অন্যদিন-এ চলচ্চিত্র, বিষয়বৈচিত্র্যে প্রোজ্জ্বল: মোমিন রহমান

অন্যদিন-এ চলচ্চিত্র, বিষয়বৈচিত্র্যে প্রোজ্জ্বল: মোমিন রহমান

মিশ্র শিল্প মাধ্যম চলচ্চিত্র। গণমাধ্যমও বটে। তাই এক মলাটের ভেতর জীবনের নানাকিছু ধারণ করা অন্যদিন-এর প্রতি সংখ্যায় নিয়মিত একটি বিভাগ হলো চলচ্চিত্র। এই বিভাগে এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের নানা খবরাখবর, কলাকুশলীদের মিনি সাক্ষাৎকার ইত্যাদি ঠাঁই পায়। এছাড়া কখনো-সখনো প্রচ্ছদ রচনায় চলচ্চিত্রের কোনো বিশেষ দিক উঠে আসে; কখনো আবার বিশেষ কোনো চলচ্চিত্রকে ঘিরে রচিত হয় প্রচ্ছদ রচনা। ঈদসংখ্যা এবং ঈদ আনন্দ সংখ্যায়ও ঠাঁই পায় চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা রচনা। গত পঁচিশ বছরের চলচ্চিত্রবিষয়ক উল্লেখ্যযোগ্য রচনার ওপর আলো ফেলা হলো এখানে।

শুরুতেই উল্লেখ করা যেতে পারে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী বছরে প্রকাশিত অন্যদিন-এর প্রথম বর্ষের একটি প্রচ্ছদ রচনার কথা। ‘স্বাধীনতার ২৫ বছর: চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক এ রচনাটি লিখেছিলেন বর্তমান নিবন্ধকার। তথ্যভিত্তিক এবং গবেষণাধর্মী এই রচনায় মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই চিত্রায়িত ‘ওরা ১১জন’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আগুনের পরশমণি’ পর্যন্ত সবগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনিচিত্রের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। নির্মিতব্য মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিচিত্র ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ ছাড়াও এই রচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পঁচিশ বছরের স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্রসমূহ। প্রচ্ছদ রচনাটির বৈশিষ্ট্য হলো, উপস্থাপনায় নতুনত্ব। এই প্রসঙ্গে এই রচনায় উল্লেখ করা হয়েছে—“বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। অর্থাৎ এমন পূর্ণাঙ্গ কাহিনিচিত্র এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে—যেখানে ’৭১-এর দিনগুলোর উত্তাপ টের পাওয়া যায় কিছুটা; বলা যায়, এ সমস্ত চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধের দরুন উদ্ভূত সমস্যা, ব্যক্তিগত সংকট চলচ্চিত্রের উপজীব্য হয়েছে। ফ্ল্যাশব্যাকে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্ভাসিত করা হয়েছে। কখনো আবার মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত মূর্ত হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রে। সুতরাং এ রচনায় দুটো দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গটি তুলে ধরা হবে।”

আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রচ্ছদ রচনা ‘বাংলা ছবিতে বর্ষা’। এটিরও রচয়িতা বর্তমান নিবন্ধকার। বর্ষাবিষয়ক এই রচনায় কয়েকটি ধ্রুপদী বাংলা চলচ্চিত্রে (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, পালঙ্ক, নদী ও নারী, সূর্যকন্যা, রূপালী সৈকতে, পদ্মা নদীর মাঝি, তিতাস একটি নদীর নাম, পরমা) বর্ষার শিল্পিত ব্যবহার তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গও এসেছে। উল্লেখ করা হয়েছে—“মূলধারার ছবিতেও বর্ষার উল্লেখযোগ্য চিত্রায়ণ দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে গান একটি আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে ‘দেবদাস’, ‘শেষ পর্যন্ত’ ‘মণিহার’, ‘জলছবি’ ইত্যাদি ছবিগুলোর কথা বলা যায়। ‘দেবদাস’ ছবিতে ‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে’, কিংবা ‘শেষ পর্যন্ত’-এ ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘর থাকে না তো মন’ অথবা ‘মণিহার’ ছবিতে ‘আষাঢ় শ্রাবণ/ মানে না তো মন’ অথবা ‘জলছবি’-তে ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে দুটি মন কাছে আসলো’ গানের পাশাপাশি বর্ষার আবহকে ক্যামেরাবন্দি করার চমৎকার প্রচেষ্টা দেখা যায়।” উল্লেখ্য, এ বিষয়ে স্বল্প পরিসরে ঈদসংখ্যা আনন্দ বিচিত্রায় প্রথম একটি ফিচার লিখেছিলেন বর্তমান নিবন্ধকার। পরে অন্যদিন-এ বিশদভাবে লিখেন তিনি। আর পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন।

