জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি অগ্রন্থিত চিঠি ও খসড়া

জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি অগ্রন্থিত চিঠি ও খসড়া

২০১৫-তে একুশে বইমেলায় ঢাকার অন্যপ্রকাশ কর্তৃক জীবনানন্দ দাশের লেখা চিঠির একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র’ নামীয় উক্ত গ্রন্থটিতে জীবনানন্দের পত্রপ্রাপকদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথাসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী, কবির অনুরক্ত-পাঠক প্রভাকর সেন, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, কবি বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দের অন্তরঙ্গ বন্ধু কথাসাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, কবি বিষ্ণু দে, কবির মা কুসুমকুমারী দাশ, বোন সুচরিতা দাশ (খুকি), কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ এবং ভ্রাতৃবধূ নলিনী চক্রবর্তী, ভারত সরকারের শিক্ষা সচিব ও ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ুন কবির, কবি নরেশ গুহ, কবি দিনেশ দাশ, ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদক ও জীবনানন্দের অনুরাগী বন্ধু কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তদীয় বন্ধু সত্যপ্রসন্ন দত্ত, ডিকে নামে সমধিক পরিচিত সিগনেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী দিলীপকুমার গুপ্ত, ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ, ‘উত্তরসূরী’ পত্রিকার সম্পাদক অরুণ ভট্টাচার্য, জীবনানন্দভক্ত কবি ও লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক অম্লান দত্ত, প্রাণতোষ ঘটক, অনিল বিশ্বাস, পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কবি ড. সুশীল কুমার গুপ্ত, চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবি হরপ্রসাদ মিত্র, খড়গপুর কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক পুলিনবিহারী পাল, কবি ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য, কবি রমাপতি বসু, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং কবি কায়সুল হক প্রমুখ।

দুবছর পর ২০১৭-তে জীবনানন্দ দাশের লেখা চিঠির আরেকটি সংকলন প্রভাতকুমার দাসের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ‘পত্রালাপ’ নামীয় এ মূল্যবান গ্রন্থে জীবনানন্দ দাশের আরও সাতজনকে লেখা চিঠি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সাতজন পত্রপ্রাপক হলেন কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক মুরলীধর বসু, শিশিরকুমার নিয়োগী, সাহিত্যিক-সম্পাদক গোপাল ভৌমিক, কবি ও সংগীতকার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, অমিয়কুমার গঙ্গোপধ্যায় এবং কবি বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়। অব্যবহিত পরে ২০১৭-এ ‘অন্যদিন’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় জীবনানন্দের লেখা আরও ১০টি অগ্রন্থিত চিঠি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ঔপন্যাসিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যয়কে লেখা একটি চিঠি। 

জীবনানন্দের অধিকাংশ চিঠি অপুনরুদ্ধরাণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে। এ যাবৎ একশত ত্রিশটির মতো চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। এখনো কিছু চিঠি হয়তো এদিক-সেদিক কারও কাছে রয়ে গেছে। যেমন অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়কে লেখা চিঠিটি প্রাপকের কাছেই গচ্ছিত ছিল। এই চিঠিটির কপি অনেক আগে সংগ্রহ করা হলেও, দুঃখের বিষয়, অন্যপ্রকাশ-এর জন্য পা-ুলিপি তৈরির সময় যথাস্থানে খুঁজে পাওয়া যায় নি। একইভাবে অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদকে লেখা জীবনানন্দ দাশের সুসংরক্ষিত চিঠিটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটি ভালো খবর হলো খড়গপুর কলেজে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ থেকে কিছু কাল অধ্যাপনা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। সেই সূত্রে ওই কলেজের করণিক উজ্জ্বলকুমার রক্ষিতের কাছে পাঁচটি চিঠি রয়েছে মর্মে সম্প্রতি জানা গেছে (ছবি দ্রষ্টব্য)।

জীবনানন্দের লেখার খাতায় বেশ কিছু চিঠির খসড়া আছে, পঞ্চাশটিরও বেশি, জীবনের শেষভাগে লেখা। আগেও কিছু খসড়া আমরা প্রকাশ করেছি। একাধিক চিঠি যাচাই করে দেখা যায় যে খসড়া এবং প্রাপককে প্রেরিত চূড়ান্ত চিঠির মধ্যে পার্থক্য উপেক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ কবি কায়সুল হককে লেখা চিঠি ও সেটির খসড়ার কথা উল্লেখ করা যায়। তাই খসড়াগুলো ‘খসড়া’ বলেই উপেক্ষণীয় নয়। বড় কথা: খসড়াগুলো থেকে এমন সব তথ্যকণিকা পাওয়া যায় যেগুলো আর কোথাও উল্লিখিত নেই।

দুঃখের বিষয় খসড়া চিঠিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ইংরেজিতে লেখা যেগুলো পাঠ করা এখন অসম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে ছোটভাই অশোকানন্দ দাশকে লেখা অনেকগুলো চিঠি। অশোকানন্দ’র ঘরোয়া নাম ‘ভেবুল’। অশোকানন্দকে লেখা চিঠিগুলো তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ। চাকরির দরখাস্ত এবং দাপ্তরিক চিঠিপত্র বাদ দিলে যে ক’জনকে ইংরেজিতে চিঠি লিখেছেন জীবনানন্দ তাদের মধ্যে ছোটভাই অশোকানন্দ দাশ ছাড়াও রয়েছেন সুহৃদ হুমায়ুন কবির, পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ।

