৯০-এ জহির রায়হান

৯০-এ জহির রায়হান

চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম স্রষ্টা জহির রায়হানের জন্মদিন ছিল ১৯ আগস্ট। বেঁচে থাকলে তিনি নব্বই বছরে পা রাখতেন।

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীর মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৃত নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। বাল্যকালে ডাকনাম ছিল জাফর। ‘রায়হান’ নামটি দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কিংবদন্তি নেতা মনি সিংহ—যা ছিল রাজনৈতিক নাম। 

স্বাধীনতা পূর্বকালের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মেধাসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই মূলধারার একেবারে বাইরে গিয়ে তার পক্ষে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হয় নি। কিন্তু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের বুকে তিনি অক্ষয় চিহ্ন রেখে গেছেন। তিনিই দেশের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন। প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’র নির্মাতাও তিনি। এমনকি রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন প্রথম চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র নির্মাতাও তিনি। কম সময়ে এবং কম বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণের দৃষ্টান্তও তিনি রেখে গেছেন।
 
জহির রায়হান চলচ্চিত্রের সাথে প্রথম জড়িত হন ১৯৫৭ সালে, এ জে কারদারের সহকারি হিসেবে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (‘পদ্মা নদীর মাঝি’র চলচ্চিত্র রূপ) ছবিতে। এ ছাড়া এহেতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ এবং সালাউদ্দিনের ‘যে নদী মরুপথে’ ছবির সাথেও যুক্ত ছিলেন। 

পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের আত্মপ্রকাশ ‘কখনো আসে নি’ (১৯৬১) ছবির মাধ্যমে। এখানে নিম্নমধ্যবিত্তের দুঃখ-কষ্ট এবং সংকট তুলে ধরা হয়েছে। অর্থ যে সবকিছুর চালিকা শক্তি এই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন চলচ্চিত্রকার। নির্মাণে পরিচ্ছন্নতা ছিল, চলচ্চিত্র-ভাষা প্রয়োগের চেষ্টা ছিল। 

জহির রায়হান এগারো বছরের চলচ্চিত্রজীবনে আটটি কাহিনিচিত্র ও দুটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে: কখনো আসেনি (১৯৬১), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), আনোয়ারা (১৯৬৪), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), স্টপ জেনোসোইড (প্রামাণ্যচিত্র, ১৯৭১) প্রভৃতি। 

জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে জীবনকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে দেশের আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে জীবনবাদী চলচ্চিত্র নির্মাণ (‘কখনো আসে নি’ থেকে ‘কাঁচের দেয়াল’), দ্বিতীয় পর্বে চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে উর্দু ও লোক ছবি নির্মাণ (‘সঙ্গম’ থেকে ‘বেহুলা’) এবং তৃতীয় পর্বে সাহিত্যের চলচ্চিত্ররূপ এবং রাজনীতি সম্পৃক্ত ছবি নির্মাণ (‘আনোয়ারা’ থেকে ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’)। 

জহির রায়হানের প্রথম পর্বের ছবিতে, কখনো আসে নি, কাঁচের দেয়াল-এ, নিম্নমধ্যবিত্তের সংকটকে উপস্থাপনা করা হয়েছে। প্রথম ছবিতে সংকটের পুনরাবৃত্তি এবং দ্বিতীয় ছবিতে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত রয়েছে। 

‘কখনো আসে নি’ (১৯৬১) ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩)—এই দুটি ছবিতেই জহির রায়হানের ব্যাষ্টিক দর্শন কাজ করেছে, বৃহত্তর সমাজের বিশ্লেষণ এখানে নেই। 

দ্বিতীয় পর্বের ছবিতে যদিও জহির রায়হান বাণিজ্যিক ছবির আবহাওয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন, কিন্তু তারপরও নিজের স্বাতন্ত্র্য ঠিকই বজায় রেখেছেন। ‘সঙ্গম’ (উর্দু, ১৯৬৪) বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের প্রথম রঙিন ছবি এবং ‘বাহানা’ (উর্দু, ১৯৬৫) প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি। লোকগাঁথাভিত্তিক ‘বেহুলা’ স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়। জহির রায়হানের বুদ্ধিমত্তায় ‘বেহুলা’কে দর্শকরা আপনজনের মতো করে দেখতে পেরেছে। নির্মাণে যে পরিচ্ছন্নতা এবং সংগীতের যে মাধুর্য (সংগীত পরিচালনা আলতাফ মাহমুদ) ছবিতে রয়েছে, তা এই ছবিকে দর্শকপ্রিয় করেছে। 

