সাক্ষী: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সাক্ষী: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

মনির দৌড়াচ্ছে সিন্দুরতলা খালের ডান পাশ ধরে। আকাশের কালো রং পাতলা হয় হয় ভাব। বনে তখনো জমানো অন্ধকার। আরও ঘণ্টাখানেক বাকি ভোর হতে। খালের দিকে নতুন মাটি এখনো আলগা। পা হড়কে যেতে চায় বারবার। বাঁ দিকের ছাড়া ছাড়া বসতির ভেতর তখনো ঘুম নিজের পলেস্তারা ঠেসে ধরেছে। এরা সারা দিন জঙ্গলে কাঠ কাটে, গোলপাতা ডাই করে ভাটিতে ভাসিয়ে আনে। কেউ যায় পশরের চ্যানেলে জাহাজে জাহাজে মালের সাপ্লাই দিতে, মজুরি করতে। সারাদিনের দানধ্যানে রাতের ঘুম হচ্ছে বেহেশতের দরজা দিয়ে প্রবেশের মতো।

এর মধ্যেও কেউ কেউ আছে নিশুতি। তারা বসতির চেয়ে বেশি বনের মানুষ। মাঝেমধ্যে আসে এদিকে আপনজনের টানে। তবে আজ সুন্দরতলা খালের বাঁ পাশের ঘরবাড়িগুলোতেও দু-একজন কয়েকবার ঘুমের ভেতর পাশ ফিরে শুয়েছে। হঠাৎ মাঝরাতে নিঃশব্দে একটা গাড়ি ঢুকেছে গ্রামে। কারও কারও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছে গেছে সে খবর। বসতির একজন অবশ্য আগে থেকেই চলে গেছে খাল পেরিয়ে বাদারে। ওখান থেকে তার বাড়ির খানিকটা দেখা যায়। আবার চাইলে মুহূর্তে বনের অন্ধকারে হাওয়া করে দেওয়া যায় নিজেকে। সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়েছে সে।

গাড়ি তার বাড়ির সামনে থামে নি। আরও অনেকখানি ভেতর পথে এগিয়েছে। নিশ্চিত হয়ে এবার অন্ধকারে নিজেকে একেবারে মিশিয়ে দিল মানুষটা। বনের গাছ যে কতরকম আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে রাখে তা শুধু বাদারের মানুষই জানে!

কিন্তু মনির জানে মানুষটা বাড়িতে আছে। ফোন করে যে তৈরি হতে বলবে সে সময় আর এখন নেই। টেনে নিতে হবে। তবে যে গোঁয়ার মানুষ! তাই এতখানি দৌড়াতে হচ্ছে মনিরকে। ওই বাড়ির পরেই নিচু জমি। ঘোরা পথে সেখান দিয়ে খালে নেমে যাবে দুজন। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে দৌড়াচ্ছে মনির। চোখের পাশ দিয়ে গাড়ির মতো ছুটে চলে গেল ফজলুর উঠোনের খেজুরগাছ, হরেন কাকার ঘরের চালে দেওয়া ছেঁড়া জালের তলায় লতানো কুমড়ার লতা, আয়েশার বাড়ির সামনের কাঠের বেঞ্চটা। মনির থামে নি। ভরসা এখনো তার পায়ের শব্দ টের পায় নি পেছনের কেউ। কিন্তু অনুপস্থিতিই যথেষ্ট। অনেকক্ষণ হয় সে নেই। এখনই বুঝে ফেলবে।

রাস্তায় নতুন মাটিতে দুরমুজ পেটা শুরু হয় নি। এই পথে বিটুমিন, ঢালাই হবে না। বড়জোর ইট বসবে খাবলা খাবলা করে। তবে সব এখন হয়ে গেলে মানুষ মনে রাখবে না। মানুষ দ্রুত ভুলে যায় জানে এলাকার মুরব্বিরা। আরও অন্তত ছয় মাস পর হবে সেসব। ভোটের আগে আগে। এই পথ দিয়ে গাড়ি আসার চেয়ে দৌড়ানো বেশি কঠিন।

