ভোর চারটায় ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ডাইনিং টেবিলে বসে লিখছি। নোটবুক থেকে ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখে লেখার চেষ্টা করছি। তাড়াতাড়িতে লেখার জন্য অধিকাংশ লেখাই অস্পষ্ট, এত খারাপ যে নিজের হাতের লেখা পড়তে পারি না। বোঝার চেষ্টা করছি এমন সময় পিং করে শব্দ হলো। কেউ ফেসবুকে নক করছে। ভোর সাড়ে চারটায় বাংলাদেশের কেউ হবে না, নিশ্চয়ই দেশের বাইরে থেকে পোস্ট দিচ্ছে। ফেসবুক খুলে দেখি, অপরাহ্ন সুস্মিত। ফেসবুকেই তার কবিতার সঙ্গে পরিচয় এবং তাৎক্ষণিক মুগ্ধতা সৃষ্টি। সব সময় না, মাঝে মাঝে আমি কবিতা পড়ি; কিন্তু তার মতো কবিতা আমার চোখে পড়ে নি। সে একেবারেই স্বতন্ত্র। অথচ তার কবিতা নিয়ে কোনো আলোচনা চোখে পড়ে নি। অন্যদের মুখে তার নামও শুনি নি। মনে হয় ফেসবুকে না এলে সে আমার অজানাই থেকে যেত। দেখলাম সে ফেসবুকে লিখেছে : আপনার পছন্দের কবিতা পাঠাচ্ছি। আমি লিখি : তুমি কোথায় থাকো? মনে হচ্ছে বিদেশে? না হলে এ সময়ে আমাকে পোস্ট দিতে না। অপরাহ্ন লিখল : মন্ট্রিয়লে। পোস্ট যে-কোনো সময়েই দেওয়া যায়। যার কাছে যায় তিনি ঘুমিয়ে থাকলে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন। আমি লিখি : ঠিক বলেছ। কতদিন থেকে লিখছ? সে উত্তর দেয় : বেশ কয়েক বছর। আমি লিখি : বিদেশ থেকে দেশের পটভূমি নিয়ে লিখতে অসুবিধে হয় না? সে লেখে : না। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। বইমেলার সময় দেশে যাই। প্রচুর বই কিনি। আমি লিখি : শুধু কবিতা লেখ? তার উত্তর আসে : না। গল্প, প্রবন্ধ সবই লিখি। তারপর লেখে : এর আগে আপনার কয়েকটা পোস্ট দেখেছি। আপনি রাত জাগেন। খুব ভোরে ওঠেন। চান্স নিলাম। আমি লিখি : মন্ট্রিয়লে এখন বেলা কত? সে লেখে : বিকেল ছ’টা।

অপরাহ্ন সুস্মিতকে আমি কখনো দেখি নি। সে ছেলে না মেয়ে তা-ও আমি বুঝতে পারি না। এ রকম নাম আজকাল ছেলে বা মেয়ে যে-কারও হতে পারে। প্রোফাইলের যে ছবি ছোট আকারে পোস্টের পাশে থাকে সেটা দেখে তার জেন্ডার বোঝার উপায় নাই। নুরুল করিম নাসিম বলেছে সে মেয়ে। তাতে আমার সংশয় যায় নি। কাকলী আহমেদকে জিজ্ঞেস করেও জানতে পারি নি। ফেসবুকে পর পর তার কয়েকটা কবিতা পড়ে আমি স্তম্ভিত এবং মুগ্ধ। এমন সহজ-সরল ভঙ্গিতে অন্তরঙ্গ সুরে কবিতা লেখা যায়? আটপৌরে জীবনের কথা শোনা যায় তার কবিতায় আটপৌরে ভাষাতেই। একটাতে সে লিখেছে দুই প্রেমিক-প্রেমিকার কথা। দুজনই বাজারে গিয়েছে। একজন আড় চোখে দেখছে। অন্যজন না-দেখার ভান করছে। প্রথমজন দ্বিতীয়জনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল যদি হাতের কাপড়ের স্পর্শ লেগে টের পায়। টের পেল না। বাড়ি গিয়ে সে বাদাম খেতে খেতে টেলিভিশন দেখছে। একটা পোস্ট দিল সে সুজির হালুয়া খেতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল : ঢেরসের পর কেউ সুজির হালুয়া খায় না। পড়ে শিহরিত হলো সে। তাকে দেখেছে ঠিকই। কিন্তু কথা বলে নি। কী কী কিনেছে সব মনে রেখেছে। চমৎকার প্রেমের কবিতা। একজন পড়ে মন্তব্য করেছে : গ্রসারি শপ রোমান্স। আরও অনেকে লিখেছে প্রশংসা করে। আর একটা কবিতায় গ্রামের কথ্যভাষা ব্যবহার করেছে অপরাহ্ন। এক জেলে তার ভালোবাসার মানুষ আসমানী নামের মেয়েকে ডাক দিচ্ছে তাকে কই মাছ ধরে দেবে বলে। কবিতার শেষের লাইন দুটো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমি পড়ে ছড়ার আকারে মন্তব্য দিয়েছি : অপরাহ্ন কী করে লেখ তুমি এসব কবিতা?/ সহজ সরল অথচ গভীর বারতা। আর একটা কমেন্ট এই রকম : কবি নই, কবিতাও পড়ি নি কো আগে/ তোমার কবিতা পড়ে কবি হই এই সাধ জাগে।

অপরাহ্নের কবিতা পড়ে বোঝা যায় না কবি নারী না পুরুষ। এমন স্বরে কবিতা লেখে সে, যে ছন্দ তৈরি করে তার ভিত্তিতে একবার মনে হয় নারীকণ্ঠ শুনছি, পরক্ষণেই মনে হয় পুরুষের স্বর। নারী ও পুরুষের যে ভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ভিন্ন প্রকাশ তার কবিতায় উভয়েরই উপস্থিতি। কবিতায় যখন কেউ কথা বলে সে যে মেয়ে না পুরুষ, বোঝার উপায় থাকে না। কবিতার শৈলীতে, শব্দ ব্যবহারে এবং পঙ্ক্তি রচনায় এই যে দ্ব্যর্থবোধকতা, জেন্ডার নিরপেক্ষতা, এই বৈশিষ্ট্য অপরাহ্নকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছে। অ্যান্ড্রোজেনাস বলে যদি কোনো চরিত্র থাকে, ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় সে তার এপিটম। কমেন্ট পড়ে দেখেছি অধিকাংশই মহিলা। এ থেকে উপসংহারে আসা যায় যে তারা তার কবিতায় নিজেদের স্বর খুঁজে পান, মনের অনুভূতি একই বলে প্রতিভাত হয়। অপরাহ্নের লেখার সঙ্গে পরিচয়ের পরই আমি কমেন্টে প্রশংসা জানাই। সে ত্বরিতে উত্তর দেয়। সম্বোধন করে ‘প্রিয় লেখক’ বলে।

ফেসবুকের সংলাপ নিয়ে উত্তর-আধুনিক যে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা সেখানে শুধু তার নাম না, সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও না, ছাপতে হবে অন্তত দুটো কবিতা। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তাকে আমি জানালাম এবং সে সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিল। এর পর তাকে লিখলাম যে, মোবাইল থেকে তার কবিতা উদ্ধার করতে পারছি না। সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটি কবিতা পাঠিয়ে দিল ফেসবুকে এবং ই-মেলে। পড়ে দেখলাম যে দুটি কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি সে দুটি তার পাঠানো কবিতার মধ্যে নেই। পুরোনো কবিতাগুলোও ভালো। কিন্তু নতুনগুলো আরও ভালো। তাকে লিখলাম তোমার সাম্প্রতিক কবিতা দুটি পাঠাও। আজ ভোরে যখন সে ফেসবুকে নক করল আমি তাকে লিখলাম : কবিতাগুলো পাঠিয়েছ? সে লিখল : পাঠাচ্ছি। এবার শুধু ই-মেলেই পাঠাব। আতাতুর্ক পাশা এসে লেখাটা টাইপ করার সময় তাকে ই-মেলে কবিতা দুটো বের করার জন্য বললাম। তিনি ই-মেল খুলতেই অন্য পুরোনো কবিতার সঙ্গে নতুন দুটি কবিতাও দেখা গেল। আমি পাশাকে বললাম, পারবেন এ দুটো আমাদের লেখার মধ্যে ট্রান্সফার করে নিয়ে আসতে? তিনি বললেন : কোন জায়গায়? আমি বললাম : ঠিক এখানে।

অপরাহ্ন সুস্মিতের কবিতা

১॥ খলবল কবিতা

পরানে

পরানে কৈ মাছ ঘাই মারে ও মুন্সিবাড়ির আসমানী

শাড়িতে গতর ঢাকে না? তুমি তো আমার জেলেনী।

দেখো না দিনমান আমার উথাল নদী দুই কূল

কি আমে আইছিলা কও আমারে আকুল

এই টং ঘরে বিড়িতে দিলা আগুন পিরিতী

অন্তরে সিনেমার গান, দেখো না পাষাণী?

জ্বরে আমি ভালুক হইছি পারি না সাঁতার

ডাক দাও কেনে? নামুক না আষাঢ়।

নৌকার খোঁপে পানি ভাসি যায় তবু নাই দানাপানি

বেবাক কৈ আজ দিবো নে তোমার গতর টানি টানি

কী করে থাকবা জলের দেশে আমি উজান ছেইলে

খোঁটা দিবা? তবু পিরিতী দিয়ো গো মেইলে।

ধুপধাপ কোথা চলি গেলে সেই চৈত্তিরে

আগুন ধরায়ে দিবা আমার বিড়িটারে?

না আছে নিজের খালপাড় বাড়ি, নাই মাছের আড়ত

চলো জাল ফেলি ভাঙি দেই তিন কূলে সিকস্তি পাড়ত

ওলো দৌড় দিবা? চলো ছাড়ি গাও গেরাম সীমানা

মাইক বাজায়ে নিমুনে তোমারে টাঙ্গায়ে শামিয়ানা।

চুমা দিবা নাকি কও খোদার কসম কানে কানে

আহারে অই দেখো ঘাই মারে কৈ, চলো যাই উজানে উজানে

 

২ ॥ দুজনে দেখা হলো

ঢেঁরস কিনতে গিয়ে ওর সাথে আলাপ। ও তখন সুজি কিনছিল। কথা হয় নি। আমি শীতটুপি পরা ছিলাম। ওর হাতে বাস্কেট। দোকানে ভিড়ভাট্টা ছিল। ভাবছিলাম পাশ কাটাবার ছলে আলতো করে ধাক্কা দিই।

পাশ কেটে যাওয়ার সময় সাহস হলো না। তবে দুজনের জ্যাকেটে খস খস শব্দ হলো।

ঘোড়াড্ডিম টেরই পেল না।

সন্ধ্যায় লিখলাম :

: সুজির হালুয়া খেতে ইচ্ছে করছে।

সর্বনাশ ! কিছুক্ষণ পর দেখি ওর স্ট্যাটাস।

: ঢেঁড়স খেয়ে সুজির হালুয়া খেতে হয় না।

বিরস বদনে ওর পোস্টে লাইক করে দিলাম।

 

আট

মালেকা ফেরদৌসের কবিতা

ফেসবুকে আমার যে তিন মাসের অভিজ্ঞতা তার ভিত্তিতে দেখছি অধিকাংশই তাদের লেখা কবিতা পোস্ট করেন। এর দুটো কারণ রয়েছে বলে মনে হয়। প্রথমত, তারা কবি যে জন্য কবিতাতেই মনের ভাব প্রকাশ করতে আগ্রহ বেশি। দ্বিতীয়ত, লেখার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট করে বন্ধুদের কাছে যেমন পৌঁছে দেওয়া যায় পত্রিকায় কিংবা ম্যাগাজিনে হলে তেমন তাড়াতাড়ি হতো না। অনেকের ক্ষেত্রে পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কের অভাবে হয়তো ছাপাই অসম্ভব হয়ে পড়ত। ফেসবুক এই দুটি সুযোগই এনে দিয়েছে তাদের সামনে। মালেকা ফেরদৌস ফেসবুকে প্রায়ই কবিতা লেখেন। প্রায়গুলোর সঙ্গে থাকে নজরকাড়া ছবি। এমন একটা ছবি—সকালবেলায় নদী কিংবা বিলের ওপর দিয়ে সারি বেঁধে চলে যাচ্ছে একঝাঁক পাখি। আর একদিন দেখলাম নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কেবল একটি পাখি। দ্বিতীয় ছবির ওপরে মালেকা যে কবিতা লিখেছেন তার স্বর রোমান্টিক হলেও বাস্তব। তিনি কল্পনা করছেন যে, পাখিটি ঝড়ে কিংবা বৃষ্টিতে তার সঙ্গীকে হারিয়েছে। যে নদী বৃষ্টির পানি নিয়ে ছুটে চলেছে পাখি যেন তার কাছে সন্ধান করছে তার সঙ্গীর। কবি নদীর উদ্দেশে যখন বলেন যে, সে মেঘের ঠিকানা ছেড়ে চলে এসেছে তখন নদী, মেঘ আর বৃষ্টির সম্পর্কটা চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। কবি নদীর সহানুভূতি আকর্ষণের জন্য বলেন, নিঃসঙ্গ পাখিটি যদি তার সঙ্গীকে খুঁজে না পায় তাহলে সে হয়তো নদীতেই ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হবে। চমৎকার কবিতা। হৃদয় স্পর্শ করে যায়। মালেকা একটা বক্সের ভেতর বড় অক্ষরে লিখেছেন : ধোঁয়াওড়া হাঁড়ির ঢাকনা খুলতে/ খুলতে মা বলতেন সবকিছুর পরিমাপ ঠিক হওয়া চাই/ সে তুমি রান্নাই বলো আর কবিতাই/ তেল খাটা?

কবিতা না হলেও কবিতার ছন্দ আছে, অর্থ সুগভীর।

একই দিনে দেখি কাকলী আহমদের লেখা তার ওয়ালে, প্রায় কবিতার মতো : কখনো কখনো সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধেরাত একাকার হয়ে যায়/ পৃথিবীর সব মুখ বাতাসে ভেসে ভেসে রোদের আঁচ/ বাড়ায়, কমায়/ কপালে ভালোবাসার হাতেরা ছুঁয়ে বলে/ এভাবেই বেঁচে থাকো কা কা/ কখন ঘরে ফিরলে/ সন্ধেবেলা কত ঝড় এল/ আমি চিন্তা করছিলাম।

পড়ার পর আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করি। কোন শ্রেণিতে ফেলা যায় এই লেখাটি? না, কবিতাই। গদ্যকবিতা। চিন্তা আর স্বর আধুনিক। ১১ এপ্রিল মালেকা ফেরদৌস বক্সের ভেতর লিখেছেন বড় অক্ষরে : বৃক্ষদের দেখ ঝরে পড়া/ ফুলের বিস্ময় নিয়ে কেমন সম্মানিত ভঙ্গিতে/ দাঁড়িয়ে আছে। একই দিনে তার আর একটা কবিতা : বিচিত্র বিদ্রƒপে ফেরালে আমায়/ ফিরে আসো তারপর/ ডানাভাঙা প্রজাপতির বুকের মধ্যে/ যেন অহর্নিশ নীল বিষে তড়পায়/ শর বেঁধা পাখির মতো/ সহসাই মুছে গেছে... । লেখার পরের অংশটা উদ্ধার করা গেল না। কবিতার নিচে চমৎকার একটা ছবি। নীল আকাশ, নিচের জমিও নীল, ডানদিকে কয়েকটা সাদা গোলাকার ফর্ম। মাঝখানে বাদামি রঙের শুকনো একটা পাতা পড়ে আছে সম্পর্ণ নতুন ভঙ্গিতে। সমতলের সঙ্গে সমান্তরাল না, উলম্ব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। এটা কি পেইন্টিং নাকি ফটোগ্রাফ বোঝা মুশকিল, এমনভাবে দুয়ের মাঝের সীমারেখা অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

 

নয়

একটি বিমান দুর্ঘটনা এবং ফেসবুক

আমার আজকাল নিয়মিত বাংলাদেশের খবর শোনা হয় না টেলিভিশনে। বিদেশি চ্যানেলে আন্তর্জাতিক খবরই শুনি। এর কারণ কোনো স্নবারি নয়। দৈনিক পাঁচটা সংবাদপত্র পড়ি আমি, বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে। সেখানে দেশের খবরই বেশি থাকে এবং টেলিভিশনের তুলনায় তার উপস্থাপন শুধু বিশদ না, নিরপেক্ষও বটে। দৈনিক পত্রিকায় দেশের খবর পড়ার জন্য আমি অপেক্ষা করি প্রায় ২৪ ঘণ্টা। ফলে টেলিভিশনের মতো খবরগুলো তাজা থাকে না। কিন্তু এতে আমার খুব-একটা অসুবিধা হয় না। আমি কাগজ পড়ি খবর জানার জন্য কৌতূহল নিয়ে, সেই খবর তাৎক্ষণিক না হলেও চলে। এর একটা অসুবিধা হলো, সারা দিনে যে প্রধান ঘটনা তার মধ্যে চাঞ্চল্যকর কিছু থাকলে সেসব সঙ্গে সঙ্গে জানা যায় না। টেলিভিশনের খবর শুনলে ঘটে যাওয়া ঘটনার খবর সঙ্গে সঙ্গেই পেতে পারি, যাকে বলে ইন রিয়েল টাইম। কিন্তু আমার বর্তমান অভ্যাসের জন্য তা হয় না। ফলে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে গেলে যখন তার সম্বন্ধে লোকমুখে শুনি বেশ অবাক হয়ে যাই এবং কিছুটা বিব্রত বোধও করি। ফেসবুকে আসার পর সকালে বিকালে অন্তত দুঘণ্টা দেওয়ার জন্য কিছু ঘটনার আভাস এবং কিছু ঘটনার সরাসরি খবর পেয়ে যাচ্ছি আজকাল। এই কারণে নেপালের কাঠমুন্ডুতে ইউ এস বাংলা এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট ২১১ দুর্ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর প্রাণহানির খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেলাম, যা হতো না যদি খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করতাম। এখনকার অভ্যাসমতো বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক খুলতেই দেখি শোক আর সমবেদনা প্রকাশ করছে ফেসবুকের বন্ধুরা। কিসের জন্য এই শোক প্রকাশ? একটু পরই তা জানতে পারি। ফ্লাইট ২১১ কাঠমুন্ডুর ত্রিভূবন বিমান বন্দরে অবতরণের সময় ক্র্যাশ করেছে। তাৎক্ষণিক গণনায় ৪৫ জন নিহত যার মধ্যে ২২ জন বাংলাদেশি। পরে সেই সংখ্যা সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৪৯ এবং ২৬। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অনেক বাঙালি মৃত পুরুষ, মহিলা আর ছেলেমেয়েদের বিষয়ে ছবিসহ তথ্য পাওয়া গেল ফেসবুকের ওয়ালে। এদের ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররা বিভিন্নভাবে চেনেন। কেউ তাদের আত্মীয়, কেউ বন্ধু বা বান্ধবী, কেউবা সহকর্মী। এই পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে বেশ কিছু জানা গেল যার জন্য মৃত ব্যক্তিরা অপরিচিত থাকে না। মনে হয় তাদের সঙ্গে অনেক দিনের জানাশোনা।

প্রথমেই বিজ্ঞ বিচারপতি শোক প্রকাশের জন্য উদ্ধৃত করলেন জন ডানের বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি : জিজ্ঞাসা কোরো না কার জন্য গির্জার ওই ঘণ্টা বাজে? এটা বাজছে তোমার জন্যই। এই কথা ক’টি ব্যবহার করে জন ডান যা বলতে চেয়েছেন তা হলো যে, আমাদের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে এই ঘণ্টা বাজতে পারত। এখন না হলেও ভবিষ্যতে বাজবে সুতরাং তার জন্য প্রস্তুত থাকো। তিনি মরমি কবিদের, মেটাফিজিক্যাল পোয়েটসদের একজন। তার কবিতার প্রধান সুর এমনই আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। বিজ্ঞ বিচারক জন ডানের কবিতার বিখ্যাত পঙ্ক্তি ক’টি উদ্ধৃত করে শোক প্রকাশের পর ফেসবুকে একের পর এক শোকবার্তা আসতে শুরু করল। প্রায়গুলোর সঙ্গে থাকছে দুর্ঘটনায় মৃতদের ছবি। একটা ছবিতে সদ্য বিবাহিত এক দম্পতিকে দেখা গেল বিয়ের পোশাকে। তারা হানিমুন করতে নেপাল যাত্রা করেছিল। অবশ্যই মধ্যবিত্ত, নচেৎ ইউরোপ যেত, নিদেনপক্ষে সিঙ্গাপুর। মেয়েটির হাতে মেহেদির রঙ লাগানো, বেশটি বধূর। বিয়ের ক’দিন পরই সে স্বামীর সঙ্গে যখন বিদেশ যাত্রা করে তখনো নিশ্চয়ই মেহেদির রং তার হাতে লেগে ছিল। এই কথা মনে করলে বেদনায় আচ্ছন্ন হয় মন। একটি এনজিওতে কাজ করত যে মহিলা এবং যাকে প্রতিভোরে দেখা যেত শিশুসন্তানকে নিয়ে স্কুলের সামনে সেও মৃতদের মধ্যে একজন। একা না, তার সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছে স্বামী এবং সেই শিশুসন্তান। পুরো পরিবারের ছবি দেখানো হলো কয়েকবার। যারা চেনেন তাদের শোকবার্তা দেখা গেল একটু পর পর। আমি এই পরিবারের কাউকে চিনি না কিন্তু তাদের কথা পড়ে এবং ছবি দেখে বেদনার্ত হলাম। ফেসবুকে লিখলাম : তোমাদের আত্মা যেন শান্তি পায়। তারপর লিখলাম : এই শোক প্রকাশ করার সময় হয় নি তোমাদের জন্য। তবু প্রকাশ করতে হলো। এটা তোমাদের প্রাপ্য নয় এখনই, তবু দিতে হলো। এর চেয়ে বেশি দুঃখের আর কী হতে পারে? একই কথা মনে আসে কো-পাইলট নাবিলার কথা ভেবে। জানতে পারি যে তিনি নিজে প্রাণরক্ষার সুযোগ পেলেও তা গ্রহণ না করে সাহায্য করেছেন অন্য যাত্রীদের প্রজ্বলিত বিমানের ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে এমন সাহস এবং নিঃস্বার্থ সেবা যিনি দিতে পারেন তিনি শুধু কর্তব্যপরায়ণ নন, একজন বীরও। এমন বীরত্বের নজির শুধু দেশে না বিদেশেও বিরল। তার প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে মন এবং গর্বে ভরে যায় বুক যে এমন একজন নারী আমাদের দেশে জন্মেছিলেন। তার দৃষ্টান্ত অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করবে। মরণোত্তর হলেও তাঁকে সর্বোচ্চ পুরস্কার দিয়ে স্বীকৃতি জানানো উচিত বলে মনে করি। ফেসবুকে তাঁর সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন অনেকে। আমিও তাঁদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাই।

সবার সম্বন্ধে পৃথক করে শোক প্রকাশ করতে পারি না। সেই শোক জানানো হচ্ছে তাদের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতদের পক্ষ থেকে। দুদিন, তিন দিন ফেসবুকের ওয়ালে এইসব শোক প্রকাশ ছাড়া অন্য কোনো বিষয় থাকে না। সবার জন্য আমি আর একটা শোকবার্তা পোস্ট করলাম। লিখলাম : বাংলাদেশে অনেক ট্রাজেডি ঘটেছে। আর একটার প্রয়োজন ছিল না। ওয়ান ট্রাজেডি টুৃ মেনি।