জীবনানন্দের হাতের লেখা দুষ্পাঠ্য। এ প্রসঙ্গে বোন সুচরিতা দাশের স্মৃতিচারণ মনে পড়ছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম দাদা কী লিখছে। দাদার লেখা তখন ছিল খুব ছোট আর জড়ানো, এখনকার মতো নয়। বুঝতে পারতাম না, রাগ হতো। একদিন বলে উঠলাম, ‘উঃ দাদা, তোমার লেখা পড়াই যায় না, মনে হচ্ছে যেন এক সারি পিঁপড়ে ছেড়ে দিয়েছ খাতার ওপরে।’ আর দাদার সেকি হাসি।’ — মনে হয় পরবর্তীকালে কবির হস্তাক্ষরের কিছু উন্নতি হয়েছিল। তবু এতদিন পর পা-ুলিপি পাঠ করা দুঃসাধ্য বিষয়। যাই হোক, পাঠযোগ্য কয়েকটি চিঠির খসড়া এই নিবন্ধে উপস্থাপন করা হলো। পত্রপ্রাপকেরা হলেন ড. অমলেন্দু বসু, হুমায়ুন কবির, বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, সাগরময় ঘোষ, গোপাল ভৌমিক, শিবনারায়ণ রায়, লীলা রায় এবং বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়। চিঠির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কবিতাটিও কোনো ক্ষেত্রে জুড়ে দেওয়া হলো, কারণ কবির আলোচনা কবিতা ব্যতিরেকে সর্বদাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রথমেই অধ্যাপক অমলেন্দু বসুকে লেখা দীর্ঘ একটি চিঠি। এত দীর্ঘ কেজো চিঠি জীবনানন্দ জীবনে খুব কমই লিখেছেন।

১। ড. অমলেন্দু বসুকে লেখা চিঠি

১৯৫৪-তে জীবনানন্দ দাশের অকাল জীবনাবসানের পর বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকার জীবনানন্দ-স্মৃতি সংখ্যা প্রকাশ করেন। ওতে অমলেন্দু বসু লিখেছিলেন ‘যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার’। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘মৃত্যুর ভাবনা জীবনানন্দে নিরবচ্ছিন্ন। ...কবির জীবনোপলব্ধির নাভিমর্মে মৃত্যুর অব্যয়ভাবনা, অন্য সব ভাবনা ঘুরে ফিরে এই কেন্দ্রের সংযোগে সঞ্জীবিত।’ অমলেন্দু বসু জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে ১৯৯৪-এ একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যার নাম ‘জীবনানন্দ’। দিনপঞ্জির খাতায় অমলেন্দু বসুকে লেখা অনেকগুলো চিঠির খসড়া পাওয়া যায়। অমলেন্দু বসুর সঙ্গে কী সূত্রে জীবনানন্দের পরিচয় হয়েছিল তা আমাদের জানা নেই। বয়সে অমলেন্দু বসু জীবনানন্দ থেকে সামান্য ছোট, তাঁর জন্মসাল ১৯১৯। অমলেন্দু বসুকে লেখা খসড়া চিঠিগুলো ধরতে গেলে এখন আর পাঠযোগ্য নয়। তবু অনুমান করে-করে অনেকটা বোঝা যায়; যদিও স্বীকার্য তাতে ভুলপাঠের ঝুঁকি থাকে।

জুন ১৯৫২’র একটি চিঠির পাঠ নিচে দেওয়া হলো। এ সময়টায় জীবনানন্দ বরিশাল ত্যাগ করে কলকাতার স্থায়ী হয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনাবসান ক্রমে মুক্ত ভারতের নাগরিক। লেখালেখির মধ্যে তেমন কিছু লিখছেন না। থাকতেন কালিঘাটে ১৮৩ ল্যান্স ডাউন রোডে। তারিখ দেওয়া নেই। কিন্তু দিনপঞ্জীর পাতা পর্যালোচনা করে বোঝা যায় ১০.৬.১৯৫২ এবং ১৮.৬.১৯৫২-এর মধ্যে চিঠিটির খসড়া করেছিলেন জীবনানন্দ। দীর্ঘকাল চাকরিহীন জীবনানন্দ কোনো একটি কলেজে শিক্ষকতার চাকরির জন্য অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করছিলেন; ব্যক্তিগত সূত্রে খবর পেয়ে বা পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে একের পর এক চাকরির জন্য দরখাস্ত করছিলেন। অমলেন্দু বসুকে লেখা চিঠিরও মূল বিষয় এরকম একটি চাকরি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর অসহায় অবস্থার কথা বিশদ করে তুলে ধরেছেন এবং চাকরির ব্যাপারে তাঁর আকাঙ্খা ও মনোভাবও অকপটে ব্যক্ত করেছেন:

প্রিয়বরেষু,

আপনার ১০ তারিখের চিঠি আজ পেলাম। অনেক ধন্যবাদ। আপনার শরীর অসুস্থ শুনে চিন্তিত হলাম। উত্তর ভারতবর্ষের আবহাওয়া তো বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। তবে ওখানে শীত ও [১টি শব্দ অস্পষ্ট] গ্রীষ্মের আবহাওয়া শুষ্ক: যেটা বাঙালিদের বোধহয় সহ্য হয় না; তাছাড়া, খাওয়াদাওয়াও অন্যরকম। দক্ষিণের আবহাওয়া বেশ ভালো। [১টি বাক্য অস্পষ্ট] ওখানে গিয়ে আপনার শরীর ক্রমে হয়তো সেরে ওঠার সুযোগ পাবে। তবে বেশি দিন থাকা দরকার কাজের চাপ যথাসম্ভব কমিয়ে। আপনি শিগ্গিরই [কোনো স্থানের নাম] যাচ্ছেন জানতে পারলাম। ওসব জায়গায় ইতিপূর্বে গিয়েছেন হয় তো। বস্তুত ওদিককার নতুনত্ব কোনোদিন ফুরায় না—দেখার শোনার আনন্দ পাবার কত কী যে রয়েছে। এই চিঠি দেরাদূনের ঠিকানায় লিখছি। ভ্রমণ থেকে ফিরে এলে পাবেন। দেরাদূনে কবে ফিরবেন?