আকাশের রং বলছে জোয়ার আসতে আরও অন্তত ঘণ্টা তিনেক বাকি। এখন খালের পানি হাঁটুসমান। আর একটু বাঁয়ে ঘুরলেই বাঁকটা। ওখান দিয়ে নামলে পানি একেবারে কম। তবে ভাটায় খুঁটি পুঁতে যায় জেলেরা এই খালে। জোয়ারে পশর থেকে মাছের স্রোত এসে আটকায়। এই অন্ধকারে খুঁটির ভেতর পা হড়কালে সব শেষ। শব্দও হবে। তাই ওদিক দিয়ে ঝুঁকি নিচ্ছে না মনির। তার আগে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাধুকে সঙ্গে নেওয়া। দুপুরে ফোনে ইশারা দেওয়ার সময় বিশেষ পাত্তা দেয় নি সাধু খবরটার। বলেছিল, তুমি সাবধানে থাকো।

বুড়ি ছোঁয়ার মতো যেভাবেই হোক একবার ওপাশে পৌঁছাতে হবে তাদের। আর একটু পথ, তারপরই শেষ মাথায় সাধুর বাড়ি। সব শক্তি দিয়ে আরও গতি বাড়াল মনির। শব্দ না করতে ভর দিতে হচ্ছে পায়ের আঙুলে। টান ধরে আসছে। জীবনে কতবার সে এমন দৌড়েছে! হেঁতাল কাঁটার পথ মাড়িয়ে, খাড়ি ধরে, বড় বড় গরান গাছের পাশে কাটা ঝোঁপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চোখের পলকে পার হয়ে গেছে বাদাবনের বহু অজানা মানচিত্রের ভেতর! তবে সিন্দুরতলা গ্রামের ভেতরের এই পথ দিয়েই মনিরকে আরও একবার দৌড়াতে হয়েছিল, রাতে, প্রায় এমন সময়েই।

মোংলা ঘাটে পৌঁছাতে দরকার ছিল একটা ভ্যান। ফাতেমার ব্যথা শুরু হয়েছিল মাঝরাত থেকে। আগে থেকে ব্যবস্থা করা যায় নি। তখন মুঠোফোনের যুগ ছিল না। বাড়ি থেকে আস্তানায় খবর পৌঁছাত মুখে মুখে। একজন কেউ ঘাটে বলে এলে, সাধু মণ্ডল তাঁর ছোট নৌকা নিয়ে যেত বাদা ধরে ধরে। ছোট খাড়ির মুখে পৌঁছে যেত নিঃশব্দে। বনে নেমে মনিরদের সীমানা চৌকি পাহারা দেওয়া কারও একজনের কাছে বলে আসত খবরটা। সেখান থেকে ঘাঁটি আর কত দূর! সব সময় যে এক জায়গায় থাকত তাও নয়। আজ ট্রলারের বহরে তো কাল ডাঙার বাদারে।

ফাতেমার তারিখ মনে রেখে এক দিন আগেই বন থেকে উঠে এসেছিল মনির। প্রথম বাবা হবে সে। র‌্যাব, পুলিশের তোয়াক্কা করে নি। কিন্তু শ্যালা নদীতে ওই রাতেই কয়লার কার্গোটা ডুবতে হলো! কপাল কাকে বলে! আর সব শালার আমোদের শেষ নাই। চলে গেল তামাশা দেখতে। কেউ কেউ তো প্লাস্টিকের বোতল, ক্যান হাতে গিয়েছিল। তেলের নাকি পরত পড়েছিল শ্যালার পানিতে। একজনকেও পাওয়া গেল না যে ফাতেমাকে নিয়ে মোংলা ঘাটে পৌঁছে দেয়। শেষ ভরসায় সেই সাধুই ছিল মনিরের সাথে। নুরি এল সংসারে। সবাই বলল পয়মন্ত হয় পয়লা মেয়ে। মনিরেরও তাই বিশ্বাস। মেয়ের জন্মের কিছুদিন পরই সুযোগটা এল। তারও আর সহ্য হচ্ছিল না ওই জীবন। বিড়াল থেকে বাঘ হওয়ার ক্ষমতা উদ্যাপন করা যায় কিন্তু বাঘ থেকে বিড়াল হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা খুব তীব্র।