মেজভাই আমাকে দেখে বলল, এখন ফেসবুকে ভাইরাল নিউজ কোনটা? আমি বললাম, ইউএস-বাংলা ফ্লাইট ২১১। শুনে সে অবাক হয়ে বলল, বাস আর লঞ্চ দুর্ঘটনায় অনেক আরোহী মারা যায়। তখন কি সেই খবর ফেসবুকে ভাইরাল হয়? আমি বলি, হয় না। মেজভাই জিজ্ঞাসা করে, কেন? আমি বললাম, বাহনের পার্থক্যের জন্য না। তাদের সঙ্গে বিমানযাত্রীর সামাজিক পার্থক্যের জন্যও না। মেজভাই বলল, তাহলে? আমি বললাম, পরিচয়। বিমানের প্রায় সব যাত্রীই কোনো-না-কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের পরিচিত। আত্মীয় হিসেবে। সহকর্মী হিসেবে। অথবা বন্ধু হিসেবে। সেই পরিচয়ের জন্য তারা শুধু সংখ্যা হয়ে থাকে না যেমন হয় বাস কিংবা লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃতদের ক্ষেত্রে। এইজন্যই ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হতে থাকে নাম-পরিচয় দিয়ে কয়েকদিন ধরে। প্রায় প্রত্যেক মৃত যাত্রীই একেকটা হিউম্যান স্টোরি হয়ে যায় এই পরিচিতির ভিত্তিতে। এর বিপরীতে বাস কি লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিরা কেবলই পরিসংখ্যান। তারা হিউম্যান স্টোরি হয় না। দুর্ঘটনার সামষ্টিক ট্র্যাজিডির ওপর লেখা হয় সংবাদপত্রে। প্রায়ক্ষেত্রেই খবরের আকারে, কখনো বা প্রতিবেদন হিসেবে। ফেসবুকে বাস-লঞ্চ দুর্ঘটনা নিয়ে লেখা হয় কি না জানি না, কেননা আমি এখানে প্রবেশের পর তেমন বড় কোনো দুর্ঘটনা হয় নি। তবে আমার অনুমান মৃতদের মধ্যে কেউ যদি বিখ্যাত না হন অথবা ফেসবুকের কারও সঙ্গে পরিচয় না থাকে তাহলে এই দুর্ঘটনায় নিহত কারও সম্বন্ধেই বিশেষ করে কিংবা পৃথকভাবে কিছু পোস্ট করা হবে না। শুনে মেজভাই বলল, হুঁ। ইন্টারেস্টিং। তারপর বলল, এই যে শুনি ফেসবুকে ফেক নিউজ ছড়িয়ে পড়ে এটা কি সত্যি? আমি বললাম, আমার অভিজ্ঞতা অল্প দিনের। সেইজন্য নির্ভরযোগ্যভাবে আমি কিছু বলতে পারি না। তবে মাধ্যমটি এমন যে খুব সহজে এর অপব্যবহার করে ফেক নিউজ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। একজন একটা অসমর্থিত খবর হয়তো নির্দোষভাবে জানাল। আর সঙ্গে সঙ্গে অন্যেরা সত্যাসত্য বিচার না করে তার ওপর নিজেদের মতামত দিতে শুরু করল, এমন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনী প্রচারণায় এমন ফেক নিউজ ছড়ানো হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এর জন্য মার্ক জাকারবার্গকে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়েছে। ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন কি না তা বলতে পারি না। তখন থেকেই অবশ্য ফেক নিউজ কথাটা খুব চালু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফেসবুক কিংবা অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়ার বিরুদ্ধে ফেক নিউজ প্রচারের অভিযোগ আনেন নি। তিনি অভিযোগ এনেছেন মেইনস্ট্রিম প্রিন্ট এবং টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলের বিরুদ্ধে। নিউইয়র্ক টাইম্স, ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে শুরু করে সিএনএন চ্যানেল তাঁর রোষানলে পড়েছে নির্বাচনের সময় ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য। তিনি সংবাদপত্রের এত কট্টর সমালোচক হোয়াইট হাউসের করেসপনডেন্টদের ট্রাডিশনাল বার্ষিক ডিনার পর্যন্ত বয়কট করেছেন। তাঁর প্রশাসনের সময়ই ফেক নিউজ, অলটারনেটিভ ফ্যাক্ট প্রথমবারের মতো আলোচনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে এই দুটি শব্দ মিডিয়ায় এবং পাবলিক ডিসকোর্সে অপরিচিত ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, ফেক নিউজ ছড়ানোর সুবিধা সবচেয়ে যেখানে বেশি সেই সোস্যাল মিডিয়া সম্পর্কে তার কোনো অভিযোগ নেই, বরং তিনি অনলাইন এইসব নিউজ চ্যানেলের বেশ ভক্ত। নিজে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মতপ্রকাশের জন্য যেমন টুইটার ব্যবহার করতেন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও তা-ই করে যাচ্ছেন। মেজভাই শুনে বলল, হুঁ। ইন্টারেস্টিং।

রওনাক আফরোজা নামে একজন পেশায় ডাক্তার। রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ে আমেরিকায় গিয়ে মেডিকেল স্কুলে আবার পড়াশোনা করেছেন। এখন ওহাইয়ো স্টেটে ভেটারানস্ হাসপাতালে কাজ করছেন কনসালটেন্ট হিসেবে। নিশ্চয়ই পেশাগত দক্ষতা আছে এবং সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা। না হলে এমন দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হতেন না। ডাক্তার হিসেবে তাঁকে ফেসবুকের ফ্রেন্ডরা কতটুকু জানে তা আমার জানা নেই। নিজেকে দিয়ে অনুমান করি যে তাদের কাছে তাঁর পরিচয় কবি এবং লেখক হিসেবেই বেশি। তাঁর লেখক পরিচিতি অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। যে তিন মাস ফেসবুকে আছি নিয়মিতভাবে তার লেখা এবং মন্তব্য প্রকাশ হতে দেখছি। পেশার চেয়ে যে তিনি ফেসবুকে তাঁর ভূমিকাকে কম গুরুত্ব দেন না এ কথাই মনে হয়েছে তাঁর লেখা পড়ে। হালকাভাবে রসিকতার ছলে তিনি লেখেন না। লেখাটা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তাঁর রোগীর আরোগ্য লাভ। ড. রওনাক আফরোজা লেখায় খুব প্রলিফিক। উত্তর আমেরিকায় তাঁর মতো প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে (কবিতা, মন্তব্য) ফেসবুকে এত লিখতে আর কাউকে দেখি না। তিনি প্রথমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন লেখার সংখ্যার ভিত্তিতে। লেখার উৎকর্ষের জন্য মনোযোগ আকর্ষণ করতে কিছুটা সময় নিলেন, আমার দৃষ্টিতে। কিন্তু বেশি সময়ের প্রয়োজন হলো না। প্রথম পোস্টে দেখতে পাই তিনি গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। তাঁকে দেখা যাচ্ছে না, পাশে রাখা মিউজিক ডিভাইস থেকে গান হচ্ছে, সেই গান দর্শক-শ্রোতার শোনার জন্য ব্যবস্থা রেখেছেন। আমি মোবাইল স্পর্শ করতেই নিচু স্বরে মিউজিক শুনতে পেলাম। তিনি লিখেছেন মাউন্টের ব্লু মিউজিক হচ্ছে। এটা তার প্রিয়, সেই সঙ্গে ব্লু জাজও। জাজ কথাটার বানান অসম্পূর্ণ ছিল। আমি সম্পূর্ণ করে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিলাম। তাঁর কাছ থেকে কোনো উত্তর এল না, হয়তো গাড়ি চালাচ্ছেন এই কারণে। তাঁর সংগীত-প্রিয়তা জানার পর বুঝলাম আমেরিকা প্রবাসী হয়ে সেখানকার কালচারের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হয়েছেন যা অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

ফার্স্ট জেনারেশান ইমিগ্রান্ট রবীন্দ্র-নজরুল আর আধুনিক বাংলা সংগীত দিয়েই তাদের সংগীত পিপাসা নিবারণ করেন। বিদেশি সংগীতের প্রতি তাদের আগ্রহ কম। ড. রওনাক আফরোজ এ দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী। এর ক’দিন পর পড়লাম ইংরেজিতে লেখা তাঁর এক কবিতা। নির্জন পথে একাকী চলেছে যাত্রী, দুদিকে ওয়েস্টল্যান্ডের মতো উষর ধূসরতা। তার ডানা ভেঙে গিয়েছে, তবু তাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। তিনি বৈরী পরিবেশ উপেক্ষা করে একসময় গন্তব্যে পৌঁছান। প্রায় নিখুঁত কবিতা। প্রায় বলছি এজন্য, যে যাত্রী পথ দিয়ে যাচ্ছে তার তো ডানা থাকার কথা না, পদব্রজেই তার যাত্রা। পাখির ডানার প্রসঙ্গ এনে কবিতাটি কিছুটা দুর্বল করে ফেলেছেন বলে মনে হলো। প্রথমবার কমেন্ট দিচ্ছি তাই ত্রুটি উল্লেখ না করে লিখলাম : এ কনফিডেন্ট ট্রাভেলার উইথ ডিটারমিনেশান অ্যাজ দি কোম্পানি। মন্তব্যটা তাঁর পছন্দ হলো। তিনি সংক্ষেপে লাইক দিয়ে জানালেন। এইভাবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় শুরু। অল্প কদিনেই বুঝলাম তিনি বেশ ম্যাচিওর এবং উইটি। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এর পর তাঁর অনেক কবিতা, মন্তব্য এবং প্রবচনের মতো ছোট লেখা পড়লাম। অনেকগুলোর ক্ষেত্রে ইন্টার‌্যাকশান হলো। প্রথমদিকে বেশ একটা কবির লড়াইয়ের মতো মন্তব্য বিনিময় করলাম দুজন। সবক্ষেত্রেই ড্র, কেউ জয়ী কিংবা পরাজিত হলাম না। এই প্রক্রিয়ায় দুজনই দুজনকে সম্মান করতে শুরু করেছি। আমি ফেসবুকে নবাগত, তিনি অনেকদিন ধরে এই মাধ্যমে লিখছেন, মন্তব্য করছেন। শুধু অভিজ্ঞ নন, অনেকের কাছে পরিচিত যা তাঁর লেখার পর লাইক আর কমেন্ট দেখে বোঝা যায়। কিন্তু এজন্য তাঁর মনে কোনো গর্ব আছে বলে মনে হলো না। তিনি প্রথমে কৌতূহল নিয়ে এবং পরে আমার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তার মন্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া জানালেন। কিছুদিনের মধ্যেই একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল যেখানে কোনো টেনশন নেই কিন্তু উত্তেজনা আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক এই ভাব আদান-প্রদানের কথা পরে আরও আসবে। এখন লাফ দিয়ে সামনে যাই। কেননা একটা সাম্প্রতিক লেখা এখনই উল্লেখ না করলেই নয়। বিষয়টা রাজনৈতিক কিন্তু বেশ সূক্ষ্মভাবে বলা যার জন্য কে টার্গেট বোঝা মুশকিল। অবশ্য আকলমন্দ যারা তারা ঠিকই বুঝবেন। দশ এপ্রিলে ফেসবুকে তাঁর লেখা : হীরক রাজার সোনার দেশে/ ন্যায় নীতি যায় ভেসে/ মেনে চলো রাজার হুকুম/ অন্য কিছু বোলো না/ রাজার শূলে চড়ো না/ মেনে চলো রাজার হুকুম/ গলা মেলাও বাকুম বুকুম। কবিতা না বলে একে ছড়া বলাই ভালো। ছড়াতেই ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা যায় বেশি। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় এমনটাই করেছিলেন। ড. রওনাক সেই ট্রাডিশন মনে রেখে ছড়া লিখেছেন। সময়োচিত এবং মোক্ষম। কোনো রাখঢাক নেই। বিদেশে থাকার এই এক সুবিধা, রাজার রোষানলে পড়ার ভয় থাকে না। কলম ব্যবহার করা যায় অনায়াসে। ড. রওনাক ইংরেজিতে এবং বাংলায়, দুই ভাষাতেই ফেসবুকে লিখে যাচ্ছেন। প্রতিসপ্তাহে কম করে হলেও একটা, অনেক সময় দুটো। একটার রেশ কাটতে না কাটতেই আর একটা এসে যাচ্ছে। ফেসবুকে কোনো পরিচিতি একটাই থাকতে পারে না, নিরন্তর নবায়ন করে নিতে হয় এটা বুঝতে আমার দেরি হয় নি। কারণটা হলো অনলাইনে না থাকলে অন্যান্য ফ্রেন্ডদের রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’ কথাটা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশ চালু। ফলে সবাই একটা চাপে থাকে। যার ফলে একটা কিছু মন্তব্য নিয়ে হাজির হতে হয়। লেখার কথাই যদি ধরি তাহলে দেখা যাবে যা সৃষ্টি হচ্ছে তার সবই উৎকর্ষের দিক দিয়ে উঁচুমানের নয়। তবু এই চাপের মধ্যেই কিছু কিছু ভালো লেখা হচ্ছে, বিশেষ করে কবিতা চর্চায়। এর একটা সহজ ব্যাখ্যা তো এই যে ফেসবুকের সীমিত পরিসরে কবিতা যেমন মানানসই, গল্প বা প্রবন্ধ সেই তুলনায় ততটা নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ছোট আকারে বেশ লেখা হচ্ছে যার অনেকগুলো সুচিন্তিত। ফেসবুক বন্ধুদের সবাই বড় লেখা পড়ার জন্য ধৈর্য রাখেন না এই বিষয়টাও মাথায় রাখতে হয় লেখকদের। এইসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ফেসবুকের জন্যই অনেকে পরিচিত হচ্ছেন লেখক হিসেবে, দেশে এবং বিদেশে। ড. রওনাকের ছড়ার মতো লেখা আর একটা কবিতা উদ্ধৃত করছি যেখানে আবার রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে : মানুষ মরে গেলে পচে যায়/ বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে/ বদলায় অকারণে বদলায় ‘... /যারা রাজনীতি করে তারা/ আরও বেশি বদলায়/ কারণেই, অকারণে নয়... / তারা আর কতকাল দু’চক্ষু/ কচলাবে আর বুভুক্ষু থাকবে...। তিনি এই কবিতার জন্য লাইক পেয়েছেন ৯৩টি। একজন মন্তব্য করেছেন : ঠিক বলেছেন। চমৎকার বলেছেন। আর একজন লিখেছেন : এদের শিঙ্গা এখন তুঙ্গে। এর পরের এক কবিতায় রওনাক লিখেছেন অন্য ভাবনা নিয়ে। চৈত্রর চাঁদ তাঁর যাত্রাসঙ্গী। আমি লিখলাম : ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। একাকী নিঃসঙ্গ যাত্রা নয় এবার। আগের কবিতায় আপনি একাকিত্ব বোধ করেছিলেন। কেবল সংকল্প আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে। এবার সঙ্গে রয়েছে চাঁদ। তিনি উত্তরে লিখলেন, মনের কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সে তার ইচ্ছেমতো চলে। আমি লিখলাম : একমত। তিনি লিখলেন : যাত্রা কখনো নিঃসঙ্গ একাকী হয় না যদি যাত্রী জানে কী করে আকাশের নীলিমা স্পর্শ করতে হয়, কীভাবে বাতাসকে চুম্বন করা যায়, প্রজাপতিকে আদরে কাছে ডেকে নেওয়া হয়। বেশ দার্শনিকতা আছে তাঁর এই কথায়। সেইসঙ্গে প্রকৃতিপ্রেম। শেষের বিষয়টি দেখতে পাই ঋতু প্রসঙ্গে। শীতের প্রকোপে বসন্ত আসতে দেরি হচ্ছে। রওনাক লিখেছেন : জলে না জোনাকি/ এখন বসন্ত, তবু মুখ ভার আকাশ/ সারা দিন বৃষ্টি কেন/ জলে ছলকে ফুসে উঠছে নদী/ আষাঢ় এসেছে যেন। এর কয়েক পঙ্ক্তি বাদ দিচ্ছি আমি স্থানাভাবে। শেষের পঙ্ক্তিগুলো এইরকম : বসন্ত আকাশ চাই সোনালি/ অথবা সুরেলা, নীলাভ রোদেলা/ কেন অকালে অবাধ্য বর্ষণ/ প্রতিদিন সারাক্ষণ মেদুর মেঘলা। একজন পড়ার পর মন্তব্য করেছেন : অনবদ্য। সুন্দর শব্দচয়ন। একজন লিখেছেন, বাহ, অপূর্ব। একজন লিখেছেন : খুব সুন্দর লেখা। এর পর আমার মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ‘নীলাভ রোদেলা’ কথা দুটি আমার মনের মধ্যে গেঁথে যায়। ১৬ এপ্রিল ভোরে দুবার গ্র্যামি পুরস্কারপ্রাপ্ত স্কটিশ গায়িকা এডেলের ‘হ্যালো’ গানের ক’টি লাইন উদ্বৃত করে পোস্ট দিলাম। প্রতিদিন ভোরে একটা কিছু পোস্ট করি। ছবি ছাড়া কখনোবা কখনো ছবিসহ। বন্ধুদের গুড মর্নিং বলার মতো। তাদের জানানো যে আমি অনলাইনে আছি। ফিয়ার অফ মিসিং আউট (এফএমও)! হ্যালো, ইট ইজ মি। ইট ইজ মি স্পিকিং। ক্যঅন ইউ হিয়ার মি। গানের এই কথা ক’টির পর আমি যোগ করেছি : সামটাইমস্ সাইলেন্স ইজ ডিফেনিং। রওনাক উত্তর দিয়েছেন, ইয়েস আই ক্যান হিয়ার ইউ। আমি লিখলাম : ধন্যবাদ রওনাক। আমি ভেবেছিলাম অরণ্যে রোদন করছি। রওনাক লিখলেন : আমার অরণ্যে বাস। কোন অর্থে লিখলেন কে জানে। জিজ্ঞাসা করব করব করেও করা হয় না। এই সকালবেলা কথার লেজে লেজ লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানে হয় না। ব্যান্টারিংয়েরও একটা অলিখিত প্রোটকল আছে। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে আমাদের দুজনের মতবিনিময় করার কিছুদিন চলার পর ড. রওনাক লিখলেন : আমাকে সম্মোধন করার আগে ডক্টর ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। বুঝলাম তিনি চাচ্ছেন তাঁর প্রথম নাম ধরেই ডাকি। আমেরিকায় এই সামাজিকতা বেশ চালু। তারা সহজেই ইনফরমাল হয়ে যায়। আমি লিখলাম : বেশ, তবে এটা দুই পক্ষেই হওয়া দরকার। ফেসবুকে আমাদের সম্পর্ক বয়সনিরপেক্ষ। আমরা সবাই বন্ধু। রওনাক সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন : তথাস্থু। এজ ইজ জাস্ট এ নাম্বার। আমি লিখলাম : আলিয়া নামের গায়িকার একটা গান আছে : এজ ইজ নাথিং বাট এ নাম্বার। কিন্তু উডি অ্যালেন অসুখী হয়ে বলেছেন : হোয়াই আর আওয়ার ডেজ নাম্বারড্ অ্যান্ড নট লেটারড? রওনাক উত্তর দিলেন : ডিফারেন্ট পিপল, ডিফারেন্ট মাইন্ডস।

রওনাক একটা বক্সের ভেতর চার লাইনের ছোট কবিতা লিখেছেন। ধ্রুপদী, বিষয়ে ও শৈলীতে : বৃষ্টি ঘন আঁধার দিন/ মন বসে না কাজে/ মরি আমি লাজে গো/ কেন শ্যামের বাঁশি বাজে? সুন্দর অনুভূতি। সুন্দর ছন্দ। সব মিলিয়ে একটা অনবদ্য অনুরণন সৃষ্টি করে। শুধু শেষ পঙ্ক্তিতে ‘কেন’ শব্দটা একটু ধন্দে ফেলে। তাঁকে লিখলাম : ‘কেন’ শব্দটা বাদ দেওয়া যায় না? তিনি উত্তর দিলেন : না। বাদ দিলে রাধার উতলা মনের জন্য শ্যাম যে দায়ী এটা বলা হবে না। মনে হবে সে নিজেই উতলা। দায়িত্বটা পুরো তার ওপর এসে পড়বে মনের অস্থিরতার জন্য। আপনার মন্তব্য জানতে চাই। ব্যাখ্যা পড়ে আমি চমৎকৃত হলাম। দেখলাম তিনি ঠিকই লিখেছেন। যথাযথ শব্দচয়ন। লিখলাম : আমি আপনার সঙ্গে একমত। তিনি খুশি হয়ে লিখলেন : ধন্যবাদ। পরে দেখলাম আমার মতো ‘কেন’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আরও একজন। অনেকের কাছেই ‘কেন’র ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় হবে, বিশেষ করে যারা কবি নন। কিন্তু রওনাকের যুক্তি জোরালো। তিনি না জেনে-বুঝে ‘কেন’ ব্যবহার করেন নি। এই ছোট্ট কবিতার জন্য লাইক পেয়েছেন ১১১টি এবং কমেন্ট এসেছে ৭২টি। কয়েকদিন পর রওনাকের আর একটি কবিতা দেখতে পেলাম ফেসবুকে : নদীর কাছে লজ্জাভরে চেয়েছিলাম জল/ বলল নদী, চোখেই তোমার সাগর যে অতল/ এই অবেলায় কি বাহানায় নদীর কাছে আসো/ সাঁতার জানো, অথৈ জলে মরতে ভালোবাস?/ নদীর কানে বলি, তোমায় দেব কি আর ফাঁকি/ ছুঁয়েই জলে জোয়ার আসে দেখেও দেখ নি কি?/ বুকে তোমার ভেলা হব ভাসব অপার ঢঙে/ চাইলে তুমি তলিয়ে যাব তোমার হিয়ার সঙ্গে/ নামছে আঁধার আর কতকাল থাকবে দূরে দূরে/ ভালোবেসে যে মরেছে, একবারই সে মরে। একজনের মন্তব্য : খুব ভালো লিখেছেন। আর একজন : একবারই সে মরে! অসাধারণ হয়েছে প্রিয় কবি। আমার এর পর আর কোনো মন্তব্য থাকে না। শেষের পঙ্ক্তিটি বাংলা কবিতায় স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো।

রওনাক ইংরেজি এবং বাংলায়, দুভাষাতেই কবিতা লেখেন। তুলনামূলকভাবে তাঁর বাংলা কবিতা যে অনেক ভালো সে কথা অনেকেই বলবেন। তিনি কবে থেকে কবিতা লেখেন জানি না। তাঁর একটা কবিমন আছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কবিতার ব্যাকরণও তাঁর আয়ত্বে। দেশে থাকলে প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন যা এখন শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ। বাংলা নববর্ষে রওনাকের ছোট কবিতা দিয়ে তাঁর কাব্যচর্চার ওপর এই ছোট আলোচনা ইতি টানতে চাই : এপারে ওপারে/ কাছে ও দূরে/ সবুজে শিশিরে/ সোহাগে ও সুরে/ ভালো থেকো/ ভালো রেখো। তারপর লিখেছেন : বন্ধু, অবক সবার জন্য আমার নববর্ষের শুভ কামনা। এর আগে তিনি হাইকু নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছেন। আমাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন : ফলোইং ইউ। আমি পড়ে দেখলাম গদ্যকবিতা হিসেবে মানানসই কিন্তু হাইকু হয় নি। ঋতুর ইঙ্গিত নেই। তিনটি পঙ্ক্তিতেই বাস্তবের বর্ণনা, কোনো উপসংহার নেই। নেই কার্যকারণ সম্পর্কের উল্লেখ। আমি এসব উল্লেখ করে লিখলাম এবং যোগ করলাম এই বলে যে তিনি পারবেন। হাইকু কবিতার যে স্পিরিট তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। রওনাক লিখলেন : ধন্যবাদ। আমি লিখলাম : গুড নাইট। তিনি লিখলেন : গুড নাইট। স্লিপ টাইট। আমি আসলে ঘুমোনোর জন্য না, ম্যান সিটি আর লিভারপুলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ান্স লীগে সেমিফাইনালে ওঠার খেলা দেখার জন্য কথা তাড়াতাড়ি শেষ করলাম। খেলা শুরু হলো রাত একটায়। শুরু হওয়ার একটু পরই মিশরের প্রবাদপ্রতিম খেলোয়াড় সালেহ গোল দেওয়ার পর আরও দুটো গোল দিল লিভারপুল। বুঝলাম পেপ গোয়ারদিলার দল জুর্গেন ক্লপের দলের কাছে হারবে। বাকি অংশ না দেখে শুতে গেলাম। পরদিন খেলা সম্বন্ধে বন্ধুদের উদ্দেশে মন্তব্য পোস্ট করলাম। রওনাক সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য দিলেন : আহা! অমন খেলাটা মিস করলাম! পড়ে আমি একটু অবাক হলাম। আমেরিকায় থেকে তাঁর আমেরিকান ফুটবল খেলার দিকেই আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। তিনি যে উপমহাদেশের ফুটবল-প্রিয়তার মধ্যে এখনো আছেন তা দেখে প্রশংসা ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না মনে। তা ছাড়া আমাদের দেশের মেয়েরা ফুটবল খেলা খুব-একটা পছন্দ করে না। সেখানে তিনি ব্যতিক্রমী। নিজ পেশা, সাহিত্যচর্চার বাইরে খেলার প্রতি আগ্রহ আমাকে তাঁর সম্বন্ধে বিস্মিত করে। লক্ষ করলাম এই খেলা এবং একই রাতে ক্রিস্টিয়ান রোনালদোর বাইসাইকেল কিক দিয়ে গোল সম্পর্কে আমার মন্তব্য প্রায় সব ফেসবুক ফ্রেন্ডের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। রওনাক ছাড়া আর মাত্র দুজন এর ওপর মন্তব্য করেছেন। বেশ বুঝতে পারি খেলাধুলার ব্যাপারে ফেসবুক ফ্রেন্ডরা খুব আগ্রহী নয়। তারা সবাই সেরিব্রাল, ব্রেন নিয়ে কাজ করেন। পেশিশক্তির ব্যবহার যেখানে সেসব জায়গায় তারা পিছিয়ে অথবা তার প্রতি মোটেও আকর্ষণ নেই।

