আমাদের কিওক্রেডাং বিজয়।। আহসান হাবীব

আমাদের কিওক্রেডাং বিজয়।। আহসান হাবীব

এভারেস্ট বিজয়ী মুহিতের সঙ্গে আমার একটা ছবি আছে। আমরা দুজন পাশাপাশি বসে আছি হাসি মুখে। ভাবলাম এই দুর্ধর্ষ অভিযাত্রীর সাথে ছবিটা ফেসবুকে দেওয়া যাক। দেওয়া হলো। নিচে লিখলাম, ‘এভারেস্ট বিজয়ী মুহিতের সঙ্গে কিওক্রেডাং বিজয়ী আহসান হাবীব।’ বলাই বাহুল্য প্রচুর লাইক পেলাম। হ্যাঁ, আমার সেই কিওক্রেডাং বিজয়ের গল্পই আজ বলতে বসেছি। 

আমার মেয়ে এষা যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেমসন ইউনিভার্সিটিতে মাইক্রোবায়লোজী পড়তে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে সে দেশের কোথাও ঘুরতে যেতে চায়। বহু চিন্তাভাবনা করে ঠিক করলাম, দেশের সর্বোচ্চ পর্বত কিওক্রেডাং বিজয় করলে কেমন হয়? কিন্তু একজন গাইড তো লাগবে। আমি আবার একা কোথাও যেতে পারি না। যোগাযোগ করলাম জুন্নুনের সঙ্গে। সে হচ্ছে একজন ‘ভূ-পর্যটক’, একই সঙ্গে কম্পিউটার উইজার্ড। আমাদের উন্মাদ-এ কম্পিউটার বিষয়ক যাবতীয় ঝুট-ঝামেলা সামলাত। দেশের হেন জায়গা নেই জুন্নুন সেখানে যায় নি। সেই শুরুতে সাজেক যাওয়া যখন নিষিদ্ধ ছিল, তখন সে সেখানে ঘুরতে গিয়ে বিডিআরের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছে। তারপরও তার ঘুরতেই হবে। 
জুন্নুন সানন্দে আমার গাইড হয়ে গেল। তবে সে সঙ্গে একজন ভারতীয় পর্যটককে নিতে চাইল, সে নাকি আমাদের দেশটা দেখতে চায়। আমি আপত্তি করলাম না। তার মানে দলে হলাম আমি, আমার স্ত্রী আমার কন্যা, আমার ছোট বোন তার মেয়ে তিথি...ছেলে তিনজন, মেয়ে চারজন। চার আর তিন লাকি সেভেন। যাত্রা হলো শুরু...

কোথায় যেন পড়েছিলাম, ভ্রমণে তিনটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে। ইনফরমেশন, নলেজ এবং উইসডম। ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ধরুন আপনি কক্সবাজার বেড়াতে গেলেন। সেখানে নাকি কোন কোন বীচে চোরাবালি আছে। এখন জানতে পারলেন উখিয়া বীচে চোরাবালি আছে, সেটা ইনফরমেশন। এখন চোরাবালি কীভাবে কাজ করে এটা জানতে হবে। সেটা নলেজ। আপনি অন্য ভ্রমণপিয়াসুদের সতর্ক করার জন্য ওখানে মানে ঊখিয়া বীচের যেই চোরাবালির কাছে আপনি উপস্থিত হয়েছেন, সেখানে একটা লাল পতাকা রেখে আসবেন সাবধানতা হিসেবে সেটাই উইসডম। তো...আমি এই ফর্মুলায় কেওক্রাডাং নিয়ে ইনফরমেশন জোগাড় করতে শুরু করলাম। ইনফরমেশন জোগাড় করতে গিয়ে দেখি এটা নাকি সর্বোচ্চ না এর চেয়ে বড় পর্বত একটা পাওয়া গেছে সিপ্পি। কী জ্বালা! আমি চেপে গেলাম যেহেতু কেওক্রাডাং যাচ্ছি...এই মুহূর্তে এটাই সর্বোচ্চ। তবে আমার পরিচিত একজন জানাল কেওক্রাডাংয়ে সবাই যে হারে আজকাল সকাল বিকাল উঠছে নামছে তাতে করে এর হাইট নাকি অভিযাত্রীদের পাড়ায় ফুটখানেক ডেবে গেছে নির্ঘাৎ। যে আমাকে এই তথ্য দিল সে নিজেই প্রতি মাসে একবার, মাঝে মাঝে দুবার দলবল নিয়ে কেওক্রাডাং-এ ওঠে। তাকে আমি পরামর্শ দিলাম, এরপর থেকে যাদের নিয়ে উঠবে সবার হ্যাভারসেকে পাঁচ কেজি করে মাটি নিয়ে উঠবে। 
কেন মাটি নিয়ে উঠতে হবে?
বাহ তোমরা যেভাবে পাড়ায়া কেওক্রাডাং-এর হাইট কমিয়ে ফেলছ মাটি ফেলে ফেলে উঁচু করাও তোমাদের দায়িত্ব। 