কলকাতায় কোনো কলেজে কাজ পেলেই আমার সব থেকে ভালো হত; কিন্তু আপাতত কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এখন কলেজে ইংরেজির demand insufficient; নিয়োগের চেয়ে ছাঁটাইয়ের পর্বটাই বেশি ক’রে চলছে এ কয় বছর; এরিই মধ্যে মুরুব্বির খুব বিশেষ জোর থাকলে এক-আধটা নিয়োগ হয়! কিন্তু সে জোর আমার একেবারেই নেই। সে জোর না থাকলে কলকাতায় অন্তত কিছু হয় না।  

এ শহরটা নানাদিক দিয়েই বড্ড খারাপ। অথচ ভালো মাসোহারা: এমনকি চলনসই (আয়) থাকলেও কলকাতার বাঙালির হৃদয়-মনের চরিতার্থতার সম্ভাবনা ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কলকাতা ও বাংলাদেশকে এত ভালো লাগলেও এখানে টিকে থাকার কোনো উপায়ই দেখছি না। p.f.-এর সব টাকা ফুরিয়েছে। [একটি বাক্য অস্পষ্ট] স্ত্রীর গয়না সবই প্রায় বেচে ফেলতে হয়েছে। কোন college-এ attached না থাকলে private tuition পাওয়া কঠিন; কলকাতার tuition এর আগের মরশুম নেই এখন আর। ছেলেমেয়েদের বাবা-কাকারা সবাই প্রায় দরিদ্র; অল্পস্বল্প ভালো tuition এখন যা পাওয়া যায় কলেজের প্রফেসররাই ভাগ করে নেয়। popular ঔপন্যাসিক ছাড়া অন্য কোনো সাহিত্যিকের পক্ষে লিখে সংসার চালানো অসম্ভব—শুধু কবিতা লিখে তো কোনো আয়ই হয় না। এরকম অবস্থায় কলকাতায় অবিলম্বে কিছু না পেলে এখানে আর থাকা যাবে না—একেবারে last ditch।

Dr S.N. Roy কবে ফিরেছেন, জানাব আপনাকে। Dr Roy এর বদলে যিনি Principal  আছেন তিনি কয়েক মাস আগে Charuchandra College এ ইংরেজি’র post-এ তার সহোদর ভাইকে নিয়েছেন; অনেক বেশি qualified candidate থাকা সত্ত্বেও। Dr Roy কী করবেন বলতে পারি না। কলকাতার হালচাল বড্ড খারাপ। তবুও বিশেষভাবে আপনি তাকে একটা চিঠি নিশ্চয়ই লিখবেন—এই অনুরোধ। Dr S.N. Roy লোক খুব ভালো। কিন্তু তার যে খুব প্রতিপত্তি আছে তা তো জানি না। Dr S.N. Roy কে [অস্পষ্ট] আপনি চিঠি লিখে দিলে খুবই ভালো হয়। আপনার চিঠি নিয়ে আমি পেলেই তার সাথে আমি দেখা করব।

Agra ও Meerut College -এ দরখাস্ত করেছি। Meerut College-এ তো ইংরেজির তিনজন লেকচারার নেবে। দুটো কলেজেই জুনিয়র লেকচারার পোস্ট; মাইনেও খুবই কম। আমাকে ৩০০ টাকা কি দিতে পারবে? অন্তত ২৫০? যে রকম অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে কম মাইনে পেলেও যেতে হবে; ক্রমে টিউশন ইত্যাদি পাওয়া গেলে চ’লে যাবে একরকম। আমার স্ত্রী B.T পাস করেছে; ওখানে হয়তো কিছু পেতে পারে। না হয় কলকাতায় বা এদিকে কোথাও চাকরি নেবে। দু-এক জায়গায় চাকরি ও Tuition পাবার সম্ভাবনা আছে আমার স্ত্রীর। কলকাতা বা বাংলাদেশের বাইরে শিগগরিই একটা-কিছু পেয়ে যাবে আশা করছি। তাহলে পরিবারের জন্য বেশি কিছু রেমিটেন্স পাঠাতে হবে না। আমার মেয়েও এবার বিএ পরীক্ষা দিয়েছে; পাস করলে সে-ও আমিও সাদাসিদে ভাবে থাকতে অভ্যস্ত; অল্পস্বল্প মাইনেতে চালাতে পারব। এখন যে ভীষণ ঋণের বোঝা, অর্থসমস্যা ও বেকার অবস্থা তার থেকে অনেকটা মুক্তি পাওয়া যাবে। অন্য একটা বিকল্প কারণে অল্প মাইনেতেও অবিলম্বে কলেজে চাকরি নেওয়া উচিত; কারণটি হচ্ছে continuity of service । কলেজের কর্তারা candidate এর [অস্পষ্ট] continuity of service  না থাকলে বেঁকে বসেন; এটা একটা [unreasonable attitude]; বিশেষতঃ ২০/২৫ বছর যাবৎ একটানা চাকরি করেছে তাদের ংবৎারপব-এ ক্ষেত্রে ২/৩ বছর মধঢ় পেলে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে অধিকাংশ College Committee  যুক্তির চেয়ে সংস্কারের পথ ধ’রেই চলে বেশি। কাজেই সব দিক দিয়ে ভেবে দেখে অবিলম্বেই একটি কলেজে যোগ দেওয়া উচিত।

Agra, Meerut, Aligarh ইত্যাদি সব বড় নামজাদা কলেজে চাকরি মোস্ট ওয়েলকাম। এমন কলেজে (এক বার) কাজ করলে কলকাতায়ও চান্স ঢের বেশী বেড়ে যাবে। অষরমধৎয-এ আমাকে কাজ দিতেই হবে। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ আপনার হাত। Aligarh ও Meerut এ নাই পেতে পারি, কিন্তু Aligarh-এ আপনি আমাকে অনায়াসেই নিতে পারেন। ৩০০ টাকা কি সম্ভব হবে অন্তত পেলে সুবিধা; আপনি চেষ্টা করলে তা হতে পারে। না হলে ২৫০ টাকাতে আমি রাজি। Aligarh-এ কি সব মুসলমান ছাত্র? ছাত্রেরা কি রকম? এক-একটা ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা কত? Aligarh এর (চাকরির) জন্য কবে দরখাস্ত করতে হবে Aligarh-এ আমার কাজ হবে আমি ধ’রে রাখছি।

আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। {আমার কবিতার বই ‘বনলতা সেন’-এর ২য় সংস্করণ আগের চেয়ে বড় আকারে Signet Press থেকে প্রকাশিত হবে। ২/৩ মাসের মধ্যে বেরুবে আশা করছি।}

সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করব ভেবেছিলাম। কিন্তু সম্প্রতি থাক। অন্য সময়ে হবে [অস্পষ্ট]। বাংলা সাহিত্যে ক্রিটিসিজম নেইই একরকম। এখনকার আধুনিক কবিতা(?) সম্বন্ধে আপনি লিখুন। আপনার বই সবচেয়ে বেশী ঋদ্ধ(?)ম সত্য ও মূল্যবান হবে।