একদিন টেইলার সুইফটের ‘রেপুটেশান’ অ্যালবামের প্রথম গান ‘লুক হোয়াট ইউ হ্যাভ মেড মি ডু’ শুনছি। হঠাৎ মনে হলো এটা পোস্ট করা যায় গায়িকার নাম না দিয়েই। পোস্টের নিচে লিখলাম : এই কথাটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র রিংকুর উদ্দেশেও বলা যায়, কেননা সে প্রায় জোর করে আমাকে ফেসবুকে ঢুকিয়েছে। আর তার পর থেকে আমি বিচিত্র সব বিষয় পড়ছি এবং তার ওপর মন্তব্য রাখছি। বলতে গেলে আমার দৈনন্দিন জীবনের রুটিনই গিয়েছে বদলে। পোস্টটা পড়ার পর কবিবন্ধু নাসিম মন্তব্য পাঠাল : আপনি কি এখন অনুতপ্ত? আমি উত্তর দিলাম : না। যা বলতে চেয়েছি তা হলো, যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না। বুঝলে, গানের লাইনটা বলে আমি আমার ভেতরের অতৃপ্তিকে বোঝাতে চেয়েছি। এটা অনুতাপের তুলনায় ভিন্ন এক অনুভূতি। একধরনের দার্শনিকতাও রয়েছে। অবশ্য কবিতাটি কবিগুরুর, আমার নয়, তা তুমি ভালো করেই জানো। এর পরই ড. রওনাক আফরোজা পোস্ট দিলেন ওই একই কথা বলে : আপনি কি ফেসবুকে এসে অনুতাপ করছেন? আমি উত্তর দিলাম : আমার কাজকর্ম দেখে কি মনে হয় আমি অনুতপ্ত? কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কথা না কাজ? তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, কাজ। তারপর লিখলেন : আই গট ইট।

পহেলা বৈশাখের আগের দিন আমি পোস্ট দিলাম : আগামীকাল আমার রমনা বটমূলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শাহবাগেও যাব না মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখার জন্য। আমি বাড়িতে আমার রকিং চেয়ারে বসে গান শুনব : ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।’ এলিয়টের কবিতাও পড়তে পারি : ‘আমি সকাল সন্ধ্যা এবং বিকেল দেখেছি/ আমি আমার জীবনকে মেপেছি কফির চামচ দিয়ে।’ এরপর আমি হয়তো দ্বিধান্বিত হয়ে কণ্ঠস্বর মেলাব ফরাসি গায়িকা এডিথ পিয়াফের বিখ্যাত গানটির প্রথম লাইনের সঙ্গে : না, আমি অনুতাপ করি না। আমার কোনো অনুতাপ নেই। স্মৃতিমেদুর পথ চলার শেষে আমি হয়তো পল এলুয়ারের কবিতার প্রথম ও শেষ পঙ্ক্তি উচ্চারণ করব অস্ফুট স্বরে : বিদায় বিষণœতা, সুপ্রভাত বিষণœতা। পোস্টটা দেওয়ার পর বেশ কিছু মন্তব্য এল। এর মধ্যে মাহমুদুর রহমান লিখলেন : পহেলা বৈশাখের দিনটি কাটানোর জন্য চমৎকার পরিকল্পনা। রওনাক আফরোজা লিখলেন : আমার ইচ্ছে হয় আপনার রকিং চেয়ারের পাশে মেঝেতে বসে আপনাকে আমার গল্প শোনাই, আর আপনার গল্পগুলো শুনি। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিই। তাঁকে বলা হয় না যে আমার সব গল্প নিজেকেই বলতে পারি না আমি, অন্যকে বলব কীভাবে? আমি কেন, কেউ-ই কি পারে? রওনাক আফরোজা মন্তব্যে যে বিনয় তা আমাকে স্পর্শ করে। তিনি আমার পাশে মেঝেতে বসতে চেয়েছেন তা যে আমাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এটাও বুঝতে পারি। কবি বলেই তাঁর মধ্যে একটা সংবেদনশীল মন রয়েছে। তিনি আমার পোস্টের অন্তর্নিহিত বিষণœতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কবি হিসেবে তাঁর সম্বন্ধে আমার ধারণা আগেই উঁচু ছিল, এখন তা আরও বৃদ্ধি পেল।

 

দশ

ফেসবুকে চিত্রকলা, সিনেমা ও ফটোগ্রাফ

ফেসবুকে চিত্রকলা বিষয়ে বেশ কয়েকজন পোস্ট দিচ্ছেন। এদের মধ্যে কালিদাস কর্মকার সবচেয়ে সিনিয়র। তাঁকে প্রায় প্রতিদিনই ফেসবুকে দেখা যাচ্ছে। পুরোনো এবং নতুন ছবি দিচ্ছেন তাঁর ওয়ালে। এ ছাড়া রয়েছে অতীতে নিউইয়র্ক, প্যারিস, লন্ডন এবং জাপানে তাঁর প্রদর্শনীর ছবি। যেসব গ্যালারি ও মিউজিয়ামে গিয়েছেন সে সবের ছবিও পোস্ট করছেন মাঝে মাঝে। এ ছাড়া রয়েছে পারফমেন্স আর্টের ভঙ্গিতে তাঁর নিজের বিভিন্ন ছবি। বেশ অক্লান্তভাবে তিনি ফেসবুকে বিচরণ করছেন। এমনিতেই দেশে বিদেশে খ্যাত, ফেসবুকের এই উপস্থিতি তাঁকে আরও পরিচিত করে তুলেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। একদিন লিখলাম, তোমার ছবিগুলি খুব সুন্দর হচ্ছে। চমক আছে। সে ত্বরিতে উত্তর দিল : চমক না। আসল ব্যাপার আছে। বুঝলাম ‘চমক’ কথাটাকে সে নেতিবাচক মনে করেছে। ফেসবুকে নিজের সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য শুনে স্পর্শকাতর হওয়া খুব সাধারণ প্রায় সবার ক্ষেত্রে। কে কোন কথায় অসন্তুষ্ট হয়, তা বলা মুশকিল। তাই নিরঙ্কুশ প্রশংসা করে যাওয়াই এখানে নিয়ম হয়ে গিয়েছে। যাই হোক, কালিদাস নিজের আত্মপ্রচারের জন্য ছবি পোস্ট করলে তাতে দোষের কিছু নেই। সবাই তেমন করছে, লেখক, কবি, গায়ক-গায়িকা। ফেসবুক তো একটা প্রচারমাধ্যমই। প্রচারের জন্য তার ব্যবহার করা হবে এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে অন্যেরাও উপকৃত হচ্ছে। যেমন ছবি সম্বন্ধে কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে। শিল্পী সম্বন্ধে জানতে পারছে। আরও বেশি সংখ্যায় চিত্রশিল্পী যে ফেসবুক ব্যবহার করছেন না এটা অবাক করার মতো। আজমীর হোসেন নামে একজন তরুণ শিল্পী তার আঁকা ছবি প্রায়ই পোস্ট করছে। বড় বড় ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো সবই বিমূর্ত ধরনের। একটা বিমূর্ত ছবি সে জলরঙে করেছে। রং খুব নিয়ন্ত্রিত, গড়িয়ে পড়তে দেয় নি। এর ফলে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিমূর্ত রূপটি ফুটে উঠেছে। প্রশংসা করে মন্তব্য লিখলাম। সে লিখে জানাল ১১ এপ্রিল শিল্পাঙ্গনে তার ছবির প্রদর্শনী হবে। আমি কি তার ব্রোসিওরে লিখতে পারব? আমি লিখলাম লেখা নিয়ে এত ব্যস্ত যে সম্ভব না। সে লিখল আমি যেন তার প্রদর্শনীতে অবশ্যই যাই। আমি লিখলাম, চেষ্টা করব। তার সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না, তার কোনো কাজ দেখি নি। ফেসবুকের ছবি দেখে যে মন্তব্য করলাম তার ভিত্তিতে শিল্পীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল। মিনি করিম নামে এক মহিলা শিল্পী সুন্দরবনের ওপর প্রায় একটা সিরিজ এঁকেছেন। প্রায়ই অ্যাক্রিলিকে, উজ্জ্বল রং ব্যবহার করে। গাছপালার দৃশ্যই বেশি। কদাচিৎ নদীর একাংশ। চমৎকার প্রকাশভঙ্গি, অর্ধ বিমূর্ত শৈলীর। জীবন্ত হয়ে উঠেছে সুন্দরবন তার তুলির টানে। সুন্দরবন ছাড়াও তিনি বিমূর্ত ধারায় ছবি তৈরি করেছেন তেলরঙে এবং অ্যাক্রিলিকে। চমৎকার কম্পোজিশন, রঙের ব্যবহারে প্রশংসনীয় নিয়ন্ত্রণ। তিনিও প্রদর্শনীর জন্য তৈরি হচ্ছেন। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে এই প্রদর্শনী ভূমিকা রাখবে। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ছবিগুলো তার স্বপক্ষে প্রচার করছে বেশ সফলভাবে। ফেসবুকে তিন মাসে চিত্রকলা নিয়ে এই কজনকে তৎপর দেখতে পেলাম আমি। অন্য শিল্পীরা ফেসবুক তেমন ব্যবহার করছে না এ কথা আগেই বলেছি। রঞ্জিৎ দাসের দুটি ছবি দেখতে পেলাম। সে তার প্রোফাইল আপডেট করে নি। একই ছবি দেখতে পাচ্ছি মাথা নিচু করে আছে। প্রণামের ভঙ্গিতে অথবা বিনয়ে। সিনিয়র শিল্পী শহীদ কবীরকে মাঝে মাঝে ফেসবুকে দেখা যায়। তিনি জলরঙে যেসব ছবি আঁকছেন আজকাল সেগুলো পোস্ট করেন। ফলে শিল্পী যে তাঁর কাজে নতুন মোড় নিয়েছেন সে সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।

ভিসুয়াল আর্টের মধ্যে ফটোগ্রাফি ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের নিজেদের এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের ফটো অনবরত পোস্ট করা হচ্ছে। নিজের ছবির আপডেট দেওয়া একটা কর্তব্যের পর্যায়ে পৌঁছেছে। কেউ বাইরে যাচ্ছে কিংবা বন্ধুদের এবং আত্মীয়দের সঙ্গে কিছু করছে সেইসব ছবি ফেসবুকে আসছে। কথার চেয়ে ছবি বেশি করে স্থান পাচ্ছে ফেসবুকে, এমন ধারণা হয়েছে আমার। কমেন্ট, পোস্ট বা স্ট্যাটাসের সঙ্গে ছবি থাকছে যেখানে সেগুলোই লাইক পাচ্ছে বেশি। ছবি ছাড়া শুধু কথা পোস্ট করে খুব-একটা মনযোগ আকর্ষণ করা যাচ্ছে না, কমিউনিকেশন হচ্ছে না জোরালোভাবে। ফেসবুকের ভাষায় কথা আর ফটোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন মনোভাব প্রকাশের জন্য ই-মোজি এবং স্টিকার। এসব কথার সম্পূরক হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। মনে হয় এসব না থাকলে কথার আকর্ষণ কমে যায়। এর সঙ্গে আছে অডিও ভিসুয়াল যেখানে নির্বাক অথবা সবাক ছবিতে নারী-পুরুষকে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ভঙ্গিতে। কেউ ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করছে কোনো বিশেষ ঘটনা বর্ণনার জন্য। সব মিলিয়ে ফেসবুকের ভাষা অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাকে রোজ সকালে ‘সুপ্রভাত’ জানিয়ে সুইহোলামং মার্মা নামে এক আদিবাসী সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি পাঠায়। তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই এবং সে আমার উদ্দেশে কোনো লেখাও পোস্ট করে না, শুধু ওই ‘সুপ্রভাত’ কথাটি ছাড়া। তার ছবিতে ল্যান্ডস্কেপই বেশি থাকে, বিশেষ করে বসে থাকা অথবা উড়ন্ত পাখি। আমি কৌতূহল নিয়ে জানতে চেয়েছি সে কি শখের ফটোগ্রাফার, নাকি তার প্রশিক্ষণ আছে এ বিষয়ে। সে কোনো উত্তর দেয় না, নিয়মিতভাবে প্রতিসকালে আমার নাম লিখে সুন্দর ছবিগুলো পোস্ট করে। তার পাঠানো ছবির মধ্যে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে বসন্তের আগমনে ফুটন্ত পলাশ ফুলের ওপর এসে বসা পাখির ছবি, সবুজ ডালে ডাঁটা ফল খাওয়ার জন্য বসে থাকা সবুজ রঙের বিরল প্রজাতির কবুতর এবং খুব ভোরের অস্পষ্ট আলোয় নদীর ওপর উড়তে থাকা একঝাঁক পাখির ছবি। সে কয়েকদিন থেকে ‘সুপ্রভাত’ জানিয়ে আর ছবি পাঠাচ্ছে না। কারণটা জানি না, কিন্তু ছবি না পাওয়ায় আমার সকালটা যেন কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। আর একজন আদিবাসী, নাম রোয়াজা, সেও মাঝে মাঝে ছবি পোস্ট করে। শুধু আমাকে না, সবার উদ্দেশে পাবলিক ডোমেনে। তার ছবিগুলো পারফর্মেন্স আর্টের শ্রেণিতে পড়ে। একটা ছবিতে দেখা যায় সে খালি গায়ে নদীতে শরীর ডুবিয়ে কেবল মুখ দেখিয়ে ভেসে রয়েছে, যেন মৃতদেহ। আর একটায় তাকে দেখা যায় গুহার প্রবেশমুখে ওপরে পাথর ঠেলে রেখেছে হাত দিয়ে। এই ছবির সঙ্গে যে কথা পোস্ট করেছে তা পড়ে বেশ চমৎকৃত হই। সে লিখেছে : আমরা যখন ক্রুদ্ধ হই তখনই খারাপ কাজগুলি করি, যখন আনন্দিত থাকি, ভালো কাজগুলো হয়। আমি প্রশংসা করে লিখলাম : চমৎকার বলেছ। চিরন্তনী সত্য। সে বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, স্যার তেমন কিছু না। তবে আপনাকে ধন্যবাদ।

চন্দন স্বশিক্ষিত ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোর বয়সে নিজ চোখে দেখেছে পাঞ্জাবি সৈন্যরা গুলি করে তার বাবাকে হত্যা করছে। সে দৃশ্য তার মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে যায় যে সে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বেশিদূর করতে পারে নি। ক্যামেরা তাকে সাহায্য করেছে কিছুটা কৈশোরের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য ভুলে থাকতে। তার ফটোগ্রাফ বিশেষজ্ঞমহলে সমাদৃত হয়েছে কারিগরি কুশলতা এবং নান্দনিক সৌন্দর্যের জন্য। সে সম্প্রতি ফেসবুকে ম্যাপ শীর্ষক অনেক ছবি পোস্ট করছে। সাদা-কালোই বেশি, কেননা ওই দুটি রঙের কন্ট্রাস্টে ভিসুয়াল ইমেজ, বিশেষ করে মানুষের ছবি যেমন শিল্পিতভাবে মূর্ত করা যায় রঙিন ছবিতে তেমন নয়। সে সুন্দরবনের ওপর বেশ কয়েকটা ছবি পোস্ট করেছে যা প্রশংসা করে আমি কমেন্ট করেছি। একটি ছবিতে দেখা যায় অনেকগুলো কাক সৈনিকের মতো কয়েক লাইনে বসে আছে একইদিকে একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে যেন তারা কারও নির্দেশ পালন করছে এবং একটা কিছু প্রতীক্ষায় আছে। ছবিটিকে অনবদ্য বলে তাকে লিখেছি। কিন্তু আর একটা ছবিতে সব উপাদান ঠিক রেখে একেবারে মাঝখানে শুকনো পাতা স্থাপন করায় তার স্বাভাবিকত্ব বিঘিœত হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে যা আমি তাকে জানিয়েছি। সে এই নিয়ে কোনো বিতর্কে নামে নি। তার সবচেয়ে চমৎকার এবং প্রায় চাঞ্চল্যকারী ছবি হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাতের বেলা খোলা মাঠে অর্ধনগ্ন এক শীর্ণকায়া রূপোপজীবিনীর শুয়ে থাকার ছবি। অসহায় ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা নারীমূর্তি এক হাত দিয়ে স্তন ঢেকে রেখেছে। তার গায়ের শাড়ি অদূরে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। শুধু শাড়ি আর কোমরের নিচে পরা পোশাকটুকু ছাড়া আর সবই কালো। ফিগার এবং বস্তু যেন ভাসছে। আমি লিখলাম : পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি ছবির মধ্যে একটি। হয়তো দশটির মধ্যে না, কিন্তু অন্যতম শ্রেষ্ঠ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সে সঙ্গে সঙ্গে লিখল : খুব উৎসাহবোধ করছি। দেখলাম, খ্যাতনামা আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেনও তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

ফেসবুকে ফটোগ্রাফির চাহিদা বেশি, তার কদরও বেশি। রাজিন চৌধুরী অভিনেত্রী সোহানা সাবার বেশ কিছু ছবি তুলে পোস্ট করেছে। নূর নামের ফটোগ্রাফারও তাই। যদিও সাবা এখন পূর্ণকালীন অভিনেত্রী। তাঁর ছবি তোলার ভঙ্গিতে মডেলের কুশলতা রয়েছে। এই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।

ফেসবুকে সিনেমা নিয়ে লেখা তেমন চোখে পড়ল না। একমাত্র ব্যতিক্রম অনুপম হায়াৎ-এর ছবিসহ পোস্টগুলো। সে অনেক দিন থেকে সিনেমার ইতিহাস এবং নির্মাণ নিয়ে লেখালেখি করছে। এই বিষয়ে তার কয়েকটা বইও আছে। সে মাঝে মাঝেই আর্কাইভ থেকে অথবা নিজের সংগ্রহের পুরোনো সিনেমার দৃশ্য, পোস্টার আর নায়ক-নায়িকার ছবি পোস্ট করে। এর মধ্যে ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ সিনেমার পোস্টার একটি। তার পোস্ট করা ফটোর মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ঢাকার সিনেমায় প্রথম নায়িকার ছবি। এই নায়িকা ছিল পতিতালয়ের অধিবাসিনী। কিন্তু সৌন্দর্যে, পোশাকে ও স্নিগ্ধতায় তাকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন বলে মনে করতে অসুবিধা হয় না। অনুপম সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বাংলা সিনেমায় ভদ্র ঘরের মেয়েরা প্রথম আসে নি। তারা সমাজের বিবেচনা মেনে সিনেমায় অভিনয়কে অসম্মানজনক মনে করেছে। তারা না করলেও তাদের পরিবার মনে করেছে। অগত্যা প্রযোজক/পরিচালককে রেড লাইট এরিয়ায় গিয়ে নায়িকা খুঁজতে হয়েছে। পতিতারা সংসার সীমান্তের মানুষ, শরীরের বেসাতি করে জীবনযাপন করে। সেইসঙ্গে পুরুষদের দেয় বিনোদন, নেচে এবং গান গেয়ে। সুযোগ পেলে সিনেমায় অভিনয়ও করেছে তারা। অথচ তাদের স্বীকৃতি ছিল না এবং এখনো নেই। তারা স্থায়ী ঠিকানাও পায় নি। ভূমিদস্যুরা মাঝে মাঝেই হামলে পড়ে উৎখাত করেছে তাদের বাড়িঘর থেকে, দখল নিয়েছে জমি। সেই জমিতে তারা তুলেছে বহুতল ভবন। উন্মুল অনিকেত দেহপসারিনীরা বাধ্য হয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে খদ্দেরের। পুরুষের কাম-লালসার শিকার তারা। পুরুষের চাহিদা মিটিয়ে সমাজের অলিখিত শ্রমবিভাজনে অংশ নিয়েছে তারা সেই স্মরণাতীতকাল থেকে। তারা তখন থেকেই না পেয়েছে স্বস্তি, না কোনো স্বীকৃতি। তাদের জীবন সবচেয়ে করুণ হয় যখন তারা বিগতযৌবনা। দেহের চাহিদা নেই, অর্ধভুক্ত, রোগাক্রান্ত শরীরে ধুকে ধুকে মরে তারা অসহায় জন্তুর মতো।

‘থ্রি বিলবোর্ডস্ আউটসাইড এবিং, মিসৌরী’ সিনেমাটি দেখে ফেসবুকে লিখেছিলাম এটি অনেক অস্কার পাবে। বেস্ট পিকচার, বেস্ট অ্যাকট্রেস এইসবের জন্য। মূল নায়িকার ভূমিকায় ফ্রান্সিস ম্যাকডরম্যান্ট অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তাকে আমি প্রথম দেখি ‘ফারগো’ নামের সিনেমায়। যতদূর মনে পড়ে সেই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি অস্কার পেয়েছিলেন। আমার পোস্ট পড়ে একমাত্র নাবিলা মুর্শেদ আমেরিকা থেকে সমর্থন জানিয়ে পোস্ট দিয়েছিল। সে সিনেমাটা দেখেছে। আমাদের অগ্রজ লেখক রশীদ করিমের একমাত্র কন্যা সে। আমেরিকায় অনেক দিন থেকে আছে। ফেসবুকে মাঝে মাঝেই তার পোস্ট দেখি। তার শীত মৌসুমের ছবিগুলো আকর্ষণীয়। তার আরও অনেক গুণ আছে। যাই হোক, সিনেমার ওপর আমার পোস্ট দেখে সে ছাড়া আর কেউ মন্তব্য করলেন না। এ থেকে মনে হলো, ফেসবুকের বন্ধুরা খুব একটা সিনেমা দেখেন না। না হলে এই তিন মাসে সিনেমা নিয়ে কারও লেখা চোখে পড়ল না কেন? অনুপমের কথা আলাদা, সে সারা জীবন সিনেমা নিয়েই লেখালেখি করেছে। কিন্তু অন্যেরা? তারা কি সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন? হিন্দি সিরিয়াল দখল করে নিয়েছে সব আকর্ষণ। তা নয়। বহুদিন হলো উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সিনেমার প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছে। এর কারণ শুধু সময়ের অভাব নয়, সিনেমার উৎকর্ষ না থাকাও। ভালো সিনেমা হচ্ছে না এই বিশ্বাস এখন সকলের। কিন্তু মাঝে মাঝে যে দু-একটা ভালো সিনেমা হচ্ছে যা দেখার মতো, এই তথ্য তাদের অজানা। নিয়মিত দেখলে তারা ভালো সিনেমা শনাক্ত করতে পারতেন। আমি নিয়মিত দেখি, বাড়িতে ডিভিডি প্লেয়ারে পুরোনো কায়দায় সিডি ব্যবহার করে। এখন যারা সিনেমা দেখছেন তারা ইউটিউব অথবা নেটফ্লেক্স ব্যবহার করছেন। বেশির ভাগ ব্যবহার করছেন পেনড্রাইভ। এইসব মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক ছবি থাকে, কয়েক শ’ নয়, হাজার হাজার। এমন পাইকারিভাবে পরিবেশিত ছবির ভেতর থেকে পছন্দ করে সিনেমা দেখা আমার রুচিতে বাঁধে। মনে হয় যেন আমার পছন্দটা ঠিক স্বাধীনতা পাচ্ছে না, ডিভাইস অদৃশ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে আমার সিলেকশন। মনে হয় এইসব ডিভাইসও অনেকে ব্যবহার করছেন না, বিশেষ করে ফেসবুকের ব্যবহারকারী যারা। তা না হলে ভালো সিনেমা দেখে কেউ-না-কেউ মন্তব্য করতেন। সম্প্রতি সোহানা সাবাকে পোস্ট দিয়ে যখন জানতে চাই তার পরবর্তী ছবি অথবা নাটক কবে দেখা যাবে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে লিংক করে তাঁর অভিনীত কয়েকটি ছবি এবং নাটক পাঠিয়ে দেন। এর মধ্যে ‘বৃহন্নলা’ নামের সিনেমাটি আমি মোবাইলেই দেখি। দেখা শেষ হলে তাঁকে পোস্টে জানাই সিনেমার বিষয়বস্তু বেশ বাস্তবানুগ এবং হিন্দু পরিবারে গৃহবধূর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। পরে যোগ করি : ‘বৃহন্নলা’ দেখে মনে হলো বাংলাদেশের সিনেমার মোড় ফিরেছে। এখন দেখা যেতে পারে। সিনেমার দর্শক হিসেবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য তার সাহায্যের কথা মনে রেখে আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।

সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি মাঝে মাঝে অর্থনীতি নিয়েও ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়। কিন্তু জীবনের সুকুমার দিক শিল্পের প্রতি মনোযোগ কম হওয়ার জন্য সার্বিকভাবে ফেসবুক জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার বাইরেই রয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়।

 