তৃতীয় পর্বে সাহিত্যের চলচ্চিত্র রূপায়ণে এবং রাজনীতি সম্পৃক্ত ছবি নির্মাণে জহির রায়হান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। ‘আনোয়ারা’ জহির রায়হানের চলচ্চিত্র পর্বে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করতে পারে শুধু সাহিত্যকর্মের চিত্ররূপ হিসেবে নয়, চলচ্চিত্র ভাষার সংযত ও পরিশীলিত ব্যবহারেও। এ সময়েই দেশীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে জহির রায়হানের নির্মাণ করেছেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। এ ছবির মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম রাজনৈতিক জীবন স্থান পেল। খোলাখুলি রাজনৈতিক বক্তব্য, পূর্ব বাংলার স্বাধিকার, জনগণের সংগ্রাম কিছুটা প্রতীকীভাবে ‘জীবন থেকে নেয়া’য় ধরা পড়ল। একটি সংসারের মাধ্যমে দেশীয় রাজনীতির চিত্র উপস্থাপন করা হলো। জহির রায়হানের যে লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রকে জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা- সেই লক্ষ্য অনেকটা পূর্ণ হয়েছে। 

জহির রায়হানের চলচ্চিত্রজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) নির্মাণ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ ছবি স্মরণীয় চলচ্চিত্রকর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির একটি মহাকাব্যিক বিস্তার আছে। অত্যন্ত নির্মোহভাবে বিবেচনা করেও ছবিটির যে বৈশিষ্ট্যকে অগ্রাহ্য করা যায় না তা হলো এর সময় এবং স্থানকে অতিক্রম করার ক্ষমতা। ‘স্টপ জেনোসাইডে’র দৃশ্যাবলি, মানুষের নির্মম অত্যাচারের দলিল চিত্রগুলি হতে পারে যে-কোনো কালের এবং যে-কোনো দেশের। এই বৈশিষ্ট্যটি এমনিতেই একটি শিল্পকে মহত্ত্বের মর্যাদা দেয়, ‘স্টপ জেনোসাইড’ সেই সাথে এক অনন্য চলচ্চিত্র, তার ভাষায় এবং আঙ্গিকে। 

সাহিত্য ক্ষেত্রেও জহির রায়হানের অবদান অসমান্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হাজার বছর ধরে (১৯৬৪), আরেক ফাল্গুন (১৯৬৯), বরফ গলা নদী (১৯৬৯)। ‘হাজার বছর ধরে’-তে আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনধারা নান্দনিকভাবে পরিস্ফুটিত। ‘আরেক ফাল্গুন’-এ মূর্ত হয়ে উঠেছে দেশের বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলন। অন্যদিকে ‘বরফ গলা নদী’ হলো অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাথা। 

জহির রায়হানের অন্য উপন্যাসগুলো হলো- শেষ বিকেলের মেয়ে, কয়েকটি মৃত্যু, তৃষ্ণা।  এ ছাড়া তিনি কয়েকটি সার্থক ছোটগল্পেরও স্রষ্টা।    
জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে মিরপুর গিয়ে আর ফিরে আসেন নি। সম্প্রতি এ বিষয়ের ওপর নতুন করে আলো ফেলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, জহির রায়হান হলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বুদ্ধিজীবী, যাঁকে গুম করা হয়েছিল। কারণ হলো, ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকার প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জহির রায়হান ঘোষণা দিয়েছিলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনে নীলনকশা উদ্ঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক গোপন ঘটনার নথিপত্র, প্রামাণ্য দলিল তাঁর কাছে আছে, যা প্রকাশ করলে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই নেওয়া অনেক নেতার কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেছিলেন, ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার প্রেস ক্লাবেই তিনি ফিল্ম শো করে প্রমাণ করে দেবেন কার কী চরিত্র ছিল। কিন্তু সেইসব মানুষের মুখোশ জহির রায়হান আর উন্মোচন করতে পারেন নি। ৩০ জানুয়ারিতেই তিনি গুম হন। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.