আশা করি ভালো আছেন।

প্রীতি নমস্কার ইতি—
জীবনানন্দ দাশ

অধ্যাপক অমলেন্দু বসু তখন আলীগড় কলেজের অধ্যক্ষ। অধ্যাপক অমলেন্দু বসুকে লেখা উপর্যুক্ত চিঠির কিছু কিছু অংশ একেবারে অপাঠ্য যদিও তথাপি মূল সুর বুঝতে সমস্যা হয় না। কলকাতায়ই একটি অধ্যাপনার কাজ খুঁজছিলেন জীবনানন্দ। কোনো আয়পত্র না-থাকায় প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা অগ্রিম শেষ করে ফেলেছেন। অনুমান করা চলে এটি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের প্রভিডেন্ট ফান্ড। কিন্তু সে টাকা কি বরিশাল থেকে আনাতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ? সংকট মোকাবেলায় স্ত্রীর গহনা পর্যন্ত বেচে দিয়েছেন। প্রাইভেট টিউটরের কাজও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর্থিক দুরবস্থার সূত্রপাত ১৯৪৭-এ দৈনিক স্বরাজ পত্রিকার চাকুরি যাওয়ার পর। এর পর দীর্ঘদিন বেকার ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বোঝা যায় একটি চাকুরির জন্য অমলেন্দু বসুর ওপর অনেকখানি নির্ভর করছিলেন জীবনানন্দ। Aligarh এ আমাকে কাজ দিতেই হবে। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ আপনার হাত। Agra ও Meerut এ নাই পেতে পারি, কিন্তু অষরমধৎয এ আপনি আমাকে অনায়াসেই নিতে পারেন’—এই অংশে তা ফুটে উঠেছে।

জীবনানন্দ দাশ অধ্যাপক অমলেন্দু বসুকে পরবর্তী চিঠিটি লিখেছেন ৮ জুলাই ১৯৫২-এর অব্যবহিত পরের কোনো দিন। এ চিঠিও দুষ্পাঠ্য। এ চিঠিতে আমরা জানতে পারি মূল সার্টিফিকেট না-থাকা কলেজে চাকুরি লাভের পথে আরেকটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ হিসেবে লিখেছেন, ‘পাকিস্তান থেকে চলে আসার সময় অনেক কিছু ফেলে আসতে হয়েছে; ৩/৪ আলমারী ভর্তি মূল্যবান বই ও বাঁধানো পত্রিকা ইত্যাদি অবধি; সেই গোলমালের সময় সার্টিফিকেট আনতে পারিনি।’

অমলেন্দু বসুকে অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ একের পর এক। তাঁর খুব আশা ছিল তিনি কিছু-একটা করতে পারবেন। ভূমেন্দ্র গুহ জানাচ্ছেন, চাকুরির জন্য জীবনানন্দ দাশের একের পর এক চিঠি পেয়ে ড. অমলেন্দু বসু, ড. অশোক মিত্র প্রমুখ এতটাই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে কলকাতায় এলে তাঁরা জীবনানন্দকে এড়িয়ে চলতেন। এ কথাটি সত্য নাও হতে পারে।

২। হুমায়ুন কবিরকে লেখা চিঠি

হুমায়ুন কবিরকে লেখা জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত চিঠিটা অনেকের মনে থাকার কথা যার শুরুতে ছিল ‘প্রিয় কবির সাহেব, আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না, আমার বিশ^াস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু—যা শেষ বিচারে কোনও একটা জিনিসের মতন জিনিস—কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’

১৯৫৩’র মার্চ বা এপ্রিলে, ১৬-৪-১৯৫৩ তারিখের আগে লেখা, এ চিঠি। কিন্তু এটি হুমায়ুন কবিরকে লেখা জীবনানন্দের প্রথম বা শেষ চিঠি নয়। লেখালেখির খাতায় আরও অনেকগুলো চিঠির খসড়া পাওয়া যাচ্ছে যার একটির অনুবাদ নিম্নরূপ। বলে রাখা ভালো এটিও দুষ্পাঠ্য, অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ করা হয়েছে বা অর্থবিকৃতি না ঘটিয়ে অনুমানের ওপর নির্ভর করা হয়েছে:

১৪. ১. ১৯৫৪

প্রিয় কবির সাহেব,

আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভারত সরকারের শিক্ষা সচিব হিসেবে আপনি ভালোই করছেন। আমার জন্য কিছু-একটা এখুনি করুন। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের ডিপিআই-এর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। ডিপিআই সাহেব (নাম ড. রায়?) বলেছিলেন, কোনো কলেজে প্রিন্সিপালের পদ এ মুহূর্তে খালি নেই; খালি হলে জানাবেন। কিন্তু যদি খালি হয়ও এবং চাকুরিও পেয়ে যাই, প্রিন্সিপালদের বেতন এমন তো আহামরি কিছু নয়। নতুন কোনো জীবিকা যেমন অল ইন্ডয়া রেডিওতে আমার জন্য যথোপযুক্ত কোনো পদ কি থাকতে পারে না; অথবা বিদেশী দূতাবাসে অথবা কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে? দয়া ক’রে শিগগিরই কিছু একটু করুন, খুবই অসুবিধায় আছি।

শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদসহ,

আপনার
জীবনানন্দ দাশ

এ চিঠি প্রকৃতই দুষ্পাঠ্য। দীর্ঘকাল আগে ভূমেন্দ্র গুহ কিছুটা পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। তারই সাহায্য নিয়ে কিছুটা বোঝা যায়। একই সুরে ১৭.৩.১৯৫৪ তারিখে পুনরায় ছোট আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি এখন একটা খুব প্রভাবশালী জায়গায় আছেন। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সাহিত্য, প্রকাশনা এবং অন্যান্য অনেক বিষয় আপনার সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে আছে, যাদের মাধ্যমে আপনি আমাকে কোনও একটা উপযুক্ত চাকরিতে বসিয়ে দিতে পারেন। দয়া করে কিছু একটা করুন এক্ষুনি।’