এগারো

নীনা হেসেল

নামটা দেখে মনে হয়েছে বাবা মা-র কেউ-একজন বিদেশি হবেন। নীনা হেসেলের সঙ্গে ফেসবুকে আমার প্রথম কথা হলো টেলিফোনে। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাবা অথবা মা বিদেশি মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, কেন এমন ভাবছেন? আামি বললাম, ওই যে নামের শেষে হেসেল। তিনি বললেন, ওটা আরবি শব্দ। জন্মের পর থেকেই নামের শেষে ওটা রয়েছে। শুনে আমার ভুল ভাঙল। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, আপনার প্রোফাইল বলছে আপনি সিয়াটলে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে পড়েছেন। আমিও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি অনেক আগে। ১৯৬০ থেকে ’৬২ সাল। আপনার হয়তো তখন জন্মই হয় নি। শুনে তিনি হেসে উঠলেন তারপর বললেন, আমি অত কমবয়সী নই। আমি সিয়াটেল ক্যাম্পাস সম্পর্কে স্মৃতিমেদুর হয়ে বললাম, খুব সুন্দর। কোয়াড্রাঙ্গেল থেকে মাউন্ট রেনিয়ারের নীল ত্রিভুজ দেখা যায়। ছড়ানো-ছিটানো বিভিন্ন ভবন খুব সুন্দর করে সাজানো। মোটেও ক্রাউডেড মনে হয় নি। আমার খুব ভালো লেগেছিল। নীনা বললেন, আমারও। তারপর বললেন, আমি এখন যেখানে থাকি কানাডার পশ্চিমে ভ্যাঙ্কুবার শহরে সেটাও সুন্দর দেখতে। কাছেই প্রশান্ত মহাসাগর। আমি বললাম, ছুটিতে ওই শহরে আমি গিয়েছি। আকাশ সমুদ্র মিলিয়ে আমার কাছে নীল রঙের শহর বলে মনে হয়েছে। নীনা হেসেল জানালেন তার ছেলেমেয়েরা টরন্টো থাকে। সেখানে তিনি যান মাঝে মাঝে। মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন বিদেশে এসে, তারপর থেকে কনসালটেন্সি করছেন। দেখলাম নাবিলার মতো পেশা, সেও কনসালটেন্ট। নীনা বললেন, তাঁর ঢাকা যাওয়া হয় না। তাঁদের বাড়ি ছিল ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। এখন সেখানে জেনেটিক প্লাজা নামে মল হয়েছে একটা। আমি বললাম, আমাদের বাড়ির খুব কাছে। আমি ২৮ নম্বরে থাকি। বাইরে বেরুলেই জেনেটিক প্লাজা চোখে পড়ে। ভেতরে যাই না। পাশে ডিপহাম নামে একটা হাসপাতাল ছিল। সেখানে যেতাম। নানা রকমের টেস্ট করাতাম। এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে যাওয়া হয় না। যাওয়ার সময় জেনেটিক প্লাজা দেখলে এখন আপনার কথা মনে পড়বে। শুনে তিনি হাসলেন, কেমন যেন বিষণ্ন হাসি। এর পর তার লেখা পোস্ট দেখলাম। তিনি টরন্টো গিয়েছেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিছু দিন থাকবেন। তার ছবির আপডেট দিলেন। এতদিন শুধু তার মুখের আংশিক দেখতে পেয়েছি, যার জন্য বয়স বোঝা যায় নি। নতুন ছবিতে তাকে পুরোপুরি দেখা গেল, শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে মনে হয় চল্লিশের ওপর হবেন। ঢাকা থেকে তাঁর আত্মীয় ও বান্ধবীরা প্রশংসা করে কমেন্ট পাঠালেন। ভারত থেকেও একজন। বুঝলাম দেশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তিনি নিজেই বললেন ফেসবুকে যোগ দেওয়ার পরে দেশের খবর তিনি নিয়মিত পান। প্রবাসীদের জন্য ফেসবুক একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন অবশ্য ভাইবার এবং স্কাইপ সেই সুযোগ আরও বাড়িয়েছে। এর ক’দিন পর তাঁর লেখা নাতিদীর্ঘ একটি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ পোস্টে দেখা গেল তাঁর ওয়ালে। সেখানে পরিচয় পেলাম অন্য এক নীনা হেসেলের। লেখায় হৃদয় মেলে দিয়েছেন। যেন পুরোনো একটা ক্ষত দেখাচ্ছেন বন্ধুদের। বিষণ্ন স্বর তাঁর এই লেখার প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত। তিনি লিখেছেন : ফল গাছ থেকে বেশি দূরে পড়ে না। ছাব্বিশ বছর বয়সে এ দেশে যখন কম্পিত বক্ষে ছোট ছেলে আর কিশোরী কন্যাকে নিয়ে প্লেনে উঠেছিলাম তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবি নি যে দীর্ঘকালের জন্য দেশান্তরে পাড়ি দিচ্ছি। ভ্যাঙ্কুবার এয়ারপোর্টে নামলাম এক আদ্যোপান্ত বাঙালি মেয়ে। তখনো আমি শাড়ি পরেছিলাম, বাচ্চারা ক্লান্ত হলেও উৎফুল্ল নতুনের আশায় উল্লসিত, খানিকটা উৎকণ্ঠিতও। আমার মনের মধ্যে শঙ্কা, ভয় উত্তেজনা। হঠাৎ করে মনে হলো এ কোথায় এলাম, এ তো অন্যরকম। যেন একটা হিমশীতলতা নেমে এল চেতনায়। মুখে হাসি আর ফুর্তিভাব নিয়ে যথারীতি সবকিছু যন্ত্রচালিতের মতো করে গেলাম। যেখান থেকে এসেছি তার সঙ্গে কোনোই মিল নেই। অজানাকে যে এত ভয় লাগে তা আগে বুঝি নি। অজানা নতুন পরিস্থিতিতে মানুষের চিরন্তন আদিম ভীতি। বাংলা শুনতে অভ্যস্ত কানে মাইক্রোফেনের ইংরেজি কথাগুলো বুঝতেই পারলাম না, যেন জীবনে ইংরেজি এই প্রথম শুনছি। আমি তো বাঙালি-ইংরেজিতে অভ্যস্ত। যাই হোক, আমাদের লাগেজ ক্যারাউসেল থেকে খুঁজে পেলাম। বিদেশের অভিজ্ঞতা আমার অগেও ছিল। তবু সেই মুহূর্তে নিজেকে একটা নিরেট বোকা, অশিক্ষিত গবেট বলে মনে হলো। ইমিগ্রেশন পেরিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে চোখ দুটো আমার বিস্ময়ে দেখে গেল জীবনের চলমানতা। মানুষ, পরিপাটি ঘাস, বাড়িঘর, যানবাহন সব যেন পটে আঁকা ছবি। হঠাৎ আমার মনে হলো, এ আমি কোথায় এলাম। এত অন্য রকম! একটি অস্বস্তি কল্পনায় বা ছবিতে দেখা একটা চিত্র আর এখন আমি বাস্তবের চিত্রেরই একটা অংশ, যেন ফ্রয়েডিয়ান স্বপ্নের মধ্যে ডুবসাঁতার কাটছি। জলের ওপরে ভেসে উঠব, কতক্ষণে বাড়ি ফিরে যাব, সেখানে সবাই আমাকে জানে, আমি সবাইকে চিনি ও জানি। গাছ-ফুল-ফল, গন্ধ-শব্দ সবই পরিচিত।

ফিরে যাওয়া হয় না। দিন আসে, বছর পেরুতে থাকি। অপরিচিত পরিচিত হয়। ক্রমশ অভ্যস্ত হই অথবা বলা যায় মেনে নিই প্রবাসী জীবন। পৃথিবী জাড্য নয়, জীবাণুও নয়। আমরা এই পৃথিবীর কক্ষেই আবর্তিত হই। তবে মাধ্যাকর্ষণ ছিন্ন করে অন্য কোনো নক্ষত্রে কিংবা অন্য কোনো পৃথিবীতে যেতে পারি না। এক অমোঘ শাশ্বত বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের অস্তিত্বকে সংহার করে নিরন্তÍর।

লেখাটিতে নীনা হেসেলের জীবন সম্পূর্ণ না হলেও অধিকাংশ প্রতিফলিত হয়েছে। এই জীবন একজন সংগ্রামী মানুষের যিনি দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। প্রবাসী হয়েছেন অনেকটাই বাধ্য হয়ে। বিদেশে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। এই দিক দিয়ে তার বিদেশ যাত্রা সফল। কিন্তু তার মনের ভেতরে রয়ে গিয়েছে একধরনের ব্যর্থতাবোধ এবং স্বদেশ ত্যাগের কারণে বিষণœতা। এই বিষণ্নতা এতই গভীর যে সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় তার উপশম ঘটে নি। ঘটলে তিনি এত বছর পর ওপরের ব্যক্তিগত লেখাটি লিখতেন না। স্পষ্ট বোঝা যায় যে ক্ষত নিয়ে তিনি বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন সেখান থেকে এখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। লেখাটি পড়ার পর নীনা হেসেল আমার বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন, যেমন হয় রক্তমাংসের শরীরের মানুষ। তিনি ফেসবুকে আগন্তুক হয়ে থাকেন না। তাঁর ব্যথায় আমি সমব্যথী হই। একজন সংবেদনশীল মানুষের সংস্পর্শে এসে আলোড়িত বোধ করি, এই জন্য যে এই স্বভাবের মানুষ আজকাল খুব বেশি নেই। যান্ত্রিক সভ্যতা এবং বৈষয়িক বিবেচনা মানুষকে বদলে ফেলেছে। লেখাটির জন্য নীনা হেসেল লাইক পেয়েছেন ৫৯টি। মন্তব্য পেয়েছেন অনেক। একটি মন্তব্য : মন খারাপ করে দিলে। আর একজন লিখেছেন : বড় ভালো লাগল তোমার লেখা। পরিস্থিতির কারণে তুমি ঠাঁই নিয়েছিলে দেশ-দেশান্তরে। কিন্তু তোমার মন পড়ে আছে বাংলায়। মন খারাপ কোরো না। চলো না কিছুদিনের জন্য বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসি। আমি ভারত থেকে, তুমি কানাডা থেকে। চলো দুজনে হাত ধরে বাংলার পথেপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াই। আর একজনের মন্তব্য : মেজপা আসো না। তুমি না সেদিন বললে আসবে? এই বিশ বছরে তোমার কত আপনজন না-ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। আর একজন : সেই যে দেশ ছাড়লে, ঘর ছাড়লে, আর তো ঘরে ফেরা হলো না তোমার। ছোটপা ভীষণ কান্না পায়, ভেতরটা ভীষণ হু হু করে। আর একজনের মন্তব্য : তার মন পড়ে আছে এখনো এই দেশে, তার বুকে এখনো মেঘলা দিনের আকাশ। একজনের মন্তব্য : আজ কষ্টগুলো ভিড় করে এভাবে আমাকে কাঁদাচ্ছে। এ যেন সকল প্রবাসীর মেঘমেদুর স্মৃতিকাতর শোকগাথা। ১৯৭২ সালে বলাকায় দেখেছিলাম, দি ট্র্যাপ সিনেমা। তখন থেকে ইচ্ছে ছিল এই ব্রিটিশ কলোম্বিয়া একবার দেখা দরকার। আর একজন : কী দুঃসহ সেই স্মৃতিকাতরতা। আর একজন : দুটি মূল চরিত্র সিনেমায়। একটি বোবা। মনে রাখার মতো অসাধারণ ছবি। একজন : নিনাপা, পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল। একজনের মন্তব্য : যাপিত জীবনের চালচিত্র। আর একজন : খুব ফ্যাকচুয়াল, সাবলীল লেখা। এটাকে বড় করে দাও। খুব সুন্দর সাড়াজাগানো বই হয়ে যাবে। তুমি কোনো ভুল করো নি। ওটাই তোমার দেশ এখন। হৃদয়ে বাংলাদেশ তোমাকে মাঝে মাঝে আনন্দ দেবে।

নীনা হেসেলের লেখা পড়ে যতটুকু তাঁকে জানতে পারি, তার লেখার ওপর প্রতিক্রিয়াগুলো পড়ে শূন্যস্থানগুলো যেন পূরণ হয়ে যায়। আমি তাঁর জীবনের একটা চিত্র দেখতে পাই সামনে। কেন তিনি প্রবাসী হন, তাঁর দুঃখ কিসের জন্য, কাতরতা সত্ত্বেও কেন তাঁর দেশে ফিরে যাওয়া হয় না—এসবই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে আসে। শুধু অবাক লাগে ভেবে যে ক্ষতটা এত দিনেও শুকিয়ে যায় নি। গেলে এমন মর্মস্পর্শী লেখা এখন তিনি লিখতেন না। সহানুভূতিতে আমার মন ভরে আসে। আমি কয়েকদিনের ফেসবুকের ফ্রেন্ড। আত্মীয় না, পুরোনো বন্ধুও না। তাই সান্ত্বনা দিয়ে কিছু লিখতে পারি না। এই প্রথম একজন প্রবাসীর এমন করুণ আর্তি তার নিজের লেখায় পড়ে জানতে পারি। এই প্রথম ‘ফল তার গাছ থেকে বেশি দূরে পড়তে পারে না’ কথাটির পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারি। ‘আদ্যোপান্ত বাঙালি মেয়ে’ বলতে তিনি কী বোঝান তারও উপলব্ধি হয়। এই লেখাটি পড়ার পর বিভিন্ন বিষয়ে নীনা হেসেলের কমেন্ট পড়ি আমি ফেসবুকে। বেশ দৃঢ়চেতা, সাহসী এবং অকপট তিনি। তাঁর ব্যক্তিত্ব সহজ-সরলতার ভেতর কঠোরতা নিয়ে গড়ে উঠেছে। পোড়খাওয়া মানুষ, কিন্তু সহজে ভাঙেন না।

নীনা হেসেলের লেখার পর বেশ কয়েকটা পোস্ট পড়ি মালেকা ফেরদৌসের। তিনি প্রবাসী নন। বাংলাদেশেই আছেন। তাঁর পোস্টের প্রধান বিষয় কবিতা। একটি কবিতা এই রকম : অন্ধকারে আলো ফেলে দাও/ হৃদয়ের নগ্নতাকে ঢেকে দাও/ প্রেমে। গভীর স্রোতের মতো স্বপ্নকে বইতে দাও। এই কবিতাটির জন্য তিনি লাইক পেয়েছেন ১০২, কমেন্ট ৭টি। এই পোস্ট পড়ার পরে দেখতে পাই একটি ছবি। বেশি কিছু লেখা নেই শুধু মুক্তিযোদ্ধা কথাটি ছাড়া। কথার চেয়ে ছবিটাই বেশি বাক্সময়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক মুক্তিযোদ্ধা মৃত এক মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর দুকাঁধে ঝুলিয়ে এগিয়ে আসছে। তার সামনে ট্রেঞ্চ, তারকাঁটা, গর্ত, আগাছা। যুদ্ধক্ষেত্র। যদি সত্যি এমন দৃশ্য দেখে ছবিটি তোলা হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে এটি যুদ্ধের ফটোগ্রাফের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। রবার্ট কাপার সঙ্গে তুলনীয়। এর পর আর একটা পোস্ট। পোস্টে এক মহিলা শাড়ি পরে কমেন্ট দিয়েছেন : এই শাড়িটা পরে ভালো লাগছিল না। পরে সুন্দর লেগেছে। আরাম। লাইক পেয়েছেন ৭৯, কমেন্ট ৪। ফেসবুকে কোন পোস্ট যে কত লাইক পাবে তার কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। শুধু নতুন শাড়ি পরেই এক শ’র ওপর লাইক পেতে পারে কেউ। নির্ভর করবে তার বন্ধুর সংখ্যা কত এবং শাড়িটিতে সত্যিই কোনো নতুনত্ব আছে কি না। নীনা হেসেলকে দেখা গেল জামদানি শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। টরন্টোতে ছেলে কি মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটির জন্য লাইক পেয়েছেন ৩৪টি, কমেন্ট ৪টি।

 

বারো

ফেসবুকে মেয়েরা

ফেসবুকে মেয়েরা যত সক্রিয় ছেলেরা সেই তুলনায় কম। এর কারণটা বেশ বোঝা যায়। পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের পাবলিক স্পেস কম, তাদের সুযোগ দেওয়া হয় হেলাফেলা করে। কি চাকরিতে, কি মতপ্রকাশে কিংবা সৃজনশীল কাজের উপস্থাপনার জন্য তাদের স্থান সংকুচিত। যারা ভাগ্যবতী তারা এই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যান। যারা বিত্ত ও প্রভাবশালী পরিবারের তাদেরও পাবলিক স্পেসে জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েরা প্রান্তিক জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু তারা মনের কথা প্রকাশ করতে চান, সুখ-দুঃখ অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে উন্মুখ। তাদের অধিকাংশই সুকুমার বৃত্তির অধিকারী। কেউ কাঁথা বোনেন, কেউ গান করেন, কেউ ছবি আঁকেন এবং অনেকেই কবি। কথাসাহিত্যেও তাদের পদচারণা বেশ বলিষ্ঠ এবং সরব। কিন্তু এসব স্বীকৃতি পায় না যতক্ষণ না পুরুষনিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় তাদের সুযোগ দেওয়া হয়। পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে তাদের অনেকেই নিজের প্রতিভা প্রকাশে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসেন না। যারা আসেন তাদের মধ্যে সবাই যে শীর্ষে উঠতে পারেন তাও বলা যাবে না। বুনোফুলের মতো অনেকেই ঝরে পড়েন লোকচক্ষুর অন্তরালে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই পরিণতি হয় খুব বেশি। ফেসবুক মেয়েদের জন্য পাবলিক স্পেস দিয়েছে যেখানে তাদের অংশগ্রহণের রয়েছে পুরুষের সমান সুযোগ এবং স্বাধীনতা। এখানে প্রবেশের জন্য তাদের কারও অনুগ্রহের অপেক্ষা করে থাকতে হয় না। ফেসবুকে তাদের ওয়ালে তারা যখন খুশি, যা ইচ্ছে বলতে এবং লিখতে পারেন। সুখের কথার পাশাপাশি দুঃখের এবং অভিযোগের বিষয়ও স্থান পায় সেখানে। ফেসবুকের বন্ধুরা সুখের সংবাদে আনন্দিত বোধ করেন, দুঃখে সমবেদনা জানান। ফেসবুকে মেয়েরা তাদের অধিকারের কথা বলতে পারেন মুক্তকণ্ঠে, তুলে ধরতে পারেন অন্যায়-অবিচারের কাহিনি। তারা কোনো অনুগ্রহ চান না, পুরুষের সমান অধিকার ভোগের সুযোগ চান মাত্র। তাদের যা প্রাপ্য তার জন্য দাবি তোলেন। যে মহিলা ছবি আঁকেন কিন্তু প্রদর্শনীর সুযোগ পান না, যাদের গানের শখ এবং দক্ষতা আছে কিন্তু রেডিও-টেলিভিশনে সুযোগ দেওয়া হয় না, যারা কবিতা-গল্প লেখেন কিন্তু কোনো সম্পাদক সেসব ছাপতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না, তাদের জন্য ফেসবুক একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মে সাহিত্যচর্চার ফসলই বিশেষ করে সুযোগ গ্রহণ করছে। ফেসবুকে মেয়েদের লেখা কবিতা, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ, ছোটগল্পের উৎকর্ষ দেখে বেশ বোঝা যায় যে তারা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। এদের লেখা বই হিসেবে কেন প্রকাশ করা হয় না, এই কথা অনেকের মনেই আসবে। অনলাইনে, ফেসবুকে তারা আত্মপ্রকাশের যে সুযোগ পাচ্ছেন তা তারা অনেক দিনের আন্দোলন করেও পান নি। ফেসবুক শুধু গণতান্ত্রিক নয়, জেন্ডার-নিরপেক্ষ। যে-কেউ এখানে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাদের ব্যক্তিতগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার জন্য এখানে কেউ ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে নেই। ফেসবুকের ভালো দিক আছে, মন্দও আছে। কিন্তু মেয়েদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি এবং অধিকার রক্ষায় ভূমিকা নিয়ে এই যোগাযোগ মাধ্যম এক সামাজিক বিপ্লব এনে দিয়েছে। এই বক্তব্য এবং মতামত আমি ফেসবুকে পোস্ট করার পর কিছু সাড়া পাওয়া গেল, কিন্তু আশানুরূপ না। পুরুষেরা হয়তো বিব্রতবোধ করে চুপ করে থাকলেন। মেয়েরা তেমন কিছু বললেন না সংকোচের জন্য। সংকোচ হয়তো এ জন্য যে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দরজা এখনো তাদের জন্য মাত্র অর্ধেক খোলা। ফেসবুকে তাদের অংশগ্রহণ পুরুষতন্ত্রের দুর্গের পতন নয়, এটা তারা ভালো করে বোঝেন কিন্তু ফেসবুকে তাদের পাবলিক স্পেস পুরুষদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে যার ফলে দুর্গের পরিখার ওপর ড্রব্রিজন একদিন তুলতেই হবে মেয়েদের অবাধ প্রবেশের জন্য। সেই অভিযানে ফেসবুক মেয়েদের সহযাত্রী শুধু নয় শক্তিশালী হাতিয়ারও বটে। আমি পোস্টে লিখেছি যে আমার মতে এটাই ফেসবুকের সবচেয়ে বড় অবদান। ড. রওনাক লিখলেন, ঠিক বলেছেন কিন্তু মেয়েদের ওপর, সমাজের ওপর ফেসবুকের বিরূপ প্রভাবের কথাও মনে রাখতে হবে। উত্তরে আমি লিখলাম, কোনো প্রযুক্তি অবিমিশ্র ভালো কিংবা মন্দ নয়। তার যা ভালো সেটির সদ্ব্যবহার করলে মন্দ দিকটা তুচ্ছ হয়ে যাবে। খারাপ দিক আছে বলে ভালো দিকটা উপেক্ষা করে থাকা উচিত হবে না। এর উত্তরে ড. রওনাক আমেরিকায় গান কন্ট্রোলের উল্লেখ করলেন। আমি দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক বুঝতে পারলাম না। আমি লিখলাম, গান কন্ট্রোলের সঙ্গে আমেরিকার রাজনীতি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। ফেসবুকের ক্ষেত্রে তেমন নয়। তবে অপব্যবহার বন্ধের জন্য তদারকির প্রয়োজন রয়েছে। এটা ফেসবুক কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে যেমন বিষদ আলোচনা হবে বলে মনে করেছিলাম তা হলো না দেখে একটু অবাকই হলাম আমি। এইটুকু বুঝলাম যে মেয়েদের সমান অধিকারের বিষয়টি নারীবাদী আন্দোলনের এতদিন পরও বেশ স্পর্শকাতর।

 

তেরো

বিউটি এবং লাল সবুজ পতাকা

হঠাৎ ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায় হবিগঞ্জের বিউটি নামের কিশোরীর ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ। ছবিতে দেখা যায় সে ধানখেতের পাশে সবুজ জমিতে শুয়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে, প্রাণহীন। তার কাপড়ের রং লাল। সবুজ আর লাল রং মিলে বাংলাদেশের পতাকার মতো হয়ে গিয়েছে। একের পর এক কমেন্ট আসছে। সবাই দৃশ্যটিকে পতাকার সঙ্গে তুলনা করছে, বলছে বিউটি তুমি আজ বাংলাদেশ। তুমি নও, বাংলাদেশ ধর্ষিতা। পুলিশের নিন্দা করেও কমেন্ট হচ্ছে, কেননা প্রথমবার ধর্ষণের পর বিউটির বাবা থানায় গিয়েছিল মামলা করতে। থানার কর্মকর্তা মামলা নেয় নি, বলেছে কোর্টে যেতে। বাবুল নামের ধর্ষক প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে, তার মা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যা। সে ক্ষিপ্ত হয়ে বিউটিকে হরণ করেছে তার নানার বাড়ি থেকে যেখানে সে আত্মগোপন করেছিল সে। রাতের বেলা প্রকৃতির ডাকে বেরিয়ে এসেছিল বিউটি, কাছেই ওঁত পেতে ছিল ধর্ষক বাবুল আর তার সঙ্গীরা। তাকে তারা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় সবুজ ঘাসের ওপর। যেন বাংলাদেশের পতাকার প্রতীক। স্বাধীনতা দিবস তখন সামনে। সেইজন্য ফেসবুকে সবাই স্বাধীনতার সঙ্গে তুলনা করে কমেন্ট দিয়েছে একটার-পর-একটা। খুব আবেগপূর্ণ সেইসব কমেন্ট। বিউটি আখতারের ধর্ষণ এবং হত্যা ভাইরাল হয়ে গিয়েছে ফেসবুকে। এক সাংবাদিকের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে : ‘দেশজুড়ে শিয়ালদের উত্থানে বীভৎস প্রতীক হয়ে থাকবে বাংলাদেশের পতাকার মতো বিউটি আখতারের লাশের ছবি। ছোটবেলায় দুধের শিশুদের শেয়ালে টেনে নিয়ে খাওয়ার ঘটনা শুনতাম। বিলের ধারে, নদীর পাড়ে বা সবুজ খেতের পাশে শিশুর অর্ধ-খাওয়া দেহ পড়ে থাকতে দেখা যেত। শেয়ালের পাল বিউটিকে আগেও একবার খেয়েছিল, রক্ত খেয়ে অর্ধনগ্ন দেহটা ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই করুণা গ্রহণ করতে পারে নি মেয়েটির বাবা। তিনি শেয়ালদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন। কেননা আইন প্রতিশ্রুতি দেয় বিচারের। সমাজের নেতারা বললেন, মেয়ে তুমি চিৎকার করো, প্রতিবাদ করো, গুটিয়ে যেয়ো না। বিউটি আখতার আর তার বাবা-মায়ের বিশ্বাস ছিল বিচারের ওপর। প্রশাসন ও পুলিশের ওপর। কিন্তু শেয়ালদের দুনিয়ায় শেয়ালরাই রাজা। শায়েস্তাগঞ্জ থানার পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি। তারা কি জানত না ধর্ষণের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ধর্ষিতার জীবন মামলার পরে আরও ঝুঁকিতে পড়ে? তার বাবা ভেবেছিলেন মেয়েটিকে নানাবাড়িতে লুকিয়ে রাখবেন। কিন্তু শেয়ালদের নেটওয়ার্ক অনেক লম্বা। গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা বিউটির নানাবাড়ি চিনে আসে। তারপর কাছের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে অপেক্ষায় থাকে। তারা জানে বিউটির নানিও গরিব। বোরকা থেকে লোহার পোশাক সব ছিঁড়তে জানে শেয়ালরা। পরদিন জনতা বাংলাদেশের আশ্চর্য পতাকার দেখা পায়। সবুজ জমিনে লাল জামা পরে রক্তে লাল মরণঘুমে শুয়ে আছে বিউটিফুল বাংলাদেশের বিউটি আখতার। সেই দৃশ্য বাংলাদেশের দুঃখী পতাকার মতো মনে হয়। আর বাংলাদেশকে মনে হয় শেয়াল-হায়েনাদের জন্য বানানো মানুষের খোঁয়াড়। এখানে আমরা আর কোথায় লুকোবো? খাঁচার আরও ভেতরে গিয়ে বসব? মিথ্যা। মিথ্যা ভাবা এই যে অনেক শেয়ালের ভিড়ে আমাকে ওরা দেখতে পাবে না।’ এই লেখায় লাইক পড়েছে ৮১টি। একজনের মন্তব্য : দুঃখ, আগে এইসব ঘটনায় স্থানীয় পর্যায়ে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ত। এখন যে সবাই নেহায়েত খোলসপরা অমানুষ। বিচার চাই। বিচার চাই। আর একজনের মন্তব্য : অন্ধ হয়ে গেছ ফলে/ তুমি যারে বলছ পাখি/ ওগুলো তো ভীত সন্ত্রস্ত কবুতর/ ওদের ধরে বেঁধে আনা হয়েছে শান্তির নামে/ তুমি যাকে বলছ সম্পদ উৎপাদন/ চোখ থাকলে দেখ একবার ওগুলো মানুষের খুনি। তুমি যাকে বলো সংহতি, সভ্যতা/ ধর্ষিত মেয়েটি জীবন দিয়ে লিখে রেখে যায় সেটা কথার কথা।