যাই হোক ইনফরমেশন, নলেজ আর উইজডমের...উইজডোম-এর ব্যাপারে আর জ্ঞান না দেই। তবে এই ফর্মুলার শেষ কথা হচ্ছে, উইজডমটাই নাকি সমাজের কাজে লাগে। যা’হোক এখন বরং মূল ভ্রমণে ঢুকি। 
হ্যাঁ, আমরা একটা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করলাম, ফোর হুইল সিক্স সিলিন্ডার গাড়ি। আমরা যখন রওনা করলাম তখন আর্মির পারমিশন লাগত। তাদের ছাপানো একটা ফরমে লিখতে হলো কতজন যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কখন ফিরব ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ফরম প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে লিখতে হলো।
ফরমালিটিজ শেষ করে কিঞ্চিৎ খাওয়া-দাওয়া করে সেই চাঁদের গাড়িতে চড়ে বসলাম। সামনে জুন্নুন আর সেই ভারতীয় পর্যটক। পিছনে খোলা জিপে আমরা পাঁচজন। ভারতীয় পর্যটক তখন পর্যন্ত দেখলাম খুবই গম্ভীর। কোনো কিছুই তার কাছে তেমন আকর্ষণীয় লাগছে না। আমি আমাদের যাত্রাপথে সুন্দর কিছু দেখলেই যখন তাকে জিজ্ঞেস করি, কি ভাই কেমন দেখলেন ? সে মুখ বাঁকিয়ে মাথা নাড়ে। বলে... ‘এরকম আমাদের ওখানটায় আছে...।’ যা-ই দেখাই তা-ই নাকি তাদের ওখানটায় আছে। 

রুমা বাজার, বগা লেক এসব পেরিয়ে যখন আসলেই কিওক্রেডাং অভিমুখে আমাদের খোলা জিপ গর্জন করে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল, তখন আমি ভিতরে ভিতরে বেশ ভয় পেলাম। কারণ কোথাও কোথাও ভয়ংকর খাড়া রাস্তা। জিপ উঠতে গিয়ে মাঝে মাঝেই পিছলে নেমে আসে। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এভাবেই চলছিল। মহিলা যাত্রীরা মহাখুশি। তারা বেশ এ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেতে শুরু করেছে। হঠাৎ এক জায়গায় কোনো কারণে আমাদের গাড়ি থেমে গেল। আর উপরে তাকিয়ে আমার কলজে ঠান্ডা হওয়ার উপক্রম। তাকিয়ে দেখি বিশাল এক মাকড়শা স্রেফ শূন্যে ভাসছে...ভঙ্গিটা এমন এখনই সে খোলা জিপের ওপর লাফিয়ে পড়বে। আমাদের পরিবারের সবারই ব্যাপক মাকড়শাভীতি আছে। সবাইর দেখলাম মুখ শুকিয়ে গেছে। জিপের হেল্পার জানাল ভয়ের কিছু নেই, এই মাকড়শা শূন্যে ভাসছে না, সে তার অদৃশ্য সূক্ষ্ম জাল পেতে বসে আছে, শিকার ধরার জন্য; ছোট পাখিও নাকি ধরে ফেলতে পারে এরা তাদের জালে। তবে আমাদের জিপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরা এভাবেই থাকে। 
যাহোক গাড়ি ফের চলতে শুরু করল। 