মাসাধিক কাল পরেই ২৩.৪.৫৪ তারিখে হুমায়ুন কবিরকে পাঠানোর জন্য আরেকটি চিঠি মুসাবিদা করছেন জীবনানন্দ দাশ। লিখছেন, ‘আপনি এখন খুব-একটা উঁচু জায়গায় আছেন, এবং খুব সহজেই আমার জন্য কিছু-একটা করতে পারেন। আপনার নিজের ডিপার্টমেন্ট আছে। খুবই যুক্তিসংগতভাবে আপনার ডিপার্টমেন্টে কোনো এক জায়গায় আপনি আমার জন্য একটা চাকরি খুঁজে পেতে পারেন, যেমন অল-ইন্ডিয়া রেডিও আছে। আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, আমাকে সাহায্য করতে এক্ষুনি আপনি যথাসাধ্য করুন, আমি খুবই অসুবিধের ভিতর আছি।’

স্মরণযোগ্য এ সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এবং তারই অধীনে শিক্ষা সচিব হুমায়ুন কবির। জানা যায়, জীবনানন্দ’র জন্য তিনি দিল্লিতে একটি কলেজে চাকুরির ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে চাকুরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। জীবনানন্দ এ দুটোর কোনোটিতেই আগ্রহ বোধ করেন নি। মনে রাখতে হবে এ সময়, ১৯৫৩-৫৪ কাল পর্বে, জীবনানন্দ হাওড়া গার্লস কলেজে চাকুরি করছেন এবং স্বভাবতঃ বাংলার বাইরে—এমনকি কলকাতার বাইরে যেতেও—বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিলেন না। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু সে সময় সেখানে ইংরেজি অধ্যাপকের কোনো পদ শূন্য ছিল না। হুমায়ুন কবির পরামর্শ দিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়, জ্যোতিবসু প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য।

চতুরঙ্গ সম্পাদক হুমায়ূন কবীরের সঙ্গে জীবনানন্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্র্ক গড়ে উঠেছিল; রবীন্দ্রনাথকে নয়—সাতটি তারার তিমির (১৩৫৫) বরং তাঁকেই তিনি উৎসর্গ করেছিলেন। চতুরঙ্গ পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশের কেবল কবিতাই প্রকাশিত হয় নি, ১৩৫৫-১৩৬০ সময়ে এ পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধসহ বেশ কয়েকটি গ্রন্থালোচনা প্রকাশিত হয়। অতএব, অনুমান করা অসংগত হবে না যে হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের পত্রবিনিময় হয়ে থাকবে। কিন্তু হুমায়ূন কবিরের লেখা কোনো চিঠি পাওয়া যায় নি।  

১৯৪৭-এ দৈনিক স্বরাজ পত্রিকায় কয়েক মাস রবিবাসরীয় সম্পাদকের কাজ ছাড়া জীবনানন্দ সারা জীবন কেবল কলেজে অধ্যাপনাই করেছেন। এতদসত্ত্বেও বলা যায় শিক্ষকতার কাজ তিনি পছন্দ করতেন না। সম্ভবত আরও বাস্তব হলো তিনি কোনো কাজই করতে চাইতেন না, কেবল লেখালেখিতে ব্যাপৃত থাকতে চাইতেন। প্রাইভেট টিউশনিও করতে বাধ্য হয়েছেন। এ কাজও তিনি পছন্দ করতেন না। স্মরণযোগ্য যে, জীবনানন্দ ২৭-১-১৯৩২ তারিখে দিনপঞ্জীতে লিখেছিলেন : When taking up a new tuition I think how many stories would make up the money, and how many poems and beautiful creations ruined. কিছু দিন পর ১২-২-১৯৩২ তারিখে লিখেছিলেন: This morning a great depression : Tuition job a hell; even college etc. jobs hell. বেকার জীবনানন্দ দাশ ১৭.৯.১৯৩৩ তারিখে লিখেছেন: What to do ? Tea shop ? Sweet shop ? Bakery ? Poultry ? Fish farming ? Opium selling ? Wine shop ? Shoe making ? ১৯৪২ এ ভাবী ভ্রাতৃবধূকে লিখেছিলেন, ‘অধ্যাপনা জিনিসটা কোনোদিনই আমার তেমন ভালো লাগেনি। ... এ কাজে মন তেমন জাগে না।’  কবিপতœী লাবণ্য দাশ জানিয়েছেন, জীবনানন্দ চাকুরি পেতেন না তা নয়, আসলে তিনি চাকুরি করতে চাইতেন না। হুমায়ুন কবিরকে লেখা চিঠিতেও দেখা যায় প্রথমত অধ্যাপনার চাকুরি চাইলেও তিনি অন্য কোনো প্রকার চাকুরিতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

৩। বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে লিখিত চিঠি

বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার নিশ্চিত চাকুরি ছেড়ে (প্রথমে ছুটি নিয়ে) জীবনানন্দ ১৯৪৬-এ কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্ত হলে কলকাতাতেই স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৭-এর প্রথম ভাগে কিছুদিন দৈনিক স্বরাজ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্ত সেই চাকুরি সেপ্টেম্বর মাসে চলে যায়। এর পর দীর্ঘকাল জীবনানন্দকে চাকুরিহীন থাকতে হয়েছে। খড়গপুর কলেজে মাত্র ছয় মাস চাকুরি করেছেন ১৯৫০-এর ১লা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে। ১৯৫২’র নভেম্বরে কলকাতার উপকণ্ঠে বড়িষা কলেজে চাকুরি পেয়েছিলেন, কিন্তু সে কেবল চার মাসের জন্য।

একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে চারদিকে হাতড়েছেন জীবনানন্দ। শেষ পর্যন্ত গোপালচন্দ্র্র রায়ের দূতিয়ালীতে ১৯৫৩’র মাঝামাঝি সময়ে হাওড়া গালর্স কলেজের ইংরেজি বিভাগে চাকুরি হয়। হাওড়া গালর্স কলেজের অধ্যক্ষ বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য একটি চিঠি সহযোগে জীবনানন্দকে ‘নিয়োগপত্র’ পাঠিয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশ এ কলেজে ১৯৫৩’র ১লা জুলাই কাজে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৪ই অক্টোবর ১৯৫৪ ট্রাম দুর্ঘটনা পর্যন্ত এ কলেজেই কর্মরত ছিলেন।