ফেসবুকে কয়েক দিন শুধু বিউটি ধর্ষণের প্রতিক্রিয়া লেখা হয়। একজন লিখেছে : মাত্র ১৬ বছরের মেয়েটি শুয়ে আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সবুজ বুকে বিউটি লাশ হয়ে শুয়ে আছে। লাইক বাড়তে বাড়তে এখন দাঁড়িয়েছে তিন হাজারে। একজনের মন্তব্য : এই কুত্তাগুলোকে পুলিশ ধরছে না কেন? আর একজন : পাকিস্তান আর বর্তমানের সঙ্গে তফাত কী? আমরা কি পাকিস্তানিদের থেকে দেশ স্বাধীন করেছি এই জন্য যে মেয়েগুলোকে আমরা ধর্ষণ করতে পারি? আর একজন লিখেছেন : তাই তো আজও প্রশ্ন জাগে স্বাধীনতা অর্জনের পরও আরও কতদিন এমন অন্যায় সইতে হবে? সব অন্যায়ের বিচার কবে পাওয়া যাবে? একজন লিখেছেন : স্বাধীনতা! আর একজন : চারদিকে কত ধর্ষক ওঁত পেতে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। এর পর কার পালা? একজন লিখেছেন : রাষ্ট্র এখানে ব্যর্থ, আইন এখানে গারদবন্দি, মমতা এখানে রূপকথা। আর একজন লিখেছেন : নির্মম, জঘন্যতম সব অপরাধের বিচার হয় না। এদেশের মাটিতে পা রাখতেও এখন ভয় হয়। আর একজন : যতদিন বাংলার মানুষ ধর্ষণকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে যাবে ততদিন আমার আপনার মা-বোনেরা কেউ-ই নিরাপদ না। মোশাররফ করিম সত্য কথা বলার কারণে তাকে নাস্তিক উপাধি দেওয়া হলো, তার ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হলো। পোশাককে দোষ দিয়ে লাভ কী? নিজের মনের কামনা-বাসনাকে যদি দমিয়ে রাখতে না পারেন তাহলে আপনার কাছে মা-বোনও নিরাপদ না। আর একজনের মন্তব্য : দেশ নাকি উন্নয়নের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। আর একজন : এখনো কি আমরা হ্যাপী ইনডিপেনডেন্স বলব? আর একজনের মন্তব্য : রাজনীতির বড় আসনে মহিলা অথচ আমাদের মেয়ের কী হবে? একজন : সবুজের বুকে লাল—ঠিকই তো আছে। এটাই তো বাংলাদেশ। একজন : থুথু দিই এমন শাসনব্যবস্থাকে। আর একজন এই দেশে বিচার পাবে না কেউ। একজন : পুলিশ ইজ দা কালপ্রিট। একজন : ধর্ষণ কি মেয়েটির পোশাকের জন্য হয়েছিল, নাকি? একজন : কী বিচিত্র এই দেশ। একজন : মানুষ না, কুত্তা এইগুলা। একজন : হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি, উন্নয়নশীল দেশের মূলনীতি। একজন : স্বাধীনতা এখনো পাওয়া হয় নি। সবুজের বুকে লালের বর্ণ এখনো বহমান। মাফ করে দে বোন। এই দেশ কালা-বোবা। এখনো স্বাধীন হয় নি এই দেশ। একজন : এ দেশে অন্ধ। সবাই অন্ধ। একজন : এদের ধরে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হোক। একজন : ধর্ষিতা বোনের শাড়ি আমার রক্তাক্ত পতাকা। এরপর ধর্ষক বাবুলের ছবি পোস্ট করেছে একজন। সানগ্লাস পরা, গলায় সোনার চেইন। একজনের মন্তব্য : আরে এ যে দেখছি মানুষের মতো। আর একজন : অমানুষ। একজনের মন্তব্য : শেয়ার করুন এই ছবি। ধরিয়ে দিন একে।

এর কয়েকদিন পর র‌্যাব বাবুলকে গ্রেপ্তার করে। এই খবরের ওপর কোনো কমেন্ট আসে না। তারপর সংবাদপত্রে খবরে জানা যায় পুলিশ বিউটির বাবা আর চাচাকে গ্রেপ্তার করেছে হত্যার অপরাধে। সংবাদ অনুযায়ী তারা পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি করেছে। ফেসবুকে এখন বিউটির খবর হারিয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে আর কোনো কমেন্ট আসছে না। আমার কাছে মনে হলো, ফেসবুকের এই এক শক্তি আর দুর্বলতার জায়গা। ইস্যু পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। এইভাবে কিছুদিন চলে। তারপর অন্য ঘটনা এসে ফেসবুকের দৃষ্টি আর মনোযোগ আকর্ষণ করে। তখন সব কমেন্ট আর পোস্ট সেইদিকে চলে যায়। আগের ইস্যু চাপা পড়ে যায়। ফলোআপের কোনো ট্রাডিশন গড়ে ওঠে নি ফেসবুকে। কদাচিৎ পুরোনো ইস্যুর উল্লেখ করা হয়। ফেসবুক তাৎক্ষণিক ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর অন্য ইস্যু এসে তার স্থান দখল করে নেয়।

বিউটি আখতারের ধর্ষণের ঘটনায় এখন রহস্য নেই বলে মনে হয়। কে অপরাধী তা জানা গিয়েছে। স্বীকারোক্তিও করেছে অপরাধী। অবশ্য সেই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাদের দোষী বলে সাব্যস্ত করা যাবে না। বিচারের প্রক্রিয়ায় অন্য বিষয়ও আসবে, সাক্ষী-প্রমাণ যদি যথেষ্ট না হয় অপরাধ প্রমাণিত হবে না। এমনই দেখা গিয়েছে এইসব ক্ষেত্রে। বিশেষ করে ধর্ষিতা হয় যদি মৃত। বিউটির ধর্ষণের মামলায় শেষপর্যন্ত কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তার চেয়েও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার হত্যার অপরাধে দোষী ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ। র‌্যাব বাবুলকে গ্রেপ্তারের পর সে শুধু ধর্ষণের অপরাধ স্বীকার করেছে বলে জানা গিয়েছে। তাকে হত্যার অপরাধ সে স্বীকার করে নি। অপরদিকে পুলিশ বিউটির বাবা আর চাচাকে গ্রেপ্তারের পর হত্যার স্বীকারোক্তি আদায় করেছে বলে প্রকাশ। অপরাধটি তাই বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। ধর্ষণের বিষয়টি এখন মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু হত্যার মোটিভ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিউটি যেন সাক্ষ্য না দেয় তার জন্য ধর্ষকেরা তাকে হত্যা করতেই পারে। অন্যদিকে বিউটির বাবা আর চাচা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বিবাদের জন্য বাবুল আর তার মাকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে হত্যা করেছে বলে পুলিশ যে তথ্য দিয়েছে সেটা কতটুকু বাস্তব এবং গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার দাবি রাখে। এখানে মোটিভের বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন বাবা কী কারণে তার নিজের কন্যাকে হত্যা করতে পারে, এই প্রশ্ন দেখা দেবে অনেকের মনে। কিন্তু এইসব নিয়ে ফেসবুকে কোনো আলোচনা নেই, কেউ কোনো প্রশ্ন তুলছে না। কারণ হয়তো এই যে, বিউটি ধর্ষণ-হত্যা এখন আর ফেসবুকে নিউজ হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে না। তার স্থান দখল করে নিয়েছে নতুন কোনো ঘটনা। যেমন, চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন। বিউটিকে নিয়ে কয়েকদিন লেখালেখির পরই যে বড় ধরনের কমেন্ট দেখতে পাই ফেসবুকে সেটি এক মহিলার লেখা। তিনি লিখেছেন : ‘আমাকে এক আশ্চর্য সবুজের গল্প শোনাতেন আমার মা। দিগন্তচারী এক অশ্বারোহীর কথা বলতেন তিনি। অরুণ বর্ণের সেই অশ্বারোহী তার অলৌকিক ঘোড়ায় চড়ে সবুজের তরঙ্গ পেরিয়ে মাঠ-নদী অরণ্যের প্রান্ত ছুঁয়ে মেঘস্পর্শী পাহাড়ের মতো কেমন ঝলমলিয়ে উঠতেন, তখন অশ্বখুরের ধ্বনি কায়াহীন সব প্রেতাত্মাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। সে ছিল অফুরন্ত বীরত্বের গল্প। তখন জ্যোতিষ্মান নক্ষত্রের মতোই জ্বলে উঠত তার চোখ, সহস্র শ্বেতকপোতের পক্ষ সঞ্চালনের শব্দ বুকের ঢেউয়ে, স্বপ্নগুলো হয়ে যেত দিকপ্লাবী এক নদী, আর লাল-সবুজের পতাকা উড়তে থাকত আমার মায়ের আঁচলে। সোনালি রঙের ভেতর ছুটন্ত অশ্বারোহীর ছবি।’ সুন্দর লেখা, কাব্যিকতা আছে। কিন্তু অব্যবহিত আগে যে বিউটি আখতারের মর্মান্তিক কাহিনি নিয়ে আলোচনা হয়েছে ফেসবুকে তার সঙ্গে কোনো মিল বা সম্পর্ক নেই এই লেখার, একমাত্র ‘লাল-সবুজ পতাকা’র উল্লেখ ছাড়া। কিন্তু এই উল্লেখও বিউটি আখতারের প্রসঙ্গে নয়। এই লেখায় লাইক পড়েছে ৯৯টি। কয়েকটি কমেন্ট এই রকম : অসাধারণ লেখা আপা। আর একজন : এমন স্বপ্ন দেখানো বাঙালি মায়ের সন্তানেরাই অলৌকিক ঘোড়ায় চড়ে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে পৌঁছে যায় সোনার বাংলাদেশে। আর একজনের মন্তব্য : আহা! যেন মহাসুন্দরের তলদেশ থেকে উত্থিত কোনো মহাসুন্দর গাথা। আর একজন : অপূর্ব। আর একজন : চমৎকার। আর একজন : খুব সুন্দর আপা। অসাধারণ শক্তিশালী আর কাব্যময়। এইসব মন্তব্য পড়ে ভাবা যায় না যে মাত্র কয়েকদিন আগে ফেসবুকে বিউটি আখতারের মৃতদেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল লাল সবুজ পতাকার এবং ঢল নেমেছিল প্রতিবাদী ও ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে নানাজনের মন্তব্যের। ফেসবুকে ইস্যুগুলি এইভাবে আসে ঝড়ের মতো, তোলপাড় করে কিছুদিন, তারপর চলে যায় দৃষ্টির আড়ালে।

 

চৌদ্দ

সোহানা সাবা : এক অভিনেত্রীর প্রতিকৃতি

সোহানা সাবার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, তাঁর অভিনীত কোনো নাটক কিংবা সিনেমা দেখা হয় নি। ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ‘প্রথম আলো-মেরিল চলচ্চিত্র পুরস্কার’ প্রদানের জন্য গঠিত কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি অসংখ্য বাংলাদেশি চলচ্চিত্র দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতার পর বাংলাদেশি চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ আমার চলে গিয়েছে। যার জন্য দীর্ঘদিন বাংলাদেশে তৈরি কোনো চলচ্চিত্র দেখা হয় নি। ফলে সোহানা সাবা অভিনীত কোনো ছবি দেখি নি। ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করার কোনো প্রসঙ্গ দেখা দেয় নি। একদিন ফেসবুকে দেখলাম সবুজ মাঠে সালোয়ার কামিজ পরে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে আছে এক নারী। দেখে চমকে উঠলাম। বিউটির কথা মনে এল। ওপরে নাম লেখা দেখলাম : সোহানা সাবা। বুঝলাম তিনি মডেলের ভঙ্গিতে ছবিটি তুলেছেন ফেসবুকে দেওয়ার জন্য। আমি ইতস্তÍত করে কমেন্ট দিলাম : এখন এ ধরনের ছবি দেখলে চমকে উঠি। এমন পোজ দিয়ে ছবিটা কি না তুললেই হতো না? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাওয়া গেল : ছবিটা পুরোনো। আমার পুরোনো ছবির সঙ্গে বাধনের ছবির মিল দেখে অবাক হয়েছি। আমি কিছুক্ষণ পর লিখলাম : ছবিটা প্রত্যাহার করা যায় না? প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল : করছি। দেখে আমি অবাক। নতুন প্রজন্মের নামি-দামি এক নায়িকা আমার এককথায় তাঁর ছবি ফেসবুক থেকে তুলে দিচ্ছেন। এই ছবি তুলতে তাঁকে এবং ফটোগ্রাফারকে অনেক সময় দিতে হয়েছে এবং কষ্ট করতে হয়েছে। অজানা-অচেনা আমার মতো একজনের মন্তব্য শুনে সেই ছবি তুলে নেওয়ার মধ্যে বিনয় আছে, সেইসঙ্গে নমনীয়তা। আমি অভিভূত হয়ে লিখলাম : ধন্যবাদ। আপনি অতি ভদ্র। এর পর তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে আমার আর কোনো আলাপ হয় নি। কিন্তু তাঁর কথা প্রায়ই মনে হয়েছে। বয়সে কম হলেও তিনি যে মহৎ চরিত্রের এবং ভুল করলে সেটা স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত হন না এটা বুঝতে পেরেছি। মাত্র আমিই ছবিটির সমালোচনা করেছি, তাঁর অসংখ্য ভক্তের মধ্যে আর কেউ নয়। সেই সমালোচনা তিনি বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমার একটা ধারণা গড়ে ওঠে যা তাঁর সম্বন্ধে আরও জানার জন্য কৌতূহলী করে তোলে। নিছকই কৌতূহল, তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার কথা তখনো আমার মনে আসে নি। এসেছে আরও পরে। আরও তথ্য জানার পর। পাঁচ দিন পর ফেসবুকের ওয়ালে সাবার নতুন ফটো দেখা গেল। আপডেট দিয়েছেন। এবারও চমকে উঠলাম। তবে আশঙ্কার জন্য না। অবাক হয়ে। এমন ভঙ্গিতে কেউ ছবি তুলতে পারে ভাবতে পারি নি। আমি বিদেশে অনেক ফ্যাশন ফটোগ্রাফারের তোলা ছবি দেখেছি। রিচার্ড এভেডন, সিসিল বিটন, আঁরি কাটির্য়ার ব্রেসোঁ। সোহানা সাবার এই ছবিটি তাদের তোলা ছবির সঙ্গে তুলনীয়। একটা পার্থক্যও রয়েছে। ছবিটি গ্রামীণ পটভূমিতে তোলা, শহরের কোনো বাড়িতে কিংবা পার্কে নয়। পেছনে দেখা যাচ্ছে গৈরিক রঙের উঁচু ঘাস হালকা পর্দার মতো জমি থেকে ওপরে উঠেছে। সেই পর্দার পেছনে মাঝারি আকারের কয়েকটা গাছের অস্পষ্ট কা- দাঁড়িয়ে আছে। সাবা একটা মাটির স্তূপের ওপর অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে কালো পোশাকে বুটজুতা পরে দাঁড়িয়ে আছেন। একটি পা সামনে বাড়িয়ে দেওয়া। তাঁর এক হাত সেই মাটির স্তূপের ওপর, অন্য হাত গালে রেখে মুখ ঈষৎ ঘুরিয়ে একদিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মুখটা পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। কালো বিদেশি স্টাইলের পোশাক তাঁর উজ্জ্বল ফরসা রঙের সঙ্গে কন্ট্রাস্ট সৃষ্টি করেছে। পোজটা কঠিন, কেননা নিচে সমতল নেই, শুকনো মাটির স্তূপটা অসমান। পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু সাবা সেই স্তূপের ওপর স্মিত হাসিমুখে স্বচ্ছন্দে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু শারীরিক শক্তি নয়, নৈপুণ্যও রয়েছে। আমি সপ্রশংস হয়ে তাকিয়ে দেখি। মাঠে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে থাকা মডেলের ছবির সঙ্গে এই ছবির আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আমি সঙ্গে সঙ্গে টাইপ করে লিখলাম : ওয়ান অফ দা বেস্ট ফটো অফ এ মডেল দ্যাট আই হ্যাভ সিন হিয়ার অ্যান্ড এ্যাব্রড। ভেরি ক্রিয়েটিভ। দি ব্যালান্স অফ দা বডি ইজ এমেজিং। দি নেম অফ দি ফটোগ্রাফার শুড বি মেনশনড। হাফ দি ক্রেডিট গোজ টু হিম। সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। পেলাম কয়েক দিন পর। তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। দেখলাম তাঁর ওয়ালে ভক্তদের কমেন্টের ছড়াছড়ি। কয়েকজনই ‘ওয়াও’ ব্যবহার করেছে। কেউ নাইস বলে প্রশংসা জানিয়েছে। আবার কেউ একটু অশালীনভাবেও প্রশংসা করেছে। বোঝা গেল ভক্তরা তাঁর সৌন্দর্য আর যৌন আবেদনের গুরুত্ব দিচ্ছে। সৌন্দর্য নিয়ে অবশ্যই তারা প্রশংসা করতে পারেন কিন্তু তাঁর সঙ্গে যখন যৌন আবেদনের বিষয়টি জড়িত হয় তখন রুচি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একজন দেখলাম ‘হট’ বলে মন্তব্য করেছে। তাঁর সাবলাইম বিউটি যে যৌনতাকে অবদমিত করেছে সেটা মনে হয় চোখে পড়ছে না অধিকাংশ ভক্তের। সাবা প্রায় প্রত্যেক মন্তব্যের ওপর লিখে অথবা ই-মোজোর প্রতীক দিয়ে উত্তর দিয়েছেন। মনে হচ্ছে তিনি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন এই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সঙ্গে। হালকাভাবে নিচ্ছেন। না নিয়ে উপায় কী? এরাই তো টিকিট কেটে তাঁর সিনেমা দেখতে যায়। আমি তো যাব না সিনেমা হলে, আমার মতো আরও অনেকে যাবেন না। দর্শকদের কথা ভেবে সাবাকে একটা আপস করতে হয়েছে, তাঁর ফিল্ডে সবাই করে। এই হ্যারাসমেন্টটা মেনে নেন তাঁরা বাধ্য হয়ে। নীরবে সহ্য করেন পুরুষের কঠিন আর নির্দয় চাহনি। মেইল গেজ নিয়ে সিনেমার তত্ত্বের আলোচনায় অনেক লেখা হয়েছে। আমি দেখলাম ছবিটির জন্য সাবা লাইক পেয়েছেন ৩ হাজারের ওপর এবং কমেন্ট ১৩০। সংখ্যা দুটি এখনো বাড়ছে। কমেন্ট যারা দিয়েছেন তাদের মধ্যে একজন লিখেছেন : আমি চিত্রপরিচালক। আমার সঙ্গে ইনবক্সে আলাপ করুন। কথা ছিল কাজের জন্য। একজন লিখেছে : ডেড! একজন লিখেছে : লুকিং টু গর্জিয়াস। একজন লিখেছে : গ্রেট মডেল। একজন লিখেছে : কী শুরু করলি? একজন লিখেছে : পাবনার পাগলাগারদে অস্বাভাবিকভাবে রোগী বাড়ার কারণে দুঃখিত। নতুন পাগলদের একটাই প্রলাপ। নাইস কিংবা হট। তারা সবাই সাবার ফ্যান। একজন লিখেছে : সো টেস্টি। একজন পুরোনো গান ব্যবহার করে লিখেছে : তোরে পুতুলের মতো সাজিয়ে/ হৃদয়ের কোটরে রাখব/ আর হৃদয়ের চোখ মেলে তাকিয়ে/ সারাটা জীবন ভরে দেখব/ আমি নেই নেই রে/ যেন গেছি তোরই মাঝে হারিয়ে। একজন লিখেছে : হাসি অপূর্ব, চোখ মায়াবী, ঠোঁট অসাধারণ, গাল গুলুগুলু। একজন লিখেছে : মাই গড! বাংলাদেশ স্টার? আই থট সি ইজ হলিউড স্টার। আমার মন্তব্য পড়ে সাবা কয়েকদিন পর লিখলেন : আই অ্যাম অ্যাবসলিউটলি ডিলাইটেড টু রিসিভ সাচ কমপ্লিøমেন্ট ফ্রম ইউ। আই অ্যাম ওভারহেলম্ড্ অ্যান্ড দিস ইজ ইনডিড এ গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট ফর মি।

মাঠে শুয়ে থাকা ছবিটি পোস্ট করা ছিল ৩১ মার্চে। নতুন ছবিটা পোস্ট করেছেন এপ্রিল ৪ তারিখে। ২৫ মার্চে ফেসবুকে পোস্ট করা সাবার একটা কবিতা চোখে পড়ল। লেখা : ভয় নেই এমন দিন এনে দেব/ তোমার জঙ্গি যত বিমানের ঝাঁক থেকে/ বোমা নয়, গুলি নয়,/ চকলেট রাশি রাশি/ প্যারাট্রুপারের মতো ঝরবে/ শুধু তোমারই উঠোন জুড়ে . . . প্রিয়/ ভয় নেই এমন দিন এনে দেব। আমি এটা পড়ার পর লিখি : মোস্ট মডেস্ট অ্যান্ড ট্যালেনটেড সেলিব্রিটি। সাকসেস হ্যাজ নট গট ইনটু ইয়োর হেড। পোস্টটা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল : ইউ জাস্ট মেড মাই ডে। আই অ্যাম হামবলড বাই ইয়োর কাইন্ড ওয়ার্ডস্। দেখলাম ইংরেজির ওপর সাবার খুব ভালো দখল। চমৎকার স্টাইলে লেখেন। ‘ইউ জাস্ট মেড মাই ডে’ কথাটি অনেকদিন পর শুনলাম। খুব ইডিওম্যটিক। এর পরই আমি ঠিক করলাম আমার কোনো লেখায় সাবাকে আনতে হবে। তিনি উপন্যাসের চরিত্র হওয়ার মতো একজন।

আমি ৫ এপ্রিল সাবাকে ফেসবুকে লিখলাম : আপনার প্রোফাইলে ‘কনসালটেন্ট অ্যাট সাবাজ কনফেশন’ বক্স লেখা দেখে বেশ কৌতূহল জেগেছে। এটা কি ক্যাথলিক পাদ্রিরা যেমন পাপীদের কনফেশন শোনার জন্য চেম্বার ব্যবহার করেন সেরকম কিছু? সঙ্গে সঙ্গে সাবার উত্তর পেলাম : হুমম। অনেকটা সেরকম। একই কনসেপ্ট। ডিটেইলস্ বলতে হবে। অনেক অন্যরকম ব্যাপার আর কি। আমি লিখলাম : খুব ইন্টারেস্টিং। এর সঙ্গে কি আধ্যাত্মিক কিছুর সম্পর্ক আছে? নাকি আটপৌরে বিষয়?

সাবা : না। লোকে আমার সঙ্গে যে-কোনো বিষয় শেয়ার করতে পারে। সব ধরনের মানুষ।

আমি : আপনি তাহলে মেন্টাল থেরাপি করেন?

সাবা : হুমম। ওইরকমই বলতে পারেন। আপনি কোথায় থাকেন?

আমি : এর জন্য কোনো ট্রেনিং নিয়েছেন?

সাবা : না। এটা সোশাল ওয়ার্কের মতো। আমি কোনো চার্জ করি না। সবাই এত ব্যস্ত। কেউ নাই যার সাথে কিছু শেয়ার করা যায়। আমি গাছের মতো, যে যার খুশিমতো কথা বলে যায়। আমি শুনি।

আমি : আপনি ব্যস্ত মানুষ। এই বাড়তি দায়িত্ব নিতে গেলেন কেন?