টাইটানিক—বিশ্ববিখ্যাত এবং ব্যবসাসফল একটি চলচ্চিত্র। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে প্রেম, শ্রেণি বৈষম্য, বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই, নারীবাদ, মানবতবাদ, সেক্স—যেন সম্পূর্ণ জীবনগাথা। এই চলচ্চিত্রটি নব্বই দশকের শেষার্ধে বাংলাদেশে মুক্তি পায় এবং শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষদের মাঝে আলোড়ন তোলে। সঙ্গত কারণেই সময়ের আলোচিত এই চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে অন্যদিন-এ রচনা প্রকাশিত হয়, ১৯৯৮-এর জুনে।

২০০২ সালে ভারতে মুক্তি পায় বলিউড সিনেমা ‘দেবদাস’। সঞ্জয় লীলা বানসালির এই ছবিটি মুক্তির পর বাংলাদেশেও ‘দেবদাস’-কে নিয়ে টেলিফিল্ম ও চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা অনেকে বলেন (যদিও গত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে চাষী নজরুল ইসলাম সাদা-কালোয় নির্মাণ করেছিলেন ‘দেবদাস’। প্রধান চারটি ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ, কবরী, আনোয়ারা এবং রহমান)। এই প্রেক্ষিতে অন্যদিন ‘দেবদাস যুগে যুগে’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশ করে। এখানে যুগে যুগে এই উপমহাদেশে নানা ভাষায় (বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তেলেগু ও তামিল) দেবদাস নির্মাণের কথা তুলে ধরা হয়। চার চরিত্র—দেবদাস, পার্বতী, চন্দ্রমুখী এবং চুনিলাল চরিত্রে কারা কারা অভিনয় করেছেন সেটি উল্লেখ করা হয়। শেষে সঞ্জয় লীলা বানসালির একুশ শতকের ‘দেবদাস’-এর কথা বিশদভাবে তুলে ধরা হয়। উল্লেখ করা হয় অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’-এর সঙ্গে বানসালির ‘দেবদাস’-এর মিল-অমিল-এর বিষয়টিও। আর মাহফুজ, তারিন ও তানিয়া অভিনীত এবং শহীদুল ইসলাম মিন্টু পরিচালিত  টেলিফিল্ম ‘দেবদাস’-এর কথাও উল্লেখ করা হয়।

অন্যদিন-এর প্রচ্ছদে এসেছে চলচ্চিত্রের তরুণ নায়ক-নায়িকারা। রাজ্জাক-এর পরে যে নায়ক এদেশের আমদর্শকের মাঝে ক্রেজ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি সালমান শাহ। তার আকস্মিক মৃত্যুতে অন্যদিন-এ ঠাঁই পায় প্রচ্ছদ রচনা—‘এ কি করলে তুমি সালমান’। সালমানের অভিনয়ের স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ার মতো ছিল। তার কস্টিউমও ছিল ভিন্ন ধরনের।

অন্যদিন-এর প্রচ্ছদে এসেছেন নায়িকা শাবনূরও। তার ও সালমানের জুটি ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। সালমানবিহীন চলচ্চিত্র জগতে যখন শাবনূরের একাকিনী পথ চলা শুরু হয়, তখন অন্যদিন-এ ঠাঁই পায় প্রচ্ছদ রচনা—‘শাবনূর: সালমান ছাড়া কত দূর!’