২৪.০৪.১৯৫৩

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

আপনার চিঠি ও নিয়োগপত্র পেয়ে আনন্দিত হয়েছি। আমার আন্তিরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। গোপালের কাছে আপনার মহত্ত্বের কথা ইতিপূর্বে শুনেছি। আপনি যে মহৎ লোক এ কয়েক দিন আপনার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তায় বিশেষ ভাবে অনুভব করেছি। আপনার কলেজে কাজ করতে আমার ভালো লাগবে।

আপনার নির্দেশ মতো শনিবার ১১টার সময় গার্লস কলেজে এ গিয়ে ইংরেজির অধ্যাপকদের সঙ্গে মিলিত হব। ১লা জুলাই থেকে পড়ষষবমব-এ অধ্যাপনার কাজ আরম্ভ করব।

আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার গ্রহণ করুন।

ইতি
ভবদীয়
জীবনানন্দ দাশ

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হাওড়া গালর্স কলেজের নাম বদলে পরবর্তীকালে বিজয়কৃষ্ণ কলেজ করা হয়েছে। গোপালচন্দ্র রায় সম্পর্কে পাঠক জানবেন যে তিনিই প্রথম বাংলায় জীবনানন্দের একটি জীবনী গ্রন্থনা করেন। ‘জীবনানন্দ’ নামীয় এ বইটি ১৯৭১-এ প্রকাশিত হয়। অধিকন্তু, তিনি জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত চল্লিশটি প্রেমের কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন যারা নাম ‘সুদর্শনা’।

 

৪. সাগরময় ঘোষকে লেখা চিঠি

‘দেশ’ পত্রিকায় জীবনানন্দের বেশ কয়েকটি কবিতা তাঁর জীবদ্দশায় মুদ্রিত হয়েছিল। ‘দেশ’-এর জন্য কবিতা পাঠানোর সূত্রে পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে চিঠি লিখতেন জীবনানন্দ। ১৪.৭.১৯৫৪ থেকে ২১.৭.১৯৫৪ এই সময়ের জীবনানন্দ সাগরময় ঘোষকে পাঠানোর জন্য একটি চিঠি মুসাবিদা করেছিলেন তাঁর লেখার খাতায়। চিঠিটি নি¤œরূপ:

প্রিয়বরেষু,

সাগরবাবু, আশা করি ভালো আছেন। আমি খুব অসুস্থ ছিলাম, এখন আগের চেয়ে ভালো আছি।

‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপবার জন্য এই সঙ্গে বেশ (?) ক’টি কবিতা পাঠালাম। এর ভেতর থেকে একটি কবিতা শারদীয় সংখ্যার জন্য নিবেন; বাকিগুলো আপনার পত্রিকার অন্যান্য সংখ্যায় ছাপাবার সুযোগ পেলে সুখী হব। কবিতাগুলো পড়ে কবিতাগুলোর প্রাপ্তি সংবাদ ও আপনার চিঠি পেলে আনন্দিত হব।

অনেক শুভেচ্ছা ও প্রীতি নমস্কার জানাচ্ছি গ্রহণ করুন।

ইতি
আপনার
জীবনানন্দ দাশ

মনে এ সময় ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে জীবনানন্দ নিশ্চিত বোধ করছিলেন। অবিলম্বে ছাপা না-হওয়ায় জীবনানন্দ সম্ভবত মনোক্ষুণœ হয়ে নভেম্বরে লেখা আরেকটি চিঠিতে কবিতাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। ভূমেন্দ্র গুহ জানিয়েছেন, ‘কবিতাগুলি সব ফেরৎ এসেছিল।’ প্রত্যাহারের জন্য লেখা চিঠিতে যে তিনটি প্রেমের কবিতার নামোল্লেখ করেছিলেন জীবনানন্দ সেগুলো হলো ‘সে’, ‘তোমাকে’ এবং ‘তোমাকে ভালোবেসে’। দেখা যাচ্ছে ‘দেশ’ ২১ আশ্বিন ১৩৬১ সংখ্যায় ‘সে’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছিল। ‘তোমাকে ভালবেসে’ মুদ্রিত হয়েছিল ১৩৬১’র শারদীয় ‘দেশ’-এ।

‘দেশ’ পত্রিকায় জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশ শুরু হয়েছিল সম্ভবত ১৩৫৪’র শারদীয় দেশ-এ ‘কার্তিক অঘ্রান ১৯৪৬’ (‘পাহাড় আকাশ জল অনন্ত প্রান্তর ...’) কবিতাটি মুদ্রণের মধ্য দিয়ে। এরপর ১৩৫৮‘র শারদীয় দেশ, দেশ-এর মাঘ ১৩৫৮ সংখ্যা, ১৩৫৯’র শারদীয় দেশ, দেশ-এর ২ আশ্বিন ১৩৬০ সংখ্যা সহ জীবনানন্দের জীবদ্দশায় সর্বমোট ১১-১২টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বলে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রে হিসাব পাওয়া যায়। ‘দেশ’ পত্রিকার ২১ আশ্বিন ১৩৬১ সংখ্যায় প্রকাশিত গীতিময় কবিতাটি নি¤œরূপ:

সে

আমাকে সে নিয়েছিল ডেকে;

বলেছিল: ‘এ নদীর জল

তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল;

সব ক্লান্তি বিহ্বলতা থেকে

স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি

এই নদী তুমি।’

 

‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’

মাছরাঙাদের বললাম;

গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিল নাম

জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে

কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে!

 

সময়ের অবিরল শাদা আর কালো

বুনোনির ফাঁক থেকে এসে

মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে

ঢের আগে নারী এক —তবু চোখ ঝলসানো আলো

ভালোবেসে ষোলআনা নাগরিক যদি

না হয়ে বরং হত ধানসিঁড়ি নদী!