সাবা : শোনার মানুষের অভাব।

আমি : আপনার সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশংসা করি। সেলিব্রিটি যারা তারা এসব করেন না। সময় নেই তাঁদের। আপনি দেখছি ব্যতিক্রমী।

সাবা : ধন্যবাদ। এটা আসলে কিছু না।

আমি : কোথায় থাকি জানতে চেয়েছিলেন। আমি ধানমন্ডি থাকি। আপনি?

সাবা : ওকে। তারপর লিখলেন : আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আত্মহত্যা করেছিল পাঁচ বছর আগে। আমি ওর কথাগুলো শুনলে করত না। অনেকে আমার সঙ্গে কথা বলার পর ভালো থাকে। এটা কোনো ব্যাপার না। আমি এলিফেন্ট রোডে থাকি।

আমি : আমরা এলিফেন্ট রোডে থাকতাম। আব্বার বাড়ি। এখন ওখানে বড় ভাবি থাকেন। তারপর লিখি : আপনার বন্ধুর আত্মহত্যার জন্য আপনি নিজেকে দায়ী মনে করবেন না। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সবারই নির্দিষ্ট সময় থাকে।

সাবা : হুমম।

আমি : আপনার সময় নিচ্ছি না তো? বলবেন। হয়তো ভদ্রতা করে বলবেন না। আপনি সত্যি ব্যতিক্রমী। পরে কথা হবে।

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এল না। দেখি সাবার নামের নিচে অ্যাকটিভের জায়গায় ওয়ান মিনিট এগো, টু মিনিট এগো, থ্রি মিনিট এগো লেখা হচ্ছে। বুঝলাম সাবা এখন ফেসবুকে নেই। সময় রাত নয়টা আটত্রিশ মিনিট। আমি লিখছি এই সময় মোবাইল পিং করে উঠল। ওপরে এক কোনায় দেখা গেল সাবার ছবি। সময় দশটা পনেরো। সাবা লিখেছেন : অবশ্যই পরে কথা হবে। আমরা তো বলতে গেলে প্রতিবেশী। সাবার সঙ্গে এই সংলাপের পর তাঁকে লিখেছি : আপনার কবিতা, কমেন্ট, কয়েকটা ফটো আমার কোনো লেখায় ব্যবহার করতে চাই। আপনার অনুমতি আছে? সাবা উত্তর দিয়েছেন : এটা আমার জন্য খুবই সম্মানের ব্যাপার। আমি মন্ত্রমুগ্ধ বলতে যা বোঝায় তা-ই। আমি লিখি : আপনি সবচেয়ে বিনয়ী সেলিব্রিটি। সাফল্য আপনার মাথায় ঢুকে স্বভাব বদলে দেয় নি। আপনি যেন এমনই থাকেন সারা জীবন।

সাবা : ইউ জাস্ট মেড মাই ডে।

আমি : আপনি এরচেয়ে কম দাবি করেন না।

 

পনেরো

একটি আন্দোলন ও ফেসবুক

রুম্পা হাওলাদার আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। তার সঙ্গে প্রথম আলাপটা বেশ নাটকীয়। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর টেলিভিশন খুলে সিএনএন খবর দেখছি। হাতের কাছে মোবাইল। সেটা তুলে ফেসবুক খুললাম। দেখি রুম্পা হাওলাদার বলে একটি মেয়ে পোস্ট দিয়েছে : ম্যানের ছবির মতো। পোস্টে তাঁর মুখের একাংশ দেখা যাচ্ছে। পাশে একটা হাতের সব আঙুল মেলে ধরা। এক-একটা আঙুলের নখে এক-এক ধরনের নেইল পলিশ। আমি বেশ কৌতুকবোধ করলাম। লিখলাম : ছবি দেখে পপ আর্ট মনে হচ্ছে। ইমপ্রেশনিজমের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সে উত্তর দিল : ভুল হয়ে গিয়েছে। অন্য কিছু লেখা উচিত ছিল। ঠিক বলেছেন ছবির সঙ্গে কথার মিল নেই। আমি জিজ্ঞাসা করি : তুমি কি আর্টের ছাত্রী, না পাস করা শিল্পী? রুম্পার উত্তর : না। আমি পাবলিক অ্যাডমিনিসট্রেশনে এমএ। আমি : শিল্প সম্বন্ধে জানলে কী করে? রুম্পা : পড়ার সময় আর্ট ইনস্টিটিউটে যেতাম বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে। সেখানে আর্টের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের কাছ থেকেই শিল্প সম্বন্ধে জানা। এ ছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশ, কবিতার দেশ’ বইটা পড়েছি। সেখানে শিল্প সম্বন্ধে অনেক লেখা আছে। আমি : তুমি আমার বন্ধু হলে কী করে? আমি রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি বলে মনে হয় না। রুম্পা বলল : আমি পাঠিয়েছি। আমি আপনার লেখার একজন ভক্ত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম : কোন বই পড়েছ, ‘নভেরা’ না তো? রুম্পা লিখল : না। আপনার ‘জার্নাল, ’৮৯’ পড়েছি। সেখানে নীরদ চৌধুরীর ওপরে আপনার লেখা পড়ে পরে তাঁর বই পড়েছি। আমি লিখলাম : বাহ! তোমার তো দেখি নানা বিষয়ে আগ্রহ। রুম্পা বলে : চেষ্টা করি। আমি লিখলাম : এখন রাত আড়াইটা। তুমি এত রাত জেগে কী করছ? রুম্পা লিখল : বিসিএস পরীক্ষার জন্য পড়ছি। রুম্পার সঙ্গে এই আলাপের পর মাঝে মাঝে কথা হয়েছে। খুব চঞ্চল। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে না। তবু সংক্ষিপ্ত আলাপেই তার এবং তার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। একদিন সন্ধ্যায় আলাপের জন্য ফেসবুকে তার টাইমলাইনে গিয়েছি। দেখি সে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করছে। লিখেছে : আমার ভাই মরে গেল। আমার কান্না পাচ্ছে। তার বন্ধু লিখছে : না না মারা যায় নি। এইমাত্র তার কথা শোনা গিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখন কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হচ্ছে। এরপর ফেসবুক থেকে ওরা হঠাৎ ডিসএ্যাপিয়ার করে গেল। আমি টেলিভিশন চ্যানেল খুলে দেখলাম ছাত্র আন্দোলনকারী আর পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ছবি দেখাচ্ছে। আমি আবার ফেসবুকের দিকে তাকালাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাথায় হেলমেট বুকের কাছে প্লাস্টিকের বর্ম আর হাতে লাঠি হাতে পুলিশের দল এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা দেখে মনে হলো শাহাবাগ। পুলিশের সামনে অদূরে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে নির্ভিক ভঙ্গিতে। তার পেছনে আগুন জ্বলছে। আশপাশে কোনো ছাত্র নেই। বেজিংয়ে ১৯৮৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে ছাত্র আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করার সময় ট্যাংকের সামনে ঝোলা হাতে দাঁড়ানো যুবকটির ছবি চোখে ভেসে উঠল। মনিকা ফেরদৌস পোস্ট দিয়েছেন : তুমি কে জানি না। তোমাকে স্যালুট। নিচে গোলাপ ফুলের স্টিকার। একজন মন্তব্য করেছে : কোটা সংস্কার নিয়ে করা আন্দোলন আবার প্রমাণ করল, এ দেশের ছাত্রসমাজ স্বার্থপর। নিজ স্বার্থ ছাড়া ওরা কখনো জাতীয় স্বার্থে পথে নামে না। এর উত্তরে একজন মন্তব্য করেছে : অজ্ঞ কথা। একজন মন্তব্য করেছে : এভাবে না বললেও চলে। মধ্যবিত্তের সন্তান নিজ শ্রেণিস্বার্থের বাইরে আর কতটুকুই বা যেতে পারে? একজন লিখেছে : আমরা যৌক্তিক আন্দোলন করছি। একে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা বেদনাদায়ক। ছাত্রলীগ নিশ্চয়ই তাদের ছাত্রত্বের কথা ভুলে গিয়ে সরকারের সঙ্গে হাততালি দিচ্ছে। চাটুগিরি করছে। আশ্চর্য! এই ছাত্রলীগের অধিকার রক্ষায় সোনালি ইতিহাস রয়েছে। আমি জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছি। আশা করি চূড়ান্ত বিজয় সাধারণ ছাত্রদের হাতের নাগালে। কোটা প্রথার সংস্কার হবে। মেধাবীরা সুযোগ পাবে। একজন লিখেছে : কোটা সংস্কার কি জাতীয় স্বার্থ না? একজন : নাহ। চাকরিপ্রার্থীর স্বার্থ। একজন : ভাই, ছাত্ররা ছাড়া কিন্তু কোনো আন্দোলন হয় নি। একজন : না হলে না হইসে। আন্দোলন বুঝার মতো বয়স হয় না বলেই ছাত্রদের পথে নামানো সহজ। মানে গিনিপিগ বলতে পারেন। আপনার কথা অনুযায়ী ছাত্র ছাড়া যদি কোনো আন্দোলন না হয় তবে সেসবের ফসল দিনশেষে ঘরে তুলেছিল কে বা কারা? ভালো করে ভাবুন। নিজেই বুঝবেন। একজন : স্বার্থ ছাড়া কোন কাজটি করেন? একজন : কেউ কোনোদিন শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য রাস্তায় নামে নি। নকল বন্ধের জন্যও না। গুম খুনের জন্যও না। প্রকাশ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধেও না। এখন চাকরির ধান্দায় নামছে পথে। অবশ্য এটা ঠিক আছে। এত সময় নষ্ট করে এই কাগজের সার্টিফিকেট নিতে আসছে সেটা তো এই চাকরির জন্য। একজন (মেয়ে মনে হলো) : আমি ছাগী তাতে তোমার কী সমস্যা বুঝাইয়া বলো সবাইকে। উত্তর : তুমি ছাগী হলে আমার কোনো সমস্যা নাই। একজন : যারা এই যৌক্তিক আন্দোলনকে স্বার্থপর বলছে তাদেরকে ছাগল কী ছাগী বলতে চাও? উত্তর : যেটা তোমার কাছে যৌক্তিক, সবার কাছে তা মনে হবে কেন? সেটা বুঝায়া কও। আমার কাছে কোনো যৌক্তিক লাগে নাই। তাই আমি বলছি। সেটা বুঝতে পার নাই বলে তোমারে ছাগী বলছি। একজন : হা হা হা। হাসাইলেন ভাই...। এটা দেশের স্বার্থ। আমার এক ভাই এই আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে বিদেশে চলে যাবেন চাকরি করতে। তার বেলায় কী বলবেন? একজন : স্বার্থপর কী করে হলো? একজন : শিক্ষা সংস্কার, নকল বন্ধু, ধান্দাবাজি, সন্ত্রাস এইসব জন্ম হয় কেন জানেন তো? আজ রাজনীতি পরিকল্পনাকারীরাই যখন মেধাহীন, এ ছাড়া তারা কোন সমাজ সংস্কৃতির জন্ম দেবে? মেধাবীরা সবখানে সংখ্যালঘু। আপনি তো নিজেও একজন মেধাবী। কতজন আপনাকে দাম দিয়ে চলে সমাজে? মেধাবীরা হিপোক্রেট হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে, তারা পয়সা খেতে পারে, আবার না-ও খেতে পারে। তবু তো দেশ চলবে মেধাবীদের হাতে। দেশের মূল উন্নয়নের জন্য কি মেধাবীদের প্রয়োজন নেই? একজন : যার চাকরি হয় এমনিতেই হয়। কোটা-ফোটা লাগে না। নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতে এখন সংস্কার করো, বাতিল করো, যতসব ফালতু কর্মকা- করে বেড়াচ্ছে। তার উত্তরে একজন : আপনার মাথার ঘিলু চৈত্রের রোদ্দুরে সব শুকাইছে, তাই এই হাস্যকর যুক্তিহীন মন্তব্য। উত্তর : আমি কখনো কোটা কী জিনিস, কোত্থেকে এল, কারা পেল, আপনার মতো হিসাব করতে বসি নি। তাই মগজ পুরোপুরি সক্রিয়। রাজিন : রাতে শাহবাগ টানছিল আমাকে। এখনো যেতে ইচ্ছে করছে। শরীর অসুস্থ তাই টিভি এবং মোবাইলে শাহবাগী হয়ে আছি। কোটা সংস্কার হওয়া দরকার মনে করি। সবাইকে বাঁচতে হবে। কোটা ব্যবসা বন্ধ হোক। একজন : চেতনার ফসল এই আন্দোলন। আমি লিখি : সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুতেই সংস্কারের প্রয়োজন হয়। কোটা পদ্ধতি এর ব্যতিক্রম এমন মনে করার কারণ নেই। কঠোর না হয়ে কর্তৃপক্ষকে নমনীয় হতে হবে। একজন : মুক্তিযোদ্ধারা কি কোটা চেয়েছিলেন, নাকি তাদের সন্তানেরা? কোন দিন, কোন মুক্তিযোদ্ধা কোটা চেয়েছে কোন সরকারের কাছে? কানাডা থেকে কবি ইকবাল হাসান লিখেছেন : সংস্কার নয়, কোটা প্রথা বাতিল করা উচিত। একজন : কোটা উঠিয়ে দিন। এই ধরনের সিস্টেম থাকলে লেখাপড়া করে কী লাভ? গুলিবিদ্ধ ছাত্রের পেট আর পিঠ দেখিয়ে একজন : আন্দোলন, ফান্দোলন, কোটা, সোটা, কিছুই জানি না। শুধু এই ছবিগুলো কষ্ট দেয়। এরা কারও সন্তান, কারও ভাই। আলতাফ শাহনেওয়াজ : এটি যৌক্তিক দাবি। পুলিশ হামলা চালিয়ে এ আন্দোলন দমানো যাবে না। এ দাবি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। কিন্ত সরকার তা না করে শিক্ষার্থীদের ওপর একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। আমরা আর রক্তপাত চাই না। রিমঝিম আহমেদ : মুক্তিযোদ্ধা কোটার দিন শেষ হোক। মুক্তিযোদ্ধারা, তাদের ছেলেমেয়েরা কোটার সুবিধা পেয়েছে, এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু নাতি-পুতি পর্যন্ত! আবু হাসান শাহরিয়ার : কোটাও বিশ্বাসঘাতকতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অংশগ্রহণ কোটামুক্ত ছিল বলেই মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। একজন : এখন বাতিল না করে সংস্কারই করা উচিত।

ছবিতে ধোঁয়ার পটভুমিতে এক যুবককে রাজপথে (শাহবাগে?) একাকী পতাকা উঁচু করে তুলে ধরার ছবি দেখানোর পর একজনের মন্তব্য : ধোঁয়াটে হয়ে গিয়েছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। আফসান চৌধুরী : ঢাকা, চিটাগাং, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ...কম বেশি এখানেও ঝামেলা হচ্ছে। একদিকে ছাত্রলীগ, অন্যদিকে কারা? ছাত্রদল, বাম? একজন : আপনি ছাত্রলীগকে কোথায় পেলেন এই আন্দোলনে? আফসান চৌধুরী : মিডিয়া। একজন : গতকাল কোটা সংস্কার বিষয়ে ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দেওয়ার পর থেকে ‘আমার পেস্টগুলো ডিলিট করা উচিত, এ বিষয়ে আমার মাথাব্যথা কেন? জেনে বুঝে পোস্ট দেওয়া উচিত’ যারা এ ধরনের বাক্য ইনবক্সে পাঠিয়ে চরম দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাদের অবগতির জন্য বলছি এত বড় শুভাকাক্সক্ষীর আমার আপাতত প্রয়োজন নেই। একজন : এত করে বললাম, ছেলেমেয়েরা তোমরা লেখাপড়া কোরো না। তোমরা নেতা-নেত্রীর কথা মেনে চলো তাতে বহুত ফায়দা আছে। কোটা-ফোটা লাগবে না লাইফে। সেই কথা তো শুনলে না। এখন বোঝো। একজন : অতি উত্তম প্রস্তাব। সোহানুর রহিম শাওন : প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা স্বার্থের টানে মুক্তিযুদ্ধ করেন নি। আজকের বাংলাদেশ দেখলে তাঁরা লজ্জিত হতেন। শাহীন হোসেন শিপু : ছাত্রলীগের গু-াদের দিয়ে সমাধানের পরিকল্পনাকারীরা কখনোই সরকারের বন্ধু নয়। সাধু সাবধান। একজন : ওরা মেধা চায় না, গেদা চায়। একজন : টিকে থাকতে সরকার/গেদাদেরই তো দরকার/মেধা তো আর মানে না পোষ/ নিজের ঘরেও খোঁজে দোষ।

আমি হঠাৎ করেই কোটা আন্দোলন যে বিস্ফোরণের আকার ধারণ করেছে তা জানতে পারি, কেননা সেই সন্ধ্যায় যখন পুলিশ অ্যাকশনে গিয়েছে আমি যথারীতি টেলিভিশনে লোকাল নিউজ দেখি নি। রুম্পার ফেসবুক ওয়ালে, আমার ভাই মরে গিয়েছে এবং তারপর তার বন্ধুর লেখা : না না, মরে নি। ভুল খবর। এটা দেখার পর আমি রুম্পাকে জিজ্ঞেস করেছি : তোমার কি ভাই? সে উত্তর দেয় নি। আমি টেলিভিশন খুলে দেখি আগুন জ্বলছে শাহবাগে ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ মিছিল ও পুলিশের ধাওয়ার দৃশ্য। কোটা নিয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। কিন্তু এটা যে আন্দোলনের আকার নিয়ে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। রুম্পার পোস্ট দেখে টেলিভিশন চ্যানেল না খুললে সেই রাতে হয়তো খবরটা আমি জানতেই পারতাম না। খবর পেতাম পরদিন খবরের কাগজ পড়ে। টেলিভিশনে দেখার পর আমি ফেসবুকে যেসব মন্তব্য দেখতে পাই তার মধ্যে কিছু ওপরে উদ্ধৃতি দিয়েছি। কয়েকজনের নাম উল্লেখ ছাড়া অন্যদের বেলায় ‘একজন’ ব্যবহার করেছি। লেখা থেকে দেখতে পেয়েছি যে প্রথম দিকে আন্দোলনের পক্ষে যেমন মন্তব্য এসেছে বিপক্ষেও বেশ কিছু। এর পর ফেসবুকে দেশ এবং বিদেশ থেকে যেসব মন্তব্য এসেছে তার বেশির ভাগই আন্দোলনকে সমর্থন করে। সমর্থনকারীদের মধ্যে আফরোজা পারভিনের মন্তব্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। সরকারে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। খুব নিরপেক্ষ হয়ে তিনি লিখেছেন : মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, তাতে কোনো দ্বিমত নেই। তাদের জন্য, তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য কোটা চালু আছে। সেই কোটা সংস্কারের দাবি উঠেছে। দাবিকারী ছাত্ররা জমায়েত করেছে। তার জন্য তাদের মারধর করতে হবে? ওদিন তো ওদের কেউ মারা যেতে পারত। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সন্তান। এদেশের সন্তান। ওরাও তো আমাদের সন্তান। এদেশের সন্তান। আর সংসদ কাঁপিয়ে উচ্চারিত হলো : রাজাকারের বাচ্চা নাকি? আফরোজা প্রশ্ন করেছেন : বাপ তুলে কথা বলার অধিকার কার আছে? জংলিরাও বোধহয় প্রকাশ্যে এমন বলে না। বললেন এমন একজন যিনি একসময় অনেকের আদর্শ ছিলেন। আজ নিশ্চয়ই তারা লজ্জা পাচ্ছে। ওই যে বলে না, যার দুর্বলতা বেশি তার আস্ফালন বেশি। একজনের মন্তব্য : শুনেই যে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। এ আমাদের কী হলো! একজন : ওনাদের মতো কা-জ্ঞানহীন নেতানেত্রীদের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়, যার কারণে দেশটার আজ বেহাল দশা। আমি আফরোজাকে লিখলাম : সুন্দর করে তোমার অনুভূতি প্রকাশ করেছ। একজনের মন্তব্য : এখনো দু-একটা প্রদীপ জ্বলে।

সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর ঘোষণায় জানা গেল এক মাসের মধ্যে সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। এর পর আন্দোলন বেশ স্তিমিত হয়ে এল, যদিও আন্দোলনকারীদের একাংশ খুব সন্তুষ্ট হলো না এই ঘোষণায়। তারা ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হয়ে বক্তৃতা আর স্লোগান দিল। এর পর প্রধানমন্ত্রী বললেন, কোটাপ্রথা বাতিল করা হবে। শুনে আন্দোলনকারীরা মনে হয় থতমত খেয়ে গেল। যেন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। প্রথম ঘোষণার পর ফেসবুকে লেখালেখি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ফেসবুকে লেখালেখি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। ১৮ এপ্রিল ৩ জন ছাত্রনেতাকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ছেড়ে দেওয়া সম্বন্ধে যে খবর এবং পুলিশ কর্তৃক তার ভিন্ন বক্তব্য তা নিয়েও ফেসবুকে কোনো লেখালেখি হলো না। ফেসবুক তার প্রথামাফিক ইস্যুটাকে কেবল ঠান্ডা ঘরে রেখে দেয় নি, পাঠিয়ে দিয়েছে অন্তরালে। পরিবেশ উত্তেজিত করে রাখা ইস্যুটি এখন ফেসবুকে পরিত্যক্ত। যদি না আবার বিস্ফোরণ ঘটে ফেসবুকে কোটা সংস্কার ইস্যুর পুনরাবির্ভাব হবে না। ফেসবুকে পুরোনো ইস্যু নিয়ে কোনো চর্চা হয় না, তার পরিণতি নিয়ে কোনো কৌতূহলও প্রকাশ করে না কেউ।

২০ এপ্রিল বক্সের ভেতরে ছোট খবর : মধ্যরাতে ঢাবি হল থেকে ২০ ছাত্রীকে হল ত্যাগে বাধ্য করল প্রশাসন (নিউজ লিংক কমেন্টবক্সে)। এর পর একজনের মন্তব্য : খুবই হতাশাজনক সরকারের এমন দুইমুখী ভূমিকা। এর আরও কিছু পর ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখা গেল : রাতের আঁধারে ছাত্র তাড়িয়ে ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করতে চাচ্ছে প্রশাসন (নুরুল হক)। কোটা সংস্কার ইস্যু মনে হয় পুরোপুরি তিরোহিত হয় নি। তার ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এমন হলে তা হবে ফেসবুকের জন্য অভূতপূর্ব ঘটনা।

 

ষোল

এক জ্যোতিষ্কের তিরোধান

স্টিফেন হকিংই একমাত্র উঁচুমানের বৈজ্ঞানিক যার নাম ও খ্যাতি পৃথিবীর সর্বত্র শিক্ষিতদের ঘরে ঘরে পরিচিত। তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বকে এমন সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে স্কুলের ছাত্র এবং অল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষের পক্ষেও সেসব বোঝা সম্ভব। তাঁর লেখা প্রথম পপুলার সাইন্স শ্রেণির বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ তাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় হওয়ার খ্যাতি অর্জন করেছে। এর পর তিনি লিখেছেন আরও কয়েকটি বই একই সহজ-সরল ভঙ্গিতে যেন সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হয়। পাশাপাশি সহকর্মীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি তাত্ত্বিক ভাষায়ও জটিল সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। সকলেই স্বীকার করেছেন যে তিনি সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্যতা ছিল কিন্তু পান নি, কেননা ব্ল্যাকহোল আর তার অনুসঙ্গে একাধিক মহাবিশ্বের যে তত্ত্ব তিনি উপস্থাপন করেছেন তা প্রমাণ করার সময় পান নি। মৃত্যুর পর এই তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু মৃত ব্যক্তিকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় না। নোবেল প্রাইজ না পেলেও অনেক নোবেল বিজয়ীর তুলনায় তাঁর খ্যাতি এবং সম্মান যে বেশি তা জোর দিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছে ওয়েস্টমিনিস্টার এ্যাবেতে যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।