নায়ক ফেরদৌস এবং তার ছবি ‘হঠাৎ বৃষ্টি’-কে ঘিরেও অন্যদিন-এ লেখা হয়েছে; লেখা হয়েছে তার পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে পদচারণার বিষয়ে। এ প্রসঙ্গে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছিল: “ফেরদৌস সাফল্যের সেই সিংহদুয়ারে পৌঁছান—যেখানে শুধু খ্যাতি, অর্থ এবং প্রতিপত্তি নেই, রয়েছে শিল্পের নান্দনিক দ্যুতি। তবে সেদিন যেন কখনো না আসে যেদিন আসা-যাওয়ার পথের ধারের এই শিল্পীটি একদিন গভীর দুঃখের সঙ্গে আবিষ্কার করবেন যে, কোথাও তার উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ও সুন্দর অবস্থান তৈরি হয় নি।”

নব্বই দশকে অশ্লীলতা যখন ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে, তখন এক পর্যায়ে নায়ক রিয়াজ চলচ্চিত্র থেকে কিছুটা দূরে ছিলেন। বলা যায়, এক ধরনের আত্মনির্বাসনে। তখন তার ভক্ত-অনুরাগীরা আশঙ্কায় ভুগছিলেন, তিনি কি গুডবাই জানাবেন চলচ্চিত্র-জগতকে? সেই সময় অন্যদিন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল, ‘রিয়াজ কি চলচ্চিত্র থেকে হারিয়ে যাবে’ শিরোনামে।

সেই সময় বাণিজ্যিক এবং অন্যধারা—দুধরনের চলচ্চিত্রেই চম্পা ছিলেন প্রোজ্জ্বল। তাই তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ হয়েছিল। শিরোনাম ছিল—‘পদ্মা নদীর মাঝি থেকে চন্দ্রকথা’।

বাংলা চলচ্চিত্রে মহানায়িকা একজনই। সুচিত্রা সেন। ২০০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে অন্যদিন প্রকাশ করে একটি বিশেষ সংখ্যা—‘চিরদিনের সুচিত্রা’। এই সংখ্যায় শুধু চিত্রনায়িকা সুচিত্রা নয়, তাঁর ভেতরের যে মানুষটি—সেই রমার কথাও বলা হয়েছে। তাঁর কেরিয়ার, নায়কেরা, ছবির গান, তাঁর উত্তরাধিকার—নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সুচিত্রার শেষ যাত্রার খবর ঠাঁই পেয়েছে। শেষে রয়েছে সুচিত্রা অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের তালিকা। এই বিশেষ সংখ্যায় সুচিত্রাকে নিয়ে লিখেছেন—মনজুরে মওলা, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, আলী ইমাম, ফরিদুর রেজা সাগর, প্রসেনজিৎ, মোমিন রহমান, মুম রহমান, সাকিরা পারভীন, এহসান ইসলাম এবং জান্নাতুল ফেরদৌস এনা। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে: “প্রায় তিন দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক বুঁদ হয়েছিল সুচিত্রার মাঝে। সাড়ে তিন দশক যখন এই মহানায়িকা স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন, তখনো তাঁর সম্পর্কে উৎসুক ছিল ভক্ত-অনুরাগীরা। শুধু আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নয়, কয়েক প্রজন্মের মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট রেখেছিলেন—রাখছেন সুচিত্রা। তাঁকে নিয়ে বাঙালির রোমান্টিক-অবসেশন রয়েছে। এটি থাকবে। রুপালি পর্দার এই মানবী আলোড়িত করে যাবে যুগ থেকে যুগান্তরে। গত ১৭ জানুয়ারি যিনি মারা গেছেন তিনি রমা, সুচিত্রা নন। সুচিত্রা সেন চিরকালের। রোমান্টিক বাঙালির মানস-সুন্দরী।”