কৌতূহলী পাঠকের জন্য উপস্থিত কয়েকটি তথ্য সংযোজন করা যেতে পারে। প্রথমত, সাগরময় ঘোষের জন্ম ১৯১২-তে। সাহিত্য-সংস্কৃতিভিত্তিক ‘দেশ’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয় ১৯৩৩-এ, প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২৪শে নভেম্বর শুক্রবার। আনন্দবাজার গ্রুপের এ পত্রিকার জন্য সাগরময় ঘোষ ১৯৩৯-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার পুরোদস্তুর সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন ১৯৭৬-এ। ১৯৯৯-এ মৃত্যুর কিছু পূর্বে, ১৯৯৭-এ তিনি ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

 

৫। গোপাল ভৌমিককে লেখা চিঠি

জীবনানন্দ দাশ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ রাখতেন। কেউ চিঠি লিখলে বা নিজের বই-পত্র পাঠালে জবাব দিতেন। ১৯৪৩-১৯৪৬ পর্বে মাসিক মাতৃভূমি এবং দৈনিক কৃষক পত্রিকার সম্পাদক গোপাল ভৌমিকের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের পত্রবিনিময় হয়েছিল। গোপাল ভৌমিককে লেখা একটি চিঠি প্রভাতকুমার দাস তাঁর ‘পত্রালাপ’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। জীবনানন্দের ‘আলোকপত্র’ (‘হে নদী আকাশ মেঘ পাহাড় বনানী ...’ ) কবিতাটি ১৩৫৬’র শারদীয় কৃষকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সূত্রে জীবনানন্দ ওই চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘শারদীয় ‘কৃষক’ পত্রিকা এখনও পাই নি। আমার কবিতাটি যথাসময়ে পেয়েছিলেন কিনা জানি না। কবিতাটি বেরিয়ে থাকলে উক্ত সংখ্যার ‘কৃষক’ ও এজন্য যে সম্মানমূল্যে ধার্য হয়েছিল তা আমার নিম্নোক্ত কলকাতার ঠিকানায় পাঠাবার নির্দেশ দিলে খুশি হব।’ এর বেশ কয়েক বছর আগে মাসিক মাতৃভূমির জন্য জীবনানন্দ দাশের কবিতা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন গোপাল ভৌমিক। সহসা রাজি হন নি জীবনানন্দ। জীবনানন্দের উত্তরটি ছিল নিম্নরূপ:

সর্বানন্দ ভবন
বরিশাল

২৪.০৭.১৯৪৩

 

প্রীতিভাজনেষু,

যথাসময়ে আপনার চিঠি পেয়ে খুশি হয়েছি। উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। ক্ষমা করবেন।

আপনার কবিতা আমি মাঝে মাঝে পড়ে প্রীত হয়েছি। আষাঢ় সংখ্যার মাতৃভূমি পেয়েছিলাম। চিদানন্দ দাশগুপ্ত কখন সে মঞ্জুর কবিতা নিয়ে গিয়েছিল আমি তা জানি না।

মাতৃভূমি’র জন্য কবিতা চেয়েছেন। প্রায় বছর দুই হল আমি বিশেষ কিছুই লিখছি না। আপনার কথা আমার মনে রইল। লিখে উঠতে পারলে কবিতা পাঠাব। মাঝে মাঝে মাতৃভূমি পড়বার সুযোগ পেলে খুশি হব। পত্রিকাটি আমার ভালো লেগেছে।

আমার কবিতার ওপরে সঞ্জয়বাবু যে (আলোচনা) লিখেছেন তাতে তাঁর বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। আর [অস্পষ্ট] সাহায্য পেয়ে আমি আনন্দিত হয়েছি

আশা করি ভালো আছেন।

                প্রীতি নমস্কার। ইতি

                জীবনানন্দ দাশ

 

এ চিঠি পাওয়ার পর থেকে গোপাল ভৌমিক নিয়মিত ‘মাসিক মাতৃভূমি’ পাঠাতেন জীবনানন্দকে। চিঠি থেকে আরেকটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে আর তা হলো কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী (জন্ম: ১৯৩১) কৈশোরে কবিতা লিখতেন। সম্ভবত একটি কবিতা চিদানন্দ দাশগুপ্ত গোপাল ভৌমিককে সংগ্রহ করে দিলে তা মাসিক মাতৃভূমিতে মুদ্রিত হয়েছিল। চিদানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন জীবনানন্দ’র ডগা কাকার জামাতা।

উপর্যুক্ত চিঠিতে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘প্রায় বছর দুই হল আমি বিশেষ কিছুই লিখছি না।’— কিন্তু এ কথা একেবারেই ঠিক নয়। ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে জীবনানন্দের যে ৪৮টি কবিতার খাতা আছে সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় ১৯৪০-১৯৪৩ পর্বে অন্তত ১০-১২টি কবিতার খাতায় শত-শত কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ (খাতা নং ২৫ থেকে ৩৬)। অনুমান করা চলে জীবনানন্দ অনুরুদ্ধ হলেই যে-কোনো পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপতে দিতেন না। ‘মাসিক মাতৃভূমি’ তাঁর কবিতার জন্য উপযুক্ত ছিল কি না এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন না বলেই ওই কথা লিখে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ১৯৪৮-এ দিনপঞ্জীতে একাধিকবার ‘মাসিক মাতৃভূমি’তে কবিতা পাঠাবেন বলে লিখেছিলেন জীবনানন্দ; শেষ পর্যন্ত পাঠান নি।

 

৬. শিবনারায়ণ রায়কে লেখা চিঠি                  

জরুরি 

১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড

কলকাতা ২৬

১১.১২.৫২

প্রীতিভাজনেষু

শিবনারায়ণ বাবু, ‘উত্তরসূরী’র যে সংখ্যায় আমার ‘যাত্রা’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে ব’লে শুনেছি তা আজ পর্যন্ত পেলাম না। আপনি দয়া ক’রে অবিলম্বেই আমার ওপরের ঠিকানায় পত্রিকাটি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলে খুশি হব। প্রীতি নমস্কার।

ইতি
জীবনানন্দ দাশ

 

‘উত্তরসূরী’র ১৩৫৯ আশ্বিন সংখ্যায় সম্পাদক শিবনারায়ণ রায় ‘যাত্রা’ কবিতাটি (কত দিন হয়ে গেল, কত বার কাঁচা ধান কার্তিকের সূর্য্যে গেল পেকে) প্রকাশ করেছিলেন। সম্ভবত ‘উত্তরসূরী’তে এটিই জীবনানন্দের প্রথম কবিতা প্রকাশ।

 

৭. লীলা রায়কে লেখা চিঠি

২০-২২.৮.১৯৫৪’র পূর্বে লেখা

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

আপনার দুটো চিঠিই যথসময়ে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়েছি। আমার শরীর অসুস্থ ছিল—অন্য নানা ব্যাপারেও বড় বিব্রত ছিলাম; আপনার চিঠির উত্তর লিখতে খুব দেরী হয়ে গেল। সে জন্যে অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করবেন।