স্টিফেন হকিংয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ২০ বছর বয়সে মোটর নিউরন নামে এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবনের অধিকাংশ কাল, প্রায় পঞ্চাশ বছর, তিনি হুইল চেয়ারে বসে কম্পিউটারের সাহায্যে কথা বলে শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে পরাজিত করেছেন। শুধু একজন স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের মানুষের মতোন জীবনযাপন নয় বর্ণাঢ্য কর্মজীবনও তাঁর ছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর মস্তিষ্ক ছিল সক্রিয়। হকিংয়ের প্রথম আবিষ্কার হলো মহাবিশ্বের তারকাগুলি যখন তাদের শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং তারপর পতন ঘটে মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তখন বিস্ফোরিত অংশগুলো নিয়ে তৈরি হয় ব্ল্যাকহোল যা আশপাশের সব বস্তুকে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে। স্টিফেন হকিং গবেষণা করে আবিষ্কার করেন যে বড় বড় নক্ষত্রের সৃষ্ট ব্ল্যাকহোল ছাড়াও ছোট আকারের অনেক ব্ল্যাকহোল রয়েছে। এর পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল মহাবিশ্বের যে এনার্জি তার মাত্র শতকরা চার ভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে সাতাত্তর ভাগ মহাবিশ্বে বিস্তৃত ডার্ক এনার্জি দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু পরিচিত ব্ল্যাকহোলের ম্যাস দিয়ে বাকি ম্যাটারের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। এর উৎস তাহলে কী? এর উত্তরে স্টিফেন হকিং বলেছেন, যেসব ছোট ছোট ব্ল্যাকহোল রয়েছে তাদের ম্যাস ছোট হলেও সংখ্যা এত বেশি যে তার দ্বারাই বাকি ২৩ ভাগ ডার্ক ম্যাটারের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এইসব ক্ষুদ্রাকার ব্ল্যাকহোল বিগ ব্যাংয়ের সময় সৃষ্টি হয়েছিল আর বড় ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি হয়েছে অনেক পরে, নক্ষত্রের শক্তি ক্ষয় হওয়ার পর। কিন্তু হকিংয়ের মিনি ব্ল্যাকহোল আবিষ্কৃত হয় নি, হাইপোথিসিসের আকারেই রয়ে গিয়েছে। তিনি এ সম্পর্কে রসিকতা করে বলেছেন, আবিষ্কৃত হলে আমি নোবেল পেতাম। তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী বড় নক্ষত্রগুলোর ভেতরের এনার্জি শেষ হয়ে গেলে সেসব কলাপ্স করে একটি বিন্দুতে পরিণত হয়, যার নাম দিয়েছেন তিনি সিঙ্গুলারিটি। এই ব্যাখ্যায় বিদ্যমান পদার্থবিদ্যা কাজে লাগে না। হকিং বলেছেন যে সিঙ্গুলারিটির পয়েন্ট থেকে এক মহাবিশ্ব থেকে অন্য মহাবিশ্বে যাওয়া যেতে পারে এবং তা ব্ল্যাকহোলের মধ্য দিয়েই। এই তত্ত্ব তিনি প্রমাণ করে যেতে পারেন নি, হাইপোথিসিসের আকারেই রয়ে গিয়েছে। টাইম ট্রাভেলের ধারণা তাঁর এই অনুমান থেকে সৃষ্টি হয়েছে। কসমোলজিতে তাঁর অবদান হলো একাধিক মহাবিশ্বের উল্লেখ এবং তাদের মধ্যে টাইম ট্রাভেলের সাহায্যে ব্ল্যাকহোলের ভেতর দিয়ে যাতায়াতের সম্ভাবনা। ব্ল্যাকহোলগুলি থেকে যে এনার্জি রেডিয়েশন নির্গত হয় তা শেষ হয়ে গেলে সেগুলো যে বিস্ফোরিত হয়ে খ-াংশে ছিটিয়ে পড়বে এ কথাও তিনি বলেছেন। ব্ল্যাকহোলগুলো শুকিয়ে হারিয়ে যায় বলে তাঁর ধারণা ছিল। অবশ্য ব্ল্যাকহোলের ইভাপোরেশনের জন্য সময়ের প্রয়োজন হবে অনেক, মহাবিশ্ব সৃষ্টির বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন বছরেরও বেশি। ব্ল্যাকহোলের র‌্যাডিয়েশন তত্ত্ব হকিং র‌্যাডিয়েশন নামে পরিচিত।

‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ বইতে তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে স্পেস ও টাইম কোথা থেকে এল তা বলা হয়েছে এবং এর ভবিষ্যৎ কী এই জটিল কথা তিনি সহজে ব্যাখ্যা করেছেন। এর পরের বই ‘দি গ্র্যান্ড ডিজাইনে’ হকিং তাঁর প্রিয় বিষয় ‘থিওরি অফ এভরিথিং’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই থিওরি আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি এবং পরবর্তীকালের পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম থিওরির মিশ্রণ করতে বা একত্রীকরণে সম্ভব বলে তিনি মনে করেছেন। এটা আবিষ্কৃত হলে বিগ ব্যাংয়ের প্রথম মুহূর্তের স্পেস-টাইমের পরিস্থিতি জানা যাবে।

আমি স্টিফেন হকিংকে দেখি কেমব্রিজে ১৯৭৯ সালে শীতকালের এক সকালে। তিনি হুইলচেয়ারে বসে কিংস কলেজের উল্টোদিকে ফুটপাতে রোদে বসে বই পড়ছিলেন। আমার অধ্যাপক তাঁকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ইনি একদিন নোবেল প্রাইজ পাবেন। আমি একটু অবাক হয়ে বিকলাঙ্গ এবং জবুথবু হয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস হয় নি যে শারীরিক প্রতিবন্ধী অমন একজন ব্যক্তির মধ্যে বিশাল এক প্রতিভা রয়েছে। আমি ফেসবুকে তাঁর মৃত্যুর পর আমার সংগ্রহে রাখা বইগুলোর ছবি পোস্ট করে মন্তব্য করি যে তাঁর মৃত্যুতে এক মহা জ্যোতিষ্কের তিরোধান হলো। আমার পোস্টের পর কয়েকটি কমেন্ট এল তাঁর সম্পর্কে। গুরুত্ব অনুযায়ী যত বেশি আসা উচিত ছিল তেমন হলো না। এতে বোঝা গেল উচ্চমার্গের বিজ্ঞান নিয়ে ফেসবুকের সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে খুব বেশি আগ্রহ নেই। তবু তাঁর মৃত্যু যে কয়েকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তারা মন্তব্য দিলেন এর ফলে ফেসবুকের মান কিছুটা রক্ষা পেল।

 

সতেরো

সোহানা সাবা

ফেসবুকে সোহানা সাবার শেষ ছবিটার ওপর বেশ কিছু খোলাখুলি মন্তব্য করলাম। বললাম পোজটা ভালো হয় নি। পা দুটোর তুলনায় হাঁটুর ওপরের অংশ বেমানান দেখাচ্ছে। ফটোগ্রাফারের উচিত ছিল আরও একটু মনোযোগ দিয়ে পরিকল্পনা করা। আসলে ছবিটা আমার কাছে আগেরটার তুলনায় বেশ সস্তা মনে হয়েছে, কিছুটা যেন রুচিহীন। আমি দোষটা ফটোগ্রাফার রাজিনের ওপরই চাপিয়ে দিলাম। রাজিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল : আপনার কথা এর পর মাথায় রাখব। এর পর লিখল, আপনার মতো বড় মাপের মানুষের কথার মর্মার্থ বোঝা আমার সাধ্যে নেই। দোয়া করবেন। রাজিনের সঙ্গে ফেসবুকে এই আমার প্রথম আলাপ। আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা না করে সে যে আমার বক্তব্য মেনে নিল এর মধ্যে তার বিনয় এবং ভদ্রতার প্রকাশ দেখতে পেলাম। সোহানা সাবা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না, কিছু লিখলেন না। পরদিন সকালে আমার ‘গুড মনিং’-এর উত্তরে তার কাছ থেকে ‘গুড মর্নিং’ পেলাম না। এতে করে মনে হলো তিনি বুঝি অসন্তুষ্ট হয়েছেন আমার মন্তব্য পড়ে। বেশ একটু অস্থির বোধ করলাম। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখি আমার মোবাইল এয়ারপ্লেন মোডে অর্থাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি কোনো কিছু পোস্ট করতে পাচ্ছি না। দুপুরে ছেলের বউ স্যাবরিনা এল। তাঁকে মোবাইল দেখিয়ে সমস্যার কথা বললাম। সে পাশে প্রেস করে এয়ারপ্লেন মোড ঠিক করে দিল। আমি সাবাকে মেসেজ বক্সে মেসেজ পাঠালাম : মনে হচ্ছে আমি অনধিকার চর্চা করছি। দুঃখিত। মেসেজ পাঠাবার পর আমি খেতে বসেছি, স্যাবরিনা পাশে বসে। নাতি দৌড়াদৌড়ি করছে। হঠাৎ দেখি মোবাইলে সাবার ছবি ফুটে উঠেছে। তার মানে সে মেসেজ পাঠাচ্ছে। তাড়াতাড়ি এঁটো হাতেই মেসেজ বক্স খুললাম। দেখলাম তিনি লিখেছেন : একেবারেই না। কেমন আছেন? দেখলাম এর পরেই তিনি অ্যাকটিভ থেকে তিন মিনিট দূরে চলে গিয়েছেন। লিখলাম : ভালো। আপনি? ওপাশ থেকে উত্তর নেই। অ্যাকটিভ থেকে তিনি চার মিনিট দূরে। আমি লিখলাম : সত্যি বলছেন রাগ করেন নি? এবার উত্তর দিলেন : কেন রাগ করব? আমি বললাম : অনধিকার চর্চার জন্য। তিনি লিখলেন : বলেছি তো, একেবারেই না। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম : কালো পোশাকে এর আগে তোলা আপনার ছবিটা আমার ফেসবুক থেকে মুছে গিয়েছে মনে হয়। পাঠানো যায়? তিনি লিখলেন : লিংক দেখুন। দেখলাম লিংকে অনেক ছবি পাঠিয়েছেন। কিন্তু কালো পোশাকপরা ছবিটা নেই। আমি লিখলাম কালো পোশাকের ছবিটা পাচ্ছি না। তিনি লিখলেন : এগুলোই বেস্ট। আমি লিখলাম : আমার কাছে কালো পোশাকের ছবিটা বেশি ভাল মনে হয়েছে। তিনি লিখলেন : হুমম। আমি লিখলাম : খুব কঠিন পোজ। তিনি লিখলেন : আমি পোজ মাস্টার। সেই জন্য ফটোগ্রাফাররা পাগল থাকে আমার ছবি তোলার জন্য। আমি লিখলাম : কীভাবে পারলেন ওইভাবে ব্যালান্স রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে? তিনি লিখলেন : আমি ব্যাসিকালি ক্লাসিকাল ড্যান্সার। সেই জন্য পারি। আমি লিখলাম : তাই বলেন। কালো পোশাকের ছবিটা পাঠান। ওটা আমার লেখায় ব্যবহার করব। অপেক্ষা করলাম, দেখলাম মোবাইল বলছে, এক মিনিট আগে অ্যাকটিভ...দুমিনিট আগে অ্যাকটিভ...তিন মিনিট আগে অ্যাকটিভ...এভাবে দূরত্বটা বাড়তে থাকল। বুঝলাম তিনি চলে গিয়েছেন। কত অ্যাপয়েনমেন্ট, কত কাজ! এটুকু যে সময় দিলেন তা-ই বা কম কী? মোবাইল ঘোরাতেই দেখি বিনোদন পত্রিকায় ৮ এপ্রিল সংখ্যায় তাঁর ইন্টারভিউ বেরিয়েছে। তার কপি পাঠিয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে আমার যেসব জানার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম তার অনেকগুলোর উত্তর এই ইন্টারভিউতে রয়েছে। বুঝলাম তিনি সময় বাঁচানোর জন্য এইভাবে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন। ইন্টারভিউটা পড়লাম একটানা। তার সম্বন্ধে এতদিনে যে ধারণা হয়েছিল সত্যিই তাই। বয়স কম হলেও বেশ কনফিডেন্ট এবং সপ্রতিভ। আধুনিকমনস্কও বটে। ইন্টারভিউতে বলা কথাগুলো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। একটা স্মার্ট পারসোনালিটির পরিচয় বহন করে। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম : কোনটা বেশি পছন্দ? অভিনয় না মডেলিং? তিনি উত্তর দিয়েছেন : আমি শুধু অ্যাকটিং করি, মডেলিং না। আমার প্রশ্ন : তাহলে ফেসবুকের ছবিগুলো? সাবার উত্তর : ওগুলো পত্রিকার জন্য। অ্যাকটরদের করতে হয়। নিউজের সঙ্গে ছবি যায়। আমি প্রশ্ন করি : ডেইলি নিউজ পেপারে? সাবা উত্তর দেন : হুমম। এর পর আমার কমেন্ট ছিল : আপনার কালো পোশাকের ছবিটা আমার কাছে বেস্ট। বলেছি তো ওটা আমার ফেসবুক থেকে মুছে গিয়েছে। লিখলাম : কালো পোশাকের ছবিটা পাঠাবেন? ওটা আমার লেখায় ব্যবহার করতে চাই। কিন্তু সাবা অন্য অনেক ছবি পাঠালেও কালো পোশাকের ছবিটা পাঠাতে পারলেন না। মনে হলো ব্যস্ততার জন্য খুঁজে পেলেন না। তাঁকে বারবার একই কথা বলতে বিব্রত বোধ করলাম। যা পেয়েছি তার মধ্যে একটা কী দুটো ব্যবহার করা যাবে। ইন্টারভিউ পড়ে দেখলাম আগামী ঈদের জন্য নাটক নিয়ে ব্যস্ত। সিনেমার শুটিংও চলছে। খুব ব্যস্ত থাকছেন যা এই সময়ে অন্যান্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।

ইন্টারভিউ পড়ে দেখলাম তিনি অল্প বয়সে বিয়ে করেছিলেন সিনেমা জগতের এক ব্যক্তিত্বকে। সেটা টেকে নি মনে হচ্ছে। তিনি বলেছেন, সিঙ্গেল লাইফ এনজয় করেছি। ম্যারিড লাইফ এনজয় করেছি। এখন ম্যারিড সিঙ্গেল লাইফ এনজয় করছি। তার মানে ডিভোর্স হয় নি, সেপারেশন চলছে। একমাত্র ছেলে নিয়ে বাবা-মার সঙ্গে থাকেন। ছেলের নাম শুদ্ধ স্বরবর্ণ। পড়েই কৌতূহল জাগে : নামটা কে রেখেছেন? তিনি না তাঁর স্বামী? অথবা নানা-নানিদের মধ্যে একজন। এমন আধুনিক আর নির্ভেজাল বাংলা নাম আমি এর আগে শুনি নি। নামকরণ থেকে তাঁর রুচি এবং মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন, তাঁর ছেলে নিজের খুশিমতো ক্যারিয়ার বেছে নেবে। যদি অভিনয় করতে চায়, করবে। যদি গায়ক হতে চায়, হবে। তার ওপর কিছু চাপাবেন না তিনি। বলেছেন, নিজের ছবির ভিডিও দেখাবেন না ছেলেকে যেন সে কোনো চাপের মধ্যে না থাকে। তার ছেলে বেড়ে উঠুক আর পাঁচজন ছেলের মতো, এই তিনি চান। সে সেলিব্রিটির ছেলে এটা যেন তার মাথায় না ঢোকে। মুগ্ধ হওয়ার মতো কথা। খুব চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর সম্বন্ধে আমার ধারণা উঁচু হয়। ইন্টারভিউতে বলেছেন, ব্যস্ততার জন্য ছেলেকে তেমন সময় দিতে পারেন না। কিন্তু কীভাবে সে বড় হবে, মানুষ হবে সে সম্বন্ধে তাঁর ধারণা খুব স্পষ্ট। বলেছেন, নানা-নানির স্নেহ পাচ্ছে। সুতরাং ছেলেকে একা থাকতে হয় না। মায়ের অনুপস্থিতি অতটা বোঝে না। কাজশেষে বাড়ি ফিরে যতটা পারেন ছেলেকে সময় দেন। বাবা কি দেখতে আসে? এ প্রশ্ন করেন নি যে ইন্টারভিউ নিয়েছেন তিনি। আমিও করব না। স্পর্শকাতর বিষয় এবং অপ্রয়োজনীয়ও বটে। কেন বিয়েটার এমন পরিণতি হলো তা-ও জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। ফিল্ম ক্যারিয়ারের জন্যই হয়েছে এমন মনে করারও কারণ নেই। অনেকের জীবনে এমন ট্র্যাজেডি ঘটছে। অভিনয়কে, মেয়েদের ব্যস্ত কর্মজীবনকে এর জন্য অনেকে দায়ী করে থাকেন যা অনুচিত। ইন্টারভিউ পড়ে দেখলাম শুধু ঢাকায় না, কলকাতাতেও অভিনয় করেছেন, ‘ষড়রিপু’ নামে এক সিনেমায়। সেখানে তারকা হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে বলে লিখেছে বিনোদন পত্রিকা। এর মধ্যে ঢাকায় বেশ কয়েকটা সিনেমায় অভিনয় করেছেন, নাটকেও করেছেন। আমি এসবের কিছুই দেখি নি। ঢাকার সিনেমা সম্বন্ধে আমার ধারণা খুব উঁচু না এ কথা আগেই বলেছি। টেলিভিশন নাটকের ক্ষেত্রেও না। সেই জন্য তাঁর সম্বন্ধে আমার জানা হয় নি। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের ছবি দেখেছি কাগজে সমালোচনা পড়ে। তার মধ্যে সাবা অভিনীত কোনো বই ছিল না। তাঁকে ফেসবুকে লিখলাম, আপনার অভিনীত সিনেমা, নাটক কবে কোথায় দেখা যাবে? তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউবে কয়েকটা ছবি এবং নাটক পাঠালেন। আমি এর মধ্যে ‘বৃহন্নলা’ নামে সিনেমাটি মোবাইলেই দেখলাম। কাহিনি বেশ বাস্তবসম্মত। ফটোগ্রাফি পরিষ্কার। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় প্রায় ত্রুটিহীন। হিন্দু পরিবারের গৃহবধূর ভূমিকায় সাবার অভিনয় অনবদ্য। আমি ফেসবুকে কমেন্ট পাঠালাম এইসব উল্লেখ করে। তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম এই বলে যে, তিনি আমাকে আবার বাংলাদেশি সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করলেন।

সাবার সঙ্গে প্রথম চ্যাটিংয়ের সময় বলেছিলাম, তাঁর সোশ্যাল ওয়ার্কের কথা। ‘সাবাজ কনফেশন বক্স’ ব্যাপারটা কী জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন ওটা তার সোশ্যাল ওয়ার্ক। সেখানে যে-কোনো মানুষ তাঁর মনের কথা তাঁকে বলতে পারে। তিনি গাছের মতো। কেবল শুনে যান। যারা আসে কথা বলে ভারমুক্ত হয়ে খুশি মনে ফিরে যায়। ভেবেছিলাম এই সোশ্যাল ওয়ার্ক তিনি বুঝি কোথাও বসে করেন। প্রশ্ন জেগেছিল মনে, তিনি যদি চেম্বারে বসে এই কাজ করেন তাহলে তো ভিড় জমে যাওয়ার কথা। কী করে সেই ভিড় সামলানো হয়? ইন্টারভিউ পড়ে দেখলাম আমার ধারণা ভুল। তিনি মানুষের কথা শোনেন রেডিও অফিসে বসে। একটা অনুষ্ঠান ওই নামে চলছে। এ ছাড়া সাবা অ্যাসিডদগ্ধদের সাহায্যের জন্য একটা এনজিওর সঙ্গে জড়িত। বেশ বোঝা গেল স্বার্থপর জীবনযাপন করছেন না মোটেও। নিজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের কথাও ভাবছেন। বিশেষ করে যাদের সমস্যা আছে এবং যারা বিপদের শিকার। তিনি যখন প্রথম কনফেশন বক্সের কথা ব্যাখ্যা করেছিলেন তখন মনে হয়েছে নেহাত শখ করে করেন। এখন দেখা যাচ্ছে তা না। বেশ দৃঢ় সোশ্যাল কমিটমেন্ট রয়েছে এর পেছনে। তাঁকে বলেছিলাম, আপনি একজন ব্যতিক্রমী সেলিব্রেটি। এখন মনে হচ্ছে সেই কথায় কোনো অতিরঞ্জন ছিল না। নিজের ছেলেকে একা রেখে ক্যারিয়ারে সময় দিচ্ছেন, তারপর যেটুকু অবসর তখন বাইরের লোকের দুঃখ লাঘবের জন্য সোশ্যাল ওয়ার্ক করছেন। এরচেয়ে বড় স্বার্থত্যাগ আর কী হতে পারে? ইন্টারভিউটা পড়ার পর তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বাড়ে। বয়সে তিনি আমার অনেক ছোট, কিন্তু শ্রদ্ধা তো বয়সের ওপর নির্ভর করে না। আমি সোহানা সাবাকে কোনোদিন দেখি নি, মুখোমুখি কথাও হয় নি। কয়েকদিন ফেসবুকে সামান্য কথা বলে এবং পাক্ষিক বিনোদনের ইন্টারভিউটা পড়ার পর মনে হলো তাকে যেন অনেকদিন ধরে চিনি। ফেসবুকে এসে যাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ধন্য মনে করেছি তিনি তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে একজন। একইসঙ্গে তাঁর ফটোগ্রাফার রাজিন সম্বন্ধেও আমার একটা ভালো ধারণা হয়ে গেল। সে সম্প্রতি আমার ফেসবুক বন্ধু হয়েছে। তারপর থেকে আমার ওয়ালে তার একটার পর একটা মন্তব্য দেখছি। সবই প্রশংসাসূচক। সে আমার সব পোস্টই মনোযোগ দিয়ে পড়ে এবং হয় লাইক কিংবা কমেন্ট করে। তার প্রোফাইল পড়ে দেখলাম সে একটা অনলাইন পত্রিকার স্টাফ ফটোগ্রাফার। এ ছাড়া অন্যান্য সংস্থার সঙ্গেও জড়িত আছে।

ভেবেছিলাম সাবাকে জিজ্ঞাসা করব তিনি যে অভিনয় জগতে ঢুকলেন এর জন্য কি মা-বাবার আপত্তি ছিল? ইন্টারভিউ পড়ে এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম। তিনি বলেছেন, বাবা-মার হাত ধরেই অভিনয় জগতে প্রবেশ করেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের খুব সাধারণ চিত্র এটা। প্রতিভাময়ী কন্যা থাকলে বাবা-মা তাকে বাইরের জগতে পরিচিত হতে সাহায্য করেন। এই বাইরের জগতটা হলো রেডিও কিংবা টেলিভিশন। এই পথ ধরে শেষ পর্যায়ে চলে আসে সিনেমায় অভিনয়। সাবার ক্যারিয়ার এই প্রচলিত পথ ধরেই এগিয়েছে। আমি লিখছি হঠাৎ মোবাইলে রং বদলে গেল। বুঝতে পারলাম নতুন কমেন্ট এসেছে। খুলে দেখি সাবা তাঁর ছবি আপডেট করেছেন। রঙহীন দেয়ালের পটভূমিতে অসমান মাটির ঢিপির ওপর বসে আছেন পা দুটো জড়ো করে, একদিকে হেলান দিয়ে। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবে স্থির হয়ে একদিকে হেলে বসে আছেন। হ্যাঁ, ক্লাসিকাল ড্যান্সারের মতোই তাঁর দেহের ব্যালান্স। এর আগের ছবিতে নগ্নতাকে কিছুটা প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, এই ছবিতে তা নেই। শরীরের যেটুকু দেখানো হয়েছে তা রুচিশীল এবং শিল্পিত। আমি লিখলাম, হোয়াট এ ক্লাসিক পোজ অ্যান্ড ব্যালান্স? যে মেয়ের ব্রেন আর বিউটি দুটোই আছে তার মডেলিং এমনই হওয়া উচিত।

পাঁচ দিন পর রাজিনের তোলা সোহানা সাবার প্রোফাইল ফটোর নতুন আপডেট দেখা গেল। এখানে তিনি সম্পূর্ণ নতুন পোজ দিয়েছেন এবং পোশাক কালো নয়, রঙিন, ওপরে লাল এবং নিচের দিকে নীল। তিনি উপুড় হয়ে মাটিতে ঘাসের ওপর শুয়ে আছেন। মাথা এবং গলাসহ বুকের উপরিভাগ দেখা যাচ্ছে। উপরিভাগটা সম্পূর্ণ দেখা গেলে নগ্নতা প্রধান্য পেত, কিন্তু সাবা এক হাতে শুকনো কয়েকটা কাঠি নিয়ে বুকের একাংশ ঢেকেছেন, যার ফলে ছবিটির নান্দনিকতা নিশ্চিত হয়েছে। তাঁর ভক্তরা ছবিটি দেখে যথারীতি উচ্ছ্বসিত এবং কেউ কেউ বল্গাহীনভাবে মন্তব্য করেছেন। প্রায় সব মন্তব্যই অগভীর, তার শারীরিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করে। আমি লিখলাম : মনে হয় ঘাস হয়ে জন্মাই ঘাসের ভেতরে। ইংরেজিতে ঘাস লেখাটা ভুল হয়ে গেল। পরে আমি সংশোধনী দিয়ে বললাম : ফেসবুকে আমি নবাগত। বানান প্রায়ই ভুল হয়। সংলাপে সময় নিই অনেক বেশি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলাম। সাবা লিখেছেন : আপনি একদম ঠিক আছেন। আমি পড়ে অবাক।

 