২০১৭-এর ২১ আগস্ট না-ফেরার দেশের যাত্রা করেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি চিত্রনায়ক রাজ্জাক। নায়করাজ। তাঁকে ঘিরেও একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে অন্যদিন। এই সংখ্যায় তাঁর জিরো থেকে হিরো হওয়ার কথা, তাঁর নায়িকারা, সেরা ১০ চলচ্চিত্র, সেরা গান, চলচ্চিত্র পরিচালনা, সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে ভূমিকাসহ নানা বিষয়ের ওপর আলো ফেলা হয়। লিখেছেন আজিজুর রহমান, সাজেদুল আউয়াল, খুরশীদ আলম, কোহিনূর আখতার সুচন্দা, আলী ইমাম, ফরিদুর রেজা সাগর, শাইখ সিরাজ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিন রহমান, মোরশেদুল ইসলাম, মোমিন রহমান, বিধান রিবেরু এবং আবদুল্লাহ জেহাদ। তাঁকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছও ঠাঁই পেয়েছে এ সংখ্যায়। কবিরা হলেন মুহম্মদ নূরুল হুদা, নাসির আহমেদ, হাসান হাফিজ, ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম এবং আরিফ মঈনুদ্দীন। আর রাজ্জাককে নিবেদিত পদ্য রচয়িতা হলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছে: “রাজ্জাক তথাকথিত নায়কচরিত্রের বাইরেও অভিনয় করেছেন এবং সেইসব চলচ্চিত্র দর্শক-সমালোচকদের হৃদয়ও স্পর্শ করেছে। তবে একটি কথা, সবসময় যে তিনি স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন তা নয়। কখনো কখনো মেলোড্রামার ভূতও তাঁর ঘাড়ে ভর করেছে। তারপরও এদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রাজ্জাকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।”

গত শতকের নব্বই দশকে এদেশের চলচ্চিত্রের আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। অশ্লীলতা গ্রাস করেছিল চলচ্চিত্রশিল্পকে। তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শক চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তাদের আবার চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট করেন কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, নির্মাতা এবং চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ। এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তাই অন্যদিন তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর কথা পাঠকদের অবগত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে (১৯৯৮ থেকে ২০১২) বেশ কয়েকটি প্রচ্ছদ রচনা উপস্থাপন করে। বলাই বাহুল্য, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘৯ নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’—এইসব চলচ্চিত্রের ওপর প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশিত হয়। আর এখানে পরিচালকসহ কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকারও ঠাঁই পায়। উল্লেখ্য, হুমায়ূনের প্রতিটি ছবি মুক্তির আগে এবং পরে দুটি করে প্রচ্ছদ রচনা পাঠকদের উপহার দিয়েছে অন্যদিন।

চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম অন্যদিন-এর মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৯৮-এর সেপ্টেম্বরে। তখন তিনি গাজীপুর জেলার ইন্দ্রপুরে নির্মাণ করছিলেন তাঁর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। ওই সময় তিনি অন্যদিন-এর কাছে বলেছিলেন: “খুব বেশি স্বাতন্ত্রিক কিছু দিয়েছি, এটা আমি বলতে পারছি না, তবে একটা জিনিস আমি দিয়েছি যে বাংলাদেশ কী এবং বাংলাদেশের বিউটিটা যে কী এটি আমি ছবিতে অবশ্যই দিয়েছি। এই ছবি যে দেখবে—বিদেশের মানুষ যদি দেখে বা দেখবে যে, হাউ সুইট বাংলাদেশ ইজ, হাউ বিউটিফুল ইট ইজ।” এই নিবন্ধকার হুমায়ূন আহমেদের মুখোমুখি হয় শেষবারের মতো, শ্রীমঙ্গলের একটি রিসোর্টে, ‘আমার আছে জল’-এর আউটডোর শুটিংয়ে, ২০০৮-এর মার্চে। তখন তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “নিজের লেখা বইটিই আমার প্রথম পছন্দ। তবে বইটি যখন চলচ্চিত্র বা নাটকে আমি ট্রান্সফার করি, তখন এই ট্রান্সফার প্রক্রিয়াটি আমার ভালো লাগে। বইতে যা আমি লিখেছি, তা আমি ট্রান্সফার করতে পেরেছি নাকি পারি নি তা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়।”