কত দিন আগের কথা, প্রায় ১৬ বছর। অথবা কয়েক বছর কম। তখন শরীরে তাগত ছিল। এখন ঊরুর মাংসে ওজন বেড়েছে। বয়সের উপহার। তবুও রক্তের তেজ এত সহজে যায় না সবার। মনির জানে খালের ওপাশে একবার পৌঁছাতে হবে শুধু। আর একটু পথ। ডান দিকের নিচু জায়গা ধরে নেমে গেলে এখনই খাল পাওয়া যায় কিন্তু পানির শব্দ উঠবে আর একা সে যাবে না। সাধু তৈরি কি না মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যাচ্ছে মনিরের। ঠিক তখনই জ্বলে উঠল গাড়ির হেডলাইটটা। যেন হাসপাতালের অপারেশন-টেবিলে রোগীর মাথার ওপরে এক সাথে জ্বলে উঠল সবগুলো আলো।

ওই গাড়ির পেছনে বসেই আজ দশানি থেকে সিন্দুরতলায় এসেছে মনির। কিন্তু সন্দেহটা প্রথম থেকেই ছিল। বড় স্যারের কথায় গন্ডগোল সে টের পেয়েছে। গত দশ বছর ধরে থানায় যাতায়াতের ফলে এসব কোড নম্বর সে বুঝতে শিখেছে। এককালে সেও তো এসব সাংকেতিক কথাবার্তা চালিয়েই যোগাযোগ করেছে মহাজনদের সাথে, নিয়ন্ত্রণ করেছে দলের। কে আর কবে শুনেছে নিত্যদিন সুন্দরবনের জলদস্যুরা ডাকাতি করতে গুলি ছুড়ছে? সব মিডিয়ার তুবড়ি। কয়বার অপহরণ হয়েছে জেলে? দু-দশ পয়সার কাজ করতে কখনো গরিব জেলেদের আটকায় নি মনিরের দল। তাদের দখল ছিল চাঁদপাই রেঞ্জ ধরে। শ্যালা পশরের মাদার ভেসেল যে পথে দিনে যায়, সেসব পথে রাতে যাতায়াত করত তার দল। প্রথম বেইমানি করে বসল কালাবগির নিরঞ্জন হালদার। ঝড়ে কোলের ছেলে আর ওর বৌসহ বাড়িটা তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে যেন কেমন হয়ে গেল নিরঞ্জন। তাগত কমে গেল। টকটকে লাল দুই চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকত। শেষমেশ পুলিশের কাছে গিয়ে নিজেই রাজসাক্ষী হলো। শুরু হলো দলের ভাঙন।

কালো পোশাকের দল তখন মাঠে নামে নামে ভাব। এত দিন ধরে বিড়াল হয়ে থাকা বনঅফিসগুলো যেন একটু একটু করে বাঘ হতে শুরু করল। প্রায়ই তাঁরা আবাদ থেকে অবৈধভাবে যাওয়া জেলেদের পেয়ে যায়। মাছের নৌকা আটকায়। মধুর গ্যালন পায়। আরও যে কত কিছু পায় ইয়ত্তা নাই। এত দিন যেন তাদের চোখে কালো কাপড়ের ঠুলি বাঁধা ছিল। মনির নিজের হিসাবে বলতে পারে, দুজন অফিসার ছয় বছরে কত টাকার গড়ান চালান করেছে আর হিস্যা নিয়েছে কত লাখ টাকার। হঠাৎ পাল্টে যেতে থাকল সব। আস্তে আস্তে দলের জোর কমতে শুরু হলো। মনিরেরও আর ভালো লাগে না এত উথাল-পাথাল সারাক্ষণ। নুরি সবে হাঁটতে শিখেছে। মা ডাকার আগে বাপ ডাকে। কোন কোন দিন বাপকে পেলে তার পেটের ওপর কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকে। তাই দেখে ফাতেমা হেসে হেসে বলে, জাত সাপের বাচ্চা। কিন্তু মনিরের মনে তখন অন্য কথা তোলপাড় হয়। এই মেয়ে বড় হয়ে কী জানবে? ওর বাবার পেশা কী!