আপনি আমাদের দেশে আধুনিক কালের একজন শ্রেষ্ঠ মহিলা প্রধান নেত্রী। আপনাকে আমি অনেক দিন থেকে মনে মনে গভীরভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা ক’রে আসছি। আমি একান্তভাবে আশা করি আপনার ব্যক্তিত্বের নবীন ও নবনবীন বিশ্বাসে দেশ ও মানুষ নানা ভাবে সার্থকতা লাভ করবার সুযোগ পাবে। শারদীয় ‘জয়শ্রী’র জন্য একটি কবিতা পাঠালাম। আপনার পত্রিকার জন্য যে ধরনের কবিতা পাঠালে মন চরিতার্থ বোধ করতে পারবে সে জাতীয় কবিতা সম্প্রতি আমার হাতে নেই বলে নৈষ্ফল্য (?) বোধ করছি। ‘জয়শ্রী’র উন্নতি কামনা করি।

আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানাচ্ছি।

ইতি,
জীবনানন্দ দাশ

১৩৬১’র শারদীয় জয়শ্রীতে জীবনানন্দ দাশের ‘লক্ষ্য’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছিল। কবি কবিতাটি সম্পর্র্কে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমরা তা পড়ে দেখতে পারি:

 

লক্ষ্য

এখানে অর্জুন ঝাউয়ে যদিও সন্ধ্যার চিল ফিরে আসে ঘরে

যেতে আর সাধ নেই পৃথিবীর ঘরের ভেতরে।

একে একে নক্ষত্রেরা দেখা দেয়—লিচু গাছে পেঁচা নেমে আসে;

গোরুর গাড়ির ঘুণ্টি সাড়া দিয়ে চলে যায় সন্ধ্যার বাতাসে;

আস্তে যাচ্ছে গাড়ি আকাশ প্রান্তর ভেঙে মৃদু বাতি নিয়ে—

চুপে চুপে কুয়াশায় যাচ্ছে মিলিয়ে;

সোনালী খড়ের বোঝা বুকে তার—মুখে তার শান্ত অন্ধকার;

ভালো; তবু আরো কিছু চাই আজ পৃথিবীর দুঃসহ ভার

বইবার প্রয়োজনে; তবুও মানবজাতি রক্তস্রোতে বারবার শক্তিশালী নদী

না হয়ে এ স্নিগ্ধ রাত্রি—শান্তি পথ হয়ে যেত যদি।

এই স্বাদু, মৃদু কবিতাটি জীবনানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘আলোপৃথিবী’ কাব্যসংকলনে গৃহীত হয়েছিল। ‘আলোপৃথিবী’ জীবনানন্দের ৬১টি কবিতার সংকলন। ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে এর প্রথম প্রকাশ। প্রকাশক আনন্দরূপ চক্রবর্তী গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড। অশোকানন্দ দাশ এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন।

৮. বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি   

 মে বা জুন ১৯৫১

বিনোদ দা

আপনার চিঠি পেয়েছি।

আমি অনেকদিন কলকাতায় অনুপস্থিত থাকার দরুণ খানিকটা গোলমাল হয়ে গেছে। আপনার গল্প আমি ‘নির্ণয়’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী অমিয় গাঙ্গুলিকে দিয়েছিলাম ও খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আপনার গল্প আগামী সংখ্যায় (এ সংখ্যায় নয়) যাচ্ছে। আমি কলকাতায় থাকলে অমিয়কে কিংবা ‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকার লোকদের বলে এই সংখ্যায়ই আপনার গল্প ছাপাবার ব্যবস্থা করতে পারতাম। দেরি হল বলে আশা করি কিছু মনে করবেন না। আমি খুব সম্ভব আজ কি কাল কলকাতায় যাব। পূজোর ছুটিতে আপনি কলকাতায় থাকবেন? দেখা করব। আশা করি ভাল আছেন। ভালবাসা জানাচ্ছি।

ইতি—

এই চিঠিটির সঙ্গে অমিয়কুমার গঙ্গোপাধ্যায়কে ১৭.১০.৫০ তারিখে লেখা একটি চিঠির সম্পর্ক আছে। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘... অধ্যাপক বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পটা আগামী মাসের ‘নির্ণয়ে’ যাবে লিখেছিলেন—আমিও ওঁকে সেই কথাটা জানিয়ে দিয়েছি।’ ‘নির্ণয়’ পত্রিকাটি অমিয়কুমার গঙ্গোপাধ্যায় অক্টোবর ১৯৫০ থেকে ছয় মাস সম্পাদনা করেছিলেন।

অমলেন্দু দাশের দীর্ঘ চিঠিটি পাঠ করতে আমাদের প্রায় এক মাস সময় লেগেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্রেফ অনুমান ও যুক্তিসঙ্গত কল্পনার ওপর ভিত্তি করে সঠিক পাঠোদ্ধারের কাজটি করতে হয়েছে। অমলেন্দু দাশকে লেখা আরও কয়েকটি চিঠির পাঠোদ্ধার অসম্ভব বলে আর মনে হচ্ছে না।

অশোকানন্দকে লেখা অনেক চিঠির একটিরও পাঠোদ্ধার সম্ভব হলো না, এই দুঃখ থেকে গেল। আমরা ভবিষ্যতে আরেক দফা চেষ্টা করে দেখব যদি সামান্যও সম্ভব হয়। কবির ভ্রাতৃজায়া নলিনি চক্রবর্তী (নিনি) ১৯৫৩তে লেখা চিঠির (‘শতদ্রু নদীটা কেমন দেখলে?’) অনেকাংশের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলেও একটি বোধগম্য রচনা গেঁথে তোলা সম্ভব হচ্ছিল না বলে প্রচুর শ্রম ও সময় ব্যয় সত্ত্বেও শেষবেলায় এসে আপাতত পরিত্যাগ করতে হলো।

জীবনানন্দের লেখা চিঠিগুলো কেবল তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব অনুধাবনে সাহায্য করবে তা নয়। আমাদের বিশ্বাস এই চিঠিগুলোতে প্রাপ্য তথ্যকণিকা তৎকালীন সময় ও সমাজকে বুঝতে সাহায্য করবে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.