হুমায়ূন আহমেদ নানা সময়ে অন্যদিন-এর কাছে বলেছেন যে, তিনি রাজধানীর পথেঘাটে পাইপে বাস করা মানুষদের নিয়ে ছবি বানাবেন, ‘গুহামানব’ নামে। একটি ভূতের ছবি বানানোর ইচ্ছাও তাঁর ছিল। ‘জলজোছনা’ এবং ‘নির্বাসন’ উপন্যাস দুটি অবলম্বনেও ছবি বানানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। এমনকি ‘নির্বাসন’-এর চিত্রনাট্যও তিনি লিখেছিলেন। কিন্তু এটি হারিয়ে গেছে।

পৃথিবীর প্রথম নারী চলচ্চিত্রকার এলিস গাই ব্লাশে। ফরাসি এই চলচ্চিত্রকারের প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য গুড ফেইরি ইন দ্য ক্যাবেজ প্যাট’। ব্লাশের পরে বিশ্ব চলচ্চিত্রাঙ্গনে বেশ কয়েকজন নারী চলচ্চিত্রকার আত্মপ্রকাশ করেছেন এবং তাদের চলচ্চিত্র সাড়া ফেলেছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের অপর্ণা সেন, মীরা নায়ার, দীপা মেহতাসহ বেশ কয়েকজন নারী চলচ্চিত্রকার বিশ্বের চলচ্চিত্রামোদী দর্শকদের আলোড়িত করেছেন।

এদেশের প্রথম নারী চলচ্চিত্রকার হচ্ছেন রেবেকা। এরপর আরও কয়েকজন নারী চলচ্চিত্রকার আবির্ভূত হয়েছেন মূলধারার চলচ্চিত্রে। যেমন—রোজী, সুজাতা, সুচন্দা, নারগিস আক্তার, শামীম আখতার, কবরী, মৌসুমী, সামিনা জামান, শাহনেওয়াজ কাকলী, মেহের আফরোজ শাওন, রওশন আরা নীপা, গীতালি হাসান। ২০১৭-এর ২৭ জানুয়ারি মুক্তি পায় তানিয়া আহমেদ পরিচালিত ‘ভালোবাসা এমনই হয়’। এই উপলক্ষে অন্যদিন প্রকাশ করে প্রচ্ছদ রচনা—‘বাংলাদেশের নারী চলচ্চিত্রকার: রেবেকা থেকে তানিয়া’।

তরুণ চলচ্চিত্রকারদের চলচ্চিত্রকর্ম নিয়েও অন্যদিন প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশ করেছে। এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যে ছবিটি নেটপ্যাক অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে এবং গুটেনবাগ চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ছবি হিসেবে, সেই ‘নোনাজলের কাব্য’ নিয়ে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে অন্যদিন প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশ করেছিল। ছবিটির পরিচালনা করেছেন তরুণ চলচ্চিত্রকার রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। সুমিতের এই অভিষেক চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু, এদেশের উপকূলবর্তী মানুষদের সংগ্রামী জীবন। আর পুরো ছবিটির শুটিং হয়েছে উপকূল এলাকায়ই, যা আগে কখনো দেখা যায় নি।

২০১৯-এর ডিসেম্বরে অন্যদিন আরেক তরুণ চলচ্চিত্রকারের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিয়ে প্রকাশ করে একটি প্রচ্ছদ রচনা। চলচ্চিত্রটির নাম ‘গহীনের গান’ এবং চলচ্চিত্রকার সাদাত হোসাইন। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সাদাতের এটি একটি নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র। নিরীক্ষা এই অর্থে ছবিটি একটি গাননির্ভর চলচ্চিত্র। এ ধরনের চলচ্চিত্র আগেও নির্মিত হয়েছে। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে গান সংলাপের কাজও করেছে। কিন্তু সেইসব ছবির সঙ্গে এই ছবির পার্থক্য হলো, আগের ছবিগুলোতে গান এসেছে গল্পের প্রয়োজনে কিন্তু এখানে গানের প্রয়োজনে গল্পকে তৈরি করা হয়েছে।