মনির বাদায় ফেরে। ভালো-খারাপের খবরের জিম্মা থাকে সাধু মণ্ডলের হাতে। কত আর বয়স মানুষটার! প্রায় মনিরেরই সমান। শ্যামনগর থেকে পালিয়ে এসেছিল মিথ্যে খুনের মামলায়। তারপর যা হয় এসব গাঁও গেরামে। পুলিশ দেখেও দ্যাখে না। কিছুদিন পর ভুলে যায় সবাই। সাধু মণ্ডলকে সিন্দুরতলায় আশ্রয় দিতে মনিরই প্রথম দাবি জানিয়েছিল। পিছ কিনারে কথা উঠলেও পরে আর ধোপে টেকে নি। সাধু নিজের চরিত্রের প্রমাণ দিয়েছে। এক চুল অসততা নেই মানুষটার ভেতর। যা করে তা সর্বোচ্চ দায়িত্ব নিয়ে করে। বাদায় শেষ দিকে খুব যন্ত্রণা বাড়ছিল। আজ এখানে ডেরা বানালেই কাল সেখান থেকে সরে যেতে হয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বাঁশির শব্দ তাদের ঠেলে দিয়েছে আরও গভীর বনের দিকে। এভাবে চালানেও ভাটা পড়ল। মহাজনেরা তত দিনে বিকল্প রাস্তায় মাল আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। দলের আয় তখন শুধু মাছ আর মধুর হিসাবের দিকে আটকে যাচ্ছে। মহাজনদের অস্ত্র আর গুলি তখন অন্য পথে যায়। বিড়াল হতে হতে মনিরের ভয় বাড়ল। মেয়ের দৈর্ঘ্য বাড়ল। অবশেষে এল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা।

কপাল তেমনি। রাজধানী থেকে সরাসরি যোগাযোগ করল মনিরের সাথেই। দলসহ আত্মসমর্পণ করলে সুস্থ জীবনে ফেরার নিশ্চয়তা। কয়েক মাস ধরে আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনে ফিরল মনির। চলে গেল বাগেরহাটের দশানিতে। মোটর গ্যারেজ দিয়েছে। চোখ নামিয়ে সালাম-আদাব দিয়ে চলে সকলকে। কিন্তু কোনো প্রতিবেশী কখনো পা রাখল না তার ভাড়া বাড়ির বারান্দায়ও। ভেতরে-ভেতরে ফাতেমা আর নুরির কাছে কুঁকড়ে যায় বন দাপিয়ে বেড়ানো মানুষটা। শুরু হলো আরেক টানাপোড়েন। যখন-তখন থানায় তলব। চাহিবামাত্র আসামি হাজির হতে বাধ্য। এখন সে গোপনে সাক্ষীদাতা। এই করে করে গত দশ বছরে সে থিতু হয়েছে একরকম। কিন্তু ভেতরে ক্ষরণটা পশরের জোয়ারভাটার মতোই চলে। ইনফরমার জীবনের গ্লানি ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। র‌্যাব-পুলিশের সাথে চলতে চলতে সে জেনে গেছে টু-ও ও-টু এর অর্থ। বিয়ে বাড়ি হলো অভিযান, থ্রিপিছ মানে অস্ত্র। এমন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ নিজের দলেও ছিল। তবে সেসব ভাষা আরেকরকম।