আঠারো

ফেক নিউজ এবং ফেসবুক

ফেকনিউজ কথাটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে উঠলেও ট্রাম্প এখন ওটা মেইনস্ট্রিম সংবাদপত্র ও নিউজ চ্যানেলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। তাদের ট্রাম্পবিরোধী সমালোচনার জন্যই তার এই বিষোদ্গার। ফেক নিউজের সম্ভাবনা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেই সবচেয়ে বেশি। এখানে একজন একটা অসমর্থিত চাঞ্চল্যকর খবর দিলে অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আন্দোলন সৃষ্টির জন্য পোস্ট করলে সেই খবর চেক করার সময় থাকে না। চাঞ্চল্যকর হওয়ার জন্য খবরটি ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যারা পড়ে, সে খবর সত্যি মনে করে এবং অন্যকে জানায়। এইভাবে মহামারীর আকারে একটা অসমর্থিত কিংবা মিথ্যা খবর ছড়িয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থির করে তোলে। যারা শোনে তাদের অনেকেই সত্যি বলে মনে করে। দুষ্ট বুদ্ধির এবং অসামাজিক প্রবণতার লোকেরা সাধারণ মানুষের এই বিশ্বাসপ্রবণতার সুযোগ নিয়ে ফেসবুকে ফেক নিউজ ছড়ায়। মার্ক জাকারবার্গ নিজেই স্বীকার করেছেন যে, মায়ানমারে ফেক নিউজ ছড়িয়ে জাতিগত ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য তিনি বলেছেন যে উভয়পক্ষই ফেক নিউজ ছড়িয়ে নিজ জাতিগত গোষ্ঠীকে অপর পক্ষ সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছে এবং তাদের সশস্ত্র হয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছে। এখানে সত্যের অপলাপ হয়েছে, কেননা রোহিঙ্গা মুসলিমরা সংখ্যালঘিষ্ঠ। তাদের অনেকের কাছে মোবাইলও নেই। থাকলেও তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে হেট স্পিচ দিলেও কোনো লাভ হবে না। কেননা, তারা নিরস্ত্র এবং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে মায়ানমারের সেনাদল। সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সংঘর্ষে নিরস্ত্র রোহিঙ্গারা হতাহতই হতে পারে, বিপক্ষের কাউকে আঘাত করার ক্ষমতা তাদের নেই। এটা মার্ক জাকারবার্গের অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু রাজনীতিবিদের মতো তিনি কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে উভয় পক্ষকে ফেক নিউজ ছড়ানোর জন্য দায়ী করেছেন। মোরাল ইম্পারেটিভ প্রতিষ্ঠার জন্য তার এই হীন প্রচেষ্টা নিন্দনীয়।

আমাদের দেশে ফেক নিউজ ছড়ানোর একটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো এক বিসিএস অফিসার তার বিসিএস স্ত্রীর প্ররোচনা ও নির্দেশে বৃদ্ধা মাকে কমলাপুর স্টেশনে ফেলে রেখে এসেছে। তার এই অমানবিক ব্যবহারে তুমুল নিন্দা হয়েছে ফেসবুকে। বিসিএস সম্প্রদায়ের নিষ্ঠুরতা নিয়ে সাধারণীকরণের মাধমে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ এই সার্র্ভিস ক্যাডারে যারা আছেন তারা হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর। কিন্তু শেষে দেখা গেল খবরটা ভিত্তিহীন। বৃদ্ধা মহিলা বাংলাদেশের নন, ভারতের এক আশ্রমের। সেই ছবি ব্যবহার করে বিসিএস ক্যাডারের সদস্যদের নিষ্ঠুরতা এবং হৃদয়হীনতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ সম্পর্কে আফরোজা পারভিন মোক্ষম উত্তর দিয়েছেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন : “হাতে লেখা একটা চিঠি এবং পাশে এক বৃদ্ধার ছবি। তিনি বসে আছেন স্টেশনে। তাকে স্টেশনে রেখে এসেছে বিসিএস পুত্র। কারণ তার বিসিএস স্ত্রী শাশুড়িকে বাড়িতে রাখতে চান না। এটা নিয়ে খুব নিন্দা সমালোচনা হলো ফেসবুকে। ক’দিন পর দেখা গেল সেই বৃদ্ধা ঢাকার নয়। ভারতে এক আশ্রমে থাকেন। তার ছবি আগেই ফেসবুকে ছাপা হয়েছে। কে তাহলে ছাপালো এই ফেক নিউজ? কেন ছাপাল? আফরোজার মন্তব্য, এটা বিসিএস বিদ্বেষীরা করেছে। নারীবিদ্বেষীরা পুত্রবধূকে দয়ামায়াহীন নারী হিসেবে দেখিয়ে গোটা নারী জাতির অবমাননা করেছে। আফরোজা লিখেছেন : দুদিন ধরে দুটো বিষয় নিয়ে ফেসবুকে তোলপাড় হচ্ছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট বউ শাশুড়িকে দেখতে পারে না বলে বাধ্যগত ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী মাকে রেলস্টেশনে ফেলে এসেছে। ইতিমধ্যে বিষয়টা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মা হিসেবে যে মহিলার ছবি ছাপা হয়েছে তিনি যে ভারতের একটা আশ্রমে থাকেন সেটাও ছবিসহ এসেছে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে আফিয়া খাতুনসহ মুষ্টিমেয় দু-একজন মহিলা কর্মকর্তা ছাড়া কেউ বিষয়টি নিয়ে কিছু বলে নি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা। এটা ফেসবুকে রসালো খাদ্য হয়েছে। পুরুষেরা শত মুখে ম্যাজিস্ট্রেট বউয়ের বদনাম করেছে যেন পুরুষটি ধোয়া তুলসি পাতা। মেরুদ-রহিত একজন বলবান পুরুষ। এ দেশে শাশুড়ি নিগ্রহের মতো ঘৃণিত কাজটি কি শুধুু বিসিএস বউ করেন, অন্যেরা করে না? শিক্ষক বৌ, চিকিৎসক বৌ, হাউজ ওয়াইফ? আর তারা কি স্বামীর সায় না থাকলে একা একা করেন? স্বামীরা বাধা দেন না কেন? গর্ভধারিণীর ওপর যখন নিগ্রহ হয় রুখে দাঁড়ায় না কেন? একজন দেখলাম পোস্টে মন্তব্য করেছে : হারামীর বাচ্চা বিসিএস। এ কেমন শালীনতা? এ কি আঙুর ফল টক বলেই?

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ বলি। চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা আভিনেতা মিশা সওদাগরকে টিভি অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করেছেন : কার সঙ্গে ধর্ষণের দৃশ্যে অভিনয় করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন? এটা একটা প্রশ্ন হলো? এই প্রশ্নের মাধ্যমে ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়া হলো। কথা হতে পারে, ধর্ষণ দৃশ্য তো পর্দায় দেখানো হয়, তাহলে প্রশ্ন করতে অসুবিধা কী? অসুবিধা আছে। যা ইচ্ছে তাই প্রশ্ন করা যায় না গণমাধ্যমে। প্রশ্ন করারও একটা ধরন থাকতে হয়। প্রশ্নটা এমন হতে পারত, ‘চলচ্চিত্রে আপনি দীর্ঘদিন অভিনয় করছেন। পর্দায় ধর্ষণ দৃশ্য দেখানো কতটা যৌক্তিক বলে আপনি মনে করেন? প্রতিনিয়ত ধর্ষণ দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন আছে কি?’ আমার কথা হলো, কাহিনিতে প্রয়োজন হলে ধর্ষণের দৃশ্য আসতে পারে। সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য নয়। তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করার জন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে যে ক’টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হয়েছে তার প্রতিটিতে ধর্ষণদৃশ্য আছে। এমনকি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ এবং ‘মেঘের অনেক রং’ চলচ্চিত্রেও। ‘মেঘের অনেক রং’ চলচ্চিত্রে দীর্ঘক্ষণ ধরে রওশন আরাকে টেনে হিঁচড়ে ধর্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। আমি এর এক দর্শক হিসেবে বলতে পারি অতটা মোটেও প্রয়োজন ছিল না। আর ধর্ষণের পর অবধারিতভাবে আত্মহত্যা, দু-একটা ব্যতিক্রম বাদে কারণ ধর্ষণের দায় নারীর, তার ইজ্জত গেছে। সমাজে সে মুখ দেখাবে কী করে? বাপ-মা তাকে নিয়ে কী করবে? মুক্তিযুদ্ধ একজন পুরুষকে দিয়েছে বীরের মর্যাদা আর একজন নারীকে দিয়েছে সমাজ-পরিত্যক্ততার তকমা। এটাই আমাদের চলচ্চিত্রে প্রতিনিয়ত কেন? মুক্তিযুদ্ধে কি আমাদের নারীরা অংশ নেয় নি? যারা ধর্ষিত হয়েছে তারা তো দেশের জন্যই হয়েছে। তাহলে কেন এই নেতিবাচক উপস্থাপনা? কেন তাদের বীরত্বের কথা আসে না গণমাধ্যমে? শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা কেউ বাদ যায় না। দিনে দিনে এটা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না।”

খুব জোরালো মন্তব্য করেছেন আফরোজা পারভিন দুটি বিষয়েই। অকাট্য তার যুক্তি। আফরোজা শুধু সাহিত্যিক নন, একজন বিজ্ঞ চিন্তাবিদ। তাঁর প্রবন্ধে ধার আছে, লক্ষ্যবিদ্ধ করে অমোঘভাবে। ফেসবুক না হলে হয়তো তাঁর এসব কথা এমনভাবে প্রকাশ পেত না।

উনিশ

সোহানা সাবা

১৩ এপ্রিলে সাবাকে দেখা গেল নতুন ধরনের ছবিতে। গাড়িতে বসে আছেন রোদচশমা চোখে, কোলে তাঁর ছেলে। কমেন্টে তিনি লিখেছেন : আমি ও উনি। বোঝা গেল বেশ রসবোধ আছে তাঁর। ছেলের মুখ নিচের দিকে যার জন্য শুধু মাথার চুল দেখা যাচ্ছে। আমি লিখলাম : স্বরবর্ণ মুখ না দেখিয়ে দর্শকদের কৌতূহল জাগিয়ে রাখল। চমৎকার ভঙ্গিতে তোলা ছবি। পরদিন সকালে যথারীতি আমি সুপ্রভাত জানালাম। লিখলাম, শুভ নববর্ষ, ফর ইউ অ্যান্ড উনি। সঙ্গে সঙ্গে না, পরে পড়ার পর সাবা লিখলেন : হা হা হা। থ্যাংকস। শুভ নববর্ষ। সেই দিনই (১৩ এপ্রিল) তিনি ফেসবুকে ভক্তদের উদ্দেশে বেশ একটা রাগী পোস্ট দিয়েছেন। সবার জন্য নয়, কতিপয় অনুরাগীকে লক্ষ্য করে, এটা পড়ার পরে বেশ বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন : আমি আমার বাবাকে ‘পাপা’ সম্বোধন করি...মাকে ‘মামণি’ সম্মোধন করি। দাদিকে ‘দীদুমণি’ ...নানিকে ‘বাজি’। তারপর খালামণি, ফুপ্পি, মামা, চাচ্চু সম্মোধন করি যেগুলো মামণি শিখিয়েছে আমার ছোটবেলা থেকেই। আমি একদম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি...বাংলা বলার সময় সচেতনভাবে বা দুষ্টুমি করেও অন্য ভাষায় কথা বলি না! আমার ছেলের নাম ‘শুদ্ধ স্বরবর্ণ’। তো গো-মূর্খ আমাকে শিক্ষা দিতে আসবেন না! বাংলা নিয়ে...আগে নিজের নাম দেখুন...বাংলায় কি না? ‘আংকেল, আন্টি/ স্যার/ ম্যাডাম তো হরদম বলছেন! বাংলা কতভাবে বিকৃত করছেন! যাই হোক ‘নতুন বছরে আমার শপথ’...আমি আমার ওয়ালে কোনো পাকনাকে দেখলেই ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দেব! ধন্যবাদ।

ওপরের পোস্টের জন্য সাবা লাইক পেয়েছেন ৫০০০। কমেন্ট এখনো আসছে। আমি বেশ আবাক হয়েছি তাঁর এই রাগী পোস্ট দেখে। তাঁর সম্বন্ধে আমার যে ধারণা সেখানে যেন কিছুটা চিড় ধরল। তাঁর তো এমন ধৈর্য হারানো ঠিক হয় নি, প্রভোকেশান যাই হয়ে থাকুক। তার ছবি যখন ফেসবুকে পোস্ট করা হয় ভক্তদের মধ্যে কেউ কেউ অশালীন ভাষা ব্যবহার করে প্রশংসা করে। তিনি তাদের ওপর রাগ করে কিছু বলেছেন এমন দেখি নি। এখন এমন কী সিরিয়াস হতে পারে যার জন্য তিনি মেজাজ খারাপ করে লিখলেন? মনে হচ্ছে তাঁর বাংলা ভাষা ব্যবহার এবং বাঙালিয়ানা নিয়ে হয়তো কেউ বিরূপ মন্তব্য করেছে। তিনি মনেপ্রাণে বাঙালি, ছেলের নামকরণ দেখেই তা বোঝা যায়। ভক্তদের কেউ যখন তাঁর এই স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়েছে তার পক্ষে হয়তো সহ্য করা সম্ভব হয় নি। একজন সাধারণ মানুষ এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানাবে। কিন্তু তিনি তো সাধারণ মানুষের শ্রেণিতে পড়েন না। তিনি শুধু সেলিব্রিটি নন, রুচিতে, মানসিকতায় এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যতিক্রমী একজন। তাঁকে সাধারণের মতো ব্যবহার করতে দেখলে শুধু অবাক না কিছুটা ব্যথিতও হতে হয়। যে ভাবমূর্তিটা গড়ে উঠেছে মনে সেটা যেন কিছুটা ম্লান হয়ে যায়। এমনটা তো হওয়ার কথা না তাঁর ক্ষেত্রে। কেউ কি নেই যে বা যিনি তাঁকে বুঝিয়ে রাগ প্রশমিত করতে পারেন? আর তারই বা প্রয়োজন কী? তিনি এত ম্যাচিওর এবং বুদ্ধিমতী যে নিজেই সামাল দিয়ে চলতে পারেন। একবার ভাবলাম কিছু একটা লিখি। তারপর মনে হলো এটা হবে সত্যিকারের অনধিকার চর্চা। তাঁকে উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার মতো আমি কেউ নই। মাত্র কয়েকদিনের ফেসবুকের বন্ধু। এই দাবিতে কিছুই বলা যায় না। এর আগে ছবি সম্পর্কে দু-একবার বলেছি। সেই মন্তব্যই আমার কাছে অবাঞ্ছিত মনে হয়েছে, যদিও তিনি কিছু মনে করেন নি বলে জানিয়েছেন।

সাবার পোস্টের ওপরে একজনের মন্তব্য : ব্লক লিস্ট লম্বা হোক। একজন : আপনার ছেলের নামটি অনেক সুন্দর। এক বান্ধবী : দোস্ত, কাল ফ্রি থাকলে বাসায় আয়। একজন : আপু, এত চটেছেন কার ওপর? থাকগে। বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা তোমায়। একজন : আমার বাংলা শুদ্ধভাবে বলতে শিখেছি পারিপার্শি¦কের চাপে পড়ে। আমার ছোটবেলায় যেখানে থাকতাম সেখানে কেউ যদি নিজের জেলার ভাষায় কথা বলত তাহলে অন্য বন্ধুরা তার সঙ্গে কথা বলত না যতক্ষণ সে না শুদ্ধ ভাষায় কথা বলত। আমি আমার ছেলেমেয়েদের শুদ্ধ বাংলা শিখিয়েছি। আমি বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলি না এবং কেউ বললে অস্বস্তি হয়। আমার স্ত্রীকে পুরোটা শেখাতে পারি নি। একজনের মন্তব্য : ওদের কথায় কান দিয়েন না আপু। ওরা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ঘৃণা করে। অমানুষদের ব্লক করে দিন। একজন : ব্লকলিস্ট বাংলাটা কী হবে? সাবার উত্তর : আমার পোস্টটা বুঝতে আপনাকে যথেষ্ট পরিমাণ আয়োডিন খেতে হবে!!! তাই আপনিও ব্লকলিস্টেড। এক বন্ধু : ওটা দারুণ বলেছিস। সাবা : (বন্ধুকে) মনোযোগ দিয়ে প্রোগ্রাম কর।

সাবার প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তা করার পর মির্জা গালিবের গজলের কয়েক পঙ্ক্তি মনে এল : দিল হি তো হায়, না সাঙ্গ কিসত্/ রোয়েঙ্গে হাম হাজার বার, কেই হামে সাতায়ে কিউ। বাংলা : পাথর তো নয়, হৃদয়ই মাঝখানে/ কেউ যদি রাগায়, কাঁদবো অঝোরে। ফেসবুকে আমি এই পঙ্ক্তিটি পোস্ট করে লিখি যে, নববর্ষের আগের দিন একজন সেলিব্রিটিকে রাগ করতে দেখে আমার এ গজলটির কথা মনে পড়েছে। তারা সেলিব্রিটিকে শনাক্ত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। আর যাঁকে উদ্দেশ করে এটি লেখা তিনিও পড়ার সময় পেয়েছেন বলে মনে হয় না। গজলটির কথাগুলো প্রকারান্তরে তাঁকেই সমর্থন করে। এটা একটা ব্যাখ্যা হিসেবে দিয়েছি, কিন্তু অজুহাত হিসেবে নয়। আমার মনে হয়েছে এবং সব সময় হবে যে, তিনি একটা ভুল করলেন। নিজেকে সাধারণের পর্যায়ে নিয়ে এলেন। তাঁর পাবলিক আর প্রাইভেট পার্সোনা এক হয়ে গেল।

যে-কোনো মানুষেরই ক্রোধ অসুন্দর। যিনি ভেতরে বাইরে সুন্দর তার জন্য এ ক্রোধ আরও অসুন্দর। আমাদের চারদিকে বড় বেশি ক্রোধ, আক্রোশ এবং জিঘাংসা। এতে ক্ষুণœ হচ্ছে ব্যক্তিজীবন, সামষ্টিক জীবন। শ্রীহীন হয়ে পড়ছে চারদিক। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে হতে হবে সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল এবং ক্ষমাশীল। সবাই হয়তো এমন পারবে না। কিন্তু কেউই পারবে না, এমন মনে করলে ভবিষ্যতের প্রতি আশা ছেড়ে দিতে হয়। তাহলে বেঁচে থাকার আনন্দই দূর হয়ে যেতে পারে। তেমন সম্ভাবনা মেনে নেওয়া যায় না। সবাই না-পারুক কাউকে-না-কাউকে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সাবা হতে পারেন সেই একজন। কয়েক দিন ইতস্তত করার পর সাবাকে পোস্ট দিলাম : মনে হয় মাঝে মাঝে আপনি ভক্তদের আচরণে বিরক্ত হন। এটা আপনাকে মানায় না। অন্যের ভুল-ত্রুটি আপনাকে ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখতে হবে। না হলে আপনি সাধারণের পর্যায়ে চলে যাবেন। আপনি তো সাধারণ নন। পোস্টটা দেওয়ার পরে মনে হলো স্পষ্ট কথা বলে নিজের বিবেককে শান্ত করেছি কিন্তু সাবা হয়তো মন্তব্যটা ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না। অসন্তুষ্ট হবেন। একদিন পর তাঁর পোস্ট দেখলাম। আমার উদ্দেশে লিখেছেন : কবে আমি বিরক্ত হলাম? আমি কারও ওপর বিরক্ত হই না। আমি লিখলাম : পহেলা বৈশাখের আগের দিন আপনি ভক্তদের মধ্যে যারা গো-মূর্খ এবং পাকনা, তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। সাবা এর উত্তরে লিখলেন : ও। ওকে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু তিনি আমার মন্তব্য কীভাবে গ্রহণ করলেন তা বুঝতে পারলাম না। আমি সন্তুষ্ট থাকলাম এই ভেবে যে তাঁর শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে আমি তাঁকে সত্য কথাই জানিয়েছি যা তাঁর ১৩ এপ্রিলের পোস্ট পড়ার পর বলতে পারি নি, কেননা সেটা ছিল পাবলিক ডোমেনে। সবার সামনে অপ্রিয় সত্যটি বলে তাঁকে বিব্রত করতে চাই নি আমি। কিন্তু না বলার জন্য একটা গ্লানি মনের ভেতর রয়ে গিয়েছিল। শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে তাঁকে সত্য কথাটা জানানো আমার দায়িত্ব ছিল। তখন পারি নি, দেরিতে হলেও সে কথা জানিয়ে মনের অস্বস্তি দূর হলো। এর জন্য তিনি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হন তাহলে আমার করার কিছু নেই। দেখা যাক।

১৮ এপ্রিল। সাবার ফটো আপডেট হয়েছে। তিনি মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। সামনে সবুজের হাতছানি। তিনি তাকিয়ে আছেন পেছন ফিরে। এক হাত মাথার নিচে, অন্য হাত হাঁটুর কাছে। হাত দুটির অবস্থান আর ব্যবহার এমন নিখুঁত যে ছবিটিকে সস্তা হতে দেয় নি, শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য অর্জনে সাহায্য করেছে। আমি লিখলাম : হাতের ব্যবহার নিখুঁত। দুজনকে অভিনন্দন। দুজন মানে সাবা এবং ফটোগ্রাফার রাজিন। রাজিন সঙ্গে সঙ্গে লাইক দিল আমার কমেন্টের ওপর। ছেলেটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছে। ফেসবুকে দু-একবার কথা হয়েছে। সে আমার ফটো তুলতে চেয়েছে। আমি ধন্যবাদ দিয়ে বলেছি, আমার ফটো তোলার বয়স চলে গিয়েছে। তুমি সময় নষ্ট কোরো না। তবে কফি খাওয়ার জন্য একদিন আসতে পার। গল্প করা যাবে। সে বলেছে, আসবে। এর পর সাবার প্রোফাইলের ফটো আপডেটে তাঁকে আবার দেখা গেল কালো পোশাকে। তিনি এক হাত মুখের কাছে এনে সামনে তাকিয়ে আছেন। খুব নির্দোষ চাহনি। সাদা-কালোতে চমৎকার কন্ট্রাস্ট হয়েছে। তিনি ভক্তদের কাছ থেকে যথারীতি কয়েক হাজার লাইক পেলেন এবং কমেন্ট কয়েক শ’। এ সবই আগের মতো। আমি লিখলাম : গ্রেসফুল, রিফ্রেসিং। লাইক দিয়ে সাবা এবং রাজিন উত্তর দিলেন। আমি আবার মন্তব্য দিলাম : সিম্পল বাট এলিগেন্ট। এর একদিন পর আবার লিখলাম : ইনোসেন্স পারসোনিফাইড। সাবাকে খুশি করার জন্য এতগুলো মন্তব্য দিলাম না। ছবিটা সত্যিই আমার কাছে সুন্দর মনে হয়েছে। সাবাকে মেসেজ পাঠালাম : আমার মতে এটাই আপনার সবচেয়ে সুন্দর ছবি। পরদিন সাবা উত্তর দিলেন : ধন্যবাদ। সেইসঙ্গে জানালেন সুপ্রভাত। আমি নিশ্চিত হলাম যে স্পষ্টবাদী হওয়ার জন্য তিনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হন নি।

বিশ

একটি নমস্কারে

১৮ এপ্রিল। ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম। একজন লিখেছে : ফেসবুকে আমার আজই শেষ দিন। কাল থেকে আমাকে ফেসবুকে দেখা যাবে না। ফেসবুকের অনেককে আমার মনে থাকবে। আমাকে কারও মনে থাকবে কি না জানি না। আমি ফেসবুক থেকে অনেক কিছু জেনেছি।

ছেলেটি কোনো কারণ উল্লেখ করে নি। তার পোস্ট দেখে মনে হলো না যে সে ফেসবুকের ওপর বিরক্ত হয়েছে কিংবা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। খুব ভদ্রভাবে বিনয়ের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে সে। কারও ওপর তার কোনো অভিযোগ নেই। সে আবার আসবে এমন আভাস দেয় নি। ‘আসি’ না বলে বলেছে ‘যাই’। গুডবাই। অডিউ। বিদায়। জার্মানদের মতো অফ উইডারসেহেন অর্থাৎ আবার না-দেখা হওয়া পর্যন্ত বিদায়, এ কথা বলে নি যাওয়ার সময়। নিশ্চই অনেক সময় কাটিয়েছে ফেসবুকে, অনেক বন্ধু হয়েছে তার। কিন্তু সব পেছনে ফেলে সে চলে যাচ্ছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড ছেড়ে। তার এই যাওয়া এবং বিদায় নেওয়া আমাকে ভাবায়। আমিও কি একদিন এইভাবে...। থাক, এখন ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাজ নেই। ব্রিজের কাছে এলে সেটা পার হওয়ার কথা ভাবা যাবে। সিডি প্লেয়ারে লোপামুদ্রার গান হচ্ছে : ‘হৃদ মাঝারে রাখব, তোমায় ছেড়ে দেব না।’ আগেও অনেকবার শুনেছি কিন্তু এবার শুনে একটু চমকে উঠলাম। গানের কথাগুলো কি কিছু বলতে চাইছে আমাকে? 

[উপন্যাসে ব্যবহৃত সংলাপ এবং পরিবেশিত তথ্য এ বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসের ফেসবুক থেকে নেওয়া। রিফাত মুনীর ফুলদানিতে ফুলসহ ফিরে এসেছে। অপরাহ্ন সুস্মিত মন্ট্রিয়লে এবং সে পুরুষ।—লেখক]

অন্যদিন ঈদসংখ্যা ২০১৮-এ প্রকাশিত  হাসনাত আবদুল হাই-এর ফেসবুকে কয়েকদিন উপন্যাসের অংশবিশেষ।

Leave a Reply

Your identity will not be published.