এবার ঈদসংখ্যা প্রসঙ্গ। ঈদসংখ্যা মানেই বিশেষ লেখা। শুধু বিনোদন নয়— পাঠক যেন নানাকিছু জানতেও পারে। অন্যদিন ঈদসংখ্যায় ঠাঁই পাওয়া চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখাগুলোতেও এই বিষয়টির প্রতিফলন দেখা যায়। ১৯৯৮ থেকে ২০১৯— এই সময়ে প্রকাশিত অন্যদিন ঈদসংখ্যার চলচ্চিত্রবিষয়ক উল্লেখযোগ্য লেখা হলো: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তারকা নায়িকা: পপি থেকে পপি/ মোমিন রহমান ও নবীন হোসেন; বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সংকট ও উত্তরণের পথ/ অনুপম হায়াৎ; বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র-ভাবনা/ মোমিন রহমান; ঘুরেফিরে ঘুড্ডি: সুতো এখনো কাটে নি/ সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী; আমার চোখে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ষাট দশক/ সুভাষ দত্ত; প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রেসিডেন্ট এবং আমি/ ফরিদুর রেজা সাগর; ইসলামী বিপ্লবোত্তর ইরানি চলচ্চিত্র: পশ্চিমা ভুরুর আকাশে উড্ডয়ন/ বিধান রিবেরু; অস্কারের সেরা দশ/ শহীদ সরোয়ার; বাংলা চলচ্চিত্রে জীবনের নানা রঙ/ মোমিন রহমান; আমি ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব/ ববিতা; চিত্রনাট্য: ঘেটুপুত্র কমলা/ হুমায়ূন আহমেদ; কিংবদন্তি অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডো/ সারিকা পারভীন; আমার প্রিয় দশ ছবি/ মৌসুমী; বাংলা চলচ্চিত্রে জীবনের তিন অধ্যায়/ মোমিন রহমান; অস্কার বিজয়ী দুই নারী চলচ্চিত্রকার/ সাকিরা পারভীন; কিয়ারোস্তামির সরল বয়ানে ‘হয়ে ওঠার’ দর্শন/ বিধান রিবেরু; বাংলা চলচ্চিত্রে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য/ মোমিন রহমান; বাংলা চলচ্চিত্রে নদী/ মোমিন রহমান; শতবর্ষী বাংলা চলচ্চিত্র: বিকাশের ধারা ও নতুন মাত্রা/ মোমিন রহমান। এই তালিকা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট এবং সেটি এই যে, বাংলা এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গ এইসব রচনায় উঠে এসেছে।

১০

নানা সময়ে প্রকাশিত অন্যদিন ঈদ আনন্দ সংখ্যায়ও চলচ্চিত্র স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় বর্ষ ২-৩ সংখ্যায় ছিল ‘উত্তমকুমার: মহানায়কের প্রতিকৃতি।’ এখানে উত্তমের জীবন, কেরিয়ার, উল্লেখযোগ্য ছবি, নায়িকা-পরিচালকবৃন্দসহ নানা কিছু মূর্ত হয়ে উঠেছে। একই সংখ্যায় রয়েছে ‘ঈদের ছবি: ২৫ বছরের ইতিবৃত্ত’ শীর্ষক দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন। সেখানে দেখা যায়, ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬—এই পঁচিশ বছরে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে ১৬১টি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ঈদ উল ফিতরে ৮৯টি এবং ঈদ উল আযহায় ৭২টি। উল্লেখযোগ্য ছবি, পরিচালক, নায়ক-নায়িকাসহ নানা প্রসঙ্গ এখানে আলোচিত হয়েছে।