ওপরে ওপরে জীবন আসলেই বদলেছে মনিরের। মোটর গ্যারেজের মালিক মনিরের মেয়ে নুরি আর  ক’দিন পর স্কুল শেষ করবে। ফাতেমার বয়স বেড়েছে। সব সামলে খারাপ নেই সে। তবুও থেকে থেকে হঠাৎ সেই বাঘটা লাফিয়ে বের হয়ে আসতে চায়। তড়পায়, হাত কামড়ায় নিজের। বিশেষ করে হাজিরা দিয়ে নতুন তথ্যের জোগান দিতে না পারলে যে সব ভাষা শোনে, এই ভাষা কেউ তার মুখের সামনে উচ্চারণ করলে এককালে তার বডি নামিয়ে দিত নালায়। এখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নিজে। কখনো কখনো ইঙ্গিতও হজম করে নিতে হয়। সেদিন বনের এক কর্মকর্তা এসেছিল পুরোনো জায়গায় বেড়াতে। এককালে তাঁর বনঅফিসে মনিরের দল রাতে ভিসিআর দেখত। তিনি পাশের ঘরে চুপচাপ বসে থাকতেন বা অন্য কোথাও চলে যেতেন। এখন বড় কর্মকর্তা হয়েছেন। ঢাকায় পোস্টিং। মনিরকে দেখে এমন তাচ্ছিল্যের চোখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন, মনে হলো একটা ইঁদুর দেখেছেন ঘরের ভেতর। ইঁদুরকে  তাও মানুষ একটু ভয়-ঘেন্না করে। মনির জানে এই দহন তার মনে-শরীরে ছাপ ফেলেছে। নিজেকে এখন নিজেরই কেঁচোর মতো লাগে। সে আটকা পড়েছে ফাঁদে। সব কথাই রেখেছে তাঁরা। শুধু দুটো মামলা ঝুলিয়ে রেখেছে প্রশাসন। একটা খুন, অন্যটা অস্ত্র মামলা। অথচ দুটোই তার ঘাড়ে চেপেছে শুধু দলনেতা হওয়ার দায়ে। মনির ছিল শুধু বাহক। অস্ত্র যিনি পাঠিয়েছেন তিনি এখন রাজক্ষমতার খুব কাছে বসে আছেন। খুনটা করেছিল দলের এক গরম রক্তের ছেলে। শরণখোলার আরেক দলের সাথে নামার এক জায়গার ভাগাভাগি নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষ। ঘটনাটা উল্টোও হতে পারত। কিন্তু মামলার প্রধান আসামি মনির। এই যে ওপরে ওপরে নিশ্চিত জীবনযাপন করছে এর মাশুল আছে। সাদা চোখে অন্য মানুষ তা বুঝবে না।

নতুন খবর দিতে না পারলে কোনো কোনো দিন শুনে আসে, আরে ওইরকম লকলকানো মেয়ে ঘরে থাকলে দু-একবার খবর না আনলেও চলবে। ইঙ্গিত স্পষ্ট। মনিরের রুহুতে পানি থাকে না। মাঝরাতে উঠে বসে থাকে বিছানায়। বাদায় আবার নড়াচড়া হচ্ছে খবর সবই পায় সে। সাধু মণ্ডল আগের মতোই সেই ধ্যানী বক। অত আগ্রহ যে কেন তার খবর আদান-প্রদানের কে জানে! মনির ভাবত তার দরদে সাধু এ কাজ করছে। এখন শুনেছে, বনের নতুন দলের দূতিয়ালি করছে। আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রণা হয়। সেও অপরাধী কম নয়। সাধু মণ্ডলকে ফেলে রেখে এসেছিল আগের জীবনে। নিশ্চিত জীবনে থিতু হয়েছে সে। তবুও মাঝেমধ্যে ফোন দেয় সাধুকে। একথা সেকথা বলে। কিন্তু টের পায় বরফ গলে না। সাধুর চোখে সে আরও নিকৃষ্ট একজন। যে নিজের স্বার্থরক্ষায় দল ভেঙে প্রশাসনের ইনফর্মার হয়েছে।