আমি চাঁদের জিপ গাড়িতে কিওক্রেডাং বিজয় করতে যাচ্ছি শুনে অনেকেই মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল... ‘এ আর এমন কী এ্যাডভেঞ্চার! হেঁটে উঠতে তাহলে না বুঝতাম এ্যাডভেঞ্চার কত প্রকার ও কী কী।’ কিন্তু আমি হঠাৎ ভয়ংকর এক বিষয় আবিষ্কার করলাম। এ যেন এটম বোমা আবিষ্কারের মতো এক ভয়ংকর আবিষ্কার। ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠলাম! বিষয়টা হচ্ছে মাঝেই মাঝেই জিপ টার্ন নিচ্ছিল। এবং তখন আমি আবিষ্কার করলাম, সেই টার্নিং পয়েন্টগুলিতে বাইরের দিকে কোনো ধরনের ফেন্সিং নেই, তার মানে চাকা যদি একবার পিছলায় তাহলে মুহূর্তে গুলির মতো হাজার ফিট নিচের খাদে পড়তে হবে। আমি একবার খেয়াল করলাম জাস্ট এক হাত, নাকি তারও কম জায়গা রেখে গাড়ি টার্ন নিল। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এরা টার্ন নেয়ার সময় গাড়ির স্পিড কমায় না। এই প্রসঙ্গে একটা জোক না শোনালেই নয়। আমাদের মতোই এক পরিবার গাড়িতে করে উঁচু এক পর্বতে উঠতে যাচ্ছে। ভয়ংকর এক টার্ন নেয়ার সময় দলনেতা খেয়াল করল একটা সাইন বোর্ড, তাতে লিখা ‘এই ভয়ংকর টার্ন নেয়ার সময় সাবধান। নিচে দুই হাজার ফুট খাদ। তবে যদি পড়েই যান পড়ার সময় ডান দিকে তাকাতে ভুলবেন না। ওখানে অসাধারণ সুন্দর একটা সিঁড়ি আছে, না তাকালে মিস করবেন...ধন্যবাদ।’

পরে আমি আদিবাসী জিপ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ভয়ংকর টার্নগুলোর ব্যাপারে...সে হাসি মুখে বলল, ভয়ের কিছু নেই। এই পাহাড়ের রাস্তা আমার মুখস্থ। কোথায় কয়টা টার্ন আছে রাস্তা কোথায় সরু কোথায় চওড়া সব তার মুখস্থ। চোখ বন্ধ করেও নাকি সে চালাতে পারবে। তাকে চোখ বন্ধ করে না চালাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলাম। তবে তাকে আর বললাম না আমি ভূগোলের ছাত্র, পাহাড়ের আইসসটেসি থিওরি পড়েছিলাম বহু আগে। সেটা এখনো কিছু মনে আছে। পাহাড়ও নদীর মতো ভেঙে পড়ে কখনো কখনো, সকালে যে চওড়া রাস্তা সেটা বিকেলে অর্ধেক হতে কতক্ষণ।

যাই হোক অবশেষে বিকেলের দিকে সত্যি সত্যি আমরা উঠে এলাম সদলবলে কিওক্রেডাংয়ের চূড়ায়... আহ কিওক্রেডাং! দেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত। ছোট্ট একটা পাথরের ওপর খোদাই করে এর উচ্চতা ইত্যাদি লিখে রেখেছে কেউ। সত্যি অসাধারণ অনুভূতি। চারিদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চারিদিকে ছোট বড় পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়... তার উপর মেঘের কালো ছায়া। মেঘগুলো সরে যাচ্ছিল বলে ছায়াগুলোও সরে যাচ্ছিল বারবার... সে কারণে আশেপাশের পাহাড়গুলোকে জীবন্ত মন হচ্ছিল কেন যেন। আমি আমাদের সঙ্গের ভারতীয় কো-অভিযাত্রীকে বললাম ‘কি এবারও...আপনাদের ওখানে আছে?’ এবার অবশ্য সে মুখ বাঁকিয়ে কোনো মন্তব্য করল না, তার চোখে মুখেও মুগ্ধতা। আর আমাদের মহিলা যাত্রীদের কথা কী বলব...তারা তখন ভাবছে রাতটা এখানে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়!
 
ঘণ্টাখানেক পাহাড়ের চুড়ায় কাটিয়ে আমরা নামতে শুরু করলাম। আলো কমে আসছে, দ্রুত ফিরতে হবে। আবার সেই ভয়ংকর রাস্তা দিয়ে নামতে হবে। বেশ বুঝতে পারছিলাম দেশের এই সর্ববৃহৎ পর্বতের চূড়ায় আর কখনো আসা হবে না। কেন যেন জীবনানন্দ দাশের কবিতাটা মনে পড়ল, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর...।’

Leave a Reply

Your identity will not be published.