১৯৯৮-এর আনন্দ সংখ্যায় রয়েছে ‘কৌতুকের নায়কেরা’ শীর্ষক ফিচার। এখানে সাইফুদ্দিন থেকে তুষার খান—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য কৌতুকাভিনেতাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। শেষে মন্তব্য করা হয়েছে—“আমাদের চলচ্চিত্রের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে অনেক কৌতুক অভিনেতা এসেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক অভিনেতাই নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পেরেছেন।” একই সংখ্যায় রয়েছে নায়করাজ রাজ্জাকের আত্মকথন ‘বেলা অবেলার গল্প’।

ঈদ আনন্দ সংখ্যায় ঠাঁই পাওয়া উল্লেখযোগ্য অন্য রচনাসমূহ হলো—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তারকা নায়ক: রাজ্জাক থেকে রিয়াজ (বর্ষ ৪ সংখ্যা ২); বাংলা চলচ্চিত্রে আবহসংগীত (বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৬); বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খলনায়ক ও খলনায়িকা (বর্ষ ৫ সংখ্যা ২৩); চলচ্চিত্রে স্টান্টম্যান: মৃত্যুর সঙ্গে খেলা (পূর্বোক্ত); তারকাদের জীবনে দাম্পত্য সংকট (বর্ষ ৭ সংখ্যা ২৩); বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা চার জুটি (বর্ষ ৮ সংখ্যা ২১); সেরা পাঁচ ভৌতিক ছবি (পূর্বোক্ত)।

১১

অন্যদিন বৈশাখী সংখ্যা ১৪১১-তে প্রকাশিত হয় ‘বাংলা চলচ্চিত্রে ছয় ঋতু’। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ষড়ঋতু কীভাবে উঠে এসেছে, সেটিই এই রচনার উপজীব্য।

বৈশাখী সংখ্যা ১৪১২-এ ঠাঁই পেয়েছে ‘সত্যজিৎ রায়: অনন্যসাধারণ এক চলচ্চিত্রকার’ শীর্ষক প্রবন্ধ। এখানে রায়ের সমস্ত চলচ্চিত্রকর্মের ওপর আলো ফেলা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, টেলিফিল্ম এবং প্রামাণ্যচিত্রসমূহের কথা।

১২

চলচ্চিত্রকে ঘিরে অন্যদিন-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, ২০০৫ সালে একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা। ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ৫০ বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শিরোনামের এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন ১৮জন চলচ্চিত্রকার। তারা হলেন সুভাষ দত্ত, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, দীলিপ বিশ্বাস, আবদুল লতিফ বাচ্চু, শিবলী সাদিক, এ জে মিন্টু, সি বি জামান, কাজী হায়াৎ, বাদল রহমান, শাহজাহান চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম খোকন, মতিন রহমান, বাদল খন্দকার, তারেক মাসুদ, মুস্তাফা সরয়ার ফারুকী এবং সালাউদ্দিন লাভলু। এখানে নানাজনের আলোচনায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশ, সংকট এবং সম্ভাবনার বিষয়টি উঠে এসেছে।

২০১৬-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘তারুণ্যের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রে তারুণ্য’ শীর্ষক এক আড্ডায় অন্যদিন-এর মুখোমুখি হয় সাত তরুণ চলচ্চিত্রকার। তারা হলেন—সোহেল আরমান, মোস্তফা কামাল রাজ, শাহনেওয়াজ কাকলী, মাসুদ আখন্দ, রেদওয়ান রনি, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল এবং সামুরাই মারুফ। তারা কমার্শিয়াল এবং আর্ট ফিল্ম, চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার, চলচ্চিত্রের দর্শক, চলচ্চিত্র সমালোচনা এবং নিজেদের ছবি নিয়ে কথা বলেন।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে এদেশের স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকারদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে; প্রকাশিত হয়েছে সোনালি যুগের নায়ক-নায়িকাদের আত্মকথন। দেশ-বিদেশের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব সম্পর্কেও বিভিন্ন প্রতিবেদন রচিত হয়েছে।

এভাবেই গত পঁচিশ বছরে অন্যদিন-এ উঠে এসেছে চলচ্চিত্রের বর্ণিল নানা দিক।

Leave a Reply

Your identity will not be published.