গ্লানি জমতে জমতে মনিরের গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে। তবুও হয়তো সে চুপচাপ সয়েই যেত বাকি জীবনটা। নুরির ভবিষ্যৎ আর নিজের বয়সটাও কম হয় নি। কিন্তু সিন্দুরতলায় গাড়ির পেছনের সিটে বসে আসতে আসতে ওয়াকিটকির এপাশ-ওপাশের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আজ তাকে বদলে দিল এক মুহূর্তে। বলা হয়েছিল বনে আবার শব্দ শুরু হয়েছে। সিন্দুরতলার দিকে নজর প্রশাসনের। এই গ্রাম থেকে দু-পা এগোলেই বন। কয়েকজনের দল হয়েছে। তিনজন এ গ্রামের। বাড়িগুলো চিনিয়ে দেবে সে। এটুকুই কাজ। বাকিটা পরে দেখা যাবে। ওঁত পাতবে, ফাঁদ বানাবে তারপর না মচ্ছব হবে। কিন্তু পেছনের সিটে বসে বসে সে দু’পাশের আলাপ শুনে বুঝেছে, অনেক দিন ধরে কোটা পূরণ হচ্ছে না। ওপর থেকে চাপ আছে। টু-ও ও-টু মানে অন্তত দুজনের খবর চাই। যারা বন্দুকযুদ্ধে মারা যাবে। তবুও সংশয় ছিল মনিরের। এতখানি সে ভাবে নি। গাড়ি যখন গ্রামের ভেতর ঢোকে তখনো ফিসফিস করে হেসে কথা বলছিল সামনের সিটে বসা স্যার। মনির আশ্বস্ত হতে পারে নি। নতুন দলের ঘর চেনাতে সাধুকে প্রয়োজন হবে। সে যে সহযোগিতা করবে সে কথাও মনির বলেছিল তাদের। সাধুর বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল না দেখে অবাক হয়েছিল। সামনের সিট থেকে নির্দেশ এল, একেবারে শেষ পর্যন্ত আগে যাই। সেখান থেকে শুরু করব। গাড়ি আসতে দেখেছে কেউ কেউ। সতর্ক হয়ে যাবে। আর আমরা তো আজই অপারেশনে যাব না। রেকি করতে এলাম।

রেকি শব্দ যে আর এখন চলে না, এ খবর মনির রাখে। খালি হাতে ফিরবে না এতখানি পথ এসে।

সিন্দুরতলার শেষ প্রান্তে গাড়ি থামার পর সেই স্যার মনিরকে বলেছিল, ‘যাও, তাড়াহুড়ো কোরো না। তোমার বন্ধুকে ডেকে আনো। আগে এখানে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলি দুজনের সাথে।’ এই শেষ শব্দ দুটো যেন একটা ঠান্ডা তরঙ্গ বইয়ে দিল শিরদাঁড়া দিয়ে। কোডটা কানে ভাসছে তখনো। ওরা গাড়ির হেডলাইট বন্ধ রেখেছিল। মনিরও আড়াল হওয়ার আগ পর্যন্ত দৌড় দেয় নি। এই পথ তার চেয়ে ভালো আর কে চেনে! অন্ধকার হলেও আকাশের একটা নিজস্ব আলো থাকেই। মনির দৌড় দিয়েছিল টিনের দোকানটার পর পথটা একটু ঘুরে যেতেই। সেদিন রাতেও দৌড়েছিল মনির এভাবে। আজও একইরকম সেই দৌড়। অদেখা সন্তান আর সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ যেন মিলেমিশে যায় মনিরের দুই পায়ের গতিতে। মনির আসলে দৌড়েই চলেছে।

আর সামান্য একটু পথ, তারপরই সাধুর বাড়ি। কেন যেন মনে হয় এক ভরসার নাম সাধু মণ্ডল। যে কখনো বেইমানি করে না। সাধু ফোনেই বলেছিল, কারও বাড়ি সে চিনিয়ে দেবে না। নিমকহারামি হবে। মনির ভেবেছিল এসব পরে দেখা যাবে। এখন পিছিয়ে এলে সন্দেহ শুরু হবে। আগে তো পৌঁছানো যাক। বন কাঁপিয়ে বেড়ানো যুবকদের প্রশাসন কবে বাড়ি থেকে ধরতে পেরেছে! ওরাও এত বোকা না। কিন্তু পথটা আজ বড় দূরের ঠেকছে। যার বাড়ির দিকে মনির পা চালাচ্ছে, সে যে বেইমানি করবে না বলে কখন বাদার অন্ধকারে মিশে গেছে—জানে না মনির। সাধুর বাড়ির উঠোনের কাছাকাছি চলে এসেছে সে। ঠিক তখনই জ্বলে উঠল গাড়ির হেডলাইটটা। এই ঘোরে সে একবারও টের পেল না, পেছনে আরও দুজন এসেছে। আলোটা জ্বলে উঠতেই নির্দেশ এল গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কণ্ঠ থেকে—‘পালা মনির...’।

[গল্পটি অন্যদিন ‘ঈদুল আজহা সংখ্যা ২০২৩’-এ প্রকাশিত]

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.